#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪৫|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
শিকদার বাড়ি একদমই চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। এ বাড়িতে উপস্থিত সকলেই এখন বৈঠকখানায় অপেক্ষা করছেন৷ প্রলয় কখন ফিরবে সেই প্রতিক্ষায় রয়েছেন সবাই। পরপর সবগুলো ঘটনা জেনে সকলেই ভালোমন্দ অনেক কথাই বলছিল মেহরাব শিকদারকে৷ তখন ফিরোজা এতকিছু সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়েছিলেন। উনাকে এখন ঘরে নিয়ে আসা হয়েছে৷ যাকে সবথেকে বেশি বিশ্বাস আর ভালোবেসেছেন সেই মানুষটাই প্রতারণা করল। অর্পণ তার মায়ের পাশেই বসে রয়েছে৷ অপেক্ষা করছে কখন তার মায়ের জ্ঞান ফিরবে৷ এখন একমাত্র সে-ই পারে ফিরোজাকে সামলে রাখতে। আপাতত এ ঘরে অর্পণ আর ইরা বাকিরা কেউই না৷ মৃত্তিকাকে বহুবার কল করা হয়েছে কিন্তু কেউ-ই ফোন তোলেনি। প্রলয়ের ফোন বন্ধ৷ অর্পণ খুবই চিন্তায় রয়েছে ওদের দুজনের। জ্ঞান ফিরতেই অর্পণকে মাথার কাছে বসে থাকতে দেখে চট করে শোয়া থেকে উঠে বসলেন ফিরোজা৷ তখনকার সবগুলো কথাই মনে পড়ে গিয়েছে। ফিরোজা আবারও পাগলামি করতে শুরু করলেন। অতি উত্তেজিত হওয়া উনার শরীরের জন্য ক্ষতিকর তাই অর্পণ তার মাকে শান্ত করার চেষ্টায় লেগে পড়ল। কিন্তু কোনো কথাই শুনলেন না ফিরোজা৷ তিনি বলতে শুরু করলেন‚
“আমি এ বাড়িতে আর থাকতে চাই না৷ তুই আমাকে এখান থেকে অন্য কোথাও সিফট করিয়ে দে বাবা৷”
প্রথমত বুঝতে না পেরেই অর্পণ জিজ্ঞেস করে বসল‚ “কেন মা?”
“ওই দুশ্চরিত্রের লোকের সঙ্গে আমি এক মুহূর্তও থাকতে পারব না৷ ভূমিকেও আমি আমার কাছে রেখে দেব৷ এখন থেকে ভূমি আমার মেয়ের পরিচয়ে থাকবে৷ মহুয়া নেই তো কী হয়েছে? আমি আছি। ওর মামনি সবসময় ওর পাশে থাকবে৷ ভূমি আমার মেয়ে৷ আমার দুটো ছেলে মেয়ে। এ বাড়ি থেকে সমস্ত সম্পর্ক আমি আজ থেকেই ছিন্ন করতে চাই৷”
কথাগুলো বলতে গিয়ে আবারও উত্তেজিত হয়ে উঠছেন ফিরোজা৷ যা উনার স্বাস্থ্যের জন্য মোটেও ঠিক নয়৷ অর্পণ চেষ্টা করল তার মাকে শান্ত রাখার৷ ইরাকে ইশারায় বলল তাদের ঘর থেকে যেন ফার্স্টএইড বক্সটা নিয়ে আসে৷ আপাতত ঘুমের প্রয়োজন। ইরাও সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল। অর্পণ তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলল‚
“মা তোমাকে একটা কথা বলব?”
কিছুটা স্থির হলেন ফিরোজা৷ ছেলের কথার প্রত্যুত্তরে শুধালেন‚ “কী কথা?”
“ভূমি আজ তার মায়ের প্রতিশোধ নেবে৷ মেহরাব শিকদারের অস্তিত্ব মুছে দেবে।”
“ওই লোকের নাম আমার সামনে তুলবি না৷ আজ আমি মন থেকে তার মৃত্যু কামনা করছি৷ একজন খারাপ মানুষের কিছুতেই পৃথিবীতে শান্তিতে বেঁচে থাকার অধিকার নেই।”
তমসাচ্ছন্ন ঘুটঘুটে আঁধারিয়া বাহ্যজগতে৷ বাহিরে ঝড়ো হাওয়া বইছে৷ ঝড় আসবে বোধহয়। বৃষ্টিও আসতে পারে৷ জানালার দুয়ার ভেদ করে হিমশীতল হাওয়ায় পুরো কামরা শীতল হয়ে উঠেছে৷ খাঁচার ভেতরে বন্দী থাকা সিংহটা চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটু খাবার পাওয়ার আশায়৷ নাজিম চৌধুরীর সমস্ত জবানবন্দির রেকর্ডিং এতক্ষণ ধরেই মেহরাব শিকদারকে দেখানো হচ্ছিল। ভিডিও দেখে রাগে ফুঁসছেন তিনি। নাজিম চৌধুরীকে হাতে কাছে পেলে হয়ত কাঁচাই চিবিয়ে খেতেন। কিন্তু তিনি তো আর জানেনই না যে‚ সেই লোকটাই আর পৃথিবীতে নেই৷ প্রলয় রাগে এতক্ষণে দুটো চেয়ার লাথি মেরে ফেলেছে৷ অতিরিক্ত রেগে যাওয়ার হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ছিল সে। হাতে লাঠি তুলে নিচ্ছিল মেহরাব শিকদারকে মারবে বলে কিন্তু কিছু একটা বাঁধা যেন থেকেই যাচ্ছিল। হাজারবার চেয়েও লোকটার গায়ে একটা আঁচড় অবধি কাটতে পারেনি সে। মৃত্তিকা কিছুটা হেয় করে মেহরাব শিকদারকে বলল‚
“দেখলেন তো মেহরাব শিকদার— সময় ক্ষ’তকে ঢেকে দিলেও আবার সেই সময়ই কিছু মানুষের মুখোশ খুলে দেয়। সত্য কখনো চাপা থাকে না৷ আপনার এই পশু রূপটা এখন সবার কাছেই জলের মতো পরিষ্কার। তবে একটা সুখবর হচ্ছে— আপনার এই অপয়া মুখটা পরিবারের কাউকে আর দেখতে হবে না।”
চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসলেন মেহরাব শিকদার। এতো কিছুর পরও কোনো আফসোস বা অনুশোচনা হচ্ছে না উনার। সবকিছু কী অবলীলায় উপভোগ করছেন তিনি! এবার বসে থেকেই আড়মোড়া ভেঙে কাউকে ডাকলেন‚
“অ্যাই বাকিরা কে কোথায় আছিস— এদের দুটো এক্ষুনি বন্দী কর!”
