#দোটানা ২
#লেখিকা_আরোহী_নুর
#পর্ব_৩১
হাসপাতালের প্রতিটা কর্ণ যেনো কেঁপে উঠছে আরুশির চিৎকারে।আয়ান স্যার আয়ান স্যার বলে বলে চিৎকার করছে আর কাঁদছে আরুশি,কেউ ওকে সামলাতে পারছে না,পাগলের মতো কান্না করছে আরুশি,এমারজেন্সিতে আয়ানের চিকিৎসা চলছে,বাইরে অপেক্ষারত অবস্থায় কান্নায় ভেঙে পড়েছে সবাই, এমনকি আয়ানের জন্য আজ সায়ানের চোখেও জল,দমে দমে আল্লাহর কাছে নিজের ভাইয়ের সুস্থতা কামনা করছে সায়ান,এদিকে আরুশির আয়ানের জন্য চিৎকার করে কাঁদাটাও মন পোড়াচ্ছে তার,আরুশি চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে।
আয়ান স্যার প্লিজ আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না,আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না,অভিমান করে চলে যাবেন না আমাকে ছেড়ে,প্লিজ।আরুশির প্রতিটা আর্তনাদ স্পষ্ট প্রমাণ করছে যে আয়ানকে ও কতোটা ভালোবাসে।এই ভালোবাসার সমতুল্য যে অন্য কিছু কখনো হতেই পারবে না,এই ভালোবাসার বন্ধন যে আরুশির নিশ্বাসের সাথে মিশে গেছে।তখন রাস্তায় এক্সিডেন্ট হলে আশপাশ থেকে অনেক লোক এগিয়ে আসে,যেহেতু আয়ান একজন সফল বিজনেসম্যান তাই শহরে ওর অনেক খ্যাতি,সে হিসেবে প্রায় অনেকেই ওকে চিনি,সেখানেও চেনা কিছু লোক থাকলে চৌধুরী ম্যানশনে ফোন করে বিষয়টা জানায় তারা আর আয়ানকে হাসপাতালেও নিয়ে যায়।খবরটা শোনার পর সবার যেনো প্রাণ বেড়িয়ে আসার উপক্রম হলো,সবাই ছোটে আসলো হাসপাতালে,ডাক্তার জানালেন আয়ানের অবস্থা বেশ ভালো না,উনারা উনাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্ঠা চালিয়ে যাবেন বাকিটা আল্লাহর হাতে,কথাগুলো শোনার পর আরুশি নিজের মধ্যে রইলো না,ভিতরে ধরা দিয়েছে আয়ানকে হারিয়ে ফেলার ভয়,বুক ফাঁটা আর্তনাদে ডাকছে আয়ানকে আর কাঁদছে,কথা সেই কবে কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে গেছে,বর্তমানে তাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রাখা হয়েছে।নিধী নামাযের রুমে আয়ানের জন্য নফল নামায পরে মোনাজাতে চোখের জল ত্যাগ করছে, সবার অবস্থায়ই নাজেহাল আয়ানের দুঃশ্চিতায়।অনেকক্ষণ পর ডাক্তার বেড়িয়ে বললেন এখন কিছু বলা যাবে না,উনারা আয়ানের প্রয়োজনীয় সার্জারী করতে পারলেও ওর অবস্থা সম্পর্কে এখন কিছু বলতে পারবেন না,আয়ানকে বর্তমানে আইসিইউতে সিফ্ট করা হচ্ছে, ৪৮ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে আয়ানকে আর বাঁচানো যাবে না।কথাটা শোনার পর নিধীও জ্ঞান হারায়।ওকেও চিকিৎসার আওতায় রাখা হয়।আজ কতোবছরে নামাযে বসেছে সায়ান সেই জানে না,কখনো নামাযে বসবে তাও আয়ানের প্রাণের ভিক্ষা আল্লাহর কাছে চাইতে তা হয়তো কখনো কল্পনাও করে নি সায়ান।তবে চাইলেও যে রক্তের বন্ধন সে ভাঙতে বা অবহেলা করতে পারবে না।মোনাজাত করতে গিয়ে সায়ানের চোখ দিয়েও বেড়িয়ে এলো আয়ানের জন্য অজোরে জল।মোনাজাতে আয়ানের প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে উঠে চলে যেতে নিলে পিছনে আরুশির আওয়াজ শুনতে পেলো।মোনাজাতে কান্নায় ভেঙে পরেছে আরুশি,অতি আবেগে সত্য জ্ঞান হয়তো তার লোপ পেয়েছে,তাই বেশ শব্দ করেই কাঁদছে আর বলছে।
আল্লাহ আমি উনার কাছ থেকে দূরে চলে যেতে চেয়েছি তবে এভাবে নয়।উনাকে আপনি আমার কাছ এভাবে কেঁড়ে নিবেন না দয়া করে।হয়তো দূরে থাকলেও সে আশ্বাসে বেঁচে থাকতে পারতাম যে ভালোবাসার মানুষটা ভালো আছে।উনার কিছু হয়ে গেলে যে আমি বাঁচতে পারবো না আল্লাহ।জীবন থেকে ১৯ টা বছর হারিয়েছি,পরিবার পরিজনের ভালোবাসা হারিয়েছি, হারিয়েছি প্রকৃত সুখ।আর হারাতে পারবো না আল্লাহ, উনাকে আপনি আমার কাছ থেকে কেরে নিবেন না।আমার স্যারকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন।আল্লাহ রহম করুন রাব্বুল আল-আমিন।
আরুশির কান্না সহ্য করতে না পেরে সায়ান আরুশির কাছে গেলো,ওর পাশে বসে ওর কাঁধে সহানুভূতির হাত রাখলে মোনাজাত শেষ করে পাশ ফিরে তাকালো আরুশি, সায়ানকে দেখে যেনো মনে জোর পেলো সে,ঝাপটে ধরলো সায়ানকে আর কান্নায় ভেঙে পরলো।
আয়ান স্যারের কিছু হবে না বলো না সায়ান?উনার কিছু হয়ে গেলে আমি থাকতে পারবো না।কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।বলো না উনার কিছু হবে না।
কথাগুলো তীরাঘাত সমতুল্য ব্যাথা দিচ্ছে সায়ানের বুকে,তবুও নিজের ব্যাথানুভাব একপাশ করলো সায়ান,সামলালো নিজেকে অতঃপর আরুশির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।
