#যতনে_রাখিবো
২৫
অভয় চলে যাবার সময়ও তাথৈ ভাবেনি সে অভয়কে এতটা মিস করবে। এয়ারপোর্টে পৌঁছে প্লেনে ওঠার আগে কল দিয়েছিল। বলেছিল পৌঁছে কল দিবে। একটা রাতই তাথৈয়ের কাছে এত বড় লাগছে বাকি দিনগুলো কীভাবে কাটবে? অভয় তাথৈকে কল করেছে পরদিন সকালে। তাথৈ ঘুম তখনও পুরোপুরি কাটেনি। ফোন রিংটোন হলে ঘুমের ঘোরেই রিসিভ করে কানে ধরলো।
-হ্যালো।
তাথৈয়ের ঘুম জড়ানো কন্ঠ শুনে অভয় বলল,
-বাংলাদেশে সকাল তো অনেক আগেই হয়ে যাবার কথা।
-কে বলছেন?
অভয় কপাল কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল ভুল নাম্বারে ডায়াল করেনি তো? নাম্বার তো ঠিকই আছে। তাথৈ লিখে সেভ করা।
-নিজের যে একটা বর আছে এক রাতেই ভুলে বসে আছো!
-ওখানে পৌঁছে আপনিও তো ভুলে গিয়েছিলেন দেশে আপনার একটা বউ আছে।
অভয় মুচকি হেসে বলল,
-ভুলিনি। হোটেলে চেক-ইন করেই তোমাকে কল দিতে নিয়েছিলাম। কিন্তু সময় দেখে ভাবলাম তখন বাংলাদেশে গভীর রাত৷ তাই ঘুম নষ্ট করতে চাইনি।
-বাহানার কোন শেষ নেই।
-আপুরা কি রাতে থেকে গিয়েছিল?
-না। আমি এখন আয়েশা আপুর এখানে আছি। নূর আমাকে নিয়ে আসার জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিল।
-ঠিক আছে। উঠে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও। আমাকে এখন রাখতে হবে। টিম মেম্বারদের সাথে লোকেশন দেখতে যেতে হবে।
-আজ থেকেই শুটিং শুরু হয়ে যাবে?
-দুই তিনদিন সময় লাগবে। লোকেশন সিলেক্ট করে সেট বসাতে হবে। তারপর শুটিং।
আপুর বাসায় তাথৈয়ের দিন রানির হালে কাটছে। আপু তাকে কিছু করতেই দিচ্ছে না। বরং একটু পরপর খাওয়ার জন্য এটাসেটা এনে দিচ্ছে। এখানে এক সপ্তাহ থাকার পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তাথৈ নিজেকেই হয়তো চিনতে পারবে না। এত মুটিয়ে যাবে!
কয়দিন ধরেই দেখা করার জন্য হাফসা পাগল করে দিচ্ছে। অনেক দিন ধরে দেখাও হয় না। তাথৈ ঠিক করেছে আজ নয়তো কাল পাগলটার সাথে দেখা করবে। বড়সড় একটা ট্রিটও দিবে।
—-
আয়েশা, মিম দু’জনেই তাথৈকে নিয়ে শপিংয়ে যাবে ঠিক করল। একটা বিষয়ে তাথৈয়ের কৌতূহল জাগলে আয়েশাকে জিজ্ঞেস করল,
-আপু দুলাভাই দেশে থাকেন না? আমাদের বিয়ের সময়েও উনাকে দেখিনি। এখনও বাসায় আসেন না।
স্বামীর প্রসঙ্গ উঠতেই আয়েশার চেহারার ভাব পাল্টে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-নূর খুব ছোট থাকতেই ওর বাবা মারা গেছে।
এব্যাপারে তাথৈয়ের কোন ধারণাই ছিল না। সে জানতো না দুলাভাই এই পৃথিবীতে নেই। আপুর বয়স কত হবে? এ বয়সেই আপুকে জীবনের সবথেকে বড় শোকটা পেতে হলো। তাথৈ পেছন থেকে আয়েশাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-সরি আপু। আমি সত্যিই জানতাম না। আপনি প্লিজ মন খারাপ করবেন না।
আয়েশা তাথৈয়ের হাত ধরে ওকে সামনে নিয়ে এসে মুখে হাসি নিয়ে বলল,
-ওর কথা বলতে কখনোই আমার মন খারাপ হয় না। ওকে নিয়ে কথা বলতে বরং আমার ভালো লাগে। জানো তো তাথৈ, ওর সাথে আমার এত সব সুখের স্মৃতি আছে যে, ওসব ভেবেই আমি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারব।
-দুলাভাই আপনাকে অনেক ভালোবাসতো, না?
