#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:৪৩
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষেধ]
সমুদ্রের কন্ঠেসর ব্যতিক্রম!এক অদ্ভুত চাহনি, এককথাই তীর্যক চাহনি নিক্ষেপ করে রয়েছে মেহেরের মুখশ্রীতে। যার ফলে মেহের অযথাই থরথর করে কাঁপছে ! তার মনে হচ্ছে সমুদ্র তার বলা প্রতিটি বাক্য আড়াল থেকে শুনেছে। সমুদ্র খানিকটা এগিয়ে এলো মেহেরের নিকটবর্তী! মেহের সঙ্গে সঙ্গে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেললো। সে পারল না সমুদ্রের তীর্যক চাহনি সহ্য করতে। তৎক্ষণাৎ সমুদ্র অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো,
–আমার পুচকি সবকিছু বুঝে। কিন্তু আমাকে বুঝে না। আচ্ছা পুচকি, এর শাস্তি আমি আপনাকে এখন দিতে চাচ্ছি। আপনি প্রস্তুত তো!
কথাটা বলে সমুদ্র পা জোড়া সংকুচিত করল মেহেরের নিকটবর্তী। কিন্তু তৎক্ষণাৎ পিছন হতে ভেসে উঠলো হাফসার জড়তা মাখা কন্ঠস্বর,
— সমুদ্র! কেমন আছো ?
সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র পিছন ফিরে হাফসার মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত আবদ্ধ করল। অতঃপর খানিকটা এগিয়ে এসে গম্ভীর কন্ঠে হাফসার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
–গুড। বাট তুমি ঠিক নেই! ইউ নো ,ফায়াজ আমাকে তোমার আচরণের ব্যাপারে ইনফরমেশন দিয়েছে।
সমুদ্রের কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেললো হাফসা। ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে মিনমিন কন্ঠে বলল,
— সত্যিই বলছি সমুদ্র আমি এখন অনুতপ্ত। সেদিন আমি বুঝতে পারি নি আমার বলা সমান্য কথাটুকু, আমাকে এতোবড় বিপদের মুখে ফেলবে। আমি ক্রোধের আগুনে ভুলে বলে ফেলেছিলাম, আম্মুকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে। বিলিভ মি, আমি ইচ্ছে করে বলি নি।
হাফসার কথার প্রেক্ষিতে সমুদ্র কর্কশ গলায় বলে উঠলো,
–আই থিংক, ফায়াজের উচিত তোমাকে ডিভর্স দেওয়া। উল্টো তুমি ডিভর্সের জন্য লয়ার খুঁজচ্ছ!
সমুদ্রের কথার প্রত্ত্যতুরে হাফসা মাথা নিচু করে নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে রইলো। সমুদ্র হাফসাকে উপেক্ষা করে সোফায় উপর গিয়ে আয়েশ ভঙ্গিতে বসল। ফির বলে উঠলো,
–ফায়াজ তোমাকে কতোটা ভালোবাসে তা সম্পর্কে কম বেশি সবাই জানে। একটা সময় আমাদের সামনে ছেলেটা পাগলামি করতো তোমার জন্য। কিন্তু তার প্রতিদানে তুমি কি করলে! তোমার শাশুড়িকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে বললে। তুমি কি জানো বাক্যটা শুনতে ছোট হলেই এর ওজন সুউঁচু পাহাড়ের চেয়ে দ্বিগুণ। একজন আদর্শ সন্তানের কাছে কতোটা মারাত্মক! তোমার আচরণ যে এতোটা বাজে, আই কান্ট বিলিভ ।
