#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা
অন্তিম পর্ব (১৫)
বিরাট কঠিন এক সত্যি বুকে পুষে আঁচলে বুনন করা চিঠির পরের অংশ শুরু করলো পত্র,
“প্রেমিক প্রেমিকার গল্পের সমাপ্তি হয়েছে বলে ভাবিস না চিঠি এখানেই শেষ। এখান থেকে তো শুরু। এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিস এই গল্পের প্রেমিক প্রেমিকা যুগল কে। তবুও আমি তোকে পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছি, এরা হলো তোর পিসি আর আমার বাবা নামক মানুষ। আর তাদের এই নিষিদ্ধ প্রেমের জন্য বলিদান হওয়া মানুষটা হলো আমার ভাই, তোদের অভ্রদা। অবাক হোস না একদম। এই যে এতক্ষণ যে গল্প শুনালাম তাও তোর অভ্রদা’র যত্নে লিখা প্রিয় ডায়েরি থেকে আমি গুছিয়ে নিয়েছি। পৃষ্ঠা গুলো লুকিয়ে ফেলেছি পৃথিবীর বুক থেকে। আমার মা যে সহ্য করতে পারবে না পত্র, একদম পারবে না। তুই লুকিয়ে ফেলিস এ গল্প গুলো কেমন? আমাদের জীবন গতি তো স্বাভাবিকই চলছিল। বড়দা আমাদের কাছে এলো তার কলেজের ছুটিতে, তোর বোনের প্রথম বিয়েটাও তো তখন ঠিক হলো, কী আনন্দ, হৈচৈ আশপাশে। এর মাঝেই হুট করে একদিন বাবা বললো আমাদের দোকানে নাকি বড়দার কলেজ থেকে কল এসেছিল। দোকানের টেলিফোনেই তো আমরা খবরা-খবর পেতাম। বড়দা তৈরী হলো, বাবা এগিয়ে দিতেই গেলো, এ যাওয়া বড়দার শেষ যাওয়া হবে কে জানতো? আমার বড়দা যে আর ফিরবে না আমি জানলে কখনোই তাকে যেতে দিতাম না। তবে আমার বাবাও যে এত অমানবিক হবে, জানলে তার কথা বিশ্বাস করে বড়দাকে যেতে দিতাম না। হয়তো বড়দাও আঁচ করতে পারে নি তার জন্মদাতা তার প্রতি এত নির্দয় হবে। ছেলেকে পৃথিবী ছাড়িয়ে দিয়ে ভেঙে পড়লেন আমার বাবা। হয়তো তোর পিসিও। কী জানি, সেও হয়তো বুঝতে পেরেছে তার প্রেমিক খুব বড়ো কিছু করেছে। নাহয় তোর মা তো কতো কথাই বলতো, সেদিনের এমন কী কথা লেগে গেলো যে তাকে আ ত্ম/হ ত্যা ই করতে হলো? হয়তো এ গল্পও অন্য কোথাও রচিত। হয়তো কখনো খুঁজে পাবি এর অস্তিত্ব। হয়তো বা চোখের দেখাটাই সত্যি হয়ে থেকে যাবে। বড়দার মৃত্যুর অনেক গুলো দিন পর যখন আমি জানতে পারলাম এসব, বিশ্বাস কর, মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রকাশ করতে পারি নি বুকের ভারিক্কি। তবে আজ পরম শান্তি নিয়ে লিখছি। পৃথিবীতে আমার কিছু চাওয়ার নেই। বাবাকে হারিয়ে আজ আমি পরম তৃপ্ত, শান্ত। আমি জানিনা তোর পিসি হয়ে কে ঘুরছে। কার জন্য বাবা টা আমার বিছানা নিয়েছিল। তবে বলবো, তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা। সে তার অজান্তেই হয়তো আমার বড়ো উপকার টা করেছিল। একটা ভয়াবহ অধ্যায়ের ইতি টানলাম এখানে। হয়তো আমাদের আবার দেখা হবে। ইট-পাথরের ঐ নিষ্ঠুর শহরের কোনো অলিগলিতে। হয়তো কখনোই আর দেখা হবে না। চা বাগানের পত্র, পুষ্প নামক প্রিয় মেয়ে গুলোকে হয়তো হারিয়ে ফেললাম সময়ের