বিবর্ণ নীলাম্বরী পর্ব-২১

0
532

#বিবর্ণ_নীলাম্বরী
#মম_সাহা

পর্বঃ একবিংশ

হসপিটালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে বর্ণ তার পরিবারের সবাই নীলার বন্ধুবান্ধব এবং শুভ্রম আর তার পরিবার রাজ আর দিয়ার বন্ধুবান্ধব।দিয়াকে সড়িয়ে দেওয়ার পরও কিছুটা এসিড এসে দিয়ার গলার বামদিকে লেগেছে, আর কিছু লেগেছে নীলার ডান হাতের মাঝামাঝি।

তখন তাদের চিৎকারে থমকে গিয়েছিলো সবাই।ঝড়ের বেগে এসিডের কথা শুভ্রমের কাছে গিয়ে পৌঁছায়।সে আসতে আসতে নীলা আর দিয়াকে বর্ণ আর নীলার বন্ধুরা হসপিটালের উদ্দেশ্যে নিয়ে আসে।

দিয়া বেশ শক্তপোক্ত মেয়ে।এসিড মারার পরও সে বেশ শক্ত রয়েছে। ব্যাথায় কাতরিয়েছে একটু। কিন্তু নীলা সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

দিয়াকে হসপিটালে রাখা হয়েছে অবজার্ভারবেশনে।তার গলার নরম চামড়া পুড়ে গিয়েছে। এটা তো সময় লাগবেই।আর নীলার হাত ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। জ্ঞান না ফেরার কারণে এখনো সবাই অপেক্ষা করছে।সকাল থেকে না খাওয়া আর হঠাৎ ভয়ের কারণে ব্রেণে চাঁপ পড়ায় জ্ঞান হারিয়েছে সে।

নীলার জ্ঞান ফেরার পর তার বন্ধুবান্ধব দেখা করে চলে গিয়েছে।তারপর নীলার রুমে প্রবেশ করেছে শুভ্রমের পরিবার।বর্ণ ওর মা,ফুফু,ভাই,রঙ সবাই আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলো।

শুভ্রম আর শুভ্রমের পরিবারকে দেখে উঠে বসে নীলা।তার হাতে ক্যানাল লাগানো স্যালাইন চলছে।শুভ্রমের চাচী এসেই নীলার সামনে হাত জোড় করে বসে কেঁদে দিয়ে বলল
-‘ক্ষমা করে দেও মা। তোমার সাথে এত খারাপ আচরণ করার পরও তুমি আজ যা করলে তার সত্যিই কোনো তুলনা হয় না।

নীলার এমনেতেই গলা ব্যাথা অবস্থা খারাপ।তবুও খুব কষ্টে উচ্চারণ করল
-‘আন্টি দয়া করে আমাকে লজ্জা দিবেন না।আপনারা মানেন আর না মানেন আপনাদের কে আমি আপন মানুষ ভাবি।দিয়া আমার ছোট বোন তার বিপদে আমি তাকে বাঁচাবো না তো কে বাঁচাবে? এসব বলে আমাকে ছোট করবেন না।’

দিয়ার মা এমনকি ওদের পরিবারের সবাই মাথা নিচু করে ফেলে। মেয়েটাকে কম কথা তারা শুনায় নি।আজ বড় উপকার করলো মেয়েটা।নাহয় তাদের মেয়ের কি হতো ভেবেই বুক কেঁপে উঠে তাদের।

মৌ নীলার কাছে এসে নীলার মুখের সামনে চুল গুলি কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে তার চাচীর উদ্দেশ্যে বলল
-‘সেদিন তো মেয়েটার বাড়ি বয়ে গিয়ে মেয়েটার বাবার শিক্ষার উপর আঙ্গুল তুলে এসে ছিলে।আজ দেখেছো ওর বাবার শিক্ষার প্রখরতা?’

