#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১০|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
ঊষাকাল উঁকি দিতে শুরু করেছে৷ আলোকচ্ছটায় পরিপূর্ণ মেদিনী। পাখিরা কিচিরমিচির কলরব তুলছে৷ পূর্বাকাশে দিবসপতি একটু একটু করে গাঢ় রং ধারণ করেছে। নীলাম্বরের মাঝে একটুকরো রক্তিম আভা। সবে ভাত বসিয়েছে ভূমি। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে রয়েছে। রাতে ঘুম হয়নি। তারউপর লাকড়িতে কিছুতেই আগুন জ্বলতে চাইছে না। পুরো ঘর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। ওদের আলাদা করে রান্নাঘর নেই৷ ছোট্টো ঘরের এক কোণায় চুলো পেতেছেন মহুয়া৷ চুলোর সংলগ্নে থাকা ছোটো জানালাটা খুলে দিল ভূমি। আজকের দিনটাই কদাকার— ভীষণ পাংশুটে। মহুয়া গিয়েছেন পানি আনতে।
“ভাবি এ মাসের পানির টাকাটা।”
রমিজা হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিয়ে নিলেন। প্রত্যেক মাসে দেড়শো টাকা করে নেন শুধুমাত্র পানির জন্য৷ টাকাটা হাতে পেয়ে হেসে দিলেন রমিজা৷ পান খেয়ে লাল হয়ে যাও দাঁতগুলো দৃশ্যমান। মহিলা ভীষণ পান চিবোন৷ গ্রামের মহিলাগন তো উনাকে ‘পানখোর’ ডাকেই চিনে ফেলেন৷ কলসি কাখে আর হাতে একটা বালতি নিয়ে বাড়ির দিকে চললেন মহুয়া৷ জামালদের বাড়ি থেকে বের হতেই পথরোধ করে দাঁড়াল মকবুল। মুখে তার বিকৃত হাসি৷ তর্জনী ও মধ্যমাঙ্গুলি ফাঁকে আটকে রাখা বিড়িতে টান দিল৷ নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করে উড়িয়ে দিল নিমিষেই। কাজের দেরি হচ্ছে মহুয়ার৷ তিনি শুধালেন‚
“কিছু বলবেন ভাই?”
“কইতে তো অনেক কিছুই আছে।”
“জি বলুন।”
“আমি আবার সোজাসাপ্টা কথা কইতেই পছন্দ করি।”
প্রত্যুত্তরে মহুয়া কিছু বললেন না। পরবর্তী কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন হয়তো। মকবুল বলল‚
“মাইয়া তো বড়ো হইছে— বিয়া শাদি দিবা না?”
“মেয়ের বিয়ে নিয়ে এখনো কিছু ভাবিনি ভাই৷”
“তোমার মাইয়া কিন্তু দেখতে হুনতে ভালাই৷ হেতিরে আমি বিয়া করবার চাই। যৌতুক দিতে হইব না। উল্টা আমি টেকা পয়সা দিমু। সারাজীবন বইয়া খাইতে পারবা। আর মাইনসের বাড়ি কাজ কইরা খাইতে হইব না।”
“ছিহ্! এইসব কী ধরনের কথাবার্তা? ভূমি আপনার সন্তান সমতুল্য।”
“আমি তো সেইটা ভাবি না।”
এই লোকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলতে রুচিতে বাঁধছে৷ ইচ্ছে তো করছে এখানেই খু’ন করে ফেলতে। মহুয়া আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ালেন না৷ বড়ো বড়ো পা ফেলে বাড়ি ফিরে এলেন। টিনের বেড়াটা খুব ভালো করে আটকে দিয়ে এলেন। লোকটা চোখমুখের ভাষা খুব একটা ভালো লাগেনি মহুয়ার। বালতিটা বারান্দায় রেখে কলসি নিয়ে ঘরে এলেন তিনি। রাগে শরীর কাঁপছে উনার। ভূমি তখন ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিল৷ কাজের ফাঁকে একবার তার আম্মার দিকে তাকাল। কেমন অস্বাভাবিক লাগছে তার আম্মাকে৷ কাজ ফেলে মহুয়ার কাছে এলো ভূমি। শশব্যস্ত ভঙ্গিতে তার আম্মার হাত ধরে জিজ্ঞেস করল‚
“কী হয়েছে আম্মা তোমার?”
মেয়েকে এভাবে বিচলিত হতে দেখে নিজেকে সামলে নিলেন মহুয়া৷ ভূমিকে আশ্বস্ত করে তিনি বললেন‚ “ক..কিছু হয়নি। একটু গরম লাগছিল।”
“ভাত রান্না হয়েছে?”
“হ্যাঁ! তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। ঝাড় দেওয়া ময়লা গুলো ফেলে দিয়ে আসি।”
“হুম যা।”
আজকের সকালের নাস্তা বানিয়েছেন নাজমা। মহুয়া এখনো আসেননি। এদিকে বাড়িতে মেহমান। বাড়িতে বিস্কুট‚ ড্রাই কেক আগে থেকেই কিনে আনা ছিল। নাজমা ঝটপট চা আর ডিম দিয়ে পাউরুটি ভেজে নিলেন। ছেলে মেয়েগুলো এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি৷ সকালে উঠে হাঁটার অভ্যেস আছে শাহাদাৎ মোড়লের। বাগানে হাঁটাহাঁটি করে অনেকটা সময়। নাস্তার ব্যবস্থা হতেই নাজমা ডাক দিলেন মিন্টুকে৷
“আমারে ডাকছিলেন খালা?”
“তোর খালু হয়তো বাগানে রয়েছেন। একটু ডেকে নিয়ে আয়৷ গিয়ে বলবি নাস্তা তৈরি৷”
“আইচ্ছা।”
ছুটে গেল মিন্টু। এদিকে নাজমা প্রথমে ইরাকে ডাকলেন৷ এরপর আরশের ঘরে ডাকতে গিয়ে বুঝলেন উনার ছেলের অনেক আগেই ঘুম ভেঙেছে। ওয়াশরুমে গিয়েছে ফ্রেশ হতে৷ তিনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থেকেই বললেন‚
“নাস্তা তৈরি। অর্পণ আর প্রলয়কে নিয়ে নিচে আয়।”
ওয়াশরুমে থেকেই “হ্যাঁ!” বলে সায় জানাল আরশ৷ নাজমা চলে গেলেন।
নীলাম্বর ছুটি নিয়েছে ধূসর মেঘমালার আড়ালে। ঊষাকালে উঁকি দেওয়া দিবসপতি ম্লান হয়েছে৷ ছাই রঙা মেঘ গুটলি পাকিয়েছে অন্তরিক্ষে। কাজে এসেও মন টিকছে না মহুয়ার। বারবার মনে হচ্ছে খারাপ কিছু ঘটবে৷ সকাল থেকেই বাঁ চোখটা ক্ষণে ক্ষণে লাফাচ্ছে৷ মহুয়া একটা জিনিস খেয়াল করেছেন‚ যখনই উনার বাঁ চোখ লাফায় তখনই খারাপ কিছু ঘটারই হয়৷ এই নিয়ে খুব চিন্তায় রয়েছেন তিনি। হঠাৎ করে কেন এমন হচ্ছে? ভাবাচ্ছে ভীষণ। আজ কাজে না এলেই পারতে৷
“ভাবি আজ আমি একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাব।”
“কোনো সমস্যা হয়েছে মহুয়া?”
“মেয়েটার জন্য হুট করেই ভীষণ চিন্তা হচ্ছে৷ এমনটা তো কখনো হয় না।”
“তাহলে তুমি দুপুরের রান্নাটা করেই চলে যেও। বাকি কাজ আমি সামলে নিতে পারব।”
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভাবি।”
বিরস দিবসের সূচনা ঘটেছে মধ্যাহ্নলগ্নে। বিশাল অম্বর জুড়ে কৃষ্ণ মেঘের আবির্ভাব। নিটোল জলে মেঘের প্রতিবিম্ব ভাসছে। শীতল বাতাবরণে পুষ্করিণীর জলও নিশ্চয়ই শীতলই হবে৷ আজ হয়তো বৃষ্টি হবে অথবা তুমুল ঝড়! শানবাঁধানো ঘাটে বসে রয়েছে প্রলয়। এখানে কেন এসেছে জানা নেই কিন্তু সকাল থেকেই ইচ্ছে করছিল এখানটায় আসতে৷ সঙ্গে থাকা নুড়িপাথর গুলো একটা একটা করে ছুড়ে ফেলছে নিটোল সেই জলে। মিন্টু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল‚
“ভাইজান বাড়িত যাইবেন না? মেলা দেরি হইছে আমরা এনে আইছি।”
“তুমি বাড়ি ফিরে যাও মিন্টু৷ আমার ফিরতে দেরি হবে।”
“আপনে একলা যাইতে পারবেন?”
“এ আর কঠিন কী?”
“তাইলে আমি বাড়িত যাই। মেলা কাম পইড়া রইছে।”
“আচ্ছা যাও৷”
সোফায় বসে আছেন শাহাদাৎ মোড়ল। আরশ আর অর্পণও রয়েছে এখানে। দুপুরের খাবার খেয়ে মিন্টুকে নিয়ে বের হয়েছিল প্রলয়। তারপর আর ফেরেনি। অর্পণ নিজে থেকে বলল‚
“আঙ্কেল কাল আমরা ঢাকা ফিরে যাব।”
“সে কী বাবা— এই প্রথম অনিন্দ্যনগরে এলে। এক সপ্তাহ অন্তত থেকে যাও৷”
“আসলে আঙ্কেল‚ ভাইয়ের কাঁধে তো অনেক দায়িত্ব। লাগাম তো আর অন্যের হাতে দিয়ে দেওয়া যায় না৷”
“কথাটা তুমি ঠিকই বলেছ। তবে এর পরের বার এলে অনেকদিন থেকে যেতে হবে৷ তোমার পুরো পরিবারের আমন্ত্রণ রইল।”
প্রত্যুত্তরে ক্ষীণ হাসল অর্পণ। একবার ইরার দিকে তাকাল। দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হতেই ভেংচি কাটল ইরা৷ অর্পণের হাসি পেলেও ভদ্রতার খাতিরে হাসতে পারল না৷ প্রলয় বাড়িতে নেই। একটু বের হয়েছে মিন্টুকে নিয়ে৷ বের হবার আগে শাহাদাৎ মোড়লকে জানিয়ে গিয়েছিল। তাকে নিয়ে চিন্তায় থাকতে হয় অর্পণের। রাজনীতির সুক্ষ্ম পথে প্রত্যেকটা কদম অতি সাবধানে ফেলতে হয়৷ কখন কোথায় কোন ঘাতক ওত পেতে বসে থাকে‚ কে জানে! ফোন বের করে ভাইয়ের নাম্বারে ডায়াল করল। দু বার রিং হতেই রিসিভ করল প্রলয়। স্বস্তির নিশ্বাস নিল অর্পণ। শশব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল‚
“একা কোথায় গিয়েছ ভাই?”
“প্রেমিকাদের মত আচরণ করবি না একদম। আমি জবাব দিতে বাধ্য নই।”
“আমার চিন্তা হচ্ছে। কোথায় আছ?”
