#যতনে_রাখিবো
২১
তাথৈ চলে যাবার একটু পরেই নোমান এসে অভয়ের পাশে দাঁড়ান। অভয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে আস্তে ধীরে বলল,
-স্যার ম্যাডাম চলে গেছেন।
অভয় নোমানের কথা শুনলেও কোন জবাব দিল না। নকল চুল দাড়ি খুলে নোমানের হাতে ধরিয়ে দিল। এতক্ষণ তাথৈয়ের সামনে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাথৈ চোখের আড়াল হয়ে গেলে পিঠ সোজা হয়ে দাঁড়াল। রাস্তার একটু আড়ালেই তার কালো গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। নোমান চারপাশে তাকিয়ে বলল,
-স্যার পাবলিক প্লেসে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক না। গাড়িতে গিয়ে বসুন।
গাড়িতে উঠে বসে সিটে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে অভয় বলল,
-নোমান।
-জি স্যার।
-সন্ধ্যার আগেই তোমার ম্যাডামকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করো। কীভাবে কী করবে আমি শুনতে চাই না। শুধু সন্ধ্যায় যেন তোমার ম্যাডামকে তার বরের বাড়িতে দেখতে পাই।
অভয়ের দিকে তাকিয়ে নোমান ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
-ঠিক আছে স্যার।
তাথৈ বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবার পরেই নোমান এসেছিল। নোমানের কথাগুলো অভয়কে ভাবতে বাধ্য করেছে। তাথৈ চলে যেতে চাইলে কবেই চলে যেতে পারত। কিন্তু তাথৈ সেটা করেনি। তাথৈয়ের পেছনে নোমানকে পাঠিয়েছিল অভয়। নোমানই জানাল তাথৈ বাড়ি না গিয়ে পার্কে বসে আছে।
অভয়ের ভেতর থেকে তীক্ষ্ণ একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তাথৈকে সে কখনও বোঝার চেষ্টা করেনি। হঠাৎ অভয় জিজ্ঞেস করে উঠল,
-নোমান তানিয়া এখন কোথায় আছে জানো?
-কোন তানিয়া স্যার?
-তোমার স্মৃতিশক্তি এত দূর্বল কেন বলতে পারবে?
তাথৈয়ের বড় বোনের নামও তানিয়া। কিন্তু স্যার তো উনাকে আপু ডাকে। তারপরও নোমান বলল,
-হঠাৎ নাম ধরে বললেন দেখে চিনতে পারিনি। তানিয়া আপু তো মনে হয় বাড়িতেই আছে। ভাবী পৌঁছে গেছেন কি-না উনাকে জিজ্ঞেস করবো?
অভয় অবিশ্বাস্য চোখে এই ছেলের দিকে তাকাল। কোন মানুষ এতটা গাধা হতে পারে তার জানা ছিল না।
-আমি কোন তানিয়ার কথা বলছে তুমি সত্যিই বুঝতে পারছো না!
অভয়ের মনে করাতে হলো না। তার তাকানোতেই নোমানের মনে পড়ে গেল। তানিয়াকে সে কীভাবে ভুলে গেল? অপরাধী মুখে নোমান বলল,
-সঠিক জানি না স্যার। তবে শুনেছিলাম উনি বিয়ে করে বরের সঙ্গে সিঙ্গাপুর চলে গেছেন।
-ওহ।
-হঠাৎ উনার কথা কেন স্যার?
-উনার জন্য একজনের মন থেকে আমি সারাজীবনের জন্য উঠে গেছি।
-কার মন থেকে স্যার?
-আছে একজন। যে আমাকে তার বিশেষ মানুষ মনে করতো।
নোমান জিজ্ঞেস করার সাহস পেলো না সেই মানুষটা কে। তবে তানিয়া স্যারের সাথে যা করেছিল তা ভোলার মতো নয়৷ একটা মেয়ে পুরো দেশ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। নিজের ক্যারিয়ার, চরিত্রের কথা না ভেবে তার স্যারের চরিত্রে দাগ লাগাতে এসেছিল। কিন্তু চার বছর আগের ওই ঘটনা স্যারকে কে মনে করিয়ে দিলো?
