বোনু পর্ব-২৪

0
3549

#বোনু
#Part_24
#Writer_NOVA

ডাইনিং টেবিলে ছয় ভাই-বোন একসাথে ডিনার করতে বসেছে।অনেক দিন পর একসাথে খাওয়া হবে।উষা গাল ফুলিয়ে বসে আছে।ইশাত,ঈশান অরূপের দিকে তাকিয়ে রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। চোখের ইঙ্গিতে বুঝাচ্ছে খাবার শেষ হোক তারপর তোর ব্যন্ড বাজাবো।অর্ণব,আদিল ওর ছোট ভাইদের কাহিনী দেখে মিটমিট করে হাসছে।উষা এখন কিছুতেই খাবে না।সে অরূপের সাথে রাগ করেছে।বাচ্চাদের মতো নাক ফুলিয়ে কয়েকবার অরূপের দিকে তাকালো।অরূপ বোনের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে উষার সামনে এলো।

অরূপঃ বোনু হা করতো। আমি তোকে খাইয়ে দিচ্ছি।
উষাঃ একদম আমার সাথে ভাব করতে আসবে না।তোমার সাথে আমি রাগ করেছি।কোন কথা নেই তোমার সাথে। তুমি ভীষণ পঁচা। আমি তোমার সাথে কিছুতেই কথা বলবো না। (মুখ ঘুরিয়ে)
অরূপঃ সরি। আমার কোন দোষ নেই। ভাইয়াদের কথায় আমি এই কাজ করেছি।
উষাঃ তাহলে যাও ভাইয়ুদের খাইয়ে দেও।আমার মন গলাতে এসো না।
অরূপঃ ভূল হয়ে গেছে মাফ করে দে।কানে ধরছি আর কখনও তোদের না বলে কিছু করবো না।
উষাঃ তুমি মারা গেছো বলে আমি কতটা ভেঙে পরেছিলাম জানো।দেখ আমার চোখ মুখের কি অবস্থা?চোখ, মুখ ফুলে গেছে। কান্না করতে করতে চোখের নিচ কালো হয়ে গেছে। কত চোখের পানি ফেলেছি আমি?দেও আমার চোখের পানি ফেরত দেও।যদি দিতে পারো তাহলে তোমাকে মাফ করে দিবো।
অরূপ দৌড়ে কিচেন থেকে এক বালতি পানি নিয়ে এলো।বালতিটা উষার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো।
অরূপঃ নে বোনু তোর চোখের পানি। আমি বালতি ভরে ফেরত দিয়ে দিচ্ছি। এবার আমার ওপর রাগ করে থাকিস না।
উষাঃ লাঠির বারি মেরে অজ্ঞান করে ফেলবো।ফাজিল হয়ে গেছো তুমি।আমি আর কিছু বলবো না তোমায়।সেজু ভাইয়ু,ছোট ভাইয়ু মাফ করলে আমিও মাফ করে দিবো।
অরূপঃ সেজু ভাই,ছোট ভাইয়ের সাথে তোর কিসের জোড়া?
উষাঃ আছে আছে।তুমি আগে তাদেরকে মানাও তারপর আমার কাছে এসো।

অরূপ, ইশাত ও ঈশানের দিকে তাকিয়ে বড়সড় একটা ঢোক গিললো।কারণ তারা দুজনেই ওর দিকে খাইয়া ফালামু লুক নিয়ে তাকিয়ে আছে। চাহনি দেখে মনে হচ্ছে এখনি অরূপের তেরটা বাজাবে দুই ভাই।
অরূপ ওদের সামনে এসে শুকনো ঢোক গিলে একবার অর্ণব ও আদিলের দিকে তাকালো।তারপর যেই ওদের দিকে তাকিয়েছে ঈশান ওকে দেখিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে পাউরুটিতে কামড় দিলো।ইশাত হাতে থাকা কাটা চামচটাকে নিয়ে জোরে প্লেটে বারি মারলো।দুজনি খুব রেগে আছে। অরূপ আরো ভয় পেয়ে গেলো।ভয়ে ভয়ে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো।