-অনেক বেশি। পৃথিবীতে খুব কম স্বামীই হয়তো তাদের স্ত্রীকে এতটা ভালোবাসা ও সম্মান দিতে পারে।
তাথৈ কী বলে আপুকে সান্ত্বনা দিবে ভেবে পাচ্ছে না। সে শুধু শক্ত করে আপুকে জড়িয়ে ধরে রাখল।
-আমার ভাইটাও কিন্তু তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে।
এই কথা শুনে কেনই যেন তাথৈয়ের কান্না পেলো। সে আপুকে বলতে পারল না তাদের মধ্যে কোন ভালোবাসা নেই। কান্না চেপে তাথৈ মনে মনে বলল,
-উনি আমাকে ভালোবাসেন না আপু। উনি হয়তো সারাজীবন আমার সাথে থাকতেও চাইবেন না। আমিই বোকা। সম্পর্কটা মিথ্যে জেনেও কেন যে মানুষটার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছি! ওই মানুষটা তো আমাকে চায় না।
—-
প্রায় একমাস পর বান্ধবীকে দেখে খুশিতে হাফসা তাথৈকে ধরে ঘোরাতে লাগল। হাফসার এমন কাণ্ডে মানুষ তাদের দেখছে।
-পাগলের বাচ্চা কী করছিস? মানুষ কী ভাবছে?
-যা ভাবতে চায় ভাবতে দে। মানুষের ভাবনা দিয়ে আমাদের কী?
সত্যিই তাদের কিছু না। তাথৈয়ের একটা ভয় ছিল মানুষ হয়তো তাকে চিনে ফেলবে। কিন্তু মাস্কের উপর দিয়ে দেখে কেউ তাকে চিনছে বলে মনে হচ্ছে না। দু’জন একটা টেবিল নিয়ে বসে পড়ল।
-ভেবেছিলাম বান্ধবী নায়কের বউ হয়েছে এর সুবিধা ভোগ করব। কিন্তু এখন দেখি সুবিধা থেকে অসুবিধাই বেশি।
-জীবনের তেরোটা বেজে গেছে বান্ধবী। ওই বেটার পাগল মেয়ে ভক্ত গুলো আমাকে নিয়ে যে হেইট কমেন্ট গুলো করে তা দেখলে তিনদিন গলা দিয়ে ভাত নামে না। আমি যেন এদের স্বামীকে বিয়ে করে সতীন হয়ে বসে আছি।
-সেলিব্রিটি লাইফ মোটেও সহজ না বান্ধবী।
-তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
-তোর নায়ক কবে ফিরবে?
-জানি না। কী খাবি অর্ডার দে তাড়াতাড়ি। ভুলেও কেউ আমাকে চিনে ফেললে জীবন নিয়ে টানাটানি লেগে যাবে।
-হ্যাঁ হ্যাঁ।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে দু’জন এবার শপিংমলে যাবে। আপু বললেও তাথৈ আজ গাড়ি নিয়ে আসেনি। দুই বান্ধবী হাত ধরাধরি করে রাস্তা পেরুচ্ছে। এমন সময় ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর তাথৈয়ের ফোন বাজতে শুরু করল। রাস্তার এপাশে এসে তাথৈ ফোন বের করে দেখল অচেনা নাম্বার। হাফসা জিজ্ঞেস করল,
-কে, তোর নায়ক?
