#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৭|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
[দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ]
“হতচ্ছাড়ি মেয়ে তোকে কতদিন বলেছি আমাদের বাড়িতে আসবি না!”
আঁখিদ্বয় সিক্ত হলো ভূমির। পা দুটো দোরগোড়াতেই থমকে গেল৷ বাড়িতে এক ফোঁটা পানি নেই৷ দুটো ভাত খেতে বসেছিল তখনই খেয়াল হলো ঘড়ায় পানি নেই। মনে কিছুটা সাহস সঞ্চার করে ছুটে এসেছিল জামাল কাকাদের বাড়ি৷ কাকি বেশ খিটখিটে মেজাজের। সহজ কথাও ক্রুদ্ধ স্বরে বলেন। মহিলা আবারও বললেন‚
“কোনো জা’রজ সন্তানের ছায়া আমার অঙ্গনে পড়ুক তা আমি চাই না।”
“দয়া করে চুপ কর কাকি। আমি জা’রজ সন্তান নই।”
মহিলা মুখ ঝামটা দিয়ে টিপ্পনী কে’টে বললেন‚
“এই কাহিনি পুরো গ্রাম জানে। ও কথা মুখে আনতেও ঘেন্না লাগে।”
দুহাতে কান চেপে ধরল। প্রতিনিয়ত এই কথাগুলো শুনতে তার একটুও ভালো লাগে না৷ মাকে নিয়ে খারাপ কথা শুনতে কারই বা ভালো লাগে? রমিজা আবারও বললেন‚
“তা আমার উঠোনে তোর ছায়া কেন?”
“বাড়িতে একফোঁটা পানি নেই আর আম্মাও বাড়ি ফেরেনি তাই আমিই তোমাদের কলপাড় থেকে পানি নিতে এসেছিলাম গো কাকি।”
“না থাকলে নেই। তোকে কে আসতে বলেছিল?”
মহিলার কথায় খুব খারাপ লাগল। এমনিতে অনেকের কাছেই এই শুনে অভ্যস্ত সে৷ দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সমান তালে কেঁদে যাচ্ছে ভূমি৷ তার কান্নায় একটুও মায়া হলো না রমিজার৷ আবারও মুখ ঝামটা দিয়েই মৃদুস্বরে বলে উঠলেন‚ “ঢং!”
গৌর কপোল জুড়ে উষ্ণ অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে৷ অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে ভূমি। মহিলা তাকে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দিল না তো দিলই না। ক্ষিধেও পেয়েছে ভীষণ। নিরুপায় হয়েই ভূমি বলল‚
“কাকি আমাকে এই ছোটো কলসিটায় একটু পানি ভরে দেবে— ভাত খেতে বসেছিলাম।”
“এখন কী তোর কাজ করে দিতে হবে আমাকে?”
একটু থেকে রমিজা নিজ থেকেই বললেন‚ “কলসি দে পানি দিচ্ছি। তবে হ্যাঁ তুই আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় ঢুকবি না।”
অল্পতেই খুশি হয়ে গেল ভূমি। ঘাড় কাত করে মহিলার কথায় সায় জানাল। কিছুক্ষণের মাঝেই মহিলা ভরা কলসি নিয়ে দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ালেন৷ ভূমির হাতে কলসিটা দিয়ে বললেন‚
“তোর আম্মাকে বলবি এ মাসের পানির টাকাটা যাতে তাড়াতাড়ি দিয়ে দেয়।”
“আচ্ছা!”
দূরাকাশে কৃষ্ণ মেঘের ঘনঘটা। ঘুরঘুর করে মেঘ ডেকে যাচ্ছে৷ দৈবাৎ ঝোড়ো হাওয়ায় গাছগাছালি এপাশ ওপাশ হেলে পড়ছে। মনে হচ্ছে যেন‚ বেশ আয়োজন করেই মেঘ বর্ষিত হবে। বাতাসের দাপটে মরিচাধরা আধ ভাঙা জানালার দুয়ার বারবার বাড়ি খাচ্ছে। আজই হয়তো ভেঙে পড়ে গেল! নিমেষহীন ভূমি আজ প্রকৃতিবিলাসে ব্যস্ত। কৃষ্ণ কেশ গুচ্ছ লতাপাতার ন্যায় জড়িয়ে আছে সমগ্র কোমড় জুড়ে। হঠাৎ খট করে শব্দ হওয়ায়‚ দৃষ্টি ঘরের দিকে আবদ্ধ করল সে। মায়াময়ী মানবীকে দেখে বিষণ্ণমনা রমণীর হৃদয় হুহু করে উঠল। সহস্র কান্না এসে ভীড় জমিয়েছে মৃগনয়নায়। এ যেন চোখে চোখে নালিশ জানাচ্ছে অনিমেষ৷ অধরোষ্ঠ কাঁপছে তরতর করে। মমতাময়ী মানবী কাছে এগিয়ে যেতেই ভূমি শুধাল‚
“আমার বাবা কে আম্মা?”
একই প্রশ্ন বারবার শুনতে শুনতে বিরক্ত হলেন মহুয়া। বাজখাঁই স্বরে বলে উঠলেন‚
“তোকে কতবার বলেছি‚ তোর বাবা নেই৷ আমিই তোর বাবা‚ আমিই তোর মা।”
“সবাই তাহলে কেন বলে‚ আমি জারজ সন্তান?”
কোনো উত্তর দিতে পারলেন না তিনি৷ মেয়ের কষ্টে যে উনারও মন কাঁদে৷ প্রতিনিয়ত নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি৷ শুরু থেকেই কম কথা শুনতে হয়নি উনাকে। তবুও প্রতিটা পরিস্থিতিতে নিজেকে নির্ভীক‚ নিগূঢ় রাখার চেষ্টা করেছেন। মেয়েকে ভালো রাখতে অহর্নিশ কষ্ট করে যাচ্ছেন তিনি। আদতে কী তা পেরে উঠছেন? নীরবতা ভেঙে ভূমি নিজে থেকেই বলল‚
“রমিজা কাকি তোমাকে টাকা দিতে বলেছেন৷”
“কীসের টাকা?”
“পানির টাকা।”
“উনি কী আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন?”
“না। আমি পানি আনতে গিয়েছেলাম।”
“উনি তোকে কটু কথা শোনায়নি তো?”
মায়ের কাছ থেকে সেই কথাগুলো লুকিয়ে গেল ভূমি। পাছেই না মা কষ্ট পায়৷ এমনিতেই মায়ের জীবনে খুব কষ্ট৷ অপূর্ণ স্বপ্ন আজও কষ্ট দেয় মাকে৷ মায়ের স্বপ্ন যে মেয়েকেই পূরণ করতে হবে৷ একদিন অনেক টাকা কামাবে। সেদিন আর মায়ের কোনো কষ্ট থাকবে না৷ ভাবতে বিষণ্ণতা এক ছুটে পালিয়ে গেল৷ মাকে আশ্বস্ত করে বলল‚
“আমাকে কেউ কিছু বলেনি আম্মা।”
মহুয়া অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পলিথিনে করে নিয়ে আসা তরকারি গুলো পাতিলে ঢেলে রাখলেন। ভূমিকে ডেকে বললেন‚
“বড়ো ভাবিজান আজকে দেখ কত তরকারি দিয়েছেন। তুই তো গোরুর গোশত পছন্দ করিস। আয় খেয়ে নে ক’টা।”
“রাতে জম্পেশ খাব আম্মা।”
মহুয়া অতি যত্নপূর্বক ছিকায় তুলে রাখলেন গোশতের পাতিল খানা। ভূমি চেয়ে দেখল একবার। বাতাবরণ ক্রমশ ব্যাকুল হচ্ছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির কণা ইতিমধ্যেই ঝরতে শুরু করেছে। ভূমি একই ভঙ্গিতে জানালার দুয়ার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বৃষ্টি তার একদই অপছন্দের। তার একটা কারণ রয়েছে বইকি! ঝুরঝুরে টিন চুইয়ে পানি পড়ে ক্রমাগত। ভেজা মেঝেতে ঘুম হয়না। কাঁথাগুলো ভিজে চুঁইচুঁই করে। মায়ের কাছে এত টাকা নেই যে— টিনগুলো পাল্টাবে। কোনো কাজ ধরতে গেলেও তো টাকার প্রয়োজন। শীত এবং বর্ষা এই দুটো ঋতুতে খুব কষ্টের মাঝেই অতিবাহিত হয় ওদের। শীত আর বর্ষা কারো কারো জন্য রোমাঞ্চকর হলেও সবার জন্য হয় না। কথাটা সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে৷ সেজন্যই এই দুই ঋতু ভূমির ভীষণই অপছন্দের।
“আম্মা বৃষ্টি পড়ছে তো— এবার কী করব?”
“কিছু করতে হবে না। আসার সময় বড়ো পলিথিন কাগজ নিয়ে এসেছিলাম। ওটা লাগিয়ে দেব। আজ আর আমাদের ভেজা মেঝেতে শুতে হবে না।”
মায়ের কথায় হুট করেই খুশি হয়ে গেল ভূমি। মহুয়া প্রাণ ভরে মেয়ের চিত্তচাঞ্চল্য হাস্যজ্বল মুখটা দেখতে লাগলেন। অল্পের মাঝেও মেয়েটা কী অবলীলায় সবকিছু মানিয়ে নেওয়া চেষ্টা করে। মেয়ের মাঝেই নিজের ছায়া দেখতে পান তিনি৷
“কী ভাবছ আম্মা?”
“তোকে কয়েকটা কথা বলি শোন!”
ভূমি গিয়ে তার মায়ের কাছে বসল। ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করল‚ “কী কথা?”
