#নিভৃতে_যতনে
#Part_34
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
আকাশটা আজ মেঘাচ্ছন্ন। চারদিকে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে বিকট শব্দে মেঘ ডেকে উঠছে। রাস্তার খালি জায়গায় জমতে শুরু করেছে কাঁদাপানি। আমি বারান্দায় থাকা বেতের মোড়ায় বসে একধ্যানে বৃষ্টি দেখছি। ঝোড়ো হাওয়ায় বৃষ্টির ক্ষুদ্র কণা আঁচড়ে পড়ছে চোখে-মুখে। সর্বাঙ্গে খেলে যাচ্ছে শীতল শিহরণ। কিন্তু তবুও আমার মধ্যে কোন হেলদোল নেই। অন্যমনস্ক হয়ে স্থির হয়ে বসে আছি সেখানেই৷ আজ দেড় মাস হতে চললো নাসরিন বেগম ইন্তেকাল করেছেন। এমনই এক বৃষ্টির দিনে তার মৃত্যু হয়েছি। সকলেই আমাকে ডেকেছিল নাসরিন বেগমকে শেষ দেখা দেখে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি যায়নি। বলতে আমার সাহস হয়নি। কেন না, কাফনে জড়ানো মৃতদেহ আর খাটিয়া যে আমার বোধগম্য নয়। আমি এইসব সহ্য করতে পারি না, বড্ড ভয় পাই। বোডিং এ থাকতে যখন একটা মেয়ে সুইসাইড করলো আর তার লাশ কাফনে মুড়িয়ে আমাদের সামনে আনা হলো তখন সেটা দেখা মাত্র আমি আমার জ্ঞান হারিয়েছিলাম৷ আর আমার সেই জ্ঞান ফিরেছিল দুদিন পর। এরপর পুরো এক সপ্তাহে আমি ভয়ে কাবু ছিলাম। এই ঘটনা এক মা ব্যতীত কেউ জানে না। হয়তো কেউ জানবেও না আমার এইসবে ফোবিয়া আছে। তাই হয়তো আমি না যাওয়ার জন্য মানুষগুলো আমাকে এক দফা দোষ দিয়ে যাবে। অবশ্য এতে নতুন কিছুই নেই। তারা তো ছোট থেকেই আমায় দোষারোপ করেই আসছে। এখন না-হয় তাদের অভিযোগের পাল্লা ভারী হলো। কিন্তু এইসব নিয়ে তো আমার ভাবনা নয়। আমার ভাবনা গিয়ে আটকিয়েছে অন্য জায়গায়। আচ্ছা, নাসরিন বেগমকে কি সত্যি আমার ক্ষমা করে দেওয়ার দরকার ছিল? লোক দেখানো মহান হওয়াটা কি আবশ্যক ছিল? হয়তো ছিল আবার হয়তো না। আচ্ছা, লোক দেখানো ক্ষমা করলেও কি আমি আদৌ মন থেকে তাকে ক্ষমা করতে পারতাম? পারতাম না তো। কষ্টগুলো তখনও ছিল এখনো আছে। পার্থক্য শুধু এইখানে, আগে কষ্টগুলো পোড়াতো আর এখন তা পোড়া দাগে পরিনত হয়েছে৷ যা আদৌ অন্তঃস্থল থেকে মুছবে কি-না সন্দেহ। ইশশ! যদি সকল কষ্ট ভোলা যেত তাহলে জীবনটা কতটাই না সাচ্ছন্দ্য হতো। ক্ষমা নামক শব্দটা তখন চাইতে হইতো না আপনি-আপনি হৃদয়ের গহীন থেকে চলে আসতো।
আমি যখন আমার আপন ভাবনায় বিভোর ঠিক তখনই কাধে কারো উষ্ণ হাতের ছোঁয়া পাই। পিলকে চমকে উঠি আমি৷ আপন ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি মা দাঁড়িয়ে আছে। চোখের চাহনি তার তীক্ষ্ণ।আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে ছোট একটা হাসি উপহার দিতেই মা ধমকের সুরে বলে উঠেন,
— এই অসময়ের বৃষ্টিতে কেউ ভিজে? জ্বর বাঁধাবে পড়ে।
