ফিরে আসা ২ পর্ব-৭৬ এবং শেষ পর্ব

0
652

#ফিরে_আসা২
শেষ পর্ব
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

“মানে কী? দেড় ঘন্টা পর প্রিমিয়ার আর এখন তোমরা এই কথা বলছো?” চিন্তায় অস্থির হয়ে বলল অরা।

রাকিব কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, “সরি ম্যাম। আসলে অফিস থেকে ফাইলটা চেক করে আনা হয়নি।

এমন একটা মুহূর্তে অরার রাগ করা উচিত। তবে রাগের থেকেও তার মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে অসহায়ত্ব এবং দুশ্চিন্তা। আগামীকাল মুক্তি পেতে যাচ্ছে এদেশের মানুষের বহুল প্রতীক্ষিত সিনেমা ‘দিগন্ত’। সে উপলক্ষে আজ বিলাসবহুল এই মাল্টিপ্লেক্সে আয়োজন করা হয়েছে সিনেমাটির প্রিমিয়ার শো। সিনেমার কলাকুশলী, অভিনেতারা তো আছেই। আজকের শোতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ইন্ডাস্ট্রির বড় বড় সব সেলিব্রিটিদের। তারকাদের আলোয় ঝলমল করছে মাল্টিপ্লেক্সটা। মাল্টিপ্লেক্সের বাইরে সাংবাদিকদের ভীড়। একটু পর পর একেকজন সেলিব্রিটি আসছে আর তারা উৎসাহে ফেটে পড়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত হচ্ছে।

এমন সময়েই কে ফিল্মসের ডিস্ট্রিবিউশনের ছেলে রাকিব এমন একটা সংবাদ জানাতে হলো! সিনেমা হলগুলোতে, বিশেষ করে এমন মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমার ফাইল ডিসিপি ফরমেট করে পাঠানো হয় হার্ডড্রাইভের মাধ্যমে। এখান থেকেই সিনেমাটা প্রজেক্টরের মাধ্যমে তারা দেখায় বড় পর্দায়। নিয়মমাফিক অফিস থেকে আজ সকালেই চলে এসেছিল সিনেমার ফাইলযুক্ত সেই হার্ডড্রাইভ। একটু আগে মাল্টিপ্লেক্সের লোকজন পরীক্ষামূলক শো চালাতে গিয়ে দেখতে পায়, হার্ডড্রাইভে কোনো ফাইলই নেই। ভুল করে ফাঁকা হার্ডড্রাইভ চলে এসেছে এখানে।

অরা উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে বলল, “দ্রুত কাউকে অফিসে পাঠাও!”

“জি ম্যাম, আমি নিজেই যাচ্ছি।”

জমকালো আয়োজনে সেজে উঠেছে দেশের সবথেকে বড় মাল্টিপ্লেক্স। প্রিমিয়ার শো উপলক্ষে আজ সাধারণ মানুষের জন্যে কোনো শো রাখা হয়নি। মাল্টিপ্লেক্সের ভেতরটা সেজে আছে ‘দিগন্ত’র বড় বড় পোস্টারে। দুশ্চিন্তায় পায়চারি করতে করতে নিজের অজান্তেই একটা দেয়ালের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ঢাকা পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো অরা। নিজের অজান্তেই সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে।

সুপারস্টার আরশাদ হক, নিজ সাফল্যের উজ্জ্বলতায় চারিদিকে আলোকিত করা না পর্যন্ত যার শান্তি নেই। তার সর্বশেষ সিনেমা ‘চুপিসারে’ বক্স অফিসে পূর্ববর্তী সকল রেকর্ড ভেঙে ফেলে। দেশ ছাড়িয়ে দেশের বাইরেও ব্যবসা করে মারাত্মক। এদেশের মানুষ আরও একবার বুদ হয় তার অভিনয়ের নেশায়। অফুরন্ত প্রশংসা কুড়িয়েছে সে ‘চুপিসারে’ দিয়ে। সঙ্গে ডজনখানেক অ্যাওয়ার্ড তো রয়েছেই। একটা সিনেমা দিয়েই আরশাদ হক প্রমাণ করে দিলো, এই ইন্ডাস্ট্রি তার। ইন্ডাস্ট্রি থেকে তাকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা, কেবলই বৃথা চেষ্টা।

আরশাদ বরাবরই আত্মবিশ্বাসী একজন মানুষ। ‘চুপিসারে’র পর সেই আত্মবিশ্বাস বহুগুণে বেড়ে গেছে। উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে নতুন করে সে শুরু করলো তার স্বপ্নের সিনেমা ‘দিগন্ত’র কাজ। একই গল্পে নতুন স্ক্রিপ্ট, নতুন টিম, নতুন পরিচালক এবং নতুন অভিনেত্রী। সবার আগে এই গল্পটা কে ফিল্মস নিয়ে গিয়েছিল জনপ্রিয় অভিনেত্রী মোহরের কাছে। বেচারির পা ভেঙে যাওয়ায় সিনেমাটির সঙ্গে সে যুক্ত হতে পারেনি। নতুন করে যখন ‘দিগন্ত’র কাস্টিং শুরু হলো, আবারও তাকেই এই সিনেমায় প্রস্তাব দেওয়া হলো। এক বাক্যে লুফে নিলো সে প্রস্তাবটি। পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হলো আরশাদের প্রিয় পরিচালকদের একজন, সাদাদ করিমকে।

‘দিগন্ত’র টিজার, ট্রেইলার এবং গানগুলো রীতিমত ঝড় তুলে দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। লোকের মুখে মুখে সিনেমার সংলাপ আর গানের লাইন। ইউটিউবে গানের ভিউয়ের রেকর্ড গড়েছে। আয়ের দিক থেকেও যে রেকর্ড গড়তে যাচ্ছে ‘দিগন্ত’, এতে কোনোই সন্দেহ নেই। এখনো মুক্তিও পেলো না, এরই মাঝে সারা দেশে আগামী এক সপ্তাহের টিকেট সোল্ড আউট। সিনেমা হলগুলো আর টিকেট ছাড়ছে না বলে দর্শক রীতিমত আন্দোলনে নেমে যাচ্ছে।

আর্দ্র ভঙ্গিতে অরা মনে মনে বলল, “আকাশের সবথেকে বড় তারাটা তুমি আরশাদ হক, জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকো আজীবন!”

