#বিবর্ণ_নীলাম্বরী
#মম_সাহা
রহস্য উন্মোচনপর্বঃ সাতাশতম
নীলা ড্রয়িং রুম পেড়িয়ে বাগানের দিকে গেলো।বিয়েটা সেখানেই হবে।বাগানের যাদের যাদের চোখে নীলাকে পড়েছে সবাই অবাক হয়ে গেছে। আজিজুর রহমান তার ব্যবসায়ের পার্টনারের সাথে কথা বলছিলো হঠাৎ তার ছোট মেয়েকে সাধারণ সাদামাটা পোশাকে এগিয়ে আসতে দেখে অবাক হয়ে যায়।
নীলার দাদী উঠে আসে।নীলার হাত টান দিয়ে বলে
-‘কিরে ছ্যামড়ি বাপের নাক কাটতে আসছিস এখানে? দেখাইতে আইছেছ তোর বাপ তোকে কত অনাদরে রাখছে? কেমন সাজ এই তোর?’
এবার সবারই ধ্যান নীলার দিকে পড়লো।তৃণকে কোলে নিয়ে বর্ণ মজা করছিলো সেও এবার অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো।
নীলা সাদা ধবধবে একটা থ্রি-পিস পড়া।থ্রি-পিসের উপর চাঁদর গায়ে দেওয়া।এখন তেমন শীতও না।হাঁটুর নীচ অব্দি লম্বা চুল গুলো ছেড়ে রাখা।পায়ে ব্যান্ডেজ। চোখ গুলো লাল টকটকে। চোখের নিচে কাঁজল লেপ্টানো।বিধ্বস্ত রূপ রমনীর।
আজিজুর রহমান এগিয়ে আসেন মেয়ের দিকে।মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন
-‘কিরে মা শরীর অসুস্থ তোর?এমন লাগছে কেন? এটা কেমন রূপ তোর মা? ভয়াবহ লাগছে তোকে? কি জামা পড়েছিস?’
নীলা বাবার থেকে টলমলে পায়ে দু কদম পিছিয়ে গেলো।দাদী তেড়ে এসে বলল
-‘এই ছ্যামড়ির মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ওরে এদিক থে সড়া।আমার মাথা গরম হইতাছে।এই মাইয়া নির্ঘাত খারাপ কিছুর মতলব করে আইছে।বড় মাইয়াটার কপাল পুড়তে আইছোছ তুই?’
বর্ণ তৃণকে ওর মায়ের কোলে দিয়ে এগিয়ে আসলো।শান্ত স্বরে বলল
-‘দাদী একটু ঠান্ডা হোন।নীলাম্বরীর নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। কি হয়েছে নীলাম্বরী?’
নীলা চোখে জল টইটুম্বুর। সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল
-‘বাবা বিয়েটা হবে না।’
নীলার কথা শেষ হতে দেড়ি ঠাঁস করে চড় পড়তে দেড়ি নেই।তার দাদীর রক্তচক্ষু নিয়ে উচ্চস্বরে বলল
-‘বিয়া নিয়া কি নাটক হয় এই বাড়িতে? অসভ্য ছ্যামড়ি। নিজের কপালে তো বিয়া নাই তাই বড় বইনের ভাগ্য টা খাইতে আইছোছ?’
দাদীর থাপ্পড়ে ছিটকে পড়ে নীলা।আজিজুর রহমান,বর্ণ ছুটে তাকে ধরতে গেলে সে হাত দিয়ে থামিয়ে দেয় তাদের।
গায়ের চাদরটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে তার বোনের কাছে এগিয়ে গেলো।এদিকে রাহাত ঘেমে একাকার। নীলা এমন করছে কেন ভেবে।
নীলা বোনের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল
-‘আপাই এ জীবনে তোমার ক্ষতি চাই নি আমি। মাঝে মাঝে সবার কথায় তিক্ত হয়ে তোমার উপর রাগ ঝাড়তাম কিন্তু আসলে তেমনটা না।তোমাকে আমি বড্ড ভালোবাসি আপাই।এই প্রথম বলছি তোমাকে আমি বড্ড ভালোবাসি আপাই। তোমার ভালোর জন্যই বলছি বিয়েটা বন্ধ করো আপাই।’
নিরুপমা বোনের দিকে এগিয়ে গেলো ধরার জন্য কিন্তু নীলা এবারও পিছিয়ে গেলো।বর্ণ এবার ভ্রু কুঁচকে ফেলল। নীলা কাউকে ধরতে কেন দিচ্ছে না।
নীলার মা মানুষের মুখে মুখে সবটা শুনে তাড়াতাড়ি বাগানের দিকে আসছে।সে এসেই বলছে
-‘কি বলছো নীলু?বিয়ে ভাঙার তো কোনো কারণ নেই তাহলে এসব বলছে কেন?’
