#মৃণালিনী
#পর্ব ৩৬
অবনী কাকার বাড়ি থেকে কাজ উদ্ধার করেই ফিরলো সৌম্য, তার মুখের খুশি সে বউয়ের কাছে গোপন করতে পারছিলো না আর। ঘরে ঢুকেই সে উত্তেজিত গলায় বললো,
আর কোনো চিন্তা রইলো না বুঝলে, এবার একসঙ্গে আমাদের দুটো সমস্যারই সমাধান হবে।
কিন্তু মৃণাল যথেষ্টই বুদ্ধিমতি, বিগত প্রায় বছর খানেকের অভিজ্ঞতায় সে কিছুটা হলেও গ্রাম্য রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলো। তাই সব কিছু যে অতো সহজে সমাধান হয়ে যাবে এরকম আশা তার ছিলো না। সে আস্তে আস্তে বললো,
কিন্তু সে তো একজন সম্মতি দিলেন! এখনও প্রায় জনা চারেক শরিক তো বাকি থেকে গেলো! তার মধ্যে আমার বিভাস আর বাবা নিয়েই বেশি সন্দেহ আছে! বাবা নিজেও কি আদৌ এতে রাজি হবেন!
কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো সৌম্য, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
চলো তাহলে, বাবার সঙ্গে কথাটা অন্তত সেরে আসি, শুভ কাজে দেরি কিসের!
স্বামীর পিছু পিছু শ্বশুর মশাইয়ের ঘরের দরজায় উপস্থিত হলো মৃণালিনী, ওদের কে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখেই, শ্যাম সুন্দর বিরক্ত মুখে তাকালেন।
আবার কি চাই?
আজ ছেলে এবং বউমা দুজনের ওপরেই তিনি সমান বিরক্ত হয়ে আছেন।
ওই শরিকি জমিটার ব্যাপারে একটু কথা বলতে এসেছিলাম বাবা, আমি অবনী কাকার বাড়ি থেকে ঘুরে এলাম একটু আগে…
অবনী ও জমির ব্যাপারে কি করতে চায় আমি জানিনা, কিন্তু যে যাই বলুক ওখানে ক্লাব হতে আমি দেবো না কিছুতেই,
ছেলে কে থামিয়ে দিয়ে বিরক্ত গলায় বলে উঠলেন শ্যাম সুন্দর।
অবনী কাকাও সেটা চান না, আমি তাঁকে অন্য প্রস্তাব দিয়েছি। ওখানে একটা মেয়েদের স্কুল করার কথা ভাবা যেতে পারে, মৃণাল পড়াবে, আর আমার মনে হয় মহিলা শিক্ষিকা থাকলে কারোরই নিজেদের বাড়ির মেয়েদের পাঠাতে আপত্তি থাকবে না।
বউমা পড়াবে! তার যদি কাউকে পড়ানোর হয়, তো সে বাড়িতে বসে পড়াক না। এই তো অবনীর মেয়েও তো পড়তে আসে তার কাছে, আমি তো কোনোদিনও বারণ করিনি তাকে! তাই বলে তাকে রাস্তায় বসে মেয়ে পড়াতে হবে!
বিরক্ত গলায় বলে উঠলেন শ্যাম সুন্দর, মৃণালিনী হতাশ দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকালো।
প্রশ্ন টা পড়ানোর বাবা, সেটা কোথায় বসে পড়াচ্ছে সেটা মুখ্য নয়! আর শুধু তো পড়ানো নয়, জমিটা উদ্ধার করার একটা ব্যাপারও আছে, একমাত্র এই কারণেই সবাই নিজেদের স্বার্থেই জমি দিতে রাজি হতে পারেন! আর অন্য কোনো কারণে এ গ্রামের সব শরিক একমত হয়েছে কখনো?
থামো তুমি! তুমি কি ভাবো আমি কিছু বুঝিনা! এই করেই তুমি আমার কাছ থেকে অতোটা জমি ছেলেদের স্কুলের জন্যে হাতিয়ে নিয়েছো! একই জিনিষ তুমি আবার করতে চাইছো! জমি দখলে রাখার নামে তুমি এখন বউয়ের জন্যে মেয়েদের স্কুল তৈরি করে নিতে চাইছো!
