#প্রেমের_তাজমহল_২
#পর্ব৬
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
পুরো আকাশ জুড়ে কালো মেঘেদের আনাগোনা। দেখে মনে হচ্ছে আকাশের ভারী দুঃখ হয়েছে। তাই সে কপালে কালো মেঘেদের ভেলা ভাসিয়ে রেখেছে। আনায়া অর্ণবের পাঠানো বার্তা পড়ে শুকনো ঢোক গিললো। এখন এই অ*সভ্য এমপিকে ক্ষেপানো মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা। আনায়া চায় না এমন কিছু হোক। আনায়া যতো চায় মানুষটার থেকে দূরে থাকতে, তাকে ইগনোর করতে। মানুষটা যেন ঠিক ততটাই কাছে চলে আসে। তাকে চেয়েও দূরে সরিয়ে রাখতে পারছে না আনায়া। আনায়ার ভাবনার মাঝে আবার কল এলো। এবার রিসিভ না করে উপায় নেই। আনায়া নিজেকে সামলে ফোন রিসিভ করলো। কেউ কোনো কথা বলছে না। দুজনই নিশ্চুপ। যেন প্রতিযোগিতা চলছে কে কতক্ষন চুপ থাকতে পারে। নীরবতা ভেঙ্গে অর্ণবই প্রথমে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কি সমস্যা? এতবার কল দিচ্ছি রিসিভ করছো না কেন? সেদিনের কথা গুলো কি ভুলে গিয়েছো?”
“যেটা বলার জন্য কল দিয়েছেন সেটা বলে ফোন রাখুন। আপনার সাথে আমার এক্সট্রা কোন কথা নেই”
“প্রেম করার জন্য ফোন দিয়েছি, কিন্তু তুমি তো আবার আমার সাথে প্রেম করবে না। এখন কি করি বলো তো?”
আনায়া বিড়বিড় করে বলল,
“অ*সভ্য এমপি। এতই যেহেতু জেনে বসে আছেন তাহলে কল দেওয়ার কি দরকার ছিলো?”
অর্ণব আনায়ার কথা স্পষ্ট শুনতে না পেয়ে সুধালো ,
“কি বিড়বিড় করছো? জোরে বলো শুনি”
“কিছু না। কিছু বলার থাকলে বলুন নাহলে রাখছি”
“তোমার সাহস তো কম না মেয়ে। এমপি অর্ণব সিকদারের মুখের ওপর কল কাটতে চাইছো?”
আনায়া কিছু বলল না। অর্ণব বুঝলো মেয়েটা তার ওপর রাগ করেছে। এমনিতেই তাকে দু চোখে দেখতে পারেন না, তার ওপর আজকে যেই ধমক টা দিয়েছে এরপর রাগ করাটাই স্বাভাবিক। শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“রাগ করেছো? ওই সময় ধমক দিয়েছি বলে?”
আনায়া তাও কিছু বলল না। লোকটাকে ইচ্ছে করছে সাবান ছাড়াই ধুয়ে দিতে। ধমক দিয়ে এখন ঢং দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছে রাগ করছো?
“আচ্ছা সরি। আমার ওভাবে বকা ঠিক হয়নি। তবে ভুল কিন্ত তোমারও ছিলো। তুমি কেন আমায় বলনি যে তুমি ইচ্ছে করে নাম দেও নি?”