মাল্টিপ্লেক্সের যে হলে সিনেমাটি আজ প্রদর্শিত হবে, সেটি আপাতত বন্ধ। সেলিব্রিটিতে গিজগিজ করছে মাল্টিপ্লেক্সের বাইরেটা। কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে হাস্যোজ্বল ভঙ্গিতে কথা বলছে, কেউ ছবি তুলতে ব্যস্ত। অরার সঙ্গে এগিয়ে এসে কথা বলছে সকলেই। প্রযোজক শ্রেণীর মানুষদের খাতির করে চলা অভিনেতাদের পুরনো অভ্যাস।

কল্পর ছয় মাস বয়সে আবারও অফিসে জয়েন করে অরা। প্রথমদিনে বড়সর একটা চমক অপেক্ষা করছিল তার জন্যে। কে ফিল্মসের ৫০% মালিকানা আরশাদ লিখে দিয়েছে তার নামে। যদিও অরা বারবার বলেছিল, “এসবের কোনো প্রয়োজন নেই।”
তবে কোনটা প্রয়োজন, আর কোনটা অপ্রয়োজন সেটা বোঝার দায়িত্ব কেবলই তার আরশাদের।

আগে সিইও হিসেবে কেবল মোটা অংকের স্যালারি পেতো সে। এখন মালিক হিসেবে সিনেমার লাভের অংশ পাচ্ছে। সেই টাকা অরা ফেলে রাখছে না। আবারও বিনিয়োগ করছে সিনেমাতেই। পুরোদস্তর বিজনেসউইমেন হয়ে উঠেছে অরা।

সকলের সঙ্গে ভদ্রভাবে আলাপচারিতা সারছে অরা। তবে মনের মধ্যে সূক্ষ্ম চিন্তাটা রয়েই যাচ্ছে। মিনিট দশেক পর সকলের থেকে আড়াল হয়ে অরা ফোন করলো রাকিবকে।

রাকিব শুকনো মুখে বলল, “ম্যাম, আমি জ্যামে আটকা পড়ে গেছি।”

অরা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “মেইন রোড দিয়ে গেলে কেন? মলের পেছনের শর্টকাট নিলেই তো হতো!”

রাকিব কী বলবে ভেবে না পেয়ে শুকনো মুখে বলল, “সরি ম্যাম।”

ফোন রেখে দুশ্চিন্তায় ডুবে কয়েক মুহূর্ত বসে রইলো অরা। নাহ্! হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। যা করার তাকেই করতে হবে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে মাল্টিপ্লেক্সের বাইরে পা বাড়ালো অরা। বের হবার পথে সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরলেও বডিগার্ড জহুরুলের সাহায্য সেখান থেকে ছাড়া পেলো।

দ্রুত পায়ে গ্যারেজে গিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো অরা। একটা মেয়ে জমকালো শাড়ি-গয়না পড়ে, ড্রাইভ করছে – দৃশ্যটা সচরাচর দেখা যায় না আশেপাশে। দেখা না গেলেও তার কিছু অরার নেই। দুহাতে দশদিক সামলাতে হয় তাকে। অফিসের হাজারটা দায়িত্ব, কথা-কল্পকে মানুষ করার দায়িত্ব, ভালোবাসার মানুষটাকে ভালোবাসার যোগান দেওয়ার দায়িত্ব। নিঃশ্বাস ফেলার সময় কোথায় তার?

শর্টকাট নিয়ে মিনিট দশেকের মাঝেই অফিসে পৌঁছে গেল অরা। নিজে আর ওপরে উঠলো না। রিসিপশনের একজনকে পাঠিয়ে দিলো এডিটিং সেক্টর থেকে হার্ডড্রাইভ নিয়ে আসতে। এবং অবশ্যই চেক করিয়ে আনতে, ভেতরে আদৌ কোনো ফাইল আছে না।

একটু পর পর ঘড়ি দেখছে অরা। দুশ্চিন্তায় এই এক অসুবিধা হয় তার। হৃদয়টা অনবরত ধুকপুক করতেই থাকে। নিঃশ্বাস থেমে আছে। এখন বাজছে ৬ টা ২৪। শো শুরু হবে ৭টা ৩০ মিনিটে। হাতে এখনো সময় আছে অনেকটা। তবুও ভরসা পাচ্ছে না অরা। যদি ফেরার পথে জ্যামে আটকা পড়ে যায় সে? যদি এই হার্ডড্রাইভেও কিছু না থাকে।

লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো অরা। বাচ্চাদের মতো দুশ্চিন্তা করার অভ্যাসটা তার আর গেলো। হার্ডড্রাইভ আসতে আসতে বাড়িতে ফোন করে তার দুই বিচ্ছুর খোঁজও নিয়ে নিলো। তারা গভর্নেন্সের কাছে আছে এই মুহুর্তে। কল্পকে অরা নিজের সাথেই অফিসে নিয়ে যায়। তবে প্রিমিয়ার শোতে এতগুলো ক্যামেরা দেখলে সে ভয় পেয়ে যাবে। তাছাড়া কথারও মানুষজনের কোলাহল খুব একটা পছন্দ নয়। তাই আজ তারা বাড়িতেই রয়ে গেছে।

হার্ডড্রাইভ নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল অরা। তার ভয়টাই সত্যি হলো। ফেরার পথে ঠিকই জ্যামে আটকে গেল সে। পাক্কা বিশ মিনিট বসে রইলো এক জায়গাতেই। মেইন রোডের জ্যাম হলে তাও সিগন্যাল পড়তো। এই গলির মধ্যে সিগন্যালও পড়ছে না, গাড়িগুলো নড়ছেও না। এদিকে দুশ্চিন্তায়-আতঙ্কে নাজেহাল অবস্থা অরার। মনে মনে ধরেই নিয়েছে সে, আজ কিছুতেই সময়মতো পৌঁছাতে পারবে না।

