#তোমাতে_আসক্ত_আমি
#ইরিন_নাজ
#পর্ব_৪৪
ঝুম বৃষ্টি নামতেই হুশ ফিরলো আরশির। অতীত বর্ণনায় এতোটাই মনোযোগী ছিলো আশেপাশের খেয়াল ছিলো না তার। আরশি দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে আবরারের হাত ধরে টা*ন*তে লাগলো। উ*ত্তে*জিত কণ্ঠে বললো,
— উঠুন এমপি সাহেব। দেখুন ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। রুমে চলুন। আরে উঠুন না…
আরশির টা*না*টা*নি তে দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আবরার। তবে রুমে ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা তার মধ্যে প্রকাশ পেলো না। আরশির অতি নিকটে এগিয়ে আসলো সে। আবরার কে এভাবে এগিয়ে আসতে দেখে ভ*ড়*কা*লো আরশি। পুনরায় রুমে ফিরে যাওয়ার জন্য তাড়া দেয়ার প্রয়াস করলো। কিন্তু তার পূর্বেই আবরারের শীতল হাত আরশির কপোল স্পর্শ করলো। আবরারের শীতল হাতের স্পর্শে শি*র*শি*র করে উঠলো আরশির সারা দেহ। নিমিষেই আঁখি জোড়া বু*জে আসলো তার। আবরার আরশির কপালে কপাল ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বললো,
— আজকের বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা তোমার সকল দুঃ*খ ক*ষ্ট ধু*য়ে মু*ছে নিয়ে যাক মিসেস অদ্ভুত চোখওয়ালি।
আরশির বন্ধ চোখ থেকে আরও কয়েক ফোঁটা উষ্ণ তরল গড়িয়ে বৃষ্টির জলের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেলো। আলতো হাসলো আরশি। প্রার্থনা করলো আবরারের কথাটাই যেনো ঠিক হয়। আজকের বৃষ্টি যেনো তার সকল দুঃ*খ ক*ষ্ট ধু*য়ে নিয়ে যায়। সে ভালো থাকতে চায়, তার সামনে দাঁড়ানো মানুষটার সাথে সারাজীবন সুখে থাকতে চায়, অনেক অনেক বছর বাঁচতে চায়। মানুষটার নিশ্চুপ ভালোবাসা শত সহস্র বছর উপভোগ করার তীব্র লো*ভ জাগ্রত হয়েছে তার ছোট্ট মনে।
—–
আরশি ভেজা পোশাক পাল্টে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখলো কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে আবরার। আবরার কে এভাবে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে শুয়ে থাকতে দেখে কপালে ভাঁ*জ পড়লো আরশির। সে দ্রুত আবরারের কাছে এগিয়ে গেলো। চি*ন্তি*ত কণ্ঠে শুধালো,
— আপনি ঠিক আছেন তো এমপি সাহেব? এভাবে মুড়ি দিয়েছেন কেনো?
আরশির আওয়াজ শুনে কম্বল থেকে চোখ বের করে উঁকি দিলো আবরার। বললো,
— আমি একদম ফিট আছি মিসেস অদ্ভুত চোখওয়ালি। ওই একটু ঠান্ডা লাগছিলো তাই এভাবে মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি।
স*ন্দি*হান চোখে চাইলো আরশি। কোমরে হাত রেখে শুধালো,
— সত্যিই ঠিক আছেন? তাহলে আপনার চোখ লাল হয়ে আছে কেনো?
থ*ত*ম*ত খেলো আবরার। নিজেকে সামলে দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
— ওই চোখে পানি গিয়ে লাল হয়ে গেছে হয়তো। এখন তুমি তোমার এই গোয়েন্দাগিরি অফ করো। আর লাইট টা নিভিয়ে ঘুমাতে এসো। অনেক রাত হয়ে গেছে।
আরশি ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। আসলেই অনেক রাত হয়ে গেছে। তাই সে চুল ভালো ভাবে মু*ছে লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো। আরশি শুতে না শুতেই আবরার ঝ*ট*ফ*ট এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। অবাক হলো না আরশি। এই কয়েকদিনে অভ্যাস হয়ে গেছে তার। কিছুক্ষন নীরবতায় কা*ট*লো। নীরবতা ভে*ঙে আবরার বলে উঠলো,
— ঘুমিয়ে গেছো মিসেস অদ্ভুত চোখওয়ালি?