আনায়া মুখ ফুলিয়ে বলল,
“আপনি আমায় বলার সুযোগ দিয়েছিলেন যে বলবো। শুরুতেই তো ধমকাধমকি করা শুরু করে দিয়েছিলেন”
“আচ্ছা, বুঝলাম আমার ভুল। তবে তুমি কেন স্টেজে গেলে? নাম ডাকলেই যেতে হবে? বাহানা দিয়ে চলে আসতে”
“এতোকিছু তখন ভাবিনি”
অতঃপর দুজনেই চুপ। অর্ণব অধির আগ্রহ নিয়ে তার ‘মায়াবতীর’ শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ অনুভব করছে।
“একটা কথা কি জানো মায়াবতী? নেভি ব্লু শাড়ি, হাতে ম্যাচিং চুরি, উন্মুক্ত তার কেশ গুচ্ছ, চোখে গাঢ় কাজল আমায় আফিমের নেশার চেয়েও বেশি টানে। তার আশেপাশে আমি কাউকে সহ্য করতে পারি না। তাই না চাইতেও তার বেলায় কঠোর হয়ে যাই । জানো মায়াবতী তার বেলায় আমি স্বার্থপর, বড্ড স্বার্থপর। তার একটু খানি ভাগও আমি কাউকে দিতে রাজি নইমা সে আমার মানে পুরোপুরি আমার”
আনায়া চমালো। একটু না অনেকটাই। এমপি সাহেব হুট্ করে তাকে ‘মায়াবতী’ সম্মোধন করলো যে? তবে কি সে ওকে ভালোবাসে? নাকি এমনি হুট্ করে ইচ্ছে হলো বলে বলে দিলো। যদিও ভালোবাসার তেমন কারণ নেই। আনায়ার সাথে কখনো তার তেমন ভাবে কথা হয়নি। ভাইয়ের বন্ধু হিসেবে তার আগমন হতো বাড়িতে। তবে আনায়া কখনো তার সাথে কথা বলেনি। কারণ মানুষটা যে রাজনীতি করে। রাজনীতি যেখানে আনায়ার চির শত্রু।
অর্ণবের কথা শুনে আনায়ার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটতে যেয়েও ফুটলো না। গম্ভীর্য ধারণ করার বৃথা চেষ্টা করলো। অর্ণব ফের বলল,
“আমায় কি একটুও ভালোবাসা যায় না মায়াবতী? রাজনীতি করি বলে আমি এতটাই খারাপ? একবার বিশ্বাস করে ভালোবেসে দেখো সারাজীবন আগলে রাখবো বাহুডোরে। কখনো কোনো অভিযোগ করার সুযোগ দিবো না। একটা বার আমায় সুযোগ দেও মায়াবতী, শুধু মাত্র একবার। যদি কোনো ভুল করি তবে তুমি যা শাস্তি দিবে আমি মাথা পেতে নিবো”
অর্ণবের এমন আকুল কণ্ঠে শুনে আনায়ার মন গোললো কিনা কে জানে? আনায়ার প্রতিক্রিয়া দেখে কিছুই বোঝা গেলো না। মুখ ফুটে বলল,
“আমি ঘুমবো”
অর্ণব কোনো কথা বললো না। আনায়া অর্ণবের সারা শব্দ না পেয়ে কল কেটে দিলো। ওপর পাশে অর্ণব হতাশ হলো। মেয়েটা এমন কেন? কেন তাকে একটুও বুঝতে চায় না? তার একটাই দোষ সে রাজনীতি করে। অর্ণব চাইলেও রাজনীতি ছাড়তে পারবে না। রাজনীতি তার ভালোবাসা, এক প্রকার তার রক্তের সাথে মিশে গেছে। তার অস্তিত্ব। অর্ণব হতাশ হয়ে মনে মনে ভাবলো মেয়েটাকে আর ফোন দিবে না। থাকুক সে তার মতো। নিজেকে বুঝিয়ে ঘুমাতে গেল।
——-
আনায়া আর অর্ষা ক্যান্টিনে বসে আছে। অর্ষা সেই কখন থেকে বক বক করে চলেছে তবে আনায়ার সেদিকে খেয়াল নেই। বেচারি মত্ত তার নিজ ভাবনায়। সেদিনের পর কেটে গেছে পাঁচটা দিন। অর্ণব আর তাকে ফোন দেয়নি। আর না দিয়েছে কোনো হু*মকি স্বরূপ বার্তা। আনায়া ভাবলো মানুষটা এতো ভালো হলো কবে থেকে? এই যে তাকে ডিসটার্ব করছে না। হুট্ করে মনে পড়লো অর্ণবের সেই আকুল আবেদনময় বাক্য গুলো। কতো টা আকুলতাই না ছিলো তার শব্দের মাঝে। তবে আনায়া নামক রমণীkকে ঘায়েল করতে তা সক্ষম নয়। আনায়ার মনে অকস্মাৎ প্রশ্ন এলো অ*সভ্য এমপি সুস্থ আছে তো? তার কিছু হয়নি তো? পরক্ষনে ভাবলো হলেই বা তার কি? মানুষটাকে নিয়ে সে ভাববে না। পাশ থেকে অর্ষা ধাক্কা দিলো। আনায়া রাগী কণ্ঠে বলল,
“কি হলো ধাক্কা দিচ্ছিস কেন?”