একটু থেমে মেহরাব শিকদার নিজের পাঞ্জাবির পকেট থেকে নিজের রিভলবারটা বের করে প্রলয়ের দিকে তাক করলেন। মৃত্তিকা কিছুটা ভয় পেল৷ মৃ’ত্যুর ভয় তার নেই। কিন্তু প্রলয়ের কোনো ক্ষতি হোক সেটা সে কখনোই চাইবে না। যতই রাগ অভিমান করে থাকুক না কেন— ভালো তো সে প্রলয়কেই বাসে। মেহরাব শিকদারকে এভাবে রিভলবার তাক করতে দেখে গাল এলিয়ে হেসে উঠল প্রলয়। মনে মনে লোকটার জন্য বড্ড আফসোস হচ্ছে তার৷ মৃত্তিকা পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ প্রলয়ের পাঞ্জাবির কাপড়টা কুঁচকে শক্ত করে ধরে রেখেছে৷ যা-ই হয়ে যাক এখান থেকে এক পা নড়বে না। মেহরাব শিকদার যাচ্ছেতাই করে ফেলতে পারে। এব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই মৃত্তিকার৷ যেই লোক নিজের স্বার্থের জন্য নিজের ঔরসজাত সন্তানকে মে’রে ফেলতে দ্বিধা করে না‚ সে সব করতে পারে। মেহরাব শিকদার এবার প্রলয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন‚
“আফসোস বউকে বাঁচাতে এসে আজ তোকেও মরতে হবে। তুই আমার বড্ড আদরের কিন্তু কী করব বল? এই মেয়েটাকে আমার সহ্যই হয় না। কোন কুক্ষণে যে মহুয়ার সাথে দেখা হিয়েছিল। এখন আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি৷ আসলে আমার উচিত ছিল বিশ বছর আগেই মহুয়া আর সেই অনাগত বাচ্চাটাকে মেরে ফেলার। তাহলে আমাকে এই দিনটা দেখতে হত না। তবে আজ সেই অপূর্ণ কাজটা সম্পূর্ণ করবই। আর তোকেও যে আমার পথ থেকে সরে যেতে হবে। আমার চলার পথে কোনো বাঁধা আসুক সেটা আমি মোটেও পছন্দ করি না৷ তাই তৈরি হয়ে যা৷ কী রে তোরা সবাই মরলি নাকি?”
মেহরাব শিকদারের কথা বলার ফাঁকে কয়েকজন লোক এলো। রিভলবার এখনো প্রলয়ের দিকেই তাক করা৷ দেখে মনে হচ্ছে যেকোনো সময় কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। লোকগুলোকে দেখে এবার প্রলয় মুখ খুলল‚
“ভুল করেও তো একটা ভুল করে ফেললে চাচ্চু! এসব কাজে তুমি বড্ড কাঁচা।”
“কী বলতে চাইছিস তুই?”
“আমি এটাই বলতে চাইছি যে‚ এখানে যাদেরকে তুমি নিজের লোক বলে মনে করছ তারা আসলে কেউই তোমার লোক নয়।”
ঘাবড়ে গিয়ে মেহরাব শিকদার বললেন‚ “মানে?”
“মানে হচ্ছে গিয়ে… অ্যাই তোরা এখন এখান চলে যা। আজ পুরোনো হিসেবের হালখাতা হবে। যাওয়ার আগে চাবিটা দিয়ে যাস।”
প্রলয়ের কথামতো একজন এসে খাঁচার চাবি দিয়ে গেল৷ এরপর সবাই একে একে চলে যেতে শুরু করল৷ মৃত্তিকা অবাক হয়ে দেখছে প্রলয়কে৷ এমনটা হবে তার জানা ছিল না৷ এসব কখন কীভাবে হলো— তার জানা নেই! সে এখনো প্রলয়কেই ধরে রেখেছে৷ ভয় হচ্ছে তার। কী হতে যাচ্ছে তার জানা নেই৷ লোকগুলোর চলে যাওয়া দেখে অবাক হয়ে মেহরাব শিকদার বললেন‚
“ওরা তো আমার লোক।”
“ভুল ভাবছ তুমি৷ এখন আমি যা বলব ওরা সেটাই করবে৷ তো এবার হিসেব নিকেষ শুরু করা যাক?”
“কীসের হিসেব নিকেশ?”
প্রলয় কিছুটা বিদ্রুপ করে বলল‚ “চিন্তা কোরো না৷ আজ তোমার নিস্তার নেই৷ তোমাকে তো আমি নিজের হাতে শাস্তি দেব৷ তুমি আমার প্রাণপ্রিয় চাচ্চু না!”
“শুধুমাত্র তুমি আমার চাচ্চু বলেই এতক্ষণ ধরে তোমাকে টলারেট করছি। তা না হলে এতক্ষণে তোমার এমন অবস্থা আমি করতাম! একচুয়্যালি তুমি আমাকে এখনো চিনতেই পারোনি৷ রাজনীতিতে আমি এমনি এমনি পড়ে আছি নাকি? ক্ষমতা কী আমার কম? একবছর আগের তেজটা‚ ভেব না কমে গিয়েছে। শূন্য রাজ্যে রানী ফিরে এসেছে। রণরঙ্গিণী রূপ নিয়ে ফিরেছে— যেটা আমি সবসময় চাইতাম৷ তোমার পাপের ঘড়াও পূর্ণ হয়েছে। বুঝলে চাচ্চু! কুটিল বুদ্ধি আমারও রয়েছে। রাজনীতি তো আমার রক্তে মিশে গিয়েছে৷”
“কিন্তু এত ভাষণ দিয়েই বা কী হবে? আজ তো তোকে আর তোর বউকে আমার হাতেই মরতে হবে। কোনো কিছুর জন্যই আমার অনুশোচনা নেই। কিন্তু আফসোস হচ্ছে— ভূমিকে কেন আমি আগেই মে’রে দিলাম না! সে যাই হোক তোরা ম’রার জন্য প্রস্তুত হয়ে যা।”
যেকোনো সময় কিছু একটা ঘটে যেতে পারে তাই মৃত্তিকা জোর করে প্রলয়ের প্যান্টের পকেট হতে রিভলবারটা বের করল। সে জানত প্রলয়ের কাছে সবসময় রিভলবার থাকেই। সরাসরি মেহরাব শিকদারের দিকেই তাক করল মৃত্তিকা।
“নিজের হাতটাকে নোংরা কোরো না ভূমি কন্যা৷ এমনটা যে আমি কখনোই মানতে পড়ব না৷ দ্বিতীয়বার তোমাকে হারিয়ে ফেলার মতো ভুল আমি করব না৷ চাঁদেরও দাগ আছে কিন্তু আমার নির্মলা ভূমি কন্যার গায়ে কোনো দাগ আমি লাগতে দেব না৷ আমি থাকতে আর কখনো কোনো আঁচড় অবধি লাগতে দেব না৷ সবকিছুর আগে ঢাল হয়ে দাঁড়াব।”
“আমি আজ কারো কথা শুনব না৷ আমার আম্মার খু’নের প্রতিশোধ আমি নেবই।”