স্রোতে। বাস্তবতার আঁচড়ে আজ আমরা নিঃস্ব। শেষবেলায় আরেকটা কথা বলে দিয়ে যেতে চাই, শাড়িটা বড়দা খুব যত্ন করে নাকি শহর থেকে এনে লুকিয়ে রেখেছিল আলমারিতে। সেটাও ডায়েরি পড়ে জানলাম। আর শাড়িটা কার জন্য আনা জানিস? তোর জন্য। আমার হতভাগা বড়দার ডায়েরি থেকে জানলাম, মানুষটা নাকি তিল তিল করে তোকে বুকের মাঝে বহু বছর আগে থেকে পুষে বেরিয়েছিল, অথচ আমরা টেরও পেলাম না! কী অদ্ভুত তাই না বল? তবে থাকুক, তুই নাহয় ভালো থাক তোর ভালোবাসায়। আমার বড়দা নাহয় অ-ভালোবেসেই মরলো।
ইতি
তোর খই”
পত্র শাড়িটা বুকের মাঝে জাপটে ধরলো। বুক ভার করে তার কান্না এলো। কতো গুলো এলোমেলো হিসেব মিলে গেলো। অভ্রদা’র অকালে বিদায় নেওয়ার গল্প আত্মপ্রকাশ পেলো। পত্র বোকা, বড্ড বোকা। কাচকে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে হিরে হারিয়েছে। আজ আর আফসোস করে লাভ নেই। চারপাশে কেবল হাহাকার আর পত্র নির্বাক। কারণ সেই তো শূন্যতা ডেকে আনলো। না ছয় সাত মাস আগে কোনো গল্পের সূচনা হতো আর না পত্র আজ এতটা অসহায় হতো। সে ভুল। পত্র ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। তার আর করার কিছুই নেই, কিছু না।
_
আতস মারা যাওয়ার কয়েকদিন পরের কথা। আতসের লা/শ নিয়ে যাওয়া বন্ধুটি আর ফিরলো না। সে এই প্রজেক্টের কাজে আর নেই বলে জানালো। এতদিন আতসের মৃত্যুতে বন্ধ হয়ে থাকা প্রজেক্ট টা আবারও শুরু করার৷ কথা বললো মালিকের ছেলে কঙ্কর আর নভ। বড়ো বড়ো মেশিন গুলো আবার সশব্দে চালু হলো। চা বাগানের সজীব পরিবেশ মুহূর্তেই প্রযুক্তির দা/নবীয় আ°ক্রমণে মর্মাহত হলো। এবার চা বাগানের মানুষ আওয়াজ তুললো কিন্তু মালিকের টাকা ও ক্ষমতার কাছে সে আওয়াজ বড়ই ক্ষীণ।
সেদিনের রাতের পর পত্র কেমন যেন কথা বলতে ভুলে গেলো। ঘর থেকে বের হওয়া রীতিমতো ছেড়ে দিলো। হাজার বার জিজ্ঞেস করেও তার এই নিশ্চুপতার সমাধান করা গেলো না। সে যেন প্রাণহীন। ভেঙে পড়া কোনো গাছের ডাল কিংবা ঝড়ে পড়া পাতা।
পুরো সংসারকে সামলাচ্ছে ছায়া আর পুষ্প। সমিরবাবু পঙ্গু হয়ে বিছানা নিয়েছে। স্বামীর এ অবস্থায় ঘরের কাজ, বাহিরের কাজ সবটার দায়িত্ব এসে পড়লো ছায়ার কাঁধে। সে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
সকাল পেরিয়ে দুপুর হলো, দুপুর পেরিয়ে বিকেল অবশেষে বেলা ফুরালো। পুষ্প আধপোড়া রান্না ঘরটায় বসে রান্না করছে। ছায়া স্বামীকে খাবার খাইয়ে শুয়ে দিয়েছে। আর পত্র পুড়ে যাওয়া রুমটার আধভাঙা চৌকিটাতে শুয়ে আছে। স্বামীকে খাইয়ে হারিকেনের আলোটা একদম ক্ষীণ করে ঘরটাকে ঘুমানোর উপযোগী করে দিলো। সমির বাবুও মুহূর্তেই ঘুমিয়ে গেলো। ছায়া স্বস্তির শ্বাস ফেলে উঠে গেলো জায়গা থেকে, ঘরের দরজা টা হালকা ভেজিয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে পুষ্পকে ডাকলো,
“পুষ্প, পুষ্প, কতদূর হয়েছে তোর?”