আমি একপলক নিজের দিকে তাকিয়ে বাইরে তাকালাম। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। যার দরুন বৃষ্টি ঝাপটা দৃঢ় হওয়ায় আমি ভিজে একাকার। নিজের ভাবনায় এতটাই বিভোর ছিলাম যে বুঝতেই পারিনি কখন এতটা ভিজে গেলাম। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে অপরাধী সুরে বলি,
— বুঝতে পারিনি।
মা গলার সুর নরম করে বলেন,
— যাও তারাতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। ঠান্ডা লেগে যাবে নাহলে৷
আমিও তার কথায় সম্মতি জানি চলে যাই ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে এসে বুঝতে পারি শীত আমায় কাবু করতে শুরু করেছে। হয়তো রাতে ধুমিয়ে জ্বরও আসতে পারে। আমি বিছানায় বসে তোয়ালে দিয়ে চুলগুলো মুছতে থাকি৷ এমন সময় মা এক কাপ রঙ চা নিয়ে হাজির হন। আমার হাতে চায়ের পেয়ালাটা ধরিয়ে দিয়ে তোয়ালেটা নিজে নিয়ে নেন। অতঃপর আমার পিছনে বসে বলেন,
— দাও আমি মুছে দিচ্ছি।
আমি কিছু না বলে তার দিকে পিঠ করে বসি আর ছোট ছোট চমুক বসাতে থাকি চায়ের পেয়ালাটিতে৷ ক্ষণেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি আমি৷ বেশ কিছুটা সময় পর মা বলে উঠলেন,
— মন খারাপ কেন?
কথাটা শুনে আমি কিছুটা ভড়কে যাই। স্বতঃস্ফূর্ত স্বরে বলি,
— কোথায় মা?
— আবার মিথ্যে বলছো? তোমাকে পেটে ধরিনি বলে যে তুমি আমার সন্তান না তা তো নয়। মায়েরা সন্তানের সব এইভাবেই বুঝে যায়। এখন বলো মন খারাপ কেন?
আমি অস্ফুটস্বরে বলি,
— ইয়ে মানে, নাসরিন বেগমের কথা ভাবছিলাম। আমার কি তাকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিৎ ছিল?
মা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন,
— আমি তোমার পক্ষে বা বিপক্ষে কথা বলছি না। শুধু এতটুকুই বলছি, অন্তর থেকে যদি ক্ষমা না করতে পারো তাহলে মুখে বলা সেই ক্ষমার মূল্য নেই৷ হয়তো মানুষটা অনুশোচনা থেকে পাবে কিন্তু কর্ম থেকে মুক্তি পাবে না।
কথাটা শুনে আমি চুপ হয়ে থাকি। মা কিছুটা সময় নিরব থেকে বলেন,
— তোমার প্রতি খালাম্মার অনিহা আমি নিজেই দেখেছি। তার অকথ্য ভাষাও শুনেছি। তাই বলতে পারি তিনি যা করেছেন তা ভুল। কিন্তু তোমার পরিবারও যে তোমার সাথে এমন করবে তা বুঝিনি। বিয়ের সময়টাও বুঝিনি যে তোমার প্রতি পরিবারের এত অনিহা।
আমি কিছুটা অবাক হয়ে বলি,
— আপনি দেখেছেন মানে?
মা স্মিত হেসে বলেন,
— ভুলে গেলে নাকি আমি আগে তোমার পাশের ফ্ল্যাটেই থাকতাম। হয়তো আমরা তোমার স্মৃতিতে নেই কিন্তু আমাদের স্মৃতিতে তোমার সেই ছোট মুখটা এখনো ভাসে।
কথাটা শুনে আমি মিইয়ে যাই৷ আসলেই আমার বিষয়টা মনে ছিল না। এত কথার ভিরে ওই কথাটা মাথা থেকে প্রায় বেরিয়েই গিয়েছিল। হঠাৎ টনক নাড়তেই আমি মাকে জিজ্ঞেস করি,
— একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
— হুম করো।
আমি অস্ফুটস্বরে বলি,
— না মানে এই বিয়েই বা কিভাবে ঠিক হলো?