অরূপঃ আমার ছোট দুই ভাই যেরকম রেগে আছে। এবার আমাকে তুলে রাস্তায় নাকি ফেলে দিয়ে আসে, কে জানে?ওদের চাহনিতে মনে হচ্ছে আমাকে ভস্ম করে ফেলবে।আল্লাহ তোমার এই ভোলা-ভালো,ভদ্র, ইনসেন্ট বাচ্চা,মাসুম বান্দাটাকে তার দুই ভাইয়ের হাত থেকে রক্ষা করো।আল্লাহ ওদের রাগটা কমিয়ে দেও।আমি আর ওদের থেকে কিছু লুকাবো না।এবারের মতো আমাকে বাঁচিয়ে দেও। (মনে মনে)
ঈশানঃ ইশাত ওকে বলে দে আমরা কারো সাথে কথা বলবো না।আমাদের সাথে কথা না বলতে।
অরূপকে বুঝিয়ে ইশাতকে কথাটা বললো ঈশান।
ইশাতঃ শান,তুই বলে দিস আমরা কারো সাথে কথা বলতে চাইছি না। সে যেনো আমাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা না করে।আমাদের এত বড় ব্যাপারটা জানানোর প্রয়োজন মনে করে নি।আমরা কি তার কিছু হয় নাকি যে আমাদের কাছে মাফ চাইতে হবে।আমার মন মানসিকতা ভালো নেই। তাই কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নই।
অরূপঃ আমার ভাইরা তো ভালো করেই আমার সাথে রাগ করেছি।অরূপরে তোর এবার ভাই-বোনের রাগ ভাঙ্গাতে দম বেরিয়ে যাবে।তাও আমার ভাগ্য ভালো রাগ করছে।অন্য কিছু হলে তো আমাকে এখন ছোট ভাই মাথায় তুলে আছাড় মারতো,তখন আমার কি হতো?এসব কথা বাদ।এখন এদের রাগ ভাঙ্গবো কি করে? আল্লাহ সাহায্য করো।(মনে মনে)
উষাঃ আমিও ভাইয়ুদের সাথে একমত।
অর্ণবঃ তোরা কি শুরু করলি বলতো?এখানে অরূপের কোন দোষ নেই। আমরাই ওকে এমন করতে বলেছি।মৃত্যুর নাটকটা আমরাই সাজিয়েছি।যাতে করে অরূপ সবার চোখের আড়ালে সব কাজ ঠিক মতো করতে পারে।আমরাও শত্রুদের সকল কাজ কর্ম ধরতে পারি।
আদিলঃ অরূপকে এখানে আমরা লুকিয়ে রেখেছি যাতে আমাদের শত্রুর সব খবর অরূপ কোন ঝামেলা ছারা আমাদের দিতে পারে।
ঈশানঃ তাই বলে মৃত্যুর অভিনয় করতে হবে।
অর্ণবঃ আপাতত তখন আমাদের হাতে এছাড়া কোন প্ল্যান ছিলো না। আমরা খুঁজেও পাই নি।

🍁🍁🍁

সবাই মনোযোগ সহকারে অর্ণব,আদিলের কথা শুনছিলো।কথার মাঝখানে ইশাত জিজ্ঞেস করলো।

ইশাতঃ ওর বুকে যে গুলি লেগেছে সেটার কি হলো?

অরূপঃ তোমার কি মনে হয় এতোদিন ওদের সাথে কাজ করেছি কোন লাইফ প্রোটেকশন ছাড়া।সৃজানদের সাথে নিজের জীবন হাতে নিয়ে কাজ করেছি।তাছাড়া ২৪ ঘন্টা সাথে বুলেট জ্যাকেট পরা ছিলো।তারপরও সবসময় ভয়ে থাকতাম।মনে হতো এই বুঝি আমাকে ধরে ফেলবে।যেদিন গুলি লাগলো সেদিনও আমি বুলেট জ্যাকেট পরা ছিলাম।বুলেট জ্যাকেটে থাকায় আমার শরীরে কোন গুলি লাগে নি।

উষাঃ তাহলে রক্ত কোথা থেকে এলো?

অরূপঃ বোনু রক্ত ছিলো না।ওগুলো লাল রং।বড় ভাইয়াদের কথায় তখন আমি অভিনয় করেছি।যাতে সবাই জানে আমি মারা গেছি।ডক্টরকেও আমরাই বলতে বলেছি যে আমি মৃত।হসপিটাল থেকে সরাসরি এখানে চলে এসেছি।সারাক্ষণ ল্যাপটপে বসে কাজ করি।শত্রুদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখি।আমি বেঁচে আছি জানলে ওরা আমার জীবনের পেছনে নিতো। কারণ ওদের সাথে থেকে আমি অনেক ইনফরমেশন পেয়ে গেছি।তাই আমাকে ভালো রাখতে এই বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করেছে মেজু ভাইয়া।