আরশি শান্ত কণ্ঠে বললো,
— উহুম। কেনো কিছু বলবেন?
আবরার কোনোরকম ভ*নি*তা না করে জিজ্ঞাসা করলো,
— সব তো বললে কিন্তু রিফার ব্যাপারে কিছু বললে না যে…
হাসলো আরশি। বললো,
— রিফা আমার বোন কি করে এটাই জানতে চান তাই তো? রিফা আমার বোন এর বেশি কাউকে বলতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় ঐসব বললে ওকে পর করে দিচ্ছি। তাই রিফার ব্যাপারে কিছু বলি নি। তবে আজ যখন সব জানালাম তাহলে এটাও নাহয় জানিয়ে দেই। রিফা আমার র*ক্তে*র সম্পর্কের কেউ নয়। হঠাৎ করেই আমার জীবনে এসেছে ও। ওকে পাওয়া আমার সৌভাগ্য ছিলো। ছোটবেলা থেকেই শখ ছিলো একটা ছোট ভাই বা বোনের। কিন্তু আমার কোনো ভাই বা বোন ছিলো না। রিফা কে পাওয়ার পর আমার সেই শখ পূরণ হয়েছে। নতুন বাসায় উঠার ছয় মাস পরের ঘটনা। টিউশন পড়িয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। প্রায় সন্ধ্যা হতে চলেছে তখন। দ্রুত পায়ে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ রাস্তার সাইডের একটা বেঞ্চে চোখ যায়। দেখি আমার চেয়ে ছোট বা আমার বয়সী একটা মেয়ে বেঞ্চে বসে কাঁ*দ*ছে। হাতে কাপড়ের একটা ব্যাগ। দেখে শহরের মনে হলো না। মেয়েটা কে দেখে মায়া হলো আমার। কেনো যেনো ভীষণ টা*ন অনুভব করলাম। ধীর পায়ে মেয়েটার কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখলাম। মেয়ে টা অ*শ্রু*শি*ক্ত চোখে ভ*য়া*র্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলো। ইশ, কি মায়ায় জড়ানো ছোট্ট একটা মুখ মেয়েটার! আমি ওর চোখের পানি মু*ছি*য়ে জিজ্ঞাসা করলাম ও কাঁ*দ*ছে কেনো? জবাব দিলো না ও। আবার কাঁ*দ*তে লাগলো। আমি কোনো জবাব না পেয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলাম ও কোনো বি*প*দে পড়েছে কিনা! এবার মেয়ে টা মাথা ঝা*কি*য়ে বুঝালো ও বি*প*দে পড়েছে। আমি তৎক্ষণাৎ মেয়েটার কাছে ওর বাবা মায়ের নাম্বার চাইলাম। এবার প্রথম বারের মতো মুখ খুললো মেয়ে টা। কা*ন্না ভেজা কণ্ঠে জানালো ওর বাবা মা নেই। বুঝতে পারলাম ভালোই বি*প*দে পড়েছে মেয়ে টা। ওকে আমার সাথে আমাদের বাসায় নিয়ে যেতে চাইলাম। প্রথমে রাজী হচ্ছিলো না। ভ*য় পাচ্ছিলো। ওকে বুঝিয়ে বললাম আর কিছু সময় পর অন্ধকার হয়ে যাবে। রাতে এই রাস্তায় বসে থাকা ওর জন্য নিরাপদ নয়। এবার রাজী হলো ও। ওকে নিয়ে বাড়িতে আসলাম। ফ্রেশ হতে বলে নাস্তা রেডি করলাম। ফ্রেশ হয়ে আসলে যত্ন সহকারে খাবার খাওয়ালাম। এবার ওকে শান্ত দেখাচ্ছিল। হয়তো আমাকে একটু একটু বিশ্বাস করতে পারছিলো ও। তাই সুযোগ বুঝে জিজ্ঞাসা করলাম ও কে, কোথা থেকে এসেছে, কি হয়েছিল ওর সাথে, কেন কাঁ*দ*ছিলো রাস্তায় বসে। ও আমার দিকে কিছক্ষন গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলতে শুরু করে ওর নাম রিফা। কুমিল্লার একটা গ্রামে ওর বাসা। ওর বাসা বললে ভু*ল হবে। ওর মামা মামীর বাসায় থাকতো ও। দরিদ্র ঘরে জন্ম ওর। ওর আম্মু ওর জন্মের সময় মা*রা যান। আর ওর আব্বু, সে নাকি অতিরিক্ত নে*শা করতো। যার কারণে উনার ও মৃ*ত্যু