-এক ছাগল বান্ধবী। ছাগলটা জ্বালিয়ে মারছে। আটটা নাম্বার ব্লক করেছি। তবুও পিছু ছাড়ছে না।
-দে তো শালার আক্কেল ঠিক করে দিই।
তাথৈ ফোনটা হাফসাকে ধরিয়ে দিল। হাফসা প্রথমেই কিছু গালি ছাড়ল। তারপর যত কঠিন বাক্য বলা যায় সব বলল। তবুও ওপাশের লোকটার বিন্দুমাত্র লজ্জা হলো বলে মনে হলো না।
-এ কোন গন্ডারের পাল্লায় পড়েছিস দোস্ত? এত কথা শোনালাম। সব যেন চামড়ার উপর দিয়ে গেল। তুই-ই কথা বল।
তাথৈয়ের এখন মেজাজ খারাপ করার কোন ইচ্ছে নেই। তাই কল কেটে ফোন অফ করে ব্যাগে রেখে দিল।
যে বান্ধবী ত্রিশ টাকা প্লেট ফুচকা খাওয়ানোর নাম শুনলে ত্রিশ বার হার্ট অ্যাটাক করতো সে আজ সাত হাজার টাকার শপিং করে দিয়েছে! হাফসা খুশির থেকে বেশি শকই পেয়েছে। বিয়ের পর এই ফকিন্নির মন এত বড় হয়ে যাবে জানা থাকলে আরও আগেই বিয়ে দিয়ে দিত।
তাথৈ বাড়ি এসে জানতে পারল অভয় নাকি কল করে তার খোঁজ করতে করতে পাগল করে দিচ্ছে। আয়েশা যখন জিজ্ঞেস করল,
-তোমার ফোন অফ কেন ছিল তাথৈ?
তাথৈয়ের তখন মনে পড়ল সে ফোন বন্ধ করে রেখেছিল। জিভ কামড়ে তাড়াতাড়ি করে ব্যাগ থেকে ফোন বের করল। আপুর সামনে সত্যিটা বলতে পারবে না। তাই বলল,
-মনে হয় চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল।
-এদিকে তোমার বর কলের উপর কল করে জানার জন্য পাগল হয়ে গেছে তার বউয়ের কিছু হলো কি-না।
-আমি রুমে গিয়ে ফোন চার্জে দিই।
-তাড়াতাড়ি যাও।
তাথৈকে ছুটে যেতে দেখে আয়েশা হাসল। সাথে স্বস্তিও পেলো। অবশেষে তার ভাইটার একটা গতি হয়েছে। মিতু চলে যাওয়ার পর আয়েশা ভেবেছিল তার ভাইয়ের জীবনে হয়তো কোনদিনও ভালোবাসা আসবে না। ভালোবাসা এসেছে। তাথৈয়ের রুপ নিয়ে।
চলবে
#যতনে_রাখিবো
Jerin Akter Nipa
২৬
শুটিং শুরু হয়ে গেছে। ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটছে অভয়ের। ব্যস্ততা যতই থাকুক তারপরও তাথৈয়ের সাথে কথা বলার সময় ঠিকই বের করে নেয়। অচেনা একটা নাম্বার থেকে কল এলে অভয় প্রথমে তুললো না। রুমে এসে মাত্রই ফ্রেশ হয়েছে। খাওয়াদাওয়া সেরে তাথৈয়ের সাথে কথা বলে ঘুমিয়ে যাবে। এর মাঝে অচেনা নাম্বারটা ভীষণ যন্ত্রণা দিচ্ছে। মাথা মুছতে মুছতে অভয় কল রিসিভ করে বলল,
-হ্যালো।
-কোথায় থাকেন আপনি? কল তুলতে এত সময় লাগে কেন? বিরক্ত হলে বলে দিবেন আর কলই করবো না।
অভয় ভ্রু কুঁচকে ফোনের স্ক্রিনে দেখল। এটা তো তাথৈয়ের নাম্বার না। কিন্তু কন্ঠ তো তাথৈয়েরই।
-কার ফোন থেকে কথা বলছো?
-আমার ফোন। অন্য কারো ফোন দিয়ে কথা বলতে যাব কোন দুঃখে?
-তাহলে কি নাম্বার চেঞ্জ করেছ?
-হ্যাঁ। এখন থেকে এই নাম্বার থেকেই কল দিব।
-হঠাৎ করে সিম চেঞ্জ করার কারণ?
-সুপারস্টারের বউ হওয়ার দুর্গতি। ওসব কথা বাদ দিন। কী করছেন এখন?
-শাওয়ার নিয়ে বেরুলাম।
-খেয়েছেন?