“মানুষের জীবনটা শধুই একটা মরীচিকা— এছাড়া আর কিচ্ছু নয়৷ জীবনে চলার ক্ষেত্রে একটা কথা মেনে চলবি‚ চেনা মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়ার চাইতে অচেনা মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়া অনেক ভালো। এতে কষ্টটা কম হয়।”
হঠাৎ করে মায়ের মুখে এমন কথা শুনে ইতস্ততবোধ হলো ভূমির। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইল মায়াময়ীর সুশ্রী পানে৷ মেয়ের ওমন চাহনির মানে বুঝতে পারলেন মহুয়া৷ গাল এলিয়ে হেসে উঠলেন তিনি৷ রুক্ষ হাত দ্বারা ভূমির গালে মমতামাখা স্পর্শ করলেন তিনি। নেত্র যুগল সিক্ত হলো কিছুটা। মহুয়া বললেন‚
“আমার পদ্মিনী যে বড্ড কোমল৷ যে কেউ তাকে খুব সহজেই কাঁদাতে পারে৷ খুব সহজেই তার ছোট্টো নিষ্পাপ হৃদয়ে আঘা’ত হানতে পারে।”
“আম্মা আমি তোমার সাহসী মেয়ে।”
মহুয়া পরম স্নেহে মেয়েকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলেন। বেঁচে থাকার এই একটা মাত্রই সম্বল উনার৷ মেয়ের মুখের হাসিটাই যে সব। মহুয়া মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন‚
“মায়ের একটা কথা সবসময় মনে রাখবি— অন্যায়ে কখনো মুখ বুজে থাকবি না। মায়ের মতো ভুল তুই কখনো করবি না৷”
মহুয়ার কথায় অবাক হলো ভূমি৷ মায়ের মতো ভুল মানে? তার আম্মা তো কখনো ভুল করতেই পারেন না। ত্রস্ত কণ্ঠস্বরে শুধাল‚ “ভুল?”
“হ্যাঁ ভুল!”
শান্ত মোলায়েম স্বরে ভূমি বলল‚ “আমার আম্মা কখনো ভুল করতেই পারে না।”
“বোকা মেয়ে! ভুল প্রত্যেকটা মানুষেরই হয়৷ ভুল থেকে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাওয়া যায়৷”
“তাহলে কী ভুল করা ভালো আম্মা?”
“ভুলের দুটো প্রকারভেদ আছে। কিছু ভুল আমাদেরকে জীবনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। লড়াই করে বাঁচতে শেখায়। আর কিছু ভুলের কারণে চলার পথে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে হয়।”
মহুয়ার আঁখিদ্বয় অশ্রুপ্লুত হলো। বহু পুরোনো কিছু স্মৃতি চোখের সামনে ভাসছে। মুখ তুলে তাকাতেই ভূমি দেখতে পেল তার আম্মা কাঁদছে। মায়ের ক্রন্দনরত মুখখানা দেখে বিচলিত হলো অষ্টাদশী কন্যা। ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল‚
“কী হয়েছে তোমার আম্মা— কাঁদছ কেন?”
দ্রুত চোখ মুছে নিলেন মহুয়া। মেয়েকে আশ্বস্ত করে বললেন‚ “বাতাসের সঙ্গে কী যেন উড়ে এসে পড়ল! খোঁচা লাগছে চোখে।”
“বড়ো করে তাকাও‚ আমি ময়লাটা বের করে দিচ্ছি।
“তেমন কিছুই না। জানালাটা আটকে দে। আমি গোসলটা করে আসি৷ শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে।”
“আচ্ছা।”
রশিতে ঝুলিয়ে রাখা কাপড় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন মহুয়া৷ মায়ের কথানুযায়ী ভূমি জানালা আটকে দিল৷ দৈবাৎ ঝোড়ো হাওয়ায় শুকনো পাতা উড়ে এসেছে মাটির মেঝেতে৷ ঝিরিঝিরি বৃষ্টির কণাও এতক্ষণ জানালার পাশের মেঝেতে লেপ্টে পড়েছে৷ ঝাঁটা দিয়ে ঝেড়ে সবগুলো পাতা ঘরের বাহিরে ফেলে এলো ভূমি। ভাতও রান্না করতে হবে৷ লাকড়িতে বোধহয় বাতাসের দাপটে আসা বৃষ্টির কণা ছিটে এসেছে৷ দ্রুত পায়ে চুলোর কাছে গেল ভূমি। কয়েক মুঠো লাকড়ি বোঝাই করে রাখা৷ না! লাকড়ি গুলো ভেজেনি। ভাগ্যিস বাতাসের দাপটে এপাশের জানালাটা আটকে গিয়েছিল। নয়তো আজ শুকনো মুড়ি খেয়ে কাটাতে হত৷ অবশ্য আম্মা সঙ্গে করে তরকারি এনেছিলেন৷ কিন্তু ভাতের স্বাদ কী আর মুড়ি দিয়ে মেটানো যায়?
বিভাসিত নীলিমা পতনোন্মুখ। কৃষ্ণ মেঘের আড়ম্বর ছেয়ে আছে সর্বত্র। বাতাবরণ ক্রমশ শীতল। ঘরের ফাঁকফোকর থেকে আসা দৈবাৎ হাওয়ায় কুপির শিখা কেঁপে কেঁপে উঠছে৷ ভূমি প্রদীপের শিখা হাতের আড়াল করল৷ বৃষ্টির সঙ্গে ঝোড়ো বাতাস থামার নাম গন্ধও নিচ্ছে না। উপরে ঝুরঝুরে টিনের সঙ্গে বড়ো কাগজ শক্ত করে বেঁধে দিয়েছিলেন মহুয়া৷ ভাগ্যিস আজ মনে করে কাগজ খানা এনেছিলেন তা নাহলে সারারাত ভেজা শীতল মেঝেতে ঘুমোতে হত মা মেয়েকে। এশারের নামায আদায়ের পর মহুয়া মেয়ের লম্বা কেশগুচ্ছে তেল লাগিয়ে বিনুনি গেঁথে দিলেন। কুপিতে খুব বেশি তেল নেই৷ ঘরেও আর কেরোসিন তেল অবশিষ্ট নেই। যা ছিল সবটা নিংড়ে কুপিতে ঢেলেছিল ভূমি। একবার কুপি নিভে গেলে আর জ্বালানো সম্ভব না৷ ভূমি তার মাকে বলল‚
“আম্মা ঘরে তো আর কেরোসিন নেই— সলতে জ্বলবে কী করে?”
“আজ আর কেরোসিন আনা যাবে না৷ মা মেয়েতে মিলে দুটো ভাত খেয়ে শুয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব আজ৷”
“আচ্ছা আম্মা আমি ভাত বাড়ছি।”
ভাতের পাতিল থেকে দুজনের জন্য ভাত বেড়ে নিয়ে এলো ভূমি। সেই সঙ্গে বিকেলে ও বাড়ি থেকে নিয়ে আসা গোশতের তরকারি একটু গরম করে নিল সে। অনেকদিন পর গরম ভাতের সঙ্গে গোশত খাবে। ভাবতে খুশি খুশি লাগতে তার৷ তরকারি গরম করার ফাঁকে একটা পেঁয়াজ আর দুটো কাঁচামরিচও নিল সে। সঙ্গে লেবু হলে মন্দ হত না। কিন্তু বাড়িতে যে লেবু নেই৷ গাছে দুটো ছিল— কে যেন চুরি করেছে।
দোদুল্যমান তপ্তকিরনে মা মেয়েতে মিলে আয়েশ করে রাতের খাবার খেল৷ মহুয়া বাসন গুলো সরিয়ে রাখলেন। মেঝেতে মাদুর‚ কাঁথা আর বালিশ বিছিয়ে ফেলেছে ভূমি। ঘুমোনোর জন্য প্রস্তুত সে। কুপিতে এখনো যৎকিঞ্চিৎ পরিমাণ তেল রয়েছে। মশারী টানিয়ে ভূমি শুয়ে পড়ল। মহুয়া কুপি নিভিয়ে মেয়ের পাশে শুয়ে পড়লেন।
প্রত্যুষের আলো ফুটতেই ঘুম ভেঙে গেল ভূমির৷ ফজরের নামায আদায় করে মা মেয়েতে মিলে আবারও শুয়েছিল। বেলা এখন গড়াচ্ছে। পাশে তাকিয়ে দেখল তার মা এখনো ঘুমোচ্ছে। প্রত্যেকটা দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয় উনাকে। শুধুমাত্র ভূমিকে একটু ভালো রাখার আশায় কত পরিশ্রমই না করতে হয়! এই সমস্ত ভাবতে ভাবতেই আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল ভূমি৷ টিন আর জানালার ফাঁকফোকর থেকে আলো এসে ঘরে প্রবেশ করছে৷ মশারীর ভেতর থেকে বের হয়ে গেল ভূমি। দুয়ার খুলতেই সাঁই বেগে আলো এসে প্রবেশ করল। মুহূর্তেই আলোয় আলোকিত হয়ে গেল ছোট্টো কুঠরি জুড়ে। বেরিয়ে গিয়ে মুরগী রাখার খুপরির দুয়ার খুলে‚ কয়েকটা খুদ ছিটিয়ে দিল সে। সকাল হলেই এরা খাবার খাওয়ার জন্য পাগল করে দেয়৷ সবগুলোই ভূমির খুন ন্যাওটা। বিশেষ করে বাচ্চাগুলো। মাঝে মাঝে তো কাঁধে উঠে বসে সবগুলোতে। মহুয়া এখনো ঘুমচ্ছেন। ভূমি গিয়ে তার মাকে ডাকল। মহুয়া উঠে যেতেই সে বিছানা মাদুর জায়গারটা জায়গায় গুছিয়ে রাখল। চট করে ঘর‚ বারান্দা আর উঠোন ঝাড়ু দিয়ে ফেলল ভূমি৷ মহুয়া এতক্ষণে হাত মুখে ধুয়ে নিয়েছেন৷ কিছুক্ষণ পরেই উনাকে কাজে যেতে হবে৷ ভূমি বাটিতে করে কয়েকটা শুকনো মুড়ি বের করে দিল তার মাকে৷
বিশাল বড়ো মোড়ল বাড়ি। সেই জমিদার প্রথার সময়কার বাড়ি এটা৷ অনিন্দ্যনগরের সবচেয়ে ধনী আর প্রভাবশালী হচ্ছেন শাহাদাৎ মোড়ল। বর্তমান সময়ে উনিই মোড়ল বাড়ির মাথা৷ বাড়িটা কোনো রাজপ্রাসাদের থেকে কম না৷ এই বাড়িতেই একজন সাধারণ পরিচারিকার কাজ করেন মহুয়া৷ বাড়ির মানুষগুলোও অসম্ভব ভালো৷ অনেক বছর ধরে তিনি এখানে কাজ করছেন৷ বিপদে আপদে সবসময় সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন শাহাদাৎ মোড়ল। একবার ভূমির প্রচণ্ড জ্বর ছিল। চিকিৎসা করানোর মতো টাকা মহুয়ার কাছে ছিল না। জ্বর ক্রমশ কাবু করছিল মেয়েটাকে। অসহায় হয়ে গ্রামের অনেকের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন মহুয়া। কিন্তু কারো কাছ থেকে সাহায্য পাননি৷ ছোটো বেলা থেকেই মেয়েটাকে সবাই অবহেলা কিছুই দেয়নি। সেখানে শাহাদাৎ মোড়ল নিজে থেকে চিকিৎসার সকল খরচ দিয়েছিলেন। মেয়েটার সেই জ্বরে টাইফয়েড হয়েছিল৷ টাইফয়েডের জন্য সমানে চুল উঠে যেত। চুল উঠে যাওয়া নিয়ে মেয়ের সে কী কান্না! ডাক্তারকে বলে তিনটা ডোজ দেওয়া হয়েছিল ভূমিকে৷ এরপর আর কখনো টাইফয়েড হয়নি ভূমির।
বিস্তীর্ণ বৈঠকখানা ঝাড়ু দিচ্ছে মহুয়া৷ সামনে বড়ো বালতিতে পানি নেওয়া৷ ঝাড়ু দেওয়া শেষ হলেই মুছে ফেলবে। কাজের মাঝেই শাহাদাৎ মোড়লের স্ত্রী নাজমা এলেন। মহুয়াকে ডেকে বললেন‚
“মহুয়া অতিথিশালা একটু ভালো করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রেখ। আমি নতুন চাদর বের করে দেব‚ একটু বিছিয়ে দিয়ো। আর হ্যাঁ আজ রান্নাবান্নার কাজ একটু বেশি। আজ বাড়িতে মেহমান আসছে ঢাকা থেকে৷ সেখানকার এমপি ‘সেহরিশ আরশান প্রলয়’ আর উনার ছোটো ভাই মান্যগণ্য ডাক্তার ‘তাসরিফ ইফরাদ অর্পণ’ আসছে। ওদের সঙ্গে আরশও আসছে। আরশ আর অর্পণ ঢাকায় একসঙ্গে পড়াশোনা করেছে। সেই থেকেই ওদের বন্ধুত্ব।”
একটু থামলেন নাজমা। এবার মহুয়া জিজ্ঞেস করল‚
“কী কী কাজ করতে হবে আমাকে বলে দিন ভাবি‚ আমি রান্না করে রাখব!”