ছেলেকে ধমকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন শ্যাম সুন্দর। সৌম্য ভ্রু কুঁচকে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন, তারপর শান্ত গলায় বললো,
আমি আপনাকে কখনো মিথ্যে বলতে চাইনি বাবা, সেটা আপনিও জানেন! কিন্তু আপনি নিজেই আমাকে মিথ্যে বলতে বাধ্য করেছেন সব সময়! এই যে দেখুন, আজ আপনাকে সত্যি বলেছি বলেই তো আপনি একটা সাধারণ ব্যাপার কে অসাধারণ করে তুলছেন। মৃণাল শিক্ষিতা, তার শিক্ষা কে আপনিও আপনার প্রয়োজনে ব্যবহার করে এসেছেন এতো দিন, কিন্তু আজ আপনাকে জমি ছাড়তে হবে বলে আপনি ওকে পড়াতে দিতে রাজি হচ্ছেন না! আর স্কুলের জমির কথা বলছেন? তাতে কি আপনারও স্বার্থ ছিলো না? আপনিও তো বিদ্যুতের হিসেব কষেছিলেন মনে মনে! আজ বিদ্যুৎ আসেনি বলেই তো জমির জন্যে আফসোস করছেন! যদি এসে যেতো, তাহলে তো বাকি জমি গুলো দ্বিগুণ দামে বিক্রি করতে পারতেন, এই হিসেব কি আপনার ছিলো না!
এবার একটু হলেও থমকে গেলেন শ্যাম সুন্দর, নিচে থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে কুমুদ ততোক্ষনে ওপরে উঠে এসেছেন। স্বামীর রাগ দেখতে অভ্যস্ত হলেও ছেলে কে রেগে যেতে কখনো দেখেন নি কুমুদ, তাই সৌম্যর গলার আওয়াজ তাঁর মনের মধ্যে যথেষ্টই ভয়ের সঞ্চার করলো। তাঁকে ঘরে ঢুকতে দেখেই প্রায় চিৎকার করে উঠলেন শ্যাম সুন্দর,
দেখো, তোমার ছেলের কলকাতায় থেকে কি উন্নতি হয়েছে! সে আমার জমি নিয়ে দান খয়রাত করতে চায়! নিজের এক কাঠা জমি বাড়ানোর কোনো ক্ষমতা নেই, দান করতে তিনি সিদ্ধ হস্ত! কালই তোমার বউমা বলছিলো না! আমি দায়িত্ব ছাড়তে চাইনি তোমার ছেলের কাছে? এই তো হবে দায়িত্ব ছাড়লে! শুধু আমার চোখ বোজার অপেক্ষা! ঝুলি হাতে তোমাদের রাস্তায় বেরোতে হবে ভিক্ষা করতে!
জমি তো তোমার কম নেই কো! আর এ জমি তে ক কাঠাই বা আচে তোমার? বেশিটাই তো অবনী ঠাকুরপোর! তিনি যদি দিতে চান তালে তোমার দিতে কি হয় শুনি?
ক কাঠা মানে! আমার ভাগ অল্প বলে কি সে জমি তে আমার দাবি নেই?
সে কতা যদি বলো, তবে আজ পর্যন্ত কি দাবি দেকাতে তুমি পারলে বলো তো! সেই কবে তে ওই জমি নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া তো কম হচ্ছে নে! এক কাটাও কি ঘিরতে পেরেছো এতো দিনে? যে ছেলের কাচে কিচু ছাড়তে চাইছো নে, সেই তো তাও কিচু করলো! সারা জেবোন টা শুদু প্যাঁচ কষে কষে কাটিয়ে দিলে, কারুর কতা ভাবলে নে ককনো!
বিরক্ত গলায় বললেন কুমুদ, স্ত্রী এবং ছেলের যৌথ আক্রমণের মুখে প্রতিরোধ করার কোনো উপযুক্ত ভাষা না পেয়ে রাগে ফুঁসতে লাগলেন শ্যাম সুন্দর।
যা করতে চেয়েছিলাম সবটাই আপনার, আমার এমনকি গ্রামের সবারই ভালোর কথা ভেবেই! কিন্তু আপনি তো তাতেও আমার অভিসন্ধিই খুঁজে পেলেন। তাই অহেতুক আপনার সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ নেই! লাভ ক্ষতির হিসেব আপনি আমার থেকে একটু হলেও বেশি বোঝেন সেটা আমি জানি, তাই মৃণালের জন্যে না হলেও নিজের স্বার্থেই যে আপনি ওই জমি ক্লাবের কাছে যাওয়া থেকে বাঁচাতে এই প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত মেনেই নেবেন এটা জানা কথা। আপনার বিচার বুদ্ধি কিছু কম নেই, একবার এখানে ক্লাবের নামে জমি দখল হওয়া যদি শুরু হয় তাহলে ভবিষ্যতে বিভিন্ন অজুহাতে অনেক জমিই যে আপনার দখল হয়ে যাবে সেটা আপনি মুখে না স্বীকার না করলেও মনে মনেই জানেন নিশ্চয়ই। আর বিভাস এর সাথে হাত মিলিয়ে যদি এ জমিতে স্কুল হওয়া আপনি আটকাতে চান তাহলে যে আপনি খাল কেটে কুমির নিয়ে আসবেন সেটাও আপনার অজানা নয়। তাই কাল আলোচনা সভায় আপনি অমত করবেন না এটুকু আমি আশা রাখি।
চুপ কর বাবা, এই রাতে আর হৈ চৈ করিস নে, এ বাড়ির হাঁড়ির খবর জানার জন্যে সব হ্যাঁ করে বসে আচে। বাপের সঙ্গে ছেলের গন্ডগোলের খবর বাইরে গেলে সে কি কিচু ভালো হবে বাবা?
