যেখানে পথচলা শুরু পর্ব-১৫+১৬

0
265

#যেখানে_পথচলা_শুরু |১৫|
#সাদিয়া_মেহরুজ

দূর্বাঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে অরোন। দুই ঠোঁটের মাঝ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে তাজা র ক্ত! লম্বা লম্বা শ্বাস টানছে শ্বাসকষ্টের রোগীদের মতো। চোখ দু’টো কি ভীষণ লাল হয়ে! দেখে মনে হবে যেন রক্ত জমে রয়েছে। শরীর অসাড়! ঝিঁঝি পোকার ডাকে মুখরিত তখন কানন। পশ্চিমাকাশে আগুন লেগেছে। সিঁদুর রাঙা মেঘের পদচারণ অম্বর জুড়ে। বাতাবরণ বাড়ে বাড়ে বলছে, সন্ধ্যা নামবে, এক্ষুণি! বাতাস বইছে। বাতাসে মিশে রয়েছে বুনো ফুলের ঘ্রাণ। বিশাল কানন তখন স্তব্ধ! অরোন চোখ খোলার চেষ্টা করে। হয়না! তীব্র যন্ত্রণায় খিঁচে বন্ধ করে নেয় আঁখিজোড়া।

-” অরোন, অরোন। ”

হুবহু মায়ের কণ্ঠস্বর! কাজ হলো এবার। অরোন ঝট করে চোখ খুলে তাকাল। আহত দেহটাকে টেনে তুলে উঠে বসল। তাকাল চারিপাশে। ভীষণ কাতর গলায় ডাকল,

-” মা, মা। ”

সাদা, লালের মিশেল জামদানী পরিহিত একজন ভদ্রমহিলা। ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। অরোনের ঠোঁটের কোণের হাসি চওড়া হলো! অক্ষিকোটরে ইতিমধ্যে জায়গা দখল করে নিয়েছে অশ্রুমালা। ভদ্রমহিলা এসে পাশে বসলেন অরোনের। বললেন,

-” এতো অল্পতেই ভেঙে পড়ছো কেন বাবা? তুমি তো এমন নয়! ”

কপাল চুইয়ে রক্তের স্রোত এসে পড়ল চোখের ঘন পাপড়ির ওপর। অরোন পল্লব ঝাপ্টাল। একবার, দুইবার। চট করে ও শুয়ে পড়ল মায়ের কোলে। প্রাণ ভরে টানল নিঃশ্বাস। প্রশান্তির নিঃশ্বাস! অতঃপর বলল,

-” আমি আর পারছি না মা। আমার দাঁড়া আর হবে না। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তুমি কেন চলে গেলে মা? এভাবে আমায় একা করে চলে গেলে কেন? ”

মা অরোনের চুলে হাত বুলালেন। অরোন গাঢ় করে শ্বাস টানল! ইশ, মায়ের গা থেকে কি সুন্দর শিউলি ফুলের সুভাস আসছে।

-” বাবা, তুমি যে একটা নিষ্পাপ মেয়েকে অযথাই কষ্ট দিচ্ছো তা কি তুমি জানো? তীরুকে কেন কষ্ট দিচ্ছো অরোন? ”

ধপ করে চোখজোড়া বন্ধ করে নেয় অরোন। গাঢ় আঁধারে ভেসে ওঠে তীরুর স্নিগ্ধ মুখোশ্রী, কাজল কালো চোখ দু’টো। হৃদয়ে শীতলতা আসে তার। মন নরম হয়! অস্থিরতা, য ন্ত্র ণা কিয়ৎ কমে আসে। ও কন্ঠের খাদ নামিয়ে শুধায়,

-” ওকে আমি মেনে নিতে পারছিনা মা। তীরুকে আমি যতবার দেখি ততবারই মনে হয় আমি ভুল করেছি। ওর চোখ দু’টো যখনই দেখি তখনই মনে হয় ও আমার ওপর বিরক্ত, রাগান্বিত। মেনে নিতে পারছেনা। তাছাড়া এ সময়টাতে আমার কারোও দরকার ছিল না। তীরুর আচরণ অনেকটা তোমার মতো মা। ওর আমার প্রতি যত্নশীলতা একদম তোমার সাথে মিলে যায়। আমার তখন তোমাকে মনে পড়ে যায়। হুট করে চোখের সামনে ভেসে ওঠে তোমার র ক্তা ক্ত মুখ। ভায়োলেন্ট হয়ে যাই! হাসঁ ফাসঁ লাগে। চারিপাশের সবাইকে তোমার খু নী মনে হয়। নিজেকেও। আমার জন্যই তো তুমি আমার কাছে নেই। ”