উষাঃ আমাদের সত্যি জানালে কি হতো?তুমি যতই অজুহাত দেও আমরা শুনবো না।আমরা তোমার সাথে কথা বলবো না।
ইশাতঃ আমিও।
ঈশানঃ আমিও কারো সাথে কথা বলছি না।
তিন ভাই-বোন মুখ ঘুরিয়ে রাখলো।অরূপ পরে গেলো বিপদে।হঠাৎ ওর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল।বুকে হাত দিয়ে আহত সুরে কুঁকড়ে উঠলো।ধপ করে মেঝেতে বসে পরলো।
অরূপঃ আহ্ অনেক ব্যাথা করছে।বুকের মধ্যে অনেক খানি চোট লেগেছে। এখনো শুকায়নি।
উষাঃ কি হয়েছে ভাইয়ু?
ইশাতঃ অরূপ তুই ঠিক আছিস তো ভাই?
ঈশানঃ কি হলো তোর?অনেক ব্যাথা করছে?

তিন ভাই বোন ব্যস্ত হয়ে পরলো।দৌড়ে অরূপের কাছে ছুটে এলো।অরূপ বুকে হাত দিয়ে রেখেছে। ভাইদের ও বোনের এমন ব্যস্ত হওয়া দেখে ফিক করে হেসে উঠলো।
উষাঃ তুমি আবার নাটক করলে তাই না?
ইশাতঃ আবার?
ঈশানঃ তোর কপালে মার আছে।তুই ভালো অভিনয় শিখে গেছিস।
অরূপঃ কি করবো তোমরা কেউ আমার সাথে কথা বলছো না।আমার কোন দোষ নেই। তারপরও তোমরা গাল ফুলিয়ে বসে আছো।ভাইয়ারাতো তোমাদের বলতে মানা করেছে।আমি তাদের কথা অমান্য করি কিভাবে?
ঈশানঃ বড় ভাইয়া, মেজু ভাইয়া তোমরা বলতে মানা করছো কেন?
অর্ণবঃ দেয়ালেরও কান আছে।তোরা জানলে আমাদের শত্রুও জেনে যেতে পারে।সেজন্য তোদের বলিনি।এই ঘটনাটা আমরা পাঁচজন জানি।আমি,আদি,জিবরান,মাসফি ও অরূপ।আমার বিশ্বাস আমরা খুব শীঘ্রই আমাদের শত্রুকে ধরতে পারবো।
ইশাতঃ অরূপ এখন এরকম করার মানে কি?
অরূপঃ কি করবো তোমারা আমার সাথে কথা বলছো না। আমারও ভালো লাগছে না।তাই এরকম করলাম।
উষাঃ দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।

উষা হাতে ভাতের চামচ,ইশাত হাতে একটা কাচের প্লেট, ঈশান ফল কাটার ছুরি হাতে নিয়ে অরূপের সামলো দাঁড়ালো। আজকে ওর খবর আছে। অরূপ ওদের হাতে এসব দেখে ভয়ে একটা শুকনো হাসি দিলো।তবে হাসিতে কাজ হলো না।তিনজন ওর দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।অরূপ বসার থেকে উঠে কোনরকম দৌড় দিলো।ওর পিছনে উষা,ইশাত,ঈশান ছুটলো।আজকে অরূপকে পেলে হাতের সবকিছু ওর উপর প্রয়োগ করবে।

🍁🍁🍁

পরের দিন…..

অন্ধকার রুমে একটা চেয়ারে বসে আছে অজানা ব্যাক্তিটা।তার সামনে আবছা আলোতে দেখা যাচ্ছে তার সামনে মির্জাদের পরিবারের সবার ছবি।সাথে আছে মাসফি,জিবরান।অরূপ,অদিতি,সৃজান, সিয়ানের ছবিতে ক্রস চিহ্ন দেওয়া।মানে হলো ওদেরকে তার রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছে।এখন নেক্সট টার্গেট জিবরান,মাসফি,আদিলের মধ্যে কে হবে সেটা ভাবছে।সৃজান,সিয়ানকে মাসফি মেরে ফেলেছে। তাতে অজানা ব্যক্তিটা খুশি হয়েছে। তার মাফিয়া হওয়ার শেয়ারের অংশ সৃজান বা সিয়ান কাউকে দিতে হবে না। শেয়ার বাদ হয়ে গেলো। এখন সে একা একাই কাজ করবে আর মাফিয়া ওয়াল্ডের বাদশাহ হয়ে যাবে।এভাবেই সে কাজ হয়ে গেলে সৃজান,সিয়ানকে মেরে ফেলার চিন্তা করছিলো।মাসফি সে কাজটা সহজ করে দিয়েছে।তাতে সে বেশ খুশি।অজানা ব্যক্তিটা নিজের স্বার্থের জন্য সব করতে পারে।নিজের স্বপ্নের বাদশাহ হওয়ার ভাগ সে কাউকে দিবে না।দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো তার সহকারী নাহিদ।