মা হালকা হেসে বলেন,
— প্রতিবেশী হওয়া সুবাদে তোমাদের সাথে আমাদের ভালো সম্পর্ক ছিল জানোই তো। কিন্তু আমরা ওই এলাকা থেকে চলে আসার পর তোমাদের সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর অনেক বছর যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু তিন বছর আগে ইদের এই সময় একদিন রাস্তায় তোমার শ্বশুরের সাথে তোমার বাবার দেখা হয়। পূর্বপরিচিত আর তারা ভালো বন্ধু হওয়া সুবাদে তোমার বাবা তাকে জোড় করে বাসায় নিয়ে যায়। আর সেখানেই তোমার শ্বশুর তোমাকে দেখে৷ তোমার সাথে বোধহয় কথাও হয়েছিল। তখনই নাকি তোমায় তার মনে ধরে যায় আর তিনি তৎক্ষনাৎ রোয়েনের জন্য তোমার বিয়ের কথা বলেন। তোমার বাবাও নাকি এক কথায় রাজি হয়ে যান। কিন্তু সামনে তোমার এইচএসসি পরীক্ষা ছিল বলে বিষয়টা তখন এতটা আগায় নি। অতঃপর বাসায় এনে তোমার সম্পর্কে আমাদের জানান। তিনি যে বিয়ে পাকা করে এসেছেন তাও জানান৷ তোমাকে আগে থেকে চিনি বলে আমারও কোন সমস্যা ছিল। অতঃপর কথা ঠিক হয় যে, এইচএসসির পর তোমার আর রোয়েনের বিয়ে হবে। আর এইখানেই কথা পাকাপাকি হয়ে যায়। অবশেষে তোমার এইচএসসি শেষে বাসায় আসতেই তোমার আর রোয়েনের বিয়ের তোরজোড় শুরু হয়। অবশ্য আমাদের সকলের আগে থেকেই সকল ধরনের প্রস্তুতি ছিলই। তাই সবকিছু তাড়াতাড়িই সেড়ে ফেলতে পারি আমরা৷
আমি অন্যমনস্ক হয়ে জিজ্ঞেস করে বসি,
— কিন্তু উনি কি এই বিয়েতে রাজি ছিল?
কথাটা বলা মাত্র অস্বস্তিতে পড়ে যাই। যত যাই হোক শ্বাশুড়িকে তো আর প্রশ্ন করা যায় না। মা স্মিত হেসে বলেন,
— সেটা না-হয় রোয়েনকেই জিজ্ঞেস কোরো।
মনে আরও কয়েকটা প্রশ্নক থাকা সত্ত্বেও আমি আর কথা বাড়ালাম না। চুপ হয়ে গেলাম। মাও অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। অতঃপর আমিও তার সাথে তাল মিলালাম৷
________________________
হেমন্তের মাঝামাঝি সময়। নীলাভ আকাশে আজ সোলানি রোদ্দুরের প্রখরতা খানিকটা কম এখন। চারদিকে টোনাটুনির কিচিরমিচির কলরব। হাওয়ায় ভাসে সদ্য ফোটা ফুলের সুবাস। ঢাকা ভার্সিটির হাক্কিম চত্তরে পিছনের দিকটায় বসে আড্ডা দিচ্ছে বন্ধুমহলের সকলের। অফ পিরিয়ড হওয়া সুবাদে আড্ডা জমেছে দারুণ। সবুজে রাঙ্গা গাছগাছালির নিচে সকলের হাতেই এককাপ চা আর মুখে হাজারটা কথা। আর কি লাগে আড্ডা জমাতে? আমি মন দিয়ে সকলের কথা শুনছি আর হাতে থাকা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি। হঠাৎ ইফতি বলে উঠে,
— এই আদিব আর নূরের বাচ্চা গেল কই? আড্ডার মাঝ থেকে উঠে ওই যে গেল তো গেল এক্কেরে মি. ইন্ডিয়া হয়ে গেল।
স্নেহা নিজের নখ দেখতে দেখতে বলে,
— দেখ কোন গাছের তলায় বসে আবার প্রেম করছে।
সুরাইয়া মুখ লটকিয়ে বলে,
— জীবনে করলামটা কি? আজ একটা প্রেমও করতে পারলাম না অথচ ওই দুই হারামির প্রেম জমে ক্ষীর। বলি এই জীবন রেখে লাভ কি?
