১৪শ পর্বের পর থেকেঃ-
”নিরব সে”
#সাদিয়া_সৃষ্টি
১৫শ পর্ব
হাতে ফোন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জিনিয়া। একবার নেড়েচেড়ে দেখছে। একবার ফোন অন করছে, আবার অফ করে রেখে দিচ্ছে। আবার সেটা হাতে নিয়ে ঘরের এ মাথা থেকে ওমাথা হেঁটে বেড়াচ্ছে। একই কাজ বার বার করছে। বার বার ভেবে চলেছে ওয়াফিফ কে ফোন দিবে কি না। আজ পর্যন্ত একবারও সে ওয়াফিফকে কল দেয় নি। দরকার পড়লে মিলা মিনা আরিফ ফোন দিত, আর এদের কাউকে না পেলে সুফিয়া ভাবি তো আছেই। সে কল করে। কিন্তু ওয়াফিফের সাথে গত কয়েক দিন ধরে ঠিক মতো কথা না হওয়ার আজ তার মাথায় এই কথাই আসলো। ওয়াফিফের সাথে ফোনে কথা বলার। কিন্তু দিবে কি না এটাও চিন্তার বিষয়। হাতে নিয়ে এদিক ওদিক হেতেও শান্তি পাচ্ছে না সে। তাই হাতে নিয়ে ফোন দিতে যাবে এমন সময় একটা নাম্বারে ফোন এলো তার মোবাইলে। সে নাম্বার টা দেখেই চিনতে পারল। যার কথা সে ওয়াফিফকে জানাতে চাচ্ছিল, সে নিজেই ফোন করেছে। ফোন টা তুলতে চাইছে না জিনিয়া। আবার কাটতে গিয়েও দ্বিধায় পড়ছে। কল কেটে দেবে না কি দেবে না। যদি কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকে। এই ভেবে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। যেন আপনাআপনিই কল কেটে যায়। তাই হল। জিনিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললেও আবার সেই নাম্বারে কল এলো। জিনিয়া আর না পেরে কল রিসিভ করল। ফোনের ওপাশ থেকে ধীর আওয়াজ ভেসে এলো তার কানে। জাবিরের কণ্ঠে অনুতাপ স্পষ্ট। কিন্তু সেদিকে খেয়াল করল না জিনিয়া।
আগে অনেক এমন হয়েছে জাবিরের কলের অপেক্ষা করেছে। রাএ জেগে অনেক গল্প করেছে। আগে অনুভূতিটাই এমন ছিল যে জাবিরের আওয়াজ শুনলেও মনে এক আলাদা অনুভূতি কাজ করত, যার নামকরণের চেষ্টা কখনই করে নি জিনিয়া। কারণ সে আওয়াজ সারাজীবন শুনতে পারবে – এমনটাই ভেবেছিল সে। কিন্তু এখন আর সেই আওয়াজে মনের মধ্যে সেই আগের মতো অনুভূতির সৃষ্টি হয় না। তবে বিরক্তিও কাজ করে না। যাই হোক না কেন, একটা সময় তাকে তো মন থেকেই ভালবেসেছিল। হয়তো এখনো মসেই অনুভূতি শেষ হয়ে যায় নি। মনের এক কোণে লুকিয়ে রয়েছে। যেটাকে চাপা দিয়ে রেখেছে জিনিয়া। বের করতে চায় না সে। নাহলে তো সে দুর্বল হয়ে পড়বে। আর সে আবার দুর্বল হতে চায়। আজ আবার যদি আবেগে ভেসে গিয়ে কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে তাহলে নিজেকে নিজে ক্ষমা করতে পারবে না সে ।
–জিনিয়া, শুনতে পারছ আমার কথা?
–হ…হা… হ্যাঁ ।
–কেমন আছো জিনিয়া?
