প্রেমনোঙর ফেলে পর্ব-০৮

0
443

#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে-মিথিলা মাশরেকা
#পর্ব-৮

গ্রামের সবুজ প্রান্তরের সুর্য একেবারে রক্তিম আভা ছড়িয়ে ডুবতে শুরু করেছে। সে সুর্যের অতি নিকটবর্তী হয়ে ঝাকের পর ঝাক বকের দল উড়ে চলেছে নিজ নিজ নীড়ের পানে। দুর মসজিদ থেকে মাগরিবের আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে মিহিভাবে। খইদের বাড়ির পাশের মসজিদে কোনো মাইক নেই। জমির হুজুর ওযু করে কেবলামুখী হয়ে দাড়িয়েছেন খালি গলায় আযান দেবেন বলে। দুর থেকে সাদা জুব্বা পরিহিত রোগাপাতলা লোকটাকে খইয়ের চোখে পরলো ঠিকই। গতি বাড়িয়ে,দেখেশুনে দৌড়ে এগোতে লাগলো ও বাড়ির দিকে। আজকে যদি আযানপর বাড়ি ফেরে,মা ওর গর্দান নিতে ভুলবে না। পরনে থাকা কাপড়টা উচিয়ে ধরে দৌড়ালো আরো জোরে। বাড়ির সামনের ঢালু বেয়ে উঠতেই কলপাড়ে মায়ের কাশির শব্দ কানে আসলো ওর।

খই দাড়িয়ে গেলো। হরিণীর মতো কান খাড়া করে আরেকবার পরখ করে নিলো খই,ঠিক শুনলো কিনা ও। আবারো কাশির শব্দ! ভুল শোনেনি ও। মায়ের আজ আবারো কাশি শুরু হয়েছে। খই সর্বোচ্চ দ্রুতিতে ছুট লাগালো এবার। বাড়িতে ঢুকে সোজা এলো কলপাড়ে।
সাহেরার আবারো রক্তবমি হচ্ছে। কাশির সাথে ঘলঘল করে রক্ত বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। চাপারঙের চেহারায় কালশুটে ভাব এসে গেছে ওর কাশতে কাশতে। চোখমুখ উল্টে টিউবওয়েল ধরে কোনোমতে নিজেকে সামলাচ্ছে সাহেরা। পাশেই বাটিসহ পান্তাভাত পরে আছে মাটিতে। দশবারোটা হাসমুরগী তা খুটে খাচ্ছে বেশ আনন্দ নিয়ে। খই বেশ বুঝতে পারলো মায়ের অসুখটা আবারো জেগেছে। দৌড়ে গিয়ে মাকে জাপটে জরিয়ে ধরে বললো,

-মা? ও মা? কি হইছে তোমার মা? হইলো ডা কি? ও মা? কথা কওনা ক্যান? মা?

সাহেরা টালমাটাল চোখে মেয়ের দিকে তাকালো। ঠোটে এখনো রক্ত লেগে আছে ওর। শরীর ধুকছে। তবুও বেশ কড়াকন্ঠে কথা বলার চেষ্টা করে বললো,

-এই…এই ভরসন্ধ্যায় কই গেছিলি তুই মুখমুড়ী? তুই জানোস না? তর মারে মারনের লাইগা তর বাড়িত না থাকোনই যথেষ্ট! জানোস না তুই?

জোরেজোরে শ্বাস ফেলে বললো সাহেরা। খই‌ উত্তর না দিয়ে মাকে টানতে টানতে কলপাড় থেকে উঠোনের নিয়ে আসলো। রোয়াকের দিকে এগিয়ে বসিয়ে দিয়ে একছুটে গিয়ে মাটির কলসি থেকে পানি নিয়ে এলো গ্লাসে করে। পানি সরিয়ে দিয়ে সাহেরা আরেকদফায় কাশতে কাশতে বললো,

-তর হাতের কিছু খামু না আমি! কই গেছিলি কই তুই? আ…আগে হেইডা ক! তরে আমি কইছিলাম গেরোস্তবাড়ির দিকে না যাইতে! কই ছিলি তুই? উত্তর দে খই! কই আছিলি?

-শুকমরার উত্তরের ঘাটে গেছিলাম মা! নাটা আর বেতুর কুড়াইতে। ঢ্যাপও পাইছিলাম! সামনের কদিন তো বাড়ি থাইকা বাইর হমু না! তাই…তুমি ওহন পানিডা খাও‌ মা! কষ্ট হইতাছে তো তোমার! জলদি খাইয়া লও! লক্ষ্মী মা আমার!

