#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পর্ব_৫
#লেখিকা_তাসফিয়াহ_আনজুম
বিয়ে। এই শব্দটা ঠিক তার নামের মতই দুটো মানুষকে এক সুতোয় বেঁধে দেয়। অভেদ ঘটায় দুটি চিত্তের। জীবনের অন্তিম সমীরন অব্দি সংস্পর্শে থাকার অঙ্গীকার পায় দুটি হৃদয়। আজ ঝুমুরের বিয়ে। ঝুমুরকে একটা লাল টুকটুকে কাতান শাড়ি পড়ানো হয়েছে। চুলগুলো খোঁপা করে দেয়া হয়েছে। সেখানে গুঁজে দিল দু’তিনটে রক্তিম জারবেরা ফুল। দুই হাত ভর্তি ভেলভেট চুড়ি, দুইপাশে দুইটা করে সোনার চুড়ি,কানে , গলায় বেশ কয়েকটা জুয়েলারি পড়ানো হয়েছে। লাল রঙের শাড়িতে যেন পুতুলের মত লাগছিল ঝুমুরকে।
বর এসেছে!বর এসেছে! বলে হইহুল্লোর শুরু করে দিল সবাই।
এই শব্দগুলো কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই অস্বস্তিতে ছেয়ে গেল ঝুমুরের সবাঙ্গ। জীবনে বহুবার এরকম শব্দ শুনেছে কিন্তু কখনো এমন অনুভূতি হয় নি তার। হয়তো এখন নিজের বিয়ে বলেই এমনটা হচ্ছে।
_________
ওয়াহিদ আর ঝুমুরকে পাশাপাশি বসানো হলো। আসার পর থেকেই ওয়াহিদ বেশ কয়েকবার ঝুমুরের মুখটা দেখার চেষ্টা করলো।কিন্তু বেশ বড় একটা ওড়না দিয়ে মুখটা ঢেকে রাখায় ভালোভাবে দেখতে পারলো না। কাজী সাহেব এসে বসলো দুজনের সামনে। প্রথমে ঝুমুরকে কবুল বলতে বলা হলো। বেশ অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও ঝুমুরের মুখ থেকে ‘কবুল’ শব্দটা শোনা গেল না। আফতার সাহেব এগিয়ে গিয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মেয়েকে ভরসা দিলেন। ঝুমুর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো। পাশে বসে থাকা ওয়াহিদকে একবারশান্ত দৃষ্টিতে দেখলো। তারপর শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
‘কবুল, কবুল, কবুল।’
এবার ওয়াহিদ কে কবুল বলতে বলা হলো। কবুল বলতে ঝুমুর যতটুকু সময় নিয়েছিল তার তিনভাগের একভাগও নেয়নি ওয়াহিদ।
‘কবুল, কবুল, কবুল।’ এক নিঃশ্বাসে ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে হালকা কন্ঠে বলে দিল ওয়াহিদ।
আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো সবাই।
বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে নিল সবাই। কিছুক্ষণ বসে থেকে গল্প গুজব করে সবার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ঝুমুরকে নিয়ে বাড়িতে ফেরার তোরজোর শুরু করে দিলেন শাকিল শেখ। ঝুমুরের বাবা আদরের কন্যার হাত তুলে দিলেন ওয়াহিদের হাতে। এবার বাবাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠেলো ঝুমুর। আফতার সাহেবের চোখের কোণেও জল জমেছে।”কেঁদো না আম্মু। তোমার যখন আমাদের কথা মনে পড়বে তখনই চলে আসবে।” মেয়ের কপালে স্নেহের আবেশে হাত বুলিয়ে দিলেন আফতার সাহেব। মা আর অন্যান্য আত্মীয়দের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঝুমুরকে গাড়িতে বসানো হলো। ওয়াহিদ গিয়ে বসলে ঝুমুরের পাশের সিটে।
______
রাত প্রায় বারোটা। সকল নিয়ম-কানুন শেষ করে ঝুমুরকে ওয়াহিদের রুমে বসানো হলো। ফুলের সজ্জিত বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে ঝুমুর। সারা রুম জুড়ে ভেসে আসছে হরেক রকম ফুলের সুবাস। ঘরে জ্বলছে নিভু নিভু আলো। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসছে ঝুমুরের। বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে রইল সে।
বাইরে থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসছে। ওয়াহিদের ভাই-বোনেরা টাকার জন্য দরজায় আটকে দিয়েছে তাকে।
“শাড়িটা পরিবর্তন করে ঘুমাও। এত ভারী শাড়িতে সারাদিন থেকে নিশ্চয়ই আনকম্ফোরটেবল ফিল করছো।”
গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠস্বর কানে যেতেই চোখ খুলে তাকালো ঝুমুর।ওয়াহিদকে দেখে তাড়াহুড়া করে খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো সে। কি যেন ভেবে হুট করে ওয়াহিদের সামনে গিয়ে সালাম করে বসলো তাকে।
ওয়াহিদ বেশ চমকে গেল। এই কি সেই ঝুমুর? যে গতকাল পর্যন্ত বিয়েটাই করতে চাইতো না!