৬টা ৫০ মিনিটে অরা হাঁপাতে হাঁপাতে হার্ডড্রাইভ নিয়ে পৌঁছালো। মাল্টিপ্লেক্সের প্রজেক্টশন বিভাগের একটা মেয়ের হাতে সেই হার্ডড্রাইভ তুলে দিয়ে তবেই তার শান্তি। ছোট্ট একটা হার্ডড্রাইভ রীতিমত ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছে তার। লেডিস ওয়াশরুমে গিয়ে চোখেমুখে জল দিয়ে সামলে নিলো নিজেকে।
বেরিয়ে আসতেই অরা দেখতে পেলো, আশেপাশে প্রায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সবাই গিয়ে ভীড় করেছে মাল্টিপ্লেক্সের মূল দরজাটার কাছে। একরাশ আগ্রহ আর প্রচ্ছন্ন একটা হাসি নিয়ে সেদিকেই এগিয়ে গেলো।

যাকে ঘিরে এত এত আয়োজন, পর্দায় যার জাদুতে হারিয়ে যাওয়ার জন্যে এত মানুষের আগমন, একরাশ সাংবাদিক আর উপস্থিত সকল সেলিব্রিটিদের যার জন্যে অপেক্ষা – সেই মানুষটাই এসে গেছে। সুপারস্টার আরশাদ হক, যার চারপাশে অদৃশ্য আলোর একটা আভা। না, আভা বলা উচিত নয়। তার চারপাশে অদৃশ্য আলোর একটা অরা।

সাদা শার্ট, কালো স্যুট-প্যান্ট, ট্রিম করা দাড়ি আর পরিপাটি করে রাখা চুলে মনকাড়া হ্যান্ডসাম লাগছে তাকে। দৃপ্ত পায়ে হেঁটে এসে সে সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়াতেই পাগলের মতো ছবি তুলতে শুরু করলো একের পর এক। সেই সঙ্গে উৎসাহে ফেটে পড়া চিৎকার তো আছেই!

সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটে। একজন জুনিয়র সাংবাদিক তার অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্যে নিয়ে এসেছে নিজের ছোটবেলার ডায়েরি। তবে সাংবাদিকদের স্রোত ব্যারিকেট দিয়ে আটকে দেওয়া আরশাদের কাছে যেতে পারছে না সে। আরশাদ নিজেই এগিয়ে গিয়ে অটোগ্রাফ দিলো মেয়েটাকে। তার এই সামান্য কাজটুকু আলোড়ন জাগিয়ে তুলল সকল সাংবাদিকদের মাঝে। সফলতার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে গেলেও সাফল্যের অহম তাকে গ্রাস করতে ব্যর্থ।

আরশাদ মাল্টিপ্লেক্সের দিকে পা বাড়াতেই সাংবাদিকরা শুরু করে দিলো তুমুল চেঁচামেচি। আরও কয়েকটা ছবি আর ইন্টারভিউ ছাড়া কিছুতেই ছাড়বে না তারা প্রিয় সুপারস্টারকে।

আরশাদও বাধ্য ছেলে হয়ে আবারও ফিরে গেল ছবির তুলতে। তবে তার তৃষ্ণার্ত চোখদুটো খুঁজছে অন্য কাউকে। যে ‘কেউ’টাকে বাদে এই ঝলমলে সাফল্যের পুরোটাই বৃথা। কাঁচের দরজা ভেদ করে মাল্টিপ্লেক্সের ভেতরেই দেখা মিলল তার। সবুজ পাড়ের বেগুনি রঙয়ের শাড়িতে অরাকে দেখে রীতিমত পাগল হয়ে যাচ্ছে আরশাদ। খোলা চুল আর ছোট্ট একটা সবুজ টিপ সেই পাগলামিতে বাড়তি উন্মাদনা যোগ করছে।

ওদিকে আরশাদের এমন সর্বনাশা চাহনিতে লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো অরা। প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে প্রথম প্রথম প্রেমিক যেভাবে তাকায় তার প্রেমিকার দিকে, ঠিক সেভাবেই আরশাদ তাকাচ্ছে তার চার বছরের পুরনো বউয়ের দিকে।

ইন্টারভিউ দিয়ে আরশাদ মাল্টিপ্লেক্সে ঢুকতেই তাকে ঘিরে ধরলো উপস্থিত সকল সেলিব্রিটি এবং পরিচালকেরা। সকলের সঙ্গেই ভদ্রভাবে কথা বলছে আরশাদ। অরাও সৌজন্য আলাপ করছে অন্যান্যদের সাথে।

শোয়ের সময় হয়ে এলো অবশেষে। এক এক করে সকলেই ঢুকতে শুরু করেছে হলে। ‘দিগন্ত’র শিল্পী-কলাকুশলীরা সব পেছন থেকে দুই নম্বর সারিতে বসবে। অরা সেখানেই গিয়ে বসে পড়লো আগেভাগে।

কয়েক মিনিট পরেই আগমন ঘটলো সুপারস্টারের। তার অবাধ্য চোখদুটো ক্ষীণ আলোর মাঝে এত বড় হলের মধ্যে থেকে মুহূর্তেই খুঁজে বের করলো অরাকে। তাকে এখনো ঘিরে আছে তার সহকর্মী বন্ধুরা। সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল তার আজীবনের আসক্তির কাছে।

ব্যস্ত ভঙ্গিতে অরার পাশে বসে তার হাতটা নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে বলল, “ফাইনালি! কতক্ষণ পর পেলাম তোমাকে!”

অরা লাজুক হাসি হেসে বলল, “এমনভাবে বললে যেন কতদিন আমার সাথে দেখা হয় না তোমার।”

আরশাদ হেসে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “দূরে দূরে ছিলে কেন এতক্ষণ?”

অরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে বলল, “তুমি ইন্টারভিউ দিচ্ছিলে আরশাদ! আমি গিয়ে বিরক্ত করি কী করে?”

আরশাদ বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল, “বিরক্ত আর তুমি? সিরিয়াসলি?”

হলের বাতিগুলো সব নিভে গেল এক এক করে। বড় পর্দায় অ্যাড চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে সিনেমা। চারিদিক অন্ধকারে ছেয়ে যেতেই একহাতে অরাকে জড়িয়ে ধরলো আরশাদ। লজ্জায় জড়সড় হয়ে বসে রইলো অরা। আশেপাশে এতগুলো মানুষ! তবুও এই ছেলেকে বাঁধা দিয়ে কোনো লাভ নেই। কোন বাঁধাটা তার আজ পর্যন্ত শুনেছে সে?

অরা নিচের দিকে তাকিয়ে কম্পিত স্বরে বলল, “তখন ওভাবে নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে ছিলে কেন? কেউ দেখলে কী ভাবতো?”