“তোমার ভাইজান আর মন্টুকে দিয়ে অনেক বাজার করিয়েছেন৷ অবশ্য সব কে’টেই আনা হয়েছে৷ তোমার একটা কাজ অন্তত কমেছে। আচ্ছা শোন! দেশি মুরগী ঝাল ঝাল করে রান্না করবে। বড়ো রুই মাছ ভাজা‚ গোরুর গোশত ভুনা‚ পোলাও আর জর্দা রাঁধবে।”
“আচ্ছা ভাবি আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সব কাজ খুব যত্নসহকারে করব।”
“এই জন্যই তোমার উপর আমার এত আস্থা।”
একটু থেমে নাজমা আবারও বললেন‚ “ওহ হ্যাঁ আরেকটা কথা— ভূমির জন্য আজ ভালো কিছু খাবার নিয়ে যেও। শুধু তরকারি না— পোলাও‚ জর্দা সঙ্গে করে নিয়ে যেও।”
নাজমার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল মহুয়ার। যেখানে উনার মেয়েকে প্রত্যেকটা মানুষ অবহেলা আর কটু কথা শোনায় সেখানে ইনিই একজন। যিনি ভূমির ভালো মন্দ প্রায়শই জিজ্ঞেস করেন। অশ্রুসিক্ত হলো নেত্রযুগল। মুখে হাসির রেখা প্রসারিত করে মহুয়া নিজের কাজে মনোনিবেশ করলেন।
চলবে?…..
#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৮|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
খাঁ খাঁ মধ্যদুপুর। রোদের তপ্ততা প্রখর। মোড়ল বাড়িতে খাবার দাবারের এলাহি কারবার। সুস্বাদু খাবারের গন্ধে রান্নাঘর ম-ম করছে। সব একা হাতে রান্না করেছেন মহুয়া। উনার রান্নার হাত ভালো। অতিথিশালা পরিপাটি করে গুছিয়ে ছিলেন সেই সকালেই। এক ফাঁকে যোহরের নামাযটা আদায় করে নিয়েছিলেন মহুয়া। শাহাদাৎ মোড়ল এখন বাড়িতেই রয়েছেন। কালো রঙা বড়ো গাড়িটা এসে থেমেছে মোড়ল বাড়ির সামনে৷ গাড়ি থেকে প্রথমে নামল আরশ৷ শাহাদাৎ মোড়লের বড়ো ছেলে৷ এরপর নামল অর্পণ। সবার শেষে নামল প্রলয়৷ আরশের সঙ্গে এগিয়ে গেল বাড়ির ভেতরে। প্রলয় আর অর্পণ একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল‚
“আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন আঙ্কেল আন্টি?”
শাহাদাৎ মোড়ল আর নাজমা একসঙ্গেই বললেন‚
“আমরা ভালো আছি। তোমরা কেমন আছ? আসতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো?”
“কোনো অসুবিধে হয়নি আমাদের৷”
শাহাদাৎ মোড়ল বললেন‚ “আরশ বাবা— প্রলয় আর অর্পণকে ওদের ঘরে নিয়ে যাও। ওরা ফ্রেশ হয়ে নিক। অনেকটা পথ তো জার্নি করে এসেছে৷ একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। কিছুক্ষণ পর টেবিলে খাবার দেওয়া হবে।”
“আচ্ছা বাবা।”
মিন্টু ওদের ব্যাগ সঙ্গে করে নিয়ে গেল দোতলার তিন নাম্বার ঘরে। আরশ বলল‚
“চলুন ভাইয়া— আয় অর্পণ।”
ওরা চলে গেল৷ টেবিলে খাবার গুলো গুছিয়ে রাখছে মহুয়া। কিছুক্ষণ পরেই হয়তো ওরা খেতে আসবে৷ নাজমা নিজেই বলেছেন খাবার গুলো নিয়ে আসতে। মিনিট বিশেক পর অর্পণ আর প্রলয়কে নিয়ে বৈঠকখানায় এসে দাঁড়াল আরশ৷
“এসো বাবা। খাবার খেয়ে নাও৷ দুপুর তো অনেক হলো। তোমাদেরও নিশ্চয়ই ক্ষিধে পেয়েছে!”
সবাই চেয়ার টেনে বসল। শাহাদাৎ মোড়ল আর নাজমাও খেতে বসলেন। মহুয়া একে একে সবাইকে খাবার বেড়ে দিলেন৷ সবাই নিজেদের মতো খেয়ে যাচ্ছে৷ খাওয়ার মাঝেই আরশ জিজ্ঞেস করল‚
“ইরা কোথায় মা?”
“তোর নানু বাড়িতে গিয়েছিল৷ যখনই শুনেছে তুই আসছিস ওমনি ছুট লাগিয়েছে৷ এই এলো বোলে।”
খাওয়ার এক পর্যায়ে অর্পণ বলল‚ “আন্টি খাবার গুলো খুব টেস্ট।”
নাজমা কিছু বলার আগেই আরশ বলল‚ “মহুয়া আন্টি খুবই ভালো রান্না করেন৷”
অন্যদিকে…
বাঁধাই করা ঘাটে বসে জুতো জোড়া ধুয়ে নিচ্ছে ভূমি। আজ গোসল করতে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে৷ যোহরের আগে একটু শুয়েছিল। কখন যে চোখ লেগেছিল জানা নেই। যখন ঘুম ভাঙে তখন প্রায় শেষ দুপুর৷ উঠে তাড়াহুড়ো করে ঘর উঠোন ঝাড়ু দিল। এরপর সকালের জমিয়ে রাখা এঁটো বাসনগুলোকে ধুয়ে‚ পুষ্করিণী পাড়ে গোসল করতে এসেছে। আশেপাশে কেউই নেই৷ ঘাটের ওপাশে ঝোপ ঝাড় গুলো বেড়েছে৷ কাল রাতে বৃষ্টি হওয়ায় পুষ্করিণীর পানি কিছুটা ঘোলাটে লাগছে। ভূমি তাড়াহুড়ো করে গোসল সেরে নিল৷ আম্মা হয়তো একটু পরেই চলে আসবেন৷ দূর থেকে কেউ একজন লোভাতুর দৃষ্টিতে পুষ্করিণীর ঘাটে তাকিয়ে রয়েছে।
ভেজা শরীরে ওড়নাটা ভালো করে পেঁচিয়ে নিল ভূমি৷ এবার বাড়িতে যাবে৷ ভেজা জামাকাপড় বাড়িতে গিয়ে পাল্টাবে। কয়েক কদম সামনে এগোতেই মকবুল এগিয়ে এলেন৷ জামাল কাকাদের পাশের বাড়িটাই উনাদের। লোকটাকে এভাবে দাঁত কেলিয়ে হাসতে দেখে যারপরনাই বিরক্ত আর ক্রুদ্ধ হলো ভূমি। স্পষ্ট স্বরে বলল‚
“সামনে থেকে সরে দাঁড়ান কাকা।”
“হোপ মাইয়া কী যে কও তুমি! আমার বয়স কী অত বেশি নি?”