আবারো পানি এগিয়ে দিলো খই। ও জানে,ওর জবাব ছাড়া সাহেরা থামবে না। তাই আগে জবাবটাই দিলো। জবাব শুনে সাহেরা মেয়ের আঁচলের গোছায় তাকালো। একটা নাটা,বেতুর,ঢ্যাপ নেই ওর গোছায়। মিথ্যে বলছে ধরে নিয়ে খইয়ের হাতে থাকা গ্লাস ফেলে দিলো রাগে। তারপর আকস্মাৎ ওর বেনুনি করা চুল মুঠো করে ধরলো সাহেরা। চেচিয়ে বললো,

-তুই আমারে মিছা কথা কইলি খই? তারমানে তুই সত্যই কাছাড়িবাড়ি গেছিলি? কার কার লগে দেখা হইছে তর? জবাব দে খই! কেডায় দেখছে তরে? তুই কার কার লগে কথা কইছোস? উত্তর দে খই! ক কইতাছি!

ব্যথায় চোখমুখ খিচে বন্ধ করে নিলো খই। মায়ের হাতে হাত রেখে অস্ফুটস্বরে সবে আহ্! বলেছে,তৎক্ষনাৎ ওকে ছেড়ে দিলো সাহেরা। নিজেই হতভম্ব হয়ে গেছে ও। যে হাতে খইকে রাজকন্যা সাজানোর স্বপ্ন দেখে,সে হাতই খইয়ের গায়ে তোলার মতো বড়সর পাপ আর হয়না। নিষ্পলকভাবে হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো ও। খই অবুঝের মতো তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। সেকেন্ড পাঁচেক পরে আবারো কাশি শুরু হয়ে গেলো সাহেরার। আরেকবার পানি এগিয়ে দিলো খই। বললো,

-মাগো! সব ফল দৌড়াইতে গিয়ে রাস্তায় পইরা গেছে। পুঁটিরা সব কুড়াইছে। আমি যাইনাই কাছারিবাড়ির দিকে। আমারে বিশ্বাস করো মা! যাইনাই আমি কাছাড়িবাড়ি! তুমি তো আছিলা ওইহানে! আমি গেলে তো শুনতাই!

সাহেরা থামলো। কারন খই ওর যুক্তিতে ভুল করেনি কোনো। কাশিটা কিছুটা ধীরে হচ্ছে,তবে একেবারে কমেনি। রক্তও বেরোচ্ছে কমবেশি। খই কাতরভাবে বললো,

-ও মা? পানিডা খাও?

আর মানা করলো না সাহেরা। পানি নিয়ে শেষ করলো কয়েকঢোকে। কাশিটা নেই। তবে অস্থিরতা কমেনি। খই কাপড়ের আঁচল বের করে মায়ের চোখমুখ মুছিয়ে দিয়ে বললো,

-ওমা? বরুনকাকার দাওয়াখানায় নিয়া যাই তোমারে চলো! আইজকা মেলা রক্ত পরছে। আইজ মানা কইরো না মা! চলো যাই! চলো?

-লাগবো না!

এতোক্ষন শক্ত থাকলেও এবার কেদে দিলো খই। কোনোদিনও ওর এই দাওয়াখানায় যাওয়ার কথা রাখলো না সাহেরা। মাকে নিয়ে ভয় হয় ওর,সেটা এই কঠোর মানুষটা বোঝেই না। সাহেরা কপাল কুচকে বললো,

-কাদছিস কেনো?

-তোমারে লইয়া আমার ভয় হয় মা! ক্যান তুমি দাওয়াখানায় যাইতে চাও‌ না? এমন অসুখ নিয়া ক্যান কষ্ট দাও নিজেরে? ক্যান এতো চিন্তায় রাখো আমারে? কি হইবো দাওয়াখানায় গেলে? আর কতোদিন তোমার এমন রক্তবমি দেখুম মা? আমার কষ্ট লাগে তো!

মেয়ের কথা আগ্রহভরে তাকালো সাহেরা। বললো,

-আমার কষ্ট হইলে,সত্যই তোরও কষ্ট হয় খই?

তীব্র অভিযোগ নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো খই। এ কেমন প্রশ্ন? যেই মাকে ঘিড়ে ওর পৃথিবী,সেই মায়ের কষ্টে ওর কষ্ট হয় কিনা,সেটা ওকে বলে দিতে হবে? সাহেরা বললো,

-কিরে? কইলি না? আমার কষ্টে তোর‌ কষ্ট হয়? আমি মইরা গেলে…

মাকে‌ জাপটে জরিয়ে ধরে হুহু করে‌ কেদে‌ দিলো‌ খই। বললো,

-এমনে কইয়ো না মা! কইয়ো না! তোমার কিছু হইলে,আমি কি নিয়া বাচুম? মানুর মা মইরা গেলে‌ পরে ওর বাজান‌ আবারো বিয়া কইরা নতুন মা আইনা দিছে। আমার তো বাজান নাই‌ মা! তুমিই আমার মা,তুমিই‌ আমার বাজান! তোমার কিছু হইলে,আমিও মইরা যামু মা! মইরা যামু!