ছেলে কে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন কুমুদ, মৃণালিনী এতক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো, এবার মাথা নাড়লো,
মা ঠিকই বলেছেন, রাত অনেক হয়েছে, এসব এখন থাক! তুমি তোমার বক্তব্য রেখেছো, এবার বাবা কে ভাবতে দাও! উনি যথেষ্টই বিচক্ষণ, জমি নিজেদের হাতে রাখার অন্য কোনো পন্থা জানা থাকলে এতো দিনে তার প্রয়োগ করতেন নিশ্চয়ই। রাতের মধ্যে যদি নতুন কিছু ভেবে বার করতে পারেন তাহলে কাল সকালে সেটা তুমি জেনে নিও। না হলে অবনী কাকা তো তোমাকে কথা দিয়ে দিয়েছেন ইতিমধ্যেই, বাবারও অমত করার কোনো জায়গা থাকবে না আর।
কথাগুলো বলেই মৃণালিনী শ্বশুর মশাইয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, সে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কুমুদ এবং সৌম্য দুজনেই তার পেছন পেছন ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। শ্যাম সুন্দর গম্ভীর মুখে বসে রইলেন, ক্লাবের হাতে যাওয়া জমি বাঁচাতে ইস্কুলের হাতে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায়ের সন্ধান করতে লাগলেন মনে মনে।
দোতলার বারান্দায় বেরিয়েই নিচে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানো পারুল বালা কে দেখতে পেলো মৃণালিনী, তিনি উদ্বিগ্ন মুখে ওপরের দিকে তাকিয়ে আছেন। ওদের কে এক সঙ্গে শ্যাম সুন্দরের ঘর থেকে বেরোতে দেখে তাঁর মুখে বিরক্তির রেখা ফুটলো,
আজ রেতে কি সবাই উপোস দেবে নাকি! এই রাত দুপুরে পাড়া জাগিয়ে কোন্দল না করলেই কি তোমাদের চলচে নে বাছা! বাড়ির ঠাকুর চাকর রা কি সারারাত তোমাদের জন্যে বসে থাকবে? খেয়ে দেয়ে কোন্দল করলে হতো নে? নিচে নেমে খেয়ে তাদের উদ্ধার কর দিকি!
বড়ো জার গলা আরও চড়া হবার আগেই কুমুদ দ্রুত নিচের সিঁড়িতে পা দিলেন, মৃণালও তাঁর সঙ্গী হলো। সৌম্য মুখ গম্ভীর করে বললো,
আমি খাবো না বড় মা, আমার খিদে নেই!
তা থাকবে কেনো বাছা! কম কোন্দল তো করলে নে সেই তে বাপের সঙ্গে! পেট তো তাতেই ভরেচে তোমার! খাবার ঢোকার আর জায়গা কোতা! আমারই হয়েচে যত জ্বালা! তা দয়া করে নিচে নাববে? নাকি আমায় আবার এই বুড়ো হাঁটু নে ওপরে তোলা করাবে!
এরপরে আর কোনো কথা থাকে না, বড়ো মা এই বয়সে হাঁটুর ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে, খাবারের থালা হাতে দোতলায় উঠে আসবেন এটা সৌম্যর কাছে কখনোই কাম্য ছিলো না, তাই বিরস বদনে সে আস্তে আস্তে নিচে নেমে এসে করুণার পেতে রাখা আসনে বসলো। একটু পরেই শ্যাম সুন্দরও নেমে এলেন, পাশাপাশি আসনে খেতে বসলেও পিতা পুত্রের বাক্যালাপ আজ বন্ধ রইলো।
বামুন দিদি খাবার দিতে শুরু করলেন, পারুল বালা এবং কুমুদ তদারকি করতে লাগলেন, মৃণাল দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখ করুণা কে খুঁজছিলো, কিন্তু সে সেই যে আসন পেতে, জলের গেলাস রেখে চলে গিয়েছিলো আর খাবার দালানে এলো না। স্বামী এবং শ্বশুর খাওয়া শেষ করে চলে যাবার পরে মৃণাল বড়ো মা এবং শাশুড়ির সঙ্গে খেতে বসলো। আজ তর্কাতর্কি তে সত্যি সত্যিই রাত অনেকটাই বেশি হয়ে গিয়েছিলো, তাই পারুল বালা সবাই কেই একসঙ্গে বসে যেতে হুকুম দিলেন।
হারু কে দালানের এক পাশে খেতে দিয়ে বামুন দিদি তাঁর, করুণার আর হারুর মার থালা মৃণালিনীর পাশে রাখলেন কিন্তু তাও করুণা এলো না। বার দুয়েক ডাকাডাকির পরেও করুণা না আসায় এবারে পারুল বালা গলা তুললেন, তাঁর গলার জোর এই অসুস্থ শরীরেও যথেষ্টই ছিলো, করুণা থমথমে মুখে হন্তদন্ত হয়ে উপস্থিত হলো। তাকে দেখেই বিরক্ত হলেন পারুল বালা,
এই মাজ রেতে এতো তোমার কি কাজ মা গো! ডাকলে সাড়া পাইনে কেনো? কোতা থাকো!