সমুদ্র কথাগুলো বলে তপ্ত শ্বাস ত্যাগ করলো। হাফসা তার বেসফেন্ড না ফলেই তাদের বন্ধুত্ব বেশ ভালো। হাফসার স্বামী ফাজায় ব্যাপক সম্মান করে সমুদ্রকে। হাফসার বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও ফায়াজ সমুদ্রকে স্যার বলে সম্বোধন করে। বেশ ভালো সম্পর্ক তাদের। তাই হাফসার কৃতকর্ম সমুদ্রের অজানা নয়। বর্তমানে মেহের অবাক চাহনিতে হাফসার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এবং মনোযোগ সহকারে সমুদ্রের কথাগুলো শুনছে। অন্যদিকে হাফসা নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। লহমায় সমুদ্র ফির বলে উঠলো ,
–ফায়াজের পরিবার যদি তোমার সঙ্গে অন্যায় অত্যাচার করতো। তাহলে আমি নিজে এর শাস্তির ব্যবস্থা করতাম। কিন্তু বর্তমানে আমার দৃষ্টিতে তুমি একজন অপরাধী। আচ্ছা তুমি কি একবার ও ভেবে দেখেছ ভবিষ্যতে তোমার পরিনাম কি হবে। তুমি নিজেও তো সন্তানের মা হবে। তখন তোমার এই সুঠোম দেহে বয়সের ভাঁজ ফুটে উঠবে। এখন যে শক্তি, গলার জোরে কথা বলছো না, তা নিঃশেষ হয়ে যাবে একদিন। ঠিক সেদিন যদি তোমার সন্তান তোমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে তাহলে তোমার অবস্থা কতোটা বেদনা দায়ক হবে, ভেবে দেখেছ কি? পারবে সেদিন পরিবারহীনা বসবাস করতে?
সমুদ্রের কথা শুনে হাফসা চোখের জল মুছে কাঁপা কাঁপা গলায় আকুতি মিনতি সহিত বলে উঠলো,
–এমন কথা বলো না সমুদ্র। এমনটা আমি চাই না। বিশ্বাস করো আমি এখন অনুতপ্ত। নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি।
হাফসার কথার প্রেক্ষিতে সমুদ্র তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহকারে বলে উঠলো,
–কর্ম তার ফল সঠিক সময়ে দিতে একদমই ভুলে না। তুমি যে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছ এতেই অনেক। আশা করে এখন থেকে ভেবে চিন্তে কথা বলবে। সবসময়ই মনে রাখবে ধারালো ছুরির আঘাতে শরীর ক্ষত বিক্ষত করলে তা সময়ে তালে তালে দেহের সঙ্গে মিশে যায়। কিন্তু মুখ হতে নির্গত একটি ধারোল ব্যাকের আঘাত কখনোই অন্তরের সৃষ্ট ক্ষতের দাগ মুছে ফেলতে পারে না। তার অদৃশ্য চিহ্ন কোথাও না কোথাও থেকে যায়।
কথাগুলো বলেই মেহেরের মুখশ্রীতে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সমুদ্র। সে নিজ কৃতকর্ম বেশ অনুতপ্ত! এতোক্ষণ সমুদ্রের কথাগুলো মনোযোগের সহিত শুনছিল মেহের। হঠাৎ সমুদ্রের এমন অসহায় দৃষ্টি দেখে তার বক্ষ পিঞ্জরের হৃদয় স্পন্দন অবাধ্য হয়ে উঠেছে।
লহমায় সমুদ্র নিজকে ঠিক করে, হাফসাকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
–বাই দা ওয়ে। এই টপিক বাদ দেও। আই হোপ, আমাদের সঙ্গে লান্চ করবে তুমি। তারপর নাহয় যাবে।
তৎক্ষণাৎ হাফসার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠলো। মুহূর্তেই চোখের জল মুছে মেহেরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সে। অতঃপর সমুদ্রকে জিজ্ঞাসা করল,
–এই বুড়িটা কে? এতোক্ষণ কথা বললাম তাও ওর নাম কী অজানা রয়ে গেলো। বাচ্চা ছোট হলেও বেশ বুদ্ধিমতি। আমার মনে হয় ওর সঙ্গে কথা না হলে আমার মাইন্ডটা কখনোই চেঞ্জ হতো না। আন্টিকে দেখেছি বাট মেয়েটাকে তো আগে কখনোই দেখিনি। তোমার বোন বুঝি?
