#বিষাক্ত_ভালোবাসা
#পর্বঃ১০
লেখিকা: #শারমিন_আক্তার_বর্ষা
চোখের সামনে কেমুনে জেনো দিনগুলো কেটে যাচ্ছে, দেখতে দেখতে ২১বছর হতে চলল। এখনও তোমার কোনো খোঁজ নেই। চলে গেলে আমার ধরা ছোঁয়ার বাহিরে,যাওয়ার আগে একটিবারও ভাবলে না। যে মানুষটা তোমাকে ছাড়া দুদণ্ড থাকতে পারে না। সে তোমাকে ছাড়া দিনের পর দিন থাকবে কি করে? তুমি চলে যাওয়ার পর আমি বড্ড এলোমেলো হয়ে গেছি ইয়ানা। আজও বেঁচে আছি শুধু তোমার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে। মনের মধ্যে এখনও বিশ্বাস টুকু সঞ্চয় রয়েছে, আমার ইয়ানা বেক করবে। জানো ইয়ানা তোমার যাওয়া পথ পানেই আমি ইয়াসির চাতকপাখির মতো তাকিয়ে থাকি। মন বলে এই পথ দিয়েই তুমি ফিরবে। আমাকে আমার থেকেও বেশি ভালো তুমি চিন্তে আর সেই তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে। কেনো ইয়ানা? ভুল আমি একটা করেছি সে জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতেও আমি প্রস্তুত ছিলাম। তাই বলে,এভাবে নয়। সেদিনের পর, চারদিন পর্যন্ত শুধু তোমাকে খোঁজা হয়েছে। কিন্তু আমার বন্ধুরা কিছুতেই তোমার সন্ধান পায়নি। আমি হাল ছাড়িনি, আমার চেনামতে তোমার সব বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করি। কেউ তোমার খবরে জানে না। তুমি বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়ার দু’দিন পর,তোমার বান্ধবী মুন্নির সাথে আমার হঠাৎ রাস্তায় দেখা হয়ে যায়। ওর কাছে জানতে পারি শেষ ক’টা দিন তুমি ওর কাছেই ছিলে। এবং ওর ওখান থেকে আকাশপথ পাড়ি দিয়েছো। মুন্নিকে তুমি কিছু বলোনি বুঝলাম। কিন্তু কি জানো, তোমার চলে যাওয়া খবরটা শুনে মুন্নির সামনে থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরার সামর্থ্য টুকু আমার মধ্যে অবশিষ্ট রইল না। এরইমধ্যে খবর এলো, আমার বোন সূবর্ণার এক্সিডেন্ট হয়েছে। স্বামী মা’রা যাওয়ার পর দশ বছরের ছেলেকে নিয়ে স্বামীর ভিটা-জমিতে স্থায়ী থেকে যায় সূবর্ণা। আমাদের অনেক জোরাজোরি তেও সে ভিটা-মাটি ছেড়ে আসে না। ছেলেকে নিয়ে নিজের জীবিকা নির্বাহ করে। তার শেষ কথা ছিল, বিয়ে করে এ বাড়িতে আসছি এক মাত্র মৃ’ত্যু আমাকে এ বাড়ি থেকে বের করবে। তিন বছরের ছেলে আরিশ কে রেখে তার বাবা মা’রা যায়। ফ্যাক্টরিতে লাগে চারদিকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। অধিকাংশ কর্মী ফ্যাক্টরি থেকে বের হতে পারে না। তাদের শেষ পরিণাম হয়েছিল, আগুনে পুড়ে মৃ’ত্যু। স্বামীর মৃ’ত্যুর সাত বছর পর, আমার ছোট্ট বোনটি রাস্তায় কার এক্সিডেন্টে মারা গেলো। স্তব্ধ হয়ে গেলাম,চারপাশ জেনো মৌমাছির মত ঘুরতে লাগে। কোনো রকম বাড়ি পৌঁছালাম। তারপর ড্রাইভ চাচা ও আমি মনিপুরের উদ্দেশ্য রওনা দেই। বোনের শেষ কার্য সম্পূর্ণ করলাম। মা আমার কান্না করতে করতে জ্ঞান হারিয়েছে। নাবালক আরিশ আমার কোমড় জাপ্টে ধরে কাঁদছে। মা ও আরিশকে নিয়ে শহরে চলে আসলাম। সূবর্ণা চলে যাওয়ার পর থেকে মা কেমন জেনো একটা হয়ে যায়। সব সময় চুপচাপ বসে থাকে। দশটা কথা জিজ্ঞেস করলে হঠাৎ, হুহহ কিছু বলছিস? এমন ভাবে বলে জেনো তিনি একটা ঘোরের মধ্যে আছে আর আমাদের কথা শুনতেই পায়না। মা’কে ডাক্তার দেখালাম। ডাক্তার রবিউল, মাকে একজন মনোবিজ্ঞানীকে দেখানোর জন্য বলল। দু’দিন বাদ অফিস থেকে বাড়ি ফিরার সময় ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে ফিরি। মার রুমে গিয়ে দেখি মা কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে, ডাকতে ইচ্ছে করল না। রাতে খাবার খেতে বসলাম। আরিশকে প্রশ্ন করলাম তোমার নানী কখন খেয়েছে? ও আমার দিকে নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
– ‘ কোই নানি রাতে খায়নি? ‘
মা’ খায়নি শুনে খাবার জেনো গলা দিয়ে নামছে না। দ্রুত খাবার টেবিল থেকে ওঠে গেলাম। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে মা’কে ডাকতে লাগি,
– ‘ও মা ওঠো। খাবে না?’