একেণের সব কইরেই গেছি বড়ো মা, ঘরখান এট্টু গুইচে রাকছিলুম!
তাড়াতাড়ি উত্তর দিলো করুণা, পারুল বালা সন্তুষ্ট হলেন।
তা ভালো! মাজে মাজে এট্টু পোস্কার করলে ঘর দেকতেও ভালো লাগে! নাও বাছা বসে পড় দিকি নি, রাত তো কম হয় নে কো! লণ্ঠনের তেল আর পুড়িয়ে কাজ নেই, তেলের যা দাম!
করুণা বসে পড়লো, সৌম্য এবং শ্যাম সুন্দর দুজনেই ওপরে উঠে যাওয়ায় পরিবেশ অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছিলো। মহিলা মহলে নানা রকম মুখরোচক আলোচনা চলতে লাগলো, হারুর মার ভূমিকাই তাতে সবচেয়ে বেশি ছিলো, এ গ্রামের গোপন খবর তার কাছেই বেশি থাকে সব সময়। একমাত্র মৃণালিনী চিন্তিত হলো, এই রাত দুপুরে লণ্ঠনের আলোয় করুণার ঘর গোছানোর কি দরকার পড়লো মনে মনে ভাবতে ভাবতেই অন্য মনস্ক হয়ে পড়লো সে, এসব আলোচনা আর তাকে স্পর্শ করছিলো না।
ক্রমশ
#মৃণালিনী
#পর্ব ৩৭
রাত কাটলেও আলোক যখন বাড়ি ফিরলো না তখন সবাই তার ফেরার আসা ছেড়েই দিলো।
ও সব জিনিসপত্তর অস্তাকুঁড়ে নে গে ফেলে দে,
হারুর মা কে হুকুম করলেন পারুল বালা, সুরেশের মুখে খবর শোনা থেকেই আলোক তাঁর দু চোখের বিষ হয়েছে।
পরের দিন সকালে সব শরিক কে ডেকে আলোচনায় বসার কথা চণ্ডী মণ্ডপে, সেখানে মেয়েদের যাওয়া নিষেধ, তাই মনে মনেই ছট ফট করতে লাগলো মৃণালিনী। কালকের তর্কাতর্কির পরে শ্বশুর মশাই কোনো দিকে মত দেন সে চিন্তা তাকে সারা রাত চিন্তিত করে রেখেছিলো। সৌম্যও এতটাই রেগে ছিলো যে তার সঙ্গে আলোচনার সাহস টুকুও মৃণাল সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি।
বেলা বাড়ছিলো, আলোচনা শুরু করতে শরিকরা একত্রিত হবার আগেই সুরেশ চিন্তিত মুখে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো। তাকে দেখেই সৌম্য প্রায় দৌড়ে গেলো,
ভাই চণ্ডী মণ্ডপে বিভাস এর নেতৃত্বে বেশ কিছু ছেলে জড়ো হয়েছে, ওরা সম্ভবত মিটিংয়ের সময় কিছু গন্ডগোল বাধাতে পারে।
ওখানে আলোকও আছে নাকি?
সৌম্য কিছু বলার আগেই দোতলার বারান্দা থেকে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন শ্যাম সুন্দর, তিনিও সুরেশের গলার আওয়াজ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। সুরেশ মাথা নাড়লো,
না, কাকাবাবু সে চালাক ছেলে, কোনোমতেই সামনে আসার বোকামি সে করবে না। তাকে অতো সহজে ধরতে আপনি পারবেন না!
মাথা নাড়লেন শ্যাম সুন্দর, কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললেন,
তাহলে সবাই কে বলে দাও, মিটিং আমার বাড়িতেই হবে, চণ্ডী মণ্ডপে নয়।
শ্যাম সুন্দরের ওকালতি বুদ্ধি কে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা এই গ্রামের ছেলে ছোকরা দের ছিলো না। চণ্ডী মণ্ডপে আলোচনা না হওয়ায় তাদের পরিকল্পনা একটু থমকে গেলো। বিভাস কিছুটা প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলো কিন্তু অবনী তাকে ধমকে থামিয়ে দিলেন,
জমিতে ভাগ আছে যাদের, তারাই তো শুধু এখানে থাকবে নাকি! শরিকি জমিতে বাইরের লোকের কাজ কি?