আমি রসিকতা করে বলি,
— আসলেই লাভ কি? মরে যা তুই। মরতে বেশি কিছু করতে হবে না, জাস্ট বুড়িগঙ্গার পানিতে গিয়ে একবার ডুব দিবি। ব্যাস! মরণ পাঁচশ পার্সেন্ট নিশ্চিত তোর। বাঁচার কোন চান্স নেই।
কথাটা শোনা মাত্র সকলে হু হু করে হেসে উঠে আর সুরাইয়া ফুসে উঠে বলে,
— তুই বন্ধু নামে কলঙ্ক।
আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই আমার ফোন বেজে উঠে। আমি ফোন হাতে নিয়ে দেখি রোয়েন। আমি আর এক মুহূর্ত অপচয় না করে ফোন রিসিভ করলাম৷
— হ্যালো!
— তোমার আজকে হাফ ডে না?
— হুম কেনো?
— ক্লাস শেষে একা যাবে না। আমি নিতে আসবো।
কথাটা শোনামাত্র ভিতরে একরাশ মুগ্ধতা ছেয়ে গেল। আমি ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বলি,
— আচ্ছা।
— সাবধানে থাকবে।
কথাটা বলেই তিনি ফোন রেখে দিলেন। আমি ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি বিদ্যমান রেখেই চোখ তুলে তাকাতেই ইফতি ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠে,
— আহা কি প্রেম! তোদের প্রেম দেখে আমি আপ্লূত দোস্ত। তা আমি কিন্তু মামা ডাক শুনার জন্য চাতক পাখির মত বসে আছি দোস্ত।
আমি কিছুক্ষণ ইফতির দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলে উঠি,
— মামা!মামা! আমার প্রিয় ইফতি মামা। আরও মামা ডাক শুনার ইচ্ছা থাকলে বল? আমি একশ বার বলে দিচ্ছি। প্যারা মামা জাস্ট চিল।
আমার কথা শেষ হওয়া মাত্র সকলে উচ্চস্বরে উঠে। আমিও তাল মিলিয়ে তাদের সঙ্গে হেসে উঠি।
____________________
ক্লাস শেষে গেটের বাহিরে এসে দাঁড়ালাম। আমি চারদিকে চোখ বুলিয়ে আমার মানুষটিকে খুঁজছি এমন সময় একটা পিচ্চি এসে আমার সামনে হাজির হয়। আমার কামিজের শেষ অংশ ধরে টান দিতেই আমি চকিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই। কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,
— কি চাই?
মেয়েটা কিছু না বলে আমার দিকে একটা চিঠি এগিয়ে দেয়। তারপর মিষ্টি সুরে বলে,
— আফনারে ওই ভাইয়াডা এইটা দিতে কইসে। লোন!
আমি চিঠিটা হাতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করি,
— কোন ভাইয়া?