কথাটা শেষ হবার পূর্বেই মৃত্তিকার হাত থেকে রিভলবারটা নিয়ে প্রলয় নিজেই শুট করে দিল মেহরাব শিকদারের বুকের ঠিক বাঁ পাশটায়। মুহূর্তেই র’ক্ত ছিটকে পড়ল সফেদ রঙা মেঝেতে৷ গলা কা’টা মুরগীর মতো ছটফট করতে শুরু করলেন মেহরাব শিকদার। উনার হাত থেকে পড়ে গেল রিভলবারটা। তবুও মুখে লেপ্টে রয়েছে উন্মাদনার হাসি। এত তাড়াহুড়োর মাঝে নিজেকে বাঁচানো সুযোগটাই তিনি পাননি৷ শরীর থেকে শক্তি কমে আসছে। মেহরাব শিকদারকে নিগড়বন্দী সিংহের গুহায় ঠেলে দিল প্রলয়। ক্ষুদার্ত সিংহ এবার গর্জে উঠল৷ কেঁপে উঠল মেহরাব শিকদারের হৃৎপিণ্ড। মৃ’ত্যুর ভয় তো প্রত্যেকেরই থাকে৷ মেহরাব শিকদারও এখন ভয় পেতে শুরু করেছেন৷ গলা শুকিয়ে আসছে উনার৷ হাত পা ঘেমে থরথর করে কাঁপছে৷ নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টায় তড়পাচ্ছেন। পা’পিষ্ঠার রক্তে ভেসে যাচ্ছে সবকিছু৷ মৃত্তিকা একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে৷ এভাবে তার আম্মা বাঁচার জন্য এক একটা লহমা তড়পেছে৷ লোকটার জন্য খানিকটা কষ্ট লাগছে মৃত্তিকার। শত হলেও তার জন্মদাতা পিতা তো৷ এটা চিরন্তন সত্য৷ সার্ফ এক্সেল দিয়ে ধুয়ে দিলে এই সত্যিটা মুছে দেওয়া যাবে না৷ পৃথিবীতে তার না আছে বাবা আর না আছে আম্মা। সত্যিই সে পুরোপুরি ভাবে অনাথ। বাবার ভালোবাসাটা ঠিক কী সেটা এ জীবনে তার আর জানা হলো না। এই আফসোস আজন্মকাল বয়ে বেড়াতে হবে৷ প্রলয়েরও স্বান্তনা দেওয়ার মুখ নেই। সে এসে মৃত্তিকাকে জড়িয়ে ধরল৷ এখন থেকে মৃত্তিকার পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়াবে সে। সঙ্গ পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল মৃত্তিকা৷ আজ নিজেকে নিস্ব মনে হচ্ছে। আম্মাকে তার খুব করে মনে পড়ছে৷ বেশ অনেকটা সময় কান্নাকাটি করার পর মৃত্তিকার কান্না থেমে যায়৷ ক্ষুদার্ত সিংহটা এখন মানুষের গোশত খাওয়ায় ব্যস্ত৷ বহুদিন পর ভিন্ন স্বাদের খাবার মুখে রুচেছে৷ ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে। হাত‚ পাসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ গুলো মাঝেতে পড়ে রয়েছে৷ গা গুলিয়ে আসছে মৃত্তিকার৷ তবুও এতেই যেন তৃপ্তি মিলছে৷ তড়পে তড়পে মড়েছে মেহরাব শিকদার। প্রলয় এবার মৃত্তিকার সামনে দু হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। অত্যন্ত শান্তস্বরে বলল‚
“শুধু সংসার না আমার এলোমেলো জীবনটাকে সাজিয়ে নেওয়ার জন্যও তোমাকে আমার প্রয়োজন। তোমাকে ভালোবাসার জন্যও তোমাকে আমার প্রয়োজন। কথা দিচ্ছি জীবন থাকতে কখনো তোমাকে কষ্ট পেতে দেব না৷ পুরো দুনিয়া থেকে তোমাকে আগলে রাখব। ভূমি কন্যাকে দ্বিতীয়বার সেহরিশ আরশান প্রলয়ের জীবনে স্বাগত৷ প্লিজ আজ আমাকে ফিরিয়ে দিয় না ভূমি কন্যা।”
রাত তখন প্রায় বারোটা….
মৃত্তিকাকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে প্রলয়। মালঞ্চ নীড়ে সকলেই ওদের দুজনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আজ থেকেই এক নতুন দিনের সূচনা৷ মেহরাব শিকদার নামক কালো অধ্যায়টা সকলের জীবন থেকেই মুছে গিয়েছে। কেউ আর মেহরাব শিকদারের কথা এ বাড়িতে তুলবে না এমনটাই জানিয়ে দিয়েছেন ফিরোজা৷ অর্পণের কাছ থেকে শুনে যতটা বুঝেছেন তাতে মৃত্তিকার দেওয়া শাস্তিটা হয়তো মৃ’ত্যুদণ্ডই হবে। ফিরোজাকে বাদ দিয়ে বাকিরা সবাই বৈঠকখানায়৷ অর্পণ তখন ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছিল৷ এখন তিনি ঘুমচ্ছেন৷ মৃত্তিকাকে দেখা মাত্রই ছুটে গেলেন মাধুরী। যত্নসহকারে জড়িয়ে ধরলেন। উনার এহেন কাণ্ডে সহসাই অবাক করল মৃত্তিকাকে। মাধুরী বললেন‚
“আমাকে ক্ষমা করে দেওয়া যায় না? মানছি আমি অনেক ভুল করেছি। তোমার উপর অনেক অন্যায় করেছি আমি। সন্তানরা ভুল করলে যেমন বাবা মা ক্ষমা করে দেয় তেমনই মা যদি অন্যায় করে থাকে তাহলে সন্তান কী পারে না সেই ভুল গুলোকে ক্ষমা করে দিতে?”
“প্লিজ আপনি এভাবে বলবেন না। আমার বিশ্বাস ছিল— একদিন হয়তো আমি আপনার ভালোবাসা পাব। আপনার উপর আমার কোনো রাগ নেই৷”
মাধুরী আজ একটু বেশিই অনুতপ্ত। অনুশোচনায় মূর্ছা যাচ্ছে। তিনি মৃত্তিকার সামনে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলেন‚ “আমার তুমি ক্ষমা করে দিয়ো মা।”
“প্লিজ মা আপনি এভাবে বলবেন না। আপনার উপর আমার কোনো রাগ নেই।”
মৃত্তিকা এবার অর্পণকে শুধাল‚ “ভাইয়া মামনি কোথায়?”
“মায়ের শরীরটা খুবই উইক। এতটা প্রেসার নিতে পারেনি।”
“মনে হচ্ছে সত্যিটা এখন না জানালেও হত।”
“অনেক তো হলো আর কত? মাকে সত্যিটা জানতেই হত। তাই আগে জানিয়ে দেওয়াটাই বেটার অপশন ছিল। তুই এত চিন্তা করিস না।”
পূর্ণতা পুষ্পিতা দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরল মৃত্তিকাকে। অভিমানী গলায় পুষ্পিতা বলল‚ “আমি তোমার উপর খুব রাগ করেছি ভাবিমণি৷ সেদিন তুমি ইচ্ছে করে নিজের পরিচয় লুকিয়েছ৷”
“সেটারও একটা কারণ ছিল বোনু।”
পূর্ণতা বলল‚ “তুমি আর কখনো আমাদের ছেড়ে চলে যাবে না তো?”