মকবুলের হাবভাব ভালো ঠেকছে না৷ কীভাবে যেন তাকিয়ে আছে। গায়ের ওড়নাটা আরও ভালো করে জড়িয়ে নিল ভূমি। সেখান থেকে প্রস্থান নিতে চাইলে মকবুল তার পথরোধ করে দাঁড়াল৷ ভয়ে আঁটসাঁট হয়ে রয়েছে ভূমি৷ আড়ষ্টতা ক্রমশ কাবু করছে তাকে৷ এমন পরিস্থিতিতে কখনো পড়তে হয়নি তাকে। ক্ষীণ কম্পিত স্বরে ভূমি বলল‚
“কাকা আমাকে যেতে দিন দয়া করে।”
“অত তাড়া ক্যা? আমার লগেও একটু সময় কাটাইয়া যাও মাইয়া৷”
“এসব আপনি কী বলছেন?”
“আমার কথা বুঝি ভালা লাগে নাই?”
মনে কিছুটা সাহস সঞ্চার করল ভূমি৷ কিছুটা রুক্ষ স্বরে বলল‚ “রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ান।”
“বাপ রে কথার দেহি বহুত তেজ। তেজি মাইয়া আমার মেলা ভালা লাগে।”
মকবুল কিছুটা এগোলো। ভূমি ভীতু চোখে আশেপাশে লক্ষ করল৷ পুষ্করিণী পাড়ে কেউ-ই নেই। সে চিৎকার করলেও কেউ হয়তো শুনবে না। তখনই দৌঁড়ে পালানোর কথা মাথায় এলো। গায়ে জড়িয়ে রাখা ওড়না শক্ত করে ধরেই দৌঁড় দেওয়ার প্রস্তুতি নিল ভূমি। মকবুল সঙ্গে সঙ্গে তার হাতটা ধরে ফেলল। ভয়ে কান্না করে দিল ভূমি।
“দয়ে করে হাত ছাড়ুন কাকা নয়তো আমি চেঁচাব।”
“তোমার চিল্লানি কেউ শুনব না মাইয়া।”
শব্দ করে কেঁদে দিল ভূমি। মকবুল বিকৃত করে হাসল৷ ভয়ে শরীর কাঁপছে ভূমির৷ এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত জানা নেই তার! এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত মায়ের কাছ থেকে তো জানা হলো না৷ সিক্ত কম্পিত আঁখিপল্লব। গৌর কপোল জুড়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রুকণা। এই পরিস্থিতি থেকে কীভাবে নিষ্পত্তি মিলবে জানা নেই৷ ঢেউ খেলানো ঘন দীঘল কৃষ্ণ কেশগুচ্ছ হতে টপ টপ করে পানি ঝরছে। হঠাৎ গম্ভীর পুরুষালি ভরাট কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হলো৷ চকিত দৃষ্টিতে তাকাল ভূমি। অশ্রুপ্লাবিত ঝাপসা চোখে সাদা পাঞ্জাবির উপর কালো কটি পরিহিত এক লোককে দেখতে পেল সে৷ লম্বা দীর্ঘ আঁটসাঁট দেহাবয়ব। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। শ্যাম রঙা কপোল জুড়ে উঁকি দিচ্ছে সংখ্যাল্প খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। লোকটা আবারও বলল‚
“একা একটা মেয়েকে পেয়ে বিরক্ত করছেন?”
মকবুল বিরক্ত হয়ে বলল‚ “ডিস্টাব কর ক্যারে? নিজের কামে যাও।”
লোকটা তার পকেট থেকে রিভলবার বের করে বলল‚ “এই জিনিসটা নিশ্চয়ই চেনেন?”
রিভলবার দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল মকবুলের। চট করে ভূমির হাতটা ছেড়ে দিল৷ এবার নিজেই হয়তো পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। লুঙ্গিটাকে শক্ত করে ধরেই ভোঁ-দৌড়ে পালাল। সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি দুজন শব্দ করে হেসে উঠল৷ লোকটা তাদের দুজনের দিকে একবার তাকাতেই হাসি উবে গেল। এরপর ভূমিকে উদ্দেশ্য করে বলল‚
“আর ইউ ওকে?”
স্কুলের মেডামের কাছ থেকে একটু আধটু ইংরেজি শিখেছিল ভূমি। পড়াশোনা আর নাচের প্রতি ভারী ঝোঁক তার৷ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার কথা একটু হলেও বুঝতে পেরেছে সে। মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে কম্পিত মোলায়ের স্বরে বলল‚ “জি!”
“ভয় পাওয়ার কিছু হয়নি। আপনি যেতে পারেন। ভেজা শরীরে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
এতক্ষণ বেমালুম ভুলে গিয়েছিল ভূমি৷ এবার ভারী লজ্জা অনুভূত হলো তার। এভাবে কোনো পুরুষের সামনে ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে থাকা মোটেও ভালো কাজ নয়। লজ্জায় মাথা কা’টা যাচ্ছে তার৷ অস্ফুটে গলায় ‘ধন্যবাদ’ জানিয়ে ছুটে পালাল সে৷ সেদিকে তাকিয়ে কালো ফ্রেমের চশমাটা ঠিক করল লোকটা। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুজনের একজন বলল‚
“বাড়ি ফেরা যাক?”
অন্যদিকে…
আবারও রান্না বসিয়েছেন মহুয়া৷ এখন রাতের খাবার রান্না হবে৷ আজ খুব চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এমনিতে সকাল আর দুপুরের রান্না করতে হয়। কিন্তু আজ তিনবার রান্নার কাজ করতে হচ্ছে৷ বিকেলও গড়িয়ে আসছে৷ রাতের জন্য ভাত‚ সবজি রান্না করলেন আর কাতলা মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল৷ ব্যাস এটুকুই! এত এত এঁটো বাসন জমেছে৷ সেগুলোও ধুয়ে গুছিয়ে রাখতে হবে৷ খাবার টেবিল আর বৈঠকখানাও ঝাড়ু দিতে হবে৷ ময়লা জমেছে৷ আজ এটুকু কাজেই ক্লান্ত মহুয়া।
পুষ্করিণী পাড় থেকে বাড়ি ফিরে আসরের নামাযের সঙ্গে যোহরের কাযা আদায় করে নিল ভূমি। দুপুরের খাবার এখনো খাওয়া হয়নি। ক্ষিধেও পেয়েছে ভীষণ। তার আম্মা আসতে এখনো অনেকটা সময় দেরি৷ ভাতের পাতিল থেকে নিজের জন্য ভাত বেড়ে নিল সে। সকালের ডিম ভাজা ছিল। এখন সেটা দিয়েই খাবে৷ সঙ্গে করে একটু শুকনো মরিচ ভর্তা মেখে নিল ভূমি। আম্মা এলে তারপর রান্না হবে৷ খাওয়া শেষ হতেই উঠোনে গিয়ে মুরগী গুলোকে ‘তিতি’ বলে ডাকতে শুরু করল। ভূমির ডাকে সবগুলো মুরগী যেখানেই ছিল ছুটে চলে এলো। কয়েকটা খুদ উঠোন জুড়ে ছিটিয়ে দিল৷ সবগুলো তাড়াহুড়ো করে খেতে শুরু করল৷ দুটো বাচ্চা ওয়ালা মুরগীকে আলাদা আলাদা খেতে দিল সে।
মাগরিবের আযান পরেছে৷ মুরগী গুলোকে অনেক আগেই খুপরিতে তুলে রেখেছিল। ঘরে এখনো আলো জ্বালায়নি৷ চুলোতে লাকড়ি জ্বালিয়ে রেখেছে সে৷ সন্ধ্যে বেলা ঘর আঁধার রাখতে নেই৷ বাহিরে এখনো আবছা আলো অবশিষ্ট রয়েছে। এই সুযোগে গোসলঘর থেকে ওযু করে এলো ভূমি। চুলোয় আগুন জ্বলতে জ্বলতে নামায আদায় করা হয়ে যাবে৷ আম্মার জন্যও চিন্তা হচ্ছে তার৷ সচরাচর এত দেরি হয় না আম্মার। আজ কেন দেরি হচ্ছে?
এইতো সবে মহুয়া বাড়ি ফিরেছে৷ সঙ্গে ছিল তিনটে পলিথিন আর একটা বোতল। ঘরে ফিরেই সবগুলো জিনিস ভূমির হাতে এগিয়ে দিলেন তিনি। জিনিসগুলো নিজের হাতে নিয়ে ভূমি বলল‚
“আজ এত দেরি হলো কেন আম্মা?”
“আজ অনেক কাজ ছিল রে মা৷ মোড়ল বাড়িতে মেহমান এসেছে ঢাকা থেকে৷”
“তুমি গোসল করে বিশ্রাম নাও। আমি রান্না বসাচ্ছি।”
“রান্না বসাতে হবে না।”
“তাহলে রাতে খাব কী আম্মা? আর পিলিথিনে এগুলো কী?”
“মোড়ল বাড়ির ভাবি আজ অনেক খাবার পাঠিয়েছেন।”
“অনেক কিছুই রান্না হয়েছিল নাকি আম্মা?”
