নেশাক্ত ভালোবাসা ২ পর্ব-৬৪

0
1875

#নেশাক্ত_ভালোবাসা
#Season_2
#লেখিকাঃ Tamanna Islam
#পর্বঃ ৬৪

গাড়ি দিয়ে যাচ্ছিলো সবাই। তবে যেতে যেতেই হঠাৎ করে আইরাত দিতে ওঠে এক গগন বিদারি চিৎকার। সবাই বেশ অবাক। আইরাতের চিৎকারে কৌশল ভরকে গিয়ে দ্রুত গাড়ির ব্রেক কষে দাঁড়ায়। দিয়া চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। আব্রাহামও হাইপার হয়ে পরে। কিন্তু এদিকে তো আইরাতের নাজেহাল অবস্থা। এক হাত কোমড়ের পাশে রেখে আরেক হাত পেটের নিচের অংশে ধরে ব্যাথায় কুকড়ে ওঠে।

দিয়া;; আইরু, আইরু কি হলো?

আব্রাহাম;; লেবার পেইন উঠেছে। কৌশল দ্রুত গাড়ি ড্রাইভ করে হস্পিটালের দিকে নে।

কৌশল কোন রকমে মাথা দু’বার দুলিয়ে দ্রুত গাড়ি আবার স্টার্ট দেয়। আইরাতের একহাত আব্রাহাম ধরে রেখেছে। তার বুকে আইরাত নিজের মাথা এলিয়ে দিয়েছে। দরদর করে ঘেমে যাচ্ছে। আর দিয়া কোন রকমে আইরাত কে বুঝিয়ে যাচ্ছে। আইরাতের বাম হাতের তালু বারবার ঢলে যাচ্ছে।

আব্রাহাম;; বেবিগার্ল প্লিজ একটু ধৈর্য ধরো। কিচ্ছু হবে না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। একটু সহ্য করো প্লিজ।

দিয়া;; কিন্তু জিজু ডেলিভারির ডেট তো আরো কয়েক দিন পর ছিলো তাই না!

আব্রাহাম;; অনেক সময় ডেলিভারি ডেটের আগে বা পরেও পেইন শুরু হয়।

আইরাত এবার আর না পেরে ঢুকরে কেঁদে দেয়। সব যেনো ছিড়ে যাচ্ছে ব্যাথায়। আরেক দফা চিল্লিয়ে ওঠে। আব্রাহামের এখন আর সহ্য হচ্ছে না এই পরিস্থিতি। যেখানে আইরাত সামান্য একটু ব্যাথা পেলেই আব্রাহাম তাকে বাচ্চার মতো কেয়ার করতো সেখানে এখন আইরাত ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। আব্রাহাম শুধু কোন রকমে সামাল দিয়ে যাচ্ছে তাকে। মন যেনো আর শান্ত নেই। এক উত্থাল-পাতাল বয়ে যাচ্ছে।

আইরাত;; আব.. আ আব্রাহাম আম আমি আ আর পারছি নাহ। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার।

আব্রাহাম;; জান আমার প্লিজ একটু সহ্য করো। এসে পরেছি আমরা। কিচ্ছু হবে না কারো। কৌশল জলদি যা।

কৌশলও কম জোরে গাড়ি ধাওয়া করছে না। কিন্তু তাড়াতাড়ি তে করা কাজই আসলে ভালো না। পথ যেনো আর ফুরাতেই চাচ্ছে না। তারও পনেরো কিংবা বিশ মিনিট পর গাড়ি এসে থামে হস্পিটালের সামনে। আব্রাহাম ফোন করে ডক্টর কে আগেই বলেছে যে লেবার পেইন শুরু হয়েছে আইরাতের। তাই ডক্টর সেই অনুযায়ীই সবকিছু ঠিক করে রেখেছে। গাড়ি থামলে আইরাত কে পেছন থেকে ধরে দিয়া। দিয়ার ওপর হালকা ভাবে হেলান দিয়ে চোখে বন্ধ করে এক প্রকার কাঁদছে আইরাত। আব্রাহাম দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পরে। গাড়ির দরজা খুলে আইরাতের উদ্দেশ্যে বলে…

আব্রাহাম;; বেবিগার্ল! হাত দাও আমার দিকে।

আইরাত;; ক ক কি কর করছেন কি আপনি?