“সেই কখন থেকে ডাকছি তোকে সে খেয়াল আছে? কোন ভাবনায় মত্ত হয়ে আসছিস শুনি?”
অর্ষার প্রশ্নে আনায়া থতমত খেয়ে গেল। এখন কোনো মতেই অর্ষা কে অর্ণব এর কথা বলা যাবেনা। তাহলে ওকে খেপাবে।
“তেমন কিছু না। তুই বল কি বলছিলি”
অর্ষা পুনরায় বলা শুরু করলো। আনায়া অর্ষার কথা মনোযোগ সহকারে শুনার চেষ্টা করলেও মনের মাঝে কোথাও অর্ণবের খেয়াল আসছে।
——
ক্লান্ত বিকেলে সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। আকাশে পেজো পেজো মেঘেদের ভেলা। আনায়া উদাস ভঙ্গিতে চেয়ে আছে আকাশ পানে। এইযে তার উদাসীনতা, তার মন খারাপে কারণ তার জানা নেই। শুধু। মনে হচ্ছে কোথাও কেউ নেই। কারো অস্তিত্বের হাহাকার। আনায়া এক মনে তাকিয়ে আছে। এমন সময় মিহি এলো রুমে।
“কি করো আপু?”
আনায়া বিরস কণ্ঠে জবাব দিলো,
“কিছু না। কিছু কি বলবি?”
“চলোনা আড্ডা দেই, গল্প করি। তুমি ইদানিং কেমন বদলে যাচ্ছে। অনেক দিন আড্ডা দেয়া হয়না। মাহির ভাইয়া, ভাবি, অর্ষা আপুও এসেছে। তোমায় ডাকছে”
“তোরা গল্প কর। আমার ভালো লাগছে না”
“যাও তোমার সাথে কথা নেই”
মিহি গাল ফুলিয়ে রাগ দেখিয়ে চলে গেল। আনায়া কি করবে? ওর নিজেরই তো কি নিজেকে কেমন বিরক্ত লাগছে। বিরহ এসে ধরা দিচ্ছে মনের কোণে চুপি সারে।
রাত দশটা নাগাদ আনায়া বসে আছে ওর ব্যালকনিতে থাকা কাউচে। পাশে অবহেলায় পড়ে আছে আনায়ার শখের মোবাইল খানা। যেটা ছাড়া আনায়া নিজেকে এক মুহূর্তের জন্য কল্পনা না করতে পারে না। তাকেও অবহেলায় ফেলে রেখেছে। আচমকা বিকট শব্দে আনায়ার পাশে রাখারা ফোনটা বেজে উঠলো। রাতের এই নিস্তব্ধ পরিবেশে আনায়ার কাছে ফোনের শব্দ কিছুটা বিকটাই লাগলো। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্ক্রিনে তাকালো। স্ক্রিনে “অ’সভ্য এমপি” নামটা দেখে মনের মাঝে কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। মানুষটা সেদিনের পরে ওকে ফোন দিতে পারে আনায়া কখনো ভাবেনি। অজান্তেই ওর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো মুচকি হাসি। তবে মুখটা গম্ভীর করে ফোন রিসিভ করলো।
আনায়া চুপচাপ ফোন কানে ধরে রাখলো। পাশের মানুষটাও চুপ করে আছে। সেকেন্ড গড়িয়ে মিনিট পার হলো তবে দুজনের কেউ মুখ খুলছে না। যেন দুজনের মাঝে প্রতিযোগিতা হচ্ছে কে বেশিক্ষণ চুপ থাকতে পারবে। তবে অর্ণব পারলো না। নীরবতা ভেঙ্গে জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন আছো?”