আরশাদ সোজাসাপ্টা জবাবে বলল, “ভাবতো যে আরশাদ হক কতটা বউপাগল! ভুল কিছু তো আর ভাবতো না।”

সিনেমা শুরু হতেই সকলের মনে হলো যেন জাদু হচ্ছে বড় পর্দায়। মুগ্ধ হয়ে সেদিকেই তাকিয়ে আছে সকলে। গল্পটার এমন চমৎকার উপস্থাপন এবং আরশাদের দুর্দান্ত অভিনয়ে সবটাকেই যেন বাস্তব বলে মনে হচ্ছে। অরাও মুগ্ধ হয়েই তাকিয়ে আছে সেদিকে।

যে সিনেমা নিয়ে সকলের এত আগ্রহ, সেই সিনেমা দেখার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই আরশাদের।

খানিক বিরক্তি নিয়েই হালকা গলায় সে বলে উঠলো, “ধুর!”

অরা হেসে ফেলে নিচু গলায় বলল, “কী? নিজের সিনেমা নিজেরই ভালো লাগছে না?”

আরশাদ থমথমে ভঙ্গিতে বলল, “দেখা সিনেমা বারবার দেখলে কারই বা ভালো লাগে? তোমরও তো দেখা সিনেমা। এত আগ্রহ নিয়ে কী দেখছো?”

অরা হাসিমুখে বলল, “তোমাকে।”

আরশাদ দুষ্টুমির সুরে বলল, “আমাকে স্ক্রিনে দেখতে হবে কেন? ব্লাড অ্যান্ড ফ্লেশ তোমার সামনেই বসে আছি। সামনাসামনি দেখো!”

অরা লজ্জা নিয়ন্ত্রণ করে বলল, “No thank you.”

আরও কিছুক্ষণ পর আরশাদ সতর্ক কণ্ঠে বলল, “অরা?”

“হুঁ?”

“দেখো পেছনের দিকের কতগুলো সিট খালি।”

“হ্যাঁ তো?”

আরশাদ নির্দ্বিধায় বলল, “চলো ওখানে গিয়ে
রোমান্স করি!”

অরা আঁতকে উঠে বলল, “কী?

আরশাদ লাগামহীন কণ্ঠে বলল, “সমস্যা কোথায়? গাড়িতে, বাড়িতে, অফিসে কত জায়গায় রোমান্স করলাম। এবার মুভি থিয়েটারেও করি!”

অরা লজ্জায় লাল হয়ে বলল, “তুমি কি পাগল আরশাদ? এতগুলো মানুষের সামনে এসব চিন্তা মাথায়ও কী করে তোমার?”

“মানুষ তো সিনেমা দেখছে। অন্ধকারের মধ্যে কে দেখতে যাবে আমাদের?”

“কেউ না কেউ দেখে ফেলবে। তাছাড়া আশেপাশে এত এত ক্যামেরা!”

আরশাদ নিষ্পাপ ভঙ্গিতে বলল, “যাবে না?”

অরা শাসন করার ভঙ্গিতে বলল, “একদম না। চুপচাপ ভদ্র ছেলের মতো বসে থাকো এখানে।”

আরশাদ আবারও সেই দুষ্টুমির সুরে বলল, “ঠিক আছে। সময়মত ঠিকই শোধ তুলবো।”

সিনেমা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই হাততালি এবং প্রশংসায় ভাসলো আরশাদ এবং ‘দিগন্ত’র পুরো টিম। আরও এক দফা ব্যস্ত হয়ে পড়লো আরশাদ। তাকে ‘অভিনন্দন’ জানাচ্ছে একে একে সকলে।

আরশাদের ব্যস্ততা নিয়ে কোনোকালেই অভিযোগ ছিল না অরার। আজও নেই। নতুন করে ‘দিগন্ত’র শুটিংয়ের সময় দীর্ঘদিন কাছে পায়নি তাকে অরা। এই তো, তিনদিন আগ পর্যন্তও চলছিল তার পরবর্তী সিনেমার শুটিং। একদিকে ‘দিগন্ত’র প্রচারণা, আরেকদিকে শুটিং। অরাকে দেওয়ার মতো সময় বের করে উঠতে পারেনি আরশাদ। তবুও কোনো অভিযোগ নেই তার। কাজপাগল আরশাদটাই যে তার সবথেকে পছন্দের।

রাত এগারোটারও বেশি বেজে গেল তাদের বের হতে হতে। ইন্টারভিউ দিয়ে আর মানুষের প্রশংসা নিতে নিতে হাঁপিয়ে উঠেছে আরশাদ। মাল্টিপ্লেক্স থেকে বের হতে পেরে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। নিজেই গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলো আরশাদ। অরা তার পাশের সিটে বসে ক্লান্ত ভঙ্গিতে গা এলিয়ে দিলো।

আরশাদ অরার চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে দিয়ে কোমল স্বরে বলল, “অনেক টায়ার্ড না তুমি?”

অরা আরশাদের স্পর্শ গায়ে মেখে চোখ বুজে বলল, “হুঁ।”

“স্বাভাবিক। যা ধকল গেল এই কয়েকদিনে।”

‘দিগন্ত’র মুক্তির আগ দিয়ে ভীষণ দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে অরাকে। এডিটিং থেকে শুরু করে প্রমোশন – সব হয়েছে তার পরিকল্পনা অনুযায়ী। ডিস্ট্রিবিউশনেও ছিল তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা। এমনও দিন গেছে কথা-কল্পকে নিয়ে এগারো ঘন্টা অফিসে অরা। ‘দিগন্ত’র মুক্তির পর তার বুকের ওপর থেকেও যেন বড় একটা পাথর নেমে গেছে।

অরা হেসে বলল, “তোমার ওপর দিয়ে তো আরও বেশি ধকল গেছে। ক্লান্ত হও না তুমি?”

আরশাদ মোহনীয় কণ্ঠে বলল, “ক্লান্ত হতে ইচ্ছাই করে না। মানুষের এত এত ভালোবাসা ক্লান্ত হতে দেয় না আমাকে।”

অরা আরশাদের গালের ওপর খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলোর ওপর হাত বুলিয়ে বলল, “I’m so proud of you!”

আরশাদ হেসে অরার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “Me too.”