আব্রাহাম;; হাত দাও। তুমি তো আর হাঁটতে পারবে না। হাত দাও।

আইরাত;; আব্রাহাম আম আমি য যেতে পারবো।

আব্রাহাম;; জানপাখি হাত দাও, এইটুকু তুমি হেঁটে যেতে পারবে না। হাত দাও আমায়। সময় কম।

আইরাত;; কিন্তু….

এই অসময়ে আইরাতের এমন না না আর শুনতে না পেরে আব্রাহাম তাকে দেয় এক ধমক। আইরাত কেঁপে ওঠে সাথে আরো কেঁদেও দেয়। একটা হাত আব্রাহামের হাতের ওপর রেখে আস্তে করে গাড়ি থেকে কিছুটা বাইরে বের হয়। তারপর আব্রাহাম ধীরে আইরাত কে কোলে তুলে নেয়। তবুও এতে আব্রাহামের মাঝে কোন ভাবান্তর দেখা যায় না, সে আগের মতোই থাকে। দিয়াও গাড়ি থেকে নেমে ছুটে তাদের পিছু পিছু যেতে লাগে। হস্পিটালের ভেতর আব্রাহাম কে দেখা মাত্রই নার্স আর ডক্টর এগিয়ে যায়। একটা বেড এনে তাতে আইরাত কে শুইয়ে দেয়। একটা রুমে আইরাত কে নিয়ে যায়। কিন্তু ততক্ষণে আইরাতের ওয়াটার ব্রেক করে ফেলে। ব্যাথা যেনো তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। আইরাতের গায়ের জামা টা কোন রকমে খুলে একটা ঢিলা জামা পরিয়ে দেওয়া হয়। চুলগুলো গুটিয়ে এক করে একটা ব্লু কালার হেয়ার ব্যাগের ভেতরে বেধে দেয়৷ তারপর আবার সেই রুম থেকে আইরাত কে বেডে শুইয়ে বের করে আরেক রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। অর্থাৎ যেখানে মূলত ডেলিভারি হবে। যাওয়ার সময় আব্রাহাম সোজা আইরাতের বেডের কাছে এসে পরে। আইরাত তো শুধু ছটফট করে যাচ্ছে ব্যাথায়। তার হিতাহিত জ্ঞান নেই বললেই চলে। আব্রাহামের হাত সে এতো টাই শক্ত ভাবে ধরেছে যে ছাড়ার আর নামগন্ধ নেই। আব্রাহাম শুধু তাকে সাহস জোগানোর জন্য এটা ওটা বলে যাচ্ছে কিন্তু প্রকৃত পক্ষে আব্রাহাম নিজেও অনেকটাই বেশি নারভাস। OT তে আইরাত কে ঢোকাতে যাবে কিন্তু আইরাত কোন ক্রমেই যেনো আব্রাহামের হাত ছাড়ে না। সে আব্রাহাম কে ছাড়া যাবেই না। তখন ডক্টর বলে ওঠেন….

ডক্টর;; স্যার প্লিজ আপনিও কেবিনের ভেতরে আসুন নয়তো ম্যাম পারবে না। প্লিজ স্যার আসুন।

অতঃপর আব্রাহাম নিজেও আইরাতের সাথে কেবিনে ঢুকে পরে। আইরাত কে পজিসন মোতাবেগ শোয়ানো হয়। ওয়াটার যেহেতু তার ব্রেক করেছে তাই ব্যাথা টা ক্রমেই ধীরে ধীরে বাড়ছে। আব্রাহাম ভয় পাচ্ছিলো এটা নিয়ে যে যদি আইরাতের কাটাছেঁড়া করতে হয়। কিন্তু ডক্টর সবকিছু দেখে বুঝলো যে কাটাছেঁড়া করতে হবে না অর্থাৎ সিজার করতে হবে না। নরমাল ভাবেই ডেলিভারি করা সম্ভব। আইরাতের মাথার কাছে আব্রাহাম তার এক হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মনে-প্রাণে আল্লাহ কে ডেকে যাচ্ছে। দুপাশে দু-তিনজন নার্স এসে দাঁড়ায়। আর ডক্টর নিজের কাজ করতে লাগে। এদিকে আইরাত আব্রাহামের হাত ধরে কেঁদেই যাচ্ছে।