–আলহামদুলিল্লাহ্।
–আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবে না? কথা বলছ না কেন? আমার সাথে কি এখন আর কথা বলতেও ইচ্ছে করে না তোমার? আমি কি সত্যিই তোমার মন থেকে একেবারে হারিয়ে গিয়েছি? সেদিন ও আমার পুরো কথা সুনলে না। এতদিন ধরে কথা বলার চেষ্টা করছি তাও ফোন ধরছ না। আমাকে একটি বার কি ব্যাখ্যা করার সুযোগ দেওয়া যায় না?
–না, অনেক দেরি করে ফেলেছ তুমি।
–কিন্তু তুমি চাইলেই সব ঠিক করতে পারো। আমি নিজেই তখন নিজের মধ্যে ছিলান না জিনিয়া। দেখো তোমার কথা অনুযায়ী জান বলাটাও ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি এই ৩ মাসে। তোমার দায়িত্ব নেওয়ার মতো করে নিজেকে গড়ে তুলেছি । তুমি তো তাও আমার সাথে যোগাযোগ না রাখার চেষ্টা করো সবসময়। কিন্তু তোমার মনে কি আমি এখন আর একটুর জন্যও নেই?
–জা…জানি ন…না।
–আমি নিজেই ওই ৫ মাস নিজের মধ্যে ছিলাম না। জিনিয়া, আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারি নি, বিশেষ করে তরুণ এর কথায় আমি নিজেই হারিয়ে যাচ্ছিলাম, আমাকে অন্য কিছু বোঝানো হচ্ছিল, আমিই নিজেই সেই কথা ধরেই এগিয়ে চলেছিলাম। কিন্তু আমার ভালোবাসা মিথ্যে ছিল না, এটা তোমার থেকে ভালো আর কেউ জানে না। গত ৩ বছরে কি আমার আচরণ দেখেও বুঝতে পারো নি তুমি যে আমি তোমাকে কত ভালোবাসি? তাও আমাকে সুযোগ দিচ্ছ না সব কিছু ঠিক করার, কেন জিনিয়া? সুযোগ তো মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামী কে ও দেওয়া হয়, তাহলে আমাকে কেন নয়? আমি নিজেকে বোঝাতে চাইছিলাম। একবার এক্সপ্লেইন করতে দিলে আমি সব ঠিক করে দিতাম। কিন্তু তুমি চলে গেলে। তোমার থেকে আলাদা থেকেও আমি ওই ৫ মাস ভালো ছিলাম না, আর না এখন আছি। আমি জানি তুমিও ভালো নেই, আমার থেকে বেশি তোমাকে আর কে চিনে বল? আমি জানি তুমি কেমন আছো, তোমার চেহারা দেখেই আমি সব বলে দিতে পারি। আমাকে কি একটা সুযোগ দেওয়া যায় না? আমি সব ঠিক করে দি, কথা দিচ্ছি।
–তরুণকে দোষ দিও না । সব ঠিক ই আছে, আর ঠিক করার কিছু নেই, তুমি তোমার জীবনে ভালো আছো, আমিও আমার জীবনে ভালো আছি, এতে সুযোগ দেওয়ার কিছু নেই। আর ডাক্তার সাহেবের সাথে, মানে ওয়াফিফের সাথে আমি ভালো নেই সে কথা কে বলেছে তোমায়? উনি খুব ভালো মানুষ, আমাকে সব ভাবেই মেনে নিয়েছে, আমার যত্ন করে। তোমার কিছুই ঠিক করার দরকার নেই। আর হ্যাঁ, এখনো যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে বলে রাখি, আমি প্রেগন্যান্ট, আর আমাকে কল করো না এসব কথা বলতে। নিজে একটা ভালো দেখে মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিও আর সুখে জীবন যাপন করো। তবে কাউকে আর ঠকিও না।