পাঁচ দিন পর অর্ণবের কণ্ঠস্বর শুনলো আনায়া। তবে মনে হচ্ছে অনেক দিন পর শুনলো। যদিও মানুষটার সাথে তার প্রতিদিন কথা হতো এমন না। তবে কেন যেন মনে হচ্ছে অনেক দিন পর। অর্ণবের কেমন আছো’র উত্তর কি দিবে আনায়া? সত্যি বলতে সে তো ভালো নেই। শরীর ভালো থাকলেও মনে জমে আছে কালো মেঘের ঘনঘটা। তবে অর্ণবকে এটা বলা যাবে না। তাই আনায়া নিজেকে সামলে জবাব দিলো,
“ভালো, আপনি?”
“তুমি মেয়ে আমার কথা জিজ্ঞেসই করো না। মাঝে পাঁচ পাঁচটা দিন কেটে গেল তবে তুমি একটিবারও আমার খবর নিলে না। একবারও জানতে চাইলে না আমি মানুষটা বেঁচে আছি কিনা? আমি নাহয় অভিমান করে কল দেইনি তাই বলে তুমিও একবার আমায় কল দিবে না? তোমার নাম ‘মায়াবতী’ না দিয়ে ‘নিষ্ঠুরিনি’ দেওয়া দরকার ছিলো। আমার বেলায় তুমি মানুষটা বড্ড নিষ্ঠুর”
অতঃপর একটুও থামলো। আনায়া অর্ণবের কথার পৃষ্ঠে কিছুই বললো না। সত্যি তো মানুষটা ঠিকই বলেছে। তার বলা একটা কথাও মিথ্যা না। অর্ণব ফের কাতর কণ্ঠে সুধালো,
“আমার বেলায় কেন এতো নিষ্ঠুরতা বলতে পারো মায়াবতী?”
#চলবে?
#প্রেমের_তাজমহল_২
#পর্ব৭
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
“আমার বেলায় কেন এতো নিষ্ঠুরতা বলতে পারো মায়াবতী?”
অর্ণবের কণ্ঠস্বর বড্ড অসহায় লাগলো আনায়ার নিকট। মনে হলো কেউ তীক্ষ্ণ চুরি বিধিয়ে দিলো আনায়ার বুকে। এই একটা কথার মাঝে লুকিয়ে আছে হাজার অভিযোগ, অভিমান। আনায়া অর্ণবের কথার পৃষ্ঠে জবাব দেওয়া মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। আসলেই তো আনায়া কেন শুধু মাত্র এই মানুষটার বেলায় এতটা নিষ্ঠুর? শুধু মাত্র সে রাজনীতি করে বলে? নাকি অন্য কিছু? আনায়া নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো তবে কোনো যথাযথ উত্তর পেল না। অর্ণব ফের বলে উঠলো,
“আচ্ছা বাদ দেও সেসব কথা। আমার বেলায় তুমি নিষ্ঠুর হলেও তোমার বেলায় আমি উদার হবো। যে উদারতায় থাকবে না সামান্য তম কার্পণ্য। তুমি ফিরিয়ে দিলেও আমি তোমায় ছাড়ছি না মেয়ে”
আনায়া অবাক হলো। এই মানুষটা এতটা পা*গলাটে কেন? সাধারণত এমপি মানুষ জন অনেক ইগো ওয়ালা হয়। তাঁদের কেউ কোনো বিষয়ে রিজেক্ট করলে তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বা তার ক্ষতি করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। তবে অর্ণব মানুষটা ভিন্ন। আনায়ার এদিকে দিয়ে অর্ণবকে ভালো লেগেছে।
অর্ণব একা একা বক বক করছে আনায়া না চাইতেও শুনছে। মাঝে মাঝে হু, হাঁ উত্তর দিচ্ছে। অর্ণব এক মনে এটা ওটা বলেই চলেছে। আনায়া কানে ফোন রেখেই আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
——
সকাল সকাল অর্ষা এসে হাজির। এদিকে আনায়ার খাওয়াও হয়নি ঠিক করে। আনায়া খাচ্ছে পাশে আবিরও আছে। আবির কলে কার সাথে যেন কথা বলছে। ওর ঠোঁটের কোণে লেগে আছে হাসি। হেসে হেসে অপর পাশের মানুষটার সাথে কথা বলছে। অর্ষা দূরে সোফায় বসে তাকালো আবিরের দিকে। ছেলেটাকে হাসলে এতো সুন্দর লাগে যে অর্ষার ইচ্ছে করে শুধু তাকিয়ে থাকতে। তবে ইচ্ছে হলেও তাকিয়ে থাকতে পারে না। অর্ষা আবিরের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে এমন সময় পাশ থেকে আনায়া বলল,
“দেখা শেষ হলে চল”
অর্ষা থতমত খেয়ে গেল। আনায়া এখানে কখন এলো। ও না আবিরের পাশে খাচ্ছিলো?