“হ্যাঁ! দেশি মুরগী‚ গোরুর গোশত ভুনা‚ রুই মাছ ভাজা‚ পোলাও আর জর্দা।”
“এত এত খাবার হয়েছে আজ৷”
“হ্যাঁ রে৷ সবই বড়োলোকদের এলাহি কারবার। তুই খাবার গুলো গরম করে নে। সেই দুপুরে রান্না হয়েছিলে এগুলো। আমি গোসল করে আসি৷”
“আচ্ছা।”
মায়ের কথা মতো খাবার গুলো গরম করে নিল ভূমি। কী সুন্দর সুবাস ছড়াচ্ছে৷ পুরো ঘর ম-ম করছে৷ সুবাস নিতেই পেটে চোঁ চোঁ করছে৷ আসার সময় মহুয়া কেরোসিন তেল কিনে নিয়ে এসেছিলেন৷ কুপি জ্বালিয়ে নিয়েছে ভূমি৷ টিমটিমে দোদুল্যমান শিখায় ঘর আলোকিত৷ গ্রামে গোধূলি লগ্নের পরপরই রজনি নেমে আসে৷ সময় পিছুটান রাখে না৷ নিজ গতিতেই এগিয়ে যায়৷ চলার পথে পিছুটান থাকতে নেই তাহলে জীবন থমকে দাঁড়ায়।
শহরের অলিগলির হরিদ্রাভ সোডিয়াম বাতির দেখা কী আর গ্রামের মেঠোপথে মিলবে? এটা যে ভারী দুর্লভ। সন্ধ্যে হবার সঙ্গে সঙ্গে তমসাচ্ছন্ন ঘুটঘুটে রূপ ধারণ করে মেদিনী। দূরাকাশে চাঁদের দেখা না মিললেও টিমটিমে তারার দেখা মিলেছে সংখ্যাল্প। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেটে ধোঁয়া ফুঁকছে প্রলয়। কাজ ছেড়ে এখানে এসেছে শুধুমাত্র অর্পণের কথায়৷ মন বসছে না এখানে৷ ঢাকা ফিরে যেতে পারলেই বাঁচে৷ তিনদিন থাকার জন্য এসেছে অর্পণ। কেন যে ছেলেটার কথা শুনতে গেল! মনে মনে আফসোস করছে প্রলয়৷ হুট করে চলেও যেতে পারবে না৷ অনিন্দ্যনগর গ্রামটা দেখতে সুন্দর তবে তার কাছে ঝোঁপ ঝাড়ই বেশি মনে হয়েছে৷ কেমন জঙ্গলের মতো অনুভূত হয়৷ চারিপাশে বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত। বড়ো বড়ো গাছগাছালি। আঁকাবাঁকা মেঠোপথ‚ গ্রামে ঢোকার মুখে এক ফালি ছোট্টো নদী। অনিন্দ্যনগর গ্রামটা আসলেই অনিন্দ্যসুন্দর।
বিশাল কামরার লাগোয়া বারান্দা থেকে চলে এলো প্রলয়। বিছানার কাছে এসেই উপলব্ধি করল তার ফোনে কেউ কল করছে৷ দ্রুত পায়ে মুঠোফোনের কাছে এগিয়ে গেল। বিছানার পাশে টিমটিমে দোদুল্যমান শিখায় হারিকেন জ্বলছে৷ জানালার পর্দা ভেদ করে মৃদুমন্দ সমীরণ উঁকি দিচ্ছে৷ কল রিসিভ করল প্রলয়।
“হ্যাঁ বল!”
ফোনটা কানে নিতেই কিছু কথা কর্ণগোচর হলো। প্রত্যুত্তরে প্রলয় বলল‚
“আমি একটু শহরের বাহিরে এসেছি। তোরা একটু সামলে নে বাকি কাজ আমি ফিরে এসে করব।”
ওপাশ থেকে কিছুই শোনা গেল না৷ প্রলয় আবারও বলল‚
“এক্ষেত্রে কী করা উচিত তুই তো জানিস রবিন। তাহলে এত কথা কীসের?”
কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে রবিনের কথা শুনল সে৷ এরপর আবারও বলল‚
“শিহাবকে বলিস মাথা গরম না করতে।”
কল কে’টে দিয়ে ফোনটাকে পকেটে রেখে দিল প্রলয়৷ শহর থেকে দূরে এসেও নিস্তার নেই৷ যেদিকটায় দেখবে না সেদিকটাতেই গণ্ডগোল বেঁধে যাবে। ভাই এসেছে শুনে বিকেলেই চলে এসেছে ইরা৷ সকাল সকাল নানু বাড়িতে গিয়েছিল৷ আজ আর থাকা হলো না তার। অন্য কোনো দিন গিয়ে থেকে আসা যাবে৷ সন্ধ্যে থেকে বিদ্যুৎ নেই৷ হয়তো কোনো সমস্যা হয়েছে৷ দোতলার করিডর দিয়ে যাচ্ছিল অর্পণ। এদিকে হাতে হারিকেন নিয়ে ভাইয়ের ঘরের দিকে যাচ্ছে ইরা। আঁধারিয়ায় আচ্ছন্ন করিডরে হুট করেই দুজন দুজনের সঙ্গে ধাক্কা খেল৷ অর্পণ হারিকেনটাকে বাঁচাতে পারলেও শেষ রক্ষা হলো না৷ মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে উঠল ইরা৷
“ও মা গো।”
“এখানে তো আন্টি নেই।”
ভেংচি কে’টে সেখানেই বসে রইল ইরা৷ কোমড়ে খানিকটা ব্যথা পেয়েছে৷ মনে মনে অর্পণকে বেশ কয়েকটা গালমন্দও করেছে৷ সব দোষ এই লোকের৷ তার জন্যই তো সে এভাবে মেঝেতে পড়ে গেল৷ হারিকেন বাঁচাল— কই তাকে তো বাঁচাল না? ইরার মুখের সামনে হারিকেন ধরে অর্পণ বলল‚
“সারা রাত কী এখানেই বসে থাকার ইচ্ছে আছে নাকি?”
“দেখতেই তো পাচ্ছেন পড়ে গিয়েছি৷ একা উঠতে পারব না৷”
“আপনাকে কী কোলে তুলে উঠাতে হবে?”
“তা হবে বৈকি!”
মেঝেতে হারিকেন রেখে ইরাকে তুলতে নিলেই‚ “থামুন থামুন!”
“আবার কী হলো?”
“কী করছিলেন আপনি?”
“আপনাকে কোলে তুলছিলাম।”
“থাক কোলে তুলতে হবে না৷ হাত দিন আমিই ধরে উঠছি।”
অর্পণ হাত এগিয়ে দিল৷ ইরা তার হাত ধরে উঠে দাঁড়াল। কোমড়ে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে৷ মেঝে থেকে হারিকেন তুলে ইরার দিকে এগিয়ে দিল অর্পণ। এরপর ঘরের দিকে চলে গেল৷ প্রলয় অপেক্ষা করছে তার জন্য। এইতো কিছুক্ষণ আগে কল করে ঘরে ডেকেছিল৷
সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে। নাজমা সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। খেতে বসার আগে ইরা সবাইকে একবার ভালো ভাবে অবলোকন করল। খাবার টেবিলের আরও চারজনের বসার জায়গা রয়েছে৷ বিশাল বড়ো খাবার টেবিল৷ শাহাদাৎ মোড়লের ভাই আর ভাইয়ের বউ আপাতত ঢাকা রয়েছেন। উনার স্ত্রীকে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছেন। গ্রামে খুব একটা ভালো ডাক্তার নেই৷ ডাক্তার দেখাতে হলেও সদরে যেতে হয়৷ শুধুমাত্র গ্রামের মানুষের কথা ভেবে শাহাদাৎ মোড়ল অনেক আশা নিয়ে ছেলেকে ডাক্তার বানিয়েছেন। গ্রামে বড়ো একটা হাসপাতাল বানিয়েছেন৷ ঢাকা থেকে চিকিৎসা করার যাবতীয় সবকিছু বন্দবস্ত করেছেন। সবটাই নিজের একা পুঁজিতে। যাতে গ্রামের মানুষ চিকিৎসাহীনতায় না ভোগে।
সবাই চুপচাপ খেতে বসেছে। খাওয়ার মাঝে আরশ তার মাকে জিজ্ঞেস করল‚
“মহুয়া আন্টি কী চলে গেছেন?”
“হ্যাঁ! ওর মেয়েটা তো বাড়িতে একা৷ তাই ও সন্ধ্যে হবার আগেই চলে যায়।”
আবারও খাওয়ায় মনোযোগী হলো আরশ। ইরা টিপ্পনী কে’টে জিজ্ঞেস করল‚
“উনাকে দিয়ে তোর কী কাজ?”
“আজ বিকেলে দেখলাম উনাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে ওই পুষ্করিণী পাড়ে‚ একটা মেয়েকে বিরক্ত করছিল এক লোক।”
ইরা অবাক হবার ভান ধরে আবারও জিজ্ঞেস করল‚ “তারপর কী হলো?”
“তারপর আর কী? প্রলয় ভাইয়া নিজের রিভলবার বের করলেন আর লোকটা নিজের লুঙ্গি খিঁচে ভোঁ-দৌড়ে পালিয়েছে।”
“মেয়েটা কেমন দেখতে ছিল রে ভাইয়া?”
পাশেই বসে থাকা ইরার মাথায় টোকা মে’রে আরশ বলল‚ “গাধি! আমি কী এত কিছু খেয়াল করেছি নাকি?”
খাওয়ার সময় কথা বলা একদমই পছন্দ করে না প্রলয়। এদের এত কথা বলায় যারপরনাই বিরক্ত হলো সে৷ এক ঢোক পানি খেয়ে বলল‚
“খাওয়ার সময় কথা বলা ব্যাড হ্যাবিটস।”
কথাতা বলেই খাওয়ায় মনোযোগী হলো প্রলয়। ভুরু কুঁচকে এলো ইরার। লোকটা একটু বেশিই গম্ভীর নয় কী? এমপি মানুষরা কী এমনই গম্ভীর ধাঁচের হয়? দুটো বিপরীতমুখী চরিত্রের দেখা পেল ইরা। সামনে বসে থাকা গম্ভীর ধাঁচের ব্যক্তির সম্পূর্ণ বিপরীতমূখী ব্যক্তিটি হচ্ছে অর্পণ।
মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে রাখা৷ ভূমির ধোয়া এলোমেলো চুলে তেল লাগিয়ে দিচ্ছেন মহুয়া৷ লম্বা চুলে নিজে তেল লাগাতে গেলে জট পাকিয়ে যায় তাইতো নিয়ম করে সপ্তাহ খানেক পর পর তেল লাগিয়ে দেন মহুয়া৷ ভূমির ভারী ফর্সা মুখশ্রী পানে চিন্তার ভাজ৷ পুষ্করিণী পাড়ের ঘটনা এখনো মাথা থেকে যাচ্ছে না৷ আম্মাকেও কথাটা বলতে পারছে না৷ এমনিতেই সারাদিন খাটাখাটুনি করে৷ রাতে একটু বিশ্রামের সুযোগ পান। অহেতুক আম্মাকে চিন্তা দিতে ইচ্ছে করছে না তার৷ দেখা গেল কাজে গিয়েও মেয়ের জন্য চিন্তায় মশগুল হয়ে থাকবেন মহুয়া। লোকের বাড়ি কাজ করে খেতে হয়। একটু ভুলচুকও তারা মানবে না। এটাই স্বাভাবিক। মেয়েকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে মহুয়া জিজ্ঞেস করলেন‚
“চুপ কেন— কী হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?”