“আছি কাছে পাশেই।”
সঙ্গে সঙ্গে কল কে’টে দিল প্রলয়। এই ছেলের ধৈর্য হবে কবে? সবকিছুতেই তাড়াহুড়ো। নাজমা গরম গরম নাস্তা বানিয়ে নিয়ে এলেন। সঙ্গে চাও বানিয়ে এনেছেন। শাহাদাৎ মোড়লের সারাদিনে দু’বেলা চা চাই-ই চাই৷ সকালে একবার তো আরেকবার সন্ধ্যায়৷ এমন সময় হুড়মুড় করে মোড়ল বাড়িতে এলেন মহুয়া। অসময়ে উনাকে দেখে সকলেই অবাক হলেন। বিশেষ করে নাজমা। দুপুরেই তো মহুয়া বলছিলেন‚ মেয়েটাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এখন আবার কী হলো? কোনো বিপদ হলো না তো? হাতে রাখা ট্রে-টা টেবিলের উপর রেখেই তিনি এগিয়ে গেলেন মহুয়ার কাছে। জানতে চাইলেন কী হয়েছে? মহুয়ার চোখমুখ ঠিক লাগছে না৷ ঝরঝর করে কেঁদে দিলেন তিনি। উনার কান্না দেখে উপস্থিত সকলে ঘাবড়ে গেলেন সবাই৷ শাহাদাৎ মোড়লের সামনে হাত জোড় করে ক্রন্দনরত কণ্ঠে মহুয়া বললেন‚
“ভাইজান— আমার মেয়েটাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ আমি সবার বাড়িতে খুঁজেছি৷ গ্রামে তো আপনাকে সবাই খুব মান্য করে। আমাকে দয়া করে সাহায্য করুন।”
আরশ এগিয়ে এসে বলল‚ “ভূমি কখন থেকে নিখোঁজ— আই মিন‚ ওকে কখন থেকে খুঁজে পাচ্ছ না আন্টি?”
“আজ তো আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম। দুপুরের রান্নার পরপরই আমি বাড়ি চলে গিয়েছিলাম।”
অর্পণ বলল‚ “তখন থেকেই উনি বাড়িতে নেই?”
“না বাবা! বাড়ি ফিরে দেখি ঘরের দরজা বাহির দিয়ে আটকানো। উঠোন পেরিয়ে টিন দিয়ে ঘেরা প্রবেশদ্বারও চাপিয়ে রাখা ছিল৷ আমার মেয়েটা তো বাড়ি থেকে কোথাও যায় না।”
কথাটা বলে আবারও কেঁদে দিলেন মহুয়া। মেয়ে ছাড়া যে এই পৃথিবীতে উনার আর কেউ নেই৷ আর কোথায় কোথায় খুঁজবেন মেয়েটাকে? অজানা আশঙ্কায় চিত্তব্যাকুল হয়ে উঠল৷ ভয় হচ্ছে ভীষণ। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গিয়েছে উনার৷ ক্রন্দনরত মানবীকে দেখে ভীষণ মায়া হলো অর্পণের৷ সে এগিয়ে এসে মহুয়ার হাতটা ধরে আশ্বাস দিয়ে বলল‚
“আপনি চিন্তা করবেন না আন্টি৷ আমরা যথা সম্ভব চেষ্টা করব আপনার মেয়েকে খুঁজে আনার।”
সময় গড়াচ্ছে সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মেয়ের জন্য চিন্তা৷ ভূমিকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। মেয়েটা সেই বিকেল থেকে নিখোঁজ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে পেরিয়েছে৷ গ্রামে সন্ধ্যে নামার সঙ্গেই রজনি নামে। ব্যাকুল আঁধারিয়ায় ছেয়ে যায় সর্বত্র। জায়নামাযে বসে মেয়ের জন্য দোয়া করছেন মহুয়া। এতটা সময় হলো এখনো মেয়েটার কোনো খোঁজ খবর নেই।
“ও আল্লাহ‚ আমার যে এই মেয়ে ছাড়া দুনিয়ায় আর কেউ নেই। আমাকে মেয়েটাকে সহিসালামতে ফিরিয়ে দাও আল্লাহ।”
অনুমতি ছাড়াই বাড়িতে প্রবেশ করল অর্পণ আর আরশ। কারো অস্তিত্ব অনুভূত হলো মহুয়ার৷ আমিন ধরে পিছু ফিরে তাকালেন তিনি। অর্পণ আর আরশকে দেখে কান্নার বেগ বাড়ল উনার৷ মেয়েটার কোনো খোঁজ পেয়েছে কি-না জিজ্ঞেস করলেন তিনি‚
“কোনো খোঁজ পেলে বাবা?”
আরশ বলল‚ “পুলিশ নিজের কাজ করছে আন্টি৷”
“আপনি কোনো চিন্তা করবেন না আন্টি। আমার ভাই নিজে পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছে। সবাই নিজের যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। ভূমিকে আমরা অবশ্যই খুঁজে পাব। আপনি প্লিজ কান্না করবেন না৷”
অর্পণের কথার মাঝেই হুহু করে কান্না করে দিলেন তিনি। শত স্বান্তনা পেলেও মায়ের মন তো আর মানে না। মা কী তার সন্তানের জন্য চিন্তা করা ছেড়ে দিতে পারে? কক্ষনো না!
রুমাল দিয়ে বেঁধে রাখা ভূমির মুখটা খুলে দিল মকবুল। মুখে তার পৈশাচিক হাসি। ভূমিকে এই অবস্থায় দেখে ভীষণ আনন্দ হচ্ছে তার। হাত‚ পা‚ মুখ বেঁধে রাখা হয়ছে। মেয়েটার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ অশ্রুকণা। মেয়েটার কান্নাই যেন আনন্দ দিচ্ছে মকবুলকে৷ সেই কোন বিকেলে মেয়েটাকে এখানে এনে রেখেছে। তার একটাই কারণ হচ্ছে‚ রাত হলে ভূমিকে নিয়ে এই গ্রাম থেকে পালাবে সে। ঘেমেঘেটে একাকার অবস্থা ভূমির। অতিরিক্ত কান্নার ফলে গলা শুকিয়ে কাট হয়ে রয়েছে। ক্রমাগত কাশছে মেয়েটা৷ মকবুল গিয়ে মুখটা খুলে দিল ভূমির। মেয়েটা হাঁপাতে শুরু করল। ক্রন্দনরত হতবিহ্বল অবস্থায় ভূমি বলল‚
“দয়া করে আমাকে যেতে দিন কাকা।”
“বারে বারে আমারে কাকা কইবা না৷ আমি তোমার কোন জনমের কাকা লাগি? আমার খালি বয়সটাই ইট্টূ বাড়ছে। দাঁড়ি ফালাইয়া দিলে চ্যাংড়া পোলাগুলার লাহান লাগব।”
শক্ত হাতে ধরল ভূমির হাত দু’খানা। মেয়েটা ছাড়া পাবার আশায় মোচড়ামুচড়ি করছে। যতই হোক পুরুষালি শক্তির সাথে কী আর পারা যায়? তারউপর হাত দুটো দড়ি দিয়ে বাঁধা। পা দুটোও একই দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে মকবুল।
“আমাকে ছেড়ে দিন। আম্মা জানলে কিন্তু আপনার রক্ষে নেই।”
“তোমার আম্মা আমার কিছুই করতে পারব না। হুদাই আমারে ভয় দেখাইয়া লাভ নাই। আমি তোমার ছাড়মু না। আর না কোনো খানে যাইতে দিমু৷ আমার বয়স কী বইয়া থাকব? আমি আইজকাই তোমারে শহরে রওনা দিমু। এইতো সকালে তোমার আম্মারে কইলাম‚ মাইয়া বিয়া দিবা নাকি! হেতি এমন কইরা চাইয়া রইল‚ মনে হইল আমারে কাঁচা চিবাইয়া খাইব। মা’গীর বহুত তেজ।”
“মুখ সামলে কথা বলুন কাকা৷ আমার আম্মাকে গালমন্দ করে কথা বলবেন না।”
মাতাল মকবুল মেঝে থেকে মদের বোতল খানা তুলে ভূমির কপালে ছুড়ে দিল। ‘ঠাস’ শব্দটা হলরুমে প্রতিধ্বনি তুলছে। সঙ্গে সঙ্গে কপাল কে’টে র’ক্ত ঝড়তে শুরু করল। মেঝেতে কাঁচের টুকরো বিছিয়ে পড়েছে৷ আঁধারে ব্যথায় নড়েচড়ে উঠতে দুপায়ে কাঁচ ফুটে উঠল। ব্যথার মাঝেও আফসোস করতে শুরু করল ভূমি৷ কোন কুক্ষণে যে জিনিয়ার কথা শুনে বাহির হয়েছিল আল্লাহ মালুম।
বিকেলে…
রাতের জন্য ভাত তাড়াতাড়ি রান্না করে ফেলেছে ভূমি। কুপির টিমটিমে আলোতে রান্না বসাতে ইচ্ছে করে না। রাতের জন্য তরকারি রান্না করতে হয় না। আম্মা সঙ্গে করে তরকারি নিয়ে আসেন। ভাত রান্না হতেই ভূমি গিয়ে মুরগী গুলোকে খাবার দেওয়ার প্রস্তুতি নিল৷ আছরের আযান অনেক আগেই পড়েছে। নামাযও আদায় করে নিয়েছে সে৷ সন্ধ্যে হবার ঘণ্টা খানেক আগেই আর মুরগী গুলো খুপরিতে উঠে যায়। এদের অভ্যেস আবার ভালো আছে। কারো গলার আওয়াজ ভেসে আসছে আবছা৷ হ্যাঁ! ভূমিকেই তো ডাকছে।
“ভূমি বু! ও ভূমি বু!”
হাতের মুঠোয় রাখা খুদ গুলো উঠোনে ছিটিয়ে দিয়ে‚ ভূমি গেল প্রবেশদ্বারের কাছে৷ জামাল কাকা মেয়ে জিনিয়া দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ এ সময় জিনিয়াকে দেখে বেশ অবাক হলো ভূমি। রমিজা কাকি তো তার মেয়েকে কস্মিনকালেও এ বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেন না। তবে আজ হঠাৎ? টিনের বেড়া সরিয়ে দিতেই জিনিয়া বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল৷ বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার আগে বাহিরের এদিকসেদিক তাকিয়ে দেখল কেউ দেখেনি তো? যাক কেউ নেই আশেপাশে। হাফ ছেড়ে বাঁচল জিনিয়া। ভেতরে প্রবেশ করেই ভূমিকে বলল‚
“তোমারে খালা যাইতে কইছে৷”
“আজ আবার কেন যেতে বলেছে? আম্মার কোনো দরকার পড়লে তো মণিকেই পাঠান।”
“আমি অত কিছু জানি না। তুমি যাইবা নাকি না?”