“ইনশাআল্লাহ কখনো যাব না৷”
আবারও জড়িয়ে ধরল দুটো তে৷ সকলেই ওদের বাচ্চামো দেখছেন। এবার নাজমা নিজের ঘর থেকে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা নিয়ে আবারও বৈঠকখানায় ফিরে এলেন। কাল গ্রামে ফিরে যাবেন৷ পরে হয়তো জিনিসটা দেওয়ার কথা আর মনে থাকবে না৷ নাজমা নিজের হাতে করে একটা সোনার চেইন নিয়ে এলেন৷ এটাই মহুয়ার সারাজীবনের একটু একটু করে জমিয়ে রাখা শেষ সম্বল। এটা তিনি ভূমির জন্য বানিয়েছিলেন। মেয়েকে নিজের হাতে পড়িয়ে দেবেন বলেও ইচ্ছে পুষছিলেন। কিন্তু ভাগ্য হয়তো অন্যকিছুই ঠিক করে রেখেছিল৷ সে যাই হোক! নাজমা এবার মৃত্তিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। চেইনটা পড়িয়ে দিতে দিতে বললেন‚
“এটা তোমার আম্মার৷ তোমাকে নিজের হাতেই পড়িয়ে দিতে চেয়েছিল৷ হয়তো ভাগ্যে এমনটা লেখা ছিল না৷ তুমি ওসব ভেবে মন খারাপ করবে না৷ তাহলে তোমার আম্মা কষ্ট পাবেন৷”
উপস্থিত সকলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷ কারো কোনো ক্ষতি না হলেও কয়টা মানুষের জীবন একেবারেই ওলট-পালট করে দিয়েছিল ওই মেহরাব শিকদার। শেষ থেকেই আবার শুরু হোক সুন্দর এই জীবন৷
পরিশিষ্ট—
নব দিবস আর নবজীবনের সূচনা৷ বাহ্যজগতে ঝিম ধরা রোদ্দুর। কোলবালিশ আঁকড়ে নিষুপ্তিতে আচ্ছন্ন প্রলয়৷ হুট করেই চোখ মুখের উপর পানি ছিটেফোঁটা আসতেই ঘুমটা হালকা হয়ে এলো। গভীর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেছে৷ মেজাজ খানিকটা ঝলসে উঠল। বিরক্তিতে চোখমুখ কদাকার রূপ ধারণ করল। কাল রাতে দেরি করে ফেরায় ঘুমটা পুরোপুরি ভাবে হয়নি। রাজনীতিতে এবার পুরো দমে নিজের দায়িত্ব পালন করছে প্রলয়৷ শোয়া থেকে উঠে বসল প্রলয়। ঘুম ঘুম ফোলা চোখে চেয়ে ভূমিকে শুধাল‚
“এভাবে বিরক্ত কেন করছ ভূমি কন্যা? জানো তো— কাল রাতে ঠিক করে ঘুমোতে পারিনি।”
“এমপি মশাই আপনাকে একটা সংবাদ দেওয়ার আছে।”
ভূমির কথাটাকে উপেক্ষা করে প্রলয় পুনরায় বালিশে মাথা এলিয়ে দিল৷ ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। আবারও চোখ বন্ধ করে কোলবালিশ আঁকড়ে ধরল সে৷ ভূমির কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হলো৷ সে এবার বলল‚
“পরে কিন্তু বলতে পারবেন না আমি আপনাকে কিছুই জানাইনি।”
চোখ বন্ধ করে রাখলেও ঘুমিয়ে পড়েনি প্রলয়৷ পাশ ফিরে একবার ভূমির দিকে তাকাল। ইশারা কাহিনি কী জানতে চাইল! অতি উচ্ছ্বসিত অঙ্গনা চট করে বলে উঠল‚ “উই আর গোয়িং টু বি প্যারেন্টস সুন।”
প্রলয় থমকাল। দৃষ্টি স্থির হলো ভূমি কন্যাতে৷ তরুণীর অধর কোণে জায়গা করে নিয়েছে আকর্ণ সেই হাসি। অদ্ভুত মিষ্টতা। আশ্চর্যতা ভর করল পুরুষচোখে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল অর্ধাঙ্গিনীর সুশ্রী পানে। পলক ফেলতেও বেমালুম ভুলতে বসেছে৷ কিছুতেই অনুভূতি ব্যক্ত করতে পারছে না৷ নেত্রযুগল ঝাপসা হয়ে আসছে৷ বাবা হবার অনুভূতিটা এতটাই তীক্ষ্ণ? সবকিছু যেন পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। ভূমিকে নিজের পাশে বসিয়ে ললাটে গাঢ় চুম্বন এঁকে দিয়ে ধরা গলায় প্রলয় বলল‚
“এতকিছু পরেও আমি তোমাকে ফিরে পেয়েছি৷ তোমার কাছ থেকে পাওয়া এই মূল্যবান অনুভূতিটা কখনো কিছুতেই ব্যক্ত করতে পারব না৷ আগের বারের ভুলের জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো ভূমি কন্যা। জানি এ ভুলের কখনোই ক্ষমা হয় না। তবুও কথা দিচ্ছি আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো বাবা হবার চেষ্টা করব৷ নিজের জীবন দিয়ে আগলে রাখব তোমাদের।”
চোখে চোখ রাখতে পারল না ভূমি। সঙ্গে সঙ্গে নামিয়ে নিল। অদ্ভুত লজ্জায় মূর্ছা যাচ্ছে রমণী। প্রলয় হুট করে জড়িয়ে ধরল ভূমিকে। অকস্মাৎ এমন হওয়ায় কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করল ভূমি। লাজুক হেসে প্রলয়কে বলল‚
“এখন থেকে ভালোবাসার ভাগও ডাবল হয়ে গিয়েছে।”
সমাপ্ত!…..
