নিরবতায় হৃদয় কোনে পর্ব-০৫

0
280

#নিরবতায়_হৃদয়_কোনে
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৫

রিশাতের মায়ের দেওয়া টাকা দিয়ে টুকটাক বাজার করেছে মিতালী। সকালে ঝুমুরকে মাহা গিয়ে পড়িয়ে আসে। সেই সময়ে রিতু মেয়েটাকে পড়িয়ে আসে মিতালী। তার সাথে রিতুর একটা চাচাতো বোন যোগ হয়েছে। দুজনকেই একসাথে পড়িয়ে দিচ্ছে।
তারপর স্কুল, বিকেলের টিউশন শেষ করে যখন ক্লান্ত বোধ করে, তখনই একচিলতে হাসি নিয়ে নির্ভীক তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। নির্জন সময়টুকু ভয় দূর করতে, তাকে সঙ্গ দিতেই নির্ভীকের আসা।
ইদানীং সে মিতালীকে ছাড়াই ক্যাম্পাসে যাচ্ছে। নিজের ক্লাসের পাশাপাশি প্রিয়ার কাছ থেকে মিতালীর জন্য নোট কালেক্ট করে দিচ্ছে। পাশাপাশি পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া, নিরব মনে একপাক্ষীক বার্তা জমিয়ে রাখা। দোকান থেকে দুটো কেক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নির্ভীক। সে বুঝতে পারে মিতালী হয়তো অর্থসংকটের কারণে দুপুরে কিছু কিনে খায়না। টিউশনে কখনো নাস্তা দিলে খায়, নয়তো পানি দিয়ে গলা ভেজায়। জীর্ণশীর্ণ, ক্লান্ত, মলিন চেহারায় তার অভুক্ততার প্রমাণ।

নির্ভীক একটি কেক নিজে নিয়ে অপরটি মিতালীর দিকে বাড়িয়ে দেয়। মিতালী কিছু বলতে চাইলেই সে থামিয়ে দিয়ে বলে,
-“তোর সাথে কথা বলতে বলতে বাড়ি ফেরার পথে আমার গলা শুকিয়ে যায়, খিদে পায়। কিছু না খেলে আমি শক্তি পাইনা। প্রচন্ড কথা বলিস তুই।”

মিতালী হাসে। পাশে ভাবলেশহীন চলতে থাকা ছেলেটাকে তার বড্ড চেনা। তাইতো এখন আর কিছু বলেনা সে।
সে চায় জনম জনম ধরে এ বন্ধুত্ব টিকে থাকুক, বেঁচে থাকুক সকল বন্ধুদের প্রাণে প্রাণে।

★★★

ক্লান্ত শরীর নিয়ে রান্না করলো মিতালী। ভেবে রেখেছে এখন থেকে রাতে রান্না করে রেখে পরেরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত খাবে। এরপরই পরেরদিনের রান্না বসাবে। এমন না করলে বেশিদিন টিকে থাকতে পারবেনা। সকালে ভাত খেয়ে বেরোলে পুরোদিন আর পেটে খাবার পড়েনা। খিদের চোটে নাড়িভুড়ি সব বেরিয়ে আসতে চায়। রোজী বেগমের হাত-পা বাঁধা। তিনি কিছু করতে গেলেই তাদের একেবারে মেয়ের ঘাড়ে নামিয়ে দেবে।

সন্ধ্যায় আসার সময়ই নির্ভীক নোট তুলে দিয়েছিলো তাকে। সেগুলোতেই একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। চর্চা না থাকলে পানির মতো স্বচ্ছ বিষয় ও পাথরের মতো কঠিন মনে হয়।
টেবিল গুছিয়ে একবার আব্বাকে দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করলো। ঘরের মাঝখানে বেড়া তুলে দিলেও আব্বা-মা আর মাহা মিতালীর পাশেই থাকছেন।
মিতালী নরম হলো, অধরকোনে হাসি টে*নে বলল,
-“আব্বা কী করো? সারাদিনে একবারও তোমার খোঁজ নিতে পারিনি।”