কিছুই হবে না আয়ানের।আল্লাহ ঠিকই ওকে আমাদের মধ্যে ফিরিয়ে দিবেন দেখে নিও।তারপর সায়ান আরুশিকে সেখান থেকে উঠিয়ে ওর চোখের জল মুছে দিলো অতঃপর আরুশি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠলে সায়ানের থেকে যথেষ্ট দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ালো,এরপর দুজনই সেখান থেকে প্রস্থান করলো।
আইসিইউ রুমের গ্লাস দিয়ে আয়ানকে দেখে যাচ্ছে আরুশি।চোখ দিয়ে জল নামা থামে নি। সায়ান অল্প দূর থেকে আয়ানের জন্য আরুশির অস্থিরতা দেখে যাচ্ছে অপলকে।বুকের অসীম ব্যাথা কোনোরুপ গায়ে মাখিয়ে নিতে চাইছে।নিজেকে স্বাভাবিক রাখছে অনেক কষ্টে।তখন আরুশির ধার ঘেষে দাঁড়ালো যায়ান। কান্নায় বসে যাওয়া স্বরে বললো।
জানো আপু যখন সায়ান ভাইয়া অসুস্থ ছিলো আর তুমি উনার জন্য অস্থির ছিলে তখন আয়ান ভাইয়া অনেক কষ্ট পেয়েছিলো,নিজেকে তোমার কাছে অনেক অপ্রিয় কেউ মনে হয়েছিলো উনার।সেদিন হাসপাতালের পিছনে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে অনেকক্ষণ উনাকে কান্না করতে দেখেছি আমি যে জায়গাতে জীবনের ১৭ টা বছরেও একবার ভাইয়াকে কাঁদতে দেখি নি।ভাইয়া তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসে আপু,আজ যদি তোমার উনার জন্য এই অস্থিরতা দেখতো তবে হয়তো নিজের এই অবস্থাকে স্বার্থকতা মনে করতো।
কথাগুলো বলে যায়ান কাঁদতে শুরু করলো,আরুশির কথাগুলো শুনে ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো আবারও শব্দ করে কেঁদে দিলো আরুশি।কেটে গেলো ২৪ ঘন্টা আয়ানের জ্ঞান ফিরার কোনো নাম নেই,ডাক্তারেরা প্রায় আশাহত,এদিকে সবাই আল্লাহর দরবারে হাত পেতে আছেন।দমে দমে আল্লাহকে ডাকছেন সবাই। নাওয়া খাওয়া বন্ধ সবারই।আরুশিকে আইসিইউ এর সামনে থেকে কেউ সরাতে পারছে না।অতঃপর ৩৭ ঘন্টা পর আল্লাহর রহমতে আয়ানের জ্ঞান ফিরলো,কিন্তু বর্তমানে কাউকে ওর সাথে দেখা করতে দেওয়া ঠিক হবে না ডাক্তার জানালেন কিন্তু জ্ঞান ফিরতেই আয়ান আরুশিকে দেখতে চাইলো তাই ডাক্তার ওকে আয়ানের পাশে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।
বর্তমানে আয়ানের পাশে বসে আছে আরুশি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে এদিকে নিজের চোখের জল এখন অব্দি শুকোয় নি তার।আয়ান এবার ধিমি কন্ঠে অনেক কষ্টে স্বর নিয়ে এসে বললো।
তুমি কোথায় চলে গেছিলে?তোমাকে ছাড়া যে বড্ড অসহায় লাগছিলো নিজেকে।তুমি ফিরে না আসলে যে নিজেকে শেষ করে দিতাম।
খবরদার যদি আবার এমনটা বলেছেন তো।আর কখনো কথাই বলবো না আমি আপনার সাথে।আর অনেক দূরে চলে যাবো।
আমাকে ছেড়ে কোথাও যেওয়া না কথা দিলাম আর কখনো মরার কথা বলবো না।
কখনোই যাবো না কোথাও আপনাকে ছেড়ে আমিও কথা দিলাম।তবে আপনি এখন কথা বলা বন্ধ করুন আর ঘুমানোর চেষ্টা করুন ডাক্তার আপনাকে অনেক রেস্ট করতে বলেছে।
সামনে নিজের প্রিয়সী বসে এভাবে কাঁদলে এই দু’চোখে ঘুম ধরা দিবে কি করে?তা আমার জন্য কান্না করছো বুঝি?
না আপনার জন্য কেনো করবো।ওই পাশের বাসার দাদুর জন্য কান্না করছি উনার উপর ক্রাস খেয়েছিলাম তো কিন্তু উনি উনার বুড়িকেই ভালোবাসেন আমাকে সাইড দেন নি তাই।
আরুশির কথা শুনে আলতো হাসলো আয়ান।
ইমোশনাল মুহুর্তেও মজা করতে ছাড়ো না তুমি না?চোখ মুছো নয়তো ভাঙা হাতে আমাকেই মুছতে হবে।
হয়েছে আর কষ্ট করতে হবে না আমার হাত আছে,হুহ।
কথাটা বলে আলতো হেসে চোখ মুছলো আরুশি।
এবার ঘুমোন।
আগে বলো পাশে থাকবে।
কোথায় যাবো না পাশেই থাকবো প্রমিজ।
অতঃপর আয়ানের মাথায় হাত বুলাতে লাগলো আরুশি আবার আর আয়ান আরুশির ওপর হাত ধরে ওর উপস্থিতি অনুভবে নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।কেবিনের দরজার কাচ দিয়ে বাইরে থেকে ভিতরের দৃশ্য দেখতে পেলো সায়ান,হৃদয়দহনের ব্যাথায় জল নামলো ওর নয়ন দিয়ে।
দুদিন পার হলো, আয়ান এখন বিপদমুক্ত ডাক্তার বলেছেন যথেষ্ট পরিচর্যার মাধ্যমে আয়ান খুব তাড়াতাড়ি সম্পুর্ন সুস্থ হয়ে যাবে। এদিকে আরুশি কোনো দিক ছাড়ছে না আয়ানের পরিচর্যায়। দুদিন ধরে আয়ানকে নিয়ে আরুশির ব্যস্ততা আর অস্থিরতা দেখে যাচ্ছে সায়ান,তবে সে যে ব্যার্থ,সয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই তার।হয়তো এটাই ওর নিয়তি।
আয়ানকে ওষুধ খাইয়ে আরুশি উঠতে নিলে আয়ান ওর হাত ধরে ফেলে যাতে আর উঠে যায় না আরুশি বরং অস্থির হয়ে বলে উঠে।
এসব কি করছেন আপনি?ক্ষত হাতে ধরছেন কেনো আমায়?ব্যাথা পাবেন তো।
পাশে বসো না কথা আছে।
কি কথা বলেন মি.স্যার?আলতো হেসে বললো আরুশি।
ভালোবাসি।
কথার জবাবে আরুশি নিরুত্তর রইলো মুখের হাসি মলিন করে।আয়ানের মুখে দুঃশ্চিতার প্রভাব আসলো।
কি হয়েছে আরুশি তুমি কিছু বললে না যে?ভালোবাসো না আমায়?
ভালোবাসি,নিজের প্রাণের চেয়েও অধিক,কিন্তু……
কিন্তু কি আরুশি?