–
–
#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা [পরিশিষ্ট]
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
“তোমার পদ্মিনী বড়ো হয়ে গেছে আম্মা। অনেকটা বদলে গিয়েছে। সে এখন মা হতে চলেছে। আমি তোমার মতো মা হতে চাই। জানো তো আম্মা— ওই মেহরাব শিকদার তার উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে৷ সে যতগুলো অন্যায় করেছে মৃ’ত্যুটা হয়তো তার জন্য উপযুক্ত শাস্তি ছিল না। তুমি আমাকে ছেড়ে কেন চলে গেলে আম্মা? তোমার অভাব যে কখনোই পূরণ হবার নয়। তোমার পদ্মিনীর জীবনে আজ সব আছে কিন্তু তুমি কোথাও নেই! তোমাকে আমার খুব মনে পড়ে৷ তুমি খুব ভালো থেক। তুমি হচ্ছ পৃথিবীর সবথেকে ভালো মা। ভালোবাসি আম্মা।”
চোখ মুছে ফেলল ভূমি। যেকোনো সময় প্রলয় চলে আসতে পারে। তার সামনে কান্না করা বারণ। করিডর থেকে দাঁড়িয়েই মহুয়ার কবরটা দেখা যাচ্ছে৷ পাশেই একটা কামিনী গাছ৷ ফুলও ফুটেছে বেশকিছু। দুটো বছর কী অবলীলায় কেটে গেল। দিবসপতি কঠোর রূপ ধারণ করেছে৷ তপ্ততায় টিকে থাকা মুশকিল। শিকদার বাড়ির সকলে অনিন্দ্যনগর গ্রামে বেড়াতে এসেছে আজ দুদিন হলো। আরশ আর তৃপ্তির রিসেপশন ছিল আজ৷ প্রলয় তার পুরো পরিবার নিয়ে উঠেছে মোড়ল বাডিতে। শাহাদাৎ মোড়ল আতিথেয়তার কোনো ত্রুটি রাখছেন না৷ কুটুম বলে কথা। সকলে ভূমির খুব খেয়াল রাখছে৷ আট মাস চলছে৷ ডেলিভারির সময়ও ক্রমশ এগিয়ে আসছে। যেখানে মেয়েটার বেড রেস্ট থাকার কথা সেখানে সকলে গ্রামে বেড়াতে চলে এসেছে। অবশ্য প্রলয় আসতে চায়নি। ভূমির জেদের কাছে হার মানতে হয়েছে তাকে৷ এ সবই ভাবছিল ভূমি। এমন সময় ফিরোজা এলেন৷ কিছুটা তাড়া দিয়ে বললেন‚
“চল খেয়ে নিবি।”
ধরা গলায় ভূমি বলল‚ “আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না মামনি।”
মেয়ের ধরা গলার স্বর শুনেই কান্না করার বিষয়টা চট করে ধরে ফেললেন ফিরোজা৷ তিনি সরাসরি শুধালেন‚ “তুই কাঁদছিলি?”
দৃষ্টি আড়াল করার চেষ্টা করল ভূমি৷ কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না৷ সে-ই ধরেই ফেলল কেউ না কেউ৷ ভূমি মেকি হেসে বলল‚ “আমি কাঁদছিলাম না মামনি৷ আসলে খুব গরম লাগছে। ভেবেছিলাম এখানে দাঁড়ালে হয়তো কিছু আরামবোধ হবে।”
“মায়ের চোখকে কী এত সহজে এড়িয়ে যাওয়া যায়?”
তবুও এড়িয়ে যাওয়ার বৃথা চেষ্টা করল ভূমি। নিজের দুঃখটাকে আড়ালেই রাখতে চায় সে৷ ভূমি এবার জোরপূর্বক হেসে বলল‚ “তুমি আমাকে নিয়ে একটু বেশিই ভাবো মামনি। আমি সত্যিই কাঁদছিলাম না।”
“আচ্ছা বিশ্বাস করলাম৷ এখন চল! দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে খেয়ে নিবি। দুপুরের ঔষধটা তো খেতে হবে— নাকি?”
ভূমি নিরাশ কণ্ঠে বলল‚ “আমার এখন খেতে ইচ্ছে না। প্রতিদিন এই একই ঔষধ খেতে আর ভালো লাগে না।”
“এই কথাটা তোর শাশুড়ীকে বল গিয়ে৷ ভাবি বলেছে পুরোটা খাবার শেষ করতে।”
অসহায় মুখ করে তাকাল ভূমি৷ সত্যি সত্যিই তার এই মুহূর্তে কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না৷ অনেকক্ষণ ধরেই গা গোলাচ্ছে। কিন্তু কিছুই বলতে পারছে না সে। পাছেই সবাই তার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই ফিরোজার সঙ্গে ঘরে চলে এলো সে৷ ফ্যানের পাওয়ার বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফিরোজা জোর করে অনেকটা খাবার খাইয়ে দিয়েছেন।
“মামনি প্লিজ এত খাবার দিয়ো না৷ অনেক খেয়েছি এখন আর পারছি না৷”
“তা বললে কী হয় নাকি? এখন তুই আর একা নোস৷ বাচ্চা দুটোরও তো পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবারের প্রয়োজন। তোর থেকেই তো ওদের পেট ভরবে৷”
“তাহলে জিড়িয়ে নিই৷ হাইপার লাগছে এখন৷”
“তাহলে পানি খেয়ে নে বেশি করে৷ যা গরম পড়েছে৷ প্রলয়কে বারবার বারণ করলাম তোকে নিয়ে গ্রামে আসতে হবে না৷ কেউ আমার কথা শুনলে তো! তোদের নিয়ে আমি আর পারি না।”
এমন সময় প্রলয় ঘরে প্রবেশ করল। ফিরোজার বলা কথাটুকু শুনে শুধাল‚ “আমাকে নিয়ে কী কথা হচ্ছে চাচি মা?”
“নাম নিতে না নিতেই হাজির৷ বলছিলাম যে— এই গরমের মাঝে মেয়েটাকে নিয়ে এখানেই আসতেই হত?”
“আমার কী দোষ? তোমার মেয়েই তো বায়না ধরেছিল অনিন্দ্যনগর সে আসবেই।”
ভূমির মুখ মুছিয়ে দিয়ে ফিরোজা বললেন‚ “ভারী দুষ্টু হয়েছিস।”
সঙ্গে সঙ্গেই গাল এলিয়ে হেসে উঠল ভূমি। প্রলয় তার নিজের জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল৷ বাহিরে গিয়েছিল। অর্পণকে নিয়ে বেরিয়েছিল৷ বিগত কিছুদিন আবহাওয়া এতটাই তপ্ত যে সহ্য করা দুর্বিষহ হয়ে উঠছে৷ ঘর থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না৷ খরানে গাছ থেকে ঝরে পড়ছে ছোটো ছোটো আম এবং লিচুগুলো। লোকেদের ফসলের ক্ষতি হচ্ছে৷ সঠিক সময়ে খেতে পানি দেওয়া যাচ্ছে না৷ অতিরিক্ত গরমে ডায়রিয়ার সংক্রমণ বাড়ছে৷ হসপিটালে রোগী সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু এত মানুষের একসঙ্গে চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে পড়ছে৷ খাবারের প্লেট নিয়ে চলে গেলেন ফিরোজা। ভূমি উঠে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল৷ পেটটা অনেকটা উঁচু হয়েছে। আলতো হাতে স্পর্শ করল ভূমি। বাচ্চা দুটো অমনি নড়ে উঠল৷ খানিকটা ব্যথা অনুভূত হলেও তৃপ্তি করে হাসল ভূমি৷ আজ সে পরিপূর্ণ। জীবনের প্রতি তার কোনো অভিযোগ নেই৷
বেশ কিছুক্ষণ সময় পর প্রলয় ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো৷ আয়নায় ভূমির প্রতিচ্ছবিতে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল৷ তার দুনিয়া— তার ভালোবাসা যাকে কি-না হারিয়ে ফেলার পরও ভাগ্য করে আবারও ফিরে পেয়েছে৷ জীবন থাকতে আর কখনো ভূমির কোনো ক্ষতি হতে দেবে না সে৷ প্রয়োজন পড়লে সমস্ত কষ্ট যন্ত্রণা নিজে মাথা পেতে নেবে৷ প্রলয় তার ঘাড়ে ঝুলিয়ে রাখা তোয়ালেটা একটা চেয়ারের উপর রেখে ভূমির দিকে এগিয়ে গেল৷ ঠিক পেছন দিকটায় দাঁড়িয়ে বলল‚
“আমার বউটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কী করছে?”