ঘটে। তখন রিফার বয়স মাত্র পাঁচ কি ছয়। তারপর ওর জায়গা হয় ওর মামা মামীর বাসায়। রিফার মামা মামী ওর দায়িত্ব নিতে চাচ্ছিলো না। কিন্তু গ্রামের লোকেদের চা*পা*চা*পির কারণে বা*ধ্য হয় ওকে আশ্রয় দিতে। জো*র করে রিফার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তাই শুরু হয় রিফার উপর নি*র্যা*তন। বাড়ির সব কাজ ওকে দিয়ে করাতো। আর ভু*ল করলে প্রচুর মা*র*ধ*র করতো। রিফা আমাকে নিজের শরীরে থাকা দা*গ গুলোও দেখিয়েছিলো। মা*রে*র দা*গ দেখে কেঁ*পে উঠেছিলাম আমি। এভাবেই মামা মামীর বাড়িতে বড় হয় রিফা। আমার সাথে যখন ওর দেখা হয় তখন ওর বয়স পনেরো কি ষোলো। যাই হোক আমার সাথে দেখা হওয়ার তিন মাস আগে গ্রামে একটা শহুরে ছেলের সাথে পরিচয় হয় ওর। কাজ শেষে নিয়মিত পুকুর পাড়ে যেতো ও। সেখানেই দেখা হয়েছিল। রিফার মতে ছেলে টা বেশ ধনী পরিবারের ছিলো। প্রথমে কৌশলে ওর সাথে বন্ধুত্ব করে, ওর ক*ষ্টে*র কথা জানার পর ওকে শা*ন্ত*না দেয়। রিফাও ধীরে ধীরে ছেলেটা কে অনেক বিশ্বাস করতে শুরু করে। এরপর হুট করে একদিন ছেলে টা ওকে প্রপোজ করে, নিজের ভালোবাসার কথা জানায়। ওকে বিয়ে করবে বলে স্বপ্ন দেখায়। রিফা ও একটু ভালোবাসা পাবে বলে লো*ভে পড়ে যায়। তো রিফার মামা মামী কিভাবে যেনো ওই ছেলের সাথে রিফার সম্পর্কের কথা জেনে যায়। তারা রিফা কে আর ওই ছেলের সাথে সাক্ষাৎ করতে দেয় না। ওর মামা কোন এক বয়স্ক লোকের সাথে ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলে। এর পরিবর্তে উনার মোটা অংকের টাকা পাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু রিফা সেটা মানতে পারে নি। ও ততদিনে ওই ছেলেটার প্রতি অনেক দু*র্ব*ল হয়ে পড়েছিল। তাই ও রাতের অন্ধকারে লু*কি*য়ে ছেলেটার সাথে দেখা করে। ছেলে টা ওকে বলে পরদিন সকালে ওরা পা*লি*য়ে যাবে এখান থেকে। শহরে গিয়ে সে রিফা কে বিয়ে করবে। রিফা ও একটুখানি সুখের আশায় ওই ছেলেটার সাথে পা*লি*য়ে আসে। শহরে এসে বাসে ওঠার পর ও ছেলেটার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হুট করে ওর ঘুম ভে*ঙে যায়। ও শুনতে পায় ছেলে টা ফোনে কাউকে ধীর স্বরে বলছে,
“হ্যা, মেয়ে টা হেব্বি দেখতে। আমি ওকে নিয়ে আসছি। এই তো কাছাকাছি ই আছি। আজকে রাতে পার্টি হবে বন্ধু। তোরা সব রেডি থাক মজা নেয়ার জন্য।”
এইসব শোনার পর রিফা বুঝতে পেরে যায় তার সামনে বি*প*দ। এই ছেলে টা মোটেও তাকে ভালো উদ্দেশ্যে এখানে নিয়ে আসে নি আর না তাকে বিয়ে করবে। রিফার ভাবনার মাঝে বাস থামলে ছেলে টা রিফা কে নিয়ে নেমে পড়ে। রিফা এমন ভা*ন করে যেনো সে কিছু শুনে নি। কিছুদূর হাঁটার পর সে ছেলেটা কে বলে তার পানি পিপাসা লেগেছে, পানি এনে দিতে। ছেলে টা পানি আনতে গেলে পা*লা*য় রিফা। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে অনেক দূরে ওই রাস্তায় এসে পৌঁছায়। রাত থেকে না খাওয়ার কারণে আর শরীরে বল পাচ্ছিলো না ও। তাই ওখানে বসে ছিলো।
থামলো আরশি। আবরার জিজ্ঞাসা করলো,
— ওর মামা মামীর সাথে যোগাযোগ করো নি?