ওদের কথার মাঝেই পিছন থেকে কেউ বলল
-‘বিয়ে ভাঙার অনেক কারণ আছে ম্যাডাম।’
সবাই পিছে ঘুরে আরেক দফা অবাক।পিছে পুলিশের পুরো একটা টিম।মাসুদ এগিয়ে গিয়ে বলল
-‘অফিসার আপনারা এখানে? আর কি কারণ আছে?’
পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে রাহতের কাঁধে হাত রেখে বলল
-‘কারণ হলো আপনাদের বর ভালো না।সে একজন ব্ল্যাকমেইলার।সে চরিত্রহীনও বটে।’
সবার মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ল শুধু কয়েকজন বাদে।বর্ণ অবাক কন্ঠে বলল
-‘কি বলছেন আপনারা? রাহাত কি করেছে?’
নীলা এবার এগিয়ে গিয়ে বলল
-‘রাহাত আমার সাথে প্রতারণা করেছে।শুধু প্রতারণা না সে আমার সাথে জোরজবরদস্তির চেষ্টা করেছিলো।আর আমি জেনো এগুলো না বলি তাই ব্ল্যাকমেইলও করেছে।’
নীলার কথা শেষ হতে দাদী তেড়ে এসে বলল
-‘এই ছ্যামড়ি খারাপ।হুদাই দোষ দিতাছে আমার নাতিরে।চরিত্রহীনা ছ্যামড়ি।’
আবার চড় দেওয়ার জন্য হাত উঠাতেই নীলা দাদীর হাতটা ধরে ফেলল।এতক্ষণ টইটম্বুর হয়ে থাকা অশ্রু গুলো ঝড়ে পড়ল।নীলা কাঁপা কন্ঠে বলল
-‘দাদী গো দোষ তো আমার ছিলো না।আমি ভালোবেসে ছিলাম এক বিশ্বাসঘাতককে আমি বুঝতেও পারি নি গো।’
তিমা এগিয়ে এসে নীলার মুখ উঠিয়ে বলল
-‘সবটা খুলে বল নীলা।সবাই আমরা অপেক্ষা করছি।’
নীলা এবার চোখের জল গুলো মুছে বলল
-‘আমি রাহাত ভাইয়াকে ভালোবাসতাম সেই ছোট থেকে।কিন্তু বরাবরই রাহাত ভাইয়ের তুচ্ছতাচ্ছিল্য শুনেছি তাই কখনো একপাক্ষিক ভালোবাসা প্রকাশ করতে চাই নি।কিন্তু আজ থেকে এক বছর আগে রাহাত ভাই নিজে আমায় প্রপোজ করে।ইমোশনাল ভাবে ব্ল্যাকমেইল করে। আমি বাধ্য হয়ে আমার এক পাক্ষিক ভালোবাসার কথা বলি।তখনও সে নাটক টা চালিয়ে যায়। তিন মাস পর একদিন ঘুরতে যাই।সেদিন রাহাত ভাইয়া আমার সাথে জোরজবরদস্তির করার চেষ্টা করে।তখনই এক ফেরেশতার মতন মানুষ আমাকে রক্ষা করে।তারপর আমি লজ্জায় মিইয়ে যাই।কাকে বলবো এই বিশ্বাসঘাতকার কথা কুল-কিনারাহীণ হয়ে যাই।
পরে যখন ঠিক করলাম সবাইকে জানাবো তখনই শুনি রাহাত ভাইয়ের সাথে আপুর বিয়ে ঠিক হয়।আমি রাহাত ভাইয়ের কাছে আকুতি মিনতি করি জেনো বিয়েটা না করে।যখন রাহাত ভাই শুনছিলো না তখন বলেছিলাম আমাদের কথা সবাইকে বলে দিবো।তখনই রাহাত ভাই বিশ্রী একটা ভিডিও নিয়ে ব্ল্যাকমেইল শুরু করে।’
টানা এতক্ষণ কথা বলে থামলো নীলা।সবার জেনো রুদ্ধশ্বাস অবস্থা। আফসানা রহমান এগিয়ে এসে বললেন
-‘কিসের ভিডিও নীলু?’