-যামু না! তোরে ছাইড়া আমিও থাকতে পারুম না খই! কোত্থাও যামু না তোরে ছাইড়া! কোত্থাও না!

খইকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো সাহেরা। এই বুকের শুন্যতা ভরে দেবে বলেই উপরওয়ালা ওর কাছে খইকে পাঠিয়েছিলো। সব ছেড়েছুড়ে,কোলজুড়ে খই আর বুকজুড়ে শান্তি নিয়ে তাইতো এতোদিন বেচে আছে ও। নইলে অনেক আগেই মৃত্যু অবধারিত ছিলো ওর। মারনরোগে স্বামী,সংসার হারালেও সৃষ্টিকর্তা ওকে বাচার কারন হারাতে দেয়নি। খইকে দিয়েছে বাচার অবলম্বন হিসেবে। কিন্তু এভাবে কতোদিন? মরতে তো হবেই একদিন না একদিন! খইকে আজীবন নিজের সাথে এভাবে বেধে রাখতে পারবে না ও! মৃত্যু ওকে সে সুখ থেকে বঞ্চিত করে দেবে যখনতখন! তখন খইয়ের কি হবে? কে দেখবে ওকে? কে আগলে রাখবে ওকে? হাজারটা চিন্তায় ভয়ে অসাড় হয়ে আসতে লাগলো সাহেরার শরীর। সুর্য ডুব দিলো। আর আশার আলো খুজতে থাকা কাকপক্ষীদের রেখে গেলো,কোনো এক অন্ধকার অতলে…

মাকে ডাক লাগাতে লাগাতে বাসায় ঢুকলো রাকীন। ইনিশা থেকে সবে বাসায় ফিরলো ও। তবে প্রতিদিনের মতো ক্লান্ত দেহ নিয়ে নয়! আজকে ওর চেহারায় আলাদাই এক ঝলকানি,আলাদাই এক উদ্দীপনা। মিসেস মাহমুদ রান্নাঘরে ছিলেন। ছেলের ডাক শুনে বেরিয়ে এলেন। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বললেন,

-কি হয়েছে রাকীন? এভাবে ডাকছিস যে? সব ঠিকাছে তো ইনিশায়?

রাকীন হেসে এগোলো। মাকে জরিয়ে ধরে রাখলো খানিকক্ষন। হেলিয়েদুলিয়ে বললো,

-সব ঠিক আছে মা! ইনফ্যাক্ট বেশিই‌ ঠিক আছে! জানো মা? আজ আমি অনেক খুশি! অনেক!

-হঠাৎ এতো খুশির কারন জানতে পারি?

বাবার আওয়াজে মাকে ছেড়ে ঘুরে দাড়ালো রাকীন। সিড়ির‌ সামনে‌ই রাজীব মাহমুদ‌ দাড়িয়ে। একছুটে বাবাকেও‌ জরিয়ে ধরলো গিয়ে। আনন্দঅশ্রু চোখে নিয়ে বললো,

-ইউ আর দ্যা বেস্ট!

-আমায় বেস্ট বলছো যে? আমি যতোদুর জানি,তুমি তো ইচ্ছের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে! খুশির‌ কোনো সংবাদ থাকলে,সেটার কারন ওই হওয়ার কথা রাইট?

রাকীন হাসলো। মিসেস মাহমুদ অধৈর্যের মতো করে বললেন,

-তোমরা বাবা ছেলে কি বলছো,কি বুঝছো,আমাকেও একটু বলবে আর বুঝাবে প্লিজ? আমার মাথা ঘুরছে তোমাদের কথা শুনে! কি ঘটেছে রাকীন? আর তুই ইচ্ছের সাথে দেখা করে এলি,ওকে নিয়ে এলি না? বলেও তো যাসনি যে ওর জন্য ক্ষীর বানিয়ে দেবো! হ্যাঁ গো? তুমি যখন জানতে ছেলে ইচ্ছের ওখানে গেছে,আমাকে বলতে পারতে একবার? পারোও তোমরা বাপ ছেলেতে!