হাফসার কথাগুলো শুনে সমুদ্রের কপালে বিরক্তের সুক্ষ্ম ভাঁজের রেখা দেখা দিলো। মুহূর্তেই তার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলে উঠলো,
–সি ইজ মাই ওয়াইফ। আন্ডারস্টান্ড?
সমুদ্রের কথা শুনে সেকেন্ড পাঁচেক অবাকের সহিত থতমত হয়ে রইলো হাফসা। ফির মুচকি হেসে বলল,
–আই কান্ট বিলিভ! বাট সমুদ্র ইউ আর সো লাকি। এমন সুন্দরী, বুদ্ধিমতি রমনীকে ওয়াইফ হিসেবে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তুমি যেমন তোমার ওয়াইফ ও ঠিক তেমন।
কথাগুলো বলে মেহেরের নিকটবর্তী এলো হাফসা। মেহেরের হাত জোড়া আগলে ধরে ভালোবাসা পরশ এঁকে দিলো মেহেরের হাত যুগলে। হাল্কা হেসে দিয়ে বলল,
–ধন্যবাদ বুড়ি! ভালো থেকো। আজ বরং আসি। তোমার কথাগুলো আমার সবসময়ই মনে থাকবে। ধন্যবাদ। খুব শীঘ্রই ফায়াজকে নিয়ে তোমাদের বাসায় বেড়াতে আসব। লাভ ইউ বুড়ি।
কথাগুলো প্রেক্ষিতে মেহের এক চিলতে হাসি উপহার দিলো হাফসাকে। প্রত্ত্যতুরে মেহের বলল,
–আপু দুপুরে খেয়ে গেলে ভালো হতো।
–না গো বুড়ি। আজ নয়।
______
মিনিট পাঁচেক পূর্বে সমুদ্রের ফ্লাট থেকে বিদায় নিয়েছে হাফসা। যাওয়ার পূর্বে এমন কিছু কথা বলে গিয়েছে সে,যার ফলস্বরূপ মেহেরের গাল যুগল এখন অবধি রক্তিম বর্ণ ধারণ করে রয়েছে। মেহেরের পরিস্থিতি দেখে বেশ বিরক্ত সমুদ্র। তার ঠোঁটের কোণে হাসির চিটে ফোঁটাও নেই। মুখশ্রীতে গম্ভীর ভাব স্পষ্ট! হঠাৎ সমুদ্র বলে উঠলো,
— ওভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন,পুচকি? অনেক বেলা হয়েছে। দ্রুত খেতে এসো। খানিক বাদেই তোমার হোম টিউটর আসবে।
তৎক্ষণাৎ মেহেরের মুখশ্রীতে একরাশ ভয়ের আবির্ভাব ঘটলো। হঠাৎ সমুদ্রের ধমকের শুনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে সে। তার মনে প্রশ্ন জাগছে, সমুদ্র একজন ভালো শিক্ষক হয়েও কেন তাকে টিচার হিসেবে পড়াতে চাচ্ছে না। সে তো পারতো তাকে পড়াতে! অবশেষে দ্রুত চেয়ার টেনে বসে পড়লো মেহের। সমুদ্র দু প্লেটে খাবার বেড়ে দিলো। মেহেরের প্লেটটা সম্পন্ন খাবার দ্বারা ভর্তি করে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
–ফিনিস ইট। একটা দানাও যেন অবশিষ্ট না থাকে। এটাই তোমার শাস্তি। বড়ো মানুষের মতো কথা বলবে কিন্তু খাবে ছোট বাচ্চাদের মতো। তা তো হবে না।
খাবারের প্লেটের দিকে লক্ষ্য করতে শুকনো ঢোক গিলল মেহের। ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে মিনমিন কন্ঠে বলে উঠলো,
–এতো খাবার কি করে খাব!
সমুদ্র মেহেরের কথার জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করলো না। বেন্ডজকৃত ডান হাত টেবিলের উপর রেখে বা হাতের সাহায্যে চামচ দিয়ে খাবার মুখে দেবার প্রয়াস চালালো। সমুদ্রের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে মেহের নিজ অজান্তেই বলে উঠলো,
–আমি খাইয়ে দেই?