অবনীর এই ঘোষণার পরে শরিকরা ব্যতীত অন্য কেউ শ্যাম সুন্দরের বাড়িতে আলোচনায় থাকার সুযোগ পেলো না। বিভাস কে কিছুটা ম্রিয়মাণ লাগছিলো, তার সপক্ষে কথা বলার মতো এই শরিক দের মধ্যে কেউ ছিলো না। আলোচনা শুরু হলো, নিজেদের বাড়ির উঠোনে আলোচনার সুযোগে মৃণাল থেকে পারুল বালা, বিভার মা থেকে মনোরমা কারোর উপস্থিত থাকায় কোনো আপত্তি থাকলো না।
সৌম্যর দেওয়া প্রস্তাবে সবাই মোটামুটি সম্মত হলেন, মেয়েদের স্কুলের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে পতিত জমির উদ্ধার দুয়ে মিলিয়ে এই প্রস্তাব সবার কাছেই গ্রহণ যোগ্য হলো। সৌম্যর ধারণাই সঠিক ছিলো, নিজের মাত্র কাঠা দুয়েক পতিত জমির বদলে অবনীর যে কাঠা ছয়েক জমি গেলো এটা হিসেব করেই শ্যাম সুন্দর প্রস্তাবের বিপক্ষে কিছু বললেন না। তাঁর নীরবতা কে সম্মতির লক্ষন ধরে নিয়ে আলোচনা এগিয়ে যেতে শুরু করতেই বিভাস আপত্তি জানালো। এই জমিতে তার বাপের ভাগ অনেকটাই, সেই দাবি কে সামনে রেখে সে তার বাবা কে প্রায় ঠুঁটো জগন্নাথ হিসেবে বসিয়ে রেখে তর্ক চালাতে লাগলো।
মেয়েরা পড়াশোনা শিখবে? কি হবে শিখে? তারা কি জজ ব্যারিস্টার হবে? বাড়ির বউরা রান্না করতে জানলেই হলো!
মহিলারা সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, মৃণাল মনে মনেই ক্ষুব্ধ হচ্ছিলো, সে কিছু বলতেই যাচ্ছিলো তার আগেই পারুল বালা এগিয়ে এলেন। তিনি যথেষ্টই বুদ্ধিমতি, মনোরমা কে হাতের নাগালে পেয়ে অপমানের সুযোগ একটুও ছাড়লেন না,
তাই নাকি বাছা! মেয়েরা নেকা পড়া না জানলেও চলে তালে! তবে যে তোমার মা সেদিন অতো কতা কয়ে গেলেন ছাদে বসে! তুমি নাকি তোমার বন্দুদের মতো নেকা পড়া জানা মে বে করবে! সেসবই মিছে কতা তালে? তাই তো ভাবি চাদ্দিকে এতো নেকা পড়া জানা মেয়ে তাকতে, তুমি কেনো আই বুড়ো হয়ে কেলাব কেলাব করে ঘুরে বেড়াও!
বিভাস বিস্মিত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো, তার মা যে কখন অবনী কাকার বৌ কে জব্দ করার জন্যে উৎসাহের আতিশয্যে,তার শিক্ষিতা মেয়ে বিয়ে করার গোপন ইচ্ছের কথা সর্বসমক্ষে প্রচার করে রেখেছিলেন তা তার জানাও ছিলো না।
তোমাকে এসব কথা কে বলতে বলেছে! আমি তোমাকে কবে এসব বলেছিলাম?
স্থান, কাল, পাত্র ভুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলো বিভাস, মনোরমা থতমত খেলেন। কিন্তু তাঁর চুপ করে যাওয়ার উপায় ছিল না, তাহলে যে ভবিষ্যতে দুপুরের মজলিশে সারা জীবন তাঁকে পারুলবালা এবং বিভার মা দুজনেরই খোঁটা খেয়ে যেতে হবে তা তিনি বিলক্ষণ জানেন।
থাম তুই! তুই যা কয়েছিলি তাই আমি কয়েচি! আর এতে নজ্জার কি আচে? বউ নেকা পড়া না জানলে চলে নাকি! তোর কটা বন্দু নেকা পড়া না জানা মেয়ে বে করেচে, তুই ক দেখি! আমারই ঘাট হয়েছে, তোকে কতা কইতে দিয়েছি! জমি তোর বাপের, উনি যা করার করবেন!! তোকে একেনে কতা কইতে হবে নে! আর তুমি মুকে আগল দে বসে আচো কেনো? তোমার জমিতে কতা কওয়ার ও কে!