পুষ্প কড়াইয়ের মাছ উল্টোতে উল্টোতে উত্তর দিলো,
“এইতো মা মাছ ভাজা হলেই একটু হালকা ঝোল দিয়ে নামিয়ে ফেলবো।”
পুষ্পের উত্তর পেয়েই ছায়া জিরিয়ে নিলো। বাড়িটা অন্ধকার। ঘরে হারিকেন যা একটু জ্বলছে। আগুন লাগার পর বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন হয়েছে। এরপর আর লাগাতে পারে নি। কোয়াটারের ওখান থেকে লাইন আনতো কিন্তু মালিকের ছেলে কঙ্কর এবার বিদ্যুৎ দিতে নাকোচ করেছে। তাই অন্ধকারেই দিন যাচ্ছে তাদের।
ছায়া রান্নাঘর ও নিজের ঘরে আরেকবার তাকিয়ে পত্র যে রুমে আছে, সেখানে গেলো। মাকে ঘরে আসতে দেখে পত্র শোয়া থেকে উঠে বসলো। ঘরের সাথে লাগোয়া জানলাটা দিয়ে বাহিরের জ্যোৎস্নায় আচ্ছন্ন পরিবেশের প্রতিচ্চবি বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেই অস্বচ্ছ আলোয় বোঝা গেলো ছায়া চৌকির সামনে হয়তো মোড়া পেতে বসেছে। দু’জন দু’জনের মুখামুখি অথচ দু’জনই চুপ। বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ছায়াই প্রথম মুখ খুললো, গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“তোর ঘর দরজা বন্ধ করে এমন নির্বাসনের কারণ দেখছি না আমি।”
মায়ের কথার বিপরীতে পত্র নিশ্চুপ। ছায়া শ্বাস ফেললেন, বিরক্তির স্বরে বললেন,
“এ জন্য ই তোমাকে আমার পছন্দ না কারণ তুমি বড্ড স্বার্থপর।”
পত্র এবারও উত্তর দিলো না। ছায়াও হয়তো উত্তরের আশা করলো না। সে এক নিঃশ্বাসে বলতে শুরু করলো,
“পত্র, দেখো, তোমাকে একটা কথা বলি। তোমার কী হয়েছে আমি জানিনা তবে আমার কেন জানি মনে হয় তোমার কোনো ভুলের কারণেই ঐ শহুরে ছেলেটার এ অবস্থা। তোমার যদি মনে হয় ভুল শুধরে নেওয়া উচিৎ শুধরে নেও। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে ভেবে বসে থেকো না। দেরিতে হলেও শুধরে নেওয়া উচিৎ কিছু ভুল। কারণ হয়তো তা আবার নতুন কোনো ক্ষতির সৃষ্টি করবে। বুঝেছ তো?”
“আচ্ছা, বড়দির সাথে বিপ্লব’দার সম্পর্ক টা কীভাবে জানলে তুমি?”