রেহেনা বেগম মানে শুভ্রমের মা মেয়েকে ধমকের স্বরে বলল
-‘যেখানে আমরা নিজেরাই লজ্জিত সেখানে তোমায় অন্য কিছু বলার দরকার নেই।আমরা যা করেছি তার জন্য আমরা এমনেতেও লজ্জিত।’

মৌ তাচ্ছিল্য হেসে বলল
-‘হ্যাঁ আজ তোমাদের মেয়েকে বাঁচিয়েছে বলে তোমরা এত নরম নরম কথা বলছো,লজ্জিত ফিল করছো।কিন্তু আজকের দিনটা না আসলেই বুঝা যেতো তোমরা সত্যি কতটা লজ্জিত।’

মৌয়ের এমন উচিত কথায় নিভে যায় তার মায়ের তেজ।মানুষ বলতেই স্বার্থপর। সে কোনো একটা কাজ করছে তার পিছনে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কারণ থাকবে।

নীলা হালকা হেসে বলল
-‘আপনারা চিন্তা করবেন না।দিয়া ঠিক হয়ে যাবে।আপনারা এখন আসুন।আসলে আমার কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছে।’

নীলার কথা শেষ হতেই সবাই রুম থেকে প্রস্থান নিলো।শুভ্রম দাঁড়িয়ে রইল। তার পরিবারের সবাই বের হয়ে যেতেই শুভ্রম নীলার সামনে চেয়ারে বসে।বর্ণ ও তার পরিবারের সবাইকে বাহিরে যেতে বলল।সবাই বাহিরে চলে গেলেও বর্ণ একই অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল।শুভ্রম বর্ণকে কিছু বলতে নিলেই বর্ণ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল
-‘আমি একজন ডাক্তার আর এজ এ ডাক্তার আমি এখানে থাকতেই পারি। আর নীলাম্বরীর সাথে তার একজন কাছের মানুষ থাকা উচিত সেই হিসেবেই আমি আছি।

শুভ্রম আর কিছু বলে না।নীলার দিকে তাকিয়ে বলল
-‘নীলা বরাবরই তুমি আমাদেরকে ঋণী করে দিয়ে দিলে।’

নীলা মুখটা গম্ভীর করে বলল
-‘আমাকে এসব কথা বলে ছোট করবেন না স্যার।দিয়া আমার বোন।’

শুভ্রম তাচ্ছিল্য হাসলো দিয়ার ডাকে।সেই হাসি মুখে রেখেই বলল
-‘স্যার! এতদিন প্রায় দীর্ঘ চার বছর পর তুমি আমাকে কিছু সম্বোধন করলে।তাও স্যার বলে!’

নীলাও ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা টেনে বলল
-‘স্যারকে স্যার বলবো না তো কি বলবো?’

শুভ্রম বিষ্ময়কর কন্ঠে বলল
-‘স্যার আর ছাত্রীর সম্পর্ক ছাড়া আমাদের আর কোনো সম্পর্ক নেই?’

নীলা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল
-‘যে সম্পর্ক প্রাণ নেই সেটা সম্পর্ক বলে না।আশা করি বুঝেছেন। এবার আপনি যান।’

শুভ্রম আর কিছু না বলে চলে যায়। বর্ণ এত ক্ষণ চুপ করে ছিলো। শুভ্রম বের হয়ে যেতেই বর্ণ শক্ত চোখে তাকালো নীলার দিকে।এগিয়ে এসে বলল
-‘আপনি সব কিছুতে এত পাকামি কেন করেণ নীলা।একটা খারাপ কিছু হয়ে গেলে কি হতো নীলা?’

নীলা আগের ন্যায় হাসি বজায় রেখে বলল
-‘আমার কিছু হয়ে গেলে কি হতো আমার জানা নেই তবে আমি কিছু না করলে আমার বাবার আদর্শের অপমান হতো এতটুকু জানি।’

বর্ণ আর কিছু বললো না।এর মাঝেই বর্ণের মা শারমিন চৌধুরী তার হাতে মোবাইল টা নীলার দিকে এগিয়ে দিলো।নীলা তার বাবার সাথে কতক্ষণ কথা বললো।অবশেষে ঠিক হলো কালই বর্ণের পরিবার আর নীলা ওদের বাড়ি যাবে।বিয়ের জন্য ওনারা আসতে পারেন নি।মেয়েকে না দেখেও থাকতে পারছে না তাই আগামীকাল তারা সেখানে চলে যাবে। বর্ণ আর তার বাবা বাদে সবাই কাল যাবে।বর্ণ হসপিটাল থেকে ছুটি নিয়ে তারপর যাবে।

________

নীলা নিজের বাড়িতে এসেছে আজ দু’দিন হলো।সবাই তার যত্ন করছে।রাহাতও কোনো রূপ খারাপ আচরণ করে নি।আত্মীয় স্বজনে বাড়ি ভরে গিয়েছে। আগামীকাল গায়ের হলুদ।

বাড়ি ভরা মানুষ থাকতেও নীলার নিজেকে একা মনে হয়।কারো একটা অভাব বেশ করে বোধহয়। মানুষ টা কে সেটা তার জানা নেই।সত্যিই জানা নেই? নাকি সে মানতে চায় না এই অনুভূতিটাকে।