সায়ানও আমায় ভালোবাসে,আমি ওর সামনে আপনার হয়ে কিভাবে থাকবো বলেন?চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষটাকে কি অন্যের সাথে মেনে নেওয়া সহজ মনে হয় আপনার কাছে?তাই আমি আপনাকে ভালোবাসলেও কখনো তা জীবনে মিলিয়ে নিয়ে এগুতে পারবো না এমনকি বিয়েও কখনো করতে পারবো না আপনাকে।নিজেদের সুখের জন্য সায়ানের বেঁচে থাকা তো আমরা মুশকিল করে দিতে পারি না।
কথাগুলো শুনে আয়ান কিছু বলবে এর আগেই সায়ান বলে উঠলো।
একদম তা নয় আরুশি।দেখো আমি তোমাকে ভালোবাসি এটা সত্য,আর সে সত্য মোতাবেক তুমি আমার সুখের জন্য নিজের সুখ ত্যাগ করতে যাচ্ছো।কিন্তু ভেবে দেখো আরুশি আমি কি তাতে আদোও সুখি হতে পারবো।তুমি যদি আয়ানের হও তবুও আমার কাছে আসবে না আর না হলেও আসবে না,এখানে তো সবদিকেই আমাকে না পাওয়ার ব্যাথা অনুভব করতে হবে তাই ব্যাথা যখন আমাকে সহ্য করতেই হবে তবে আমিই করি,না হয় না পাওয়ার ব্যাথার সাথে হারানোর ব্যাথাও উপভোগ করলাম।আমার কষ্টে তুমি লাঘব ঘটাতে পারবে না আরুশি সেই ক্ষমতা তোমার বা কারো নেই আল্লাহ ব্যতীত,তাই নিজেদের জীবন সুন্দর করে গুছিয়ে নাও এটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।আমাকে সুখ দিতে গিয়ে নিজেরা কষ্টে পোড়ো না।
কিন্তু সায়ান……
নো…..কোনো কিন্তু না, আয়ান ভালো হলেই তোমাদের বিয়ে হচ্ছে এটাই ফাইনাল।একফালি হাসি নিয়ে কথাটা বললো সায়ান।এবার আয়ানকে উদ্দেশ্য করে বললো।
ওই তুই আবার ভাবিস না আমি তোর কাছে হার মেনে গেছি।ওই তোর অবস্থা দেখে দয়া হলো তাই আরুশিকে দিয়ে দিলাম নয়তো তোর মতো ফালতুর কপালে আরুশি জুটতো না,বুঝেছিস ফালতু আয়ান।
তুই ফালতু সায়ান।
অতঃপর একটু থেমে দুজনেই একসাথে হেঁসে উঠলো।সায়ান এগিয়ে এসে আয়ানকে জরিয়ে ধরে বললো।
ভাই এই প্রথম বার বুঝতে পারলাম রক্তের টান আসলে কাকে বলে।দেখ না সারাজীবন তোকে ঘৃণা করে আসলেও যখন তোকে মরণাপন্ন অবস্থায় দেখলাম ভিতরটা মোচর দিয়ে উঠলো।মনে হলো এই যেনো প্রাণটা বেড়িয়ে যাবে।
আমারও ঠিক এমনটাই মনে হয়েছে যখন তুই অসুস্থ ছিলি।যাক অবশেষে আল্লাহ আমাদের একে অপরের প্রতি টানটা যে জাগিয়েছেন এটাই আলহামদুলিল্লাহ।
আলহামদুলিল্লাহ।
যাকগে,বর্তমানে তোরা রোমান্স কর আমি বরং আসি।
আরে ওমন কিছু না সায়ান তুমি বসো আমাদের পাশে।
আরে চান্স নাই আরুশি,কাবাবে হাড্ডি আমি হতে ইচ্ছুক নই।আমার তো এখানে এসে তোমাদের রোমান্সের ব্যাঘাত ঘটানোর কোনো ইনটেনশনও ছিলো না তবে তোমাদের সাথে সবকিছু ক্লিয়ার করে নেওয়া জরুরি মনে করেছিলাম,যে হিসেবে আমি আরুশিকে জানি ও এই টপিক নিয়ে এমনভাবে মাথা ঘামাতোই আমার তা আগেই জানা ছিলো,কারন ওর মতো ভালো মনুষ্যত্বের অধিকারি আজকাল খুঁজে পাওয়া দূরুহ,যাক এসে ওর পুরো কথা কানে গুঁজতে পেরেছিলাম এটাই অনেক। ওকে আমি তবে আসি।
কথাটা বলে আর দাঁড়ালো না সায়ান।তড়িৎ গতিতে হাসপাতালের বাইরে কোথাও বেড়িয়ে গেলো গাড়ি নিয়ে।মিথ্যে হাসি উদাও হলো ঠোঁট থেকে চোখে ভরে এলো সত্য ব্যাথায় পোড়ার জল,ঠোঁট কামড়ে নিঃশ্বব্দে কাঁদতে লাগলো সায়ান।
কেটে গেলো এক মাস,আয়ান অনেকটা সুস্থ এখন।আরুশি সবসময় আয়ানের খেয়াল করে,ওদের দুষ্ট মিষ্টি খুনসুটি প্রায়ই লেগে থাকে।ভালোই কাটছে দিনগুলো সবার তবে একজন বাদে।সায়ান নিজেকে হাজারো কাজে ব্যস্ত রাখলেও আরুশির স্মৃতি থেকে পালানোর সামর্থ্য ওর নেই। সায়ান সবার সামনে নিজেকে হাসিখুশি প্রমাণ করতে চাইলেও ভিতরে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, তা কাউকে দেখাতে না চাইলেও সবাই তা বুঝতে সক্ষম হচ্ছে। তবে কারোই যে তার জন্য কিছু করার নেই।সবাই নিজেদের প্রার্থনায় শুধু সায়ানের মনে শান্তির প্রার্থনা করে যাচ্ছেন,যেখানে মুখ্য অবদান রয়েছে নিধী কথা আর আরুশির।
আজ হুট করেই সবাইকে একত্রে ডেকে সায়ান জানালো আজকে বিকেলেই ও লন্ডন যাচ্ছে। হুট করে ওর লন্ডন যাওয়া মেনে নিতে পারছে না সবাই।কারন হিসেবে সায়ান বললো তার অফিসে ওকে প্রমোশন দেওয়া হয়েছে কাজে ওর নিপুণতা, দক্ষতা আর শ্রম দেখে, বর্তমানে কাজের জন্যই ওকে লন্ডনে যেতে হবে কয়েকদিনের জন্য তাছাড়া ও বেশ কয়েকদিন থেকে কোথাও বেড়াতে যায় নি তাই অনেকদিন লন্ডনে থেকে আসবে ভাবছে তাছাড়া লন্ডন থেকে ফিরে নিজেদের বিজনেস জয়েন করবে সুখবরটাও জানালো সায়ান।সবাই এতে খুশি হলেও সায়ানের এভাবে কোথাও চলে যাওয়া সবার মন খারাপের কারন হয়ে উঠলো।তবে নিধী তাতে অসম্মতি জানালো না,নিধী বুঝতে পারলো সায়ানের মনোভাব।নিধীর মতে সায়ান কয়েকদিন আয়ান আরুশির থেকে দূরে থাকলে নিজেকে বেশ সামলে নিতে পারবে।তাই নিধী সবাইকে আলাদা ডেকে বিষয়টি বোঝালো।অতঃপর সায়ানের চলে যাওয়া কনফার্ম হলো।সায়ান ব্যাগপত্র নিয়ে রেডি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আয়ান আরুশির কাছে এলো,দু’জনেরই চেহারায় নিরাশা ভর করেছে,আরুশির চোখে জল ছলছল করছে।হাসিমুখে দুজনের কাছে এসে বললো সায়ান।
চলি।
আবার কবে আসবি?