পত্র খুব আশা নিয়ে মাকে প্রশ্ন কররেও ছায়া একদম ঝেরে ফেললো সে প্রশ্ন। মোড়া ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো,
“খেতে আসো, ভাত দিচ্ছি।”
পত্র জবাবে কিছু বললো না। তার দৃষ্টি জানালার বাহিরে। ছায়া নিঃশব্দে ঘর ছাড়লো। তারপর সব আবার শুনশান।
_
রাত পেরিয়ে ভোর হলো। চা বাগানের মানুষদের অবাক করে দিয়ে সেদিন আর শহুরে মেশিন গুলো শব্দ তুলে চালু হলো না। পত্র ও পুষ্প সকালে উঠে নিজেদের কাজে লেগে পড়লো। আজ কয়েকদিন পর পত্র আবার ঘর ছেড়ে বেরুলো। উঠোন ঝাড়ু দিলো। পুষ্প পুকুর থেকে এঁটো থালাবাসন গুলো ধুয়ে আনলো। রান্না চাপালো চুলায়। পত্র বাবাকে পরিষ্কার করিয়ে দিলো। দু’বোন কাজে লেগে পড়লোও আশেপাশে তারা ছায়ার কোনো অস্তিত্ব দেখতে পেলো না। এ নিয়ে অবশ্য তাদের কোনো মাথা ব্যাথাও নেই। কয়েকদিন যাবত বাড়ির জন্য প্রয়োজনীয় বাজারহাট ছায়াই করছে। আর সকালে বাজার করতেই বেরিয়ে যায়।
সকাল গিয় দুপুর ঘনিয়ে আসে। ঘরের অবশিষ্ট সবজি, মাছই রান্না করে ফেলে পুষ্প মায়ের অপেক্ষায় থেকে শেষমেশ। দু বোন স্নান সেড়ে যাবতীয় কাজও শেষ করে ফেলে তবুও মায়ের আসার লক্ষণ নেই। একটু চিন্তিত হলেও তেমন পাত্তা দেয় না তারা। দু’জনে যখন উঠোনে এসে বসলো পত্রের হুট করেই কিছু একটা মনে পড়লো। সে মুহূর্তেই ঘরে গিয়ে ফিরে এলো। হাতে সেদিনের বিন্নীর দেওয়া শাড়িটা। পত্রের হাতে শাড়িটা দেখে ভ্রু কুঁচকালো পুষ্প। কিছুটা অবাক হয়ে বললো,
“এটা এনেছিস যে?”
পত্র শাড়িটায় কয়েকবার হাত বুলিয়ে নিলো তারপর আচমকাই শাড়িটা সে পুষ্পের কোলে দিয়ে বললো,
“এটা আসলে তোর জন্য ছিলো,পুষ্প। অভ্রদা তোর জন্য শহর থেকে এনেছিল। বিন্নী জানতো না বলে আমাকে দিয়েছে।”
পত্রের কথায় চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো পুষ্প। অবাক কণ্ঠে বললো,
“অভ্রদা এনেছে!”
“হ্যাঁ।”
“আমার জন্য?”
“হ্যাঁ রে।”
“সত্যিই অভ্রদা আমার জন্য এনেছিল?”
পত্র এবার মিছে মিছে বিরক্ত হয়ে বললো,
“হ্যাঁ রে ভাই, তোর জন্য ই এনেছিল। কতোবার এক কথা জিজ্ঞেস করিস!”
“অভ্রদা সত্যি সত্যি আমার জন্য এনেছে? যেমন করে নেলপলিশ আনতো!”
পুষ্পের কণ্ঠ স্বরে ভিন্নতা লক্ষ্য করেই চমকে উঠলো পত্র। চমকে যাওয়ার হাবভাব ছড়িয়ে গেলো তার মুখমন্ডলে। আমতা-আমতা করে বললো,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। নেইলপালিশ আনতো যে, তাই শাড়িও এনেছে।”
“তবে তোর কথা ই ধরে নিলাম বরাবরের মতন। এটা তাহলে আমার তো?”
“হ্যাঁ, তোর।”
“এমন ভিজে কেন?”