নিজের মনের অবস্থা বুঝতে দিল না ভূমি। মুখে হাসির রেখা প্রসারিত করে বলল‚
“আমাকে কেউ কিছু বলেনি আম্মা। তুমি অহেতুক আমার জন্য চিন্তা কর।”
“চিন্তা কী আর সাধে করি রে? মায়ের মন থেকে সন্তানের জন্য চিন্তা করা বাদ পড়ে? সারাক্ষণ মনটা চিন্তায় বিভোর থাকে। তোকে আমি সবসময় বলি‚ লোকের কথায় কান দিবি না৷ তারা শুধু তোকে কষ্ট দেবে৷ কষ্ট দিয়ে ভেতর থেকে ভেঙে দিতে চাইবে। কিন্তু তুই কখনো ভেঙে পড়বি না। মনে রাখিস তুই হচ্ছিস তোর আম্মার শক্তি।”
“তুমি অহেতুক আমার জন্য চিন্তা কোরো না আম্মা৷ আমি তোমার সাহসী মেয়ে— আমিই তোমার শক্তি।”
মহুয়া মেয়ের চুল আলতো হাতে টেনে দিতে লাগলেন। এভাবে টেনে দিলে আরাম পায় ভূমি। এমনটা তিনি সবসময়ই করেন। কাঁকই দিয়ে লম্বা চুল গুলোতে দুটো বিনুনি গেঁথে দিলেন। তেল আর কাঁকই জায়গা মতো রেখে এসে ভূমি তার মায়ের সামনে গিয়ে বসল। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল‚
“আম্মা আজকের খাবার গুলো খুব সুস্বাদু ছিল। কত দিন পর বাড়িতে এত ভালো ভালো খাবার এলো! খাবারের গন্ধে পুরো বাড়ি ম-ম করছিল।”
মেয়ের চোখমুখের তৃপ্তির আভাস পেলেন মহুয়া। একদিকে আনন্দ দিচ্ছে আরেকদিকে নিজের অপারগতায় সুপ্ত মনস্তাপ অনুভূত হচ্ছে। মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলেন তিনি। কান্না পাচ্ছে ভীষণ। তবে নিজেকে শক্ত রাখতে হবে। ঠিক যেভাবে উনিশ বছর আগে মহুয়া নামক তরুণীর নিষ্পাপ কোমল হৃদয় চূর্ণবিচূর্ণ হবার পরও‚ অনাগত সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে কঠোর তৈরি করেছিলেন।
চলবে?…..
#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৯|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
বিদ্যুৎ এসেছে কিছুক্ষণ আগে৷ বৈঠকখানায় বসে আছেন শাহাদাৎ মোড়ল। উনার সামনেই মুখোমুখি বসেছে প্রলয় আর অর্পণ। উনার বাম পাশে বসেছে আরশ। হাসপাতাল নিয়েই মূলত উনাদের কথাবার্তা চলছিল৷ হাসপাতাল হরদমে চালু করতে চাইছেন শাহাদাৎ মোড়ল। বৈঠকখানায় বসে এই প্রস্তাবটা রেখেছেন তিনি৷ উনার কথানুযায়ী সবাই রাজি। আরশও নিজের মতামত প্রকাশ করল।
“মেডিকেল ক্যাম্প করলে কেমন হয়? ঢাকা অথবা অন্য জায়গা থেকে ভালো ভালো ডাক্তার আনা হবে রোগী দেখার জন্য। এভাবে আমাদের হাসপাতালও চালু হবে আর গরীব অসহায় মানুষরা সেবাও পাবে৷ আমার তো এখনো মাস ছয়েক ঢাকা থাকতে হবে বাবা। তার আগে তো পুরোপুরি ভাবে আমি গ্রামে আসতে পারছি না৷”
আরশের কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনল। তার কথা শেষ হবার পরপরই অর্পণ বলল‚ “আরশের সঙ্গে আমিও এক মত আঙ্কেল৷ এখানে হসপিটালে ক্যাম্প হলে মন্দ হবে না।”
এতক্ষণ চুপ থেকে সবার কথা শুনছিল প্রলয়৷ মনে মনে একটা সিদ্ধান্তই নিয়েছে সে। মানা না মানা বাকিদের ব্যাপার। প্রলয় এবার নিজে থেকেই বলল‚
“আমি কী একটা প্রস্তাব রাখতে পারি?”
“হ্যাঁ বাবা বল।”
“হসপিটালের পাশেই একটা ফার্মেসির ব্যবস্থা করে দিতে চাই৷ ঢাকা থেকে সব ধরনের ঔষধ এখানে আনা হবে৷ গরীবদের জন্য ডক্টর প্যাসক্রাইভ করা ঔষধ স্বল্প মূল্যে দেওয়া হবে৷”
“প্রস্তাবটা কিন্তু খারাপ না৷ এ কথা আগে মাথায় আসেনি৷ হাসপাতালের প্রাঙ্গণে একটা বড়ো ঘরের মতো রয়েছে ওখানে ফার্মেসি তৈরি করলে মন্দ হবে না।”
“তাহলে কালই সব বন্দবস্ত করে ফেলা হবে ইনশাআল্লাহ।”
একটু থেকে প্রলয় আবারও বলল‚
“গ্রামের কিছু কিছু জায়গায় কলের ব্যবস্থা করা উচিত৷ নদীর ধারে ব্রিজটাও পুরোপুরি ভাবে হয়নি৷ শুনেছি কলেজটাও নাকি ওপাড়ে। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জটিলতা বাড়ছে৷ তাদের যাতায়াতে সমস্যা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আমি অবশ্যই কথা বলব৷”
অতি উচ্ছ্বাস সহিত অর্পণ বলে উঠল‚ “আমার ভাই সবসময় জনগনের সেবায় নিয়োজিত।”
চোখ রাঙিয়ে তাকাল প্রলয়৷ নিজের প্রশংসাগীতি শুনতে তার মোটেও ভালো লাগে না। প্রলয় আবারও বলল‚
“তবে আঙ্কেল একটা জিনিস খেয়াল রাখবেন— এসব কাজে আমার নামটা জড়ানোর প্রয়োজন নেই। আমার কাজ জনগনের সেবা করা‚ নিজের পাবলিসিটি নয়।”
শাহাদাৎ মোড়ল ভীষণ খুশি হলেন প্রলয়ের কথায়৷ গত সংসদ নির্বাচনের সময় কত কত ওয়াদা করেছিলেন এমপি পদের প্রার্থীরা। অথচ কোনো কাজই সুষ্ঠু ভাবে সম্পূর্ণ হয়নি। সরকার থেকে তো অনুদান কম আসছে না। গত কাউন্সিলর ভোটে কত কত প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিল বিভিন্ন প্রার্থীরা। বয়স্ক ভাতা‚ প্রতিব’ন্ধী ভাতা‚ বিধবা ভাতা আরও কত ভাতা‚ অনুদান— সবই নাকি আসার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে। অথচ সেগুলো পায় হাতে গোনা কয়েকজন। বাকি ভাতা গুলো কোথায় যায়?
গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মাঝে মেয়েদের রাখতে পছন্দ করেন না শাহাদাৎ মোড়ল। তার একটা কারণ হলো‚ বাড়ির মেয়েরা যেহেতু এসব ক্ষেত্রে জড়িত নয় তাই তাদের এসব ক্ষেত্রে না টানাই ভালো। মেয়েকে শিক্ষিকা হতে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। অথচ উনার মেয়ে হবে কি-না জার্নালিস্ট। তবুও তিনি মেয়ের স্বপ্নকে সম্মান করেন শাহাদাৎ মোড়ল৷ নাজমা সব কথাই শুনলেন। প্রলয়ের কথায় তিনি খুবই প্রসন্ন। উনার মতে এমন এমপি প্রতেকটা জেলায় জনকল্যাণের জন্য থাকা উচিত।
নাজমা গিয়ে বসলেন স্বামীর পাশে। সঙ্গে সঙ্গে ইরাও গিয়ে বসল তার মায়ের পাশে। অনেকক্ষণ ধরেই একটা কথা বলার জন্য হাঁসফাঁস করছে সে৷ সবাই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছিল বিধায় কিছু বলার সাহস হচ্ছিল না৷ এই তো এখনই কাঙ্ক্ষিত সুযোগ ধরা দিয়েছে৷ মায়ের কাঁধে মাথা রেখে ইরা বলল‚
“মা তুমি কী মহুয়া আন্টির মেয়েকে কখনো দেখেছ?”
“হঠাৎ তুই মহুয়ার মেয়েকে নিয়ে পড়লি কেন?”
“উফ তুমি বলোই না।”
“আমি দেখিনি তবে মিন্টুর বোনের থেকে শুনেছিলাম— মেয়েটা নাকি অনেক সুন্দরী। বাড়ি থেকে বেরই হয় না৷ সারাটাদিন একা বাড়িতে পড়ে থাকে। মণির সঙ্গেই তো মহুয়ার মেয়ে পড়ত।”
ভূমির প্রতি আগ্রহ বাড়তে লাগল ইরার৷ এত বছর ধরে মহুয়া তাদের বাড়িতে কাজ করছে কিন্তু কখনও এইসমস্ত কথা জানতে চাওয়া হয়নি৷ কিন্তু আজ ভীষণ করে জানতে চাইছে সে। ইরা তার মাকে জিজ্ঞেস করল‚ “এখন পড়ে না?”
“না রে। মেয়েটা মাধ্যমিকের পর আর পড়াশোনা করেনি৷ পড়াশোনায় নাকি খুব ভালো ছিল৷ আর খুব ভালো নাচ করে৷”
“মেয়েটাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে৷ আচ্ছা মেয়েটার নাম কী?”
