১৩দশ পর্বের পর থেকেঃ-
”নিরব সে”
#সাদিয়া_সৃষ্টি
১৪দশ পর্ব
সূর্যের আলো চোখে পড়তেই চোখ ধীরে ধীরে খুলতে থাকে জিনিয়া। নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করতেই অবাক হয়। ধীরে ধীরে উঠে বসে। দুই হাত দিয়ে নিজের চোখের কাছে নিয়ে যায় চোখ মুছতে। তখন মনে পড়ে ওয়াফিফের কথা।
”অকারনে কখনো চোখে হাত দিবে, বিশেষ করে মোছার জন্য। জানো এতে করে কত জীবাণু চোখে পড়তে পারে। তাছাড়া আমাদের চোখ অনেক সেনসিটিভ জায়গাগুলোর মধ্যে একটি। যদি নিজের খেয়াল না রাখতে পারো তাহলে পরে সমস্যা হবে। আমার মতো চশমাও পরা লাগতে পারে।”
কথাটা মনে পড়তেই আনমনে হেসে উঠল জিনিয়া। ওয়াফিফের বলা প্রতিটা কথা তার যেন মুখস্ত হয়ে গিয়েছে। ডাক্তার হওয়ায় যতক্ষণ জিনিয়ার সাথে থাকে, উঠতে বসতে খেয়াল রাখে আর নানান কথা বলে। জিনিয়ার নিজের ইচ্ছা ছিল মেডিকেলে পড়ার। কিন্তু চান্স পায় নি। আর তখন টাকার অভাব ও ছিল তাদের পরিবারে। তাই সে আর্টস নিয়ে পড়াশোনা করে আর পাশাপাশি টিউশনি করে। ইচ্ছা ছিল এমএ পাশ করে চাকরি খোঁজার। তবে তার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। আর ওয়াফিফের মতো মানুষের দেখা মিলে তার।
ওয়াফিফের কথা মনে আসতেই আবার মনে পড়ে কাল রাতের কথা। সে নিজের শাড়ি ঠিক করে একবার দেখে নিয়ে উঠে পড়ে। এতক্ষণ সে এক বারও পাশে তাকায় নি। কাল রাতে সে জানালার কাছে বসে থেকেই রাত কাটিয়ে দিয়েছিল কি না সেটাও মনে নেই। আবার মনে পড়ল রাতে ডাইনিং টেবিলের উপর খাবার রেখে দিয়েছিল। সেটাও সরানো হয় নি। বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল জিনিয়া? ভাবতেই নিজের অবাক লাগে । সে কখনো বসে বসে ঘুমায় নি। ছোট থাকতে চেষ্টা করেছিল ঠিকই। কিন্তু পারে নি। মায়ের বকা শুনে বিছানায় শুয়ে পড়তে হত। আর তারপর যত বড় হতে থাকে, এসব বিষয় মাথা থেকে ততই চলে যেতে থাকে। যেন অনেক দিনের বালু এসে জমে যায় সেসব স্মৃতির উপর। আবার যখন হঠাৎ তেমন একটি ঘটনা ঘটে তখন মনে হয়, এক জোর হাওয়া এসে সেই বালু উড়িয়ে নিয়ে যায়। তেমনটাই লাগল জিনিয়ার। সে ভাবনার মধ্যেই আগে রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে পা বাড়াল। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখে সব ঠিকঠাক ভাবেই আছে। টেবিলে কিছুই নেই। ফ্রিজের কাছে গিয়ে সেটা খুলতেই রাতে রান্না করা খাবার গুলো তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। তার মনে পড়ছে না যে রাতে সে কখন এসব কাজ করল? সে কি আদৌ ঘর থেকে বের হয়েছিল? কারণ অতো সকালে কেউ উঠে না। আর রাতে একবার সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর সে দেখে গিয়েছিল। সব ঠিকই ছিল সেখানে। নিজের মাথায় হাত দিয়ে হালকা মারে জিনিয়া। তবু কিছু মনে না পড়লে আবার নিজের রুমে ফিরে আসে। আসতেই চোখে পড়ে বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটাকে। এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে তার মুখে।