-” এমন অপ্রকৃতস্থের মতো ব্যাবহার না করে আসল দোষীকে খুঁজে বের করো। শা স্তি দাও। দেখবে শান্তি পাবে। অতীত ভুলো অরোন! নয়ত কখনোই শান্তি পাবে না তুমি। নিজেকে, আশপাশের মানুষকে দোষারোপ করা বন্ধ করো। ”

অরোন চটজলদি উঠে বসে। মায়ের চোখে চোখ রাখে। অনুনয় যোগে প্রশ্ন ছুঁড়ে,

-” কে দায়ী মা? বলো। বাবা? ওরা বলে বাবা দায়ী। আমি, আমি এটা কখনোই মেনে নিতে পারবো না মা। বাবা এ কাজ কিছুতেই করতে পারে না। ”

সায়াহ্ন নেমেছে ধরনীর বুকে। নিষ্ঠুর আঁধার শুষে নিচ্ছে নভোমন্ডলের সকল আলো। বিলীন হওয়া আলোর মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে মায়ের প্রতিবিম্ব। তা দেখে চঞ্চল হয় অরোন। বার কয়েক শুধায়,

-” যেও না মা। যেও না। আমি একা থাকতে পারবো না। ”

প্রতিবিম্ব অস্পষ্ট। লহমায় ছায়া গায়েভ! আহত দেহ নিয়ে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায় অরোন। রক্তপাত বন্ধ হয়নি তখনো। হাঁটা ধরতেই লাঠিতে পা আঁটকে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। তপ্তশ্বাস ফেলে ও! আবারও, আবারও সে কল্পনায় ডুবে ছিল। মিথ্যে ছিল সবটা! মা আসেনি। আসবেও না কখনো। হৃদস্থল ক্ষত – বিক্ষত হয় অরোনের। পড়ে থাকে সেভাবেই। বাড়ি ফিরবে না আজ। রাতটা এখানেই কাটাবে। বাড়ি ফেরার ইচ্ছে বা শক্তি কোনোটাই নেই। এক্সিডেন্ট করে দেহের অবস্থা বেহাল!

শীতল বাতাস বইছে। ঠান্ডা বাতাসের প্রকোপে কাপল অরোন! নির্জীব বাতাবরণ তখন চেয়ে চেয়ে দেখল কেবল শক্তপোক্ত ছেলেটার চাপা আর্তনাদ। অরোনের চাপা চিৎকারে আকাশ – বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। গাছের ডালে বসে থাকা পেঁচাটাও তার ডাক বন্ধ করে দিয়েছে। মৌন রূপে শুনছে অরোনের আহাজারি!

_

এক ঝুমঝুমি বরষায়।

বৃষ্টি হচ্ছে! মুষলধারে বৃষ্টি। মেঘে ঢাকা পড়েছে আকাশ আজ চার দিন হলো। কাঠফাটা গরমের উত্তাপে পুড়ে ছারখার প্যারিসকে শীতল করতে বর্ষা এসেছে আজ দু’মাস প্রায়। বর্ষায় বিদায়ী বার্তা দিচ্ছে বাতাবরণ। তীরু বেলকনিতে দাঁড়িয়ে তখন। চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির গান শুনছে। মলিনতা ছাপানো মুখোশ্রী জুড়ে। এই মলিনতা এখন প্রায়সই দেখা যায়। তীরু বলে, সে তো এমনই! কিন্তু নাহ্! ঐ যে জীবনে একটা ঝড় এলো? তারপর থেকে সে এলোমেলো। কয়টা মাস গেল মাঝে যেন? উঁহু মাস নাকি বছর? তীরুর জানা নেই তা! তবে অরোনের সাথে বিচ্ছেদের অনেক – অনেকগুলো দিন কে টে গেছে। কাগজে কলমে বিচ্ছেদ নয় মনের বিচ্ছেদ। অরোনটা অবশ্য কম চেষ্টা করেনি তাকে মানাতে। বহু কাঠখড় পুড়িয়েছিল ছেলেটা। তীরুর রাগ ভাঙাতে সেই কি চেষ্টা! কিন্তু দিন শেষে হলো কি? মাঝখান থেকে অনেকগুলো দিন পেড়িয়ে গেলো কেবল। তীরুর অভিমান কমেনা, রাগ ভাঙেনা। কাজের কাজ কিচ্ছুটি হয় না! মেয়েটার মনে অভিমানের গাঢ় ছাপ বসেছে। অরোনের সেই আচরণটা তার মন থেকে মুছেই না কিছুতেই।