আরশি ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
— হু করেছিলাম। কিন্তু উনারা রিফা কে ফিরিয়ে নিতে না*রা*জ। বো*ঝা মাথা থেকে নেমেছে বলে কথা। আর তারা নিতে চাইলেও আমি ওই জা*হা*ন্না*মে ওকে আর যেতে দিতাম না। এরপর থেকে রিফা আমার কাছেই আছে। ওকে নিজের ছোট বোন বলে মেনে নিয়েছি। মেয়ে টা জীবনে অনেক ক*ষ্ট করেছে। আমি তো তাও জীবনের অনেকগুলো বছর বাবা মায়ের ভালোবাসা, আদর সব পেয়েছি। কিন্তু ও পায় নি। এমন কি মা বলে ডাকার সুযোগটাও পায় নি। তাই তো আমার মা কে মা বলে ডাকতে বলেছি। যাতে একটু হলেও মায়ের অভাব পূরণ হয়। চেয়েছিলাম ওকে একটা ভালো জীবন দিতে, ভালো রাখতে। কিন্তু পারি নি। এই দুনিয়ায় যে অর্থ ছাড়া মানুষ অচল। আর আমার অর্থের পরিমান ছিলো সীমিত।
আরশির হাত মুঠোয় পুরে নিলো আবরার। শান্ত স্বরে বললো,
— তুমি যা করেছো, তা কয়জন ই বা করতে পারে বলো তো! একটা বাইরের মেয়ে কে আশ্রয় দেয়া, নিজের বোনের আসনে বসানো, এতগুলো বছর ধরে আগলে রাখা এটা কি সবার পক্ষে সম্ভব? আমার মনে হয় না ও তোমার কাছে খা*রা*প ছিলো বরং ও তোমার কাছে অনেক সুখে ছিলো, ভালো ছিলো। একদিন নাহয় ওকেই জিজ্ঞাসা করে দেখো…
চোখ বন্ধ করে হাসলো আরশি। কিছুক্ষন নীরব থেকে বললো,
— আপনি তো এই সব কিছু আগে থেকেই জানতেন তাই না এমপি সাহেব?
চ*ম*কা*লো আবরার। আমতা আমতা করে বললো,
— আমি কিভাবে জানবো?
আরশির ঠোঁটের হাসি চ*ও*ড়া হলো। বললো,
— আপনি আমার ব্যাপারে অনেক কিছুই জানতেন এটা আমি জানি। তবুও কেনো আমার কাছ থেকে পুনরায় সব টা এতো মনোযোগ দিয়ে শুনলেন এমপি সাহেব?