ওয়াফিফ কাৎ হয়ে শুয়ে ছিল। এবার তার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে উঠে। কে করেছে এসব কাজ বা করতে পারে? সে হাসি মুখে এগিয়ে যাওয়ার আগে চোখে পড়ে টেবিলে রাখা বাটি আর রুমালের দিকে। যেটা তখনও পানিতে ডুবানো। আর পাশে কিছু ওষুধ রাখা। সাথে সাথে চিন্তার রেশ ফুটে ওঠে তার মুখে হাসি সরে গিয়ে। সে নিজের এক হাত কপালে গালে আর গলায় ঠেকিয়ে নিজের তাপমাত্রা মাপার চেষ্টা করে। শরীরের তাপমাত্রা হালকা বেশি দেখতেই খারাপ লাগা কাজ করে তার মধ্যে। ওয়াফিফ সারাদিন কাজ করে এসে তার যত্ন করেছে রাতে আবার? তাও ক্লান্ত শরীরে? এরপর খাবার ও সরিয়ে দিয়েছে। নিজে খেয়েছে কিনা তার কোন ঠিক নেই। নিজেরই খারাপ লাগে জিনিয়ার। সে ওয়াফিফকে ডাকতে গিয়েও ডাকে না। ওয়াফিফ কত রাত করে ঘুমাতে গিয়েছে কিংবা আদৌ রাতে ঘুমিয়েছে কি না – সেই চিন্তায় আর ডাকল না তাকে। সে সোজা বাথরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে।
ওয়াফিফের ঘুম ভাঙল তার কিছুক্ষণ পরেই। সে মাথা থেকে হাত সরিয়ে আশেপাশে তাকাল। নিজের পাশে জিনিয়াকে না পেয়ে আশেপাশে খোঁজ চালায়। বাথরুম থেকে পানির শব্দ আসতেই শান্ত হয়ে উঠে বসে। দুই হাত দিয়ে সে তার মাথা চেপে ধরে। ঘুম ঠিক মতো হয় নি কয়েকদিন ধরে। তার উপর গত রাতেও ঘুম হল না তার। ভোরের দিকেই ঘুমিয়েছিল। কিন্তু অভ্যাস বশত বেশি সময় ঘুমিয়ে থাকতে পারল না। তাই দ্রুতই উঠে পড়ল সে। কিন্তু গত কয়েকদিনে ক্লান্তির পর এই কম পরিমাণ ঘুম তার জন্য সুবিধার ঠেকল না। সে নিজের মাথা দুই হাত দিয়ে চেপে ধরল। আর গত রাতের কথা মনে করার চেষ্টা করল।
গত রাতে বাড়ি ফিরতেই সে সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে এই ভেবে চাবি দিয়ে দরজা খুলেছিল। ভেতরে ঢুকে দেখল সব রুম অন্ধকার। তাই ভেবেছিল সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে। নিজের ঘরে গিয়ে লাইট জ্বালাতে গিয়ে থেমে গেল সে। জিনিয়া তখনও জানালার কাছে বসে ছিল। চাঁদের আলোয় তার মুখটা স্পষ্ট বোঝা না গেলেও ভালোই লাগছিল দেখতে। রাস্তার লাইটের আলো কিংবা আশেপাশের বাড়ির সিঁড়ি ঘরের আলোয় ওয়াফিফের পুরো রুমে এক আলাদা পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। নিজের হাত থেকে এপ্রোন টা বিছানায় ফেলে দিয়ে সে জিনিয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়াল আর যেই না কপালে হাত দিল ছোট চুল গুলো সরাতে, অমনি সে বুঝে গেল জিনিয়ার হালকা জ্বর এসেছে যেটা বাড়তে পারে। তাই তখন জিনিয়াকে সেখান থেকে সরাতে নিজের কোলে তুলে বিছানায় ঠিক মতো শুইয়ে দেয় আর চাদর দিয়ে ভালো করে মুড়ে দেয় তাকে। রান্নাঘর থেকে একটা বাটি আনে আর নিজের ড্রয়ার থেকে একটা রুমাল বের করে সেটা দিয়েই জল পট্টি দিতে থাকে আর কিছু সময় পরপর জিনিয়ার শরীরের তাপমাত্রা দেখতে থাকে। অনেকটা সময় পর জিনিয়ার তাপমাত্রা কমলে সে অনুভব করে তার ক্ষুধা লেগেছে। আর সে হাসপাতাল থেকে ফিরে হাত মুখ ও ধোয় নি। তাই ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে লাইট জ্বালাতেই খাবার গুলো দেখতে পায়। কিছু সময় ভাবতেই বুঝতে পারে যে জিনিয়া কেন তার অপেক্ষা করছিল। তবে সেদিন যে জিনিয়ার জন্ম দিন ছিলে সেটা ওয়াফিফ জানত না। সে ভেবেছিল জিনিয়া হয়তো আবার কোন নতুন রান্না শিখেছিল। সেটা টেস্ট করাতেই ওয়াফিফের অপেক্ষা করছিল। তাই সে নিজের মতো একটু খেয়ে বাকি সব গুছিয়ে রাখে। তারপর নিজেও ঘুমাতে যায়।