এই তো তোর বিয়ের পর তোর বাচ্চাদের নিজের পিঠে চরানোর জন্য।হা হা।
তুই কখনো শুধরাবি না সায়ান?
তুই কবে শুধরালি বল আয়ান?বিয়েটা করে নিস এসে যেনো দেখি বিয়ে করে নিয়েছিস।
তুমি ছাড়া বিয়ে করবো না আমরা।
আরে বলে কি পাগলিটা,নিজের বিয়েতে কেউ প্রাক্তনকে দাওয়াতে রাখে না কি!এক কথায় শেষ…. তোরা বিয়ে করলেই আমি দেশে ফিরবো নয়তো নয়।
কিন্তু……..
এই তোমার কিন্তু কিন্তু করার স্বভাব যাবে না কখনো?এই আয়ান তোর হবু বউকে বুঝিয়ে বলিস তো দেবরের সাথে এতো ফরমালিটি করতে হয় না।হা হা।
আচ্ছা তবে চলি কেমন।ফ্লাইটে দেরি হবে নয়তো।
অতঃপর চলে গেলো সায়ান দূরদেশে। বাংলাদেশের মাটি থেকে প্লেনটা ছেড়ে দিতেই তার মনে হলো প্রাণটা যেনো এই মাটিতেই রয়ে গেছে,সাথে নিয়ে যাচ্ছে শুধু শরীর নামক কঠিন এক পদার্থ। এই শরীরের নেশাই আজ বুকের সবথেকে বড় পীড়ার কারন হয়ে দাঁড়ালো ওর।আল্লাহ সবসময় সৎ পথের অনুসারীদের পাশে থাকেন।যা এবার আয়ানের ক্ষেত্রেও ঘটেছে,সায়ান যদি আজ সৎ হতো হয়তো আরুশি ওর কপালে লিখা হতো,তবে মনে মনে শপথ করেছে সায়ান নিজেকে একজন প্রকৃত মানুষরুপে গড়ে তুলবে।আরুশি নিজের ভালোবাসার দোহাই দিয়েছে তাই নিজেকে কখনো শেষ করতে চাইবে না,তাই রোজ মরণ যন্ত্রণা সহ্য করার মতো ভয়ংকর সিদ্ধান্ত সে নিয়ে নিয়েছে।কাজের কথা তো শুধু একটা বাহানা মাত্র,সায়ান নিজে থেকেই আয়ান আরুশির জীবন থেকে দূরে চলে আসতে চেয়েছে কারন সে জানতো ও থাকাকালীন দুজন কোনোরুপ নিজেদের সম্পর্কে আগাবে না আর সায়ান নিজেকে কারো ভালোবাসার পথে কাটাস্বরুপ রাখতে চায় নি।এমনটা আয়ান আরুশি না ভাবলেও ভাবনাটা সায়ানের নিজেরই।তাই সরে এসেছে ওদের জীবন থেকে।আরুশিকে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে তবে হ্যাঁ ব্যাথাটা মনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে সে।
চলবে………..
#দোটানা ২
#লেখিকা_আরোহী_নুর
#পর্ব_৩২
চার মাস কেটে গেলো আয়ান এখন সম্পূর্ণ সুস্থ তবে আয়ান আরুশি এখনও বিয়ে করে নি।সায়ান ওদের বার বার বিয়ের জন্য তাগদা দিচ্ছে। কিন্তু ওরা সায়ান ব্যতীত বিয়ে করতে চায় না আর সায়ান বলে দিয়েছে ওরা বিয়ে না করলে ফিরবে না।অতঃপর নিধী ওদের বোঝালো যে সায়ানের সামনে বিয়ে করা মানে ওর বেঁচে থাকা আরও দূরুহ করে দেওয়া, সায়ানের দূরে থাকাই এখন ওর জন্য ভালো,লন্ডন থেকে ফিরে এসে যদি দেখে আয়ান আরুশি নিজেদের জীবনে এগিয়ে গেছে তবে হয়তো সায়ানও জীবনে এগুনোর প্রেরণা পাবে,সবার কথামতো আয়ান আরুশি বিয়ের জন্য রাজি হলো, আজ ধুমধাম করে বিয়ে দেওয়া হলো ওদের তবে সায়ানের অনুপস্থিতি সবার মন খুঁড়ে খাচ্ছে। মন যেনো চেয়েও কেউ ভালো রাখতে পারছে না।ধুমধাম করে ওদের বিয়ে দিতে চায় নি কেউ সায়ানের অনুপস্থিতিতে বিশেষ করে আয়ান আরুশি এর বিপক্ষে ছিলো তবে সায়ানের জেদের কাছে হার মানলো সবাই।সায়ান খুব করে চাইলো আয়ান আরুশির ধুমধাম করে বিয়ে হোক সে মোতাবেকই হলো।ওদের বিয়ের ক্ষণে সায়ান ভিডিও কল দিয়ে ওদের দেখলো আর সবার অগোচরে চোখের জল মুছলো,বিয়ে হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে কোনো এক কারন দেখিয়ে ভিডিও কল কেটে সজোরে কাঁদতে লাগলো সায়ান।আজ যে সত্য অর্থে আরুশিকে হারিয়ে গেলো সে।আজ থেকে আরুশি অন্য কারো স্ত্রী, আরুশির ভাবনা ভাবারও অধিকার এখন সায়ানের নেই।এই চারমাসে আরুশির জন্য একটু অনুভুতিও কমাতে পারে নি সায়ান,বরং প্রতিনিয়ত জ্বলছে বিরহদহনে।আজকের দিনটাকে যে তার জীবনের সবথেকে ভয়ংকর খারাপ একটা দিন মনে হচ্ছে।এতো কষ্ট যে সায়ানের এর আগে কভু হয় নি,এই পীড়া সহ্য করার থেকে মরে যাওয়াও যেনো সায়ানের কাছে সহজ মনে হচ্ছে তবে তাও যে করতে ব্যর্থ সায়ান,মনে পরলো সায়ানের আরুশির বলা একটি কথা,আরুশি বলেছিলো যতটুকু যে করবে তাকে ঠিক ততোটুকুই পেতে হবে আর সায়ানও যে তার ভাগের টা পাচ্ছে, তাই তাকে সয়ে যেতে হবে সব।