গাড়ি চলতে শুরু করেছে বাড়ির উদ্দেশ্যে। ড্রাইভ করতে করতে আরশাদ সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল, “অরা? কয়েকটা দিন পর এই প্ল্যানটা করলে ভালো হতো না?”

অরা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “কেন?”

“তুমি রেস্ট নিতে পারতে।”

অরা মৃদু ধমকের সুরে বলল, “একদম না! সেই দুই বছর ধরে প্রমিজ করে ঘুরাচ্ছো আমাকে। আমার কোনো রেস্ট লাগবে না।”

সে দিনটায় ডুব দিয়ে দুজনেই হেসে উঠলো আনমনে। আরশাদ আর অরার দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকী। শুটিংয়ের ব্যস্ততা ফেলে বিশেষ দিনটায় আরশাদ ছুটে এসেছিল অরার কাছে। কথা দিয়েছিল, ব্যস্ততা একটু কমলেই তারা তিনজন মিলে ঘুরতে যাবে মালদ্বীপে। আর অরা বলেছিল কম্পিত স্বরে, “তিনজন না, চারজন।”

সেদিনই আরশাদ জানতে পারে তাদের কোল আলো করে আসছে তাদেরই ভালোবাসার ফসল। ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা আর বাস্তবায়ন হয়নি অরার প্রেগন্যান্সির কারণে। কল্প পৃথিবীতে আসার পরও নানান ব্যস্ততার কারণে, এই পরিকল্পনার কথাটা একেবারে ভুলতেই বসে যায় তারা।

তবে তারা যে একে অপরের জন্যে সময় বের করার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দুজনেই তাই কাজ থেকে খানিক বিরতি নিয়ে আবারও নতুন করে সাজিয়ে ফেলল সেই পরিকল্পনা। বহু প্রতীক্ষার পর অবশেষে কাল মালদ্বীপে যাচ্ছে তারা, চারজন।

বাড়িতে পা রাখতেই বসার ঘর থেকে ভেসে এলো কথা-কল্পর হাসির আওয়াজ। টিভিতে কী যেন দেখছে, আর হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে দুজনে। আরশাদ আর অরার গলায় স্বর কানে ভেসে আসতেই উঠে এক লাফে সোফা থেকে নেমে পড়লো দুজনে।

কল্প তার ছোট্ট ছোট্ট পায়ে ছুটে গেল আরশাদের কাছে। ফুটফুটে একটা হাসি হেসে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, “বাবা!”

আরশাদও প্রচ্ছন্ন হাসি হেসে কোলে তুলে নিলো ছেলেকে। ছেলে তার বাবা বলতে অজ্ঞান। আরশাদকে না দেখলে তার দিনটা শুরুই হয় না। সাত মাস বয়সে প্রথম যে কথাটা সে বলেছে, সেটাও “বাবা!” শুটিং শেষে আরশাদ বাড়ি ফিরে এলো, কল্প যেন আর চেনেই না অরা এবং কথাকে। সারাক্ষণ বাবার কোলে থাকা চাই তার। অরাকে এখন আর তাদের দুজনের মাঝখানে ঘুমাতেও দেয় না। বাবাকে মাঝখানে রেখে ঘুমাতে হবে তার।

আরশাদ কল্পর কপালে চুমু খেয়ে বলল, “তুই এখনও জেগে আছিস বাবা?”

কল্প মিষ্টি হেসে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো। কল্পর ছোট্ট হাতে একটা কাপড়ের ব্রেসলেট দেখতে পেলো আরশাদ।

আগ্রহ নিয়ে বলল, “এটা কে দিয়েছে?”

কল্প তার শিশুসুলভ মিষ্টি কণ্ঠে বলল, “আপি।”

কথাও এতক্ষণে এসে জড়িয়ে ধরলো আরশাদকে।

আরশাদ এক হাতে কল্পকে ধরে রেখেই আরেক হাতে কথাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কী মা? এতক্ষণে সামলেছিস ভাইকে?”

কথা গর্বিত ভঙ্গিতে বলল, “হ্যাঁ! আমি তো সবসময় সামলাই কল্পই।”

আরশাদ আদুরে গলায় বলল, “সামলাবিই তো! তুই বাবার লক্ষ্মী মেয়ে না?”

অরা প্রাণ ভরে দেখছে দৃশ্যটা। সারা দুনিয়ার চোখে সুপারস্টার আরশাদ হক, নিজের সন্তানের সঙ্গে থেকে নিমিষেই শিশু হয়ে যায়।

অরাকে দেখে কথা আরশাদের কাছ থেকে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “দেখো মাম্মাম! আমি নিজেই আজ নিজের চুল বেঁধেছি!”

অরা মুগ্ধ গলায় বলল, “বাহ্! খুব সুন্দর লাগছে। একদম প্রিন্সেসের মতো।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ সত্যি! আচ্ছা শোন, আজ কিন্তু জলদি ঘুমিয়ে পড়তে হবে। কাল অনেক সকালে উঠতে হবে না?”

কথা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “তুমি আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে মাম্মাম?”

“অবশ্যই দেবো!”

অরার ফ্রেশ হয়ে কথার ঘরে এলো তাকে ঘুম পাড়াতে। চোখের সামনে দিয়ে একটু একটু করে বড় হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। বাবার মতোই সফলতার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছুঁতে শুরু করেছে তাকে। কথার আঁকা ছবি মাস কয়েক আগে বিদেশের এক এক্সিবিশনে প্রদর্শিত হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক করেও শিরোপা জিতে এসেছে সে।

সেই সাথে অনেকটাই নির্ভর হয়ে পড়েছে তার মাম্মামের ওপর। মেয়েরা না-কি যত বড় হয়, ততই মায়ের সঙ্গে তাদের গড়ে ওঠে অন্যরকম এক বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্বটা অরা আর কথার মাঝে অটুট।

কথা গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে, অরা তার পাশে শুয়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তার মাথায়।

কথা হঠাৎ কৌতূহলী গলায় বলল, “মাম্মাম?”

অরা আদুরে গলায় বলল, “কী সোনা?”

“আমরা কোথায় ঘুরতে যাবো?”

“সমুদ্রে।”

“সমুদ্র কি অনেক সুন্দর?”

অরা হাসিমুখে বলল, “হুঁ! তুই বাবার সঙ্গে অনেক আগে গিয়েছিলি তো ওখানে। মনে নেই?”