আবার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দ্বিধায় পড়লো পত্র। অতঃপর বোকা বোকা হেসে উত্তর দিলো,
“কাল বের করতে গিয়ে কাঁদা ভরে গিয়েছিল। তাই ধুয়ে দিয়েছি।”
“তাহলে আমি আজ পরবো এটা কেমন? দুপুরের ভাত খেয়ে তারপর পরবো আর অভ্রদা’র সমাধির কাছে গিয়ে অভ্রদাকে দেখিয়ে আসবো।”
পত্র কেবল মাথা দুলালো। ভেতর থেকে একটা ভারি ভাব মুহূর্তেই হালকা হয়ে গেলো। বিন্নী ভুল বলেছে, অভ্রদাকে ভালোবাসার লোক আজও আছে পৃথিবীতে। যে হয়তো চিরকাল এমন করেই ভালোবেসে যাবে।
দুপুরে দু’বোন খাওয়া দাওয়া করলো। পুষ্প গেলো শাড়ি পড়তে আর রোদ ঝিমিয়ে পড়তেই পত্র বেরিয়ে গেলো মায়ের খোঁজে।
প্রথমেই বাজারে গেলো। বাজারের কোণা কোণা অব্দি খুঁজতে শুরু করলো কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে ছায়ার কোনো অস্তিত্বের কেউ ঠিকানা দিতে পারলো না। এতক্ষণের ফুড় ফুড়ে ভাব মুহূর্তেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। পত্রের মনে ভয় জাগতে শুরু করলো। পত্রের উন্মাদনা দেখে পরিচিত কয়েকজনও লেগে পড়লো ছায়াকে খোঁজার কাছে। দুপুর ঝিমিয়ে বিকেল হলো। দলবেঁধে ছায়াকে খোঁজার কথা ছড়িয়ে গেলো পুরো চা বাগান জুড়ে। পৌঁছে গেলো পুষ্পের কান অব্দি। তা শুনে বিচলিত হলো সমির বাবুও। কিন্তু অকেজো পায়ের জন্য সে উঠতে পারলো না বিছানা থেকে। পুরোনে আসবাবপত্রের ন্যায় এক জায়গায় ঠাঁই পড়ে রইলো কিন্তু পুষ্প বেরিয়ে গেলো তৎক্ষনাৎ। বাবার ঘরের দরজাটা বাহির দিয়ে আটকে সে বেরিয়ে এলো। দু’বোন মিলে পুরো চা বাগানে মায়ের খোঁজ করলো কিন্তু কোথাও পেলো না মাকে। পুষ্প কেঁদেকেটে একাকার হলো কিন্তু পত্র রইলো শক্ত। বোনকে কাঁদতে দেখে বেশ কোমল কণ্ঠে বলেছে,
“কাঁদিস না পুষ্প, আমি আছি তো।”
পুষ্প হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। মানুষ হারাতে হারাতে মেয়েটার এত ভীত হয়েছে যে হারানোর কথা ভাবলেও তার শরীরের প্রত্যেকটি লোমকূপ অব্দি কেঁপে উঠে। পুরো গ্রাম যখন ঘোষণা করে দিলো ছায়া চা বাগানে নেই পত্র তখন অন্যরকম একটা পদক্ষেপ নিলো। পুষ্পকে বাড়ি পাঠিয়ে সে সবকিছুর হিসেব মিটাতে বেড়িয়ে পড়লো গন্তব্যে।
চা বাগানের ঘন জঙ্গল ঘেঁষে যাওয়া ছিমছাম, সুন্দর ধরণের কোয়াটারের আজ বাহিরের বাতি জ্বলছে না। ঘরের ভেতর ক্ষীণ আলো ছড়াচ্ছে হলুদ রঙের বাতিটি। সেই আলোয় ব্যাগ গুছাতে ব্যস্ত নভ। ব্যাগ গুছিয়ে ঘর ছেড়ে বেরোতেই উঠোনে এক নারী অবয়ব দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে কিছুটা চমকে উঠলো, দু’কদম পিছিয়ে গিয়ে সন্দেহ দূর করার জন্য বললো,
“কে? কে?”
“কী অদ্ভুত! আজকাল আমার ছায়ামূর্তিটাও তোমার অপরিচিত লাগছে?”
মেয়েলি পরিচিত কণ্ঠটা শুনতেই ঢোক গিললো নভ। আমতা-আমতা করে বললো,
“তুমি এখানে কী করছো?”
“হিসেব চাইতে এসেছি। হিসেব দিবে না প্রিয়?”
“কিসের হিসেব?”
নারী অবয়বটা খানিক এগিয়ে উঠোনের মাঝামাঝি এলো। ঘরের আলো ঝাপসা নারী মূর্তিটার দিকে পড়লো। মেয়েটা হেসে উঠলো অথচ চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা। কেমন অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
“আমায় তুমি ঠকালে প্রিয়? চোখ বন্ধ করে ভালোবেসে ছিলাম বলে ভেবেছো বোকা! বোকা ছিলাম বলে ধোঁকা দিয়ে দিলে? কাজটা ঠিক করলে?”
নভ ধমকে উঠলো। ধমক দিয়ে বললো,
“কী বলছো পত্রলেখা?”