“ভূমি।”
আঁধারিয়া মেদিনী ধূসর রঙে সাজিয়েছে নিজেকে৷ সময় অতিবাহিত হবার সঙ্গে সঙ্গে নিজের রূপ পালটে হয়তো আলোয় আলোকিত হবে সমগ্র। ভূমির ঘুম ভেঙেছে সেই কাক ডাকা ভোরে৷ উঠেই হাতের কাজ সব সেরেছে। রাতের কিছু এঁটো বাসন ছিল সেগুলোও ধুয়ে দিয়েছে৷ এরপর আম্মাকে ডেকেছে। মা মেয়েতে মিলে ফজরের নামায আদায় করবে বলে৷
‘চিল কাকের সঙ্গে উড়ে যা।’ কথাটা বলেই মুরগীটাকে টিনের চালে উড়িয়ে দিল ভূমি। একাকী খিলখিলিয়ে হেসে উঠল সে৷ এমন করাটা তাকে মণি শিখিয়েছে। এটা বেশ কাজেও দিয়েছে। আজ অবধি তার একটা মুরগীর বাচ্চাও চিল বা কাক নেয়নি। খাঁচায় নাদুসনুদুস বাচ্চাগুলো তাদের মাকে খুঁজে না পেয়ে চিঁচিঁ করছে। সেই আওয়াজ অনুসরণ করে মুরগী টিনের চাল থেকে নেমে পড়ল৷ মাটি ঠুকরে বাচ্চাগুলোকে কাছে ডাকছে। ডিম থেকে গুনে গুনে চৌদ্দটা বাচ্চা ফুটেছে। আম্মা পানি নিয়ে এলেই বাচ্চাগুলো দেখাবে৷
মোড়ল বাড়িতে….
রান্নাঘরে সবজি কাটছিলেন মহুয়া। টাটকা মাছ সবজি সকালে মিন্টুকে দিয়ে কিনিয়ে আনেন শাহাদাৎ মোড়ল। প্রতিদিনকার কাঁচাবাজার প্রতিদিনই আনা হয় মোড়ল বাড়িতে। মাছ আগে থেকেই কা’টিয়ে আনা৷ সবজি আর শাকও বেছে নিয়েছিলেন মহুয়া৷ এবার শুধু রান্না করাটাই বাকি। তখনই উপস্থিত হলো ইরা। রান্নাঘরে তার দেখা সচরাচর মেলে না। আজ এসেছে হয়তো কোনো কাজ আছে৷ মহুয়া হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন‚
“তোমার কী কিছু লাগবে? তাহলে আমাকে বল আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”
“আমার কিছু লাগবে না আন্টি।”
একটু থেকে ইরা আবারও বলল‚
“মহুয়া আন্টি আমার একটা আবদার আছে তোমার কাছে।”
সবজি কা’টা থামালেন মহুয়া৷ ইরার দিকে তাকিয়ে বললেন‚ “কী আবদার মা? তুমি বল— আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব পূরণ করার।”
“ভূমিকে একবার আমাদের বাড়িতে আসতে বলবে? ওকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে৷”
হকচকিয়ে গেলেন মহুয়া৷ ছোটো বেলা থেকেই মেয়েটা বাড়ি থেকে দূরে কোথাও যায়নি। স্কুলেও খুব ভয়ে ভয়ে যেত। ওর উপস্থিতি কারো পছন্দ ছিল না৷ মেয়েরা ঠাট্টা তামাশাই করেছে বেশি৷ হাতে গোনা দুজন বন্ধু ছিল ভূমির। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে মেয়েটাকে আর পড়াশোনাও করতে পারলেন না তিনি৷ গ্রামে একটাই বেসরকারি কলেজ। কলেজের খরচও আকাশচুম্বী। একা হাতে সংসার আর মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারলেন না মহুয়া৷ সমাপ্তি টানতে হলো পড়াশোনার অধ্যায়কে৷
“আমার মেয়েটা খুবই অন্তর্মুখী আর ভীতু স্বভাবের৷ বেশি মানুষের মাঝে গেলে হতভম্ব হয়ে পড়ে। আমি মণিকে বলছি ওকে ডেকে নিয়ে আসতে।”
প্রসন্ন মনে ঘাড় কাত করে সায় জানাল ইরা৷ বাড়ির পুরুষরা এখন বাড়িতে নেই। সবাই হাসপাতালে গিয়েছেন। আসতে হয়তো দেরি হতে অয়ারে। ইরা মিন্টুকে ডাকল‚
“মিন্টু ভাই একটু এদিকে আসেন তো।”
ইরার ডাকে বাগান থেকে ছুটে এলো মিন্টু৷ এসেই জিজ্ঞেস করল‚
“কী হইছে আফামণি— কোনো দরকার?”
“তুমি একটু বাড়িতে গিয়ে মণিকে ডেকে আন। বল আমি ডাকছি।”
“আইচ্ছা।”
কথাটা বলেই যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবে ছুটে চলে গেল মিন্টু৷ মিনিট পাঁচেকের মাথায় তার ছোটো বোন মণিকে নিয়ে এলো। এবার আর ইরা কিছু বলল না। মহুয়া নিজে থেকেই বললেন‚
“ভূমিকে একটু নিয়ে আয় তো মা৷ আর শোন— বলবি ভালো জামাকাপড় পড়ে আসতে।”
শেষোক্তটি কিছুটা ফিসফিসিয়ে বললেন মহুয়া৷ উনার কথার প্রত্যুত্তরে মণি বলল‚ “আইচ্ছা খালা।”
ইরা খাবার টেবিলের চেয়ার টেনে সেখানেই বসল। মহুয়া টেবিল পরিষ্কার করতে লাগলেন। এঁটো বাসন গুলো রান্না ঘরে রেখে এসেছেন৷ এবার শুধু দুপুরের রান্নার শেষ করার পালা। তাহলে বড়ো কাজটা থেকে নিস্তার পাবে।
সবে যহরের নামায আদায়ের জন্য জায়নামায বিছিয়েছে ভূমি। এরই মাঝে উঠোনের কাছে কারো গলার আওয়াজ ভেসে আসছে৷ প্রথমে বুঝতে পারল না— কে এভাবে ডাকছে! পরবর্তীতে মণির কথা মাথায় এলো। হ্যাঁ! এ তো মণির কণ্ঠস্বর। জায়নামাযটা একটু ত্যারচা ভাজ করে ঘর থেকে বের হলো ভূমি। তার ভাবনাই ঠিক। টিনের বেড়া সরিয়ে দেখতে পেল‚ মণি কোমরে হাত গুজে হাঁপাচ্ছে। মেয়েটা কী ছুটে এসেছে? কিন্তু কেন? ভূমিকে দেখতে পেয়েই মণি লম্বা নিশ্বাস নিল। এরপর বাড়ির ভেতরে ঢুকল। প্রবেশদ্বার আটকে ভূমি গেল মণির পেছন পেছন। মণি এবার বলল‚
“তোরে খালা আমার লগে যাইতে কইছে।”
“কোথায় যাব আমি?”
“মোড়ল বাড়িত।”
অবাক হলো ভূমি। হঠাৎ ও বাড়ি থেকে তার ডাক এলো কেন? আম্মার কিছু হয়নি তো? কথাটা ভাবতেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল ভূমির। ত্রস্ত ভারী কণ্ঠে শুধাল‚
“আ…আম্মার কিছু হয়েছে?”
ব্যকুল অষ্টাদশী কন্যা মুহূর্তেই অধৈর্য হয়ে পড়ল৷ কণ্ঠনালি দিয়ে যেন কথা বের হচ্ছে না। সে মণিকে প্রত্যুত্তরের সুযোগ পর্যন্ত দিল না। আবারও জিজ্ঞেস করল‚
“কী হলো কিছু বলছিস না কেন? আম্মা ঠিক আছে তো?”
“কইতে তো দিবি। খালা ঠিক আছে। খালা আমারে পাঠাইছে তোরে নিয়া যাইতে৷ কারণ জানতে চাইস না। আমারেও কিছু কয় নাই খালা।”
“নামাযটা পড়ে নিই৷”
মণি ঘাড় কাত করে সায় জানাল‚ “আইচ্ছা।”
বেশ অনেকটা সময় পর…
“আম্মা তুমি আমাকে ডেকেছিলে? হঠাৎ এখানে কেন ডাকলে আম্মা?”
মেয়ের শান্ত মোলায়েম কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই হাত থেমে গেলেন মহুয়ার৷ সোনালি রোদ আছড়ে পড়ছে৷ বাগানে ভেজা কাপড়চোপড় মেলছিলেন তিনি। রান্নাবান্না কাজ শেষ হতেই সাবান পানিতে ভিজিয়ে রাখা ময়লা কাপড়চোপড় গুলো ধুয়ে নিলেন তিনি। ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়ের দিকে তাকাতে চোখ অন্ধকার হয়ে এলো। অনেকটা সময় রোদের দিকে তাকিয়ে থেকেই হয়তো এমনটা হচ্ছে। কিছুটা সময় নিলেন মহুয়া। এরপর বললেন‚
“এখানে যেহেতু ডেকেছি তার মানে কোনো একটা দরকার তো নিশ্চয়ই রয়েছে।”
“কিন্তু এ বাড়িতে আমাকে কীসের দরকার আম্মা?”
“হাতের কাজটা শেষ করতে দে— বলছি সব।”
ভূমিও মায়ের হাতে হাতে সাহায্য করতে শুরু করল। যাতে করে এই খাঁখাঁ রোদ্দুরে তার আম্মাকে বাহিরে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়। মহুয়া বারণ করলেন তবে এ মেয়ে শুনলে তো? কাজ শেষ হতেই মহুয়া মেয়েকে নিয়ে বিশাল বৈঠকখানায় প্রবেশ করলেন। উনার হাতে একটা বালতি৷ আরেকটা বালতি ভূমির হাতে। খাবার টেবিলের চেয়ার টেনে বসে ছিল ইরা৷ ভূমির আসার অপেক্ষাতেই প্রহর গুনছিল সে৷ অপেক্ষা প্রহর যে কতটা কঠিন আজ হারে হারে টের পেয়েছে৷ হঠাৎ করেই ইচ্ছে হলো মহুয়া আন্টির মেয়ে দেখবে৷ দেখবে মানে দেখবেই!
মহুয়ার সঙ্গে একটা মেয়েকে আসতে দেখে ইরা উঠে দাঁড়াল। সে ধরেই নিয়েছে এটাই মহুয়া আন্টির মেয়ে৷ কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে এগিয়ে গেল সে৷ ভূমির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল‚
“তোমার নাম কী?”