মতিন সাহেব হাসলেন মেয়ের কথা শুনে। কাঁপা-কাঁপা স্বরে বললেন,
-“তোর কাঁন্ধে যেই দায়িত্ব উঠাইয়া দিছিরে মা। আমি কোনোদিন ভাবিনাই এমন পরিস্থিতি হইবো। আমি বোঝার মতো পইড়া থাকুম।”

মিতালী কপট রাগ দেখালো। রাগত স্বরে বলল,
-“তুমি কেন নিজেকে বোঝা মনে করো? তুমি হচ্ছো আমাদের মাথার উপর বটগাছের ছায়া। যার দোয়াতে আমাদের সফলতা আসবে।”

মতিন সাহেব মেয়েকে ইশারা করলেন ঝুঁকতে। মিতালী ঝুঁকে যেতেই তার কপালে চুম্বন করে বললেন,
-“আমি খাঁটি হীরার মালিক। আমার চাইতে ধনী আর কেডায় আছে?”

মাহা আড়াল থেকে বেরিয়ে মুখ ভার করলো। মিথ্যে রাগ দেখিয়ে ন্যাকা কান্না জুড়ে দিলো। বলল,
-“সব আদর তোমাদের মেয়ের জন্য। আমাকে ড্রেনে পেয়েছো তো কী হয়েছে? একটু আদর করে দিলে কি টাকা খসে যাবে?”

মাহার কান্ডে সবাই হাসলো। মতিন সাহেব দুই মেয়েকেই দুহাতে জড়িয়ে বললেন,
-“তোরা দুইডাই আমার হীরা।”

★★★

সকালে বের হওয়ার সময় মাহবুবের মেয়ে মাহবুবাকে চোখে পড়লো। দূর থেকে পিটপিট করে ফুফিকে দেখে গেলো। মিতালী আশেপাশে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে ইশারা করলো। মাহবুবা এলোনা। সেও আশেপাশে তাকালো। মাকে নজরে পড়তেই ঘরে ঢুকে গেলো।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মিতালী। মেয়েটা আগে তার কাছে আসলেও ঝা*মে*লা হওয়ার পর থেকে আসছেনা। হয়তো কড়া সুরে না করে দিয়েছে। কথা না শুনলে মেয়েটাকে তুলে আছাড় মা*র*তে ও দ্বিধা করবেনা মাহবুব।

বৃহস্পতিবার হওয়ায় আধা বেলা স্কুল করেই বাড়ি ফিরলো মিতালী। আগামীদিন শরীরটাকে বিশ্রাম দিতে পারবে ভেবেই একটু শান্তি লাগছে। সপ্তাহের ছয়টি দিন জুড়েই দৌঁড়ঝাপের উপর থাকতে হয়।

★★★

সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে বাড়ি থেকে বেরোতে নিলেই নির্ভীকের মা পথ আগলে দাঁড়ান।
-“কই যাস?”

নির্ভীক স্বাভাবিক প্রশ্ন ধরেই উত্তর দিলো,
-“একটু সামনের দিকেই যাচ্ছি। আবার ঘুরে চলে আসবো।”

মা বললেন,
-“মিতালীর লগে দেহা করতে যাস, তাইতো? সেদিন ও এ নিয়া ঝা*মে*লা বাঁধাইলি। কী দরকার আছে ওর লগে কথা কওনের?”

-“মা তুমি এসব বাদ দাও তো। ওই মাহবুবের কাজই হলো মানুষের পেছনে লাগা।”

-“তবুও বাপ, আমি এত ঝা*মে*লা চাইনা। তোর বাপরে ছাইড়া তোরে বুকে নিয়া পইড়া রইছি। কিছু একটা হইলে আমি আর বাঁচুমনারে আব্বা।”

কথা বলতে বলতে মুখে আঁচল চেপে কেঁদে ফেললেন নির্ভীকের মা।
নির্ভীকে মাকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলো। হেসে বলল,
-“তুমি আমাকে নিয়ে এত চিন্তা কেন করো, বলোতো? কিছু হবেনা আমার, সবসময় তোমার দোয়া আমার উপর থাকছে তো।”