—–
তাথৈ বাড়িতে এলেও এটা বুঝতে দেয়নি সে রাগ করে চলে এসেছে। আপু সন্দেহ করলেও তাথৈ বোনকে এটা বলেছে,
-আমি তোমাদের অনেক মিস করছিলাম আপু। এই বাড়িটাকে মিস করছিলাম। তাই চলে এসেছি। বিয়ে হয়েছে বলে কি এটা আমার বাড়ি না? আমি এখানে আসতে পারবো না?
-আমি কি সেটা বলেছি? কিন্তু অভয়কেও সাথে নিয়ে আসতি।
-তুমি জানো না উনি কত ব্যস্ত মানুষ। উনার কি আসার সময় আছে?
তানিয়া কিছুটা মন খারাপ ভাব করে বলল,
-তোদের বিয়ের পর এখন পর্যন্ত অভয় আমাদের বাড়িতে আসেনি। যত বড়ো নায়কই হোক মানুষ কি শ্বশুরবাড়িতে যায় না?
বোনকে মন খারাপ করতে দেখে তাথৈ মনে মনে ভাবল,
-উনি তো বিয়েটাই মানেন না। শ্বশুরবাড়ি আসার কথা তো অনেক পরের ব্যাপার।
-হ্যাঁ রে, তুই এসেছিস। অভয়কেও কল করে আসতে বল না।
-শুধু শুধু কেন একটা মানুষকে জোর করবে আপু? উনার আসার ইচ্ছে হলে নিজে থেকেই আসবে। তাছাড়া উনার আলিশান বাড়ি রেখে আমাদের এই ছোট্ট গৃহে উনি থাকতে পারবেন? শুধু শুধু বেচারাকে ডেকে এনে কষ্ট দিও না তো।
আপুকে নয়ছয় বুঝিয়ে তাথৈ নিজের ঘরে চলে এলো। কতদিন পর নিজের ঘরে এসেছে। নিজের ঘর কথাটা বলতেই আলাদা একটা প্রশান্তি কাজ করে।
-ওই নাক উঁচা দেমাগে ভরপুর নায়কের বাড়িতে আর যাচ্ছি না। বিয়েকে তো নাটক বানিয়েছিই। আরেকটু নাটক করে ডিভোর্সটাও দিয়ে দিব। যাতে এই বিয়ে নামক নাটকটা আর চালিয়ে যেতে না হয়।
—–
তাথৈয়ের শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে সন্ধ্যায় এক গাড়ি মিষ্টি, পান সুপারি নিয়ে নোমান এসে হাজির হয়েছে। তাথৈ তখন ড্রয়িংরুমে বসে বাবাইকে পড়ানোর নাম করে দু’জনই টিভি দেখছিল। নোমানকে এভাবে দেখে তাথৈয়ের চোখ কপালে উঠে গেছে। এসব কী? পুরো মিষ্টির দোকান তুলে এনেছে নাকি?
-নোমান সাহেব! এসব কী? মিষ্টির দোকান খালি করে সব আমার বাড়িতে নিয়ে এসেছেন কেন?
বেচারা দু’হাতে ধরা মিষ্টির ভারে নুইয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাথৈ ওসব খেয়াল না করে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে।
-আপনাকে এখানে কে আসতে বলেছে? আমাদের মহল্লায়ও এতগুলো ঘর হবে না আপনি যতগুলো মিষ্টির প্যাকেট এনেছেন? এসব কী বলুন তো?
-ভাবী আগে এগুলো রাখি। তারপর আপনার প্রশ্নের উত্তর দেই?
-না, রাখবেন না। আপনার স্যারের টাকার মিষ্টি আমরা কেউ খাবো না। আপনি এগুলো আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।
তাথৈ হয়তো নোমানকে সত্যিই ফেরত পাঠাতো। কিন্তু তার আগেই তানিয়া চলে এসেছে। নোমানকে দেখে অবিশ্বাস্য গলায় বলল,
-নোমান নাকি? এসব কী পাগলামি? তোমার হাতে এ সব কি মিষ্টির প্যাকেট?
-গাড়িতে আরও আছে আপু।
তানিয়া অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে বলল,
-আরও!
-প্রথম বার স্যারের শ্বশুরবাড়িতে এসেছি। খালি হাতে এলে কী ভালো লাগতো?
-তাই বলে এত মিষ্টি!
-আপু এগুলো কোথায় রাখবো?