ভূমি একবার তার মায়ের দিকে তাকাল। মায়ের কাছ থেকে অনুমতি পেতেই অপ্রতিভ কম্পিত কণ্ঠে বলল‚
“ও…ওয়াজিহা মেহরাব ভূমি।”
ভূমির কাঁধে হাত রেখে ইরা বলল‚ “বাহ্! নামের মতই তুমি খুব সুন্দর।”
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ভূমি। প্রত্যুত্তরে কী বলা উচিত জানা নেই তার৷ ইরা মহুয়ার কাছে অনুমতি চাইল‚
“আন্টি ভূমিকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাই?”
মহুয়া একবার মেয়ের দিকে তাকালেন। উনার বোকাচণ্ডী যে কিছুই বুঝতে পারছে না৷ মেয়ের অবস্থা বুঝতে পেরে মহুয়া বললেন‚
“ও কিছুটা অন্তর্মুখী স্বভাবের। এখানে আমাকে ছাড়া আর কাউকেই তো ও চেনে না তাই কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছে।”
“তুমি চিন্তা কোরো না আন্টি। আমি তো ওর বন্ধু।”
মহুয়া নিঃশব্দে অনুমতি দিলেন। ইরা এগিয়ে এসে ভূমির হাত ধরল। যারপরনাই বিস্ময়াভিভূত অঙ্গনা সেখানেই বরফের ন্যায় থমকে দাঁড়াল। সে যাচ্ছে না দেখে ইরাও থেমে গেল। সে জিজ্ঞেস করল‚
“কি হলো থেমে গেলে কেন?”
কম্পিত কণ্ঠস্বরে ভূমি বলল‚ “আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে৷ যদি বলতেন আমাকে এখানে কীসের জন্য আনা হয়েছে? আমাকে কী কোনো কাজ করতে হবে।”
অনুদ্ধত স্বীকারোক্তি ভূমির৷ ইরা বুঝিয়ে বলল‚
“তেমন কিছুই না। আমি তো তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই৷ তাই তো তোমাকে এত তাড়াহুড়োর মাঝে নিয়ে আসা হলো৷ আমাকে কী তোমার পছন্দ হয়নি?”
“তেমন কিছুই না আপু।”
“আপনি বা আপু কোনো সম্বোধন নয়। তুমি আমাকে নাম ধরে ডাকবে। আজ থেকে আমরা বন্ধু। আর হ্যাঁ বন্ধকে কেউ আপনি বলে ডাকে না৷ তুমি আমাকে তুই করেও বলতে পার!”
ধনী পরিবারের মেয়েকে কী আর তুই করে বলা যায়? কস্মিনকালেও না৷ ভূমি বলল‚
“তুমি করেই বলব।”
“আচ্ছা। এবার চল‚ তোমাকে আমার ঘরে নিয়ে যাই।”
ইরাকে অনুসরণ করল ভূমি। চকচকে শ্বেত টাইলসের সিঁড়ি ভেঙে উপরের দিকে উঠছে ইরা। নিচ তলা থাকে উপরের তলা আরও বেশি সুন্দর আর পরিপাটি। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় ভূমি এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছে৷ বেখেয়ালিতে কখন যে মাথায় পেঁচিয়ে রাখা ওড়না পড়ে গিয়েছে টেরই পেল না৷ লম্বা বিনুনি হেঁটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুলে উঠছে। ইরা সামনে থাকায় ভূমিকে তেমন খেয়াল করেনি।
সকালে নাস্তা করেই বের হয়েছিলেন শাহাদাৎ মোড়ল। কালকের কথানুযায়ী আজ হসপিটালে যাওয়া হয়েছিল৷ প্রলয়‚ অর্পণ আর আরশও গিয়েছিল৷ কাল রাতেই উপরের মহলে ঔষধ আর ব্রিজের কাজের কথাটা জানিয়েছিল প্রলয়৷ তার এক কথাতেই কাজ হয়ে গিয়েছে৷ এই সপ্তাহেই সব কাজ শুরু হয়ে যাবে। গ্রামে বেশ কয়েকটা জায়গায় চাপকলের ব্যবস্থা করা হবে৷ অর্পণকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে প্রলয়। ওর নাকি শরীর টা খারাপ লাগছিল। বাহির থেকে স্যালাইন আর পানি কিনে গুলিয়ে খেয়েছিল৷ এরপর প্রলয়ের কথাতেই হাসপাতাল থেকে প্রস্থান নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে৷ অর্পণকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে প্রলয় আবারও কোথাও একটা যাচ্ছিল। তখনই দেখতে পেল কালকের সেই মেয়েটাকে৷ পুষ্করিণী পাড়ে এই মেয়েটাকেই সাহায্য করেছিল৷ মেয়েটাকে মোড়ল বাড়িতে বেশ অবাকই হলো সে।
প্রলয়কে দেখা মাত্রই ক্ষিপ্রবেগে ওড়নাটা মাথায় জড়িয়ে নিল৷ লোকটাকে চিনতে তার এক মুহূর্ত সময় ব্যয় হয়নি। এই লোকটাই তো কাল তাকে বাঁচিয়েছিল৷ আঁটসাঁট হয়ে ইরার পাশে দাঁড়িয়ে রইল ভূমি৷ ওদের দুজনকে যাওয়ার জন্য পথ করে দিল। অর্থাৎ প্রলয় সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। বাহিরে রোদ থেকে আসার কারণে মাথা ধরেছে৷ চোখমুখ লাল হয়ে গিয়েছে৷ ফোন একবার সময় দেখে নিল প্রলয়। এরপর উল্টো ঘুরে যেতে লাগল। হঠাৎই ভূমিকে পরিপূর্ণ পর্যবেক্ষণ করল ইরা৷ বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলল‚
“মাশাআল্লাহ! তোমার চুল এত ঘন আর লম্বা? আমি এর আগে কখনো এত সুন্দর চুল দেখিনি। আমি তো তোমার চুলের প্রেমে পড়ে গেলাম।”
আগে কখন নিজেকে নিয়ে প্রশংসিত হয়নি ভূমি। ইরার মুখে এমন কথা শুনে অতীব লজ্জাপীড়িত হলো সে। সলজ্জে ক্ষীণ হাসল সে।
চলে যাওয়ার আগে ইরার কথাগুলো কর্ণগোচর হতেই থমকে দাঁড়াল প্রলয়। সমস্ত লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে একটিবার পেছন ফিরে তাকাল। কোমর ছড়ানো ঘন দিঘল বিনুনি। হঠাৎই অনুভূত হলো বুকের মাঝে প্রলয়ঙ্কারী তরঙ্গ বাজছে। দৃষ্টি স্থির হলো কিছু সময়ের জন্য। হৃৎস্পন্দন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এ কী দোটানায় পড়ল সে৷ চুলের ভারে মেয়েটা পড়ে না যায়! আচ্ছা খোপা করলে কী— মাথার চাইতেও খোপাটা বেশি বড়ো হয়? আরও অনেক কিছুই ভাবল প্রলয়৷ মাথাটা ঝেড়ে সমস্ত আজগুবি ভাবনাকে দূর করল। বড়ো বড়ো পা ফেলে চলে গেল নিজের বরাদ্দকৃত কামরায়৷ অর্পণ হয়তো ফ্রেশ হতে গিয়েছে৷ বাহিরে রোদের ছটা অত্যন্ত উত্তাপ ছিল৷ এখন নিজেরই গরম লাগছে। গোসল করতে পারলে ভালো লাগছে। গরম সহ্য হয় না তার।
নাজমা এসে আরেকদফা গুণকীর্তন করে গেলেন ভূমির৷ মেয়েটার প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই সুন্দর নয় কি-না। এমন সুন্দরী মেয়েকে যেকেউ-ই পুত্রবধূ করতে চাইবে। উনার মনেও এমন ভাবনা বার কয়েক উঁকি দিয়েছে ইতিমধ্যেই।
মেঘমালা রং পাল্টেছে। মধ্যাহ্ন পেরিয়ে অপরাহ্ণে এসে ঠেকেছে। আজ হাতের কাজ তাড়াতাড়ি মিটিয়ে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন মহুয়া। খালি বাড়ি রেখে মেয়েটা মোড়ল বাড়িতে ছুটে গিয়েছিল। অজানা আশঙ্কা মনে গাঁথিয়েই বেরিয়েছিল মেয়েটা। ভূমিকে দেখা মাত্রই মুরগী গুলো ছুটে এলো। হয়তো ক্ষিধে পেয়েছে ওদের৷ সেই যে সকালে খাবার দিয়েছিল তারপর আর খাবার দেওয়া হয়নি। বাচ্চা গুলোও ক্ষিধের তাড়নায় চিঁচিঁ করছে৷ ভূমি দ্রুত ঘর থেকে খুদের কৌটা নিয়ে এলো। খাবার দেখে সবগুলো এসে হাজির হলো তার পায়ের কাছে। কয়েক মুঠো খুদ উঠোনে ছিটিয়ে দিল ভূমি। আছরের নামায আদায় করা হয়নি এখনো। গোসলঘর থেকে ওযু করে এলো সে। মহুয়া এতক্ষণে ওযু করে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
ঘরের কোণায় কুপি জ্বলছে৷ যামিনী নামতেই গাছের পাতাগুলো মূর্ছা গেল। তাদেরও বিশ্রামের প্রহর নেমেছে৷ ঘন তমসাচ্ছন্ন ঘুটঘুটে সর্বত্র। হরিদ্রাভ টিমটিমে আলোতে মাদুর আর তার উপর মোটা কাঁথা বিছিয়ে নিল ভূমি। রাত হয়েছে৷ ঘুমোনোর সময়ও হচ্ছে। বিছানা করে বসতেই মহুয়া মশারী টানিয়ে নিলেন। বিছানার কিনারায় মশারী গুজে দিল ভূমি৷ কুপি নিভিয়ে মেয়ের পাশে এসে শুয়ে পড়লেন মহুয়া। শুয়ে থেকেই মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। চোখ বন্ধ রেখে ভূমি বলল‚
“মোড়ল বাড়ির মানুষগুলো খুব ভালো।”
“হ্যাঁ।”
চলবে?…..