“যাচ্ছি। তুই একটু অপেক্ষা কর। আমি মুরগী গুলোকে খুপরিতে তুলে নিই।”
“আইচ্ছা।”
স্কুলের দিক থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে ক্রমাগত। থানা থেকে বেরিয়ে এদিকটা দিয়ে যাচ্ছিল প্রলয়৷ অর্পণের থেকে যখন শুনেছে ভূমি নামের মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না‚ তখনই সে মোড়ল বাড়ি থেকে আবারও বেরিয়েছিল। বিকেলে পুষ্করিণী পাড়ে কিছুটা সময় কাটিয়ে মোড়ল বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে অর্পণকে পেল না সে। ফোনে কল দিতেই অর্পণ সব খুলে বলল তাকে। এরপর হুড়মুড় করে বেরিয়েছে সে। সোজা গিয়েছে অনিন্দ্যনগর থানায়। তাকে দেখা মাত্রই কনস্টেবল তড়িঘড়ি করে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ বেচারা বসে বসে ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল৷ প্রলয়কে দেখেই চিনতে পেরে গিয়েছিল। একটা মিসিং ডায়েরি আর শাসিয়ে এসেছিল— যে করেই হোক মেয়েটাকে একঘণ্টার মাঝেই খুঁজে বের করতে হবে৷ তার এক কথাতেই কাজ হয়ে গিয়েছে৷
সন্দেহকে গুরুত্ব দিয়ে প্রলয় স্কুলের ভেতরে প্রবেশ করল। এরপর যা দেখল তাতে তার শিরা উপশিরা রক্ত টগবগ করতে শুরু করল। সেদিনে সেই লোকটাই ভূমিকে আটকে রেখেছে৷ ফোনের ফ্ল্যাশলাইট চালু করতেই মকবুল চেঁচিয়ে উঠল‚
“অ্যাই কে রে? কে ওখানে?”
“তোর মৃত্যুদূত।”
প্রলয় দৌঁড়ে গিয়ে ভূমির পাশে দাঁড়াল৷ একটু ঝুকে বলল‚
“আপনি ভয় পাবেন না৷ আমি আছি তো। আমি আপনার কোনো ক্ষতি হতে দেব না।”
প্রলয়কে খুব সহজেই বিশ্বাস করে নিল ভূমি। এই লোকটাই যে পরশুদিন তাকে মকবুলের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল৷ আধবোজা চোখে প্রলয়ের দিকে তাকিয়ে শুষ্কবিমর্ষ কণ্ঠে ভূমি বলল‚
“দয়া করে আমাকে বাঁচান। আমাকে আমার আম্মার কাছে পৌঁছে দিন।”
দুজনের কথার মাঝেই ভারী মাতাল কণ্ঠে মকবুল বলে উঠল‚
“তোর আম্মা যেমনে বেশ্যার খাতায় নাম লেখাইছিল তোরেও ওই খাতাতেই নাম লেখাইতে হইব৷ তুই হইবি আমার রক্ষিতা।”
নিভন্ত ছাই এবার আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে পরিনত হলো৷ চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে তৎক্ষণাৎ। শুকনো ঢোক গিলল মকবুল। তবে নিজের ভীতিকে প্রকাশ করল না প্রলয়ের সামনে। মনে সাহস সঞ্চার করে বলল‚
“ওই মিয়া তুমি এইখান থাইকা চইলা যাও। আমারে আমার কাম করতে দেও।”
প্রলয়ের গম্ভীর সেই কণ্ঠস্বর‚ “যদি না যাই?”
“তোমারে মাইরা হইলেও আমি এই মাইয়ারে নিয়া যামু।”
বাঁকা হেসে প্রলয় বলল‚ “আমাকে মারবেন? সেহরিশ আরশান প্রলয়কে মারবেন?”
হকচকিয়ে গেল মকবুল। তবুও নিজের ধারাকে অটল রেখে বললেন‚ “হ কইলামই তো— তোমারে মাইরা হেরপর এই মাইরারে ভোগ করমু আমি।”
“তাই বুঝি?”
তীব্র রাগে চেঁচিয়ে উঠল প্রলয়। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল মকবুলের। এ জন্মে এমন রাগের সম্মুখীন হতে হয়নি তাকে। আজই প্রথম৷ প্রচণ্ড রাগ ধরে রাখতে না পেরে মকবুলের বুকের মধ্যিখানে লাথি মে’রে বসল প্রলয়৷ ছিটকে পড়ে গেল মকবুল। ধুলোবালি জমা মেঝেতে পড়তেই আর্তনাদ করে উঠল সে৷ ভয়ে দুচোখ বন্ধ করে নিল ভূমি। কপাল বেয়ে র’ক্ত ঝড়ছে। এতকিছুর মাঝে পায়ের ব্যথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে সে৷ চোখের সামনে প্রলয়ের ভয়ঙ্কর রূপ দেখছে। এমনিতে গম্ভীর মনে হয়েছে তাই বলে এত রাগ? চোখমুখ দিয়ে যেন আগুন ঝড়ছে৷ থেকে থেকে কেঁপে উঠছে ভূমি। হঠাৎ করে অচৈতন্য হয়ে মেঝেতে ঢলে পড়ে মেয়েটা। দেখেও দেখে না প্রলয়। তার পূর্ণ অগ্নিদৃষ্টি মকবুলের দিকে নিক্ষেপ করেছে৷ মকবুল হাত জোর করে ভীতু গলায় বলল‚
“আ..আমারে ছাইড়া দেও৷ এই ভূল আমি আর করতাম না।”
“আমার বিচারালয়ের একটাই শাস্তি। আর তা হচ্ছে মৃত্যু।”
তিনটে গুলির আওয়াজে অনিন্দ্যনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হলগুলো কেঁপে উঠল। অচৈতন্য হয়ে পড়ে থাকা অঙ্গনাকে একপলক দেখে নিল প্রলয়। কা’টা মুরগীর মতো ছটফট করছে মকবুল। একটা সময় তার নিথর দেহটা সেখানেই পড়ে রইল৷ মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট চালু করে এদিক-সেদিক কিছু একটা খুঁজতে লাগল। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পেতেই কোলে তুলে নিল ভূমিকে। মেয়েটার কপাল র’ক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠছে। কাঁচের টুকরো দিয়ে পা কে’টে ক্ষ’তবিক্ষ’ত হয়েছে। আদতে কী সেই ব্যথা অনুভূত হচ্ছে অচৈতন্য হয়ে পড়ে থাকা অঙ্গনার? তীব্র ব্যথায় নীল হয়ে আছে কোমলময়ীর সুশ্রী।
বড়ো বড়ো পা ফেলে স্কুল থেকে বেরিয়ে গেল প্রলয়। এখানে থাকাটা একটুও নিরাপদ নয় দুজনের জন্য। নিজের আর ভূমির বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ রাখেনি সে৷ আর যদি এতেও কোনো সমস্যা হয়ে থাকে— সেটা ব্যক্তিগত ভাবে বুঝে নিবে। রাতের নিস্তব্ধতা বাড়ছে৷ একটু আধটু হাঁটার শব্দ হচ্ছে৷ রাতের শিশিরে ভিজে আছে মাটিতে জন্মানো দূর্বাঘাস গুলো। ভেজা কাঁদা মাটি লেগে রয়েছে প্রলয়ের জুতো জোড়ায়। অন্ধকার নিশ্চয়ই সেটা দৃষ্টিগোচর হবে না। শানবাঁধানো ঘাটে নিয়ে এসে শুইয়ে দিল ভূমিকে। হাঁটু গেড়ে বসে পায়ের বাঁধন খুলে দিল প্রলয়। ডান পায়ের গোড়ালিতে একটা বড়ো কাঁচের টুকরো গেঁথে রয়েছে। প্রলয় সন্তপর্ণে টুকরোটা বের করল। অচৈতন্য অবস্থাতেও কেঁপে উঠল ভূমি।
পুষ্করিণী পাড়ে আবছা আলোর দেখা পেয়েই কয়েকজন ছুটে এলো৷ গুলির আওয়াজ শুনেই মূলত উনারা বের হয়েছেন। ব্যাটারি লাইটের আবছা আলোতে প্রলয় আর একটা অচৈতন্য মেয়েকে একসঙ্গে দেখে একজন বলে উঠলেন‚
“পুষ্করিণী পাড়ে ন’ষ্টা’মি করবার আইছেন? এই না আপনে মান্যগণ্য লোক। সমাজের সেবা করেন? একা একটা মাইয়ারে পাইয়া ইজ্জত লুটবার আইছেন!”
মুখ তুলে লোকগুলোর দিকে তাকাল প্রলয়। আপাতত নিজের জন্য চিন্তা হচ্ছে না তার৷ মেয়েটার জ্ঞান ফেরানো অধিক জরুরি। লোকগুলোর কথা কানে তুলল না৷ হাতে মুঠোয় কিছুটা পানি তুলে ছিটিয়ে দিল ভূমির মুখে। ভূমির মুখের দিকে একজন লাইট ধরল৷ অসাড় হয়ে পড়ে থাকা মেয়েটার মুখ ভেসে উঠল নিমিষেই। লোকগুলোর মাঝেই একজন বলে উঠল‚
“কারেই বা কী কইতাছি আমরা? মা যেমন আকাম করছিল‚ মাইয়াও তো সেই পথেই হাঁটব।”
চলবে?…..
#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১১|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
অদূরে কারো কারো উচ্চরব ভেসে আসছে৷ দিনের আলোয় বাতাবরণ যেমন কোলাহলে পরিপূর্ণ হয়‚ রাতে ঠিক ততটাই নীরবতায় আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে। অর্পণ আর আরশকে কিছু না বলেই কুপি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন মহুয়া। উনার এমন ব্যবহার অবাক আর হতভম্ব করল অর্পণ আর আরশকে। একপ্রকার হন্তদন্ত হয়ে বেরোলেন মহুয়া। মন বলছে উনার মেয়ে কাছে পাশেই রয়েছে। আওয়াজ ভেসে আছে পুষ্করিণী পাড় থেকে৷ ধ্বনি অনুসরণ করে তিনি সেদিকটাতেই গেলেন। লোকসমাগম ছয় সাতেক হবে। সকলেই ব্যাটারি লাইট ধরে রেখেছে প্রলয় আর অচৈতন্য হয়ে পড়ে থাকা মেয়েটার দিকে৷ দূর থেকে স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও মহুয়া ধীর পায়ে সেদিকটাতেই এগিয়ে গেলেন। মেয়েকে এই অবস্থায় দেখে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লেন তিনি। উনাকে দেখা মাত্রই একজন বলে উঠল‚
“বড়োলোক এমপি পাইয়া মাইয়ারে লেলাইয়া দিছ। এখন বুঝ কেমন লাগে!”
ক্রন্দনরত অবস্থায় মহুয়া বললেন‚ “এসব কী বলছেন আপনারা? আমার ভূমি এমন মেয়ে নয়। দেখছেন তো আমার মেয়েটা দুর্বল। তারপরও কেন খারাপ খারাপ কথা বলছেন?”
“চোরের মায়ের বড়ো গলা। শহরে গিয়া তো নিজেই পেট বাঁন্দাইয়া আসছিলা। ভুইলা গ্যাছ বুঝি?”