মেহের কথার প্রত্ত্যতুরে ইগোর সহিত বলে উঠলো,
–না। লাগবে না। আমি কোন পুচকির হাতে খাব না। সমাজে আমার একটা রিপুটেশন রয়েছে।
সমুদ্রের কথাই নিশ্চুপ হয়ে রইলো মেহের। মুহূর্তেই সমুদ্র তীর্যক চাহনি নিক্ষেপ করলো মেহেরের মুখশ্রীতে। অতঃপর ফিসফিস করে বলে উঠলো,
–না খেলে বড়ো হবে কী করে! হুম? তোমাকে যে খুব শীঘ্রই বড়ো হতে হবে। তুমি কি বুঝো না কেউ তোমার বড়ো হবার অপেক্ষায় চাকত পাখির ন্যায় বসে রয়েছে। সে যে তোমার বড়ো হবার অপেক্ষায় প্রতিক্ষণ ছটফট করে মরে যাচ্ছে।
সমুদ্রের বলা বাক্য গুলো কর্ণপাত হতেই মেহেরের অন্তরে ঝড় হাওয়া বইতে আরম্ভ করেছে। এই নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশেও থরথর করে কাঁপছে সে। খুব অস্বস্তি বোধ হচ্ছে তার! সমুদ্রের কন্ঠেসরে যে অসাহায়ত্ব ফুটে উঠেছে।
______
ঘড়ির কাঁটাতে ছুঁই ছুঁই তিনটা। প্রাইভেট টিচারের সামনে মাথা নিচু করে বসে রয়েছে মেহের। সমুদ্র একই রুমের বেলকনিতে বসে প্রকৃতি বিশাল করতে ব্যস্ত। অবশ্য প্রকৃতি বিলাসের সঙ্গে কারো সঙ্গে কথা বলছে। এককথাই মেহেরের উপর তার কোন লক্ষ নেই। শিক্ষক মেহেরকে কীভাবে পড়াচ্ছে তা তার নিকট অজানা। লোকটা কিছুদিন পূর্বে মেডিকেল প্রথম পর্যায় সমাপ্তি ঘটিয়ে বর্তমানে ইন্টানি করেছে। সমুদ্রের সঙ্গে লোকটার ভীষণ ভালো সম্পর্ক।
—-
বেশ মার্জিত ভাবে পরিপাটি হয়ে টিচারের মুখমুখি বসে রয়েছে মেহের। ওড়না যেন এলোমেলো না হয় তাই আলপিন দিয়ে বেঁধে নিয়েছে। খানিক সময় অতিবাহিত হয়েছে কিন্তু টিচার এবং স্টুডেন্ট কারো মুখেও কোন কথা। লোকটা বারংবার আড়চোখে মেহেরকে পর্যবেক্ষণ করছে। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে লোকটা বলে উঠলো,
–আমি সাফাত। তোমার নাম কি?
