প্রথম ভালোবাসার সুর পর্ব-০৪

0
4

#প্রথম_ভালোবাসার_সুর❤️
#লেখনীতে:অনুসা_রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:০৪

আবরাজ আর মেহেরের বিয়ের তিনটা দিন পার হয়ে গেছে। নাহ!এখনো শেহনাজ পারভীন একবারো ভালোভাবে কথা বলেনি মেহেরের সাথে।তবে আগের চেয়ে একটু শান্ত হয়েছে। কটু কথা শোনায় ঠিকই কিন্তু মেহের নিজের ঘরের ভিতরে থাকায় তা শুনতে পায় না।নিজের ঘর আর কই!সে মূলত বেশিরভাগ সময় মীরার ঘরেই থাকে।মীরার ঘরে বেশ অনেক বড় বইয়ের আলমারি আছে যেখানে অনেক উপন্যাসের বই আছে।মেহের সেগুলো পড়ে সময় কাটায়।নিজের মনের দুঃখ গুলো থেকে কিছু সময়ের জন্য বের হয়ে আসতে চায়।আরবাজের ঘরে শুধু রাতে ঘুমায়।
তাও সোফায়।এইত যেমন এখনো সে মীরার ঘরে আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে বই পড়ছে।এমন সময় আয়শা এসে মীরার ঘরে ঢুকলো। ঢুকেই বলতে লাগলো,

-“উপস!মীরা তো কলেজে।মনেই থাকে না আমার।”

মেহের বই থেকে চোখ সরিয়ে তৎক্ষনাৎ তাকালো আয়শার দিকে।আয়শা পেটে হাত দিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে। মেহের বই রেখে একটু এগিয়ে এসে বললো,

-“তাতে কি হয়েছে ভাবী।আপনি কি কিছু বলবেন?কিছু লাগবে?”
-“না তেমন কিছু না।আসলে অনেক একা একা লাগছে।কেউ নেই।কার সাথে কথা বলব!মা আর খালামণি তো বাহিরে গেল।”

মীরা হেসে কিছু বলতে গিয়েও বললো না।হাসিটা মিলিয়ে গেল।তার শ্বাশুড়ি তো আয়শার থেকে দূরে থাকতে বলেছে তাকে।মেহেরকে চুপ থাকতে দেখে আয়শা হাসি মুখে বলে উঠলো,

-“কিন্তু তুমি তো আছো।চলো দুজন মিলে গল্প করি।এমনিতেও তো নতুন বউদের কতকিছু বলার থাকে।”
-“হ্যা…আসলে!না মানে…”

আয়শা এসে বিছানায় বসে পড়লো।মেহের তখনো সেখানে দাঁড়িয়ে। আয়শা মেহেরের দিকে তাকিয়ে বললো,

-“কি হলো?”

মেহের চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।আয়শা বিষয়টা বুঝতে পেরে মুচকি হেসে বললো,

-“তুমি কি খালামণির ওসব কথাগুলো ভেবে আমার কাছে আসছ না!”
-“কি বলব বুঝতে পারছি না ভাবী।”
-“তুমি এসে বসো তো পাশে।”
-“আন্টি যদি এসে দেখেন!”
-“কিছু হবে না,এসো।”

মেহের ধীর পায়ে এগিয়ে এসে পাশে বসে পড়লো।আয়শা হালকা হেসে বললো,

-“আমি এসব বাজে কথা বিশ্বাসও করি না আর মানিওনা বুঝলে!”

মেহের মাথা নিচু করে ফেললো।আয়শা আবারো বললো,

-“মানুষের অসুখ-বিসুখ থাকতেই পারে।তোমার যে সমস্যা আছে সে কথা মা আমায় বলেছেন।কিন্তু তাই বলে এই সমস্যা থেকে আমার বাচ্চার ক্ষতি হবে এটা নিতান্তই কুসংস্কার মাত্র।”

মেহের ছলছল চোখে তাকালো আয়শার দিকে।আয়শা মুচকি হেসে বললো,

-“আমার একটা বোন আছে।ওরও বয়স তোমারি মত।আজ যদি ও তোমায় জায়গায় থাকত?আমি না সবসময় অন্য মানুষের মধ্যে নিজের পরিবারের মানুষের কিছু বৈশিষ্ট্য পেলে তাদেরকে আপন ভেবে ফেলি।যেমন তোমাকে!”
-“ধন্যবাদ ভাবী।আপনি আমার বিষয়টা বুঝতে পারছেন হয়ত।”
-“হুম পেরেছি বুঝতে অনেকটাই।এখন তুমি এটা বলো তো বিয়েটা ভাঙলো কিভাবে আর কিভাবেই বা কি!”
-“সেসব কথা এখন আর মনে করে লাভ আছে?”
(মলিন গলায়)
-“বাপরে!এত লাভ-লোকসান দেখলে হবে বলোতো?ঘটনা বলো শুনি।”

মেহের মাথা নিচু করে আছে।আবারো সেসব কথা আর ঘটনাগুলো মনে হচ্ছে। মেহেরের গলা কাঁপছে। আয়শা নিজেই বললো,

