প্রজাপতি উৎসব পর্ব-১০

0
279

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ১০
বিকেলে মিলি আমার রুমে এসেছিল। আমরা জিগেস করলাম,
-বাসর রাতে কী হয়েছে বলবি না?
মিলি ফিক ফিক করে হাসে কিন্তু বলে না। আমি হুমকি দিলাম,
– না বললে কিন্তু কুদ্দুস দুলাভাইয়ের পেছনে অতন্দ্রিলাকে লেলিয়ে দেবো।
-আচ্ছা তন্দ্রাকে লেলাতে লাগবে না, আমিই বলছি।
-তাড়াতাড়ি বল।
-তোদের কুদ্দুস দুলাভাই একটা প্রথম শ্রেণীর পাগল।
মিতু এবার উৎসাহ নিয়ে জিগেস করলো,
-কেন? তোকে নিয়ে কী করেছে রে? এতদিন পর হাতের কাছে পেলো।
-কবিতা পড়ে শুনিয়েছে।
দিলশাদ বললো,
-কবিতা শোনাবার জন্য বিয়ে করা লাগে? কী কবিতা?
-আমাকে নিয়ে কবিতা, ও নিজেই লিখেছে।
দিলশাদ এবার ফোঁড়ন দিলো,
-কুদ্দুস দুলাভাই কবিতা লিখেছে? তাহলে আর কী বাকি থাকলো? ফেসবুকের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করছে বিদায় পিতিবি।
আমি বললাম,
-মিলি কী কবিতা? একটু শোনা প্লিজ।
– আচ্ছা শোন তাহলে,
মিলি, ওগো মিলি
মম টাইগার লিলি,
তোর দুই চোখে আলো,
এতো ঝিলিমিলি,
সারা্রাত চুলে তব
কেটে দেবো বিলি।
মিতি বললো,
-খারাপ না কিন্তু , কবিতাটা সুইট আছে। এখন আসল ঘটনা বল। আর কোথায় বিলি কাটলো?
-কবিতা শেষে আমাকে নিয়ে ছাদে গেলো।
দিলশাদ বললো,
-ছাদে কেন, ঘরে বিছানা নাই? নাকি ছাদেই বিলি কাটতে হবে?
আমরা সবাই হেসে বললাম, মিলি বললো,
-উফ, ছাদে তারা দেখাতে নিয়ে গেছে। সপ্তর্ষি মন্ডল চিনিয়ে দিলো, বললো এখন থেকে আমাকে অরুন্ধতি বলে ডাকবো।
-তারপর কী হলো?
-শেষ রাতের দিকে আমরা ঘরে এলাম।
-তারপর?
-তারপর তোদের আগ্রহ পুরণ হলো। বিলি কাটলো।
আমরা সবাই আবার হেসে ফেললাম। বিয়ের রাত খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, ওই রাতে একটা মেয়ে সুখী হলে তার সারা জীবন সুখী হবার সম্ভাবনা থাকে। মিলিকে খুব সুখী লাগছে।
মিলি আর দিলশাদ চলে যাবার পর মিতি বললো,
-রূপা, আমি প্রেগ্ন্যান্ট।
মনে হলো আমি ভুল শুনেছি। মিতি বিছানায় বসে উল দিয়ে কী একটা বুনছে। আমি বিস্মিত কন্ঠে জিগেস করলাম,
-কী বললি মিতা?
-আমি প্রেগ্ন্যান্ট।
-মানে কী? কী বলছিস এটা?
-ইচ্ছে করে না। হঠাৎ হয়ে গেছে।
রায়হান ভাইয়ের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। লোকটা মিতির সরলতার সুযোগ নিয়ে সত্যি সত্যি সর্বনাশ ঘটিয়ে দিয়েছে। বললাম,
-কী করবি মিতি এখন? ক্লিনিকে যাবি?
-মানে? কীসের জন্য ক্লিনিকে যাবো? রায়হান ভাই বলেছেন আগামী মাসেই আমাদের বিয়ে হবে।
-তাই, এ জন্য উল বুনছিস?
-হুম, মোজা বানাচ্ছি। বাচ্চা শীতকালে হবে তো, গরম জামা লাগবে। প্রথম জামা দোকান থেকে কিনতে চাই না।
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম,
-প্রেগ্ন্যান্সির কি দু মাস হয়ে গেছে?
-হ্যাঁ ।
-তোর বিয়ের সাতমাস পর বেবি ডেলিভারি হবে?
-জানি তুই কী মিন করছিস। রায়হান বলেছে আমরা প্রিম্যাচিউরড ডেলিভারি দেখাবো। তাহলে সবাই ভাববে যা হবার বিয়ের পরেই হয়েছে।
-বাহ, রায়হান ভাইয়ের মাথায় তো এসব সেয়ানা বুদ্ধি ভালো খেলে। প্রিকশন নেয়ার কথা মনে ছিল না?