ফোঁ*স করে নিঃশ্বাস ফেললো আবরার। আসলেই সে আরশির ব্যাপারে অনেক কিছুই জানতো। আর যতটুকু অজানা ছিলো তা আজ আরশি নিজেই বলেছে। আবরার ধীর আওয়াজে বললো,
— মানুষ নিজেদের একান্ত গো*প*নীয় কথাগুলো শুধুমাত্র নিজেদের অতি প্রিয় আপন জনদের নিকট ই ব্যক্ত করতে পারে। তারা সেই মানুষটা কে অনেক বেশি ভরসা করে। তাই তো নিজেদের কে সেই মানুষটার সামনে খোলা বইয়ের মতো উপস্থাপন করে। আমি সবসময় ই তোমার নিকট সেই অতি প্রিয় ভরসাযোগ্য মানুষ টা হতে চেয়েছিলাম। তাই তো সব টা জানার পরও তোমার মুখ থেকে আবারও সব টা শুনেছি। তোমার কাছ থেকে সব টা শুনে ভীষণ তৃপ্তি অনুভব করছিলাম জানো মিসেস অদ্ভুত চোখওয়ালি! তুমি যখন আমাকে সব টা জানাচ্ছিলে মনে হচ্ছিলো আমি বুঝি স্বার্থক।
আরশি ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় আবরারের চোখে চোখ রাখলো। গভীর দৃষ্টি তা*ক করে সরল ভঙ্গিতে বললো,
— আমি আজ আপনাকে সব কিছু কেনো বললাম জানেন এমপি সাহেব? কারণ আপনি আমার সেই অতি প্রিয় ভরসাযোগ্য একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষ। যার কাছে আমি নিজেকে খোলা বইয়ের মতো উপস্থাপন করতে চাই। যাকে আমি ভীষণ ভরসা করি, যার কাছে নিজেকে নিরাপদ ভাবি, যার কাছে সব শেয়ার করে এখন আমি ভীষণ হালকা অনুভব করছি। আপনিই সেই মানুষ টা। আমার একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষ।
কথা শেষ করে আবরারের বুকে মুখ গু*জ*লো আরশি। আরশি কে শ*ক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলো আবরার। চোখ মুখ চকচক করছে তার, ঠোঁট জুড়ে তৃপ্তির হাসি খেলা করছে। কানে বারংবার ধ্বনিত হচ্ছে, “আপনিই সেই মানুষ টা। আমার একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষ।”
চলবে,
#তোমাতে_আসক্ত_আমি
#ইরিন_নাজ
#পর্ব_৪৫
সকালে ঘুম ভা*ঙা*র পর আবরার কে আর খুঁজে পেলো না আরশি। বুঝতে পারলো আবরার চলে গেছে।বি*র*ক্তিতে কপাল কুঁ*চ*কে আসলো তার। লোক টা একদিন ও যাওয়ার আগে তাকে ডেকে দেয় না। রা*গে গ*জ*গ*জ করতে করতে ফ্রেশ হতে চলে গেলো সে।
—–
নাস্তা করে মিসেস বন্যার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ভার্সিটি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো আরশি। আজ থেকে ভার্সিটি তে যাবে সে। এমনিতেই অনেক বড় গ্যাপ গিয়েছে। যদিও প্রতিদিনের লেকচার আরশির বন্ধুরা পাঠিয়ে দিতো। অনেকদিন পর বন্ধুদের সাথে দেখা হবে। তাই ভীষণ ভীষণ খুশি আরশি।
ভার্সিটি তে পৌঁছে সোজা ক্যান্টিনে চলে গেলো আরশি। গিয়ে দেখলো তার বন্ধুরা আগে থেকেই বসে আছে। আরশি কে দেখে মোহনা চি*ৎ*কা*র করে বললো,
— দোস্তওওওওও তুই আইসোস!
মোহনার চি*ৎ*কা*রে কানে হাত দিলো সবাই। আবির মোহনার মাথায় চা*টি মে*রে বললো,
— চোখে কম দেখস নাকি তুই? ও আইছে বলেই তো দেখলি। আবার ষাঁড়ের মতো চি*ল্লা*য় জিজ্ঞাসা করিস কেন ও আইছে কিনা…
মাথায় চা*টি মা*রা*য় আর ষাঁড় বলায় রে*গে গেলো মোহনা। আবিরের চুল খা*ম*চে ধরে বললো,
— আমার গলা আমি চি*ল্লা*মু, তোর কি? তোর যদি এতোই স*ম*স্যা তো তুই যা গা এখান থিকা। কিন্তু আমারে মা*র*লি কেন? আজকে তোর সব চুল ছিঁ*ড়ে ফেলমু আবিরের বাচ্চা।
চুল জো*রে টা*ন দেয়ায় ব্য*থা*য় চোখ মুখ কুঁ*চ*কে আসলো আবিরের। সে ব্য*থা*তুর কণ্ঠে বললো,
— ছাড় আমার আম্মা। আর মা*র*মু না। আমি তো একটাই মা*র*লাম। আর তুই আমার কয়টা চুল ছিঁ*ড়*লি? ছাড় পে*ত্নী*র নানী দাদি।
পে*ত্নী*র নানী দাদি বলায় আরও শ*ক্ত করে আবিরের চুল টে*নে দিলো মোহনা। ক্যান্টিনের সবাই হা*ব*লার মতো তাকিয়ে আছে আবির আর মোহনার দিকে। আরশি অবস্থা বে*গ*তি*ক দেখে দ্রুত এগিয়ে এসে মোহনার হাত থেকে আবিরের চুল ছাড়ালো। মেকি রা*গ দেখিয়ে বললো,
— কত গুলো দিন পর আসলাম। কই একটু জড়িয়ে ধরবি, ভালো ম*ন্দ জিগাবি তা না তোরা দুইজন ঝ*গ*ড়া, মা*রা*মা*রি লাগাইছোস!