বিয়ের সাজ খুলে নরমাল কাপড় পরে আয়ান আরুশি আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে বৈবাহিক জীবনের সুখ শান্তি চেয়ে দুই রাকআত নফল নামায আদায় করে নিলো।বর্তমানে ফুল ভর্তি বিছানায় স্বামীর বুকে মাথা রেখে চোখের জল ত্যাগ করছে আরুশি,ভালো নেই আয়ানেরও মন।
কেঁদো না আরুশি,আমাদের তো আর কিছু করারও নেই,শুধু চাইবো আল্লাহ যেনো সায়ানকে ক্ষমা করে তার ভবিষ্যত উজ্জ্বল করে দেন।
আমি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছি তবে এর থেকে বেশি কিছু আমার ওর জন্য করার ছিলো না।ও জোর করে আমার মনের একটা টান নিজের করে নিয়েছিলো তবে আমি কখনো হয়তো ওকে ভালোবাসি নি,ভালোবাসার আসল মানে তো আপনার থেকে শিখলাম আমি।
হয়েছে আমার লক্ষিটি আর কান্না করতে হবে না, তোমার চোখের জল এই হৃদয়কে যে বড্ড পোড়ায়।কথাটা বলে আরুশির চোখ মুছে দিলো আয়ান তারপর আবারও বললো।
আর আজ থেকে তুমি আমাকে আপনি না তুমি করে বলবে আর নাম ধরে ডাকবে কেমন।
না আমার কেমনটা যেনো লাগবে।
কোনো কেমনটা লাগবে না,তুমি আমাকে তুমি করেই বলছো, এটাই ফাইনাল।
ঠিক আছে স্বামী সাহেব যেমনটা আপনার ইচ্ছে। হা হা।
অতঃপর কিছুক্ষণ গল্প করে দুজন একে ওপরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পরলো।আরুশি আয়ানের বুকেই ঘুমালো।
এভাবে কাটলো আরও দুদিন,আয়ান আরুশির মধ্যে ছুটোখাটো রোমাঞ্চ হলেও ওরা এখনও একে ওপরের উপর স্বামী স্ত্রী অধিকার খাটায় নি,হয়তো দুজনই একটা সুন্দর আর যোগ্য মুহুর্তের অপেক্ষা করছে একটা সুন্দর সুচনার জন্য।
আজ আরুশি আর আয়ান আয়ানের ফার্ম হাউজে এসেছে,দুজন একটু আলাদা সময় কাটাতে চায় তাই,এখানে দুজন কয়েকদিন থাকবে।আরুশির হাতের মেহেদির রং এখনো যায় নি, আয়ানের আরুশির হাত ভর্তি মেহেদি অনেক ভালো লাগছে তাই বর্তমানে ওর হাতের মেহেদি দেখছে ওকে পাশে বসিয়ে,তখন খেয়াল করলো ওর হাতের মধ্যে যেখানে আয়ানের নাম লিখা ছিলো সেখানটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছেন এমনকি আশপাশের জায়গাও যেহেতু তিন দিন পেরিয়ে যাওয়ায় মেহেদী অনেকটা হাত থেকে উঠতে শুরু হয়ে গেছে,কিন্তু এতে বেশ নারায হলো আয়ান,মুখ ফুলিয়ে বললো।
আমার নাম উঠলো কেনো হাত থেকে?
আরে মেহেদী তো উঠেই যাবে স্বাভাবিক। আর হাতের নামে কি আসে যায় তোমার নাম তো আমার মনের লিখা হয়ে গেছে চিরতরের জন্য।
তারপরও,আমার নাম আমার তোমার হাতেও চাই, তাই তুমি প্রতিদিন একবার করে মেহেদী দিয়ে হাতে আমার নাম লিখবে যাতে ফ্যাকাশে না হয়।
হুহ আমার বয়েই গেছে তা করতে।
তোমার করতে হবে কারন তুমি আমার স্ত্রী আর আমার কথা তোমাকে রাখতেই হবে।
বিয়ে করতে না করতেই অধিকার খাটানো শুরু করেছো না কি?
তোমার উপর একমাত্র অধিকার তো শুধু আমার, তাই অধিকার আমি না খাটালে কে খাটাবে বলো?
হুহ খুব এসেছে আমার মি.পজেজিব।
হুম আমি তোমার মি.পজেজিব আর তুমি আমার মিসেস পজেজিব।
কথাটা বলে আরুশির কোমড় ধরে হেঁচকা টান দিলো আয়ান যাতে আরুশি ওর অনেক কাছে চলে আসলো,আরুশি লজ্জামিশ্রিত স্বরে বললো।
আপনার ভিতরেও রোমান্স নামক বস্তু আছে জানা ছিলো না।
হুম ভাবছি আমি কতো রোমান্টিক আজ তোমাকে তা বুঝিয়েই দেই।
যাহ আমার লজ্জা করে।
এখনি ভেঙে দিচ্ছি লজ্জা।
কথাটা বলে আয়ান বেসামাল হয়ে আরুশির ঠোঁটের পানে এগিয়ে আসলে আরুশি অতি লজ্জা আর দুষ্টুমিতে আয়ানকে আলতো ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে ছোটে ঘরের বাইরে চলে আসে বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে,আয়ানও আরুশির পিছন ছোটে আসে,তখন রাত প্রায় ১ টা,আবহাওয়া বেশ শীতল,প্রকৃতি যেনো আজ ভালোবাসাময় এক অনুভুতি উপহারে দিয়ে যাচ্ছে তাতে বেগতিক হচ্ছে দুটি মন,বৃষ্টিতে ভিজছে আরুশি আর অপলকে দেখছে আয়ান,প্রকৃতির প্রেমাণুভুতি ওদের মন নাড়িয়ে দিলো ,আরুশিকে আপন করে নেওয়ার এক আদম্য নেশা চড়ে বসলো আয়ানের মনে,অল্পক্ষণ আরুশিকে অপলকে দেখে তার পাশে গেলো আয়ান,ওর কোমড়ে হাত রেখে তাকে নিজের দিকে টেনে নিলো,আরুশির শরীরে খেলা করে উঠলো অজানা এক শিহরণ,নিজেকে যে আয়ানের কাছে উজার করে দিতে চায় আরুশি নিজেও,পেতে চায় তার স্ত্রীর মর্যাদা তাই আটকাতে চায় না আয়ানকে,ওকে ছোঁয়ার যে আয়ানের পূর্ণাঙ্গ অধিকার আছে।