মা কোনো আওয়াজ করল না। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে মাকে তুলার জন্য হাত বাড়ালাম। অদ্ভুট লাগলো, বেশ কয়েক বার আওয়াজ দিলাম, শরীর নাড়িয়ে ওঠতে বললাম কিন্তু মা কোনো সাড়াশব্দ দিচ্ছে না। চোখের কোণে ছলছল করে ওঠল অশ্রুকণা। বিছানায় মা’র মাথার পাশে বসলাম। দু’হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে বসালাম। বুকের মধ্যে খানে মাকে নিয়ে বললাম,
– ‘ তুমিও সবার মতো আমাকে ধরণীর বুকে একা রেখে চলে গেলে মা?’
এতকিছুর মাঝে,তোমাকে আমি ভুলিনি ইয়ানা। মা চলে যাওয়ার পর আমার পাশে তোমাকে সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তুমি ছিলে না, হয়তো তুমি জানোও না, মা যে আর নেই।
বোন নেই, মা-ও চলে গেছে, ধরা ছোঁয়ার বাহিরে তুমি, কাছে ছিল আমার সূবর্ণার অংশ আরিশ। আরিশের মুখের দিকে তাকালে আমার মধ্যে ধুক করে ওঠে। আরিশ ও যে অবিকল আমার সূবর্ণার মত হয়েছে। ইয়ানা তুমি না আরিশকে দেখলে ওর থুতনিতে হাত রাখতে,গালে কপালে চুমু একে অনেক সখ আহ্লাদে বলতে, তোমার একটা মেয়ে বাবু চাই। তুমি মেয়ের জামাই করবা আমাদের আরিশকে। সেই তুমি কোথায় এখন ইয়ানা? শুনেছিলাম তুমি প্রেগন্যান্ট কিন্তু আজ অব্দি জানা হল না, আমাদের সন্তানের কথা। আমি কি আধোও ছেলে সন্তানের বাবা নাকি মেয়ে সন্তানের?জানা নেই।
রাতের শুরু, ঘরের এক কোণে ইজি চেয়ারে বসে আছে ইয়াসির৷ বিছানার ওপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এলবাম গুলো। হাতে রয়েছে মস্ত বড় একটি ওয়ালমার্ট। ইয়ানার হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী স্পষ্ট। ছবিতে হাত বুলাচ্ছে ইয়াসির। চোখের কেণে কিঞ্চিত জল ছলছল করছে। বুকের মধ্যে খাখা করছে। এত বড় বাড়িতে সে একা। ধম বন্ধ হয়ে আসছে, মাঝেমাঝে তো মনে হয় এই চার দেয়াল ইয়াসিরের গ’লা টিপে ধরে। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে ইয়ানার ওয়ালমার্ট বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে ইয়াসির।
ক্ষীণকণ্ঠে বলে,
– ‘ ফিরে আসো ইয়ানা। ফিরে আসো। মৃ’ত্যুর আগে তোমাকে মন ভরে একটু দেখতে চাই।’
_____________
অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ির জন্য প্রস্থান করে ইয়ানা। অফিসের মাঝে হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে পরে যায় সে। জ্ঞান ফিরতে বসকে বলে দু’দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যায়। বাড়িতে আসার পর, বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পরল। বসে বসে কাজ করায় পিঠে ভীষণ ব্যথা করছে। মেইড মেইজি কে বলল, একটু গরম পানি করে ছ্যাঁক দেওয়ার জন্য, মেইজি বহু বছর ধরে ইয়ানার বাড়িতে কাজ করে। সন্ধ্যার পর কোনো কাজ না থাকলে,মেইজি কে বাংলা ভাষা শিখায় ইয়ানা। এজন্য অনেকটা শুদ্ধ বাংলা বলতে পারে ও বুঝে মেইজি। গরম পানির ছ্যাঁকে আরাম পায় ইয়ানা। চোখ জোড়া ভেঙে আসছে। আজ বেশি ক্লান্ত মেয়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু ঘুমে চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে আসছে।
ওঠে বসে মেইজিকে চলে যেতে বলল ইয়ানা। মেইজি চলে যেতে দরজা ভেতর থেকে লক করে আলমারির কাছে আসে। আলমারির কাভার্ডে কাপড়ের ভাঁজের মধ্যে ইয়াসিরের একটা ছবি লুকিয়ে রাখছে ইয়ানা। ইয়ানা ইয়াসিরের থেকে দূরে থাকলেও ইয়াসির তার মন থেকে দূরে নয়। ছবিটা বুকের সাথে চেপে ধরে কান্না করতে লাগে ইয়ানা। হাঁটু ভাজ করে বসে পরল। জড়ানো কণ্ঠে বলল,