রাকীন এগিয়ে গিয়ে মায়ের গলা জরিয়ে ধরলো আবারো। তার গোমড়ামুখ দেখে কাদোকাদো গলায় বললো,

-মা? বাবা না হয় জানে কি ঘটেছে আজ। কিন্তু তুমি তো আর জানো না! ছেলের জীবনের এতোবড় সুখবরটা শোনার আগ্রহ না দেখিয়ে ইচ্ছেকে নিয়ে পরে আছো। ইজ ইট ফেয়ার?

-হয়েছে হয়েছে! অনেক এদিকওদিক বলেছিস! এবার বলতো বাবা? এতো খুশি কেনো তুই? ইচ্ছের জন্য?

রাকীন সামনে এসে মায়ের হাত মুঠো করে নিলো। বললো,

-ইচ্ছের ফেরা নিয়ে আমি যথেষ্ট খুশি মা। তবে খুশির আরেকটা কারন আছে। বলতে পারো, সেটাই প্রধান কারন। আমার আর আই ডি এর প্রজেক্টটা গভার্মেন্ট পাশ করে দিয়েছে মা! আজ সন্ধ্যায় কল করেছিলো ওরা! ওখান থেকে সবটা কনফার্ম করেই বাসায় ফিরছি।

মিসেস মাহমুদ বুঝে উঠলেন না বিষয়টা। বললেন,

-আর আই ডি মানে? ইনিশার প্রজেক্টে গভার্মেন্টের পাশ লাগে বুঝি? আগে কখনো শুনিনি তো!

রাকীন আবারো হেসে মাকে এনে সোফায় বসিয়ে দিলো। মায়ের সামনে হাটুগেরে বসে বললো,

-রুলার ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট মা। গ্রামীন অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্দেশ্যে নেওয়া একটা ছোট্ট পদক্ষেপ। এটা বেসরকারীভাবে করা যেতো না। তাইতো এতোদিন সরকারী পাশের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম।

কিঞ্চিত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন মিসেস মাহমুদ। ইনিশার বাইরেও রাকীন কিছু ভেবে রেখেছিলো,এটা ধারনায় ছিলো না তার। রাজীব মাহমুদ এসে সোফায় বসলেন। রাকীন বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,

-এতো তাড়াতাড়ি তোমার অনুমতি পাবো,ভাবি নি বাবা।

রাজীব মাহমুদ ফাইল থেকে চোখ তুলে ছেলের দিকে তাকালেন। মৃদ্যু হেসে বললেন,

-তুমি যথেষ্ট বড় হয়েছো রাকীন। বাবা পরে,আগে একজন গাইডলাইন আর বন্ধু হতে চেয়েছি তোমার। আমার সব কাজের উদ্দেশ্যে এটাই। নিজের স্বপ্ন ছুয়ে দেখো রাকীন! ইটস্ হাই টাইম!

আরেকবার বাবাকে জরিয়ে মনপ্রান ঠান্ডা করে নিলো রাকীন। তারপর চলে এলো নিজের ঘরে। বিছানায় ডিলের ফাইল রেখে মুচকি হাসলো ও। কিছু একটা ভেবে আলমারির একদম নিচের ড্রয়ার থেকে কিছু একটা বের করলো ও। মোমরঙে আকা ছবিটা দেখেই মিইয়ে গেলো ওর হাসি। মেঝেতে বসে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো রাকীন। গ্রামের চিত্রপট আঁকা ছবিটা দেখতে দেখতে ধরা গলায় বললো,

-জানিস? ইচ্ছে ফিরে এসেছে। তোর স্বপ্নও পুরন হতে চলেছে। এখন আমার চারপাশে শুধু তোর অভাব খেয়া। এতোগুলো বছর হলো এই অভাব সইতে সইতে আমি ক্লান্ত রে! দমবন্ধ লাগছে! কোথায় হারিয়ে গেলি তুই বলতো? কোথায় হারিয়ে গেলি? এতো অভিমান তোর? ছোট্ট একটা ঘটনায় এভাবে সবাইকে ছেড়ে চলে গেলি তুই? আর আসবি না খেয়া? সবাই কি তাহলে সত্যিই বলে? তুই সত্যিই আর ফিরবি না? আমাদের কাছে? আমার কাছে? এভাবেই আজীবন তোর স্মৃতি বইতে হবে আমাকে? কি করে বুঝাই তোকে বল? যে যাই কিছু বলুক না কেনো,আমার অনেকটা জুড়ে এখনো তুই। তোকে হারিয়ে এখন অনুভব হয়,তোর স্মৃতি না,তোকে আগলে বাচতে চাই আমি! শুধুই তোকে আগলে বাচতে চাই খেয়া! শুধুই তোকে!

#চলবে…