ধপাধপ পা ফেলে ইলি রুমে আসলো। তীরুকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লম্বা শ্বাস ফেলে কদম বাড়াল। কাছাকাছি গিয়ে বলে উঠলো,

-” কি করবে ভেবেছ কিছু? ”

চমকে পিছন তাকাল তীরু! জিজ্ঞেস করলো,

-” কি করবো বলতে? অরোন এসেছিল নাকি? ”

ইলি কফির মগ বাড়িয়ে দিল। তীরু নিলো। নিজের কাপে চুমুক দিতে দিতে ইলি শুধাল,

-” উঁহু! তার তো খোঁজ নেই বহুদিন। এদিকে আর দেখিনা। উইলির থেকে নাকি তোমার খোঁজ – খবর নেয়। আমি বলছিলাম জবের কথা। পড়াশোনাতো শেষ। কি করবে? ”

তীরু সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না। কিয়ৎক্ষণ শূন্যে চেয়ে থাকল। আপনমনে বিড়বিড়াল,

-” ছয় মাস হয়েছে তবে বিচ্ছেদের। ”

ইলি ভ্রু কুঁচকায়, ” কি বিড়বিড় করছো টীরু? ”

-” উহ্ নাথিং! ভার্সিটি না কোম্পানিতে জয়েন হবো ভাবছি। এপ্লাই করেছি। দেখি ডাকে কিনা। তবে মেইবি পজেটিভ রেসপন্স আসবে। ”

ইলি হৃষ্টচিত্তে বলে উঠলো,

-” তাহলে তো ভালই! অগ্রিম শুভকামনা। ”

এলোমেলো ধোঁয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দেয় তীরু, তাকায় বাহিরে। বৃষ্টির তেজটা কমেছে। ম্যাপল ট্রির পাতা বেয়ে পড়ছে বৃষ্টির পানি। সুন্দর লাগছে তার দেখতে। তীরুর মতিগতি দেখে ইলি বুঝতে পারে, মেয়েটার সাথে আর কথা হবে না। সে এখন নিজ ভাবনায় ডুবে থাকবে। উঠে বেড়িয়ে যেতে যেতে ও বলে,

-” জীবনের তো একটা দিক হলো। এবার ঐ ছেলেটা কে একটু দেখো। আর কতো টীরু? ছেলেটা মাফ চাচ্ছে তো ছ’মাস যাবৎ। এতো অভিমান ভালো না”

তীরু আনমনে বাহিরে তাকিয়ে থাকে। বলেনা কিছু। সে যে বাড়াবাড়ি করছে! কিন্তু কি করার? মন যে মানে না। বারংবার অন্তরাল শুধায়, ” পাষাণ, নি ষ্ঠু র ছেলেটার হতে দূরত্বই শ্রেয়। ”

বিচ্ছেদের ছ’মাস! অরোন কি ছ্যাচড়ার মতো তীরুর পেছনে ঘুরেছে কেবল? নাহ্! ছ’মাসে বহু ঘটনা ঘটেছে। দু’জনের জীবনেই ছিল তুমুল ব্যাস্ততা। রাত ছাড়া তীরুর দেখা মিলত না হোস্টেলে। ভার্সিটি, জব এতেই সময় কাটাতো। ছমাসের কয়েকমাসই তো এমন উধাও ছিল তীরু! অরোন হতাশ হয়ে ঘুরে যেত। যখন দেখা হতো ভাবত, এখনই বলে দেবে সবটা! কিন্তু কিসের যেন জড়তা, সঙ্কোচ। হয় না আর বলা। তীরুকে নরম গলায় মানাতে চেষ্টা করে, হয়না। ক্লান্ত অরোন! ক্ষমাপ্রার্থী তো সে। মেয়েটা কেন বোঝে না? সবকিছু বলতে চায়, তীরু তো দেয় না তাকে সময়। মেয়েটার কি ঝাঁঝ! ফটাফট কঠিন কথা বলে অরোনকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। পারিপার্শ্বিক যন্ত্রণা তার ওপর তীরুর এহেন আচরণ অরোনের জীবনটাকে ন র ক করে তুলেছে। দিন শেষে এখন তার একটা কথাই মাথায় ঘুরপাক খায়,