মুহূর্তেই আরশি কে ঝা*প্টে ধরলো মোহনা। আহ্লাদি কণ্ঠে বললো,
— সরি জানু। দেখ না সব এই আবিরের বাচ্চার জন্য হইছে। ওই আগে শুরু করছে। আমি তো ভালো একটা বাচ্চা তোরা তো সবাই জানিস ই!
মোহনার কথায় আবির বাদে সবাই ফিক করে হেসে দিলো। আরশি মোহনার গাল টে*নে বললো,
— সত্যিই বলসোস। তুই একটা বাচ্চা, ভালো বাচ্চা।
আরশির কথায় শব্দ করে হাসলো সবাই। যেনো কোনো জোক্স শুনলো তারা। আবির মুখ বাঁ*কা করে বললো,
— এই বুড়ি মাইয়া নাকি আবার বাচ্চা। শা*ক*চু*ন্নি কোথাকার।
আবার রে*গে গেলো মোহনা। দাঁ*তে দাঁ*ত চে*পে বললো,
— দেখলি এই আবিরের বাচ্চা আমাকে কি বললো? আমি নাকি শা*ক*চু*ন্নি? আবিরের বাচ্চা দেখে নিস তোর বউ হবে শা*ক*চু*ন্নি, মিলিয়ে নিস তুই।
আবির মাছি তা*ড়া*নোর ভঙ্গিমায় হাত নাড়িয়ে বললো,
— আরে যা যা। শ*কু*নের দোয়ায় গরু ম*রে না। হুহ।
মোহনা শ*য়*তা*নি হাসি দিয়ে বললো,
— তার মানে তুই স্বীকার করতেসোস তুই একটা গরু?
আবির ও ঠোঁট বা*কি*য়ে বললো,
— আমি গরু হলে তুই ও শ*কু*নি।
গাল ফু*লা*লো মোহনা। কথায় না পেরে চোখে পানি চলে আসতে চাইলো তার। আরশি পরিস্থিতি সামাল দিতে আদুরে কণ্ঠে মোহনা কে বললো,
— থাক ছুনা ক*ষ্ট পায় না, পিচ্চি বাবু টা। এই আবির একটা ব*দ, শ*য়*তা*ন। ওর কথা কানে নিবি না বুঝলি!
আরশি এভাবে বলায় মোহনা ও হেসে ফেললো। মাথা ঝাঁ*কি*য়ে ‘হ্যা’ বোঝালো। আরশির দৃষ্টি গেলো এবার মুন আর আহির দিকে। ওদের উদ্দেশ্য করে বললো,
— কিরে তোদের কি আলাদা করে নিমন্ত্রণ দিতে হবে। আয় এদিকে। কতদিন পর দেখা হলো।
মুন আর আহি যেনো এটারই অপেক্ষায় ছিলো। দুইজনই চেয়ার ছেড়ে উঠে আসলো। ঝা*প্টে ধরলো আরশি কে। রাহুল আবির কে খোঁ*চা দিয়ে বললো,
— আয় দোস্ত বুকে আয়। আমরা কেন বাদ যামু। ওরা ঝা*প্টা*ঝা*প্টি করতে পারলে আমরাও পারি। তাই না ক?
বি*র*ক্ত হলো আবির। রাহুলের হাতে এক ঘা বসিয়ে দিয়ে বললো,
— দূরে যা শা*লা। নিজের বউ রে গিয়ে জড়ায় ধর। যাহঃ…
রাহুল মুখ টা অন্ধকার করে বললো,
— আজ একটা বউ নাই বইলা…
আরশিরা সবাই নিজেদের চেয়ার দ*খ*ল করে বসে পড়লো। আহি রাহুল কে জিজ্ঞাসা করলো,
— কিরে মুখ টা এমন বানায় রাখসোস কেন?