প্রলয়ের হাতটা পেটে চেপে ধরে ভূমি বলল‚ “অনুভব করুন।” সঙ্গে সঙ্গেই নড়ে উঠল। খুশিতে অক্ষিকোটর হতে উপচে পড়ল তরল নোনাজল। চশমা খুলে অশ্রুসিক্ত আঁখিদ্বয় মুছে নিল৷ এ কান্না যে বড্ড সুখের। বড্ড তৃপ্তির৷ ভূমি অবাক চোখে দেখল প্রলয়কে। লোকটার ইদানীং ব্যস্ততা বাড়ছে অথচ তার খেয়াল রাখতে ভুলে না৷ যথাসম্ভব চেষ্টা করে তাকে সময় দেওয়ার— তাকে ভালো রাখার৷ তার প্রতি যত্নশীল হবার৷ স্বামীর বক্ষঃস্থলে মাথা এলিয়ে দিয়ে আবদারের সুরে বলল‚
“বিকেলে একটু আমাকে নিয়ে হাঁটতে বের হবেন? বাড়িতে শুয়ে বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না৷”
“কোথায় যাবে? বাহিরে তো খুব গরম।”
“আমাদের বাড়িটায় একটু নিয়ে যাবেন। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। প্লিজ!”
“এই শরীরে ওখানে না যাওয়াই বেটার৷ অন্য কোনোদিন নিয়ে যাব— প্রমিজ!”
মন খারাপ হয়ে গেল ভূমির। আজ বারবার মুড সুইং হচ্ছে৷ কান্না পাচ্ছে ভীষণ। ভূমি নিজের অশ্রু সংবরণ করল৷ প্রলয় বুঝতে পারল তার প্রেয়সীর মন খারাপ হয়েছে৷ ভূমিকে আবার জড়িয়ে ধরল প্রলয়।
নীলাভ অম্বরে ভেসে বেড়ায় সাদা তুলোর ন্যায় মেঘের দল। শীতল বাতাবরণ। বোঝার উপায় নেই মধ্যাহ্নের তপ্ততা ছিল প্রখর। বেলা গড়িয়েছে৷ অপরাহ্ণ ঝিমিয়ে উঠেছে। হাঁটতে হাঁটতেই ভূমিকে নিয়ে সেই পুরোনো বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল প্রলয়। বাড়ির সামনের দিকটায় বিস্তীর্ণ খোলা মাঠ। এখন বেশ কয়েকটা ঘর বাড়ি হয়েছে। স্কুল তৈরি হয়েছে। হসপিটালটাও খুব সুন্দর ভাবে চলছে। ভূমি একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল তাদের সেই পুরোনো বাড়িটার দিকে। ছোট্টো উঠোন বিশিষ্ট বাড়িটা শূন্য ব্যাকুলতায় উৎকণ্ঠিত। অবহেলায় পড়ে থাকা বাড়িটার দেয়াল খসে খসে পড়ছে। উপরের টিনগুলো মরিচা ধরে গিয়েছে৷ একপ্রকার পরিত্যক্তই বলা যায়। অথচ এই বাড়িটাতেই তার শৈশব কৈশোর কেটেছে৷ কত সুখকর স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে এই বাড়িটাকে ঘিরে। আম্মার সাথে কাটানো কতই না মধুর সময় অতিবাহিত হয়েছে। শূন্য হৃদয়টা হুহু করে উঠল। পুরোনো ঘটনাগুলো স্মৃতিচারণ হচ্ছে৷ নেত্রযুগল ঝাপসা অশ্রুপ্লুত হলো। দ্রুত আঁখিপল্লব ঝাপ্টে চোখের অশ্রু শুষে নিল। ভূমি আঁকড়ে ধরল প্রলয়ের হাতখানা। শরীরটা খারাপ লাগতে শুরু করেছে৷ মাথাটা ঝিমঝিম করছে৷ ভূমির এমন অবস্থা দেখে কিছুটা ঘাবড়াল প্রলয়৷ শক্ত করে ধরে মোড়ল বাড়ির দিকে অগ্রসর হলো। এ অবস্থায় ভূমির এখানে নিয়ে আসাটা মোটেও উচিত হয়নি। মেয়েটা জেদ ধরেছে বলে এখানে নিয়ে আসার সিদ্ধান্তটা নেহাৎই বোকামি ছাড়া আর কিছুই না৷ কিছুটা দূরে যেতেই ভূমি অচৈতন্য হয়ে ঢলে পড়ল প্রলয়ের বাহুতে৷ এক মুহূর্তের জন্য হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ল প্রলয়৷ কোনো কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। ভূমিকে পাঁজোকোলে তুলেই বাকিটা পথ পাড়ি জমাল৷ ভূমির শরীরের ওজন আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে৷ এখন আট মাস চলছে। টুইন্স হবে৷ জ্ঞান হারিয়ে শরীরের পুরোটা ভর ছেড়ে দিয়েছে৷ কিছুটা কষ্ট হয়েছে তবুও হাল ছাড়েনি প্রলয়। মিনিট বিশেকের মাথায় মোড়ল বাড়িতে পৌঁছেছে। ভূমিকে নিয়ে বৈঠকখানায় আসতেই সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়ল৷ অর্পণ এসে পালস চেক করল৷ হুট করে দূর্বল হয়ে পড়ায় জ্ঞান হারিয়েছে ভূমি। তবে এত চিন্তারও কিছু হয়নি৷ এতগুলো মাস পর পুরোনো ঘটনাগুলোর চাপটা সহ্য করতে পারেনি বলেই এমনটা হয়েছে৷ ভূমিকে ঘরে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে৷ বাড়ি ভরতি মেহমান। এমন পরিস্থিতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না প্রলয়৷ মাধুরী আর তনুজা রয়েছেন ভূমির সঙ্গে। ঘরে শুধু ভীড় বাড়িয়ে লাভ নেই তাই উনাদের দুজনকে ঘরে থাকতে দিয়ে বাকিদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ল অর্পণ। করিডরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে অর্পণ শুধাল‚
“ভাই ওর কী হয়েছিল? হুট করে সেন্সলেস হবার তো কথা না৷ ভূমি তো একদম ফিট ছিল৷”
“ওদের ওই পুরোনো বাড়ির সামনে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেছিল৷ হুট করে কী হলো জানি না। আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে কেমন যেন করছিল!”