-এখন খাবো।
-নূর আপনাকে ভীষণ মিস করছে। জানতে চাচ্ছে কবে ফিরবেন?
শুধু যে নূর মিস করছে এটা পুরোপুরি সত্য না। মিস তাথৈও করছে। কিন্তু নিজের কথা কি আর বলা যায়?
-ফিফটি পার্সেন্ট শ্যুট শেষ। বাকি কাজ শেষ করে দ্রুতই চলে আসবো।
-হুম। ওহ, যে কথা বলতে কল দিয়েছিলাম। কাল আমি আপুর, মানে আমার বোনের বাসায় যাচ্ছি।
অভয় নিঃশব্দে হাসল। প্রথম দিকের ঘাড়ত্যাড়া তাথৈকে মাঝে মাঝে মিস করে অভয়। তখন তাকে কিছুই বলার প্রয়োজন মনে করত না। নিজের খুশি মতো চলতো। এখন যা করে বলে করে।
-আচ্ছা যেও।
অভয়ের সাথে কথা বলার সময়ই অন্য একটা নাম্বার থেকে কল আসছিল। তাথৈ ভেবে পেলো না কিছুক্ষণ আগে অন করা সিমের নাম্বারটাও কে জেনে গেল? তাথৈ কল তুলে বলল,
-হ্যালো। কাকে চান?
-আপনাকে।
-মানে? ফাজলামি কথা বলার জন্য কল দিয়েছেন? কে বলছেন শুনি?
-ভেবেছিলেন সিম চেঞ্জ করে ফেললেই আমি আপনাকে আর খুঁজে পাবো না?
এটা ওই লুচ্চা বুঝতে পেরে তাথৈয়ের নিজের মাথাই বারি দিয়ে ফাটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কপালে হাত দিয়ে তাথৈ বলল,
-এই নাম্বারটাও তুই জেনে গেছিস! কিন্তু কীভাবে? সত্যি করে বল তো তুই কে? আমার চেনাজানা কেউ? এই তুই রনি নয়তো?
– রনিটা কে? এই ছেলেও তোমাকে কল করে?
-তুই নিজে রনি হয়ে এখন নাটক করছিস! হারামজাদা কুত্তা।
-তোমার মুখ থেকে এসব কথা শুনতে বড্ড কিউট লাগে। তবে তুমি এই জায়গায় ভুল করছো। আমি কোন রনি না।
-রনি না?
-না।
-তাহলে কে তুই? এক বাপের বেটা হলে নাম বল।
-সামির।
-কে সামির?
-তুমি আমার নাম জানতে চেয়েছিলে না? আমার নাম সামির।
সামির! এই নামের কাউকে চেনে সে? উঁহু। তাথৈ বরং এই নাম আজই প্রথম শুনেছে।
-আমি কোন সামিরকে চিনি না। কে তুই? আমাকে কেন বিরক্ত করছিস? তোর জন্য কি এখন আমি ফোন চালানোই বন্ধ করে দেব?
-এমনটা কোরো না প্লিজ। তোমার সাথে কথা বলতে না পারলে আমি দম বন্ধ হয়ে মরে যাব।
তাথৈ সত্যিই আর এই প্যারা নিতে পারছে না। গত একটা মাস ধরে হাজারটা নতুন নাম্বার থেকে কল দিয়ে তাকে রীতিমতো মানসিক টর্চার করছে। তবুও এর শান্তি হচ্ছে না। তাথৈ খুব শান্ত স্বরে বলল,
-দেখ ভাই, আমি জানি না তুই কে। আমার সম্পর্কে তুই কতটা জানিস এটাও জানি না। কিন্তু তুই বিশ্বাস কর তোর প্রতি আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই। আমি একজন বিবাহিতা মেয়ে। আমার স্বামী আছে। আমার পেছনে সময় নষ্ট করে কোন লাভ নেই।
-তুমি বিবাহিতা হলেও আমার কোন সমস্যা নেই।
তাথৈ এত সুন্দর করে বোঝানোর পর এই উত্তর মোটেও আশা করেনি। রাগে তার মাথা দপ দপ করছে। কোন মানুষ কীভাবে এতটা বেহায়া হতে পারে? তার বিয়ে হয়ে গেছে জেনেও বলছে কোন সমস্যা নেই। রাগে তাথৈ যে গালি গুলো দিল তা লিখার উপযোগ্য নয়।
——
ছবির কাজ অলমোস্ট শেষের দিকে। সামনের সপ্তাহেই দেশে ফিরবে। তিন মাস খুব বেশি সময় না হলেও অভয়ের মনে হচ্ছে সে তিন যুগ ধরে বাড়ি থেকে দূরে আছে। তিন মাসে তাথৈয়ের সাথে একবারও ভিডিও কলে কথা হয়নি। তাথৈ নিজে থেকে কখনও ভিডিও কল দেয়নি। অভয়ও বলতে পারেনি। অভয়ের প্রার্থনা এই সাতটা দিন তাড়াতাড়ি কেটে যাক।
—–
তানিয়া লক্ষ্য করেছে তাথৈ কারো সাথে ফোনে কথা বলার সময় খুব খারাপ ব্যবহার করে। অভয়ের সাথে কি ওর কোন সমস্যা চলছে? বলা যায় না। এই মেয়ের সাথে কোন বিশ্বাস নেই। তাই তানিয়া একদিন সরাসরিই জিজ্ঞেস করে ফেলল,
-অভয়ের সাথে কি তোর কোন ঝামেলা চলছে?