রাহুল ঠোঁট উ*ল্টে বললো,
— ভাল্লাগে না আর এই ব*দ*না মার্কা জীবন। তুই আর আরু শ*লা*র ঝা*ড়ু দুইটা তো মিঙ্গেল হয়ে গেলি। আমি যে কবে মিঙ্গেল হমু রে…
আরশি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
— তোর তো আগে থেকে ঠিক। এতোই শখ হলে বিয়ে টা করে নে!
রাহুল গালে হাত ঠেকিয়ে বললো,
— সেই কপাল কি আর আছে? জ*ল্লা*দ মার্কা শ্বশুর আমার। বিয়ের প্রস্তাব পাঠাইলাম আব্বা আম্মা রে দিয়া। কিন্তু উনার এক কথা ছেলে মেয়ে দুইজন ই এখন ছোট। আরও বড় হোক। অনেক বুঝানোর পর আকদ টা করাতে রাজী হইছে কিন্তু সেটাও আমার অনার্স শেষ হওয়ার পর। আর আকদ হইলেও উনি মেয়ে দিবে না এখন। কি জ্বা*লা বল? বউ রে ঘরে তু*লতে তু*লতে তো আমি মনে হয় বুড়াই হইয়া যামু।
রাহুলের অবস্থা দেখে মুখ টি*পে হাসতে লাগলো সবাই। মোহনা দুঃ*খী দুঃ*খী কণ্ঠে বললো,
— তোর তো তাও বিয়া ঠিক। কিন্তু আমার? যাও একটা ক্রাশ ছিলো, সেই ক্রাশটারেও এই আরু, ঝা*ড়ু টা বিয়া কইরা নিলো। আর আমার আব্বা আম্মার ও মেয়ের বিয়া নিয়ে কোনোওওওও মাথা ব্য*থা নাই। সামনে পড়লেই বলবে “আম্মাজান ভালো মতো পড়াশোনা করেন। ফাইনালে যেনো রেজাল্ট ভালো হয়”। বলি আমার কি বিয়া সাদি হইবো না নাকি! সিঙ্গেল ই ম*র*তে হইবো মনে হয়!
মোহনার কথা শেষ হতেই শব্দ করে হেসে উঠলো সবাই। অনেকদিন পর সবাই এক জায়গায় হওয়ার ওদের বন্ধুমহলে যেনো প্রাণ ফিরে এসেছে। বেশ অনেক সময় নিয়ে গল্প করলো ওরা। ক্লাসের টাইম হয়ে এসেছে দেখে উঠে পড়লো সবাই। ক্লাসে যাওয়ার পথে হুট করে কল আসলো আরশির ফোনে। সে ফোন বের করে দেখলো রিফা কল দিচ্ছে। আরশি রিসিভ করে কথা বলতে বলতে আস্তে ধীরে যেতে লাগলো ক্লাসে। ততক্ষনে ওর ফ্রেন্ডরা বেশ দূরে চলে গেছে। আরশি কথা শেষে ফোন ব্যাগে ঢুকাচ্ছিলো এমন সময় কেউ একজন ধা*ক্কা দিলো তাকে। পড়তে পড়তে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিলো আরশি। তবে র*ক্ষা হলো না তার ফোনটার। রা*গ হলো আরশির। সেই ব্যক্তি কে কিছু ক*ড়া কথা শোনানোর জন্য পেছন ফিরে চাইলো। কিন্তু কে ধা*ক্কা দিয়েছে তা ঠাহর করতে পারলো না। অনেকেই ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে ছি*টি*য়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরশি বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করলো। কিন্তু কে এমন করেছে বুঝতে পারলো না। ক্লাস শুরু হতে আর বেশি সময় নেই। তাই আরশি সেই ব্যক্তিকে খোজা বাদ দিয়ে নিজের ফোন টা তু*লে উঠে দাঁড়াবে এমন সময় তার চোখ আ*ট*কে গেলো একটা ছোট্ট কাগজের টুকরোর উপর। তার পায়ের কাছেই পড়ে আছে। কিছু একটা লেখাও আছে কাগজে যা কিছু টা দেখা যাচ্ছে। কেমন যেনো স*ন্দে*হ হলো আরশির। সে আলতো হাতে কাগজ টা তু*লে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আগে