#বৃষ্টিস্নাত_তুমি – (১৮)
হুযাইফা মাইশা
ইয়াদ আজও ঊর্মিকে দেখে থমকে গেল। ঊর্মি সেদিনের মতো হেসে হেসে আসছেনা। বরং আজকে তার মুখটা থমথমে। ক্লাসে অমনোযোগী থাকায় বেশ কথা শুনিয়েছেন স্যার। সেই রেশ ধরেই মূলত থমথমে সে। বান্ধবীদের পেছনে ফেলে একাই বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এসেছে তাই। ইয়াদ ঢোক গিলে এদিক সেদিক তাকায়। ততক্ষণে তাকে ঊর্মিও খেয়াল করেছে। মাঝেমধ্যে একসঙ্গেই ক্লাস ছুটি হয় দুজনের। যদিও দুজনের কেউই সেটা খেয়াল করেনা। আজ হঠাৎ ইয়াদকে দেখে হাঁটার গতি কমালো ঊর্মি। ইয়াদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আদিব। ঊর্মির দিকে তাকানো ইয়াদকে মৃদু ধা’ক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ পছন্দ হয়েছে নাকি?’
থতমত খেয়ে ইয়াদ বলল,
‘ ধুর।’
‘ পছন্দ হলে এক কাজ করতে পারিস।’
‘ কি?’
‘ পছন্দ হয়েছে তবে।’
অসন্তোষ দৃষ্টি নিয়ে তাকাল ইয়াদ। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল আদিব। বলল,
‘ কফির অফার দে। টুকটাক কথা সেড়ে ভালো লাগলে আগাবি, নইলে না। আগে জানাশুনা ভালো। তাছাড়া মেয়েরও তো ইন্টারেস্ট থাকতে হবে নাকি।’
‘ ডিরেক্ট কফি?’
‘ তুই না বললি সেদিন রাস্তায় কথা হয়েছে।’
‘ ওইতো হালকা।’
‘ সিনিয়র হিসেবে ট্রিট কর।’
ব্যাপারটা নিয়ে বেশ ভাবলো ইয়াদ। খানিক্ষণ পর হেসে সম্মতি দিল। একটু কথায় কেমন ভালো লাগলো মেয়েটাকে। গত কয়দিন যাবত মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেয়েছে বিষয় গুলো।
সামনে এগিয়ে গেল ইয়াদ। ঊর্মি মেডিকেল থেকে বেরিয়ে গেছে ততক্ষণে। রিকশার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। ইয়াদ হুট করে পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ আপনার নাম কি যেন?’
হকচকিয়ে দু’কদম পিছিয়ে যায় ঊর্মি। হাস্যোজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে থাকা যুবককে দেখে সে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
‘ জ্বি?’
‘ আপনার নাম জানা হয়নি।’
‘ জেনে কি করবেন?’ প্রশ্নটা নিজের ভেতরই চেপেই গেল ঊর্মি। পিটপিট করে তাকিয়ে বলল,
‘ ফারহা হাসান ঊর্মি।’
‘ কফি খান?’
‘ হ্যাঁ, কেন?’
‘ আমার সাথে খাবেন?’
সরাসরি কথা বলার অভ্যাস ইয়াদের। চোখ মুখ অত্যন্ত স্বাভাবিক। ঊর্মি থতমত খেল আবার,
‘ জ্বি?’
‘ কফি খাওয়ার জন্য বললাম, খাবেন?’
‘ এই ভরদুপুরে?’
‘ সমস্যা কি!’