শেষের কথাগুলো স্বামীর উদ্যেশ্যে বলে উঠলেন মনোরমা, তিনি তাড়াতাড়ি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। মনোরমার এই কথার পর বিভাস এর কথার আর কোনো দাম ছিলো না, আলোচনা সহজেই শেষ হয়ে গেলো। মেয়েদের স্কুল তৈরির প্রস্তাব গৃহীত হবার সঙ্গে সঙ্গেই বিভাস স্থান ত্যাগ করলো।
তোমাদের বুদ্ধি কে বলিহারি যাই বাপু! মেয়েদের পড়ানো হবে সে তো না হয় হলো! কিন্তু ঝড় জলে পড়া হবে কি করে! তার জন্যে ঘর লাগবে নে! মাতার ওপর ছাদ না হলে কি মেয়েরা মাঠে ঘাটে বসে পড়তে পারে!
আলোচনা শেষ করে সবাই উঠতেই যাচ্ছিলেন, পারুল বালার গলার আওয়াজ তাঁদের থামিয়ে দিলো। সবাই অবাক হয়ে তাকালেন, সবচেয়ে বেশি অবাক হলো মৃণালিনী। বড়ো মাই তার স্কুলের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে ভেবেছিল সে!
পারুল বালার ইচ্ছে কে গুরুত্ব দিয়েই আপাতত আটচালা করে দেবার প্রস্তাব হলো, ঘরের খরচা অনেক, সরকারি সাহায্য না পেলে সে সব অনেক টাকার ব্যাপার, এই মুহূর্তে করা সম্ভব নয়। সব কিছু এতো সহজে মিটে যাবে এ আশা কারুরই ছিলো না, মৃণাল খুব খুশি হলো তার অনেকদিনের স্বপ্ন পূরণের একটা ধাপ ছিলো এটা।
দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর্ব চলাকালীন আজও বাপ ছেলে তে কোনো কথোপকথন হলো না। নিজের স্বার্থের কথা ভেবেই আলোচনা চলাকালীন শ্যাম সুন্দর চুপ করেছিলেন কিন্তু বাড়ির বউয়ের আটচালায় বসে পড়ানোর প্রস্তাব তাঁর একটুও মনঃপুত হয়নি। ছেলের শিক্ষিতা মেয়ে বিয়ে করার ইচ্ছেতে তিনি কখনই বাধা হয়ে দাঁড়ান নি, কারণ তাঁর ধারণা ছিলো বউ যতই শিক্ষিতা হোক না কেনো, সে শিক্ষা শুধুমাত্রই তাকে তার বিয়ের উপযুক্ত করার জন্যেই দেওয়া। আজ সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হওয়ায় তিনি মনে মনেই ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। সৌম্যও আজ প্রথম বার বাবার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলো, সারা জীবন তাঁর কথার অবাধ্য না হওয়া ছেলের এই ধৃষ্টতা মেনে নেওয়াও শ্যাম সুন্দরের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাই আজ মাথা নিচু রেখেই গম্ভীর মুখে খেয়ে উঠে গেলেন শ্যাম সুন্দর।
তিনি বেরিয়ে যেতেই সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। মৃণালিনী নিজেও এতক্ষন বড়ো কোনো অশান্তির আশঙ্কায় দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁড়িয়ে ছিলো, শ্বশুর মশাই কে কোনো রকম বিতর্ক ছাড়াই স্থান ত্যাগ করতে দেখে অবশেষে পিঁড়ি টেনে নিয়ে স্বামীর খাওয়ার পাশে বসে পড়লো। শ্যাম সুন্দর ওখান থেকে উঠে যেতেই কুমুদ এর মুখে হাসির রেখা ফুটলো, ইস্কুলের ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য জানার জন্যে তিনি উৎসাহী হয়ে উঠলেন। সৌম্য তাঁর সব কৌতুহল যথেষ্টই ধৈর্য্য সহকারে মেটানোর চেষ্টা করছিলো, হারুর মা এবং বামুন দিদিও মনোযোগ সহকারে তার কথা শুনছিলেন, একমাত্র পারুল বালা সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।
সৌম্য খেয়ে উঠে যাওয়ার পরে কুমুদ হারুর মা কে বড়ো জা কে খাবার জন্যে ডাকতে পাঠালেন। একটু পরে পারুল বালা ধীরে ধীরে সেখানে উপস্থিত হলেন, তাঁর চেহারার মধ্যেই ক্লান্তি ফুটে উঠছিলো, সেটা সেখানে উপস্থিত সবার চোখেই পড়ছিলো।
তোমার শরীলটা কি আবার খারাপ লাগতে লেগেচে গো দিদি?