এতগুলো মানুষের সামনে আবারও পুরোনো কথা উঠে আসছে। গ্রামের মানুষগুলোর কথাবার্তা শুনে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে মহুয়ার৷ মেয়েকে নিয়ে খারাপ কথা তিনি কখনো সহ্য করবেন না! কক্ষনো না! মহুয়া বললেন‚
“অনেক বলেছেন আর না! আমার আল্লাহ জানেন আমি কখনো পাপ করিনি৷ আর না আমার মেয়ে কোনো পাপ করতে পারে।”
এবার প্রলয় মুখ খুলল‚ “অনেকক্ষণ ধরে আপনাদের অনেক কথা শুনছি। আপনারা আপনাদের নোংরা মুখটা এবার বন্ধ করুন। দেখছেন তো একটা মেয়ে কতটা দুর্বল। আপনাদের এখানেই থেকে কোনো কাজ নেই তাই এখন এখান থেকে যেতে পারেন।”
“আমগোর এইসব দেইখা কোনো কাম নাই। তবে কথা তো আমগোরই কইতে হইব। কে কইতে পারে— এই মাইয়ার এমন অবস্থা তোমার লিগা হয় নাই?”
দাঁত কিড়মিড় করে রমিজা বললেন‚ “উনিশ বছর আগে এই মহুয়ারে গ্যারামে জায়গা দেওয়াই আমগো সবচেয়ে ভুল। একই ভুল আমরা দ্বিতীয় বার করতাম না। এই মাইয়ারে আইজ গ্যারাম থাইকা বাইর করতে হইব।”
“ঠিক! রমিজা ভাবি একখান উচিত কথা কইছে।”
নিজের পক্ষে কাউকে পেয়ে রমিজা যেন আকাশে উড়ছেন। অত্যাধিক ভাব নিয়ে বললেন‚
“আমি উচিত কথা কই দেইখাই‚ আমারে কেউ ভালা পায় না।”
স্ত্রীর কথা তেতে উঠলেন জামাল মিয়া। কোনো কালেই স্ত্রীর মুখের উপর কথা বলতে পারেন না তিনি। গালমন্দ করে চুপ করিয়ে দেন রমিজা। আজ মুখ খুললেন। জামাল মিয়া বললেন‚
“এখন কইলাম বেশি করতাছ৷ ওগো সমস্যা ওরাই মিটাইয়া লইব। তুমি চুপ থাক।”
জামাল মিয়ার দিকে চোখ গরম করে তাকালেন রমিজা। স্বামী বলা কথা কস্মিনকালেও পছন্দ হয় না উনার। ভীড় ঠেলে অর্পণ আর আরশ এসে দাঁড়াল পুষ্করিণী পাড়ে। মহুয়া মেয়ের মাথার কাছে বসে রয়েছেন। অর্পণ হাঁটু গেড়ে বসে ভূমির পালস পরিক্ষা করল। মেয়েটার শরীর অত্যন্ত দুর্বল। আরশের দিকে তাকিয়ে কিছুটা ইশারা করল অর্পণ। ইশারা বুঝতে পেরেই আরশ বলল‚
“আপনারা এখন ভীড় কমান। ইমিডিয়েটলি ভূমির ট্রিটমেন্ট শুরু করা প্রয়োজন। কপাল আর পায়ের ক্ষ’তটাও বেশ গভীর। ড্রেসিং করাতে হবে।”
শাহাদাৎ মোড়লকে খুব সম্মান করে গ্রামবাসী। সেই সাথে আরশকেও সম্মানের চোখে দেখে সবাই। তার এক কথাতেই কাজে দিল। আপসে মেনে নিয়ে একজন বলে উঠল‚
“আমরা এখন চইলা যাইতাছি কিন্তু কাল এর একটা বিহিত মোড়ল সাব-রে করতেই হইব।”
ভীড় কমতে শুরু করেছে৷ প্রলয়ের দিকে তাকিয়ে অর্পণ বলল‚ “ভাই উনাকে বেশিক্ষণ এভাবে রাখলে ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে। ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেই ভালো হবে। কপাল আর পায়ে বেন্ডেজ করাতে হবে৷”
বিনা বাক্যব্যয়ে ভূমিকে কোলে তুলে নিল প্রলয়৷ অর্পণ দ্রুত পায়ে গাড়ি থেকে ফার্স্টএইড বক্স নিয়ে ভূমিদের বাড়িতে ঢুকল৷ মহুয়া তাড়াহুড়ো করে মেঝেতে মাদুর আর কাঁথা বিছালেন। একটা বালিশও এগিয়ে দিলেন তিনি। ভূমিকে নিয়ে গিয়ে মেঝেতে শুইয়ে দিল প্রলয়। আরশ তার ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে রেখেছে৷ অর্পণ ছুটে এলো। প্রলয় সেখান থেকে সরে দাঁড়াল। ধুলোবালি‚ র’ক্ত জমাট পা দুটো ড্রেসিং করিয়ে বেন্ডেজ করে দিল অর্পণ। ক্ষ’ত হয়েছে বেশ অনেকটাই। ডান পায়ে খুব বেশি আঘা’ত পেয়েছে। কাঁচ অনেকটা ফুটে গিয়েছিল। কপালের রক্তও পরিষ্কার করিয়ে দিল। অল্পের জন্য ক্ষ’তটা গভীর হয়নি। যার জন্য সেলাইও লাগেনি। টিটেনাস আর ঘুমের ইঞ্জেকশন পুশ করে দিল। আজ আর জ্ঞান ফিরবে না৷
“আন্টি আপনি চিন্তা করবেন না। আশা রাখা যাচ্ছে দুর্বলতা ভাবটা কালকের মধ্যেই কে’টে যাবে। তবে ক্ষ’ত শুকতে সময় লাগবে।”
“তোমাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ বাবা। আমার মেয়েটাকে কোথায় পেয়েছিলে প্রলয়?”
“উনাকে আমি এই অবস্থাতেই রাস্তা পেয়েছিলাম। জ্ঞান ফিরছিল না বিধায় ঘাটে নিয়ে গিয়েছিলাম। তখনই গ্রামের মানুষ একজোট হয়ে যা তা বলতে শুরু করল।”
প্রলয় আসল কথাটা জানাল না। কিছুটা এড়িয়েই গেল। প্রলয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মহুয়া বললেন‚
“তুমি না থাকলে যে আমার মেয়েটার কী হত! তোমার ঋণ প্রত্যর্পণ করার ক্ষমতা আমার নেই বাবা৷”
“আপনি প্লিজ এভাবে বলবেন না। মানুষই তো মানুষের হিতসাধনে আসবে। রাত হচ্ছে‚ আমরা এখন আসি?”
“আচ্ছা বাবা।”
অর্পণ আর আরশকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল প্রলয়। নিজের ফোন থেকে অর্পণের ফোনে একটা টেক্সট করল সে। নোটিফিকেশন বেজে উঠতেই একবার ফোন স্ক্রিনে চোখ বুলাল অর্পণ। এরপর আরশকে বলল‚
“আরশ তুই গাড়ি নিয়ে বাড়িতে চলে যা। আমি আর ভাই একটু থানা থেকে আসছি।”
অর্পণের হাত থেকে গাড়ির চাবিটা নিয়ে আরশ বলল‚ “তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি। আসছি।”
সে রাতে ঘুম হলো না মহুয়ার। মেয়ের মাথায় কাছেই ঠায় বসে রইলেন নির্ঘুম রাত। ভোরের আলো ফুটে উঠতেই মহুয়া গোসল ঘরে গেলেন। কিছু সময় পর ওযু করে এসে নামায আদায় করলেন। অনেকটা সময় নিয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন। মেয়েকে ফিরে পেয়ে অশান্ত মন খানিকটা শান্ত হলো তবে মন থেকে চিন্তা কিছুতেই দূর হলো না। না জানি আজ নালিশে কী অপেক্ষা করছে! সজাগ হচ্ছে ভূমি। কপালে আর পায়ে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। অসহনীয় ব্যথায় কপাল কুঁচকে এলো মেয়েটার। একটু করে উঠার চেষ্টা করল। তবে ব্যর্থ হলো সে৷ উঠতে পারল না৷ মহুয়া খেয়াল করলেন। জায়নামায গুছিয়ে রেখে মেয়ের মাথার কাছটায় গিয়ে বসলেন। মেয়ের শরীরের ভরটা নিজের উপর নিয়ে উঠে বসালেন তিনি। মেয়েকে শুধালেন‚
“এখন ঠিক লাগছে? বাহিরে যাবি?”
ভূমি মাথা উপর নিচ ঝাকাল। যার অর্থ ‘হ্যাঁ!’ সে বাহিরে যাবে।
ঘর্মাক্ত হয়ে রয়েছে প্রত্যেকের শরীর। মোড়ল বাড়ির বাগানে গ্রামবাসী ভীড় জমিয়েছে। সকলেই ভূমি আর প্রলয়ের বিরুদ্ধে নালিশ নিয়ে এসেছে। শাহাদাৎ মোড়ল পড়েছেন বিড়ম্বনায়৷ কীইবা বিচার করবেন তিনি? কীইবা বিচার করার আছে উনার। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তো এখানে কেউই নয়। সকলে একসঙ্গে বলাবলি করছে‚
“আমগো গেরামে মাইয়ারে অপবিত্র করছে ইনি। আমরা এর বিহিত চাই মোড়ল সাব।”
“এই ন’ষ্টা মাইয়া রে আমগো গেরামে আর রাখমু না।”
ভূমির ব্যাপারে খারাপ কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল প্রলয়৷ চেঁচিয়ে বলে উঠল‚ “মুখ সামলে কথা বলুন৷ সত্যি মিথ্যে কিছু না জেনে কারো সম্বন্ধে খারাপ কথা বলতে পারেন না।”
“আপনে মিয়া চুপ থাকেন। অসহায় মাইয়া পাইয়া ইজ্জত লুটছেন আর বড়ো বড়ো কথা কন?”
“হয় এই মাইয়া রে এমপি সাব বিয়া করব আর নাইলে এরা মা মাইয়া এইখান থাইকা সারাজীবনের লাহান চইলা যাইব। তাও আবার মুখে চুন কালি মাইখা।”
অর্পণ এগিয়ে এসে বলল‚ “কীসের মধ্যে কী বলছেন আপনারা? অসহায় একটা মেয়েকে আমার ভাই সাহায্য করেছে আর আপনারা তার উপরই আঙুল তুলছেন? ছিহ্!”
“মোড়ল সাব আমরা আপনের কাছে বিচার চাই।”
সকলের এত এত কথার জালে আটকে পড়েছে ভূমি। মেয়েটা কান্না করতেও যেন বেমালুম ভুলে গিয়েছে৷ এত মানুষের কটু কথায় ভয় হচ্ছে ভীষণ। মায়ের আঁচল খামচে ধরে রেখেছে৷ নিজেকে অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছে ভূমির৷ অষ্টাদশী কন্যার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠেছে অজানা আশঙ্কায়। এই বিবাদের শেষ কোথায়— জানা নেই তার!