মেহের শিক্ষকের জবাবে নিম্ন কন্ঠে বলল,
–মেহের ।
–বাহ সুন্দর নাম তো! নাও এবার এ্যাট ফাস্ট বায়োলজি বই বের করো। বিকস আমার ফেবারিট সাবজেক্ট এটা। আমি তোমাকে শুধু মাত্র সাইন্সের সাবজেক্ট গুলো পড়াব। সমুদ্র স্যার আপতত শুধু মাত্র সাইন্সের সাবজেক্ট গুলো পড়াতে বলেছে। আজ থেকে আমারা মন দিয়ে পড়ালেখা করবো। লেইট হয়ে যাচ্ছে। বই বের করো।
শিক্ষকের কথাই মেহের মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। অতঃপর পড়তে আরম্ভ করলো।
___________
প্রায় মিনিট দশেক ধরে রাফুকে কল দিচ্ছে জারা। তার আজ জানতেই হবে বর্ষণের সমন্ধে। এতো দিন বর্ষণের সমন্ধে জানতে চাই নি সে। কিন্তু আজ তার ভীষণ ভয় হচ্ছে। তার বর্ষণ তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা কেন করলো তা আজ তার জানতেই হবে। ইয়াদ ইসরার বেগমের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। কিন্তু বরবর জারাকে উপেক্ষা করে। সবকিছুই মিলিয়ে জারার মস্তিষ্কের বিপাক পরিস্থিতি। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে সে। আজ সে বর্ষণের ব্যাপারে ইনফরমেশন নিবে। বর্ষণের দেওয়া কিছু স্মিতি বাসা থেকে নিয়ে এসেছিল সে। বর্তমানে সেগুলো বিছানায় উপর ছরিয়ে ছিটিয়ে রয়েছে! রহস্য উন্মোচন করতে বারংবার রাফুকে কল দিচ্ছে কিন্তু রাফু ফোন ধরছে না। অবশেষে একপর্যায়ে রাফুকে আর কল করলো না। সিদ্ধান্ত নিলো বর্ষণের নম্বরে কল করবে। আজ সে পুরোনো সব হিসেব নিকেশ করবে। আজ বর্ষণের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আজ সে দুঃখ প্রকাশ করবে ধরনীর বুকে।
পরিশেষে কম্পমান আঙুলের স্পর্শে বর্ষণের নম্বরে কল দিলো সে। তার হাত পা প্রচন্ড কাঁপছে। বক্ষ পিঞ্জরের হৃদয় স্পন্দন তড়িৎ বেগে ছুটতে! তার মনে হচ্ছে একটু পরেই নিঃশ্বাস আটকে মারা যাবে সে। অবশেষে কানের নিকটবর্তী ফোন নিলো। শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে ঠিক করে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে রিনিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফোন রিসিভ করল কেউ। তৎক্ষণাৎ জারা ঠোঁট যুগল প্রসারিত করে অস্ফুটে স্বরে কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠলো,
–হ্যা,,লো,,,
(চলবে)
#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:৪৪
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষেধ]
পরিশেষে কম্পমান আঙুলের স্পর্শে বর্ষণের নম্বরে কল দিলো সে। তার হাত পা প্রচন্ড কাঁপছে। বক্ষ পিঞ্জরের হৃদয় স্পন্দন তড়িৎ বেগে ছুটতে! তার মনে হচ্ছে একটু পরেই নিঃশ্বাস আটকে মারা যাবে সে। অবশেষে কানের নিকটবর্তী ফোন নিলো। শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে ঠিক করে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে রিনিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফোন রিসিভ করল কেউ। তৎক্ষণাৎ জারা ঠোঁট যুগল প্রসারিত করে অস্ফুটে স্বরে কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠলো,
–হ্যা,,লো,,,
ওপার হতে কারো কন্ঠস্বর আভাস পেলো না জারা। তার হাত পা ব্যাপকভাবে কাঁপছে! শরীর শীতল হয়ে এসেছে। শরীর স্বাভাবিক রাখার প্রয়াসে ওষ্ঠ জোড়া দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরলো সে। কিন্তু তাতেও কম্পন থামার নাম গন্ধ নেই। প্রায় সেকেন্ড পাঁচেক নিরবতা পালন করলো ফোনের দু পাশে থাকা দু জন ব্যক্তি। একপর্যায়ে জারা অনুভব করতে পারল তার বর্ষণের ত্যাগ কৃত নিশ্বাস। দু জন মানবীর নিশ্বাশ ভারী হয়ে এসেছে! হঠাৎ ফোনের ওপাশ ওপাশ থেকে ভারী কন্ঠে উত্তর এলো।
— কেমন আছেন মিসেস ইয়াদ?
প্রচন্ড ঝাঁজালো কন্ঠস্বর। যে কন্ঠস্বর হতে নির্গত প্রতিটি বাক্যে মিশে রয়েছে একরাশ ঘৃণা। জারার উপর প্রচন্ড ঘৃণা জমে রয়েছে ব্যক্তিটার হৃদয় গহীনে। বাক্যটা জারার কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্র, গাল ভাসিয়ে দু ফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য টপটপ করে বিসর্জন হলো। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ হতে ফির বর্ষণ বলে উঠলো,
–আপনি তো ভালোই আছেন। থাকবেন না কেন, আপনার পুরোনো প্রেমিক যে আপনার কাছে ফিরে এসেছে। থার্ড ক্লাস গ্যাল! লজ্জা করে একসঙ্গে তিনজন ছেলের জীবন নিয়ে খেলতে?