“কিছু বললি?”
“বললাম চল”
অর্ষা উঠে আনায়ার সাথে হাঁটা দিলো। এমন সময় আবির পিছন থেকে বলে উঠলো,
“বাহিরে যেয়ে দাঁড়া। আমি আসছি। তোদের ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে আমি অফিসে যাবো”
আনায়া মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। আনায়া অর্ষার কানে ফিসফিস করে বলল,
“যেভাবে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিলো চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিলি? একটু তো ছাড় দে আমার ভাইটাকে”
অর্ষা আনায়ার কথায় লজ্জা পেল। লজ্জায় ওর কান, গাল রক্তিম বর্ণ ধারণ করছে। আনায়া জানে মেয়েটা লজ্জাবতী তাও ‘ও’ ইচ্ছে করেই ওকে লজ্জা দিচ্ছে। অর্ষা লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
“তুই চুপ করবি?”
“সত্যি বললে এমনই হয়”
আনায়া আর অর্ষা বাহিরে এসে দাঁড়ালো। কিছুক্ষনের মাঝেই আবির এসে গাড়ি বের করলো। আনায়া আর অর্ষা উঠে বসলো। গাড়ি চলতে শুরু করলো আপন গন্তব্যে।
পর পর চারটা ক্লাস করে ক্লান্ত সবাই। একেক জনের কোমর ধরে এসেছে। সাধারণত একটা ক্লাসের পর বা দুটো ক্লাসের পর ব্রেক থাকে তবে আজকে কোনো ব্রেক ছিলো না। আনায়া অর্ষা সাথে ওদের ফ্রেন্ড গুলো ক্লাস শেষ হতেই ছুটলো ক্যান্টিনের দিকে। খিদেয় পেটের মধ্যে ইঁদুর দৌড়া দৌড়ি করছে। খাবার অর্ডার দিয়ে যে যার মতো গল্প আড্ডায় ব্যস্ত হলো। কিছুক্ষণের মাঝে খাবার চলে এলো।
আনায়াদের এক ক্লাস গ্যাপ দিয়ে আরো দুটো ক্লাস বাকি। খাওয়া শেষে সকলে উঠে দাঁড়ালো ক্লাসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। মাঠে আসতেই আনায়ার নজর গেল আনায়াদের ডিপার্টমেন্ট এর সামনে বাইকে হেলান দিয়ে সিগারেট মুখে নিশানের দিকে। লোকটা কে দেখলেই আনায়ার শরীর ঘৃ*ণায় গুলিয়ে ওঠে। তার সেই বিশ্রী চাহনির কথা মনে পড়ে যায়। আনায়া কোনো কথা না বলে চুপচাপ নিশানের পাশে কাটিয়ে যেতে নিলো। এমন সময় ওড়নায় টান লাগলো। আনায়া ভাবলো হয়তো কোথাও আটকেছে। তাই ওড়না ধরে টান দিলো তবে আসছে না। আনায়াকে দাঁড়াতে দেখে বাকিরাও আটকে গেল।
আনায়া পিছু ঘুরলো। দেখলো নিশানের হাতের মাঝে ওর ওড়নার কোনা। আনায়া মাথা মুহূর্তেই গরম হয়ে গেল। আনায়া ওড়না ধরে জোরে টান দিলো তবে নিশান অনেক শক্ত করে ধরে রেখেছে। আনায়া চেয়েও ছাড়াতে পারছে না। নিশান আনায়ার ওড়নার কোনা হাতে পেঁচাতে পেঁচাতে কাছে এলো।
“কি ব্যাপার পরী ইদানিং তোমায় দেখা যাচ্ছে না দেখি? ইগনোর করছো আমায়? তবে লাভ নেই। এই নিশানের নজর থেকে তোমায় কেউ বাঁচতে পারবে না। তুমি একবার নিশান আহমেদের চোখে পড়েছো মানে তুমি তার”