“অর্পণ কাজির ব্যবস্থা কর— এক্ষুনি এখানে বিয়ে হবে। পুরো গ্রাম সাক্ষী থাকবে।”
প্রলয়ের কথায় ভড়কে গেল অর্পণ। এখানে কাজি ডেকে আনা মানে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তার ভাই যে কখনো অন্যায়ের সাথে আপস করেনি। তাহলে আজ কেন? অর্পণ নিজে থেকে কিছু বলতে নেবে তার আগেই হুঙ্কার দিয়ে উঠল প্রলয়৷ তার এমন হুঙ্কারে কেঁপে উঠল উপস্থিত সকলের হৃদয়৷ প্রলয়ের এক অন্যরকম রূপ দেখছে শাহাদাৎ মোড়ল। এই তিনদিন তো অত্যন্ত বিনয়ী এবং শান্ত মনে হয়েছিল৷ কিন্তু ছেলেটার যে এত রাগ তা ঘুনাক্ষরেও টের পাননি তিনি৷ পাবেনই বা কী করে? মানুষ যতটা প্রকাশ করে ততটাই জানা যায় আর বাকিটা তো অজানাই থেকে যায়। মায়ের আঁচলের পেছন থেকে উঁকি দিল ভূমি৷ এতক্ষণে সব কথাই শুনছিল। সমস্ত কটু কথা নীরবে হজম করেই নিচ্ছিল। তাহলে লোকটা কেন এদের দাবি মেনে নিচ্ছে?
কিছু সময় চুপ থেকে প্রলয় আবারও বলল‚ “যেটা বললাম— চুপচাপ সেটাই কর৷ নাকি দাওয়াত করে পাঠাতে হবে?”
বিয়ের কথা শুনতেই চোখ মুখে আঁধার নেমে এলো মহুয়ার। তার মেয়ে সজ্ঞানে কোনো অন্যায় করতেই পারে না। এতটুকু বিশ্বাস উনার ভূমির প্রতি রয়েছে৷ এত মানুষের ভীড়ে আতঙ্কে আড়ষ্ট হয়ে রইল মায়ের পেছনটায় লুকিয়ে রইল ভূমি। মায়ের আঁচল খানা খিঁচে ধরে রেখেছে সে৷ মহুয়া মেয়েকে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেছেন। ভূমি একবার মাথা তুলে মায়ের সুশ্রী পানে তাকাল৷ উদ্দীপ্ত‚ উদ্ভ্রান্তের ন্যায় বলল‚
“আম্মা আমি কোনো অন্যায় করিনি— আর না আমি কোনো পাপ করেছি৷ তাহলে কেন শাস্তি পেতে হবে?”
মেয়ের এহেন কথা মায়ের মায়াময়ী হৃদয়কে ক্ষ’তবিক্ষ’ত করল। নিজেকে সামলে মহুয়া বললেন‚ “কোনো অন্যায় না করেও কিছু কিছু সময় পরিস্থিতির চাপে পড়ে আমাদের সবকিছু সহ্য করে নিতে হয়।”
“আমার কী দোষ ছিল আম্মা? ওই খারাপ লোকটাই তো আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।”
মাথায় র’ক্ত ছলকে উঠল মহুয়ার। এ কথা তো তিনি জানতেন না। অতিশয় ক্রোধে বশীভূত মানবী চেয়ে রইলেন মেয়ের মুখপানে৷ গম্ভীর কণ্ঠে শুধালেন‚
“কে নিয়ে গিয়েছিল তোকে?”
মায়ের কণ্ঠস্বর বড্ড অচেনা মনে হলো। মুখ তুলে তাকাল ভূমি। ক্রন্দনরত অবস্থাতেই বলল‚ “মকবুল কাকা।”
শরিয়ত মতে বিয়ের কাজ সুসম্পন্ন হলো। নালিশে উপস্থিত কাউকেই স্থানচ্যুত হতে দেয়নি প্রলয়। বরঞ্চ সে নিজের সিদ্ধান্তে অটোল৷ আজ বিয়ে হবে মানে আজই হবে। এর কোনো ব্যত্যয় হবে না। অত্যন্ত রোদের তপ্ততা আর বিরক্তিতে চোখ মুখ ঝলসে যাচ্ছে বাকিদের। দাঁত কিড়মিড় করে সকলেই চেয়ে রয়েছে প্রলয়ের দিকে৷ মনে হচ্ছে যেন কাঁচাই চিবিয়ে যাবে। বিয়ের কাজ সম্পন্ন হবার পরেও মানুষগুলোর কানাঘুষা বন্ধ হলো না। বরঞ্চ সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাদের কানাঘুষা তড়তড় করে বাড়তে লাগল। প্রলয় শান্ত স্নিগ্ধস্বরে শুধাল‚
“কাজ খতম? এখানে তো আপনাদের আর কোনো কাজ নেই! দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
“এই ন’ষ্টা মাইয়ারে এই গ্রামে দেখতে চাই না মোড়ল সাব। আমরাও তো পরিবার নিয়া বাস করি৷ পোলা মাইয়ারা কী শিখব?”
অত্যন্ত তীক্ষ্ণ স্বরের কথা ছুড়ে দিল প্রলয়‚ “শুনেছি আপনি স্কুল শিক্ষক। আপনার থেকে এমন ব্যবহার আশা করা যায় না।”
গম্ভীর স্বরে প্রলয়ের বলা কথাটায় ভড়কে গেলেন আজিজ মাস্টার। কিছু বলতে পারলেন না ঠিকই কিন্তু আমতা আমতা করতে লাগলেন। আরেকজন বলে উঠল‚
“বিয়ার কাম শেষ। শুনছিলাম আপনেরা নাকি শহরে চইলা যাইবেন?”
অর্পণ বলল‚ “হ্যাঁ চলে যাব— তাতে কী?”
“এই অপয়া মাইয়ারে লগে কইরা নিয়া যাইবেন। এরে আমরা আমগোর গেরামে কিছুতেই রাখমু না।”
এবার মুখ খুললেন শাহাদাৎ মোড়ল। তিনি বললেন‚ “আপনাদের কথা মানা হয়েছে। আপনারা এখন আসতে পারেন।”
ভীড় কমতে শুরু করল। ভূমিকে ছেলের বউ বানানোর ইচ্ছে দমন হলো নাজমার। মনে মনে তিনি বেশ বড়োসড়ো ইচ্ছে পোষণ করছিলেন। হোক মেয়েটা গরীব— তাতে কী? এত বছর ধরে মহুয়া উনাদের বাড়িতে কাজ করছে। কখনো কোনো খারাপ উদ্দেশ্য উপলব্ধি করেননি তিনি। বরঞ্চ মহুয়া উনার বেশ বিশ্বস্ত। ভূমি‚ মেয়েটা বেশ শান্তশিষ্ট। একদম মহুয়ার কার্বনকপি। প্রথম থেকেই মহুয়াকে বোনের মতো দেখে এসেছেন নাজমা। ভূমিকে তিনি সেদিন প্রথম দেখলেও মণির কাছ থেকে সমস্ত খোঁজ খবর আগেই রেখেছিলেন। চুপসানো মুখ নিয়েই স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন নাজমা। উনার পাশেই একটা চেয়ারে ভূমিকে বসিয়ে রাখা হয়েছে৷ মেয়েটার পায়ের ব্যথা আগের তুলনায় বেড়েছে। দাঁতে দাঁত খিঁচে ব্যথাকে সংবরণ করছে মেয়েটা। মেয়েকে সামলে রেখেছেন মহুয়া।
অর্পণ আর আরশ দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রলয়ের পাশে। অর্পণ চেয়েও কিছু করতে পারল না। তার ভাই যেটা বলেছে সেটা করেই ছাড়বে। অ্যাট এনি কস্ট! অনেক কিছুই জানার রয়েছে অর্পণের। তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে তার ভাইয়ের দিকে। প্রলয় বুঝতে পেরে বলল‚
“এখানে একটা কথাও না। আমি আজই ঢাকা ফিরতে চাই। সব ব্যবস্থা কর।”
অকপটে অর্পণ শুধাল‚ “আর ভূমি?”
“উনি এখন আমার দায়িত্ব— কথাটা ভূলে যাস না।”
হন হন করে মোড়ল বাড়ির ভেতরে চলে গেল প্রলয়। ভেতরে দাবিয়ে রাখা তুমুল ক্রোধ আর কিছুতেই দমন করা যাচ্ছে না। বড়ো বড়ো পা ফেলে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় নিজেদের কাঙ্ক্ষিত কামরায় গিয়ে দুয়ার আটকে দিল প্রলয়। এক হাত দূরত্বে সাজিয়ে রাখা ফুলদানিটা সজোরে মেঝেতে ছুড়ে ফেলল৷ চোখের পলকে ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেল ফুলদানিটা৷ রাগ কিছুতেই কমছে না। আরও অনেক কিছুই ভাঙতে ইচ্ছে হলো কিন্তু সে তো এই বাড়ির অতিথি। অতিথি হয়ে এমন আচরণ মোটেই ভদ্রতার পরিচয় দিচ্ছে না।
সময় এসে ঠেকেছে ভরদুপুরে। দুর্বল শরীর নিয়ে এতটা সময় রোদের তপ্ততা সহ্য করে‚ একপর্যায়ে কাল রাতের মতো পুনশ্চ জ্ঞান হারাল ভূমি। সকালে অল্প কিছু খাবার খেয়েছিল বটে। অচৈতন্য ভূমিকে নিয়ে গিয়ে বৈঠকখানার সোফায় লম্বা করে শুইয়ে দেওয়া হলো। মেয়ের চোখ মুখে ক্রমাগত পানি ছিটিয়ে দিচ্ছেন মহুয়া৷ তবুও মেয়েটার জ্ঞান ফিরছে না৷ উপায়ন্তর না পেয়ে ইরা ছুটে গেল তার ভাইয়ের কাছে। আরশ ছুটে এলো বৈঠকখানায়।
“অতিরিক্ত দুর্বল হওয়ায় এমনটা হয়েছে। আন্টি আপনি কী ওকে সকালে খাবার আর ঔষধটা খাইয়েছিলেন?”
শশব্যস্তভাবে মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে মহুয়া বললেন‚ “হ্যাঁ!”
“ওর একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। ওকে ধরে যদি একটু ইরার ঘরে নিয়ে যেতে পারেন।”
আরশের কথা শেষ হবার পূর্বেই প্রলয় সেখানে উপস্থিত হলো। সঙ্গে করে নিজের লাগেজ নিয়ে বেরিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে সে এক্ষুনি এখান থেকে চলে যেতে চাইছে। তাকে দেখা মাত্রই শাহাদাৎ মোড়ল অসহায় কণ্ঠে বললেন‚
“মেয়েটার শরীর তো দুর্বল। আবারও জ্ঞান হারিয়েছে৷ বিকেলে রওনা দিলে হয় না?”