‘ কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনিনা।’
‘ সিনিয়রদের কথা ফেলতে নেই, চলুন।’
_
কথার মধ্যিখানে কল আসলে যারপরনাই বিরক্ত হয় ইয়াভকিন। ফোন বের করে কাজলের নাম্বার দেখে অবাক হয়। ভরদুপুরে উনি কল করেন না সচরাচর। করলে সন্ধ্যা বা রাতের দিকে। কেননা, দিনের বেলা ওরা অফিসে, ভার্সিটিতে থাকে সেটা উনি জানেন। কল ধরতেই ফ্যাচফ্যাচে কান্নার শব্দ কানে আসলো সর্বপ্রথম। ইয়াভকিন গাড়ি থামালো রাস্তার ধারে। পূর্ণতার প্রশ্নবোধক চাহনি। সেদিকে একপলক তাকায় সে। ওপাশ থেকে কাজলের ক্রদনরত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে,
‘ তোর বাবা আবার অসুস্থ হয়েছে। সদর থেকে আসার সময় শরীর খারাপ করায় বড় ভাইজান নিয়ে গেছেন হাসপাতালে। মাথা ঘুরছিল নাকি, পড়ে টড়েও গিয়েছে। এই বয়সে এসব ধক-ল নিচ্ছে, তুই বাড়ি আয়, একটা বিহিত করে দিয়ে যা। এ বাড়িতে কেউ আমার কথা কানে তুলেনা এখন। উনি যা বলে সবাই মেনে নেয়, কোনটা ভালো কোনটা খারাপ, বুঝবেনা নাকি?’
‘ কান্না থামাও মা। আমি আসবো, এসে দেখব সব।’
ফোন রাখতেই ঝুঁকে এল পূর্ণতা,
‘ কি হয়েছে?’
‘ বাবা অসুস্থ। একবার গ্রামে যেতে হবে।’
‘ আমিও যাব।’
‘ তোমার ভার্সিটি।’
‘ আমি সামলাতে পারবো।’
ফ্ল্যাটে ফিরে দুজনে তড়িঘড়ি করে খেয়ে বের হলো। বিকেল হয়ে গেছে তখন। ইয়াভকিন চিন্তিত ভীষণ। বাবার কিছু হলে মা কেঁদেকুটে একাকার করে ফেলেন। ভদ্রমহিলা ভীষণ নরম। একটু কিছু হলেই তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে ফেলেন। এতবছর হয়ে গেল, তবুও পাল্টাননি উনি। পূর্ণতা না চাইতেও ঘুমিয়ে পড়ল। গাড়িতে উঠলেই তার ঘুম পায়। তাছাড়া সকালে জলদি উঠেছে। সেজন্য বেশিই মাথা ধরেছে। ঘুমিয়ে হেলে পড়তেই তাকে আগের বারের মতো আগলে নিল ইয়াভকিন।
গ্রামে যখন এসেছে তখন সন্ধ্যা। পূর্ণতার চোখ মুখ ফুলে গেছে। কোনোমতে পানি ছিটিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল। বাড়ির দুয়ারে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে ইয়াসিন সাহেব। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাজল এগিয়ে এলেন। ইয়াসিন সাহেব পেছন থেকে ডেকে বললেন,
‘ তোমার কান্ডজ্ঞান নেই নাকি! ওদের অফিস-ভার্সিটি। সামান্য অসুস্থ হয়েছি তাই বলে এভাবে ওদের আনবে?’
মুখ ঝা’মটা মে’রে কাজল জবাব দিলেন,
‘ কথা বলবেনা। আমার ছেলেকে আমি ডাকবো। একটা বিহিত করে দিয়ে যাক এবার। বাড়িতে তো আমার কথার মূল্য নেই।’
ওদের কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলল পূর্ণতা। ইয়াভকিন চেয়ে চেয়ে দেখল। পা বাড়িয়ে বাড়িতে ঢুকল দুজনে। ইশরাত নেমে এল। বাড়ির ছোট মেয়ে সে। খানিকটা গিয়ে এসে পূর্ণতাকে নিয়ে আবার উপরে গেল। সর্বপ্রথম ঢুকলো নিজের রুমে। ওর রুমটা ছিমছাম, গোছানো রুম। বিছানায় পূর্ণতাকে বসিয়ে সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প শুরু করলো। রুমে এলেন ওর মা, সায়মা। ভদ্রমহিলার হাতে নাশতার ট্রে। পূর্ণতা উঠে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করে বলল,
‘ ছোট মা, আপনি কষ্ট করতে গেলেন কেন? আমাকে ডাকতেন।’
‘ কষ্ট কিসের, বসো। জার্নি করে এসেছ, খেয়ে রেস্ট নাও।’
নাশতার ট্রেটা রেখে তিনি বেরিয়ে গেলেন। ইয়াজিদ আর ইশরাত বাড়িতেই থাকে। শহরের স্কুল-কলেজে যেতে অসুবিধা হয়না দুজনের। গাড়িগুলোর একটা তাদের জন্য বরাধ্য। টেবিলের উপরে পা দুলিয়ে বসলো ইশরাত। চোখের চশমা একটু ঠে’লে বলল,
‘ ভাবি, এবার কি থাকবেন কিছুদিন?’
