মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব-১৫

0
856

#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৫

“তাড়াতাড়ি পড়া শুরু করো, নাহলে একটা বেতের বাড়িও নিচে পড়বে না।”

টেবিলের বেতের আঘাত করে তীব্রতর কণ্ঠে বললেন। অকস্মাৎ কেঁপে উঠলাম। চোখের পলক স্থির থাকল। আজ বেত নিয়ে হাজির। এর হাত থেকে মুক্তি নেই। জিভ দিয়ে ওষ্ঠ ভিজিয়ে নিলাম। আমি মলিন হয়ে পড়তে শুরু করলাম। পা জোড়া টেবিলের নিচে দুলছে পড়ার তালে তালে। তিনি সরু দৃষ্টিতে সবকিছু অবলোকন করলেন। অতঃপর দিলেন এক ঝাড়ি,

“পা নাচানো বন্ধ করে পড়, নাহলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবো ইডিয়েট।”

“আপনি কি জানেন, আপনি দেখতে অনেক সুন্দর? সুন্দর মানুষের মন একদম ভালো হয়না। সবসময় আমাকে বকে, একটুও ভালোবাসে না।”

ভ্রু কুঁচকে স্মিত হেসে বললেন, “প্রথমত আমি জানি, আমি দেখতে সুন্দর, সুদর্শন যুবক। দ্বিতীয়ত, সুন্দর মানুষের মন অন্যদের মনকেও সুন্দর করতে সচেষ্ট থাকে। তৃতীয়ত, পড়ার সময় পড়া আর ভালোবাসার সময় ভালোবাসা।”

এমন প্রতুক্তি মোটেও প্রত্যাশা করিনি। ‘ভালোবাসার সময় ভালোবাসা’ বলি কোনোদিন কাউকে ভালোবেসেছিস? ভালো লাগে না।
হাতের উপর প্রখর আঘাত পড়তেই দহনে প্রজ্বলিত হল। থেমে গেল পা। আমি বইয়ের ভেতরে মন স্থির করে পড়তে লাগলাম। ধ্রুব স্যার সন্তুষ্ট হলেন না। দড়ি দিয়ে টেবিলের সাথে বেঁধে দিলেন পা। নড়াচড়া বন্ধ। পড়তে বলে নিশ্চল ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন তিনি। নিজের প্রতি প্রচণ্ড বিরক্ত অনুভব করলাম। প্রবল ক্ষোভ নিয়ে পড়তে লাগলাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। আমি পড়া বন্ধ করলাম না। ধ্রুব স্যার এলেন না। গভীর রাত হয়েছে, তবুও তার দেখা পেলাম না। হুট করে মেঘের গর্জন শুনতে পেলাম। আমি চমকে উঠলাম। জানালা থেকে কিছুটা দূরত্বে বসে আছি, ফলস্বরুপ, জানালা বন্ধ করার চেষ্টা বৃথা। তৎক্ষণাৎ বৃষ্টি শুরু হল। রেলিংয়ের ওপর টিপটিপ শব্দে জলধারা পতিত হচ্ছে। সেই বিন্দু কণাগুলো পড়ছে এসে মুখে। ভিজে যাচ্ছি আমি। পা জোড়া চেয়ারের সাথে বাঁধা থাকায় নড়তে ব্যর্থ আমি। ধীরে ধীরে নড়ার চেষ্টা করতেই বিকট শব্দে নীচে পড়লাম। বিনিময়ে পানির ধাঁচ যথারীতি ভিজিয়ে তুলছে আমায়। হিম হয়ে আসছে দেহ। দরজার দিকে দৃষ্টি মেলালাম। ধ্রুব স্যার এলেন না। অশ্রু গড়াল। তিনি আসবেন না। কক্ষনো তাকে ক্ষমা করব না, কক্ষনো না। জ্ঞান হারালাম সেখানে। যখন জ্ঞান ফিরল ধ্রুব স্যারকে নজরে এল সর্বপ্রথম। আমাকে তোলার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে পায়ের বাঁধন খুলে ফেলেছে। পরক্ষণেই ঝুঁকে কোলে তোলার প্রয়াস করলেন। আমি চেয়ারের হাতল ধরলাম। কিছুতেই তার কোলে উঠব না। তিনি আমাকে পড়বেন তো। আমি পড়ব।

আমি নিজে নিজেই উঠলাম। মাথা ভার হয়ে আছে ঠান্ডায়। ভেজা জামা পড়নে। চোখজোড়া আপনাআপনি গ্ৰথণ হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে ধ্রুব স্যারের চেয়ারে বসে মুখ ঢেকে ফেললাম বই দিয়ে। ধ্রুব স্যার আমার এরুপ প্রতিক্রিয়া দেখছে বেশ বিরাগী হলেন। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,