-“আচ্ছা আমিই জিজ্ঞেস করি!জায়ান কে?”
-“আমার কাজিন।”(কাঁপা গলায়)
-“ওহ আচ্ছা!ওর সাথেই বিয়ে ঠিক ছিল তাই না?”
-“হুম!আসলে ও আমার পিছনে প্রায় কয়েকমাস ঘুরেছে,প্রপোজ করেছে।তবুও আমি হ্যা বলিনি।কারণ তেমন কিছু ফিল ই আসেনি ওর প্রতি কোনোদিন। এসবে জড়াতেও চাইনি।কিন্তু তারপর ওরা প্রস্তাব দিয়েছে। আম্মু-আব্বুর কথার উপর না করিনি।আমিও রাজি হয়ে গেছিলাম। কেননা জায়ান বলেছিল ও আমায় ভালোবাসে।”
-“এ অবধি তো সব ঠিক।তারপর?”(কৌতুহল নিয়ে)
-“বিয়ের দিন সকালে আমি একটু অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।কিন্তু রাতে বিয়ে থাকায় বিকেলে চলে আসি। বিয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে জায়ানের মা এসে আমার ডাক্তারি রিপোর্ট ছু্ড়ে মারেন।আর অকথ্য ভাষায় যা নয় তাই বলেন।”

বলতে বলতে মেহেরের চোখ ভিজে যায়।তবুও নিজেকে সামলে বলে উঠলো,

-“ওনার ভাষ্যমতে আমরা আগের থেকেই জানতাম যে আমি… আমি…ম..মা হতে পা..রব না!ক..কিন্তু বিশ্বাস ক…করুন!আমরা কিছুই জ..জানতাম না!”

বলতে গিয়ে মেহেরের হিঁচকি উঠে গেল।আয়শা মেহেরের কাঁধে হাত দিয়ে বললো,

-“শশশ!চুপ চুপ।ওকে আর কিছু বলতে হবে না।আমি বুঝেছি।”

মেহের চুপচাপ কান্না করছে।আর নিজে নিজেই বলছে,

-“আঙ্কেল তখন আমাদের কে অপমানের হাত থেকে বাঁচাতে আরবাজের সাথে আমার বিয়ে দেন।আঙ্কেল আমার বাবার ছোট বেলার বন্ধু। অনেক ভালো বন্ধু।”
-“হুম বুঝলাম।হয়েছে এবার চুপ।আর কেঁদো না।আর ওই ছেলেটা কি মায়ের আঁচল ধরে চলে গেল।”

মেহের উপর-নীচ মাথা নাড়ালো।

-“কাপুরুষ একটা!”

মেহের ইচ্ছে হলো আরবাজকে নিয়েও কিছু বলার।কিন্তু কিছু বলার আগেই হঠাৎ নাজমা বেগমের আওয়াজ শোনা গেল।ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলছেন,

-“আয়শা!কই তুমি মা!ঘুমাও নাকি!”

আয়শা এ ঘর থেকেই জবাব দিলো,

-“আমি এ ঘরে মা!”

বলে উঠে দাঁড়ালো।আর বলে উঠলো,

-“মা এসেছে,দেখি কি বলে।”

মেহের মাথা নাড়ায়।আয়শা যেতে নিতেই পড়ে যেতে নিলো।অমনি ওর পেটে হাত দিয়ে ওকে সামলে নিলো মেহের।আর চোখ বড় বড় করে বলে উঠলো,

-“সাবধানে ভাবী!কি হতে পারত!”

আয়শা ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল।বুকে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে! কি হতে পারত এখন!নাজমা বেগম রুমের দরজা থেকে পুরো ঘটনা টা পরখ করলেন আর বলতে লাগলেন,

-“তোমার সাহস কি করে হলো আমার বউমার পেটে হাত দিলে!এখন যদি কিছু হয়!আপা?এই আপা।”

নাজমা বেগমের গলা শুনে শেহনাজ পারভীন ছুটে এলেন।তারপর বলতে লাগলেন,

-“কি হয়েছে আবার!”
-“তোমার ছেলের বউ আমার আয়শার পেটে হাত দিয়েছে।এখন যদি কিছু হয়?তার দায় কে নেবে?এই বন্ধ্যা নিবে?”
-“কি বলছিস! আয়শা ঠিক আছো?এই মেয়ে!তোমার সাহস কি করে হয় ওর পেটে হাত দেয়ার।তোমাকে না ওর থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম।ইশশ!কি একটা অবস্থা!”

