নীলাঞ্জনা পর্ব-১২

0
219

#নীলাঞ্জনা
#পর্ব_১২
#লেখনীতে_শুভ্রতা(প্রাণ)

“বাবাই আমি মিঃ নভর সাথে কথা বলতে চাই। আমার মনে হয় বিয়ের মতো সিরিয়াস একটা ব্যাপারে জড়ানোর আগে আমাদের আলাদা কথা বলা উচিত।”

মেয়ের কথায় রওনক সাহেব অবাকই হন বটে। কেনোনা কিছু দিন আগে তিনি নিজের যখন বলেছিলেন তখন তার মেয়ে নভর ছবিটা পর্যন্ত দেখতে চাইলো না। তাহলে এখন কি হলো? নাকি নয়নার কথার ভিত্তিতে হচ্ছে এগুলো?

“দেখ নীল মা আমি জানি তুই নয়নার কথা গুলোতে কষ্ট পেয়েছিস। কিন্তু আমি তো বলেছি তুই সারাজীবন আমার মেয়ে হয়েই থাকবি। তবে সত্যি তো আর আমরা অস্বীকার করতে পারি না তাই না? এগুলোর জন্য তুই বিয়েতে কোনো ঝামেলা করিস না। বাবাই এর রিকুয়েস্ট।”

“না বাবাই ঝামেলা না। আর না আমি তোমার বোনের কথায় মন খারাপ করেছি। আমি তোমার মেয়ে আর এটাই বিশ্বাস করি। কিন্তু আমি চাই তার সাথে কথা বলতে। আর না করো না তুমি। ওনাকে একটা ক্যাফেতে আসতে বলো।”

মেয়ের কথায় ভরসা পান রওনক সাহেব। মাথা নেড়ে বলেন
“ঠিক আছে। আমি নভকে ফোন করে বলে দিচ্ছি। ও তোকে কল করে নেবে।”

নিজেও মাথা নেড়ে বাবাই এর রুম ত্যাগ করে মহু।

নয়না আকশার ও পলাশ চৌধুরীর মুখোমুখি বসে আছে পিয়াল। চোখ মুখ অসম্ভব রকমের লাল হয়ে আছে তার। খানিকটা অসহায়ত্ব আর খানিকটা ক্রোধে। পলাশ সাহেব আর নয়না করুণ চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না অপরাধ বোধের জন্য। আবার পিয়ালও চেপে ধরেছে, তাঁদের বলতেই হবে কারা তার আসলে বাবা-মা।

“তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি মম। বলো কারা আমার বাবা মা! কোথায় থাকেন তারা? কি নাম সেই গ্রামের? অ্যানসার মি ড্যাম ইট!”

পিয়ালের চিৎকারে কেঁপে ওঠেন নয়না। পাশেই তার স্বামী পলাশ নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছেন। স্বামীর দিকে করুণ চোখে স্বামীর দিকে তাকান নয়না কিন্তু সেই স্বামীও মুখ ফিরিয়ে নেন। অসহায় হয়ে পড়েন নয়না আকশার। বোধহয় এটাই তার শাস্তি। কম অন্যায় তো করেননি তিনি। পিয়ালের সাথে, পিয়ালের বাবা মার সাথে, নীলাঞ্জনার সাথে, নিজের পরিবারের সাথে এমনকি নিজের সাথেও। এটাই হয়তো প্রাপ্য তার। উপায়ন্তর না পেয়ে মুখ খোলেন তিনি।

“তোমার বাবার নাম নওশাদ শেখ। শহর থেকে কিছুটা দূরে…. গ্রামে থাকতেন তখন। এখন কোথায় আছেন জানিনা।”

নয়নার কথা শেষ হলে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না পিয়াল। ছুটে বেরিয়ে গেলো বাবা মায়ের ঘর থেকে। ছলছল নয়নে চেয়ে রইলেন নয়না আকশার। এমতাবস্থায় পলাশ সাহেবও কটাক্ষ করে বাণী ছুড়তে ভুললেন না।

“বারণ করেছিলাম এই মুহূর্তে সবাইকে না জানাতে। আমার কথা শুনলে আর এরকম কিছু হতোনা। বরাবরই বেশি বোঝার এই স্বভাব তোমাকে বিরূপ পরিস্থিতিতে ফেলে আর ভবিষ্যতেও ফেলবে।”

একটা ক্যাফেতে মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছে নভ আর নীল। দুজনেই চুপচাপ হলেও প্রত্যেকের হৃদয়েই চলছে তোলপাড়। একজন এত বছর পর নিজের নীলময়ীকে পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা তো অন্যজন হিসাব মেলাতে ব্যাস্ত। নভকে চুপ থাকতে দেখে মহুয়া বা নীলই আগে কথা শুরু করে।

“বাবাই হয়তো আপনাকে বলেছে আমার কথা।”

“হ্যাঁ উনি বললেন তুমি আমার সাথে কথা বলতে চাও।”

মাথা নাড়ে নীল।
“আসলে আমার আপনাকে কিছু জানানোর আছে এবং আপনার থেকেও কিছু জানার আছে। এবার আপনিই ঠিক করুন আগে কে বলবে!”