“স্টুপিড উঠ। জ্বর চলে আসবে।”

অব্যক্ত স্বরে বললাম, “আসুক জ্বর। মে’রে ফেলুক আমায়, তাহলে পড়তে হবে না। তবুও এখন আমি পড়ব। পড়বই পড়ব। কেউ থামাতে পারবে না।”

ধ্রুব স্যার বিচলিত হলেন। লাইব্রেরীর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পদচারণ করলেন। ধৈর্যহীন হয়ে কোলে তুলে নিলেন আমায়। জোর করে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। আমি উঠার প্রয়াস করেও বরাবরই ব্যর্থ। ক্লান্ত শরীরে নিয়ে ধ্রুব স্যারের কাছে পাঁচ বছরের বাচ্চার ন্যায়। কাবার্ড থেকে স্বযত্নে রাখা চুরিদার বের করে দিলেন। পাল্টে নিতে বললেন। গোমড়া মুখে পাল্টে বসে রইলাম। ততক্ষণে ধ্রুব স্যার ডাক্তার ডেকে এনেছেন। এতরাতে ডাক্তার ডাকার কারণ জানতে ব্যর্থ। শরীরটা অতিরিক্ত উষ্ণ। জ্বরের লক্ষণ। ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক মাথায় জ্বর পট্টি দিতে বসলেন ধ্রুব স্যার। ভেজা কাপড়ের টুকরো চোখের উপর পড়তেই চোখ মেলে তাকালাম।

“আপু তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে দে, ভিজে যাচ্ছি তো।” ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলল বাবুই।

ব্যাঘাত ঘটল তন্দ্রায়। বাইরে অবিরাম ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। জালানার খোলা, বিনিময়ে ফোঁটা ফোঁটা জলধারা আঁচড়ে পড়ছে মুখমণ্ডলের উপর। দ্রুত জানালার কাঁচ নামিয়ে দিলাম। ধ্রুব স্যারের কথা মস্তিষ্কে হানা দিতেই বালিশের দিকে তাকালাম। একি কোথায় তিনি? আমি তো লাইব্রেরীতে প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছিলাম। আনমনেই উচ্চ শব্দে হেসে উঠলাম। এতক্ষণ আমি তন্দ্রা ঘোরে নিমজ্জিত ছিলাম। এজন্যই লাইব্রেরীতে বিছানা, কাবার্ড, জামা কাপড়, ডাক্তার রাখা ছিল। এই ছেলেটা আমাকে স্বপ্নেও বিরক্ত করছে, কি ভয়ানক ব্যাপার স্যাপার। কিছুদিন পর যদি আমার এই ভয়ানক দুঃস্বপ্নটাই সত্যি হয়। আচ্ছা, আমি কবে এমন পড়াচোর হলাম? আমি পড়তে যথেষ্ট ভালোবাসি।তাহলে?
আমি জীবনেও ধ্রুব স্যারের কাছে পড়ব না। প্রয়োজনে ভার্সিটিতেই যাবো না।

টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে একঢোক পানি পান করলাম। পুনরায় বালিশে মাথা হেলিয়ে দিলাম।
______

এগারোটার কাছাকাছি। ধ্রুব স্যারের ক্লাস নেই। আজকে ভার্সিটিতে কোথাও থাকে দেখা যায়নি। আজকে আসার কোনোরুপ ইচ্ছে ছিলনা। ধ্রুব স্যারকে জানাতে এসেছি। কিন্তু মহাশয় হাওয়া। তাকে দেখা যায়নি। ক্লাসও নেই তার।

বন্ধুমহল সবাই একত্রে। আমার উৎকণ্ঠার কারণ জানতে তাদের আয়োজন। কিন্তু নিশ্চুপ আমি। আমার এরুপ ভাবাবেগ দেখে নিরব বিরক্তিকর কণ্ঠে বলে,

“তুই কি সারাজীবন চুপ করে থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিস, তাহলে থাক। আমরা বরং যাই।”

অন্য প্রসঙ্গ টেনে বলি, “মামা আমার বিয়ে ঠিক করেছে?”

“কী?” [বিস্মিত কণ্ঠে একসাথে]

“চ্যাঁচামেচি করছি কেন, আশ্চর্য?”

তড়িগড়ি করে বলে আঁখি, “কার সাথে, কবে, কখন, কীভাবে?”

তৌফির দ্রুত কণ্ঠে বলে, “প্রিয়ার মত বুড়া চাচার সাথে নয়তো?”