বোনের প্রশ্নে অবাক হয়ে তাথৈ চটপট জবাব দিল।
-কই না তো? কেন জিজ্ঞেস করছো?
-তাহলে কার সাথে কথা বলার সময় এমন গালিগালাজ চেঁচামেচি করিস?
তাথৈ এতদিন কাউকে জানায়নি। কিন্তু আজ আপুকে সবটা বলে দিল। সব শুনে তানিয়া জিজ্ঞেস করল,
-অভয়কে জানিয়েছিস?
-না।
-জানাসনি কেন? যদিও তোর কোন দোষ নেই। কিন্তু ধর, অভয় যদি অন্য কোনভাবে বিষয়টা জানতে পারে তখন কি…
তানিয়ার কথার মাঝেই তাথৈ বলে উঠল,
-আমাকে ভুল বুঝবেন? কেন? আমি কি কোন অন্যায় করেছি?
তানিয়া চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলল,
-আমি বলেছি তুই অন্যায় করেছিস? তবুও স্বামী স্ত্রীর মাঝে কোন কিছুই গোপন থাকা ভালো না। দু’জনই যখন দু’জনের সব বিষয়ে জানবি তখনই তো সম্পর্কটা আরও মজবুত হবে।
-দুলাভাইকে তুমি সব বলো?
-অবশ্যই বলি।
-অদরকারি কথাও বলো?
-সারাদিনের সব কথা তোর দুলাভাইকে না জানানো পর্যন্ত আমি রাতে ঘুমাতে পারি না। বেচারা শুনতে না চাইলেও বলি।
তাথৈ ভেবে নিলো সে-ও অভয়কে সব জানিয়ে দিবে। তবে এখন জানানোটা ঠিক হবে না। এমনিতেই উনার কাজের কত চাপ। তার উপর এটা একটা বাড়তি টেনশন হয়ে যাবে। দেশে ফিরলেই জানাবে বরং।
—–
আপু ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকায় তাথৈ বাবাইকে স্কুল থেকে নিতে এসেছে। দেখা যাচ্ছে বাবাইয়ের স্কুলেও তাকে অনেকেই চেনে। চেনাটা অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু তার কাছে অটোগ্রাফ চাওয়া এটা কতটা স্বাভাবিক ঘটনা? সে কি এক দুইটা মুভি করেছে? নাকি নায়কের বউ হয়ে নায়িকা হয়ে গেছে। বাঙালির আবেগের শেষ নেই।বাবাইকে নিয়ে কোনরকম পালিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে এসে বাঁচল। বাবাই অবশ্য বেশ খুশি। সব বন্ধুর মায়েরা কেমন তার খালামনির সাথে ছবি তুলতে চাচ্ছিল। খালামনির হাত ধরে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বাবাই বলল,
-খালামনি তুমি কি নায়িকা হয়ে গেছো?
-আরে নারে বাপ! আমার নায়িকা হওয়ার কোন শখ নেই।
-তাহলে সবাই তোমার সাথে ছবি তুলতে চাইল কেন?