অতিরিক্ত ক্রোধের সহিত কতগুলো অনর্গল বললো বর্ষণ। মুহূর্তেই জারা অবাকের চরমে পৌঁছে গেলো। বিশ্বাস হচ্ছে না, বর্ষণের বলা কথাগুলো। জীবনে তার বড্ড অভিপ্রায় ছিলো একবার হলেও বর্ষণের কন্ঠস্বর কর্ণপাত করার। আজ প্রায় তিন বছরের অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। সে আজ প্রথম বারের মতো বর্ষণের কন্ঠস্বর শুনলো। এতে তো তার আনন্দিত হবার কথা। কিন্তু সে আনন্দিত নয় বরং বড্ড ব্যথিত! লোকটা যে তার সঙ্গে উপেক্ষা কৃত কন্ঠে কথা বলছে। শুধু উপেক্ষা নয় তার উপর মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছে। যেখানে জারা নিজে অভিযোগ প্রদান করবে সেখানে তার উল্টোটা দৃশ্যমান হচ্ছে। জারা চালেও এর প্রতিবাদ করতে সক্ষম হচ্ছে না। তার গলা আটকে এসেছে। শত চেষ্টা করেও মুখশ্রী হতে একটি বাক্য ও নির্গত করতে পারছে না। শুধু মাত্র তার চোখের জল বাধাহীন অবাধ্য হয়ে গড়িয়ে পড়ছে। কয়েক মিনিটের মাঝেই জারার চোখ যুগল জলে ভর্তি হয়ে উঠেছে। ঝাপসা হয়ে এসেছে তার দৃষ্টি শক্তি। অতঃপর বর্ষণের বলতে লাগল,
–জানো জেবু, আমার না ঘৃণা হয় নিজের উপর। দুনিয়ারতে কী মেয়ের অভাব ছিলো। আল্লাহ কেন তোমার সঙ্গে আমার যোগাযোগ সৃষ্টি করলো? কেন তোমার মতো ছলনা ময় নারীর প্রেমে পড়ালো? কেন আমার জীবনেও প্রেম কলঙ্কের গোটা গোটা দাগ তৈরি করে দিলো? তুমি একজন বিশ্বাস ঘাতক। জানো,আমার অন্তরালে বারংবার বলে তুমি একজন খুনি। খুনির তো শাস্তি পাওয়া উচিত। কিন্তু আমি কীভাবে তোমার শাস্তির ব্যবস্থা করবো, বলো তো? যে মেয়েটা আমার হৃদয় ধারাল ছুড়ি দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করেছে আমার হৃদয়ের পুরোটা জায়গা জুড়ে। তাকে আমি কী করে শাস্তি দেবো! আমি যে নিরুপায়। এই ধরনীর বুকে এমন কোন বিচার প্রতি নেই যে কিনা তার শাস্তির ব্যাবস্থা করে দিবে। কেউ নেই। সবাই আমাকে মিথ্যেবাদী বলবে। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না।
কথাগুলো একবারে বলেই জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো বর্ষণ। তার নিঃশ্বাসের পরিমাণ মাত্রার অধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। খানিক স্তব্ধতা পালন করলো তারা। জারা চোখ বুজে কান্না করছে অবিরাম! কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না। বর্তমানে বাক প্রতিবন্ধী তালিকায় নাম লিখিয়েছে সে। অবশেষে ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে বর্ষণ ঘৃণা ভরা কন্ঠে পুরনায় বলতে লাগলো,
— এই মেয়ে কোন কথা বলছো না কেন? তোমার কাছে আমার জবাব চাই। আমার প্রশ্নের উত্তর দেও। তুমি আমাকে ঠকিয়েছো মেনে নিলাম। নিজ প্রেমিককে ধোঁকা দিয়েছো তাও মেনে নিলাম। কিন্তু তাই বলে ইয়াদের ঘাড়ে চাপলে কেন? ও কী করেছিল? বেচারা তো নিরপরাধ। ওকে কেন বিয়ে করলে? কেন ওর সারাটা জীবন ধ্বংস করে দিলে? আনসার মি,,,, হেই স্টুপিড গ্যাল আনসার মি?