‘ মনেহয় না। তোমার ভাইয়ার না অফিস!’
‘ কালকে থাকবেন তো?’
‘ কি জানি, সব তোমার ভাইয়ার উপর।’
‘ কালকে ফুপিমণি আসবেন।’
‘ উনাকে তো দেখিনি।’
‘ আপন ফুপিমণি না, আব্বুর চাচাতো বোন। কিন্তু আপন বোনের মতোই। খুব ভালোবাসেন আব্বুদের।’
কথা বলতে বলতে ইশরাতের নজর গেল দরজার দিকে। ফোন কানে ইয়াভকিন দাঁড়িয়ে। এদিকেই তাকানো। ভ্রু নাঁচিয়ে ইশারা করল। ইশরাত দুষ্ট হেসে পূর্ণতাকে বলল,
‘ ভাবি? ভাইয়া ডাকছে, যান।’
অপ্রস্তুত হয়ে পূর্ণতা পা বাড়াল বাইরের দিকে। ইয়াভকিনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ কিই?’
‘ রুমে আসো। এখানে আসলে দেখি তোমাকে পাওয়াই যায়না।’
‘ পরে আসি?’
‘ না এখনি।’
‘ এখন আমি নিচে যাব। মায়ের সাথে কথা আছে।’
বিরক্ত নয়নে তাকিয়ে ইয়াভকিন বিদায় নিল। মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে হাতে ট্রে নিয়ে নিচে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো পূর্ণতা।
রান্নাঘরে তিন গিন্নি দাঁড়িয়ে। সাথে কাজের মেয়েটা। রান্নাবান্নায় ব্যস্ত সকলে। পূর্ণতা গিয়ে ট্রেটা একপাশে রাখল। কাজলকে এই সেই বলে নিজে রান্না করতে গেল। বিয়ে হয়েছে এতদিন, একদিনও রান্না করে কাউকে খাওয়ালো না!
রান্নাঘরটা বিশাল বড়। বাড়িটাও তেমন। এ ছাড়াও তিন ভাইয়ের বেশ জায়গা আছে গ্রামে। নামডাকও কম নেই, চেয়ারম্যান যেহেতু।
রাতের রান্না শেষ করতে করতে সাড়ে নয়টা বাজলো। ঠেলে-ঠুলে পূর্ণতাকে রুমে পাঠালেন কাজল। মেয়েটা ঘেমে গেছে পুরো। রুমে এসে সর্বপ্রথম ফ্যানের নিচে বসলো পূর্ণতা। মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ইয়াভকিনের দিকে নজর নিল। ভ্রু কুঁচকে সে ফোনে কথা বলছে। একবার তাকে দেখে নিয়ে নজর ফিরিয়েছে। মুখ ভঙ্গিতে চিন্তিত ভাব স্পষ্ট। কিঞ্চিৎ রাগের আভাসও প্রকাশ পাচ্ছে। কথা বলা শেষ সে যখন সামনে আসলো পূর্ণতা কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
‘ আপনার জন্য বাতাস পাচ্ছিনা, ইশ!’
মিথ্যে কথা। ইয়াভকিনকে রাগানোর প্রচেষ্টা। সফলও হলো বটে। ইয়াভকিন তাকে মৃদু ধা’ক্কা দিল। বিছানায় ফেলে দিয়ে দু’হাতে ভর দিয়ে ঝুঁকে এল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘ কি বলছিলে?’