মাকে বুঝ দিয়ে মিতালীকে আনতে বেরিয়ে পড়লো।
দেখা পেতেই নির্ভীক বলল,
-“কাল তো ছুটি। আজ একটু ধীরে হাঁট। কতদিন হলো দুজনের একসাথে অনেকক্ষণ খুব একটা গল্প করা হয়না।

মিতালী হাঁটার গতি কমালো। ধীর পায়ে এগোতে থাকলো। হঠাৎ নির্ভীক প্রশ্ন করলো,
-“মিতা, তোর কেমন ছেলে পছন্দ?”

মিতালী ভ্রু কুঁচকে বলল,”হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

নির্ভীক বলল,
-“এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম। কখনো জানা হয়নি তো তাই।”

মিতালী কিছুকক্ষণ ভাবলো। অতঃপর বলল,
-“সাদামাটা, একটু অগোছালো, একটু দায়িত্বশীল।
সে প্রেম নিয়ে নয়, সুখ নিয়ে আসুক। আমি বারবার তার প্রেমে পড়বো। সুখ মানে টাকা নয়, তার বক্ষস্থল যেনো আমার শান্তির স্থান হয়। যেমন আমার বাবা কাড়িকাড়ি টাকা না কামিয়েও আমাদের সুখে রেখেছেন।”

নির্ভীক অনিমেষ চেয়ে রইলো। তাকে দেখার তৃষ্ণা এজীবনে না ফুরাক। তাকে না পাওয়ার খাতায় রাখলেও ভালোবাসার অন্ত না থাকুক।
যদি কখনো সময় আসে তাকে জানাবার, ফিরিয়ে দেওয়া ভাঙা মন নিয়েও আজীবন ভালোবাসবে নির্ভীক। তার অপলক দৃষ্টি নজর কাড়তেই মিতালী ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো,”কী?”

নির্ভীক দুপাশে হালকা মাথা দুলিয়ে হেসে ফেললো। বলল, “একটা কবিতা বলি?”

_”কবিতা শোনাই যায়। তুই কিন্তু আগে এমন ছিলিনা। এই বছর দেড়েক হবে কবিতা নিয়ে বেশ ঘাটাঘাটি করছিস।”

আনমনে বলল নির্ভীক,”তার প্রেমে পড়ার পর আমি কবিতার প্রেমে পড়ে যাই। আমার হৃদয়স্থলের সকল অনুভূতি যে একেকটা কবিতার অংশবিশেষ।”

মিতালীর মন খা*রা*প হলো। নিজেকে ঠিক রেখে বলল,
-“বাহ্! তুই প্রেমে পড়েছিস, বছর কেটেছে। অথচ আমি জানলাম আজ?”

মিতালীর কথায় চমক কাটলো নির্ভীকের। লুকোচুরি ভঙ্গিতে বলল,”আরে কবিতা পড়তে পড়তে কথায় একটা টা*ন চলে এসেছে। সেরকম কিছুনা।
আমি তোকে কবিতা শোনাই।”

মিতালীকে কিছু বলার সুযোগ দিলোনা নির্ভীক।

“মেঘের মতো ভার হয়ে রয় বুক,
মেঘের মতন থমথমে কী ব্যথা!
মেঘতো তবু বৃষ্টি হয়ে ঝরে,
আমার কেবল জমছে ব্যাকুলতা।”

—সাদাত হোসাইন।

মিতালী মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যায়। ভেবে ভেবে মরিয়া হয়ে ওঠে নির্ভীকের কিসের এত ব্যাকুলতা?
হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতেই বিদায় জানালো সে।
নির্ভীক দাঁড়িয়ে থাকে। যতক্ষণ না দৃষ্টি সীমানার বাইরে ছুটে যায় কল্পনা বিলাসিনী রমণী।