আর সহ্য করতে পারলো না জারা। তার উদ্দেশ্যে ছিলো সে হাজারো কৈফিয়ত চাইবে, বর্ষণের নামক ব্যক্তির নিকট। কিন্তু এ বর্ষণ তো তাকেই বিশ্বাস ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করলো! তাহলে কী তার অতীতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল? লহমায় জারার হাত থেকে মোবাইল ফোনটা ধপাস করে আছড়ে পড়লো মেঝেতে। একপায়ে ফোন ধরার শক্তি হারিয়ে বসলো। মুহূর্তেই দিশেহারা হয়ে মেঝেতে বসে পড়লো সে। পরিশেষে চোখ মেলে অনুভূতিহীন নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেঝেতে।
——————
ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমের এক কোণে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রয়েছেন শোয়াইব খান। চোখ জোড়া বন্ধ করে রেখেছেন তিনি। অসম্ভব হয়ে উঠেছে তার অন্তরাল! পুরোনো অতীত যেন স্পষ্ট ভেসে উঠছে তার চোখের পাতায়। মেহেরকে দেখার পর থেকে তার রাতে নিদ্রা হারাম হয়ে গেছে। মেহেরকে দেখার পর থেকেই তার অন্তরে ভীষণ অদ্ভুত অনুভূতির জাগ্রত হয়েছে। অচেনা একটা মেয়েকে একটিবার দেখেই অদৃশ্য মায়ায় আবদ্ধ হয়ে পড়েছে সে। তার মনে হচ্ছে আবার যদি মেয়েটাকে দেখতে পেতো সে! তার আফসোস হচ্ছে বারবার। ইশ, যদি মেয়েটার সঙ্গে সেদিন সে কথা বলতে পারতো। কেন কর্ণপাত না সেদিন মেয়েটার কন্ঠস্বর। কেন সেদিন তোতা পাখিটার সঙ্গে কিছুটা সময় পার করলো না? তিনি আনমনে মেহেরকে তোতো পাখির নামে ভূষিত করেছেন। কেন করছেন তাও তার নিকট অজানা। মেয়েটার চেহারার সঙ্গে তার খুব কাছের মানুষের প্রতিচ্ছবি রয়েছে। প্রায় বছর ষোলোক পূর্বে যে নারীর সঙ্গে ছলনায় মত্ত ছিল সে। যাকে দিশেহারা করে, একা ফেলে চলে এসেছেন তিনি। সে অবলা নারীর প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে মেহেরের মুখশ্রী! এ যেন তার স্ত্রী কল্পনার অবিকল রূপ। এতে করে নিজের উপর অত্যধিক বিরক্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। তার মনে আবার মায়া দয়া উদয় হলো কবে? সে তো নির্দয় ,কঠোর মনের ব্যক্তি। তার হৃদয় যে বিন্দু পরিমাণে ও মায়া দয়া ছিলো না। তাহলে কেন মেহেরকে দেখে দুর্বল হয়ে পড়েছে সে। বিশ্বাস ঘাতকদের ও বুঝি আত্মগ্লানি হয়!