“আপনার ভাবীরা বলেছিল সালাম করতে, তাই।”নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে ঝুমুর।
ওহ আচ্ছা। বলে ঝুমুরকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে আলমারি খুলে একটা বাদামি রঙের খাম আর একটা নীল রঙের র্যাপিং কাগজে মোড়ানো মাঝামাঝি আকারের বক্স বের করে আনল।
“এটা তোমার মোহরানার টাকা।”বাদামি রঙের খামটা ঝুমুরের হাতে দিয়ে বলল ওয়াহিদ। এটার উপর শুধু তোমার অধিকার। তোমার যেভাবে খুশী খরচ করবে।
“এত টাকা দিয়ে আমি কি করবো?”
তোমার টাকা। তুমিই জানো!
এবার ঝুমুরের দিকে নীল কাগজে মোড়ানো বক্সটা এগিয়ে দিল, নাও এটা তোমার বিয়ের প্রথম রাতের উপহার।
এসবের কি দরকার…
হুশ! কোনো কথা নয়। এখন আমার রিটার্ন গিফট দাও।
রিটার্ন গিফট! কি দিবো আমি!
চুমু। দুষ্টু হেসে বলে নিজের গাল বাড়িয়ে দিলো ওয়াহিদ।
কিই!!
শুনো নি?আবার বলবো?
দেখুন..!
দেখার জন্য তো সারারাত পড়ে আছে বউ। ঝুমুরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো ওয়াহিদ।
কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলা কণ্ঠস্বরে কেঁপে উঠল ঝুমুর। হৃদস্পন্দন থমকে গেল তার।বেশ কয়েকবার ওয়াহিদের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইল। কিন্তু পুরুষ মানুষের শক্তির কাছে সে ব্যর্থ হল। তার মধ্যে আর ছাড়িয়ে নেয়ার প্রয়াস ও দেখা গেল না। চোখ বন্ধ করে দুই হাতে শাড়ি মুঠো করে ধরে পাথরের মতো ঠাই দাঁড়িয়ে রইল।
কিছুসময় পর ওয়াহিদ ঝুমুরের কপালে একটা উষ্ণ চুমু দিয়ে নিজের বাহুডোর থেকে আলাদা করলো।যাও ফ্রেস হয়ে ওযু করে আসো। দুজনে একসঙ্গে নামাজ পড়বো।
ঝুমুর কিছু না বলে দ্রুত শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। লজ্জায় তার কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে।
বেশ অনেকক্ষণ পর শাড়ি পাল্টে মেরুন রঙের জর্জেট একটা শাড়ি পড়ে ওয়াশরুম থেকে বের হল ঝুমুর। সে শাড়ি পড়তে পারে মোটামুটি। সারাদিনের ভারী সাজগোজ আবার মাথাও প্রচন্ড ব্যথা করছিল তাই একেবারে গোসল করে নিয়েছে।ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছিল তার। চুলের পানিতে শাড়ির পেছনে ভিজে গেল বেশ অনেকখানি। দৃশ্যমান হলো মসৃণ কোমর। হঠাৎ ঝুমুরের চোখ যার সোফায় বসে থাকা ওয়াহিদের দিকে। ওয়াহিদ সম্মোহনী দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। কিন্তু দৃষ্টিটা মুখের দিকে ছিল না। ওয়াহিদের চোখে চোখ মিলিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই শাড়ির আঁচলটা ভালোভাবে পেঁচিয়ে নিল শরীরে।
ওয়াহিদ সোফা থেকে উঠে এগিয়ে এলো ঝুমূরের দিকে। “নিজেকে এত পেঁচিয়ে রাখার কি আছে?আমিই তো।” কোমরে শাড়ি দ্বারা আবৃত অংশে হাত রেখে বললো ওয়াহিদ।
চলবে।