” Being an introvert is a curse. ”

চলবে~

#যেখানে_পথচলা_শুরু |১৬|
#সাদিয়া_মেহরুজ

২২শে এপ্রিল, ২০১৩

মধ্যদুপুর। মোহনপুর গ্রাম তখন স্তব্ধ প্রায়। দুপুরে সবাই খাওয়াদাওয়া করে ভাত ঘুম দিচ্ছে। জাঁকাল রোদ্দুরের মাঝে সেসময় একাকী মাঠে কাজ করছে তখন বার বছর বয়সী কিশোর যার নাম অরোন। ও বাদে ধানক্ষেতে কেওই নেই। বিরান চারিপাশ। কড়া রোদে গা পুড়িয়ে অরোন কাজে ব্যাস্ত তখন। এখন না কাজ করলে বিকালে তার পড়া হবে না। পড়া বাদ দিয়ে কাজে আসতে হবে। কাজ বাদ দিলে তার ঘরে খাবার জুটবে না! সে কথা মাথায় রেখেই শত য ন্ত্র ণা চেপে রেখে অরোন একা একাই কাজ করছে। পেটে ক্ষুধা!তীব্র ক্ষুধা চেপে রেখে আপনমনে কাজে ব্যাস্ত ও। কাজ অ – সমাপ্ত ফেলে গেলে বাড়ি গেলে তার খাবার জুটবে না। বাবা কিছুতেই খেতে দেবেন না। সকালেও দেরীতে ঘুম থেকে ওঠার শাস্তিস্বরূপ বাবা খেতে দেননি। পরে অবশ্য মেঝ আপা তাকে চিড়ামুড়ি দিয়ে গিয়েছিল খানিকটা। কিন্তু এতোটা খাটুনির পর অতটুকুতে কি আর পেট ভরে?

যথাসময়ে আছরের আজান পড়তেই কাজ শেষ হলো অরোনের। চটজলদি পুকুর থেকে হাত – মুখ ধুয়ে সে ছুটল বাড়ির পথে। সারাটা দিন রোদে থেকে মাথা ঘুরছে। হাঁটতে গেলেই পড়ে যাচ্ছে এঁকেবেকেঁ। বিশ মিনিটের পথ শেষে বাড়ি পৌঁছাল অরোন। ঘর ফাঁকা, উঠোনে কেও নেই। পুরো বাড়িটায় কেমন গা ছমছমে নীরবতা। অরোনের কেমন যেন লাগল। ও ডাকল হাকঁ ছেড়ে,

-” মা, মা। ”

প্রতিক্রিয়াহীন! প্রতিত্তুর করলো না মা। কি আশ্চর্য! মা তো কখনো তার ডাকে না সাড়া দেননি। তবে আজ কি হলো? মা কি বাড়িতে নেই? এসময় তো বাবা আসে। মা’র তো বাড়িতেই থাকার কথা। আর বোনেরাই – বা কোথায়? অরোন দুরুদুরু বুকে পা ফেলল। ঘরের ভেতর প্রবেশ মাত্রই সামনে দৃশ্যমান হলো মায়ের ক্ষতবিক্ষত লা শ! বিকেলের মরা রোদ এসে মায়ের র ক্তা ক্ত দেহের ওপর পড়েছে। অরোন কিংকর্তব্যবিমুঢ়! টের পেল কেও তার গলা চেপে ধরে রয়েছে। বক্ষপিঞ্জরে খঞ্জন দিয়ে আ ঘা ত করছে। ডুকরে কেঁদে উঠল অরোন। মুখ থুবড়ে পড়ে রইল ভূমিতে। হামাগুড়ি দিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে কোলে নিল তার মাথা। গালে হাত দু’টো আলত করে রেখে শুধাল,

-” মা, আমার মা। কি হয়েছে মা? তোমার গায়ে র ক্ত কেন মা? মা কথা বলো না মা! ”