একটু উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করলেন কুমুদ, পারুল বালা আজ আর অস্বীকার করলেন না। খানিকটা মাথা হেলিয়ে বললেন,
গায়ে কেমন যেন বল পাচ্ছি নে! এট্টু দুব্বল লাগচে!
তাহলে বরং আজ থেকে আপনার ঘরেই খাবার দিয়ে আসবো বড়ো মা, আপনাকে আর দালানে আসতে হবে না।
তাড়াতাড়ি বলে উঠলো মৃণালিনী, পারুল বালা বিরক্ত হলেন।
না বাছা! গতর আমার এমন পড়ে যায় নে কো একনো, যে ঘরে দোরে সকড়ি করতে হবে! ওসব মেলেচ্চ ব্যাপার আমার সইবে নে!!
কিন্তু বড়ো মা……
মৃণাল আরও কিছু বলতেই যাচ্ছিলো, পারুল বালা হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন,
এই তোমার দোষ বাছা! সব তাতেই তক্কো! তক্কো না করলে তো তোমার পেটের ভাত হজম হয় নে! তার ওপরে একন আবার হয়েচো দিদিমণি! সবাইকেই পড়াতে নেগেচো দেকচি!
মৃণাল দুঃখিত হলো, পারুল বালা গম্ভীর মুখে খেতে শুরু করলেন।
আচ্ছা ঠিক আচে, রাতে তো আর সকড়ি নেই কো! দিদির রাতের খাবারটা না হয় ঘরেই দে আসবে, কি বলো দিদি?
বউমার দুঃখিত মুখ লক্ষ্য করে বড়ো জার উদ্যেশ্যে বলে উঠলেন কুমুদ, পারুল বালা সম্মতি জানালেন। তিনিও সম্ভবত মৃণালের মুখ লক্ষ্য করেছিলেন তাই আর এই প্রস্তাবে আপত্তি করলেন না।
সবার খাওয়া দাওয়া মিটে যাওয়ার পরে মৃণাল নিজের ঘরে এসে সৌম্যকে দেখতে না পেয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলো। সৌম্য একটু চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়েছিলো, বউ কে ঢুকতে দেখে একটু উদ্বিগ্ন গলায় বললো,
আলোক দা সেরকম কিছু বাধা সৃষ্টি করলেন না কেনো বলতো? এতো সহজে সব কিছু হয়ে যাবে আমি কিন্তু ভাবিনি একটুও! ইস্কুলটা শুরু করতে বেশি দেরি করা যাবে না কিন্তু, বিভাস আলোক দার সঙ্গে মিলে নতুন কিছু প্যাঁচ কষে ফেলার আগেই জমিটা দখলে আনতে হবে আমাদের।
মৃণাল একটু চিন্তায় পড়লো, তার বি এ পরীক্ষার সময় এগিয়ে এসেছিলো, এই সময় ইস্কুল শুরু হলে সে কিভাবে কলকাতায় অতদিন পরীক্ষার জন্যে থাকবে ভেবে উঠতে পারছিলো না।
তুমি অতো কি ভাবছো? আবার কিছু সমস্যা হলো নাকি!
তাকে চিন্তিত মুখে চুপ করে থাকতে দেখে সৌম্যও চিন্তিত হলো। মৃণাল মাথা নাড়লো,
নাহ! ঠিক সমস্যা নয়, তবে ইস্কুল এক্ষুনি শুরু করলে আমার পরীক্ষার কি হবে! আগের বার যেভাবে পরীক্ষা দিয়েছিলাম বারবার তো আর সেটা সম্ভব হবে না! তুমি যতই আপত্তি করো, এবার কিন্তু আমি বাড়িতে বলেই পরীক্ষা দিতে যাবো! আর আমি চলে গেলে ইস্কুলের দায়িত্ব নেবে কে?
সৌম্য একটু থমকালো,
হ্যাঁ, আমিও ভেবেছি এবার সত্যি কথাই বলবো বাবা কে। একবার যখন বিতর্ক শুরুই হয়েছে তখন আর লুকিয়ে রেখে লাভ কি! এই সত্যিটা জানাও ওনার প্রয়োজন! কিন্তু আমি ওটা নিয়ে ভাবছি না, আমি ভাবছি ইস্কুল তৈরি যদি তোমার পরীক্ষার জন্যে পিছিয়ে যায় তাহলে এর মধ্যে ক্লাব তৈরির চেষ্টা আবার নতুন করে শুরু হয় কিনা! আচ্ছা কেমন হয় যদি তোমার পরীক্ষা চলাকালীন সুরেশ ইস্কুলের দায়িত্ব নেয়?