জড়িয়ে ধরলো আয়ানকে অতি শিহরনে,জড়িয়ে ধরায় যেনো আয়ানও আরুশির সম্মতি আন্দাজ করতে পারলো তাতে তাই আলতো করে প্রাপ্তির হাসি ফোঁটালো ঠোঁটের কোনে।অল্পক্ষণে আরুশিকে জড়িয়ে ধরা থেকে ছাড়িয়ে তাকে উঁচু করে ধরলো আয়ান আরুশির কোমড়ের পিছনে হাত রেখে।আয়ান থেকে অল্প খাটো আরুশি তাই নিজের পা দ্বয় উঁচু করলো সে যাতে আয়ানের মুখোমুখি পৌঁছাতে সক্ষম হলো আরুশি,আয়ান আলতো করে আরুশির চুল মুঠো করে নিয়ে ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট মিলিয়ে নিলো, শিহরনে আরুশি খাঁমছে ধরলো আয়ানের কাঁধের দিকের শার্ট,খানিকক্ষণ এভাবে থাকার পর আয়ান আরুশিকে কোলে তুলে নিলো আর নিজের রুমের দিকে হাঁটা শুরু করলো,তারপর রুমের দরজা বন্ধ হলো।দুজনই দুজনে হারিয়ে গেলো,ওদের সম্পর্ক আজ পূর্ণতা পেলো,পেলো নতুন এক রুপ।
আরুশির আয়ানের প্রতি ভালোবাসা আর সম্মান আরও বেড়ে গেলো আজ কারন বিয়ের আগে প্রায় ৬ মাসের মতো ওরা প্রেমের সম্পর্কে ছিলো তবে কখনো আয়ান ওকে সেভাবে ছুঁতে চায় নি আর নাতো সেরকম কোনো আবদার করেছে।আজ পবিত্র ভাবেই আয়ান আরুশিকে নিজের করে নিলো।ফার্ম হাউজে কয়েকদিন থাকার পর দুজন হানিমুনে গেলো সুইজারল্যান্ড। সেখানে প্রায় ১ মাসের মতো থেকে আসলো দুজন।
দু’বছর কেঁটে গেলো তবে সায়ানের মনে আরুশিকে নিয়ে অনুভূতি এক চুলও কম হয় নি।প্রতিদিনই পুড়ে মরে বিরহ জ্বালায়।এদিকে সায়ানের বাড়ি আসার কোনো নাম নেই।কতো কাকুতিমিনতি রোজ করা হয় ওর কাছে তবে ও না আসার হাজারটা কারন দেয়।সবাই ওকে বলে বলে ক্লান্ত হয়ে পরেছে।অবশেষে আরুশির অনেক রাগ হলো,এমনিতে সায়ানের সাথে ও স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলে। আজ সায়ানকে ভিডিও কল করলো আরুশি।উদ্দেশ্য ওকে বাড়ি ফিরিয়ে আনা এখন যে মতেই হোক।প্রথম প্রথম স্বাভাবিক ভাবে বললো আরুশি তবে সায়ান সেই তার উল্টা পাল্টা কারন দেখাতে শুরু করলো অতঃপর আরুশি নিরাশ হয়ে সেই কলে উপস্থিত থাকা অবস্থাতেই কেঁদে দিলো।
কেনো এমনটা করছো বলো,তোমার কথামতো তো সব করেছি আমরা তবে এখন কেনো আসছো না?তোমার সমস্যা আমাকে নিয়ে তাইতো?ওকে আমি চলে যাবো কোথাও তবুও তুমি বাড়ি ফিরে আসো,তুমি ছাড়া আমাদের পরিবার অসম্পূর্ণ।
আরে আরে বলে কি পাগলিটা!কোথায় যাবে তুমি!তুমি ছাড়া আয়ান আর বাকি সবার কি হবে বলো?আমার তোমাকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কান্না বন্ধ করো?তোমাকে কান্নায় একদম মানায় না।প্লিজ তুমি কান্না করো না আমি আসছি।
কবে আসছো বলতে হবে।
আরে….
কোনো আরে বারে না বলো কবে আসছো?
দুদিন সময় তো দেওয়া যায় আমাকে তাই না ?
ওকে দুদিন দিলাম তৃতীয় দিন যেনো তোমাকে আমার সামনে পাই।কথাটা মনে রেখো।
যো হুকুম মহারানী।
অবশেষে সায়ান ফিরলো দেশে। সবার যেনো সুখের সীমা নেই।খুশিতে মায়েদের চোখে জল।এদিকে ঘরে এনে রেখেছে ওরা সায়ানের জন্য কাউকে,অচেনা মেয়েটাকে দেখে সায়ান হতবাক হলো কারন মেয়েটা দেখতে প্রায় আরুশির মতোই। ওর বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে সবাই তার উত্তর হিসেবে এই টুকুই বললো ওর বিষয়ে পরে জানানো হবে।