প্রলয় ঘাড় বাকিয়ে তাকাল ভূমির দিকে৷ অচৈতন্য অবস্থাতেও মেয়েটা কপাল কুঁচকে রেখেছে। একপলক দেখে নিল প্রলয়। দমে গেলে যেন। মহুয়া গিয়ে ভূমিকে ওঠানোর চেষ্টা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ব্যর্থ হলেন তিনি। প্রলয় কোনো কথা না বলেই কোলে তুলে নিল ভূমিকে। বেশ কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে ইরার ঘরের দিকে অগ্রসর হলো। পেছন থেকে দৌঁড়ে এসে ইরা তার ঘরের দুয়ার খুলে দিল। প্রলয় সন্তপর্ণে বিছানায় শুইয়ে দিল ভূমিকে। পেছন পেছন মহুয়া ছুটে এলেন। মেয়ের মাথার কাছটায় গিয়ে বসলেন তিনি।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে। ভূমির জ্ঞান ফিরেছে অনেকটা সময় আগেই। অপরিষ্কার জামাকাপড় পাল্টে নাজমা একটা নতুন শাড়ি দিয়েছে ভূমিকে পড়ার জন্য। ইরা নিজেই শাড়িটা পড়িয়ে দিয়েছে। মহুয়া নিজ হাতে মেয়েকে খাবার খাইয়ে দিয়েছেন। এরপর আর কোনোদিন সুযোগ হবে কি-না আল্লাহ মালুম। ভূমিকে হাতমুখ ধুইয়ে গোছগাছ করিয়ে দিয়েছিল ইরা৷ বেশ কয়েকটা নতুন জামাকাপড় সঙ্গে করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই ওরা বেরিয়ে পড়বে। ভূমি তার মাকে জড়িয়ে ধরে সমানে বিলাপের সুরে কাঁদছে।
“আমি তোমাকে ছাড়া কী করে থাকব আম্মা? আমি যে মরেই যাব। তুমি উনাদের বারণ করে দাও৷ আমি কোত্থাও যেতে চাই না।”
বুকটা ধক করে উঠল মহুয়ার৷ মেয়েকে ছাড়া কী করে থাকবেন ভাবতেই বুকটা ছিড়ে যাচ্ছে৷
“ও আম্মা গো আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না আম্মা। তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিয়ো না আম্মা।”
অতিরিক্ত কান্নার ফলে কপালে কিঞ্চিৎ ব্যথা অনুভূত হচ্ছে ঠিকই কিন্তু ভূমি সেই ব্যথার তোয়াক্কা করল না৷ গলা ছেড়ে কাঁদছে মেয়েটা। মেয়ের কান্নায় কাঁদছে মায়ের হৃদয়। মহুয়া মেয়ের হাতটা প্রলয়ের হাতে তুলে দিয়ে বললেন‚
“আমার পদ্মিনী বড্ড কোমল। বিয়েটা খুব খারাপ পরিস্থিতে হয়েছে। এর শাস্তি আমার মেয়েটার উপর যেন না পড়ে বাবা। আমার মেয়ের জন্য অবশ্যই তুমি একজন দায়িত্ববান জীবনসঙ্গী হবে। আমি এই ভেবে নিশ্চিন্ত হব যে— আমার পরেও ভূমিকে দেখে রাখার মতো মানুষের হাতে আমার মেয়েটা পৌঁছেছে। এ দুনিয়া আমার মেয়েটাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না‚ আমার জীবন যে জড়িয়ে রয়েছে ওর সঙ্গে। তুমি সবসময় ওর পাশে থেক বাবা।”
“আপনি চিন্তা করবেন না৷ এখন থেকে উনি আমার দায়িত্ব। আমি অবশ্যই নিজের দায়িত্ব কর্তব্য দুটোই খুব নিষ্ঠার সাথে পালন করব।”
একটা কাগজের টুকরো মহুয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে প্রলয় বলল‚ “এটা আমার নাম্বার আর বাড়ির ঠিকানা৷ মেয়েকে যখনই দেখতে ইচ্ছে হবে তখনই চলে আসবেন।”
আড়ালেই চোখ মুছে নিলেন মহুয়া। কালো রঙা গাড়িটা চলতে শুরু করল৷ কান্নার বেগ বেড়েছে ভূমির। বুক চিড়ে কান্না পাচ্ছে তার। হুট করে জীবনটা এভাবে পাল্টে না গেলে হত না? আর যে আম্মাকে কাছে পাবে না সে। মাথার উপর থেকে আদুরে সেই হাত আজ থেকে আর থাকবে না। আম্মাকে একা ছেড়ে সে যে বহু দূরে চলে যাচ্ছে। আবার কবে দেখা হবে আম্মার সঙ্গে? ভাবতেই এবার শব্দ করে কেঁদে দিল ভূমি। হুট করে এমন কান্না করায় ভড়কে গেল প্রলয়। পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে ভূমির দিকে এগিয়ে দিল। মেয়েটা নিল না৷ সে কী দেখতে পাচ্ছে না গম্ভীর লোকটা তার অশ্রু মোছানোর জন্য রুমাল এগিয়ে দিয়েছে? নাকি ইচ্ছে করে দেখতে চাইছে না। প্রলয় একটি বার তার বাম পাশে তাকাল৷ এরই মাঝে মেয়েটা পুনশ্চ জ্ঞান হারাল? ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রলয়। আয়নায় সবটাই খেয়াল করল অর্পণ। ইশারায় জিজ্ঞেস করল ‘কী হয়েছ?’
“সেন্সলেস হয়ে পড়েছে আবার।”
অর্পণ বলল‚ “চিন্তার কিছু নেই। অতিরিক্ত কান্না করার ফলে জ্ঞান হারিয়েছেন।”
চলবে?…..
#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১২|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা অতিক্রমণ করে কালো রঙা গাড়িটা এসে থেমেছে মালঞ্চ নীড়ের সামনে৷ গাড়ি ভেতরে প্রবেশ করতেই দারোয়ান প্রবেশদ্বার খুব ভালো করে আটকে দিল। সেগুন কাঠের কারুকাজ করা সদর দরজার কাছে হরিদ্রাভ আলো জ্বলছে। অলিগলিতেও সোডিয়াম বাতি জ্বলছে। ঝিঁঝি পোকার ঝাঁক বসেছে। সোডিয়াম আলোতে মালঞ্চ নীড় আবছা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। যার বহির্ভাগ শ্বেতরঙায় মোড়ানো। পুরোটা সময় প্রলয়ের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে এসেছে ভূমি। অচৈতন্য অবস্থাতে বুঝতেও পারেনি— আর পাশে ঢাল হয়ে বসেছে তার অর্ধাঙ্গ। গাড়িতে বসেই ফ্যালফ্যাল করে দেখছে চারিপাশটা। এদিকে অর্পণ দুটো লাগেজ নিয়েই বড়ো বড়ো পা ফেলে বাড়ির ভেতরে চলে গিয়েছে৷ গ্রামের ঝামেলা মিটে গেলেও বাড়ির ঝামেলা কী করে মেটাবে বুঝতে পারছে না অর্পণ। চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে তার৷ এদিকে প্রলয় বেশ চিন্তাশূন্য ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে তার কোনো চিন্তাই নেই পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারে। প্রলয় এসে গাড়ির দরজা খুলল। হাত এগিয়ে দিল ভূমির দিকে৷ কিছুটা ভড়কে গেলে নিজেকে সামলে নিল ভূমি। কম্পিত কণ্ঠে বলল‚
“আ..আমি পারব!”
“আপনার পা শুকতে সময় তো লাগবে৷ এমতাবস্থায় হেঁটে যেতে সমস্যা হতে পারে৷”
ভূমিকে প্রত্যুত্তর করবার সুযোগ না দিয়ে‚ তার পিঠে হাত রাখল প্রলয়। থেকে থেকে কেঁপে উঠল ভূমি। প্রলয়ের কাঁধে হাত রেখে শরীরের ভর ছেড়ে দিল সে৷ ভূমিকে কোলে তুলে নিল প্রলয়। এগিয়ে গেল বাড়ির ভেতরে। সদর দরজা আগে থেকেই খোলা রয়েছে৷ এতক্ষণে সবাই বৈঠকখানায় উপস্থিত৷ ভূমিকে কোলে করে নিয়ে বৈঠকখানায় গিয়ে দাঁড় করাল প্রলয়। মেয়েটা যাতে পড়ে না যায়‚ সেজন্য ভূমির বাহু ধরে রাখল প্রলয়। সকলের দৃষ্টি ওদের দুজনের দিকেই। মাধুরী একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন আঁটসাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে। একপ্রকার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলেন। মেয়েটার কপালে আর পায়ে বেন্ডেজ করা। বেন্ডেজের উপরও ছোপ ছোপ র’ক্তের দাগ। মেয়েটার ফর্সা মুখশ্রীতে চিন্তার ভাজ। পড়নে তার কলাপাতা রঙা আটপৌরে শাড়ি। মাধুরী উনার ছেলেকে শুধালেন‚
“মেয়েটা কে?”
অকপটে স্বাভাবিক কণ্ঠে প্রলয় বলল‚ “আমার স্ত্রী।”
পা দুটো কেঁপে উঠল মাধুরীর। ছেলে যে এভাবে কাউকে না জানিয়ে এত বড়ো সিদ্ধান্ত নেবে এটা তিনি কস্মিনকালেও ভাবেননি। একটি মাত্র ছেলে উনার। অনেক স্বপ্ন‚ অনেক আশা ভরসা ছিল ছেলেকে নিয়ে৷ কথায় আছে না‚ ‘শখের পিঠা মাঝখানে কাঁচা!’ এ ব্যাপারে ঠিক তেমনটাই হয়েছে। রাগে দুঃখে কাঁদছেন তিনি। ফিরোজা কাছে এসে দাঁড়ালেন। মাধুরীর কাঁধে হাত রেখে স্বান্তনা দিলেন। আফসোসের সুরে মাধুরী বললেন‚
“এ তুই আমার কী সর্বনাশ করলি প্রলয়? তোকে নিয়ে আমার কত স্বপ্ন ভরসা ছিল! তুই সব শেষ করে দিলি।”
প্রলয় কিছু বলল না৷ মা তো ভুল কিছু বলছেন না। কিন্তু সেও যে অপারগ ছিল। ওমন একটা মুহূর্তে বিয়ে করা ছাড়া কীইবা করার ছিল তার। প্রলয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভূমিকে দেখে খুব বেশি হাইপার হয়ে উঠলেন মাধুরী। ফিরোজা উনাকে শান্ত করার জন্য বললেন‚
“ভাবি তুমি একটা শান্ত হও। এবার তো তোমার প্রেসার বেড়ে যাবে৷”
মাধুরী তো শান্ত হলেনই না বরঞ্চ আরও উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। প্রলয়কে উদ্দেশ্য করে বললেন‚
“কোন কুক্ষণে তুই গ্রামে গিয়েছিলিস? না তুই গ্রামে যেতিস আর না এই সর্বনাশ তোর দ্বারা হত৷”
একটু থেমে মাধুরী পুনশ্চ বললেন‚ “অ্যাই অর্পণ তুই বল— কী হয়েছিল?”
অর্পণ সকলের সামনে সব কথা খুলে বলল। সবকিছু শুনে রেগে গেলেন মাধুরী৷ তেড়ে গেলেন ভূমির সমীপে। মায়ের রাগ সম্পর্কে অবগত প্রলয়। ভূমিকে নিজের আড়াল করে নিল। মাধুরী চেঁচিয়ে উঠলেন‚
“এই মেয়েটা আমার ছেলেকে ফাঁসিয়েছে৷ অলক্ষ্মী‚ অপ’য়া মেয়ে— তোর জন্য আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। আমার ছেলের সুন্দর ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে এগোল।”
নীরবে অশ্রুবর্ষণ করছে ভূমি। সেই সকাল থেকে একই কথা শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ প্রায়। প্রলয় সঙ্গ দিয়ে বলল‚
“উনাকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ হবে না মা। এখানে উনার কোনো দোষ নেই। ওই মুহূর্তে আমার যা ঠিক মনে হয়ে আমি সেটাই করেছি। আর হ্যাঁ আমি আমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো কটু কথা শুনতে চাই না৷ যা হবার হয়ে গিয়েছে৷ ভাগ্য হয়তো এমনটাই চাইছিল।”
মোর্শেদ শিকদার আর মেহরাব শিকদার এখনো বাড়ি ফেরেননি। উনারা এই ব্যাপারে কিছু জানেনও না৷ নিজেদের ঘরে পড়তে বসেছিল পূর্ণতা পুষ্পিতা। মায়ের চিৎকার চেঁচামেচিতে বৈঠকখানায় না এসে পারল না৷ এসেই দেখল তাদের বড়ো ভাইয়া এসেছে। সঙ্গে একটা মেয়েও দাঁড়িয়ে। বোকা দুই বোন কিছুই বুঝতে পারল না৷ কিছু বলতে নেবে তার আগেই অর্পণ ইশারায় তাদের চুপ থাকতে বলল। নয়তো মায়ের কাছে হয়তো বকাও শুনতে পারে৷ পূর্ণতার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে পুষ্পিতা বলল‚
“অ্যাই পূর্ণ! বড়ো ভাইয়ার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা কে রে?”