ওর ভাবনার মাঝেই দরজা খোলার আওয়াজ পায় ওয়াফিফ। জিনিয়াকে অনেক দিন পর এভাবে ভেজা চুলে দেখল সে। আগের কয়েক দিনে সে জিনিয়ার সাথে ঠিক মতো দেখা করতে পারে নি। আর না পেরেছে কথা বলতে। কাজের চাপ বেশি ছিল এমনটা বলা যায় না। তবে সে নিজে অনেক ব্যস্ত ছিল। তাই জিনিয়াকে দেখে মনে হচ্ছে অনেক দিন পর দেখল সে। অবাক হয়েই সেদিকে তাকিয়ে থাকল। মেয়েটাকে সে ভালোবাসে কি না জানা নেই ওয়াফিফের। তবে সে রোজ নতুন করে এই মেয়ের মায়ায় জড়িয়েছে। নতুন করে জিনিয়াকে চিনেছে। নতুন করে অবাক ও মুগ্ধ হয়েছে জিনিয়াতে।
–আপনি উঠে পড়েছেন? আরেকটু ঘুমাতেন।
জিনিয়ার ডাকে চিন্তার জগত থেকে বেরিয়ে এসে ওয়াফিফ উত্তর দেয়,
–হ্যাঁ হ্যাঁ। এখনই উঠলাম।
–ওহ, আমি আপনার কফি এনে দিচ্ছি।
বলেই জিনিয়া চলে গেল। এক কাপ কফি বানিয়ে ফিরে এসে সে দেখল ওয়াফিফ ঘরে নেই। হয়তো বাথরুমে ভেবেই কাপ টা টেবিলে রাখতে গিয়ে দেখল টেবিলের উপর একটা ছোট বক্স রাখা। খুশিতে তার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। সে ভাবল ওয়াফিফ হয়তো তার জন্যই এনেছে সেটা। না চাইতেও সে বক্সটা খুলে দেখল। বক্সে একটা নেকলেস রাখা। সে সেটা ধরতে গিয়েও ধরল না। মনে সংকচ নিয়ে সে বক্সটা বন্ধ করে আগের মতো রেখে দিল। আর মনের খুশিতে রান্না ঘরে চলে গেল। জিনিয়া সকালে নাস্তা নিজেই বানায়। আর দুপুরে আর রাতের রান্নায় ভাবিকে সাহায্য করে। মাঝে মাঝে নিজেই রান্না করে তবে সেদিন ওয়াফিফের কাছে বকা খেতে হয়। কিন্তু জিনিয়া এই বকাটাও অনেক মনোযোগ দিয়ে শোনে। যেন ওয়াফিফ কোন গুরুতেপুরন লেকচার দিচ্ছে তাকে। জিনিয়া পারে না ওয়াফিফের বলা সব কথা নোট আকারে লিখে রাখতে !
ওয়াফিফ অন্যান্য দিনের মতো সেদিন ও হাসপাতালে ঠিক সময়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে জিনিয়াকে বলে গেল অপেক্ষা না করতে। আগের বার অপেক্ষা করতে গিয়ে জ্বর বাঁধিয়েছিল। আর যেন তেম না করে। আর ওর কাজের চাপ একটু বেশি। তাই তার বাড়ি ফিরতে দেরি হতে পারে।
।
।
আরও বেশ কিছু দিন এইভাবেই চলল। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে যে কেউ বলবে জিনিয়া আর ওয়াফিফের ভেতরে কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু আসলে তেমন কিছুই না। সেই নেকলেস আর জিনিয়া পায় নি। প্রথম দিকে এই নিয়ে ভাবলেও পরে ভুলে গিয়েছে। হয়তো অন্য কারো জন্য কিনেছি ওয়াফিফ। কিন্তু কার? এই চিন্তা করতে গিয়েও করে নি সে। বিনা কারণে এই চিন্তা করলে সে কি থেকে কি ভাববে আর ওয়াফিফ কে ভুল বুঝে বসবে। এর থেকে চিন্তা না করাই ভালো। তবে ওদের মধ্যে কথা খুব কম হয়। আগের মতো একদমই না। ওয়াফিফ জিনিয়ার খেয়াল ঠিকই রাখে কিন্তু কথা টা। এই এক জায়গায় সব আটকে যায়। জিনিয়া যখন মনে করে যে ওয়াফিফ তাকে ইগনোর করেছে তখনই তার জাবিরের কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু পরে নিজেকে নিজেই বলে সে- ওয়াফিফ এমন করতেই পারে না।
কিন্তু হঠাৎ করে জাবিরের আগমন ঘটে। শেষ কয়েক দি ধরে জাবির জিনিয়ার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। ফোন নাম্বার আগে থেকেই ছিল। আর কোন এক ভাবে ওয়াফিফের বাড়ির ঠিকানাও বের করেছে সে। জিনিয়া এসব কথা ওয়াফিফ কে চাইলেও জানাতে পারছে না। পারবে কি করে? ওদের মধ্যে তো তেমন কথাই হয় না।
চলবে।
[রিচেক করি নি, ভুলগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ]
Sadia Hq Sr.