স্কুলে একবার পালর্স রেট মাপা শিখিয়েছিল রেনু আপা অরোনকে। অরোন তৎক্ষনাৎ মায়ের পালর্স রেট চেক করলো। নাকের কাছে আঙুল দিয়ে শ্বাস পর্যবেক্ষণ করলো। সবশেষে মায়ের শীতল, বরফের মতো দেহটা তাকে বলে দিল নি ষ্ঠু র সত্যটা! কান্না বন্ধ হলো তার। পাথরের মতো তাকিয়ে থাকাকালীন বলে উঠলো,

-” পড়াশোনা করে অনেক বড় মানুষ হয়ে তোমাকে নতুন শাড়ী কিনে দিব বলেছিলাম মা? তুমি নতুন শাড়ী পড়বে না? মা, আমি যে কম টাকা পাই। এর জন্য যে তুমি পেট ভরে ভাত খেতেও পারো না তার জন্য কষ্ট পেয়ে চলে গেলে মা? আমার কত স্বপ্ন ছিল মা। একদিন অনেক টাকা ইনকাম করে তোমাকে পেট ভরে খাওয়াব। তোমার সব কষ্ট দূর করব মা। তুমি আমাকে এই সুযোগটা দিলে না। মা, মারে! আমি আর কোনোদিনও তোমার কাছে বেশি ভাত খেতে চাওয়ার জন্য কান্না করবো না মা। তুমি উঠো একটু। আমাকে একটু জড়িয়ে ধরো মা, আমি আর কিচ্ছু চাইনা। উঠো না মা। ”

অরোন বিলাপ ব ক ছে! জোরে জোরে শ্বাস টানছে। তার ছোট্ট মনটা এতো বড় চাপটা আর সামলাতে পারল না। ধপ করে মাটিতে চোখ বন্ধ করে লুটিয়ে পড়ল ও। সেদিন এভাবেই অরোনের মা তাকে ছেড়ে চলে যায়। তাকে কে মা র লো? এটা একটা রহস্যই রয়ে গেল কেবল।

_

১২ই জুন, ২০৩০।

ভেজা মাটি। কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই বৃষ্টিতে স্নান করেছে প্যারিস। আবহাওয়া শীতল। সমীরে তখন ছুটছে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। আকাশ’সম দৈত্যের মতো গাছগুলোকে সজীব দেখাচ্ছে বেশ। সাইকেলিং এর মাঝে মাঝে আশপাশটা সুক্ষ্ম চোখে পরখ করতে করতে এগোচ্ছে তীরু। সে প্রায় শহরের শেষদিকে এসে গিয়েছে। এদিকটায় তেমন বাড়িঘর নেই বলা যায়। ঘন জঙ্গল, দৈত্যসম গাছপালার রাজত্ব চলে এখানটায়। অবসরে জঙ্গলে সময় কাটানোর ভারী ইচ্ছে ছিল তার। তাছাড়া সামনে তার বেশিরভাগ সময়ই এই জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরেফিরে কাটবে তাই আগে থেকে অভ্যাস করে নেওয়া ভালো নয় কি?

নির্দিষ্ট স্থানে সাইকেল থামাল তীরু। কাঁধের ব্যাগটা ভূমিতে অবহেলায় ফেলে রেখে দু-হাত দুই দিকে মেলে লম্বা শ্বাস টানল। কি শান্তি! কি সুখ যে মিশে রয়েছে প্রকৃতিতে। সৃষ্টিকর্তার এক অপরূপ সৃষ্টি এই প্রকৃতি। যার সৌন্দর্যে ডুবে থেকে আজীবন কাটিয়ে দেয়া যায়। সামনে ‘ রেস্ট্রিক্টেড এরিয়া ‘ সাইনবোর্ড ঝুলানো। ওদিকটায় একবার তাকিয়ে তীরু দৃষ্টি ফেরাল। ওমনি চমকাল ও, ভীষণ! বিড়বিড় করে আওড়াল,

-” যার পিছু ছাড়াতে আমি ছন্নছাড়া হয়ে ঘুরি তার সাথে বারবার কেন দেখা হয়ে যায় আমার? গড! ”