–এবার ও আমার কথা পুরোটা সুনলে না। শুনলে হয়তো বুঝতে পারতে, আমার জায়গায় আমি ঠিক ছিলাম। সবটা আমাকে শুনিয়ে দিয়ে আমাকেই দোষী করে দিলে জা.. সরি, জিনিয়া। আমি অবশ্যই তোমাকে সব না জানানোর পর্যন্ত থেমে থাকব না। তোমার সাথে কথা বলার সুযোগের অপেক্ষায় থাকব, চেষ্টা করব। আমি জানি তুমি আমাকে এখনো ভুলে যাও নি। অমন মেয়ে তুমি না। আর তোমার এই গুনটাই আমাকে মুগ্ধ করেছিল আর এখনো করে।
–আমি কাউকে ম…মনে রাখি নি।
–সেটার উত্তর তুমি নিজেই জানো। নিজেকে ভুল বুঝিও না। পারলে নিজের মনের কথা শুনে আমার কাছে চলে এসো। এতে আমরা ২ জনই ভালো থাকব, দরকার হলে তোমার সন্তান কেও মানতে রাজি আছি আমি। ওকে আমার নিজের সন্তানের মতই বড় করব…
–রাখছি, আর কখনো কল করবে না।
বলেই জাবিরের আর কথা না শুনে ফোন কেটে দিল। আজও জিনিয়া কে বুঝতে পারল না ঠিক করে। এতটাই যখন জানে যে জিনিয়া জাবিরকে ভালোবাসে তাহলে জাবির কি করে বিশ্বাস করতে পারল যে জিনিয়ার গর্ভে ওয়াফিফের বাচ্চা। এতদিন না জাবির দাবি করত যে জিনিয়াকে সবচেয়ে ভালো করে চেনে জাবির, তাহলে কোথায় গেল তো চিন্তা শক্তি? বিশ্বাস টুকুও নেই তো আজ। আচ্ছা, জাবির তরুণের কথা কেন তুলল? তরুণ কি এমন করেছিল যে জাবির তরুণের কথায় জিনিয়ার থেকে দূরে ছিল?
এসব আর ভাবতে ইচ্ছা করল না জিনিয়ার। সে ফোন হাতে নিয়ে ওয়াফিফ কে ফোন করল। দুই বার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে ওয়াফিফের আওয়াজ ভেসে এলো।
–হ্যালো।
ওয়াফিফের এর কণ্ঠে ক্লান্তি প্রকাশ পাচ্ছে। জিনিয়া বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল,
–ডাক্তার সাহেব।
ওয়াফিফের কি হল জানা নেই, তবে ওর মুখে একটা বড় হাসি ফুটে উঠল, ওয়াফিফের সামনে বসে থাকা ৩ জন মানুষের মধ্যে এক জন বেশ অবাক হল ওয়াফিফের এই হাসি দেখে। ওয়াফিফ কার কথা শুনে এভাবে হেসে উঠল, ভাবতেই নিজের হাত মুঠোয় পুরে নিল সে। নিজের কিঞ্চিৎ লম্বা নখের কারণে হাতে দাগ বসে গেল। তবুও সে ওয়াফিফের দিকে তাকিয়ে রইল।
ওয়াফিফ সাধারণভাবেই জবাব দিল,
–বল, কি হয়েছে? আজ কিন্তু প্রথমবার তুমি আমাকে কল করলে।
জিনিয়ার এতক্ষণ যে চিন্তায় মাথা ব্যথা শুরু হয়েছিল সেটা মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেল। তার জায়গায় মনে এক প্রশান্তি কাজ করল। তবে এর পাশাপাশি মনে চিন্তাও হানা দিল। ওয়াফিফের যে কতটা ক্লান্ত সেটা অয়াফিফের আওয়াজ শুনেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কেন? বুঝতে পারল না জিনিয়া। সামনের আয়নায় চোখ পড়তেই নিজেকে দেখে অবাক হল জিনিয়া। তার কান লাল হয়ে গিয়েছে। ওয়াফিফের সাথে ফোনে কথা বলাতেই এতো লজ্জা তার কোথা থেকে আসছে, বুঝতে পারল না সে কারণ সে ভেবেছিল সামনাসামনি কোথা বলার চেয়ে ফোনে কোথা বলা তুলনামূলক সহজ হবে। কিন্তু হল তার উল্টো। জিনিয়াসেসব চিন্তা বাদ দিয়ে অন্য চিন্তায় লেগে পড়ল। ওয়াফিফকে সাহস করে ফোন তো দিয়ে দিল, কিন্তু কি বলবে এখন।
–কি হল, চুপ করে আছো কেন? কিছু বলার থাকলে বলে ফেলো, আমার সামনে কাজ আছে অনেক। নেটওয়ার্ক প্রবলেম হচ্ছে না কি? আমি কি কেটে দিব?