-এখানেই রাখো। কী কাণ্ড! কতক্ষণ ধরে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো। তাথৈটাও একটা বেআক্কেল।
আপু চলে আসাতে তাথৈ নোমানকে কিছু বলতে পারছে না। নোমানকে ফেরত পাঠালে আপু বুঝে যাবে এমনিতে আসেনি সে। ওই বাড়ি থেকে একেবারে চলে এসেছে। তাথৈ আপাতত আপুর থেকে সত্যটা লুকিয়ে রাখতে চায়। আপু হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো ধৈর্য তার নেই।
নোমানকে তাথৈয়ের সামনে একা ছেড়ে তানিয়া নোমানের আপ্যায়নের আয়োজন করে গেছে। আপু যেতেই তাথৈ নোমানকে চেপে ধরল।
-কেন এসেছেন আপনি? এত ব্যস্ত একজন মানুষের ম্যানেজার হয়ে আপনি নিশ্চয় আমাদের হালচাল জানতে আসেননি।
-স্যার আমাকে আপনাকে নিয়ে যেতে পাঠিয়েছে।
এই কথাটা শুনে তাথৈয়ের মেজাজ হুট করেই বিগড়ে গেল। লোকটা কত বড় শয়তান! নিজেই তাকে চলে আসতে বলে এখন আবার ঢঙ করতে ম্যানেজার কে পাঠিয়েছে তাকে নিয়ে যেতে। নাটকের কোন শেষ নেই। রাগে তাথৈয়ের গলা চড়ে গেলেও আপু শুনতে পাবে এটা ভেবে নিচু গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-আপনার স্যারের নিকুচি করি। নিজেই বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে এখন আপনাকে পাঠিয়েছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে! আপনার স্যারের কি মাথায় সমস্যা আছে? নয়তো এত তাড়াতাড়ি কথার নড়চড় হয় কিকরে? যাব না ফিরে। কী করবেন উনি? উনাকে গিয়ে বলবেন যত শীঘ্রই পারে আমাকে যেন ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেন। হতে পারেন উনি বিশাল মাপের নায়ক। কিন্তু আমার কাছে উনি উট পাখির ডিমের থেকেও বড়ো মাপের জিরো।
তার স্যার বোকা এটা বলবে না। কিন্তু এসব ব্যাপারে স্যারের জ্ঞান বুদ্ধি একটু কম। বউকে কী এমন বলেছেন যে ভাবী উনার উপর এতটা ক্ষেপে আছেন!
-আমি কাউকে এখনও কিছু জানাইনি। ডিভোর্স লেটার হাতে পাওয়ার পরই জানাবো। আপু খাবার-দাবারের যা ব্যবস্থা করছে চুপচাপ খেয়েদেয়ে চলে যাবেন। দ্বিতীয় বার ভুলেও আর আপনার স্যারের কথাতে আমাকে নিতে আসবেন না।
—–
জীবনে যে একফোঁটা সুখ থাকবে এটাও নেই। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ নোমান এসে জানাল স্যার তাকে নিতে পাঠিয়েছে। ওই লোক নোমানকে পাঠালেই কেন যাবে সে? তার কি কোন আত্মসম্মান নেই? যখন মন চাইবে বলবে, চলে যাও। যখন মন চাইবে নেওয়ার জন্য মানুষ পাঠিয়ে দিবে।
-সবকিছু কি উনার ইচ্ছেতেই হবে নাকি? ফিরে যাব না এটাই ফাইনাল।
চলবে
#যতনে_রাখিবো
২২
রাতের খাবার খেয়ে ঘরে আসতে না আসতেই ফোন বাজতে শুরু করেছে। এই হাফসাটা আরও তাকে জ্বালিয়ে খাবে। এর কলের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়েই মনে হয় নোমানের কাছে ফোন পাঠিয়ে দিয়েছে। তাথৈ সাথে সাথে কল তুললো না। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করালো। এর মাঝেও কিন্তু হাফসা হাল ছাড়েনি। শেষে বিরক্ত হয়ে তাথৈ কল রিসিভ করল।
-সমস্যা কী তোর? কই থাকিস তুই? ভাবিস না হিরোকে বিয়ে করে নিজেও হিরোইন হয়ে গেছিস। এত কিসের ভাব তোর! বাপরে বাপ, হাজারটা কল দেওয়ার পরেও সে কল তুলতে পারে না এত বড় সেলিব্রিটি হয়ে গেছে!