হাবিবা খানম ঠোঁট বাঁকা করে বললেন
-‘দেখো তোমার মেয়ে কার সাথে শুয়েছে ওটাই আমার ভাইয়ের ছেলে দেখে ফেলেছে তাই এত নাটক।’
নীলা মুখ কুঁচকে “ছিঃ” বলে উঠল।তারপর শক্ত কন্ঠে বলল
-‘রাহাত ভাই তোমার ভাইয়ের ছেলে হলে আমিও তোমার ভাইয়ের মেয়ে তাই এক পাক্ষিক কথা বলো না।আর যেটা জানোনা সেটা নিয়ে তো আরও আগে বলবে না।’
এতক্ষণ পরে তিমা মুখ খুললো
-‘আহ্ মা চুপ করো।নীলু তুই বল কিসের ভিডিও?’
নীলা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
-‘নিরুপমা আপাইয়ের গোসলের ভিডিও।যা রাহাত ভাই আপার অগোচরে তুলেছিলো।এবং সেটাই নেটে আপলোড দেওয়ার হুমকি আমাকে দিয়েছিলো।’
নিরুপমা জেনো দু’কদম পিছিয়ে যায়। তাহলে এই জন্য নীলা সব মেনে নিতে চেয়েছিলো?
রাহাত এগিয়ে এসে আমতাআমতা করে বলল
-‘তোর কাছে প্রমান আছে এসবের?’
এবার পুলিশ অফিসার মুখ খুললেন
-‘হ্যাঁ প্রমাণ আছে মিষ্টার রাহাত।কাল আপনি নীলার সাথে কথা কাটাকাটির সময় সবটা নিজের মুখে স্বীকার করেছেন তার ভিডিও আছে আমাদের কাছে।’
এই বলে সে ভিডিও টা অন করলো।সেখানে সত্যি রাহাত নিজের মুখে সব স্বীকার করছে।রাহাত অবাক দৃষ্টিতে তাকালো নীলার দিকে।নীলা বাঁকা হেসে বলল
-‘অবাক হচ্ছেন রাহাত ভাই? ভিডিও টা কে করলো ভেবে অবাক হচ্ছেন? আপনি কাল এসে দেখে ছিলেন না মোবাইলে চার্জে দিচ্ছি? হ্যাঁ তখন চার্জেই দিছিলাম কিন্তু কি মনে করে ভিডিওটা জেনো অন করছিলাম।অবশেষে আমি সাকসেস।’
আফসানা রহমান ঠাস করে চড় বসালেন।তারপর নিজের স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন
-‘তুমি কিছু বলবে না ওকে?’
আজিজুর রহমান এতক্ষণে মুখ খুললেন
-‘আমি জানতাম সবটাই।তবে রাহাত এত ঘৃণিত জিনিস নিয়ে আমার মেয়েকে ব্ল্যাকমেইল করছে আমি জানতাম না।’
আজিজুর রহমানের কথায় উপস্থিত সবাই দ্বিগুণ অবাক হলো।আফসানা রহমান সেই অবাক ভাবটা রেখেই বললেন
-‘তুমি জানতে মানে কীভাবে?’
আজিজুর রহমান শান্ত স্বরে বলল
-‘নিরু বলেছে সবটা।’
তিমা বললো
-‘মামু খুলে বলো সবটা।’
আজিজুর রহমান বললেন
-‘আমি নিরুর কথায় নিরুর আর রাহাতের বিয়ে ঠিক করি।নিরু আমাকে বলেছিলো রাহাত এমন কিছু করেছে নীলার সাথে যা নীলাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে।জানতাম এমন কিছুই যা নীলা বলতে পারছে না তাই সব চাল।’
নীলা এগিয়ে এসে বলল
-‘হ্যাঁ নিরু আপু সবটা আগে জানতো।আমি জানতাম না নিরু আপু যে সবটা জানতো।আসলে নিরু আপুকে কেউ সবটা জানিয়েছে আর সে আর কেউ না সে হলো নীড় ভাইয়া।’
শারমিন চৌধুরী এবার বিষ্ময় নিয়ে বললেন
-‘নীড় জানিয়েছে? কিন্তু কীভাবে ও জানলো?’
নিরুপমা এগিয়ে এসে বলল
-‘ঐ যে রাহাত জোরজবরদস্তি করেছিলো তখন একটা ছেলে বাঁচিয়ে ছিলো বলেছে না? ওটা নীড়ই ছিলো।’
সবার কাছে জেনো এক নতুন রহস্য বের হলো।নীড় আর নিরুপমাই তাহলে সবটা করেছে।কিন্তু কীভাবে? ওদের সম্পর্ক কি? আর কিইবা আছে নীলার বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ?
#চলবে