-বললাম না অ্যাক্সিডেন্টালি হয়ে গেছে।
-আচ্ছা যা ভালো মনে হয় কর। তুই তো জানিস মিতি, আমি সব সময় চাই তুই ভালো থাক।
-জানি। এখন পিঙ্কি প্রমিস কোর এই কথা কাউকে বলবি না।
আমি আঙ্গুল বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, প্রমিস।
মিতিকে বকতে গিয়েও মায়া করে বকতে পারলাম না। কোন কোন মেয়ে এত বোকা হয় কীভাবে? মিতি ভাবছে রায়হান ভাই ওকে বিয়ে করবে। সেই বিশ্বাসের কারণে সে বিয়ের আগেই প্রেগ্ন্যান্ট হয়ে বসে আছে। নিশ্চিন্ত মনে উল বুনে মোজা বানাচ্ছে। ওর চাইতে আমার চিন্তাই বেশী। আহা, সব যেন ঠিকঠাক হয়। কোন উল্টাপাল্টা হলে এই মেয়েটা কষ্ট নিতে পারবে না।
ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি এখন মোটামুটি শান্ত। চন্দ্রিমা আর ক্রমেলা ক্যাম্পাসে ইনফ্রারেড ক্যামেরা বসানো ড্রোন ছেড়েছে। যারা মেয়েদের অ্যাবিউজ করছিল তারা হঠাৎ সতর্ক হয়ে ডুব মেরেছে। কিন্তু তার আগেই থার্মাল ইমেজে রাতের দিকের কিছু গ্রুপ অ্যাক্টিভিটি ট্র্যাক করা হয়েছে। চন্দ্রিমা আশা করছ খুব শীঘ্রই এদের শনাক্ত করা যাবে। ক্যাম্পাস হলো নাজুক এলাকা, লাবণিও চাচ্ছে হৈচৈ না বাঁধিয়ে খুব লাইট টাচে ব্যাপারটার সমাধান হোক। চওড়া কাঁধ আর ঝাকড়া চুলের বেশ কয়েকটা ছেলেকে গোপনে নজরে রাখা হয়েছে।
রঞ্জন ওর বাবার ব্যবসার কাজে ব্যংকক গেছে। সাতদিন পর ফিরবে। যাবার আগে আমাকে একটা আইফোন গিফট করেছিল। আমি বলেছি এত দামী ফোন আমার লাগবে না, খামোখা বিলাসিতায় অভ্যাস হয়ে যাবে। রঞ্জন মন খারাপ করে ফোনটা ফিরিয়ে নিয়েছে। ব্যংকক যাবার আগে রঞ্জন জিগেস করেছিল আমার জন্য কী আনতে হবে। আমি বলেছি তুমি সুস্থমত ফিরে এসো, এর বেশী কিছু চাই না।
রঞ্জনকে আমি পুরো বুঝতে পারি না। মাঝে মাঝে ও এমনভাবে আচরণ করে মনে হয় আমি ওর সোলমেট না, জাস্ট একটা শখের খেলনা। মানুষ যেমন খেলনা নিয়ে অনেক সময় মহা ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আমার প্রতি ওর মনোযোগ অনুযোগ অনেকটা সেরকম।
বহু দিন পর মস্কো থেকে হাতে লেখা চিঠি এসেছে। খাম খুলতেই ভেতর থেকে ঝর ঝর করে অনেকগুলো সাদাটে গোলাপি রঙের ফুলের পাপড়ি মেঝেতে পড়লো। টিটু ভাই লিখেছেন,
রূপা,
ফুলের পাপড়িগুলো কি পেয়েছো? ওগুলো রাশিয়ান রডোডেন্ড্রন। মনে আছে রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতায় ছিল, উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রনগুচ্ছ। হঠাৎ তোমাকে সত্যিকার ফুল দিতে ইচ্ছে করলো, তাই খামে ভরে রডোডেনড্রন পাঠিলাম।
মনে পড়ে পহেলা বৈশাখে সাদা গোলাপি শাড়ি পড়ে তুমি মুক্ত মঞ্চে এসেছিলে? তুমি আবৃত্তি করছিলে রুদ্র তোমার দারুণ দীপ্তি এসেছে দুয়ার ভেদিয়া। আর আমি বাঁশী বাজাচ্ছিলাম। তোমার মাথার পেছনে সূর্য উঠছিল। কিন্তু সূর্যের চেয়ের তোমার দীপ্তি ছিল প্রখর। আমি সারাক্ষণ তোমার দিকে চেয়েছিলাম।
এই যে তোমাকে দিয়ে এত বিপ্লবের ইস্তেহার বিলি করতাম, সে তোমাকে একটা কথা বলবার আশায়। সে কথা যখন সাহস করে বললাম, তখন তুমি অন্যের হয়ে গেছো।
মস্কোর পথে যেতে যেতে উদ্ধত কোন শাখার শিখরে রডোডেনড্রন দেখলে তোমার সেই পহেলা বৈশাখের চেহারাটা মনে ভাসে। তোমার হাত ধরে খুব হাঁটতে ইচ্ছে হয়। রূপা, তুমিই আমার রডোডেনড্রন।
ইতি,
টিটু
যতবার টিটু ভাইয়ের চিঠ পড়ি ততোবার মনটা কেমন ভারী হয়ে যায়। অযথাই কান্না পায়। কী করবো, টিটু ভাইকে চিঠি লিখতে মানা করে দেবো?
(চলবে)