মেয়েটা সায়শা,সবাই সায়ানকে বিয়ে করাবে কথাটা মাথায় চড়িয়েছিলো, তবে সায়ান বিয়ে করতে রাজি হবে না এটা সবাই জানতো।কারন এই দুই বছর সবাই সায়ানকে ফিরে এসে বিয়ে করার তাগদা দিলেও সায়ান মানে নি।কিন্তু সায়ানকে বিয়ের জন্য মানিয়ে নেওয়ার দায় ভার আরুশি নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিলো আর আরুশির উপর বিশ্বাস করে সবাই ওকে না জানিয়েই ওর জন্য বউ খুঁজতে বেরুলো।অনেক জায়গায় মেয়ে দেখেও কেনো যেনো ওদের মন মতো হলো না, কোনোদিক যেনো মিলছিলো না তখন হঠাৎ একদিন একটি মেয়েকে দেখতে যায় ওরা তবে ওকে ভালো না লাগলেও যে মেয়েটা মেয়ের পক্ষ হয়ে চা নিয়ে আসলো তাকে চোখে ধরলো উনাদের,ঠিক যেনো দেখতে আরুশির মতোই সে,পৃথিবীতে না কি এক চেহারার সাত জন লোক থাকে হয়তো তেমনই ঘটনাটা,হুবহু দেখতে আরুশির মতো না হলেও প্রায়ই এক,তাই সবার ওকে পছন্দ হলো তবে ওর মা ওকে বিয়ে দিতে রাজি হলেন না, যে জায়গাতে ও বড় আর বড় বোন রেখে ছোটো মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইছেন উনি,সেদিন ওকে না দেওয়ার কথায় উনারা নিরাশ হয়ে চলে আসেন সেখান থেকে কিন্তু মহিলাটি ছোটো মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য প্রায় অনেক উঠেপরে লেগেছিলো।উনারা চলে আসলেও ওকেই মনে ধরেছিলো উনাদের তাই আশেপাশে খবর নিলে জানতে পারেন ও মহিলাটির সৎ মেয়ে।৭ বছর বয়সে মা মারা গেলে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন।তখন থেকে ওর দূর্দিন শুরু হয়,বাবার প্রচেষ্ঠায় গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করেছে তবে ১ বছর আগে বাবাও মারা গেলে ওর অবস্থা আরো খারাপ হয়।ওই বাড়িতে আছে শুধু একটা আগাছার মতো।অতঃপর কথাটা শুনে উনাদের অনেক খারাপ লাগে,অনেক প্রচেষ্ঠার পর আরুশির উদ্যোগে আয়ান আর আরুশি ওর সাথে একাকিত্বে দেখা করতে সক্ষম হয়,আর ওর সাথে কথা বলে।ওকে বিয়ের জন্য বলে।ও প্রথমে মানে না তবে ওই জাহান্নামে যে ও নিজেও থাকতে পারছে না আর।কিন্তু ও পালিয়েও আসতে চায় না,তাই উনারা আবারও বিয়ের কথা নিয়ে যান ওই বাড়িতে মহিলাটি আবারও মানা করলে উনারা সায়শা কে উনাদের সাথে চলে আসতে বলেন,চৌধুরী বাড়ি আর চৌধুরী বাড়ির লোকেদের ভালো মনুষ্যত্বের বিষয়ে কেই বা না জানে।তাই সায়শা ভয় পেলো না,চলে এলো ওদের সাথে।দুদিন পর সায়ানকে বিয়ের কথা জানালে এক কথাই বলে সায়ান ও কখনো বিয়ে করবে না।অনেক বোঝায় সবাই সায়ানকে কিন্তু ও বিয়ে করবে না এটাই ওর মূল কথা,সবাই যখন বোঝাতে বোঝাতে হাল ছেড়ে দেওয়ার প্রান্তে তখন আরুশি একটা বুদ্ধি বের করলো।সবাই ওর বুদ্ধি শুনে হতবাক,আয়ান বলে উঠলো।
এই তোমার মাথা গেছে!এমন কিছু দাদিমা কি করে করবে,আর সায়ানকে এমনটা করে কখনো আয়ত্তে আনা যাবে না।
পারবে না কেনো আমার একমাত্র দাদি শাশুড়ী মা কিছু পারে না এমন হতে পারে।কি বলো দাদি শাশুড়ী মা।করবে অসুস্থতার নাটক।হা হা
কিন্তু…….
কোনো কিন্তু না,তুমি শুধু শুয়ে থাকবে আর যখন সায়ান তোমার পাশে বসে কান্না করবে তখন শুধু এটা বলবে।
যে রে ভাই আমার বয়স হয়েছে,চলে যাওয়ার আগে তোর বিয়েটা দেখে যেতে চাই।বেস হয়ে যাবে আমাদের কাজ।
যতো কুবুদ্ধি মাথায় পুরে রেখেছে।
এই যে মি.এ্যরোগেন্ট আমার বুদ্ধিতে গা তোমার কেনো জ্বলছে,ঘরে গিয়ে নিজের ল্যাপ্টপ গুতাগুতি করো যাও।
দেখে নিবো তোমাকে…..
হুহ……
আয়ান চোখ ছোটো করে আরুশির দিকে তাকিয়ে স্থান ত্যাগ করলো।আরুশি ফিক করে হেসে দিলো।
অতঃপর দাদিমাকে অসুস্থতার নাটক করতে বলা হলো,দিদু মেনে যান আর বাকি সবাইও কারন সায়ান জীবনে এগুক ওরা সবাই চায়,একজন নকল ডাক্তার এনে মিথ্যে বলিয়ে আরুশি কেঁদে কেঁদে নাটক করে সবাইকে দিয়ে মিথ্যে বলিয়ে সায়ানকে বিশ্বাস করালো যে দাদিমা খুব অসুস্থ আর একটু দুঃশ্চিতা উনার জন্য প্রাণ হানি,অতঃপর দিদু আরুশির কথামতোই উক্ত আবদার করলে সায়ান নিরুপায় হয়ে যায়।আরুশি ছাড়া কাউকে বিয়ে করার কথা চিন্তা করতেও পারে না সে।তাই দেখবো বলে উঠে চলে যায় সেখান থেকে সায়ান,সবাই আশাহত হয়।সায়ানের চোখ ভরে আসে জলে আরুশি ওর পিছন আসে,সায়ানকে আরুশি পিছুডাক দিলে সায়ান আরুশির অগোচরে নিজের আঁখিদ্বয় মুছে ফেলে।আরুশি এবার সায়ানের সামনে আসে।
কি শুরু করেছো সায়ান তুমি এসব?
তোমরা কি করছো এসব বলোতো?দিদুর অসুস্থতার দোহাই দিয়ে আমাকে বিয়ে করিয়ে নেবে!