নাহিদঃ ভাই পরের প্ল্যান কি কিছু ভেবেছেন?আগেরটা তো অরূপের কারণে ফ্লপ হয়ে গেলো।

—তবে এক হিসেবে ভালো হয়েছে।মির্জাদের অনেক বড় শক্তি অরূপ তো শেষ হয়েছে।আমি তাতে খুব খুশি হয়েছি।অন্য দিকে মাসফি সৃজান ও সিয়ানকে শেষ করে দিয়েছে। এখন শুধু মির্জারা, মাসফি, জিবরানকে শেষ করলে আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো।

নাহিদঃ অরূপ তো আমাদের অনেক খবর পেয়ে গিয়েছিল। মির্জাদের অনেক বিশস্ত ও শক্তিশালী একজন ছিলো।তবে ভাই মির্জারাও কম শক্তিশালী নয়।ওদের মাথায় বুদ্ধি দিয়ে ভরা।কিছু একটা করে এবারও যদি আমাদের প্ল্যান ডিসমিস করে দেয়।তখন কি করবেন?এবার অনেক সাবধানে কাজ করতে হবে।কিছুতেই হারলে চলবে না।

—-তুমি ঠিক বলেছো নাহিদ। এবার অনেক সতর্কতার সাথে কাজ করতে হবে। ওদের শেষ না করা পর্যন্ত আমি শান্তি পাবো না। অরূপ বেশি বেড়ে গিয়েছিল তাই ওকে নিশ্চিন্তে সারা জীবনের জন্য ঘুম পারিয়ে রেখেছি কবরে।এবার বাকিগুলোকে কবরে পাঠাতে হবে।তাহলেই আমি হবো মাফিয়া ওয়াল্ডের বাদশাহ। আমার যে কি খুশি লাগছে?আমি খুব শীঘ্রই বাদশাহ হতে পারবো।সবাই আমার নামে ভয়ে কাঁপবে। সব জায়গায় থাকবে আমার ত্রাসের রাজত্ব। সব মাফিয়া, গ্যাংস্টার,ডন আমার কথা মতো চলবে।

নাহিদঃ ভাই আগেই এতো খুশি হয়েন না।নয়তো দেখা যাবে সবকিছু উল্টো হয়ে যাবে।আপনি মির্জাদের হাতে গুলি খেয়ে কবরে পরে থাকবেন।

—কি বললে তুমি?

রেগে নাহিদের শার্টের কলার ধরে বললো।

নাহিদঃ ভাই রাগ করেন না।আমি যাস্ট বলতে চাইছিলাম বেশি আশা করলে কখনও তা পূরণ হয় না।তাই বেশি আশা করেন না।আপনি আপনার প্ল্যান মোতাবেক এগিয়ে যান অবশ্যই সফল হবেন।
(ভয়ে ভয়ে)

—আমাকে অবশ্যই সফল হতে হবে। আমি জিতবই জিতবো।আমাকে যে জিততেই হবে।আমার এতো দিনের স্বপ্ন আমি মাটি করবো না।

নাহিদের কলার ছেড়ে দিয়ে অজানা ব্যক্তিটা কিছু একটা ভাবতে লাগলো।

নাহিদঃ মনে হচ্ছে ভাই এবার ওপরে টপকাবে।তাই এতো বেড়ে গেছে। মির্জাদের হাতে এবার তার মৃত্যু নিশ্চিত। নিজেতো মরবেই সাথে আমাকেও মারবে।আমিও সুযোগের স্বদ ব্যবহার করতে পারি।অবস্থা বেগতিক দেখলে ভাইকে রেখে আমি পালাবো।জান বাঁচানো ফরজ। নিজে বাঁচলে বাপের নাম।আমি আগে বাঁচবো তারপর ভাই তোমার কথা চিন্তা করবো।যদি তুমি জিতে যাও তাহলে নিজের স্বার্থের জন্য তোমার গোলামী করবো।নয়তো তোমাকে ছেরে পালিয়ে নিজের জীবন নিয়ে দূর কোন অজানায় সব ছেরে পাড়ি দিবো। (মনে মনে)

নাহিদের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো।পৃথিবীতে সবাই নিজের কথাই চিন্তা করে।তাহলে নাহিদ কেন করবে না।স্বার্থ নামক বস্তুটা ঘিরে আমরা আমাদের কাজ হাসিল করি।

#চলবে