–না না। আপনি কি খেয়েছেন?
–না, এখনো না।
–আজ বাসায় মেহমান আসবে। সেই নিয়ে মা কথা বলতে চায়। সময় পেলে মায়ের সাথে কথা বলে নিবেন।
–ঠিক আছে, আর কিছু?
–না।
–তাহলে রাখছি এখন।
বলেই কেটে দিল ওয়াফিফ আর কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর আবার সামনে বসে থাকা মানুষ দের সাথে কথা বলা শুরু করল।
জিনিয়া ও ফোনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সুফিয়া ভাবির ডাক শুনতে পেল। তাই সোজা তার কাছে চলে গেল।
সেখানে গিয়ে দেখল আফিয়া রহমান বসে আছেন আর সামনে টিভি তে কিছু একটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। সুফিয়া ভাবি রান্নাঘরে রান্নায় ব্যস্ত। আজ আফিয়া রহমানের ভাই আর তার পরিবার আসবে। সেই জন্য এতো আয়োজন। তারা মূলত আসবেন জিনিয়া কে দেখতে। ওয়াফিফের বিয়েতে আসতে পারেন নি বলে এখন দেখে যাবেন। জিনিয়া কে দেখে আফিয়া রহমান তাকে নিজের কাছে ডাকলেন। জিনিয়া সেখানে গেলে আফিয়া রহমান তাকে হাত ধরে নিজের কাছে বসিয়ে দিলেন। তারপর নিজের পরিবার সম্পর্কে সব বলতে থাকলেন, পরিবারে কে কে আছে? কে কেমন? কয়জন বাড়িতে আসবে – এসব। জিনিয়াও তার কথা মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকল। তবে তার মাথায় সেই পুরনো চিন্তা পড়ে আছে। নিজের বাচ্চার সম্পর্কে সব কিছু বলে দিতে চাচ্ছে সে কিন্তু সাহস করে বলতে পারছে না। নিজের নিরব স্বভাবের জন্য কখনো প্রতিবাদ করতে পারে নি সে। আর না পেরেছে কখনো কোন কথা খুলে বলতে। সব সময় চুপ করেই থেকে এসেছে। নিশ্চুপ থাকাই যেন তার এক মাত্র স্বভাব। যেই স্বভাবের জন্য সে নিজেই মনের মধ্যে দুঃখের পাহাড় জমিয়ে রেখেছে, কারো কাছে প্রকাশ করছে না আর না করতে পারছে। নিজেকে বার বার বুঝিয়েছে, বার বার চেয়েছে সব সত্য বলে দিতে, কিন্তু পারে নি, প্রতিবার শুধু কষ্টের পরিমাণ টাই বেড়েছে। নিজেকে অপরাধী মনে হতে থাকে তার সব সময়। তবু বলতে পারে না কিছু। নিরব হয়ে থাকে সর্বক্ষণ। কেউ জানতে পারে না তার এই নিরবতার পিছনে কত কিছু আছে। যেগুলো অপ্রকাশ্য।
চলবে।
[রিচেক করি নি, ভুলগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ]
Sadia Hq Sr.