আনায়ার রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে। নিশানের নিকৃষ্ট দৃষ্টি ও সহ্য করতে পারছে না। ইচ্ছে করছে নিশানের চোখ তুলে গুটি খেলতে। আনায়া দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ওড়না ছাড়ুন”
“এতো সহজে তো ছাড়বো না পরী। সেদিন এতো ভালো নাচলে তার পুরুস্কার নিবে না? এসো আমি তোমায় পুরুস্কার দিচ্ছি”
নিশান আনায়ার ওড়না সেভাবেই হাতের মুঠোয় রেখে আনায়ার হাত ধরলো। আশেপাশে ভীড় জমে গেছে। অনেকেই তামাশা দেখতে দাঁড়িয়ে গেছে। নিশান ঠোঁটের ভাঁজে চেপে রাখা সিগারেটের ধোয়া আনায়ার মুখের ওপর ছাড়লো। আনায়া কাশছে। ও ধোয়া সহ্ করতে পারে না। ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় ওর। কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে।
“হাত ছাড়ুন, ছাড়ুন বলছি”
“ছাড়বো না। না ছাড়লে কি করবে শুনি?”
আনায়া নিজের রাগ সামলাতে না পেরে গাঁয়ের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ঠাস করে থা*প্পড় বসিয়ে দিলো নিশানের গাঁয়ে। আশেপাশে সবার মুখ হাঁ হয়ে গেছে। তারা হয়তো ভাবেনি আনায়া এমন কিছু করতে পারে। ভার্সিটিতে রেগিং অহরহ কম বেশি হয়ে থাকে। নিশান গালে হাত দিয়ে ক্রোধে ভরা চোখে তাকিয়ে আছে আনায়ার দিকে। তবে আনায়া ভয় পেল না। বরং আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে বলল,
“আপনার সাহস কিভাবে হয় আমার হাত ধরার?আপনার ওই হাত আমি কেটে কুচি কুচি করে কুকুর কে খাওয়াবো, মাইন্ড ইট। এতদিন যা করছেন সিনিয়র বলে কিছু করিনি। কিন্তু আজকে আপনি সব কিছুর সীমা ছাড়িয়ে গেছেন। এতো দিন কিছু বলিনি তার মানে দুর্বল ভাববেন না। এরপর আপনাকে আমার আশেপাশে দেখলে ভালো হবে না বলে দিলাম। একদম খু*ন করে ফেলবো । আর লজ্জা থাকলে আমার সামনে আসবেন না”
কথা গুলো বলে আনায়া আশেপাশে জড়ো হওয়া মানুষ গুলোর দিকে তাকালো। তাঁদের দেখে মনে হচ্ছে তারা সিরিয়াল দেখতে এসেছে। আনায়া এক প্রকার চি*ল্লিয়েই বলল,
“সিরিয়াল দেখা শেষ হলে আপনারা আসতে পারেন”
আনায়া গট গট পায়ে হাঁটা দিলো। এতক্ষণ রাগের মাথায় কি বলেছে বা করেছে আনায়ার সে দিকে খেয়াল নেই। এই মেয়েটা এমনই, এমনি যথেষ্ট ভদ্র তবে রেগে গেলে দেখা যায় তার আসল রূপ। সে কতটা ভ*য়ংকর হতে পারে। আনায়া এখনো রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। টেবিলে ব্যাগ রেখে ওয়াশরুমে গেল। এখন হাত না ধুলে মনে হবে হাতে নর্দমার জীবাণু লেগে আছে। আনায়া ঘষে ঘষে হাত ধুলো।
অর্ষা অবাক চোখে চেয়ে আছে আনায়ার দিকে। সাথে আশপাশ থেকে ওর বান্ধবীরাও তাকিয়ে আছে। আনায়া ওদের এভাবে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? তোরা সবাই এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন? মনে হচ্ছে এলিয়েন দেখেছিস”