কথা বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে বলল, “মনে পড়ছে না, কিন্তু ছবিতে দেখেছি। অনেক ছোটবেলায় গিয়েছিলাম তো!”

অরা হেসে উঠে বলল, “কথা, এখনো তুই ছোটবেলাতেই আছিস।”

“আচ্ছা মাম্মাম? শুধু আমি আর বাবাই গিয়েছিলাম কেন? তুমি কোথায় ছিলে?”

অরা অন্যরকম গলায় বলল, “তোদের কাছেই ছিলাম।”

“তাহলে যাওনি কেন?”

অরা আবারও হেসে উঠে বলল, “উফ মাম্মাম! ঘুমা তো এখন।”

ওদিকে আরশাদ ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। কল্প তার বুকের ওপরে। কল্পর ভাঙা ভাঙা কথাগুলো শুনতে যা ভালো লাগে আরশাদের! মনটা যেন প্রশান্তির সাগরে ডুব দেয়।

আরশাদ একরাশ আগ্রহ নিয়ে বলল, “কল্প, বল তো বাবা!”

কল্প সঙ্গে সঙ্গে বলল, “বাবা!”

“মা?”

“মা!”

“আপি?”

“আপ্পি!”

আরশাদ হাসিমুখে বলল, “আচ্ছা, এবার বল তো বাবা তোর নাম কী?”

কল্প ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, “ক…পো।”

আরশাদ হেসে উঠে ছেলের গালে চুমু খেয়ে বলল, “তাই? সত্যি? এবার বল তো বাবা, আমি!”

“আ… ই।”

“ইংলিশে বলছিস কেন? বাংলায় বল। আমি!”

এতক্ষণে কথাকে ঘুমের রাজ্যে রেখে এসে গেছে অরা। বাবা-ছেলের কথোপকথন শুনতে শুনতে সে এসে শুয়ে পড়লো আরশাদের আরেক পাশে।

গায়ের ওপরে ব্ল্যাঙ্কেট টানতে টানতে অরা বলল, “এই বিচ্ছু, ঘুমিয়ে পড়। আপি ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু।”

শুয়ে পড়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে আরশাদকে জড়িয়ে ধরলো অরা। কল্প সঙ্গে সঙ্গে নিজের ছোট্ট শরীরের সবটুকু জোর খাটিয়ে সরানোর চেষ্টা করছে অরার হাত।

অরা ভ্রু কুঁচকে বলল, “হাত সরাচ্ছিস কেন? বাবা তোর একার?”

কল্প ঠোঁট উল্টে বলল, “হ্যাঁ।”

অরা জেদ ধরে বলল, “না, বাবা আমার।”

কল্পও পাল্টা জেদ দেখিয়ে বলল, “না আমার।”

দুজনের শিশুসুলভ এই কথোপকথনে না হেসে পারলো না আরশাদ।

বিয়ের আগে বহুবার কাজে স্বার্থে দেশে-বিদেশের নানান প্রান্তে আরশাদের সঙ্গে গেছে অরা। আর বিয়ের পরে গেছে ভালোবাসার স্বার্থে। তার সঙ্গে ট্রাভেল করে সত্যিই অন্যরকম আনন্দ পাওয়া যায়। একটা মুহুর্তও মনে হয় না ক্লান্তিময়।

ঢাকা থেকে মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে পৌঁছাতে সময় লাগলো সাড়ে ৪ ঘন্টার মতো। পুরোটা সময় কথা-কল্প ঘুমিয়েই কাটালো।অরা আরশাদের কাঁধে মাথা রেখে গল্পে মেতে রইলো পুরোটা সময়।

মালের ভেনালা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নেমে তারা অপেক্ষা করতে লাগলো তাদের পরবর্তী ফ্লাইটের জন্যে। মালে থেকে মান্ধু নামের একটি দ্বীপে যাবে তারা। এই দ্বীপেই রয়েছে পৃথিবীর একমাত্র আন্ডারওয়াটার ভিলা ‘দ্য মুরাকা’।

দ্বিতীয় ফ্লাইটের দৈর্ঘ্য ১ ঘন্টা ২৫ মিনিট। পুরোটা সময় জুড়ে কথা-কল্প আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলো আকাশের মেঘগুলোর দিকে। এয়ারপোর্টে আগে থেকেই তাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল হোটেল থেকে আসা গাড়ি।

মাঝসমুদ্রে তৈরি করা হয়েছে পৃথিবীর সবথেকে বিলাসবহুল এই হোটেল। স্বচ্ছ নীল জলরাশি কথা-কল্পের উচ্ছ্বাস বাড়িয়ে তুলল কয়েক হাজারগুণ। প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য উচ্ছ্বসিত করে তুললো অরাকেও, আর তার উচ্ছ্বাসভরা মুখটা আরশাদকে।

মুরাকায় মালদ্বীপের সংস্কৃতি অনুযায়ী ঢোলের শব্দে আর নাম না জানা এক সাদা ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হলো তাদের। হোটেলে পা রাখতেই অরা বুঝতে পারলো, কেন এটা পৃথিবীর সবথেকে দামী হোটেল।

ঝকঝকে একটা লিভিং রুম, লিভিং রুমের সঙ্গে প্রাইভেট সুইমিং পুল। মেঝেটা কালো মার্বেল পাথরের। মাথার ওপরে ছোট ছোট আলোকসজ্জায় সাজানো। বড় বড় দুটো বেডরুমও আছে এখানে। দুটোই তাদের আগমনের জন্যে চমৎকার করে সাজানো।প্রকান্ড ডাইনিং রুম, সী এই ফেসিং বাথটাব, বিশাল কিচেন, জিম – আগ্রহ নিয়ে সবটা ঘুরে ঘুরে দেখছে অরা, কল্প এবং কথা। আরশাদ তাদের উচ্ছ্বাসের পুরো মুহূর্তটা ভিডিও হিসেবে ধারণ করে রাখছে সারা জীবন জমিয়ে রাখবে বলে।

সবথেকে বড় চমকটা অপেক্ষা করছিল সমুদ্রের নিচে। এতক্ষণ তারা মাঝ সমুদ্রে থাকলেও, এবার লিফটে করে সমুদ্রের নিচে যাওয়ার পালা। সমুদ্রের নিচে এই হোটেলের সবথেকে আকর্ষণীয় অংশটি।