পত্রের হাসি হাসি মুখটা এবার হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। আক্রোশে ফেটে পড়ে বললো,
“তুমি আমার সাথে প্রতারণা করেছো। এখন না বোঝার নাটক করছো তাই না? এই যে আমার প্রিয় চা-বাগান, এটাকে তুমি এমন মৃত্যুপুরীতে রূপান্তরিত করেছো। না তুমি ছয় সাত মাস আগে আমাকে তোমার জালে ফেলতে আর না আমি এতো এতো পাপের অংশীদার হতাম। কেন, কেন তুমি আমাকে আতসের সাথে সম্পর্ক গড়তে বলেছিলে? কেন তুমি আমাকে মিথ্যে বুঝিয়েছিল প্রজেক্টের নামে? আমাকে স্বর্ণের আংটি দিয়ে প্রেম জাহির করতে চেয়েছিল। আর আমি কী বোকা ছিলাম! ভেবে ছিলাম তুমি আমায় ভালোবাসো। অন্ধের মতন তোমার কথা বিশ্বাস করে ছিলাম। এমনকি তুমি বলেছিলে পুকুরপাড়ে যেন আমি অভ্রদাকে দেখেছি সে কথা বাগানে প্রচার করি। আমি তাও করেছিলাম কিন্তু আমি একটা বারও বুঝতে পারি নি তুমি কিসের লোভে বলেছো। ভেবেছিলাম ভালো চাও আমার, আমাদের। কিন্তু তুমি করেছো সব তাই না? এই যে আমার বাবার পা টা আজ অসাড়, তাও তোমার জন্য তাই না? কত গুলো পাপ আমি করেছি তোমার কথাকে বিশ্বাস করে। সবাই বলতো আমি বুদ্ধিমতী, কিন্তু সেই আমিই যে ভালোবেসে চরম বোকা হয়ে গেছি তা আমি কাউকে বলতে পারলাম না। কেন এমন করলে আমার সাথে?”
“প্রজেক্টের লোভে। এই প্রজেক্টটা সম্পূর্ণ করতে পারলে কতগুলো টাকা পেতাম জানো? যখন প্রথম বার এলাম চা-বাগান পর্যবেক্ষণ করতে, তখন মনে হয়েছিল তোমার বাবা আর নাহয় ঐ অভ্র ঝামেলা তৈরী করবে। আর তাদের দু’জনের একটা দুর্বল জায়গা, তা হলো তুমি। তুমি কী ভেবেছো, অভ্রকে আমি চিনি না? প্রথম বার এসেই অভ্রের সম্পর্কে পুরো আগাগোড়া খেয়াল রেখেছি। কিন্তু আমার কিছু করার আগেই তোমার অভ্রদা চলে গেলো বহুদূর। আর তোমার বাবার সাথে ওটা আমি করি নি করেছে কঙ্কর। ওর ক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চয় জানো? কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আজ ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর আমার মস্তিষ্ক যা বলছে, কঙকরকে আর খুঁজে পাওয়া যাবেও না। তাই প্রজেক্ট ফেলেই আমি চলে যাচ্ছি। প্রজেক্টের জন্য আনা টাকা গুলোই আমাকে ভালো ভবিষ্যৎ দিতে পারবে, আমার আর কি চাই৷ আর তোমার অভ্রদা সেজে আমি পুরো চা বাগানকে ভয় দেখাতে চাইলেও আমার আর তত কষ্ট করা লাগে নি। তার আগেই কেউ একজন আমার কাজ গুলো করে দিয়েছে তোমার পিসির রূপে।”
“আর আতস, ওর সাথে আমাকে জড়িয়ে ছিলে কেন?”