‘ দরজা খোলা। কেউ আসবে।’
‘ আমার রুমে কেউ নক না করে আসেনা।’
‘ কিন্তু দরজা পুরোপুরি খোলা। নক করা লাগবেনা।’
তড়াক করে দরজার দিকে তাকাল ইয়াভকিন। পূর্ণতা সুযোগ কাজে লাগিয়ে চট করে তাকে ধা’ক্কা দিয়ে উঠে এল। ঠোঁট প্রসারিত করল। ইয়াভকিন শোয়া থেকে উঠে বসল। তীক্ষ্ণ নজর আরও তীক্ষ্ণ হলো,
‘ বেশি চালাকি না?’
উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো পূর্ণতা। যেতে যেতে বলল,
‘ খেতে আসুন।’
_
ভোরের দিকে ইয়াসিন সাহেবের প্রেশার লো হয়ে গেছে। নামাজ পড়ার জন্য উঠতেই মাথা ঘুরিয়ে উঠেছে উনার। হাত লেগে স্টিলের গ্লাসটা পড়েছে নিচে। কাজলের পাতলা ঘুম ভেঙে গেছে ততক্ষণে। উনাকে কোনোমতে ধরে রেখে বিছানায় শুয়ালেন। পরপরই সবাই উঠে আসলো উনার চিৎকারে। ইয়াভকিন ছুটে এসেছে। এরপর পিছু পিছু এসেছে পূর্ণতা। ঘোলাটে দেখছে সব। তবুও হেলেদুলে যখন এসে দেখল ইয়াসিন সাহেব বিছানায় স্বজ্ঞানে নেই তখনই কেমন সব ঘুম উবে গেল। থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কাজলের পাশে গিয়ে হাত ধরে নিচু কণ্ঠে বলল,
‘ কাঁদবেন না মা, বাবা জলদি ঠিক হয়ে যাবেন।’
কাজলের বিলাপ শেষ হয়না। পূর্ণতা ইয়াভকিনের পাশে এসে আগের ন্যায় নিচু কণ্ঠে বলে,
‘ ডাক্তার ডাকুননা?’
‘ এখন ডাক্তার পাবনা। জ্ঞান ফিরিয়ে ওষুধ খাওয়ানো আপাতত।’
ইব্রাহীম সাহেব আর ইমতিয়াজ সাহেবও তাই ঠিক মনে করলেন।
বিছানায় হেলান দিয়ে বসা ইয়াভকিন। চিন্তিত মুখশ্রী। ইয়াসিন সাহেবকে নিয়ে চিন্তা ক্রমশ বাড়ছে। পূর্ণতা চোখ মুখে পানি ছিটিয়ে এসেছে সবে। ঘুমের কারণে তাকাতে পারছিলনা। ইয়াভকিনের পায়ের কাছটায় বসতেই পা গুটিয়ে নিল ইয়াভকিন। জানালা দিয়ে প্রবেশ করা আলোর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ পর্দা টানিয়ে আসো তো।’
পর্দা মেলে দিয়ে ফিরে এল পূর্ণতা। হেলান দিয়ে বসল নিজেও। ইয়াভকিন হাত বাড়িয়ে দিল, একহাতে টেনে আনলো নিজের কাছে পূর্ণতাকে। পূর্ণতার মাথায় থুতনি ঠেকিয়ে নিশ্চুপে চিন্তায় মগ্ন হল। পূর্ণতা খানিকটা সময় পর মুখ তুলে চাইল,
‘ চিন্তা করবেন না। বাবা ঠিক হয়ে যাবেন। আর আমি আছিনা আপনার সাথে? দুজনে মিলে সামলে নিব।’
ইয়াভকিন আলগোছে মেয়েটার চুলে ঠোঁট স্পর্শ করল। অত্যন্ত শান্ত, নিচু কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল,
‘ আমার পূর্ণতা।’
চলবে।