লিফট এক তলা নিচে এসে থামতেই, চমকে উঠলো অরা। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো তার। অর্ধবৃত্তাকার কাঁচে ঘেরা একটা ঘর। কাঁচের চারিদিকে নীল রঙের স্বচ্ছ জল এবং তাতে সাঁতার কেটে বেড়ানো হাজারো রঙিন মাছ। ওপরে, আশেপাশে যেখানেই চোখ যাচ্ছে সেখানেই এই একই দৃশ্য। মনে হচ্ছে যেন একটা অ্যাকুরিয়ামের মধ্যে আছে তারা।

এই ঘরে একটা বিশাল বিছানাও আছে। পাশেই বসে বসে অপরূপ সুন্দর দৃশ্যটা উপভোগ করার জন্যে একটা সিটিং কর্ণার। কথা-কল্প উচ্ছ্বাসের উর্ধ্বে উঠে কাঁচের কাছে গিয়ে লাফালাফি শুরু করলো। এই অপূর্ব দৃশ্য এবং বিচ্ছু দুটোর উচ্ছ্বাসে জল চলে এলো অরার চোখে।

আরশাদ আচমকা তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কেমন লাগলো?”

অরা মুগ্ধ গলায় বলল, “অসম্ভব সুন্দর। সবটাই স্বপ্নের মতো লাগছে।”

আরশাদ অরার মাথার একপাশে চুমু খেয়ে বলল, “নাহ্! এটা স্বপ্ন না। আমাদের বাস্তব স্বপ্নের থেকেও সুন্দর।”

“Thank you Arshad!”

আরশাদ দুষ্টু গলায় বলল, “শুধু থ্যাংক ইউতে কাজ হবে না। আমার অন্য কিছু চাই।”

সমুদ্রের নিচে এই ঘরে অনেকটা সময় কাটিয়ে দিলো তারা চারজন। এতটা আনন্দের মুহূর্তে এ জীবনে যেন আগে কখনো আসেনি।

দীর্ঘ ফ্লাইট এবং ফ্লাইট পরবর্তী আনন্দে-উল্লাসে ক্লান্ত হয়ে উঠেছে কথা-কল্প। তাদেরকে ওপরের ঘরগুলোর একটায় ঘুম পাড়িয়ে রেখে আবারও সমুদ্রের নিচের ঘরটায় অরাকে টেনে নিয়ে এলো আরশাদ।

অরা আরশাদের গলা জড়িয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাসিমুখে বলল, “রেস্ট নিতে দেবে না আমাকে?”

আরশাদ ধাক্কা দিয়ে অরাকে ফেলে দিলো নরম তুলতুলে বিছানার ওপরে।

নিজেও তার ওপর ঝুঁকে এসে বলল, “আমার অন্য কিছুটা আগে দাও।”

অরা লজ্জারাঙা গলায় বলল, “তুমি কি আজীবন এমন অসভ্য থাকবে আরশাদ?”

আরশাদ তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “তুমি কি আজীবন এমন লজ্জাবতী থাকবে অরা?”

অরাকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে বিদ্যুতের গতিতে তার ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে দিলো আরশাদ। অরা তার শার্ট খামচে ভালোবাসাময় জগতে হারিয়ে গেল তারই সাথে।

বিকেলের দিকে বিচ্ছু দুটো ঘুম থেকে উঠতেই তাদের নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে গেলো আরশাদ আর অরা। মাঝ সমুদ্রে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে কল্প। কথা ছুটে বেড়াচ্ছে ঢেউয়ের পিছু পিছু। কল্প তার ছোট্ট হাতে বালি দিয়ে কিছু একটা বানানোর চেষ্টা করছে। কথা এসে তার তৈরি করা বালিঘরে ভেঙ্গে ফেলছে। দুজনের এই আনন্দঘন মুহূর্তগুলো প্রাণভরে দেখছে আরশাদ আর অরা। পৃথিবীর সকল শান্তি যেন লুকিয়ে আছে এই দুটো দেবশিশুর মাঝে।

রাতে সমুদ্রের নিচের ঘরটাতেই তারা চারজন একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লো। অরা কথাকে জড়িয়ে ধরে, আর আরশাদ কল্পকে। সমুদ্রের নিচে এই ঘরটাকেই অরার মনে হতে লাগলো পুরো পৃথিবী। এর বাইরে পৃথিবীর কোনো অস্তিত্ব নেই তার কাছে, থাকার প্রয়োজনীয়তাও নেই।

অরার ঘুম ভেঙে ঘুম খুব ভোর বেলা। চোখ পিটপিট করে তাকাতেই দেখতে পেলো ঘুমন্ত কথা-কল্পকে। তবে আরশাদকে দেখছে না সে কোথাও। বিচ্ছু দুটোর কপালে চুমু খেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো অরা। আশেপাশে কোথায় নেই আরশাদ। লিফট দিয়ে তাই উঠে পড়লো ওপরে।

লিভিং রুমের সঙ্গে লাগোয়া বিশাল সী ফেসিং বারান্দা। সূর্যের লালাভ আলো কেবল ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। সেই আলো খানিকটা এসে লাগলো অরার গায়েও। বারান্দার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই অরা দেখতে পেলো তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে।

স্লাইডিং ডোর ঠেলে বারান্দায় প্রবেশ করতেই আরশাদ ঘুরে তাকালো তার দিকে। উপহার দিলো তার মোহনীয় হাসিটা। আনমনেই প্রচ্ছন্ন হেসে উঠলো অরা।

আরশাদের পাশে বসে তার কাঁধে মাথা রেখে হাস্যোজ্বল কণ্ঠে বলল, “ঘুম কখন ভাঙলো স্যার?”

আরশাদ শান্ত হাসি হেসে অরাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে বলল, “এই তো, কিছুক্ষণ আগে। তোমার মুখে স্যার ডাকটা শুনে নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছি।”

অরা মজার ছলে বলল, “চাইলে এটাই ডাকতে পারি কিন্তু!”

“No thank you. আমার নামটা তোমার মুখে সবথেকে বেশি সুন্দর।”

অরা হেসে বলল, “Good Morning.”