নীলা মন মরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার রুমের বারান্দায়। সন্ধ্যা নেমেছে বিশাল আকাশের বুকে। নীলা আজ ভীষন মন খারাপের অসুখে ভুগছে।সকালে উঠেই শুনেছে ডাক্তার সাহেব আসতে পারবেন না।সেই থেকে যে মন খারাপের রোগে ধরেছে এখনও সেই রোগেই আক্রান্ত।

নিজের এমন অনুভূতির সাথে অপরিচিত নীলা।এই মানুষটার জন্য এমন অনুভূতির কারণ জানা নেই নীলার।নীলার ভাবনার মাঝেই কেউ একজন পিছনে থেকে এসে বলল
-‘আপনার মন খারাপ?

নীলা আনমনেই উপর নীচ মাথা নাড়ালো। তার পিছে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা আবার জিজ্ঞেস করল
-‘কাউকে মিস করছেন?’

নীলা আবারও আনমনে উপর নীচ মাথা নাড়ালো।এবার পিছনের ব্যাক্তি সামনে এসে বলল
-‘থাক আর মিস করা লাগবে না।এই যে আসি চলে এসেছি।’

অনবরত কানের কাছে কথা শুনে ধ্যান ভাঙলো নীলার।বিরক্ততি নাক মুখ কুঁচকে তাকালো সে।উদ্দেশ্য সামনে থাকা ব্যাক্তি টাকে কত গুলো কড়া কথা শুনানো। কিন্তু সামনের ব্যাক্তিকে দেখে সে আবেগে আপ্লুত হয়ে যায়। তার সামনে তার ডাক্তার সাহেব দাঁড়িয়ে আছে।

নীলা অবাক কন্ঠে বলল
-‘আপনার না কাজ আছে আসবেন না বললেন? তাহলে এখন এখানে?’
-‘ভেবেছিলাম আপনাকে সারপ্রাইজ দিবো।আর আমার কাছে খবর গেছে।কেউ একজন নাকি আমায় বড্ড মিস করছে।তাই চলে আসলাম।’

বর্ণের এমন কথায় মুখ ভেংচি কাটে নীলা।মনে মনে সে বেশ খুশি হয়েছে।তবুও মুখ ভেংচি কেটে বলল
-‘কেউ আপনাকে মিস করে না। যা শুনেছেন ভুল শুনেছেন।কে দিলো আপনাকে ভুল খবর টা?’

বর্ণ মুচকি হেসে বলল
-‘যে দিয়েছে সে কখনোই ভুল খবর দেওয়ার মানুষ না।সে সম্মানিত ব্যক্তি।’

নীলা এবার হেসে বলল
-‘হয়েছে হয়েছে। এখন এখান থেকে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন একটু পর ছাদে সব কাজিন মিলে আড্ডা বসবে।ফ্রেশ হয়ে এসে খাবার খাবেন।যান তাড়াতাড়ি।’
-‘তো আড্ডা হলে কী হয়েছে? আপনি তো নাকি যাবেন না বলেছেন? আপনার শরীর ভালো লাগছে না।তাহলে?’

বর্নের কথায় জিব কাটে নীলা।একটু আগে সে ড্রয়িং রুমে বলে এসেছে আড্ডার মাঝে সে থাকবে না শরীর ভালো লাগছে না।আসলে যে মন ভালো না সেটা বলবে কীভাবে।

নীলার ভাবনার মাঝেই বর্ণ হেসে বলল
-‘হয়েছে আর কিছু বলা লাগবে না।আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।আপনি আমার খাওয়ার সময় আমার সাথে থাকবেন।’

নীলা হেসে মাথা নাড়াতেই বর্ণ প্রস্থান নিলো রুম থেকে।নীলাও বারান্দা থেকে ঘরে আসতে নিলে বারান্দার মাঝে ঠাস করে কিছু একটা পরার শব্দ হয়।নীলে তাকিয়ে দেখে একটা কাগজ তার পায়ের কাছে।

ভ্রু কুঁচকে কৌতুহল নিয়ে কাগজটা খুলে নীলা।সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা
-‘বোনের জীবনটা শেষ করে দিবে নীলা?সত্য যতই কঠিন হোক তা প্রকাশই শ্রেয়।’

এমন কথায় ভয় পেয়ে যায় নীলা।কে এমন চিরকুট দিলো তাকে? সে বাদে এসব কথা কে জানে?

#চলবে।