পাশ থেকে আনায়ার ফ্রেন্ড রাইহা বলল,
“তুই আজকে যা খেল দেখালি আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম। তুই জানিস নিশান কার ছেলে? ও কতটা ডে*ঞ্জারাস? আমি ভাবছি ও এই থা*প্পড় এর বদলা কিভাবে নিবে সেটা। নিশান বড় লোক বাপের বিগড়া হুয়া ছেলে”
“নো টেনশন। ওর মতো নিশান পিশানকে কে ভয় পায়? আনায়া ভয় পায় না”
আনায়া মুখে এটা বললেও মনে মনে ভয় কাজ করছে। তবে আনায়া সেটা কাউকে বুঝতে দিলো না।
——–
ভার্সিটি অফ আজকে। আনায়া বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। ছুটির দিন গুলোতে ওর ঘুম থেকে উঠতেই ইচ্ছে করে না। তার ওপর দিনটা যদি হয় বৃষ্টিময় তাহলে তো কথাই নেই। সকাল সকাল এক দফা বৃষ্টি হওয়ায় ঠান্ডা পরিবেশ। পরিবেশ জুড়ে বইছে ঠান্ডা হাওয়া। আনায়া চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। তবে ওর সাধের ঘুম যেন পছন্দ হলো না বজ্জাত ফোনের। বিকট শব্দে বেজে উঠলো। আনায়া চরম বিরক্ত হলো। ইচ্ছে করছে ফোনটা তুলেই আছাড় দিতে। তবে সেটা যে দেওয়া যাবে না। ঘুমের ঘোরে হাতড়ে ফোনটা নিয়ে রিসিভ করে কানে ধরলো। অপর পাশের ব্যক্তির শব্দ শুনে মুহূর্তেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সিম কোম্পানি থেকে কল এসেছে। আনায়া ফোনটা বিছানায় ছুড়ে ফেলল। তার সাধের ঘুম নষ্ট করার জন্য লোকগুলো কে বকা দিতে ভুলল না। উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেল এখন আর ঘুম হবে না।
খাওয়া শেষে আনায়া নিজের রুমে বসে আছে। ফোন স্ক্রল করছে। তবে কিছুই ভালো লাগছে না। বিরক্ত লাগছে সব কিছু। আচমকা বাহিরে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। আনায়ার বিষিয়ে থাকা মনটা মুহূর্তেই আনন্দে নেচে উঠলো। টুপ্ করে আয়নার সামনে যেয়ে চোখে কাজল পড়লে। বেঁধে রাখা কেশগুচ্ছ উন্মুক্ত করে দিলো। পুরো পিঠে ছড়িয়ে গেল উন্মুক্ত কেশ গুচ্ছ। অতঃপর ছুটলো ছাদের পানে।
আকাশে মেঘেদের ভেলা। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির প্রকোপে শুকনো আনায়া নিমিষেই ভিজে গেল। কাক ভেজা যাকে বলে। আনায়া চোখ বুজে বৃষ্টির ফোঁটা গুলো গায়ে মাখছে আবেশে। হাত পেতে বৃষ্টির ফোঁটা হাতে জমা করে ছিটিয়ে দিলো। আনায়াকে দেখে মনে হচ্ছে বাচ্চা মেয়ে বৃষ্টির পানি দিয়ে খেলা করছে। আনায়া দু পাশে হাত ছড়িয়ে দিয়ে চোখ বুজে রইলো।
অপর দিকে তৃষ্ণার্থ দৃষ্টিতে এক যুবক তাকিয় আছে তার প্রেয়সীর পানে। যুবকের চোখ জুড়ে খেলা করছে মুগ্ধতা। প্রেয়সীর মায়া ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
“মায়াবতী, আমার মায়াবতী”
#চলবে?