হে নেবো।আর কি করার আছে আমাদের। দেখো সায়ান কারো চলে যাওয়াতে জীবন আটকে যায় না।হ্যাঁ প্রথম ভালোবাসার জায়গা কাউকে দেওয়া যায় না তাই বলে তো এটা নয় জীবন দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না।আজ দুবছর হয়ে গেছে সায়ান,এখন তো তুমি জীবনে একটু এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারো,তুমি এভাবে শুধু নিজে কষ্ট পাচ্ছো না সবাইকে কষ্ট দিচ্ছো,মায়েদের প্রায়ই তোমার জন্য কাঁদতে দেখেছি।এমনকি আমি আর আয়ানও নিজেদের জীবনে আর এগুতে পারছি না,বিয়ের দুবছরেও আমরা বাচ্চা নেই নি শুধু অপরাধ বোধ থেকে।তোমাকে কষ্ট দিয়ে নিজেদের জীবনে সুখের পর সুখ আমরা আনতে পারছি না সায়ান,শত সুখের মধ্যেও তোমাকে কষ্ট দেওয়ার খারাপ লাগা আমাদের থেকেই যায়।আর কারো জন্য না হলেও মায়েদের জন্য অন্ততো জীবনে এগিয়ে যাও, মায়েরা প্রায়ই খাওয়াদাওয়া করেন না তোমার দুঃশ্চিতায়।আমি আর কিছু বলবো না সায়ান,তুমি তো চাও আমরা সুখে থাকি সে মোতাবেক আমাদের সুখে রাখতে চাইলে বিয়েটা করে নাও।
কথাগুলো বলে আরুশি প্রস্থান করলো।সায়ান পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো অনেকক্ষণ সেখানে,চোখ গড়িয়ে পরলো তার জল।অনেক ভাবলো সায়ান,অতঃপর সবার সুখের দিক বিবেচনায় নিয়ে বিয়েতে মত দিলো,তবে সে ধুমধাম করে বিয়ে করবে না বলে দিলো,কিন্তু কে শুনে কার কথা বাদ্য বাজিয়ে ধুমধাম করে বিয়ে দিলো সবাই সায়ানের।বাসর ঘরে বসে আছে সায়শা,সায়ান ভিতরে এসে ওর পাশে বসলো,সায়শা মাথা নিচু করে বসে আছে।সায়ান বললো।
তোমার বিষয়ে সবকিছু বলেছে আমায় আরুশি।তবে আমার বিষয়ে তুমি কিছুই হয়তো জানো না।যেহেতু বিয়ে হয়েছে সে হিসেবে তোমার আমার বিষয়ে সব জানা উচিত।
আমি একসময়কার শরীর লোভী একটা হিংস্র অধম,জানিনা কতো মেয়ের সাথে রাত কাটিয়েছি তাও কোথায় কোথায়।আমার নেশাই ছিলো মেয়েদের শরীর আর খারাপ নেশাজাত দ্রব্য।তবে আরুশির ভালোবাসার নেশা কাটালো আবার অন্য সকল আসক্তি।আনলো আমাকে সঠিক পথে।তবে সেই আরুশিই আমার কপালে জুটলো না।তবে সে রয়ে গেলো মন জুরে।বর্তমানে কোনো খারাপ অভ্যেস আমার নেই,পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ি,সত্য কথা বলি আর সৎ কাজ করি।কিন্তু সব অভ্যেস বদলে ফেললেও আরুশিকে মনে করার অভ্যেস বদলাতে পারি নি আর জানিনা কভু পারবো কি না।তাই তোমাকে শুধু একটা কথা বলতে চাই যেখানে তোমাকে বিয়ে করেছি সেখানে তোমাকে একদিন না হয় স্ত্রীর মর্যাদা দিতেই হবে,তোমার পর জীবনে আর দ্বিতীয় নারী আসবে না সে নিশ্চয়তা আমি তোমায় দিতে পারি,যেহেতু তোমার সাথে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে সেহেতু তোমাকেও নিজের মনে একটা জায়গা করে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে আমায়,তবে বিষয়টা মোটেও সহজ নয় আমার পক্ষে। আমার হয়তো অনেক সময় লাগবে,আশা করি তুমি বিষয়টা বুঝবে।
এবার নরম স্বরে বললো সায়শা।
আপনার যতো সময় লাগে নিন।আমি আপনার জন্য জীবনভর অপেক্ষা করতে রাজি।কারন আপনিই তো এখন আমার ভবিষ্যত।আমার শেষ বিচারটাও যে আপনার সাথেই হবে।একজন অর্ধাঙ্গিনি হিসেবে আপনাকে বুঝা আর আপনার প্রতিটা পদে সাথী হয়ে থাকা আমার দায়িত্ব এবং কর্তব্য।
তুমি সত্যিই অনেক ভালো।তা এতো ভারি সাজে বসে আছো হয়তো অস্তিত্বে লাগছে তোমার। ফ্রেস হয়ে এসে শুয়ে পরো।বিছানা বড় আছে একপাশে নির্দিধায় ঘুমোতে পারবে আর তোমার সমস্যা হলে আমি না হয় ফ্লোরে চলে যাবো।
আরে তা লাগবে না।আমি এডজাস্ট করে নিতে পারবো।আলতো হেসে বললো সায়শা।
আয়ান আরুশি ল্যাপ্টপে কমিডি মুভি দেখছে এসব আরুশিরই ধান্দা, আয়ান বিছানায় হেলান দিয়ে ল্যাপ্টপ সামনে ধরে আছে আর আরুশি ওর বুকে মাথা রেখে মুভি দেখছে আর হাসছে।দুজনই হেসে কুপকাত,হঠাৎ আরুশি ল্যাপ্টপ বন্ধ করে দিলো আয়ান তখন হাসছিলো, হাসি থামিয়ে এবার বললো।
কি হয়েছে বন্ধ করলে কেনো?
তোমার হাসি দেখবো,এগুলা থেকে এটাই আমার কাছে প্রিয়।জানতাম না এই ঘুমরো হনুমানটাও হাসতে জানে।
আমার হাসি যে তোমার সাথে হারিয়ে গেছিলো আরুশি আর তোমার সাথেই ফিরে এসেছে।তোমাকে আবার হারিয়ে গেলে যে এই প্রাণটাও যাবে।
হুশ….একদম ওসব কথা বলবে না।আমি এতো জলদি তোমায় ছেড়ে কোথায় যাচ্ছি না।তোমার জীবন জ্বালিয়ে ছানাবানা করার প্লান আছে আমার।বুড়ো হয়ে যখন লাঠি ভর করে হাঁটবে তখনও জ্বালাবো।
প্রেমের আগুনে তো জ্বালিয়েছো আমায় আর কতো জ্বালাবে।
যতোসময় না তুমি জ্বলে ছাই হয়ে যাও।হা হা হা হা।
তুমিও না।হা হা।
সায়ানকে বিয়ে তো করিয়ে দিয়েছি তবে কি ও জীবনে এগুবে আয়ান?
শুনেছি এক ছাঁদের নিচে থাকতে থাকতে ভালোবাসাটাও নাকি হয়ে যায়।হয়তো জীবনে প্রথম ভালোবাসার জায়গা কাউকে দেওয়া যায় না তাই বলে কি কেউ দ্বিতীয় সুযোগ পায় না।আশা করি সায়ান সায়শার সাথে জীবনে এগিয়ে যাবে হয়তো একটু সময় লাগবে।
হুম আমিও এটাই আশা করি।
হুম,তবে আমার আশা ভরসার কি হবে,নেশালো কন্ঠে বললো আয়ান।
ভ্রুকুচকে বললো আরুশি।আশা ভরসা মানে?
আয়ান দুষ্টু ভঙ্গিতে আঙুল দিয়ে নিজের ঠোঁটের দিকে ইশারা করলো।আরুশি দুষ্টুমি করে বললো।
আমার ঘুম পাচ্ছে অনেক।
হাই তুলে কথাটা বলে আরুশি শুতে নিতে খপ করে ওর হাত ধরে নিলো আয়ান অতঃপর বললো।
এখনই ঘুম উদাও করছি আপনার মহারানী।
আরে কে কোথায় আছে কেউ বাঁচাও আমায় ঘুমরো হনুমানটার হাত থেকে।হা হা হা
আজ তোমায় কে বাঁচাবে দুষ্টু রানী।
অতঃপর আয়ান আরুশিকে নিজের মতো ভালোবাসতে শুরু করলো।
চলবে………