-সব আমার কপালের দোষ রে বাবা।
-শুনুন। শুনুন, একটু দাঁড়াবেন প্লিজ।
পেছন থেকে কারো ডাক শুনে তাথৈ দাঁড়িয়ে পড়ল। তাকে কেউ ডাকছে? মনে তো হচ্ছে তাকেই ডাকছে। তানিয়া আপুর বয়সী একজন মহিলা। ডান হাতে বাবাইয়ের বয়সী একটা ছেলের হাত ধরা। হয়তো মহিলার ছেলে। এই মহিলাও কি তার অটোগ্রাফ চায়! হায় কপাল! মহিলাটি তাথৈয়ের সামনে এসে মুগ্ধ চোখে ওকে দেখে যাচ্ছে। তাথৈ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এই মহিলা তাকে এভাবে দেখছে কেন? গলার কম্পন লুকাতে পারছে না মিতু। স্কুলে সবার মুখে তাথৈয়ের কথা শুনে ছুটে বেরিয়ে এসেছে।
-আপনি কি আমাকে কিছু বলবেন?
-আপনার নাম তাথৈ?
-জি।
-সা…না মানে, আপনি অভয় খানের ওয়াইফ?
তাথৈ থেমে থেমে জবাব দিল,
-জি।
-আমি কি আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি?
অ্যাহ! এটা কেমন আবদার ভাই? ছবি তোলা বাদ দিয়ে সোজা জড়িয়ে ধরা! মিতু তাথৈয়ের অনুমতি পাওয়ার অপেক্ষা করতে পারল না। তার আগেই তাথৈকে জড়িয়ে ধরল। হতভম্ব তাথৈ ভেবে পেলো না তার এখন কী করা উচিত। আচ্ছা মহিলাটা কি মৃদু কাঁপছে? উনি কি অসুস্থ? তাথৈকে জড়িয়ে ধরে মিতুর আনন্দ হচ্ছে। সাথে বুকের ভেতর সামান্য কষ্টও হচ্ছে। অবশ্য একজনের খুশির সামনে তার এই কষ্ট হাসি মুখে আপন করে নিবে। মিতু তার চোখের পানি মেয়েটাকে দেখাতে চায় না। তাই চোখ মুছে নিয়ে তাথৈকে ছেড়ে লজ্জিত মুখে হাসল। কৌতূহল ও আতঙ্ক মিশ্রিত চোখে বাবাই তাকিয়ে দেখছে এই আন্টি তার খালামনির সাথে কী করছে? মিতুর ছেলের অবাক চোখে মা’কে দেখছে। মা ওই আন্টিকে কেন জড়িয়ে ধরেছে? মেয়েটা তার আচরণে যথেষ্টই হকচকিয়ে গেছে বুঝতে পেরে মিতু ক্ষমা চেয়ে বলল,
-আপনাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দেওয়ার জন্য আমি মন থেকে ক্ষমা চাচ্ছি। আপনি কি রাগ করেছেন?
মেয়েটার ব্যবহার যথেষ্ট মার্জিত। অন্যদের মতো টক্সিক আচরণ করেনি। তাথৈ হেসে বলল,
-রাগ করিনি। আপনি কি আমাকে চেনেন?
-আপনাকে কে না চিনে বলুন তো!
তাথৈ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলল,
-এটাই তো সমস্যা। সবাই চেনে। কেউ না চিনলেই বোধহয় ভালো হতো।
তাথৈয়ের ফোনে কে যেন কল করছে। এদিকে বাবাইও বাড়ি যাবার জন্য হাত ধরে টানাটানি করছে। এসব দেখে মিতু আর সময় নিলো না। সে ছেলেকে নিয়ে ফিরে যেতে ধরল। আন্টিটা চলে গেলে বাবাই জিজ্ঞেস করল,
-খালামনি উনি কে?
মিতুর ছেলেও মাকে জিজ্ঞেস করছে,
-আম্মু তুমি ওই আন্টিটাকে কীভাবে চেনো?
মিতু ছেলের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে পেছন থেকে তাথৈ ডেকে বলে উঠল,
-শুনছেন? আপনার নামটা বলে যাবেন?
মিতু পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল,
-আমার নাম মিতু।
চলবে