চেয়ার থেকে লহমায় উঠে দাঁড়ালেন শোয়াইব খান। তৎক্ষণাৎ দ্রুত জানালার সামনে থেকে পর্দা সরিয়ে সারা ঘর আলোকিত করে তুললেন। নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধে পেরে না উঠে ,অবশেষে পুরনো অতীত ঘাটাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। টেবিলের গোপন ড্রয়ার থেকে ডায়রি বের করলেন। মেহেরের সম্পন্ন তথ্য কালেক্ট করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তিনি। আজ যে করেই হোক মেহেরের সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য সংগ্রহ না করে শান্ত হবেন না তিনি। সে উদ্দেশ্যে ফোনটা হাতে নিয়ে কাউকে কল করলেন।
—————–
অবসন্ন বিকেল। ঘড়ির কাঁটাতে ছুঁই ছুঁই পাঁচটা। সাফাত স্যার বিদায় নিয়েছেন খানিকক্ষণ পূর্বে। সমুদ্র এখন অবধি বেলকনিতে অবস্থান করছে। এতোক্ষণ কাজে ব্যস্ত ছিলো সে। কিন্তু বর্তমানে মেহেরকে কর্মে ব্যস্ত করে প্রকৃতি বিশাল করতে মেতে উঠেছে সে। স্যার প্রস্হান করার সঙ্গে সঙ্গেই মেহের কে কফি তৈরি করতে নিয়োজিত করেছে সমুদ্র। এর পিছনে অবশ্য তার একটা উদ্ভুদ উদ্দেশ্যে রয়েছে। সে চাই কফি দেবার জন্যে অবশ্যই বেলকনিতে আসতে বাধ্য। এতে করে কিছুটা মুহূর্তে একসাথে অতিবাহিত করতে পারবে। ভেবেই মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠলো সমুদ্রের ঠোঁটের কোণে।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই মাথা নিচু করে বেলকনিতে প্রবেশ করলো মেহের। সমুদ্রের নিকটবর্তী হলেই যে তার বড্ড ভয় হয়। অযথাই একরাশ অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরে। ভীতি গ্রস্ত মুখশ্রী নিয়ে সমুদ্র সামনে কফির মগটা ধরলো মেহের। তৎক্ষণাৎ মেহেরের হাত থেকে কফির মগটা হাতে নিয়ে চুমুক দিলো সমুদ্র। এক চুমুক দিয়ে অতঃপর গম্ভীর কন্ঠে বলল,
— আই হোপ তোমার নিউ টিচার বেশ ভালোই পড়ান। তারপরেও পড়া না বুঝলে অবশ্যই আমাকে ইনফর করবে। অন্ডারস্টান্ড!
সমুদ্রের বলা বাক্যের প্রত্ত্যতুরে মেহের দ্রুত বলে উঠলো,
— আচ্ছা। আমি তাহলে এখন আসি।
বলেই এক পা স্বল্প প্রসারিত করলো মেহের। কিন্তু পা যুগল ধাবিত করার পূর্বে সমুদ্র শীতল কন্ঠে বলে উঠলো,
— কোথাও যাওয়া হবে না আপনার। আপনি এখন এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন। আমি না বলা পর্যন্ত এক আপনার পা যেন না নড়ে। ইটস মাই ওডার।
তৎক্ষণাৎ থতমত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মেহের। সমুদ্র কেন বুঝে না তার শুধু মাত্র আপনি বলে সম্বোধন মেহেরকে অস্থির করে তুলে। মেহেরের হৃদয় স্পন্দন দ্বিগুণ করে তুলে! অদ্ভুত রহস্যময় অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরে। শুধু মাত্র সমুদ্রের বলা একটি মাত্র শব্দে! তাও কেন যে সমুদ্র বারংবার তাকে বিভ্রান্তে ফেলে।
কফির মগটা পাশ্ববর্তী রেখে মেহেরের মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত আবদ্ধ করলো সমুদ্র। মুহূর্তেই ভ্রু কুঁচকে বলল,
–কুল পুচকি। আমি কী বাগ না ভাল্লুক!
সমুদ্রের উত্তরে মেহের ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে নিম্ন কন্ঠে মিনমিন করে বলে উঠলো,
— না না। আমি ঠিক আছি তো।
মেহেরের উত্তর পেয়ে সমুদ্র হঠাৎ বলে উঠলো,
–তাই? ওকে, নাও আই নিড প্রুভ। সো ওড়নাটা খুলো তো!কুইক,,
(চলবে)