বহুবছর একসাথে কাটানোর পর একটু একটু মায়া, একটু খানি মুগ্ধতা, বছর দেড়েক আগে হুট করেই প্রেমে পড়া। অথচ সে প্রেম জানেনা।
প্রেম ক্ষণে ছিলোনা কোনো সাজ, ছিলোনা কোনো হৃদয় থমকে দেওয়া শাড়ির আঁচল।
সাদামাটা কামিজে স্বেদজলে আচ্ছাদিত রমণী কেমন হৃদয় কেড়ে নিলো।
প্রেম জাগলো এক অপরিপক্ক পুরুষ হৃদয়ে। সেদিন প্রথম প্রেম জানলো সে। ভালোবাসা ধীরে ধীরে হৃদয়ে ছড়ালো।

★★★

কাঁচা বাজার কিছুই নেই ঘরে। আজ হাঁড়িতে কি চড়বে ভাবতে ভাবতে বুদ্ধি পেলো। শুকনো মরিচের যা দাম, বয়ামে চার-পাঁচটা শুকনো মরিচ পেলো। সাথে একটা রসুন আর পেঁয়াজের সংমিশ্রণে করে নিলো মরিচ ভর্তা। ঘরম ভাতের সাথে এই মরিচ ভর্তা অমৃতের স্বাদ যেন।
রোজী বেগম নিজের ভাগের একটুখানি তারকারি মেয়ের জন্য লুকিয়ে আনতে গেলেন। পাত থেকে সরিয়ে উঠে আসার সময় পিয়ালী পথরোধ করে দাঁড়ালো।
বাটির তরকারি টুকু কেঁড়ে নিয়ে বলল,
-“খেতে না পারলে দিয়ে দেবেন। তবুও আমার ঘরের খাবার কোনো কুকুর , বিড়ালকে দেবেননা।”

রোজী বেগম চুম মে*রে গেলেন। এদিক ওদিক দৃষ্টি লুকাবার চেষ্টা মাত্র।
পিয়ালীর কথাখানায় বেশ জোর ছিলো বিধায় ঘরের অপর প্রান্তে থেকে মিতালীও কিছুটা শুনতে পেলো। কিন্তু ব্যাপারটা বুঝতে পারলোনা। বাবা-মাকে কিছু বলেছে কি-না দেখতে সেদিকে গেলো।
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,”কী হয়েছে এখানে?”

পিয়ালীর একেকটা কথা সুঁচের মতো বিঁধলো মনে। সে বলল,
-“বাবা-মার পুরো দায়িত্ব নিতে চেয়েছিস। তাহলে এখন না খেতে পেরে আমার ঘরের তরকারি কেন লাগবে? ল*জ্জা লাগেনা? খেতে না পারলে মানুষের বাড়িতে কাজ করে খা।”

এবার মায়ের উপর রা*গ হলো মিতালীর। সে তো বলেনি তার তরকারি লাগবে। কেন শুধু শুধু এতগুলো কথা শুনবে? মা আর আব্বার সাথে যখন কেউ উঁচু গলায় কথা বলে, তখন তার খুব খা*রা*প লাগে। মায়ের চোখে চোখ রাখলো মিতালী। ঠান্ডা গলায় বলল,
-“আমার তো তরকারি লাগবে না মা। নিজের যতটুকু সামর্থ্য ততটুকুতে আমি তুষ্ট থাকতে পারি। আর কোনোদিন তুমি এমন করবেনা।”

রোজী বেগম টলটলে জলভরা চোখে তাকালেন। মতিন সাহেব ও চুপ হয়ে আছেন।
মিতালী ফিরে এসে মরিচ ভর্তা দিয়েই ভাত খেয়ে নিলো। লাল লাল ভাতের দলা মুখে পুড়ছে আর চোখ মুছতেছে। কারো কাছে ছোট হওয়ার চেয়ে ভিটার মাটি কামড়ে ম*রে যাওয়া ভালো। এই দুনিয়ায় যারা আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে পারে, তারাই বোধহয় ভালো থাকে।

#চলবে………