অরোন মন দিয়ে ড্রাইভিং এ ব্যাস্ত। খানিকটা দ্রুতই ড্রাইভ করছে। সন্ধ্যার পূর্বেই এ জায়াগাটা পাড় হতে হবে। লোক মুখে শুনেছে এখানে বন্যপ্রাণীর বিস্তার বেশি। হুটহাট সামনে চলে আসে। মানুষের ওপর হা ম লা ও করে বসে! সরকার খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে না এদের। কারণ এটাই তো তাদের বাসস্থান। এই সড়ক ব্যাবহার শিথিল করা হয়েছে। তবুও অনেকে দ্রুত বাড়ি ফিরতে এই সড়ক ব্যাবহার করে থাকে। পড়ে বিপদে পড়ে নিজেরাই।

ফাঁকা সড়কে একাকী তীরুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ব্রেক কষলো অরোন। ঝুঁকে মাথায় বাড়ি খেল ও।মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চটজলদি নেমে এলো গাড়ি থেকে। বকের মতো লম্বা কদম ফেলে তীরুর নিকট পৌঁছে জিজ্ঞেস করলো,

-” তীরু, এখানে কি করছো? ”

আরো একটা মাস! সাতমাসের মাঝে এখন তিন মাস পর দুজনের মুখোমুখি সাক্ষাৎ। এতদিন বলতে গেলে তীরু এদিক সেদিক ঘুরে বেড়িয়েছে। ফ্রান্স দেখা তার শেষ বললেই চলে।

-” হাওয়া খেতে এসেছি। ” তীরু জবাব দিল।

কপালে ভাজ ফেলে অরোন। পুনরায় প্রশ্ন ছোঁড়ে,

-” হাওয়া খেতে এখানে আসার কি প্রয়োজন? এই জায়গাটা কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা তুমি জানো? ”

চোখ দু’টো বড় বড় করে তীরু শুধাল,

-” ওহ তাই নাকি? আপনি না বললে তো আমি জানতামই না। অত্যান্ত ধন্যবাদ আমায় এ বিষয়ে অবগত করার জন্য। ”

-” হেয়ালি করো না তীরু। আমি কিন্তু সিরিয়াস। ”
শীতল গলায় বলে উঠলো অরোন।

তীরু হাই তুলল। ” হ্যা আপনিই তো এখানে একমাত্র সিরিয়াস বান্দা যে সব জানেন। সবজান্তা পাবলিক আপনি। ”

তীরুর হেয়ালিপনা গায়ে বিধঁছিল অরোনের। তবুও সে সহ্য করে নিল দাঁত চেপে। শীতল চোখে চেয়ে বলল,

-” আসো তোমাকে ড্রপ করে দেই। ”

তেতেঁ উঠল তীরু। বলল,

-” অন্ধ নাকি? আমার সাইকেল চোখে দেখেন না? একা এসেছি একা যাবো। ড্রপ করার কি আছে যান এখান থেকে। ” শেষের কথাটা ধমকের সহিত বলে তীরু।

-” তীরু! তুমি কি এখনো আমায় মাফ করতে পারো নি? আ’ম সরি! আর কতবার বলবো? ফিরে চলো বাসায়। আমাদের বাড়িতে। ”

-” সেই একই ডায়লগ। নতুন কিছু বলতে পারেন না আপনি? এক কথা শতবার শুনতে শুনতে কান পঁচে যাচ্ছে আমার। ”

তিতকুটে বিরক্তিটা চেপে তীরু বলল। অরোন শান্ত তখনও। নিশ্চুপ অরোনকে থম মে রে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাগটা বাড়ল তীরুর। ও হনহনিয়ে ছুটল জঙ্গলের ভেতর। পেছন পেছন ছুটল অরোন নিজেও। দু’জন ছোটার মাঝে খেয়ালই করলো না তারা ‘ রেস্ট্রিক্টেড এরিয়া ‘ তে প্রবেশ করে ফেলেছে!

-” তীরু প্লিজ ওদিকে যেওনা। ”

তীরু, অরোন ওরা দু’জন ছুটতে ছুটতে এসে পড়েছে অনেকটা দূরে। বেশিক্ষণ দৌড়ানোর ফলে পা ধরে এসেছে তীরু। ও থামল। হাঁটুতে দু-হাত রেখে লম্বা কয়েক শ্বাস টানল। ততক্ষণে অরোনও তার পিছু এসে দাঁড়িয়েছে। ক্লান্ত তীরুকে দেখে শুধাল,

-” অযথাই ছুটলে। এখন কষ্ট তো নিজেই পাচ্ছো। ”

তীরু কটমট দৃষ্টিতে তাকাল। বলল,

-” আপনি যাননি এখনও? অ স ভ্য লোক! ”

সায়াণ্হ নেমেছে। বাতাবরণে আলোর পরিমাণ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। অরোন চারপাশ দেখে আতঙ্কিত হলো অন্তরালে। সে একা হলে সমস্যা ছিল না কিন্তু সঙ্গে যে তীরু!