– ‘ আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি ইয়াসির।’
_____________
রাতের খাবার যত আগে খাওয়া যায় ততই স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। আটটা বাজা মাত্র সকলে একসাথে খেতে বসে। সবার টেবিলে জায়গা হয়নি বলে কয়েকজন ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে খাচ্ছে। খেতে খেতে সবাই খাবার ও রান্নার প্রশংসা করছে। মিসেস সুমাইয়া লজ্জিত বোধ করছেন। বিয়ের এতগুলো বছরে তার রান্নার প্রশংসা এভাবে কেউ করেনি। আজ সবার কি হল হুট করে সবাই রাধুনি ও খাবারের প্রশংসা করে শেষ করতে পারছে না। মি.মাহিন খাওয়ার মধ্য খানে আঙুল চেটে বলল,
– ‘ হুম! আজকে মনে হচ্ছে রান্নাটা বেশ মনোযোগ দিয়ে করছো। বেশ ভালো হয়েছে। প্রশংসা না করলেই নয়! এভাবেই তো প্রতিদিন রান্না করতে পারো। মুখে লেগে আছে রান্নার স্বাদ। মন বলছে, আমি একাই সব খেয়ে ফেলি।’
মিসেস. সুমাইয়া ফিক করে হেসে ফেলল। হাসি থামিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,
– ‘ আজ কে আমি অনেক ভালোবেসে সবগুলো রান্না করছি। তাই হয়তো এত স্বাদ হয়েছে।’
মি.মাহিন এর ছোট ভাই মাহমুদ খেতে খেতে শুধালো,
– ‘ আজ রান্নার প্রতি এত ভালোবাসা যে, কোনো স্পেশাল কিছু আছে নাকি ভাবী?’
মিসেস সুমাইয়া উনার শাশুড়ী কে পিছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরল, আর বলল,
– ‘ আজ তো মায়ের জন্মদিন।’
সুমাইয়ার কথায় অবাক হল সকলে। আজ যে শ্যামার দাদীর জন্ম দিন সেটা বাড়ির সবাই ভুলে গেছে। এমনকি নার্গিস সুলতানা নিজেও ভুলে গেছেন। তার দুই ছেলেরা ভুলে গেছে কিন্তু বড় ছেলের বউ সুমাইয়ার মনে ছিল আর সে উনার পছন্দের সব রান্না একা হাতে করছে এবং অনেক কিছু এক্সট্রা ও রান্না করছে। খুশিতে চোখে জল চলে আসে নার্গিস সুলতানার। তিনি সুমাইয়া কে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– ‘ বেঁচে থাকো মা। আমার মাথায় যতগুলো চুল আছে ততগুলো হায়াত জেনো আল্লাহ তোমাকে দেন।’
শ্যামার চাচি এগিয়ে আসলেন তিনিও তার শাশুড়ী কে জড়িয়ে ধরে জন্মদিনের মোবারক জানালো। শ্যামা চেয়ার ছেড়ে ওঠে যায়। ওর দাদীকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী স্বরে বলে,
– ‘ বুড়ি জন্ম দিনের এতগুলা শুভেচ্ছা।’
সবার আনন্দ দেখে চোখের কার্নিশ বেয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরল আমার। আজ আমার দাদী নেই, ছোট থেকে না বাবার আর না দাদীর আদর ভালোবাসা পেয়েছি। আজ যদি আমার দাদী আমার কাছে থাকতো তাহলে হয়তো আমাকে অনেক আদর করতো আর আমিও দাদীকে জড়িয়ে ধরে আদর করতাম। মনে মনে কথাটি চিন্তা করতে বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসল। আনমনা দেখে শ্যামা ডাক দিলো ওর কণ্ঠ শুনে হুঁশশ ফিরল আমার। আমরাও সব বন্ধু রা মিলে দাদীকে উইশ করলাম। দাদীর সামনে কয়েকটা দাঁত নেই। তিনি আমাদের সবার এইটুকু ভালোবাসা আহ্লাদ পেয়ে ভীষণ খুশি হলেন। সহাস্যে হাসতে লাগল। আমাদের সবাই কে জড়িয়ে ধরে গালে কপালে আদর করে দিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে সবার জন্য দোয়া কামনা করল। এতটুকু তে একটা মানুষ যে এত খুশি হতে পারে দাদীকে না দেখলে হয়তো বুঝতেই পারতাম না। দাদীর হাসিমাখা মুখটা দেখে বুকটা জেনো প্রশান্তি তে ভরে যাচ্ছে। দাঁত নেই তবুও কি অমায়িক সে মুখের প্রস্ফুটিত হাসি।
চলবে… ইন শা আল্লাহ!