তাথৈ ফোন কানের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখল। শোয়ার জন্য বিছানা গুছিয়ে হাফসাকে বলল,
-তোর ভাষণ শেষ হয়েছে? নাকি আরও কিছুক্ষণ বক্তৃতা দিবি?
-তুই একটা অমানুষ।
-তাই তো তোর সাথে মিশি। এখন বল কেন কল দিয়েছিস।
-শখে দিইনি। নায়কের বউ হয়ে দিনদুনিয়া সব ভুলে বসে আছিস। এমনকি এটাও যে তোর এখনও গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করা বাকি।
তাথৈ সোজা হয়ে বসে উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল।
-পরীক্ষার রুটিন দিয়ে ফেলেছে?
-জি মহারানী। আপনার তো পড়াশোনা থেকে জান ছুটেছে। কিন্তু আমার এখনও পড়তে পড়তে শহিদ হওয়া বাকি।
-চুপ কর খবিশ। আমার এখন তোর থেকেও বেশি পড়তে হবে।
-কেন? তুই কি জব করবি? তুই পড়াশোনা করে জব করলে তোর নায়ক বরের টাকাপয়সা কে খাবে?
-উনার দ্বিতীয় বউ। কারণ আমি আর উনার সাথে থাকছি না। কয়েক দিনের মধ্যেই ডিভোর্স দিয়ে আমিও তোর মতো সিঙ্গেল হয়ে যাব।
এই কথা শুনে হাফসা বিস্ফোরণ মূলক প্রতিক্রিয়া দিল। চেঁচিয়ে তাথৈর কান ফাটিয়ে দিয়ে বলল,
-আস্তাগফিরুল্লাহ! এসব কী বলিস?
তাথৈ হেলান দিয়ে বসে দায়সারা ভাবে বলল,
-ঠিকই বলি।
-ছাতার মাথা ঠিক বলিস। মানুষের বিয়ে কয়টা হয়? ডিভোর্স কেন দিবি?
-ওই লোকের সাথে তোর বান্ধবীর যায় না।
-এই কথা তুই এখন বুঝছিস? বিয়ের আগে কী করছিলি?
তাথৈ বিয়ের আগেও বুঝেছে। কিন্তু এটা তো সত্যিকারের বিয়ে না। তাই এত ভাবার কারণ ছিল না।
-মানুষ ভুল থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করে। এই বিয়ে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে দ্বিতীয় বিয়ে সফলভাবে কাটাবো।
-সামনে থাকলে তুই আমার হাতে লাথি খেতি।
-লাথি হাতে খায়না মাথা মোটা।
হাফসা এতক্ষণ সবকিছু নিয়ে মজা করলেও তাথৈর মুখে ডিভোর্সের কথা শুনে প্রচণ্ড সিরিয়াস হয়ে গেছে। ফাজলামি বাদ দিয়ে বলল,
-মজা সাইডে রাখ দোস্ত। সত্যি করে বল। তোদের মাঝে কি হয়েছে?
-কিছু হয়নি। আজ বাড়ি চলে এসেছি।
হাফসা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-কখন?
-সকালে।
-ঝগড়া করে এসেছিস?
-না।
-ঝগড়া না হলে তাহলে কেন এসেছিস?
-কেউ আমাকে নিজেই চলে আসতে বললে আমি কী করবো? উনার পা ধরে বসে থাকবো? বলবো, আমাকে তাড়িয়ে দিবেন না। দয়া করে আপনার চরণে একটু ঠাঁই দিন।
কী জন্যে যেন বাইরে থেকে তানিয়া তাথৈকে ডাকল। তাথৈ একবার আসছি বলেও না গিয়ে হাফসার সাথে কথায় লেগে রইল।
-তোদের বিয়ের তো এখনও দুই মাসও হয়নি দোস্ত। এখনই ডিভোর্সের সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছিস! বিয়েটাকে তুই কী মনে করিস? জানি তোদের দু’জনের কোন মিল নেই। কিন্তু বিয়ে তো দু’জনের মিলিত চেষ্টাতেই সফল হবে।
-আমি একাই চেষ্টা করি দোস্ত। উনার দিক থেকে কোন চেষ্টা নেই। আমি উনার বউ আছি না মরে গেছি উনি এই খবরটাও তো রাখেন না। পুরোটা দিন বাড়ির বাইরে থাকেন। মানছি উনার অনেক কাজ। আমিই বেকার মানুষ। বসে বসে খাই। তবুও কি উনি নিজে আমাকে একটা কল দিতে পারেন না? বারবার উনার ম্যানেজারই কেন কল দিবেন? উনি নিজে একটা বার কেন এই কথা জিজ্ঞেস করেন না, কেমন আছো তাথৈ? আজকের দিন কেমন কেটেছে? আমি কাজে অনেক ব্যস্ত। তোমাকে কল দিতে পারি না। তুমি কিছু মনে করো না, কেমন?