কথাটা বলতে বলতেই পিচ্চিটা দৌড় দিয়ে চলে যায় আর ক্ষণেই সকলের মাঝে হারিয়ে যায়। আমি পিছন থেকে বেশ কয়েকবার ডাকা সত্ত্বেও সে সাড়া দিল না। আমি ভ্রু কুঁচকে রেখেই চিঠিটা উল্টেপাল্টে দেখলাম। কোন নাম-টাম কিছু লিখা নেই। আমি এক ঝাঁক কৌতূহল নিয়ে যেই না চিঠি খুলতে যাব তার আগেই কেউ সেটা ছো মেরে হাত থেকে নিয়ে যায়। আমি এক রাশ বিরক্তি নিয়ে চোখ তুলে “কে রে” বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। চুপসে গেলাম মুহূর্তেই। সামনেই রোয়েন ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার দিকে একপলক তাকিয়ে উনি চিঠিটা খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মুহূর্তেই চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করেন। আমি একটু উঁকি-ঝুঁকি দেখার চেষ্টা করলাম আসলে চিঠিতে কি লিখা। উপরে ‘প্রেয়সী’ সম্মোধন আর কিছু আবেগময় লাইন চোখে পড়তেই আমার আর বুঝতে নেই এইটা নির্ঘাত কোন প্রেমপত্র। কথাটা বোধগম্য হতেই আমার গলা শুকিয়ে আসে৷ জীবনে প্রথমবার কোন প্রেমপত্র পেলাম আর তাও কি-না পড়ার আগেই নিজের বরের হাতেই ধরা হলো? হায় খোদা! এমন ভাগ্য বুঝি লাখে আমারই হয়? এখন না জানি রোয়েন কি করে। ক্ষণেই রোয়েনের চেহেরায় পরিবর্তন দেখতে পেয়ে আমার গলা শুকিয়ে আসে। আমি কিছু বলতে তার আগেই রোয়েন চিঠি ভাঁজ করে নিজের পকেটে রেখে গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
— চলো!
কথাটা বলে উনি সামনের দিকে এগিয়ে যান। আর এইদিকে তাঁর এমন কন্ঠ শুনে আমার শরীরে কাঁপন ধরে যায়। মনে মনে ভাবতে থাকি, “এইটাই বুঝি ঘূর্ণিঝড় আসার আগের পূর্বাভাস?” আমি যখন কথাটা ভাবছি তখনই রোয়েন থেমে পিছে ঘাড় ঘুরে আবার বলে উঠেন,
— কি হলো চলো।
আমি কোনমতে মাথা দুলিয়ে রোয়েনের পিছু পিছু যেতে শুরু করি। না জানি আজ ভাগ্যে কি আছে।
#চলবে
#নিভৃতে_যতনে
#Part_35
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
নীলাভ আকাশে একভাগ আজ হলদে-সোনালির রঙে সজ্জিত। হলদেটে সূর্যটি নিস্তেজ হয়ে ধীরে ধীরে হেলে পড়ছে পশ্চিমাকাশের বুকে। পাখিদের হট্টগোল এখনো বিদ্যমান। মৃদু আলোর ঝলকানিতে আমি আড়চোখে বার বার রোয়েনকে পর্যবেক্ষণ করছি আর চুলে হাতখোপা করছি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে এখন সন্ধ্যা হতে চললো অথচ রোয়েন এখনো শান্ত। সে দিব্যি ল্যাপটপ চালিয়ে যাচ্ছেন। এমন এক ভাব যেনো কিছুই হয়নি। বুঝতে পারছি না এর মতিগতি। আদৌ ওইটা কোন প্রেমপত্র ছিল কি? যদি সেটা প্রেমপত্র না হয় তাহলে রোয়েন ওইটা আমায় ফেরত দিলো না কেন? আর যদি প্রেমপত্রই হয় তাহলে এই ব্যাটা শান্ত কেন? নিজের একমাত্র বউয়ের জন্য প্রেমপত্র এসেছে তা দেখামাত্র তো মাথা গরম হয়ে যাওয়া উচিৎ। জেলাসিতে জ্বলে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়ার কথা। কাহিনী কি রে ভাই? চিঠিটাতে ছিলো টা কি? রোয়েনকে যে চিঠিটা নিয়ে প্রশ্ন করবো সেই স্পর্ধা আমার নেই।
আমি যখন আমার আপন ভাবনায় মগ্ন তখন এক পুরুষালী কন্ঠ কর্ণধারে এসে বারি খেতেই আমি সচকিত দৃষ্টিতে তাকাই।
— এইখানে এসো।
আমি একপলক রোয়েনের দিকে তাকিয়ে ভালোমত করে খোপা করে নেই। অতঃপর ধীর পায়ে এগিয়ে যাই উনার দিকে। তাঁর সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি মুখ তুলে আমার দিকে তাকান। স্বাভাবিক কন্ঠেই বলেন,
— সেই চিঠিতে কি ছিল জানতে চাইবে না?