অর্পণের পাশে দাঁড়িয়ে ইরা বলল‚ “দুপুরে আমাকেও বলছিল— ওর নাকি ওদের পুরোনো বাড়িটা খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।”
ফিরোজা এবার চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন‚ “এ অবস্থায় ওখানে নিয়ে গিয়ে মোটেও ঠিক করিসনি প্রলয়৷ তারউপর সূর্যের তাপমাত্রা প্রখর। গরমে টিকে থাকা মুশকিল। ভাগ্যিস কোনো ক্ষতি হয়নি।”
“আমি তো বারণ করেছিলাম চাচি মা৷ তোমার মেয়ে আমার কথা শুনলে তো।”
“একবার জ্ঞান ফিরুক। ইচ্ছেমতো বকে দেব৷”
এরই মাঝে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন মাধুরী। ভূমির কাছে তনুজাকে রেখে এসেছেন৷ তখন ভূমিকে এ অবস্থায় দেখে অনেকটাই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন তিনি। প্রত্যেকটা মানুষ চিন্তিত হয়ে পড়েছিল৷ মাধুরী এবার বললেন‚
“আজকের পর থেকে ওর এসব বায়নাকে আর গুরুত্ব দেওয়া চলবে না৷ ভূমি এখন আর একা নয় এই কথাটা তোরা কেন বারবার ভুলে যাস? তোদের এই গাফিলতির জন্য যদি ওর বা বাচ্চাদের কিছু…”
বলতে গিয়েও থেমে গেলেন মাধুরী। এসব অশুভ কথা একদমই মুখে আনবেন না তিনি৷ মাধুরী আবারও বললেন‚ “তারউপর আগের বাচ্চাটা মিসক্যারেজ!” এই বলেই মন খারাপ হয়ে গেল মাধুরীর। আগের বারের বাচ্চাটার ক্ষতির জন্য তো তিনিই সবথেকে বেশি দোষী৷ এই আক্ষেপটা হয়তো সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। এই আনন্দের দিনে পুরোনো কথা মনে করতে না চেয়েও বারবার মনে পড়ে যায়৷ মাধুরী নিজের সমস্ত চিন্তা ভাবনাকে দূরে রেখে আবারও ভূমির কাছে গেলেন। জ্ঞান ফেরেনি। মেয়েটা এখন ঘুমচ্ছে। প্রেগন্যান্সির এই সময়টায় ভূমি বড্ড ঘুম কাতুরে হয়েছে৷ খাবার জোর করে খাওয়াতে হয়৷ প্রলয় যখন বাড়িতে থাকে না সেই সময়টা মাধুরী আর ফিরোজা খুব খেয়াল রাখেন। পূর্ণতা পুষ্পিতা আর ইরা নিজেদের পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকে পুরোটা সময়৷ প্রলয় তার রাজনীতি আর অর্পণ হসপিটাল। মোর্শেদ শিকদার খুব কম সময়ই বাড়িতে থাকেন। বেশির ভাগ সময় অফিসের কাজেই ব্যয় হয়৷ সামনে পরীক্ষা থাকায় পূর্ণতা পুষ্পিতা আসতে পারেনি৷ মেয়েরা একা বাড়িতে থাকবে তাই মোর্শেদ শিকদারও থেকে গিয়েছেন৷ বাকিসব কাজের জন্য সাবিনা তো রয়েছেই। প্রলয় এবার ফিরোজাকে উদ্দেশ্য করে বলল‚
“চাচি মা আমরা কাল ঢাকা ফিরে যাচ্ছি৷ ইরা আর অর্পণ কিছুদিন থেকে পরেই না-হয় ফিরবে।”
সঙ্গে সঙ্গেই ইরা বলল‚ “আমি আর আপনার ভাইও ঢাকা ফিরে যাব ভাইয়া৷ তাছাড়া আমার ভার্সিটি আর ওর হসপিটালও রয়েছে।”
“হ্যাঁ ভাই আমরা সবাই একসঙ্গেই ঢাকা ফিরে যাব ইনশাআল্লাহ।”
“তাহলে সবকিছু প্যাকিং করে রেখ তোমরা৷ কাল সকাল সকাল বের হব আমরা৷”
পরিশিষ্ট—
তিন বছর পর…দিনান্তের প্রভা অস্তোন্মুখ। তিমিরের ঢল নেমেছে মেদিনীর বুকে। গ্রীষ্মের উষ্ণতার সমাপ্তিতে প্রকৃতি মজেছে নববর্ষার লীলায়। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির কণা মৃদু তরঙ্গের আওয়াজ তুলছে। রাতের নিস্তব্ধ আঁধারেও সেই আওয়াজ আবছা কর্ণগোচর হচ্ছে। সময়ের স্রোত খুব তাড়াতাড়িই অতিবাহিত হয়। মনে হচ্ছে যেন‚ এইতো কিছুদিন আগে দুটোতে জন্মাল৷ সারাটাদিন ভাইবোন মিলে ঝগড়া করবে অথচ কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচে না এমন অবস্থা৷ একজনের কাছ থেকে আরেকজনকে আলাদা করা যায় না৷ প্রজ্ঞা দু’মিনিটের বড়ো হলেও পূর্ব তাকে বড়ো ভাইয়ের মতো ট্রিট করে এখন থেকেই৷ এদের ভাইবোনের নাম “শেহনাজ আরশান প্রজ্ঞা” এবং “শেহজাদ আরশান পূর্ব” মিলিয়ে রেখেছিল পূর্ণতা পুষ্পিতা। তিনদিন হলো প্রলয় রাজনৈতিক কাজে ঢাকার বাহিরে গিয়েছে৷ আজ ফিরবে৷ ঠিক কখন পৌঁছাবে সেটা জানায়নি৷ বলেছিল সেটাই নাকি সারপ্রাইজ। এই বৃষ্টির মাঝে কী করে প্রলয় বাড়ি ফিরবে সেটা নিয়েও চিন্তা হচ্ছে তার৷ এদিকে ছেলেমেয়ে দুটোকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে বেহাল দশা ভূমি৷ দুষ্টু দুটো কিছুতেই ঘুমতে চায় না৷ বারবার এদিক সেদিক তাকাচ্ছে আর এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে৷ ভূমি খেয়াল করল খুব জোরে বৃষ্টি বর্ষিত হচ্ছে৷ ছেলেমেয়ে দুটোকে বিছানায় শুইয়ে রেখে বারান্দায় দরজা আটকাতে গেল সে৷ জানালার পর্দাগুলোও ভালো করে দিয়ে দিল। কাজ শেষে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল প্রলয় চলে এসেছে৷ চুলগুলো ভেজা৷ পার্কিং সাইড থেকে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে গিয়েই হয়তে ভিজেছে। প্রজ্ঞা আর পূর্ব তাদের বাবার গলা জড়িয়ে ধরেছে৷ প্রলয় বসে রয়েছে বিছানায়। ভূমি ভেংচি কেটে বলল‚
“যেমন বাবা তেমনই তার ছেলে মেয়ে৷”
প্রলয় আর বাচ্চা দুটো চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে রয়েছে ভূমির দিকে৷ যেন আজ নতুন করে দেখছে। ভূমি শুধাল‚
“তিনজন মিলে এভাবে তাকিয়ে থাকা হচ্ছে কেন? ভুল কী বলেছি?”