-এই সামান্য বিষয়কে ইস্যু বানিয়ে তুই ডিভোর্সের কথা ভাবছিস? তানিয়া আপু জানতে পারলে তোর চৌদ্দ গোষ্ঠীর নাম ভুলিয়ে দিবে।
-সামান্য বিষয় না দোস্ত। তুই আমার জায়গায় থাকলে বুঝতি।
-তোর জায়গায় না থেকেও আমি বুঝতে পারছি। ডিভোর্স নেওয়ার জন্য এটা একটা সামান্য কারণই।
-কচু বুঝছিস তুই। তুই জানিস? আজ সকাল থেকে না খেয়ে আমি উনার জন্য রান্না করছিলাম। এই কথাটা কি উনি জানেন? জানেন না। উল্টো উনি কী বললেন? তুমি চলে যেতে চাইলে যেতে পারো। এই কথার মানে কী? আমি সকালে রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম এতে উনার কিছু আসবে যাবে? যাবে না। রাগটা যদিও উনার জন্যই। আমাকে ঘাড় থেকে নামানোর কত চেষ্টা! এমন সম্পর্ক আমি চাই না দোস্ত। যে সম্পর্কে কোন ভালোবাসা নেই।
-তুই তো আগেই জানতি ওই লোক তোকে ভালোবাসে না। তারপরও বিয়েটা করলি। এখন তাহলে এসব অভিযোগ উঠছে কেন?
-কেন উঠছে এটা তো আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। আমি তো সব জেনেই রাজি হয়েছি। এখনও সব জানি। তারপরও আমার দিক থেকে এক্সপেকটেশন এত বেশি হয়ে যাচ্ছে কেন?
-এসবের একটা কারণই হতে পারে। তুই ওই ব্যাটা নায়ককে ভালোবাসতে শুরু করেছিস। যেখানে ভালোবাসা থাকবে সেখানে এক্সপেকটেশন অটোমেটিক তৈরি হয়ে যাবে। নায়কের প্রেমে পড়ে এখন সেন্টি খাচ্ছ আমি কেন উনার থেকে বেশি বেশি আশা করছি!
-ফালতু কথা বলিস না তো। ভালোবাসা না ঠ্যাং।
-তুই শালি আগে থেকেই ওই ব্যাটাকে পছন্দ করতি। কলেজে থাকতে কত পাগলামি করতে ভুলে গেছো? রনি তো তোর পথ ক্লিয়ার করে দিয়েছে। তবুও হারামজাদার সাথে শুধু শুধু ব্রেকআপ করলাম। রনি সেদিন ওই বাজিটা না ধরলে এসব কিছু হতো?
-বাজির কথা তুই মনেই করাস না৷ আমার আইফোন এখনও পাইনি।
-আইফোনের থেকে দামী জামাই পেয়েছিস। এখন আবার আইফোনও চাস! কত লোভীরে তুই?
-আমি লোভী?
-অফকোর্স তুই লোভী।
-তোর মাথা।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ দরজার দিকে চোখ গেলে তাথৈ কয়েক মুহূর্তের জন্য স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছিল। রাতদুপুরে ভুলভাল দেখার মানে কী? সে দেখতে পাচ্ছে অভয় দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এই সময় অভয় এখানে কী করতে আসবে?
-আসবো?
রাশভারী কন্ঠস্বরটা এখনও কানে বাজছে। তার মানে কি এটা কল্পনা না? তাথৈ চোখ পিটপিট ফোনে হাফসাকে বলল,
-রাতদুপুরে ভুলভাল দেখছি। আমার কানে জোরে একটা চিৎকার কর তো।
হাফসা এতক্ষণ কী বোঝালো আর হৃদি কী বুঝলো! কানে চিৎকার দেওয়ার কথা বলছে! হাফসা রেগে এটা বলে কল কেটে দিলো।
-পাগলের জাত। দোয়া করি এই জীবনে যেন ডিভোর্স না পাস। তোর জন্য ওই মুডি নায়কই ঠিক আছে।
তাথৈয়ের থেকে অনুমতি না পেয়ে অভয় বিনা অনুমতিতেই ভেতরে চলে এলো। তাথৈ এখনও এটাকে কল্পনা মনে করেই বসে আছে। কিন্তু এটা যে তার কল্পনা না তা প্রমাণ করতেই যেন তানিয়া অভয়ের পেছন থেকে বেরিয়ে এসে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
-তোকে ডেকেছিলাম কানে যায়নি? কী করছিস ঘরে বসে?