“তোরে বলছে, ও বুড়া। তোর মারিয়া একবারে কচি মনে হয়। ওর তো চামড়া কুঁচকে গেছে। আমার বিয়েতে নিয়ে আসিস, তোরে আয়রণ মেশিন ট্রিট দিবো নে। ওটা দিয়ে ওর চামড়া সোজা করে দিস।”

তৌফিক ক্ষোভ সংযত করতে ব্যর্থ হয়ে বলে উঠল, “তোর হবু বর কোন ইর নেতা। আমার মারিয়া যথেষ্ট সুন্দর, তোর সোজা করার দরকার নাই। পুলিশ জামাই পাইয়া আকাশে উঠে গেছিস। যা তোর পুলিশ জামাই কাছে। যত্তসব, থাক তোরা।”

ফাঁকা ক্যাম্পাসে লা’থি দিয়ে চলে গেল তৌফিক। আমি, আঁখি, নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলাম। ফুঁপিয়ে উঠল প্রিয়া। অস্ফুট স্বরে বলে,

“ও তো সবসময় তাহিরকে বুড়া বলে, আমি একটু বলছি তারজন্য এভাবে বলতে পারল।”

প্রিয়ার প্রস্থান করল। আমরা তিনজনে গালে হাত দিয়ে একসাথে বললাম, “কী হলো এটা?”
.
ধ্রুব স্যার একটু দেরি করে উপস্থিত হলেন। ক্যাম্পাস অতিক্রম করে যাওয়ার সময় দৃঢ় গলায় বলেন, তার কেবিনে দেখা করতে। পুনরায় এগোলেন। তৎক্ষণাৎ মাহি এলো সেখানে। স্যারকে স্যরি বলার পূর্বেই পা পিছলে ধপাস করে পড়ল নিচে। মাহি কোমরে হাত দিয়ে কাতরাচ্ছে ব্যথায়। ধ্রুব স্যার গোটা ব্যাপারটা ইগনোর করলেন। মাহিকে না তুলেই নিজের কেবিনের দিকে অগ্ৰসর হল। মাহি নামের কোনো তরণী তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, বোঝার দায় নেই। স্যারের ন্যায় সুদর্শন পুরুষ এমন একটা কাজ করতে পারেন দেখে সবাই হতভম্ব।
‘সুদর্শন’ শব্দ মস্তিষ্কে হানা দিতেই কালকে রাতের স্বপ্নটার কথা দৃশ্যগোচর হল। আমি স্বপ্নে স্যারকে সুদর্শন পুরুষ বলে অভিহিত করেছিলাম। লজ্জানত হল মুখশ্রী। দ্রুত মাথায় দোপাট্টা টানলাম। তার পিছুপিছু দূর্বল পায়ে অগ্ৰসর হলাম। কিছুটা পথ দিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। গলা উঁচু করে বলেন,

“খাওয়া-দাওয়া করো না, তাড়াতাড়ি এসো। আমাকে আবার যেতে হবে।”

.
“কী হয়েছে, তোমার চড়ুই। আমার সামনে হঠাৎ এত লজ্জা পাচ্ছ কেন আর মাথায় এতবড় ঘোমটা দিয়েছ কেন? মনে হচ্ছে, বাসর ঘরে বসে আছি।”

লজ্জায় মুখশ্রী চুপসে গেল। উপায়ান্তর না পেয়ে ঢেকে নিলাম মুখ। এখানে আর থাকা যাবে না। নত কণ্ঠে বললাম,
“স্যার, আসছি।”

“আজকে আমাদের প্রিন্সিপাল স্যারের বাড়িতে ডিনারে ইনভার্ট করা হয়েছে, তোমার মনে আছে।”

লহমায় লজ্জা ভঙ্গ হল। বেমালুম ভুলে গেছি। ইদানীং বিষন্নতার কারণে ভুলে যাচ্ছি, ধ্রুব স্যার ছাড়া কিছু মনে থাকে না। আমতা আমতা করে বললাম,
“মনে ছিলনা।”

সন্দিহান গলায় বললেন, “খাওয়ার কথা মনে থাকে তো?”

“না, কাল রাত থেকে কিছু খাইনি।”

“তাহলে মন কার কাছে, রাহাতের কাছে?”

“আপনি সবসময় রাহাত স্যার, রাহাত স্যার করেন কেন? মনটা আপনার কাছে ছিল। রাহাত স্যারের দোষ একদম দিবেন না।”

“কী? বুঝলাম না।” না বোঝার স্বরে।

আপনাআপনি হাত দিয়ে ঠেকলো ওষ্ঠদ্বয়ের উপর। ক্ষোভের বশে মুখ ফসকে গেছে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]