প্রলয় বলল‚ “আমাদের দল ভারী এটা তো তোমাকে মানতেই হবে ভূমি কন্যা!”
অমনি বাচ্চা দুটো মাথা উপর নিচ ঝাকাল। ভূমি বলল‚ “আমার দলেও একজন আছে সেটা ভুলে গেলে চলবে না এমপি মশাই।”
কথাটা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ভূমি৷ বাচ্চা দুটো কিছুই বুঝল না৷ প্রলয় মিটিমিটি হাসছে৷ সে জানে ভূমি এখন কোথায় গিয়েছে। দল ভারী করতে হবে না? ভেতরের বাচ্চামো এখনো রয়েই গিয়েছে। মিনিট দুয়েকের মাথায় ধৃতিকে কোলে করে নিয়ে চলে এলো ভূমি৷ বাচ্চাটা ভূমির গলা জড়িয়ে রেখেছে৷ ভীষণ শান্তশিষ্ট। সারাক্ষণ গম্ভীর হয়েই থাকে৷ ঠোঁটের হাসিও খুব কম দেখা যায়৷ এইটুকুন মেয়ের এমন ব্যবহার বাড়ির সকলকে ভীষণ অবাক করে। মেয়েটার মাঝে ভূমি এবং প্রলয়ের ছায়া লক্ষ করা যায়৷ যেন ওদের দুজনের স্বভাবের সংমিশ্রণ। ধৃতিকে কোলে নিয়ে ভূমি ওদের সামনে এসে দাঁড়াল। প্রলয়‚ আর ছেলেমেয়ে দুটোকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলল‚
“আমার কার্বনকপি।” ধৃতির গালে একটু আদর করে ভূমি পুনশ্চ বলল‚ “ফুপিমণির গালে একটা কিসি দাও তো মা।”
সঙ্গে সঙ্গেই বাচ্চা মেয়েটা ভূমির গালে চুমু দিয়ে আবারও গলা জড়িয়ে ধরল৷ তার বয়স সবে দু বছর। “আশনূহা ইফরাদ ধৃতি” ভূমি নিজে নামটা রেখেছিল। প্রলয়ের হাত ধরে গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পূর্ব আর প্রজ্ঞা৷ তাদের মাম্মামকে কেন ধৃতি চুমু দিল‚ সেই জন্য বেজায় রেগে আছে তারা! ছেলেমেয়ে দুটোকে এভাবে গাল ফুলিয়ে রাখতে দেখে ভূমি হেসে দিল। প্রলয় পূর্ব এবং প্রজ্ঞা চোখ ছোটো ছোটো করে সন্ধিহান বৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। ভূমি এবার বলল‚
“বাবাইয়ের আদরের দুলাল দুলালি এবার গাল ফোলানো বন্ধ কর তোরা।”
ভুরুযুগল কুঁচকে পূর্ব বলল‚ “মাম্মাম তুমি ওকে কোল থেকে নামিয়ে দাও।”
“ওরে হিংসুটে! তোরা থাক তোদের বাবাইয়ের সঙ্গে।”
প্রজ্ঞার মুখটা কাঁদোকাঁদো ভাব৷ যেকোনো মুহূর্তে কেঁদে দিতে পারে৷ ভূমি এদের দুটোকে আরেকটু জ্বালানোর জন্য বলল‚ “আজ আমি ধৃতির সঙ্গেই থাকব৷”
”তাহলে আমরা কার সঙ্গে থাকব মাম্মাম?”
মেয়ের এহেন কথায় ঠোঁট টিপে হাসল ভূমি। থাক আর জ্বালাবে না বাচ্চা দুটোকে৷ আপস করে নিতে শুধাল‚ “এখন থেকে মাম্মামের কথা শুনবি তো?”
প্রজ্ঞা আর পূর্ব দুজনেই বলে উঠল‚ “শুনব মাম্মাম।”
বাতাবরণ গম্ভীর। বৃষ্টি থেমেছে অনেক আগেই। উৎকণ্ঠিত যামিনী ম্লান করেছে। তবে আবহ শীতল। প্রজ্ঞা পূর্ব দুজনেই ঘুমচ্ছে। প্রলয় দাঁড়িয়ে রয়েছে বারান্দায়। গ্রিল থেকে বৃষ্টির কণা টুপটাপ পড়ছে টবগুলোর উপর৷ পানিতে টইটম্বুর। ভূমি ডাকতে এলো প্রলয়কে৷ এসে দেখল লোকটা চুপ করে দাঁড়িয়ে অদূরে চেয়ে রয়েছে। হয়তো কিছু একটা ভাবছে গভীর ভাবে৷ ভূমি গিয়ে পাশে দাঁড়াতেই প্রলয় পাশ ফিরে তাকাল। চোখে চোখ রেখে বলল‚
“একটা কথা বলব?”
ভূমি পূর্ণ দৃষ্টে দেখল প্রলয়কে৷ লোকটাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। কী এমন কথা বলতে চাইছে লোকটা? ভূমি শুধাল‚ “কী কথা?”
“আমি তোমার আগে ম’রতে চাই।”
প্রলয়ের মুখে এসব কথা শুনে বুকটা ধক করে উঠল৷ প্রিয়কে হারিয়ে ফেলার ভয় জেঁকে বসল যেন৷ ভূমি বলল‚ “কীসব কথা বলছেন এমপি মশাই?”
“ঠিকই বলছি। আমি তোমার আগেই ম’রতে চাই যাতে আর একটা দিনও তুমি বিহীন কাটাতে না হয়।”
মুহূর্তেই অশ্রুপ্লুত হলো মৃগনয়না। প্রলয়ের প্রতি অভিমান জমল কিছুটা৷ কতটা সহজে কথাগুলো বলে ফেলল লোকটা। অথচ ভাবল না তার মনের খারাপ লাগাটা৷ চোখের পানি মুছে ভূমি বলল‚
“আপনার মুখে এসব কথা যেন আমি আর কখনো না শুনি। তাহলে আমাকে আর খুঁজে পাবেন না৷”
“এই রে আমার বউটা কী রাগ করেছে?”
“না! সে আপনার কথাতে কষ্ট পেয়েছে।”
ভূমিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে প্রলয় বলল‚ “তোমার সব অভিমান কষ্টকে আমি নিংড়ে নেব ভূমি কন্যা। আর কক্ষনো এমন কথা বলব না স্যরি! খুব যে ভালোবাসি৷”
সমাপ্ত!……