“Good Morning. দিনটা এখন শুরু হলো আমার।”

অরা ভালোলাগার হাসি হেসে বলল, “আমাকে ছাড়া দিন শুরু হয় না বুঝি?”

আরশাদ দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “অসম্ভব!”

কয়েকটা মুহূর্ত এভাবেই বসে রইলো তারা।
প্রশান্তিময় নীরবতায় গা ভাসালো নির্দ্বিধায়। নীরবতায় যেন হাজার বছর অরা কাটিয়ে দিতে পারবে আরশাদের সঙ্গে।

অরা হঠাৎ অস্পষ্ট গলায় বলল, “আরশাদ?”

“হুঁ?”

অরা আর্দ্র গলায় বলল, “Thank you.”

আরশাদ অবাক গলায় বলল, “কেন?”
অরা প্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সবকিছুর জন্য। তুমি আমার এ জীবনে যে কতটা সুখ আমাকে দিয়েছো, ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।”

আরশাদ স্নিগ্ধ হাসি হেসে বলল, “তোমাকেও থ্যাংক ইউ।”

“কেন?”

আরশাদ অন্যরকম গলায় বলল, “একটা সময়ে বেঁচে থাকতেই ইচ্ছা হতো না। আর এখন ইচ্ছা হয় যেন হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকি। তোমার জন্য, তোমাদের জন্য।”

আরশাদের কানের নিচে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে অরা বলল, “হাজার বছরই বেঁচে থাকবে তুমি।”

এত সুখ, এত আনন্দ, এত এত ভালোবাসা – তবুও অরার চোখদুটো ভিজে ওঠার উপক্রম। অরার ভেতরটাকে পড়ে ফেলার ক্ষমতা যে মানুষটা রাখে, সেই আরশাদ নিমিষেই টের পেলো তার চোখের এই আর্দ্রতা।

তাই তো উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “অরা? কী হয়েছে?”

অরা মলিন স্বরে বলল, “আমার না মাঝে মাঝে প্রচন্ড ভয় হয় জানো!”

আরশাদ দ্বিগুণ উদ্বেগ নিয়ে বলল, “কেন?”

অরা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ভয়ার্ত গলায় বলল, “আবারও যদি কোনো দুর্যোগ নেমে আসে আমাদের জীবনে?”

সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটে। হাসিটা গোপন করার কোনো চেষ্টা না করেই আরশাদ আরও শক্ত করে অরাকে আঁকড়ে ধরে বলল, “আসুক। কী আর হবে? রাগারাগি হবে, মান-অভিমান হবে। তারপর? সেই তো একে অপরের কাছেই ফিরে আসতে হবে বারবার। আমরা একে অপরের একমাত্র আশ্রয় অরা। ফিরে আসা ছাড়া উপায় কী?”

এবার সত্যি সত্যিই কেঁদে ফেলল অরা। নিঃশব্দে কেঁদেই যাচ্ছে সে। টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে একটু পর পর। অকস্মাৎ কোনো প্রত্যাশা-প্রস্তুতি ছাড়াই এই মানুষটাকে জীবনে পেয়েছে সে। আরশাদকে হঠাৎ এভাবে পাওয়াটাই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।

অরা কান্নার মাঝেই বলল, “আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি আরশাদ। অসংখ্যবার বলেছি এই একই কথা। তবুও মনটা চায় আরেকবার বলি।”

আরশাদ অরার কপালে চুমু খেয়ে সযত্নে তার চোখের জলগুলো মুছে দিয়ে বলল, “কাঁদছো কেন বোকা মেয়ে? বলবেই তো। আমিও আজীবন শুনতে চাই এই একই কথাটা বারবার। আর বারবার বলতে চাই, আমিও তোমাকে ভালোবাসি। প্রচন্ড ভালোবাসি, পাগলের মতো ভালোবাসি।”

ভালোবাসা, পৃথিবীর সবথেকে পুরাতন এবং সবথেকে নতুন এক রহস্যের নাম। যে অভাগা এই বস্তু পায় না, কোনোদিন সে উদঘাটন করতে পারে না রহস্যের। আর যে পেয়ে যায়, তার কাছে পৃথিবীর সমস্ত সুখ তুচ্ছ হয়ে যায়। সত্যি হয়ে উঠে কেবলই ভালোবাসা। চিরজীবী হোক আরশাদ-অরার ভালোবাসা!

(সমাপ্ত)

[সমাপ্তর জায়গায় চলবে লিখে ফেলেছিলাম। এতদিনের অভ্যাস আমার! গত বছর সেই জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে কোনো এক সকালে নিজের ওপর জেদ ধরেই লিখতে শুরু করি কোনো এক সুপারস্টার আর তার ম্যানেজারের গল্প। প্রথম পর্বটা লিখে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিলাম খানিকক্ষণ। কেমন হলো শুরুটা? এই গল্প কি কন্টিনিউ করা উচিত? ভাগ্যিস করেছিলাম। তাই তো পেয়ে গেলাম আমার মনের সবথেকে কাছের দুটো চরিত্র, আরশাদ আর অরা। প্রায় সাড়ে সাত মাসের যাত্রা তাদের নিয়ে। এই মায়া কীভাবে কাটিয়ে উঠবো আমি? আজ থেকে দিনভর আমার মাথায় ঘুরপাক খাবে না তারা, দিনশেষে লিখতে বসবো না তাদের নিয়ে। এই মন খারাপ রাখি কোথায়? তবে মন খারাপের মাঝে মন ভালো করে দেওয়ার কারণ আপনারা। ধৈর্য নিয়ে এতগুলো দিন ধরে পড়ছেন আমার গল্প। জানি না কতটুকু লিখতে পারি, তবে আপনাদের উৎসাহ প্রতিনিয়ত আমাকে লিখতে বসার অনুপ্রেরণা দেয়। আপনারা আছেন বলেই এত বড় একটা গল্প লেখার সাহস পেলাম। হাজার হাজার ধন্যবাদ আপনাদের। আশা করি সবসময় এভাবেই পাশে পাবো প্রত্যেককে। অনেক অনেক ভালোবাসা আপনাদের জন্যে। ফিরে আসবো খুব জলদি নতুন কোনো গল্প আর নতুন চরিত্রদের নিয়ে। ভালো থাকবেন ততদিন ❤️]

ফিরে আসা সিজন-১ পড়তে লেখটির উপর ক্লিক করুন