“ভেবেছিলাম, ভবিষ্যতে কিছু হলে তার সমস্ত দায়ভার যেন আতসের ঘাড়ে পড়ে। পুরো চা-বাগানের কাছে তোমাদের সম্পর্কের একটা নাম দিতে চেয়েছিলাম যেন আমি কোনো কিছুতেই না থাকি।”
পত্র কতক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো তার সামনে মানুষের ন্যায় অমানুষটার দিকে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই শরৎ এর কথা, যে শরৎ এ সে নভ নামের ছেলেটার প্রেমে পড়েছিল। যে প্রেম বয়ঃসন্ধির আবেগে মিশে ধারণ করেছিল অন্ধত্ব। আর আজ সেই অন্ধত্বে চা-বাগান আর তার কাছের মানুষ ধ্বংসের মুখে। নিজেদের ধ্বংস চোখের সামনে ভাসতেই পত্র হিং/ স্র রূপ ধারণ করলো। নভের উপর হামলে পড়লো। ওর বুকের দিকের শার্ট খামচে ধরে বললো,
“সেদিন আতস ছেলেটা আমাকে বিশ্বাস করেছিল, বিশ্বাস করে সব বলেছিল। আর আমি বিশ্বাস করে ছিলাম তোমায়। তাহলে আমি কী ধরে নিবো আতসের মৃত্যুর পেছনে তুমি দায়ী? কেবল মাত্র তুমি?”
“হ্যাঁ আমি। কারণ আর কেউ জানতো না আতসের চলে যাওয়ার কথা। আমাকে জানিয়েছিল বলেই ওকে সাবধান করেছিলাম যেন চা বাগান ছেড়ে না যায়। কিন্তু ও তোমার আমার ব্যাপারে আঁচ করে ফেলে। এক কথায়, দুই কথায় আমাদের মাঝে ঝামেলার সৃষ্টি। তারপর রাগ সংবরন করতে না পেরে সব শেষ করে দিলাম।”
পত্র থম মেরে গেলো। ঘৃণায় রি রি করে উঠলো তার শরীর। কলারে রাখা হাতটাও ঢিলে হয়ে গেলো। এক দলা থুথু নিক্ষেপ করলো সে উঠোনে, তাচ্ছিল্য করে বললো,
“দেখো প্রকৃতির কী নিয়ম! আতস আমায় বিশ্বাস করে ঠকেছে, আর আমি তোমায়। ঠকালে আমাকে তাই না? ঠকিয়ে ভাবছো জিতে গেছো?”
শেষের কথাটা বলতে বলতে পত্র উত্তেজিত হয়ে উঠলো, আশপাশ ফিরে কি যেন খুঁজলো। অন্ধকারেই ছুটে গিয়ে কোথা থেকে যেন একটা কুড়াল নিয়ে এলো। কিন্তু সে তা দিয়ে প্রহার করার আগেই নভ হো হো করে হেসে উঠলো। ব্যাগটা কাঁধে শক্ত করে চাপিয়ে বললো,
“আমাকে মারবে? কার জন্য? তোমার আদৌও অস্তিত্ব আছে এখানে? গিয়ে দেখো, এতক্ষণে বোধহয় তোমার ঘর পুড়ে ছাঁই। তোমার বাবা বোন হয়তো জ্যান্ত জ্ব লে গেলো। মাও তো নেই। কী করতে থাকবে গ্রামে? তুমি বরং আমার সাথে চলো।”
নভর কথায় পত্রের হাত থেকে কুড়ালটা গড়িয়ে পড়লো। এতক্ষণে সে দূর হতে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পাচ্ছে। তা শুনেই তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো। পুষ্প আর বাবা যে বাড়িতে। অনাকাঙ্ক্ষিত ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে সে লুটিয়ে পড়লো মাটির বুকে।
অন্যদিকে পত্রদের বাড়ির সামনে তুখোর ভিড়। পুরো বাড়িটা দাউদাউ করে জ্বলছে। বাড়ির ভিতরে তো পুষ্প অভ্রদার দেওয়া শাড়িটা যত্ন করে পড়ে বাবার সাথে বিছানায় বসে ছিলো মা আসবে বলে। মেয়েটার আর মাকে দেখা হলো না! চা-বাগানের গল্প কী তবে প্রকৃতি লুকিয়ে ফেললো তার গর্ভে!
(সমাপ্ত)
[দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ এখানেই শেষ। এবার তৃতীয় তথা অন্তিম পরিচ্ছেদ শুরু হবে। বাকি যতটুকু রহস্য বা প্রথম পর্ব শুরু যেখানে হয়েছিল আমরা তৃতীয় পরিচ্ছেদে সেখানে যাবো এবং বাকি রহস্য সমাধান করবো। গঠনমূলক মন্তব্য করবে সবাই। বেশি মন্তব্য হলে কালই শুরু করবো]