-” ঝগড়া করার টাইম না এখন তীরু। চলো এখান থেকে। সন্ধ্যা নেমেছে দেখেছ? ”

তীরু স্বাভাবিক হলো। চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো,

-” ও মাই গড! আমরা তো রেস্ট্রিক্টেড এরিয়াতে এসে পড়েছি। ”

-” গর্দভ মেয়ে জলদি ছুটো। ”

তীরুর হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো অরোন। তবে ভাগ্য বোধহয় সহায় ছিল না তাদের। এখানে বিপদের উপদ্রবটা মূলত রাত নামলেই শুরু হয়। দূর হতে ডেকে উঠল বুনো শেয়াল। কোনো কিছু দ্রুত গতীতে ছুটে আসছে। গলা শুকিয়ে এলো অরোনের, ও তাকাল তীরুর পানে। সব চিন্তা এখন এই মেয়েটার জন্য হচ্ছে তার। লহমায় দর্শন হলো দু’টো বুনো শেয়ালের। বিশাল দেহের অধিকারী শেয়াল দুটো ওদেরকে দেখা মাত্র ছোটার গতী শিথিল করে ফেলল। তীরু খামচে ধরল অরোনের ঘর্মাক্ত শার্ট। আতঙ্কিত গলায় বলল,

-” সব আমার দো ষ! সব আমার জন্য হয়েছে। এখন আমরা ম রে যাবো অরোন। ”

অরোন অভয় দিল। ” হুঁশ। কিচ্ছু হবেনা। শান্ত হও। আই উইল সেভ ইউ। ”

ম রা গাছটা হতে ডাল ভেঙে নিল অরোন। প্রথমে শান্ত থেকে শেয়াল দু’টোর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা চালাল। শেয়াল দুটো আক্রমণাত্মক না হলে এদের আ ঘা ত করবে না। তাহলে হিতে বিপরীত হবে। শেয়াল দু’টো কিয়ৎক্ষণের মাঝেই ছুটে এলো ওদের কাছে। দু’জন দুদিকে। আক্রমণ করবে। অরোন প্রস্তুতি সমেত একটাকে আ ঘা ত করে তীরুর পানে ছুটে যাওয়া শেয়ালটার মাথায় ডাল ছুঁড়ে দিল। একটা শেয়াল দূর্বল হলেও অন্যটা ছিল তেজী। অরোনকে আক্রমণ করে বসলো ওটা। ঘাড়ে ধা রা লো দাত দিয়ে কামড় বসাল। অরোন আ র্ত না দ করে উঠল। তীরু নির্বাক! শেয়াল তখন তার দ্বিতীয় আক্রমণ অরোনের বাহুতে করেছে। পা দিয়ে দেহ জুড়ে আঁচড় কে টে ছে। লহমায় অরোনের সাদা শার্ট র ক্তে একাকার হয়ে শেষ! ও ব্যাথাতুর কন্ঠে চেঁচাল,

-” তীরু যাও এখান থেকে। জলদি। বের হও এই জঙ্গল থেকে। ”

অরোনকে তখনও শেয়ালটা আ ঘা ত করে যাচ্ছে ক্রমাগত। তার মাঝে নিজের জন্য চিন্তা না করে অরোন তীরুকে ছুটে যেতে বলাটা তীরুর বুকে আ ঘা ত করল। নির্বাকতার খোলস ছিঁড়ে ফেলে ও শক্ত হলো। পায়ের কাছে পড়ে থাকা ডালটা নিয়ে এগিয়ে ও শেয়ালটাকে আ ঘা ত করে বসল। কাজ হলো! পাল্টা দ্বিতীয় আ ঘা ত পেয়ে তেজী শেয়াল এবার কাত হয়েছে। তীরু চটজলদি অরোনের কাছে পা গুটিয়ে বসে পড়লো।

-” অরোন, অরোন। ”

হুঁশ নেই অরোনের। তীব্র য ন্ত্র ণা য় জ্ঞান হারিয়েছে সে।

চলবে~