“আমি তো তোর সঙ্গেই এলাম। বেশি কথা বলিস না। দেখছিস তো মা আজ ক্ষেপেছে।”
এবার ফিরোজাকে উদ্দেশ্য করে প্রলয় বলল‚ “চাচি মা খাবার বেড়ে দাও৷ উনি ভীষণ দুর্বল।”
কথাটা বলেই ভূমিকে কোলে তুলে নিল। মেয়েটা এতগুলো সিঁড়ি ভেঙে উপরে যেতে পারবে না৷ ভূমিকে নিজের ঘরেই নিয়ে গেল প্রলয়। বিছানায় বসিয়ে— তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল সে। বিছানায় বসে পুরো কামরা পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করল ভূমি৷ আসবাবপত্রে সাজানো গোছানো সুন্দর এই কামরা তাদের ছোটো ঘরের এক অংশ মাত্র। এমন সময় দুয়ারে কেউ কড়া নাড়ল।
“আসব?”
নড়েচড়ে বসল ভূমি৷ দরজা ভেদ করে অর্পণ ঘরের ভেতর প্রবেশ করল৷ বিছানার কাছে গিয়ে নিজের ফোনটা ভূমির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল‚
“আপনার মা কথা বলবেন।”
হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিল ভূমি। অর্পণ আর একমুহূর্ত দাঁড়াল না। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে দরজা চাপিয়ে দিয়ে গেল। ভূমি ফোনটা কানে নিল। ফোনের অপরপ্রান্ত নীরবতায় আচ্ছন্ন। ভূমি নিজে থেকেই বলল‚
“আ..আম্মা!”
কতটা সময় পর মেয়ের গলার আওয়াজ পেলেন মহুয়া। কলিজা শীতল হলো৷ বাঁ হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বললেন‚
“আমার মা। কেমন আছিস তুই? ঠিক আছিস তো? কেউ তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি তো?”
মাধুরীর করা খারাপ ব্যবহারের কথা আম্মার কাছে বলল না। অযথা আম্মাকে চিন্তায় ফেলে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। ভূমি বলল‚
“আমি একদম ঠিক আছি আম্মা৷ কেউ আমার সাথে কোনো খারাপ আচরণ করেনি। সবাই আমাকে মেনে নিয়েছে।”
“শ্বশুর বাড়ির সবার মন জুগিয়ে চলবি মা৷ এখন থেকে ওটাই তোর পরিবার। এতকাল ধরে আফসোস করে এসেছিস তোর বাবা নেই বলে। এখন একটা পরিবার পেয়েছিস৷ ইরার থেকে শুনেছি প্রলয়দের বিশাল বাড়ি‚ বিশাল পরিবার। শ্বশুর‚ শাশুড়ী‚ দেবর— ননদ‚ চাচা শ্বশুর‚ চাচি শাশুড়ী পেয়েছিস৷ তাদের সবাইকে মান্য করে চলবি। কখনো কারো মনে আঘা’ত দিবি না। সবার কথা মতো চলবি। কেউ যেন বলতে না পারে— আমি তোকে কোনো শিক্ষা দিইনি।”
“পরিবার পাওয়ার লোভে আমি যে তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি আম্মা। তুমি যে আমার থেকে বহু মাইল দূরে। চাইলে আমি তোমার কাছে ছুটে যেতে পারব না। আমি তোমাকে ছাড়া কী করে থাকব আম্মা?”
আঁচলে মুখ চেপে কাঁদছেন মহুয়া৷ কথা বলতে পারছেন না তিনি। ইরা উনার থেকে ফোনটা নিয়ে নিল। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল‚
“তুমি একদম চিন্তা কোরো না ভূমি। এখন থেকে যখনই আন্টির কথা মনে পড়বে আমার নাম্বারে কল দেবে। আন্টিকে আমরা আমাদের বাড়িতে রেখে দেব৷ উনারাও আর একলা মনে হবে না।”
রাত তখন সাড়ে এগারোটা৷ খাবার আর ঔষধ খেয়ে অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে ভূমি। বাড়িতে এসে প্রলয়ের বিয়ের কথা জানার পরও চুপ করে ছিলেন মোর্শেদ শিকদার। মাধুরীকেও চিৎকার চেঁচামেচি করতে বারণ করে দিয়েছিলেন তিনি। তবে প্রলয়ের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে চেয়েছেন মোর্শেদ শিকদার৷ প্রলয়ও তার বাবার কথা মতো স্টাডি রুমে গিয়েছে কথা বলার জন্য৷
“গ্রামবাসীর কথায় এভাবে বিয়ে করে নিলে? অর্পণকে নিয়ে কাল রাতেই ফিরে আসতে।”
“বিয়ে করার সিদ্ধান্ত একান্তই আমার। তুমি আমাকে খুব ভালো করেই জানো বাবা। কারো সাধ্য নেই সেহরিশ আরশান প্রলয়কে জোর করার। তোমার ছেলে কাপুরুষ নয় যে‚ রাতে আঁধারে কাউকে বিপদে ফেলে পালিয়ে আসবে।”
“এখন কী করবে কিছু ভেবেছ?”
মোর্শেদ শিকদারের কথা কিছু বুঝল না প্রলয়। বাবাকে শুধাল‚ “মানে?”
“এভাবে হুট করে বিয়ে— সমাজ কী বলবে? গ্রামের ওই জঘন্য কথা যদি মিডিয়ার কাছে পৌঁছয়‚ ভাবতে পাচ্ছ কী হবে? তুমি হচ্ছ এখানকার এমপি। খবরটা মিডিয়ার কাছে গেলেই ভাইরাল।”
“এসব নিয়ে আমি কিছু বলছি না বাবা। বিয়েটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। জনে জনে জানাতে আমি সাচ্ছন্দ্য বোধ করছি না। তবে চাইলে ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে বড়ো করে রিসেপশনের আয়োজন করতে পারো। আমার কোনো আপত্তি নেই। ততদিন ভূমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবেন। পরিবারের সঙ্গে মিশে যেতে পারবেন।”
যামিনীর নাম করে নিশীথনিবিড় আঁধার নেমেছে মেদিনীর বুকে৷ অম্বরে ঘোর অমাবস্যা। কৃষ্ণপক্ষের শেষ তিথি চলছে বোধহয়। নীরবতায় বিরাজমান কামরায় ঘড়ির কা’টা তখন খটখট শব্দ তুলছে৷ সময় বলছে‚ সে থেমে থাকবে না৷ সবে ঘরে প্রবেশ করল প্রলয়৷ এতটা সময় ধরে ছাদে পায়চারি করছিল৷ ঘরের ঘুম বাতি জ্বলছে৷ সেই আবছা আলোয় উপলব্ধি করল‚ বিছানার একপাশে জড়োসড়ো হয়ে শুয়েছে ভূমি। ঘরের বাতি জ্বালাল না। দরজা আটকে সোজা চলে গেল খোলা অলিন্দের দিকে৷ প্রলয়ের হিমশীতল বাতাবরণ ভীষণ পছন্দের৷ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে একটা সিগারেট ধরাল৷ ঘুম আসছে না কিছুতেই৷ মস্তিষ্কে চিন্তার পাহাড় জমেছে৷ হুট করে নেওয়া সিদ্ধান্তের ভবিষ্যৎ জানা নেই তার। তর্জনী ও মধ্যমাঙ্গুলি ফাঁকে আটকে রাখা সিগারেট টান দিতেই নাক মুখ দিয়ে উষ্ণ ধোঁয়া বের হয়ে গেল৷ চোখ বন্ধ করে নিল প্রলয়। মৃদুমন্দ সমীরণ গা ছুঁয়ে দিচ্ছে৷
সমস্ত চিন্তাকে ধোঁয়ায় উড়িয়ে আঁধারিয়া কামরায় ফিরে এলো প্রলয়। বন্ধ ঘরের ভেতরে দুটো মানুষ আটকা পড়েছে৷ একজন ক্লান্তি আর দুর্বলতার কারণে ঘুমচ্ছে। আরেকজন শত ক্লান্তির পরও দুচোখের পাতা এক করতে পারছে না। প্রলয় ঘরের লাইট জ্বালাল৷ বিছানার ডান পাশে নিষুপ্তিতে আচ্ছাদিত মেয়েটা দুহাত ভাজ করে মাথার নিচে রেখে একপাশ হয়ে শুয়েছে৷ গায়ে পাতলা চাদর গলা অবধি জড়িয়ে দেওয়া। ঘুমোনোর আগ অবধি শীত করছিল তাই গায়ে চাদর জড়িয়ে নিয়েছিল ভূমি। অবুজ মেয়েটা বুঝতেও পারল না— ঘরে এসি চালিয়ে রাখা ছিল। এসির পাওয়ার খানিকটা কমিয়ে বিছানার কাছে গেল। ভূমির দিকে কিছুটা ঝুঁকে চুলে হাত বুলিয়ে নিজে নিজেই কয়েকটা কথা আওড়াল‚
“প্রত্যেকটা আকস্মিক পরিস্থিতির কোনো না কোনো কারণ থাকে৷ কিছু কারণ অজানাই থাকুক। এখন থেকে আপনার সকল দায়িত্ব আমার৷ আমি চেষ্টা করব অহর্ণিশ আপনার পাশে থাকার। সবকিছু থেকে আপনাকে রক্ষা করার।”
পুনরায় ফিরে গিয়ে ঘরের লাইট বন্ধ করে দিল প্রলয়৷ এরপর ভূমির অপরপাশে শুয়ে পড়ল৷ মনে কিছুটা অস্বস্তি‚ অশান্তি নিয়ে নিদ্রাকে আমন্ত্রণ জানাল।
রাতের তখন শেষ প্রহর…
“তুমি চাইলেই আমাকে নিজের কাছে আটকে রাখতে পারতে আম্মা৷ কিন্তু তুমি তা করোনি। আমাকে নিজের থেকে বহুদূরে ছুড়ে ফেলেছ৷ আমি তোমাকে একটুও ভালোবাসি না আম্মা।”
চোখের সামনে মেয়েটা আঁধারে মিলিয়ে যাচ্ছে৷ চেয়েও কিছু করতে পারছেন না মহুয়া৷ ঘুমের ঘোরেই “ভূমি…!” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি৷
উনার কাতর চিৎকারে ধড়ফড় করে উঠে বসল ইরা৷ বহু কষ্টে একটু ঘুমিয়ে ছিলেন। ভূমির শূন্যতা পূরণ করতে মহুয়াকে নিজের ঘরে রেখেছিল ইরা৷ ঘরের বাতি জ্বলতেই দেখতে পেল‚ অপর পাশে বসে সমানে কেঁদে যাচ্ছেন মহুয়া৷ উনাকে এভাবে কাঁদতে দেখে ইরা অবাক হলো বৈকি! মহুয়ার হাতের পিঠে হাত স্পর্শ করে শুধাল‚
“কী হয়েছে আন্টি? খারাপ কোনো স্বপ্ন দেখেছ?”