মৃণাল মাথা নাড়লো,
না, সেটা সম্ভব নয়, সুরেশের কাছে কেউ তাদের মেয়েদের পড়তে পাঠাবে না। সে একে পুরুষ তায় অবিবাহিত! মাঝখান থেকে এই অজুহাতেই বিভাস ইস্কুল বন্ধ করে দেবে। আচ্ছা, যদি সরমা কে মাসখানেকের জন্যে দায়িত্ব নিতে বলতাম, তাহলে কেমন হতো?
হতো তো ভালই, কিন্তু সেজন্য আগে তো ওর সুবিধা অসুবিধা দেখতে হবে। ও এখন সংসারী মৃণাল, সব সময় যে ওর পক্ষে সব কিছু করা সম্ভব হবে এটা ভেবে নেওয়া ঠিক নয়। তবে এবার ফিরে গিয়ে না হয় ওদের সঙ্গে আলোচনা করি একটু! বিমলের মতামতও তো জরুরী!
চিন্তিত গলায় বললো সৌম্য, সমস্যা মিটে গিয়েও যেনো মিটছিলো না, মৃণালিনী নিজেও উদ্বিগ্ন হচ্ছিলো।
ইদানিং বড়ো মার শরীর ভালো যায় না, তাই ঘরের মধ্যেই থাকেন তিনি। উপরন্তু গত কালের উত্তেজনায় তাঁর শরীর নতুন করে দুপুর থেকে খারাপ হয়েছিলো তাই শাশুড়ির কথামতো রাতের খাবার নিয়ে বড়ো মার ঘরে গেলো মৃণালিনী। পারুল বালা খাটে উঠে বসতেই তাঁর পায়ে হাত দিল মৃণাল,
বড়ো মা! আপনার আশীর্বাদ নিয়েই শুরু করতে চাই! আপনি একটুও রাগ করেন নি দেখে খুব আনন্দ হয়েছে আমার! সত্যি বলছি আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার পড়ানোয় মত দেবেন না।
থাক বাছা! ভালো হোক!
আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন পারুল বালা, সারাজীবন দেখে আসা বড়ো মার সঙ্গে আজকের বড়ো মা কে মেলাতে পারছিলো না মৃণালিনী।
ন বছর বয়সে এ বাড়িতে এয়েছিলুম যার হাত ধরে, তারে মনেও পড়ে না। এক এক করে স্বামী, শ্বশুর, শাউরী সবাই চলে গেলো! মাতার ওপরে ছাদ আর স্বামীর সম্পত্তিটুকু ছিলো বলে কারুর কাছে মাতা নিচু করতে হয়নে ককোনো। আমি এই সংসার টুকুই আঁকড়ে বেঁচে ছিলুম! এটুকু বাদে আমার আর কিচু ছিলো নে। সবাই যে আমাকে মনে মনে দয়াই করেচে সব সময়, সে কি আমি বুঝিনি! আমার এই গিন্নি হওয়া! সেও তো তোমার শ্বশুরের দানই! বাপের বাড়ির গলগ্রহ হওয়ার তে তো এ অনেক ভালো! যত বুঝিচি লোকে আমায় করুণা করে, ততো জ্বলেপুড়ে মরিচি! আর ততো আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরিচি সংসার। কুমুদ এর কি নেই বলো! ওর সব আচে, তাই তো ও ও আমাকে গিন্নিটুকু হতে দিয়েচে দয়া করে!
তোমারে দেকেও বড়ো ভয় হয়েছিল, শিককিতো মেয়ে! পাছে আরও বেশি চালাক হও! তাই তো নিজেকে গিন্নি দেকাতে তোমারেও কতো কতা কয়েচি! কিন্তু আসলে হাত আমার খালিই! কিচুই নেই! যখন চলে যাবো, কাঁদার জন্যে নিজের বলতে কেউ থাকবে নে মা গো! আসলে সবাই আমাকে ভয় পায়, কেউ ভালোবাসে নে!
বড়ো মা! সবাই আছে আপনার! সবাই আপনাকে ভালোবাসে! আজ এতো আনন্দের দিনে এসব কথা বলবেন না, আমরা সারাজীবন আপনাকে মাথার ওপর ছাতার মতো পেতে চাই!
বড়ো মা কে জড়িয়ে ধরে বললো মৃণালিনী, পারুল বালা চোখ মুছে স্মিত হাসলেন, চোখের জল আর তোবড়ানো গালের হাসি তাঁর ভাঙাচোরা মুখে একসাথে খেলা করতে লাগলো। বড়ো মার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে রইলো মৃণালিনী, এই মুহূর্তে তারা শাশুড়ি বউমা নয়, দুজন নারী মাত্র। এই অসমবয়সী দুই নারী তাদের সম্পর্কের জটিলতা কাটিয়ে কোথাও গিয়ে বন্ধু হয়ে উঠল বোধহয়।
ক্রমশ