নিজের ফোন টা চেক করলো। কিন্তু ফোনের তেমন কিছু হয় নি। গ্লাসে এক কোণে সামান্য ফা*ট*ল ধরেছে। তাই দেখে স্ব*স্তি*র নিঃশ্বাস ফেললো সে। ফোন টা কে ব্যাগে রেখে কাগজের টুকরো টা খুললো আরশি। কিন্তু কাজের টুকরোর লেখা টা পড়ে আশ্চর্যান্বিত হলো সে। নিঃশ্বাস যেনো বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো তার। কারণ কাগজের টুকরো তে গুটিগুটি অক্ষরে লেখা আছে “আরশি রহমান, যদি নিজের বাবার খু*নী কে তা জানতে চাও তবে নিচের নাম্বারে যোগাযোগ করবে। আর অবশ্যই সেটা গো*প*নে। কারণ তোমার আপন জনেরাই তোমার শ*ত্রু। ওরা যদি কোনোভাবে জেনে যায় তবে তোমাকেও বাঁচতে দেবে না আর আমিও বি*প*দে পড়বো।” এতটুকু লেখা আছে কাগজে। আর নিচে একটা নাম্বার ও দেয়া আছে। আরশি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কাগজের দিকে। সে জানতো তার বাবা খু*ন হয়েছে। সেটা নরমাল কোনো এ*ক্সি*ডে*ন্ট ছিলো না। কিন্তু এতো বছর পর কে সেই খু*নী*র খবর দিতে চাচ্ছে? কেনোই বা দিতে চাচ্ছে? এতো বছরে কেনো দেয় নি? সত্যিই তাকে তার বাবার খু*নী*র সন্ধান দেয়া হবে? নাকি এটা কোনো ষ*ড়*য*ন্ত্র? আর কিছু ভাবতে পারছে না আরশি। তার মাথায় কেমন যেনো য*ন্ত্র*না শুরু হয়েছে, মাথা ঝি*ম*ঝি*ম করছে। ক্লাসের কথা যেনো মাথা থেকে বেরিয়েই গেছে। সে সবসময় ই চাইতো নিজের বাবার খু*নী কে খুঁজে বের করতে, তাকে শা*স্তি দিতে। কিন্তু সেটা তার মতো সাধারণ একটা মেয়ের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। আরশি কি করবে বুঝতে পারছে না। কেউ ঘাড়ে হাত রাখায় চ*ম*কে উঠলো আরশি। দ্রুত কাগজের টুকরো টা হাতের মুঠোর মধ্যে পুরে নিলো। সামনে তাকিয়ে দেখলো আবির দাঁড়িয়ে আছে। আবির কপালে ভাঁ*জ ফেলে জিজ্ঞাসা করলো,
— কিরে কি হয়েছে? এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো আর এতো চ*ম*কা*লি ই বা কেনো? কোনো স*ম*স্যা? আমাকে বলতে পারিস।
আরশি হাসার চেষ্টা করে বললো,
— আরে না না, কোনো স*ম*স্যা নেই। ওই রিফা কল দিয়েছিলো। তাই কথা বলছিলাম ওর সাথে।
আবির কপালে হাত ঘ*ষে বললো,
— ওহঃ। আচ্ছা চল ক্লাসে যাই। ক্লাস তো শুরু হয়ে গেলো বলে।
আরশি মাথা ঝাঁ*কি*য়ে বললো,
— হ্যা, হ্যা চল…
ক্লাসে গিয়েও পড়ায় মন বসাতে পারলো না আরশি। সারাক্ষন তার মাথায় ওই লেখাগুলোই ঘুরেছে। আরশি কে যেটা সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে সেটা হলো, যে চিরকুট টা লিখেছে সে আরশি কে কারোর সাথে ব্যাপার টা শেয়ার করতে নিষেধ করেছে। এমন কি তার আপনজনেরা তার শ*ত্রু এমনটাও উল্লেখ করেছে। আরশি কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। একবার ভাবছে বাড়িতে গিয়েই আবরার কে সব টা জানাবে আবার ভাবছে জানানো ঠিক হবে কিনা!
চলবে,