আয়শা এবার কথা বলার সুযোগ পেল।তারপর জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বললো,

-“আমি একটু জন্য পড়ে যাইনি।আমার আত্মা এখনো কাঁপছে।কই আপনারা আমাকে ধরে পানি-টানি দিবেন।তা না করে আপনারা ওকে দোষ দিচ্ছেন।এগুলো কেমন স্বভাব!”
-“আচ্ছা হয়েছে! নাও এবার চলো ঘরে গিয়ে শুবে।”

নাজমা বেগমের কথার প্রতিত্তোরে আয়শা বলে উঠলো,

-“না হয়নি!আমাকে বলতে দিন মা।আটকাবেন না।”
-“শোনো বউমা…”
-“বললাম তো।বলতে দিন আমাকে।মেয়েটা একে তো নতুন।তার উপর আপনাদের এসব অত্যাচার।ও আমাকে না ধরলে আমি পড়ে যেতাম,ব্যাথা পেতাম।সিরিয়াস কিছু হতে পারত।ও আমায় বাঁচিয়েছে।আর আমার মনে হয় না যেই হাত আমাকে বাঁচিয়েছে সেই হাত আমার বাচ্চার কোনো ক্ষতি করবে।এসব আপনাদের নিতান্তই কুসংস্কার আর জেদ মাত্র।”

এতটুকু বলতেই মেহের কাঁদতে কাঁদতে দ্রুত পায়ে হেঁটে বাইরে চলে গেলো।আয়শা উঠে দাঁড়ালো।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

-“এগুলো স্বভাব পাল্টান মা।আজ আমাকেও হয়ত এসব করতেন যদি আমার বরের চাকরী না থাকত।আজ চাকরী আছে বলে আমার ভাষণগুলো শুনছেন।তা আমার ভালোই জানা আছে।চলুন,এবার বাসায় যাওয়ার সময় হয়েছে।আমি বাপের বাড়ি ছিলাম বলে এখানে থেকেছেন।আর কত?এবার চলুন নিজের সংসারে।”

বলেই হেঁটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।মনের সব রাগ আজ উগ্রে দিয়েছে আয়শা।কেননা এমন সময়ও গিয়েছে যখন এই বউমা বউমা করা নাজমা বেগমও তার সাথে জঘন্য ব্যবহার করেছে। কেন?তখন শরিফ আর সে দুজনই স্টুডেন্ট ছিল বলে!আজ এত দরদ কেন?তার স্বামীর চাকরী আছে বলে।তবে শেহনাজ পারভীন বরাবরই তাকে ভীষণ আদর করে।এখন যে কেন এমন হয়েছেন সেটা ও বুঝতে পারছে না।
মানুষ বড়ই অদ্ভুত! একটা মানুষের থেকে একটা চাকরীর দাম কত বেশি!চাকরী মানুষের ব্যবহারকে কিনে নেয়।নাজমা বেগম তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ!

রাত ১১ টা পার হয়ে যাওয়ার পরেও আজ এখনো আরবাজ বাসায় ফিরেনি।আরবাজের মা কিছুসময় খাবার নিয়ে টেবিলে বসে ছিলেন।সেটা মেহের দেখেছে।তবে আরবাজ তার মাকে কল দিয়ে বলেছে বসে না থাকতে বিধায় তিনি খাবার ঢেকে ঘরে চলে গিয়েছেন।এদিকে মেহেরের কিছুতেই ঘুম আসছে না।
শত হোক!আরবাজ তো তার হাসবেন্ড!
মেহের ডিসাইড করলো সেই জেগে থাকবে।বেশ কিছুসময় পর কলিং বেল বাজলো।আরবাজ ভেবেছিল তার মা হয়ত তখনো জেগে।কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে মেহের দরজা খুললো।আরবাজ ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,

-“তুমি!”

মেহের দরজা হতে সরে দাঁড়ালো। তারপর বললো,

-“ভিতরে আসুন।”
-“তুমি এত রাতে জেগে কেন?”
-“আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম বলতে পারেন।”

আরবাজ ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘড়ি খুলছিল।মেহেরে এই কথা শুনে অবাক হয়ে তাকালো মেহেরের দিকে।তারপর বললো,

-“কেন?”
-“এটা আমার দায়িত্ব তাই।”
-“দায়িত্ব?”
-“হ্যা দায়িত্ব। আপনি আপনার দায়িত্ব থেকে সরে যেতে পারেন কিন্তু তাই বলে তো আমি পারি না।”(হালকা হেসে)
-“আমি আমার দায়িত্ব থেকে সরে যাইনি।”(দাঁতে দাঁত চেপে)
-“বাদ দিই সেসব কথা।খেতে আসুন।”
-“খাব না আমি।”

ব্যস্ত গলা বলে আরবাজ ওয়াশরুমে যেতে লাগলো।মেহের পিছন থেকে বলে উঠলো,

-“আপনার অপেক্ষায় আমিও কিছু খাইনি।”

আরবাজের কানে গেলো কথাটা।কিন্তু কিছু বললো না।মেহের উত্তর না পেয়ে নিজেই গিয়ে টেবিলে বসলো
তার ভীষণ খিদে পেয়েছে। এই লোকটার জন্য না খেয়ে থাকার মানেই হয় না।ভেবেছিল একসাথে খাবে।
এদিকে আরবাজের কানে এখনো কথাটা বাজছে।
মেহের তারজন্য খাইনি!এমন তো কখনো হয়নি যে তার জন্য কেউ না খেয়ে থেকেছে তার মা ছাড়া!
না চাইতেও আরবাজের মনে একটা ভালোলাগা কাজ করলো!

চলবে…..