বাড়ির প্রত্যেকটা লোক এসে হস্পিটালে হাজির। সবার মাঝে বেকুলতার ছাপ স্পষ্ট। অধীর আগ্রহে হস্পিটালের বাইরে দাঁড়িয়ে বা বসে রয়েছে সবাই। যখন আর এক বিন্দুও শক্তি আইরাতের মাঝে বাকি নেই,, চোখ যেনো তার নিভু নিভু তখন আব্রাহাম আইরাতের মাথার সাথে নিজের মাথা ঠেকিয়ে রেখে দেয়। তখনই একদম শান্ত পরিবেশের মাঝে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। পুরো হস্পিটাল কেঁদে কেঁদে মাথায় তুলে নিয়েছে। বাইরের সবাই শুধু কেবিনের দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। একটা বাচ্চাকে নিয়ে টাওয়ালে মুড়িয়ে একজন নার্সের কাছে দিয়ে দেয়। সে বাচ্চাকে নিয়ে চলে যায়। পরমূহুর্তেই আরেকটা বাচ্চা কে আরেকজন নার্সের কাছে দিয়ে দেয়। আইরাতের এখনো তেমন কোন হুস নেই। প্রচন্ড দ্রুত গতিতে শ্বাস নিচ্ছে সে। বেশ ভালোই ব্লিডিং হয়েছে। তবে এতে আইরাতের ইনশাআল্লাহ কোন ক্ষতি হবে না। সব ঠিকই আছে আর এইটুকু তো হওয়ারই ছিলো। ডক্টর আইরাত কে ঠিক ঠাক করে দেয় একদম নিট এন্ড ক্লিন। অতঃপর হাত থেকে গ্লাপস আর মুখ থেকে মাস্ক খুলতে খুলতে বলে ওঠেন….

ডক্টর;; সব বাচ্চাই সুন্দর। আল্লাহ’র দেওয়া বিশেষ উপহার হয়। কিন্তু সত্যি বলতে কি এত্তো সুন্দর বাচ্চা আমি আমার ডক্টর লাইফে কখনোই দেখি নি এর আগে। অনেক অনেক কংগ্রেচুলেশন স্যার & ম্যাম আপনাদের টুইন বেবি হয়েছে। একজন ছেলে আর একজন মেয়ে।

আইরাত মুচকি হাসে। হালকা করে মাথা তুলে দেখে আব্রাহাম আইরাতের হাতটা অনেক শক্ত করে ধরে মাথার কাছে তার মাথা নামিয়ে রেখেছে। এর মাঝেই একজন নার্স আসে। আইরাত খেয়াল করে দেখে নার্সের কোলেই দুজন বাচ্চা। তবে নার্স টা দুজন বেবি কে একসাথে নিতে গিয়ে কেমন হিমশিম খাচ্ছে। ডক্টর দ্রুত একজন কে নিজের কোলে নিয়ে নেয়। উঠে বসার মতো অবস্থায় আইরাত নেই। কিন্তু এখন কি আর সেই খেয়াল আছে তার। আইরাত উঠে বসতে ধরলে আব্রাহাম তাকে ধরে তুলে বসিয়ে দেয়। পিঠের পেছনে একটা বালিশ দিয়ে দেয়। ছেলে-মেয়ে উভয় কেই আইরাতের কোলে দেওয়া হয়। দুপাশে দুজন কে নিয়ে বসে আছে আইরাত। মনে হচ্ছে এর থেকে বেশি সুখময় শান্তিময় সময় আর নেই। এখন এই সময় টুকু তাদের একা থাকতে দেওয়াই ভালো তাই নার্স আর ডক্টর বাইরে বের হয়ে পরে। মিনিট কয়েক পর বাকি সবাই কে কেবিনের ভেতরে যেতে বলে। আইরাত তাকিয়ে দেখে আব্রাহাম ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।

আইরাত;; জামাইজান!

আব্রাহাম;; হুম।

আইরাত;; আপনি খুশি নন!?