কথাটা শোনামাত্র আমার বুক ধক করে উঠলো। নয়নযুগল আপনা-আপনি বড় হয়ে আসে। আমি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁটযুগলটি ভিজিয়ে নিয়ে অস্ফুটস্বরে বলি,
— না মানে হ্যাঁ…
তিনি নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠেন,
— আমার জিন্সের বা সাইডের পকেটে তোমার চিঠিটা আছে। যাও সেটা নিয়ে আসো।
আমি কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে এগিয়ে যাই বারান্দার দিকে। পকেট থেকে চিঠিটা বের করে পুনরায় ফেরত আসি তাঁর কাছে। উনি ল্যাপটপের স্ক্রিনে দৃষ্টি স্থির রেখে বলেন,
— পড়ো!
আমি বুকভরা নিঃশ্বাস নিয়ে চিঠির ভাঁজটা খুলি। চিঠির ভাঁজ খুলতেই বুঝা গেল আসলেই এইটা একটা প্রেমপত্র। শুধু যে প্রেমপত্র তা নয়, এ যেন এক বিশাল রচনা। আগে জানতাম মানুষ খালি ‘গরুর’ রচনাই বড় করে লিখতে পারে কিন্তু এখন তো দেখছি এরা জীবন্ত মানুষকে নিয়েও ‘গরুর’ মত রচনা লিখে ফেলছে। আমি কিছুক্ষণ হতভম্ব দৃষ্টিতে চিঠিতে চোখ বুলালাম। অতঃপর পড়তে শুরু করতাম,
” প্রিয় প্রেয়সী,
আজ তোমায় কিছু কথা বলতে চাই। কথাগুলো কিন্তু তোমার জানা অতিব জরুরি। জানি না এরপর তোমার রিয়েকশন কি হবে? আদৌ তুমি আমার অনুভূতির গভীরতা বুঝবে কি-না। কিন্তু আমি আর কথা লুকিয়ে রাখতে পারি না। তাই সরাসরি ভাবেই বলছি।
মাস খানিক হলো তোমার মায়াতে পড়ে আটকে গিয়েছি আমি। তোমার কথার মায়াজালে বাজে ভাবে ফেঁসে গিয়েছি আমি। তোমার হাসির ঝংকার কেড়ে নিয়েছে আমার ঘুম। তোমার চোখ দুইটির গভীরতায় ডুবে গিয়েছি আমি৷ সারাক্ষণ মন আমার এখন তোমার কিনারাতেই থাকে। জানি না কেন, তোমার সাথে কথা বলতে মন চায় বার বার। তোমাকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয় বারংবার। তোমার এক ঝলকই যথেষ্ট আমার মুখে হাসি ফুটাতে। তোমার জন্য আমার মনে রয়েছে এক অন্যরকম অনুভূতি। যা কখনো কোন মেয়ের জন্য হয়নি। জানি না কিভাবে কেমনে তোমার মায়াতে নিজেকে জড়িয়ে গিয়েছি আমি আর সেই মায়া যে কখন ভালবাসায় পরিনত হয় তা বুঝতে পারিনি। হ্যাঁ ভালবেসে ফেলেছি আমি তোমায়। বড্ড বেশি ভালবেসে ফেলেছি। জানি না, তুমি বিষয়টা কিভাবে নিবে, কিন্তু তোমার হাত ধরে নদীর তিরে হাটতে চাই, তোমায় নিয়ে চন্দ্রবিলাস করতে চাই, রাতের পর রাত জেগে কাটাতে চাই, তোমার সাথে সারাজীবনের জন্য তোমার এই হাতটি ধরে পারি দিতে পুরো জীবন। দেবে কি অনুমতি আমায়, তোমার হাতটি ধরার? গ্রহণ করবে কি আমার ভালোবাসা? কথা দিচ্ছি কখনো তোমায় নিরাশ করবো না। সবসময় নিজের ভালোবাসার চাদরে তোমায় মুড়িয়ে রাখবো। শুধু একবার ভরসা করে হাতটি ধরো।