নভ একটু আশ্চর্য হলেও প্রকাশ করে না তা। শান্ত ভঙ্গিতে বলে
“যেহেতু তুমি ডেকেছো তাই তুমিও আগে বলো। এরপর প্রশ্ন করো, আমি উত্তর দিতে চেষ্টা করবো।”

কোনোরকম ভনিতা না করেই নীল শুরু করে তার কথা।
“আমি বুঝতে শেখার পর থেকে নিজেকে রওনক আকশার এর মেয়ে মহুয়া আকশার নীলাঞ্জনা বলে জেনে এসেছি। সারা দুনিয়া তাই-ই জানে, আপনিও। কিন্তু কাল রাতে জানতে পারলাম আমি আসলে আকশার বাড়ির মেয়ে নই, চৌধুরী বাড়ির মেয়ে। পলাশ চৌধুরী এবং নয়না আকশার এর একমাত্র মেয়ে আমি। এরমধ্যে নানা কাহিনী আছে। জন্মের সময় আমার মা নয়না নিজের সংসার বাঁচাতে আমাকে কোনো এক মহিলার ছেলের সাথে বদল করে নিয়েছিলেন। সেটাও ওই মহিলার অগোচরে। কেবল একজন নার্স জানতেন। কিন্তু আমি তাকে নিজের মা বলে মানি না। আমি শুধু আমার বাবাই এর মেয়ে।”

এতক্ষণ ধরে মন দিয়ে নীলের কথা গুলো শুনলেও এবার মুখ খোলে নভ।
“তোর কি ছোটবেলার কোনো কথাই মনে নেই নীলময়ী?”

নভর মুখে তুই ডাক আর নীলময়ী নাম শুনে চমকে তাকায় নীল। দেখতে পায় একজোড়া ছলছলে চোখ চেয়ে আছে তার পানে।

“কি মনে থাকার কথা বলছেন?”

নীলের প্রশ্নে কিছুটা আহত হলেও ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে সব কিছু বলতে থাকে নভ। সেগুলো শুনে নীল অবাকের পর অবাক হতে থাকে। চোখ ভিজে ওঠে তার। এত সব অঘটন কি তার সাথেই হতে হলো? সবশেষে নভ বলে
“তোর হাতে তুই সবসময় যে লকেট রাখিস তা তোর পঞ্চম জন্মদিনে আমিই তোকে দিয়েছিলাম। ওটার মধ্যে তোর আর আমার ছবি আছে। আর ভাগ্যের কি পরিহাস! সেদিনই তুই আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেলি। সৃষ্টিকর্তার কাছে হাজার শুকরিয়া যে তিনি আবারও তোকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন।”

নভর কথা গুলো শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রয় নীল।
“বুঝলাম সবই কিন্তু বাবাই হঠাত আপনার সাথে আমার বিয়ে দিতে কেনো চাইলেন? আপনাকে চিনলেনই বা কীভাবে?”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করে নভ।
“তুই তো জানিস আমি অভ্রর ফ্রেন্ড। একই ভার্সিটিতে পড়তো অভ্র আমেরিকা থেকে আসার পর। তোর হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে বাবা অনেকটাই চুপচাপ হয়ে গেছিলেন। বছর তিনেক আগে একদিন খবর আসে বাবা অনেক অসুস্থ। অপারেশন করতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। সেখানে টাকা লাগবে অনেক গুলো। সেদিন আমার আর মায়ের কথা গুলো পেছন থেকে অভ্র শুনতে পায়। তখন ওই তোর বাবাইকে বলে আমাকে টাকা ম্যানেজ করে দেয় আর সাথে কাজের ব্যবস্থাও। আঙ্কেলের অফিসে বেশ কিছু ঘাপলা হতো, সেগুলো আমিই সমাধান করি। এরপর থেকে উনি আমাকে অন্য নজরে দেখেন। তোর হয়তো মনে আছে কিছু দিন আগে আঙ্কেলের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিলো। সেখানে ডাক্তার রক্তের কথা বললে গ্রুপ অনুযায়ী রক্ত পাওয়া যায় না কোথাও। পরে আমিই রক্ত দিই। তখন আঙ্কেল তার মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দিতে চান। আমি তখনও জানতাম না কে ওনার মেয়ে, নামটাই তো জানতাম না। ততদিনে তোকে ফিরে পাওয়ার সব আশা শেষ। আর যেহেতু আমার অসময়ে উনি পাশে ছিলেন তাই না করিনি। ভাগ্গিস না করিনি, তাই তো তোকে ফিরে পেলাম।”

কথা গুলো বলে থামে নভ। নীল নিচের দিকে তাকিয়ে কিছু ভেবে চলেছে। সে নিজেও চুপ করে যায়। হয়তো সময় লাগছে মেয়েটার একসাথে এত গুলো ধাক্কা সামলাতে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর কথা বলে নীল।

“আমাকে নিয়ে যাবেন আমার সেই বাবা মায়ের কাছে?”

করুণ সুরে বলার কথা গুলো যেন বুকে গিয়ে বেঁধে নভর। বড্ড কষ্ট হয় তার নীলময়ীর জন্য। হোক নীল তার খালামনির পালিত মেয়ে কিন্তু সে তো ভালোবাসে! বিনাবাক্যে রাজি হয়ে যায় নভ। অতঃপর ক্যাফে থেকে বেরিয়ে বাইকের পেছনে নিজের নীলময়ীকে বসিয়ে নিয়ে রওনা হয় গ্রামের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ লাগে তাঁদের সেখানে পৌঁছাতে। নীলের হাত ধরে টেনে ভেতরের দিকে নিয়ে যেতে থাকে নভ।

“মা, খালামনি, খালুজান, নয়ন, নিহা কোথায় সবাই? এসে দেখে যাও কাকে নিয়ে এসেছি! দেখলেই চমকে যাবে তোমরা।”

আর কিছু বলার আগেই থেমে যায় নভ। বাড়ির লোকদের চমকে দেওয়ার উদ্দেশ্য থাকলেও চমকে যায় সে নিজেই। চমকে ওঠে পাশে থাকা নীলাঞ্জনাও!

চলবে…?