এবার আব্রাহাম চোখ তুলে আইরাতের দিকে তাকায়। আইরাতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ তার চোখের কোণে পানি জড়ো হয়ে যায়। আইরাত অবাক হয়ে তাকায়। এবার আব্রাহাম আর ঠিক থাকতে পারে না। আব্রাহাম কেঁদে দেয়। আইরাত কে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে।

আব্রাহাম;; খুশি রে আমার জানপাখি। আমি অনেক খুশি। একেবারে বাধভাঙ্গা খুশি আজ আমি। আমার বিশ্বাস হয় না। আমার কি আদৌ এতো টা সুখ পাওনা। আমার বলার ভাষা নেই। পৃথিবীর সবথেকে ভাগ্যবান আমি আজ।

আইরাত আব্রাহামের দিকে তাকায়। আব্রাহামের চোখে অশ্রুবিন্দু মুক্তোর ন্যায় ছলছল করছে আর মুখে ঝুলছে বিশাল মাপের হাসির রেখা। এবার আব্রাহাম বেবিদের দিকে তাকায়। আসলেই নবজাতক সুন্দর। দুধে-আলতা গায়ের রঙ। এত্তো গোলুমোলু। তাদের থাই, হাত আর গালগুলো বেশি মোটাসোটা। ঠোঁট গুলো এত্তো ছোট্ট আর গাঢ় গোলাপি। চোখের পাপড়ি গুলো কি যে কিউট। ঠোঁটের ঠিক ওপরেই ছোট্ট একটা বুচো নাক। মেয়ের চুলগুলো কালো আর ছেলের চুলগুলো হালকা ব্রাউন কালারের। দুজন এতোটাই দেখতে এক রকম যে এদের চেনার উপায় নেই যে কোনটা ছেলে আর কোনটা মেয়ে। আইরাত মেয়ে কে আব্রাহামের দিকে এগিয়ে দেয়। আব্রাহাম আইরাতের দিকে তাকিয়ে থাকে।

আইরাত;; আরে কি হলো তাকিয়ে আছেন কেনো? ধরুন।

আব্রাহাম আমতা আমতা করে বলে..

আব্রাহাম;; আব… না মানে আমি নিবো মানে যদি ব্যাথা পায়।

আইরাত;; পাবে না আপনি ধরুন।

এর মাঝেই মেয়ে কেঁদে দেয়। তার কান্না দেখে আব্রাহাম তড়িঘড়ি করে কোলে নেয় তাকে আর সাথে সাথেই মেয়ের কান্না বন্ধ। আইরাত হেসে দেয়।

আইরাত;; হুমম আমার বুঝা শেষ, মেয়ে হবে বাপের পাগল।

নিজের কোলের দিকে তাকিয়ে দেখে ছেলে বৃদ্ধ আঙুল চুষছে।

আব্রাহাম;; আচ্ছা আমি না কিছু বুঝলাম না।

আইরাত;; কি?

আব্রাহাম;; বাচ্চা হওয়ার সাথে সাথেই খাওয়ার জন্য কান্না করে আর এই দুজন কিছুই না। একজন আঙুল চুষছে আর একজন চুপ।

ছেলে মেয়ে দুজন কে একসাথে নিয়ে বসলে দুজনেই একসাথে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। জ্বলজ্বল করছে তাদের চোখগুলো।

আব্রাহাম;; তোমার মতোই হয়েছে।

আইরাত আব্রাহামের দিকে তাকায়।

আব্রাহাম;; একদম গোলুমোলু।

ব্যাস এটা বলার সাথে সাথেই বাচ্চাদের কান্না শুরু। কানের পর্দা যেনো ফেটে গেলো। বুঝলো ক্ষিদে পেয়েছে। বাকিরা সবাই কেবিনে ঢুকে। এখন কমপক্ষে বাটিতে করেই দুখ নিয়ে খাওয়াতে হবে কেননা আইরাতের শরীর ভালো না আর সেই অবস্থায় সে নেই। সবাই তো বাচ্চাদের পেয়ে খুশিতে পাগল। এক্কেবারে দিশেহারা। আর আব্রাহাম ব্যাস্ত আইরাত কে নিয়ে। আইরাত এর টেক কেয়ার সে নিজেই করে। আজ না হলেও হয়তো আগামীকাল আইরাত কে হস্পিটাল থেকে রিলিজ দেওয়া হবে। আব্রাহাম-আইরাত বসে ছিলো। আইরাতের কোমড়ের এক সাইডে হাত রেখে দিয়েছে সে। সবাই কে বাচ্চাদের নিয়ে মাতামাতি করতে দেখে আব্রাহাম আইরাত তাদের মাথা একসাথে ঠেকিয়ে হাসিমুখে তাদের সবার দিকেই তাকিয়ে থাকে। এই গোটা পৃথিবীর সবথেকে বেশি সুখময় মূহুর্ত যেনো এটাই। শুরু হলো আজ থেকে আব্রাহাম-আইরাতের জীবনের আরেক নতুন ধাপ।





চলবে~`