আপুর রাগ দেখে বুঝলো লোকটা সত্যিই তাদের বাড়িতে এসেছে। তাথৈ তীক্ষ্ণ চোখে অভয়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবল,
-কেন এসেছে এখন? আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েও শান্তি হয়নি। নতুন করে জ্বালাতে বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে।
তানিয়া রাগ করছে কারণ অভয় আসবে এই কথা তাথৈ আগে কেন জানায়নি। সবার রাতের খাওয়া শেষ। ফ্রিজে বেঁচে যাওয়া পাবদামাছের তরকারি আছে শুধু। ভাতও নেই। অভয় আসবে আগে জানলে অন্তত রান্না করে রাখত। তাহলে এখন তাকে এরকম লজ্জায় পড়তে হতো না। অভয়ের সামনে তানিয়া তাথৈকে কিছু বলতে পারল না। কিন্তু আড়ালে নিয়ে গিয়েই পিঠে কিল বসিয়ে দিল। তাথৈ বাঁকা হয়ে গিয়ে বলল,
-এই কিল কিসের জন্য? এখন আবার আমি কী করেছি?
-কী করেছিস জানিস না তুই?
আরেকটা কিল খাওয়ার ভয়ে বোনের মুখের উপর জানি না কথাটাও বলতে পারল না। ঠোঁট ফুলিয়ে পিঠ ডলতে লাগল।
-অভয় আসবে এই কথা আগে কেন বলিস নি। ছেলেটা যে এসেছে ওকে কি এখন না খাইয়ে রাখবো?
-প্রথমত উনি কোন ছেলে না। দামড়া পুরুষকে ছেলে বলছো। কেমন বিশ্রী শোনাচ্ছে।
তানিয়া দ্বিতীয় বার বোনের উপর হাত তুলতে গিয়েও থেমে গেল। এই গাধা পিটিয়ে মানুষ বানানোর চেষ্টা বৃথা। ভেবেছিল বিয়ের পরে হয়তো একটু পরিবর্তন আসবে। কিন্তু এখন আগের থেকেও বেশি অলস আর কাজ চোর হয়েছে।
তাকে একা বসিয়ে রেখে দুই বোন যে সেই গেল। আর ফিরে আসার নামগন্ধ নেই। অভয় তাথৈয়ের ঘরটা ভালো করে দেখছে। ছিমছাম মোটামুটি অগোছালো একটা ঘর। দেখেই বোঝা যায় এঘরে যে বাস থেকে সে মোটেও পরিচ্ছন্নতা সচেতন মানুষ না। ড্রেসিংটেবিলের উপরের জিনিস গুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। এই এলোমেলো জিনিস গুলোর মধ্য থেকেই অভয় ভীষণ দামী একটা জিনিস খুঁজে পেলো। তাথৈয়ের বাবার সাথে ওর একটা ছবি। মনে হয় স্কুল টাইমের তোলা। কারণ ছবিটিতে তাথৈয়ের পরনে স্কুল ড্রেস পরা। অভয় সেদিকে এগিয়ে গেল। ছবিটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগল। বাবার মেয়ের মিষ্টি একটা মুহূর্তকে ছবিতে বাঁধাই করে রেখে দেওয়া হয়েছে।
-কী করছেন ওখানে?
তাথৈয়ের কন্ঠ পেয়ে অভয় ছবিটা যথাস্থানে রেখে ফিরে তাকাল। তাথৈও দেখেছে অভয় তার ছবি দেখছিল। তারপরও অভয় মুখে বলল,
-কিছু না।
তাথৈয়ের কপাল কুঞ্চিত হলো। কিরকম মিথ্যা কথা বলছে। ককর্শ গলায় তাথৈ জিজ্ঞেস করল,
-এখানে কেন এসেছেন?
চলবে
Jerin Akter Nipa