তোমার উত্তরে অপেক্ষায় রইলাম। চিন্তা নেই তোমায় আমায় খুঁজতে হবে না, আমি নিজেই এসে তোমার সামনে ধরা দিব।
ইতি
তোমারই কাছের একজন ”
চিঠিটা পড়ে আমার বিষম খাওয়ার মত অবস্থা। ভনভন করে মাথা ঘোরাচ্ছে। ভাই রে ভাই! এইটা চিঠি ছিল নাকি বস্তা ভরা অনুভূতির দোকান? আর কিসব থার্ডক্লাশ মার্কা ডায়লগ দেওয়া। আর কথার কি শ্রী। ছিহ! মানে আমাকে কি বাংলা সিনেমার সাবনূর পেয়েছি নাকি যে এমন থার্ডক্লাশ মার্কা চিঠি পেয়ে আমি গলে টলে বাতাসে শাড়ির আঁচল উড়িয়ে দৌড়ে যাব চিঠির পিঠে হ্যাঁ বলতে? হাস্যকর! মানে লাইফে ফাস্ট প্রেমপত্র পেলাম তাও নাকি এমন থার্ডক্লাশ মার্কা? তার উপর চিঠিটা রোয়েন আগেই পড়েছে। না জানি উনি কি ভাবছেন আমাকে নিয়ে। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে আমার। ইশশ! রোয়েনের হাতেই এই বাকওয়াস চিঠিটা পড়তে হলো? সিয়াশা এই মুখ তুই এখন তাঁকে কিভাবে দেখাবি? তোর উচিৎ এখনই এক গ্লাস পানিতে ডুবে মরার।
আমি যখন এইসব আকাশ-পাতাল চিন্তা-ভাবন করছি তখন রোয়েন গলা ঝেড়ে বলে উঠে,
— পড়া শেষ?
সাথে সাথে আমি আমার স্তম্ভিত ফিরে পাই। চকিত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাই। তারপর স্বতঃস্ফূর্ত স্বরে বলি,
— আমি জানি না এইটা কে দিয়েছে। সত্যি বিশ্বাস করুন।
রোয়েন নিজের কোল থেকে ল্যাপটপটা রাখতে রাখতে বলেন,
— তো আমি কখন বললাম তুমি জানো?
মুহূর্তেই আমি মূর্ছা যাই। মুখে কিছু প্রকাশ না করলেও চিঠি প্রেরকের উপর আমার এখন আকাশ সমান রাগ হচ্ছে। সামনে পেলে পুরো বাঁশবাগানের বাঁশ ওই ব্যাটার মাথার উপর ফাটিয়ে দিতাম। বেয়াদব একটা! ক্ষোভে কখন যে হাতের মুষ্টির তলে চিঠিটা বিষিয়ে ফেলি বুঝে উঠতে পারি না। হঠাৎ রোয়েন আমার ঠিক সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে উঠেন,
— ইশশ! চিঠির কি হাল করেছ। বেচারার শত অনুভূতি এইভাবেই হাতের মুঠোয় বিষিয়ে দিলে?
তৎক্ষনাৎ আমি ভড়কে উঠে। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি রোয়েনের মুখ পানে। কোনমতে জিহ্বা দিতে ঠোঁটযুগল ভিজিয়ে নিয়ে মেকি হাসি দিয়ে বলি,
— তো কি করবো? মনের সিন্দুকে যত্নসহকারে তুলে রাখবো?
রোয়েন আমার দিকে এক কদম এগিয়ে আসতেই আমি দুই কদম পিছিয়ে যাই। রোয়েন আমার দিকে আরেক কদম এগিয়ে আসতে আসতে বলেন,
— রাখতে ইচ্ছে করলে রাখো। মানা করেছি নাকি?
আমি পিছনে যেতে যেতে বলি,
— নিজের স্ত্রীকে বলছেন পরপুরুষকে নিজের মনে জায়গায় দিতে?
— কেন বলতে পারি না?
আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই আমি পিছাতে পিছাতে কাবার্ডের সাথে লেপ্টে যাই। কিছু বুঝে উঠার আগেই, রোয়েন আমার দুইপাশে হাত রেখে আমাকে তার বাহুদ্বয়ের মাঝে আবদ্ধ করে নেন। আমি একপলক তাঁর দিকে মাথা নুইয়ে ফেলি৷ মিনমিনে গলায় বলি,
— অদ্ভুত তো আপনি। আপনার জায়গায় এখন অন্য যে কেউ হলে কেলেংকারী লাগিয়ে দিত। জেলাস হতো। আর আপনি কি-না..
রোয়েন আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলেন,
— সবাই আর আদনাফ জুহায়র রোয়েন এক না। বুঝলে!
আমি এইবার স্বগতোক্তি গলায় বলে উঠি,
— সিরিয়াসলি! আপনি জেলাস না? একটুও খারাপ লাগেনি আপনার? অন্যের কথা বাদই দেন, আপনার জায়গায় আমি থাকলে হয়তো….
কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম আমি৷ মুখ ফোসকে যে কি বলে ফেলেছি তা ভাবতেই লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছি আমি। ভাগ্যিস পুরো বাক্যটা শেষ করার আগেই ফুলস্টপ লাগিয়েছি নাহলে আজ লজ্জায় আমি নির্ঘাত ইন্তেকাল করতাম। আমায় চুপ করে যেতে রোয়েন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন,
— হয়তো কি?
আমি নতজানু হয়ে বলি,
— কিছু না।
— ওকে! কিন্তু তোমার কেন মনে হলো আমার এইসব দেখে জেলাস বা কষ্ট পাওয়া উচিৎ?
আমি অস্ফুটস্বরে বলি,
— এইভাবেই।
উনি স্বাভাবিক কন্ঠেই বলেন,
— তুমি কি পালিয়ে গিয়েছ নাকি অন্যের বাচ্চার মা হয়ে গিয়েছ যে আমি জেলাস ফিল করবো অথবা কষ্ট পাবো?
আমি আঁতকে উঠে বলি,
— আস্তাগফিরুল্লাহ! কিসব কথা।
রোয়েন পুনরায় আমার কানের সামনে এসে ফিসফিসিয়ে বলেন,
— আমার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটার উপর শুধু আমার অধিকারের দলিল লিখিত,যা আছে,থাকবে এবং সম্পূর্ণ রুপে আমার’ই থাকবে। তার প্রতিটা শ্বাস আমার জন্যই মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বলবে,আমি তোমার,আমি তোমার! তাই,আমার জেলাস ফিল করার প্রশ্নই উঠে না,গোট ইট।
কথাটা বলেই তিনি সটান হয়ে দাঁড়ান। মুহূর্তেই আমার গাল দুইটির মাঝে ছেঁয়ে যায় রক্তিম লালাভ আভা। মানুষটা প্রত্যেকবার অপ্রকাশ্যভাবেই নিজের অধিকারটা বুঝিয়ে দেয়। আমার প্রতি তাঁর অনাগত অনুভূতির গভীরতা নিমিষেই বুঝিয়ে দেন তিনি। রোয়েন বিছানার কাছে যেতে যেতে বলেন,
— বউ যাদের সুন্দর তাদের নিকট হাজার হাজার প্রেমপত্র আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়,বরং না আসাটাই অস্বাভাবিক।
কথাটা শোনা মাত্র আমার কান গরম হয়ে আসে। দুই গালের মাঝে বিদ্যমান লালাভ আভা প্রগাঢ় হয়ে আসে৷ লজ্জায় মিইয়ে যাই আমি। বিয়ের পর এই প্রথম রোয়েন আমার প্রশংসা করলো। কথার ছলে বুঝিয়ে দিল আমি সুন্দর। আজ নিজেকে এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারী মনে হচ্ছে। প্রচন্ড রকমের প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে মনের দুয়ারে।আসলেই, প্রিয় মানুষটির প্রশংসায় যে প্রশান্তি মিলে তা আর কোথাও মিলে না।
#চলবে