“ভূমি আমার থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে।”
এই বলে পুনশ্চ কাঁদতে শুরু করলেন। ইরা স্বান্তনা দিয়ে বলল‚
“ভূমি যদি জানে তুমি এভাবে খাওয়া‚ ঘুম ছেড়ে সারাক্ষণ কাঁদছ তাহলে কী ও ভালো থাকবে?”
কান্না থেমে গেল মহুয়ার। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন ইরার মুখ পানে৷ ইরা আবারও বলল‚
“মেয়েকে সুখী দেখতে চাও— এটাই তো তোমার একমাত্র চাওয়া তাই না আন্টি?”
অশ্রুসিক্ত নেত্রে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন মহুয়া৷ মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে ইরার করার উত্তর দিলেন‚ “হু!”
“তাহলে তোমাকে আগে ভালো থাকতে হবে৷ এখন ঘুমিয়ে পড়! কাল আমি ভিডিও কলে ভূমির সঙ্গে কথা বলিয়ে দেব। ভূমিকে দেখতে পারবে তুমি।”
তৎক্ষনাৎ রাজি হয়ে গেলেন মহুয়া। ইরার কথা মতো শুয়ে পড়লেন৷ আর কাঁদবেন না তিনি। ইরা তো বলেছে কাল ভূমির সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবে। ছুঁতে না পাড়ুক মেয়েটা তো চোখের দেখতে দেখতে পারবেন। ঘরের বাতি বন্ধ করে দিল ইরা৷ এসে শুয়ে পড়ল মহুয়ার পাশে৷ চোখ বন্ধ করে রেখেছেন মহুয়া। ইরা উনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। মনে মনে ভাবল‚ প্রত্যেকটা মেয়েকেই একদিন স্বামীর ঘরে যেতে হয়! এভাবেই প্রত্যেকটা মায়ের বুকে হাহাকার নামে। সেই মেয়েটিকে অন্যের ঘর-সংসার আঁকড়ে ধরতে হয়। সেই অন্যের সংসারটাই একদিন নিজের হয়ে ওঠে। বড্ড শখের— বড্ড ভালোবাসার!
উৎকণ্ঠিত অহোরাত্র কে’টে গিয়েছে৷ নবোদিত সূর্যের কিরণ সর্বত্র আচ্ছাদিত। তেজস্বী সোনালি রোদ উঁকি দিচ্ছে জানালার দুয়ার ভেদ করে। মৃদুমন্দ সমীরণে সফেদ রঙা পর্দা শূন্যে বিচরণ করছে৷ ঘুম হালকা হয়ে এসেছে ভূমির। আধবোজা চোখে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল বিছানাতেই৷ পুরো ঘরময় চোখ বুলাল। সবকিছুই অচেনা মনে হলো। পরক্ষণেই মনে পড়ল‚ সে তো আর গ্রামে নেই। চলে এসেছে বহুদূরে। বিষণ্ণমনা হয়ে বিছানা ছেড়ে নামল। পুরো ঘর জুড়ে নীরবতা বিরাজ করছে৷ কাল বিকেল থেকে একই শাড়িতে এখন বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। শাড়িতে অভ্যস্ত নয় সে। গা কেমন কুটকুট করছে। সোফার কাছে প্রলয়ের লাগেজ রাখা৷ ভূমি সেদিকটাতেই গেল। চেইন খুলে নিজের জন্য জামাকাপড় বের করল। ইরা কাল সঙ্গে করে জামাকাপড় পাঠিয়ে দিয়েছিল। বেছে বেছে লাল রঙা থ্রিপিসই বের করল সে৷ খুঁড়িয়ে ওয়াশরুমের কাছে গেল। পায়ে ব্যথা এখনো অল্পস্বল্প রয়েছে। তবে সমস্ত দুর্বলতা কে’টে গিয়েছে। অতিরিক্ত ঘুমের কারণে ফজরের নামাযটাও আদায় করা হয়নি৷
ওয়াশরুম থেকে গোসল করে বেরিয়েছে ভূমি। তোয়ালে দিয়ে মাথা পেচিয়ে রাখা। হাতে থাকা ভেজা কাপড় ঘরের সংলগ্নে থাকা বারান্দায় গিয়ে মেলে দিয়ে এলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে‚ তোয়ালে খুলে ভেজা চুল মুছতে শুরু করল। এরই মাঝে প্রবেশ করল পূর্ণতা‚ পুষ্পিতা আর ফিরোজা৷ ভূমিকে দেখে মিষ্টি করে হাসলেন ফিরোজা। স্নিগ্ধস্বরে শুধালেন‚
“উঠে পড়েছ?”
আঁখিপল্লব ঝাপ্টাল ভূমি। তিনজনেই এগিয়ে গেল। পূর্ণতা পুষ্পিতা ইতিমধ্যেই বিছানায় বসে পড়েছে। ফিরোজা বললেন‚
“আমি হচ্ছি প্রলয়ের চাচি মা। আজ থেকে তোমারও চাচি মা। আর ওরা হচ্ছে পূর্ণতা আর পুষ্পিতা। যমজ বোন। তোমার রায়বাঘিনী ননদিনী।”
শেষোক্তটি মজার ছলেই বললেন ফিরোজা৷ ভূমি মেয়ে দুটোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দুজনের মুখশ্রীতে অমিল রয়েছে অল্পস্বল্প। তবে বেশিরভাগই মিল।
“চাচি মা তুমি যাও আমরা ভাবিমণির সঙ্গে আছি।”
ফিরোজা চলে যেতেই পুষ্পিতা গিয়ে বিছানায় সোজা হয়ে বসেই বলল‚ “আমার তোমাকে বেশ ভালো লেগেছে৷ মা শুধু শুধু রেগে আছে।”
পূর্ণতা বলল‚ “তুমি চিন্তা কোরো না। মা এমনই। বড়ো ভাইয়াকে খুব ভালোবাসেন। কাউকে না জানিয়ে হুট করে বিয়েটা হয়ে গেল তো তাই রাগ করে আছে।”
ভূমি খুব মনোযোগ দিয়ে পূর্ণতার কথা শুনল। এবার পুষ্পিতা বলল‚ “তবে মা খুব বেশিদিন রাগ চেপে রাখতে পারেন না। তুমি দেখ— তোমাকেও ভীষণ ভালোবাসবে।”
পূর্ণতা দৌঁড়ে গিয়ে নিজের ঘর থেকে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে এলো। ভূমির ভেজা কেশগুচ্ছ হতে টপটপ করে পানি ঝরছে। পুষ্পিতা হা করে তাকিয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে যেন‚ কখনো ঘন দীঘল কেশ কখনো দেখেনি সে। পুষ্পিতার মাথায় চাঁটি মে’রে বসল পূর্ণতা৷ কিছুটা ব্যথা পেল বৈকি৷ ঝাঁঝাল স্বরে ধমকে উঠল। দুটোর কাণ্ডকারখানায় হাসি পেলেও প্রকাশ করল না ভূমি। পূর্ণতা হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ভেজা চুল শুকিয়ে যেতেই বিনুনিও গেঁথে দিল। এরপর ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে ভূমিকে নিয়ে নিচে গেল। সকলের প্লেটে খাবার বেড়ে দিয়ে সবেই স্বামীর পাশে বসেছেন মাধুরী৷ পূর্ণতা পুষ্পিতার সঙ্গে ভূমিকে আসতে দেখেই তিনি বললেন‚
“এই মেয়েটা এখানে কী করছে? এই মেয়েটা কী এখন এখানে বসে খাবে নাকি? ফিরোজা তুই ওর খাবার ঘরে দিয়ে আসতে পারলি না?”
“বারবার এই মেয়েটা এই মেয়েটা করছ কেন মা? ওর একটা সুন্দর নাম আছে। ওকে ওর নামেই ডাকবে।”
“এই মেয়ে এখানে বসে খেলে আমি খাব না।”
“তাহলে আমি স্ত্রী নিয়ে আমি বাহির থেকে খেয়ে আসতে বাধ্য হব। শুধু স্ত্রীর কথা ভাবলেই তো চলবে না। মায়ের অসুবিধেও তো আমাকেই দেখতে হবে তাই না?”
এতক্ষণ সবটাই পর্যবেক্ষণ করলেন মোর্শেদ শিকদার। বাবা হিসেবে তিনি যদি সবটা বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিতে পারেন তাহলে মা হিসেবে মাধুরী কেন পারবেন না? মাধুরীর রাগ করে এভাবে কথা বলার যথার্থ কারণ রয়েছে তবুও অযৌক্তিক মনে হলো উনার। মোর্শেদ শিকদার বললেন‚
“সত্যিটা মেনে নেওয়া চেষ্টা কর মাধুরী৷ যা হবার হয়ে গিয়েছে। সবই শুনেছি আমি। বিচার বুদ্ধি আমারও আছে। বাহিরে তোমার ছেলে দেশে মানুষের সেবা করছে আর তুমিই কি-না বাড়িতে কারো উপর অবিচার করছ।”
স্বামীর কথায় মুখটা থমথমে হয়ে গেল মাধুরীর৷ উচিত কথা সহ্য হলো না যেন। আঁধার নেমে এসেছে পুরো মুখে। চুপ করে বসে রইলেন স্বামীর পাশে। আর একটা কথা বলার সাহস পেলেন না তিনি। মুখ টিপে হাসল পূর্ণতা পুষ্পিতা। বড়ো বড়ো চোখের শাসানো দৃষ্টিতে তাকালেন দুটোর দিকে। মায়ের চোখ রাঙানো দেখে হাসি বন্ধ হয়ে গেল পূর্ণতা পুষ্পিতার। দুজনেই খাওয়ায় মনোযোগী হলো। প্রলয় উঠে দাঁড়াল। নিজের পাশের চেয়ারটা কিছুটা সরিয়ে বসার জন্য ইশারা করল। প্রলয়ের ইশারা বুঝতে পেরে ভূমি বসল৷ প্লেটে করে দুটো স্যান্ডউইচ‚ একটা ডিম আর একগ্লাস দুধ এগিয়ে দিল ভূমির দিকে। মোবাইলে সময় দেখে প্রলয় বলল‚
“লেটস্ ফিনিশ!”
মুখে কিছু বলল না ভূমি। প্রলয় আবারও বলল‚ “সবগুলো খাবার খাবে।”
প্রলয়ের মুখে তুমি সম্বোধন শুনে অন্তঃকরণ কেঁপে উঠল। অজানা অনুভূতিতে ব্যাকুল হয়ে উঠল হৃদয়৷ চুপটি করে খেতে শুরু করল ভূমি।
চলবে?…..