#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১৬|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
ভূমি নিজে আজ রান্না করছে৷ আম্মা কম বেশি অনেক ধরনের রান্নাই শিখিয়েছেন৷ এরই মাঝে বাড়ি ফিরেছেন মাধুরী আর ফিরোজা। কিছু কেনাকাটা করতে গিয়েছিলেন উনারা৷ চুলোর আঁচ কমিয়ে শরবত বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ভূমি। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে রাখল। মাধুরী আর ফিরোজার হাতে অনেকগুলো শপিং ব্যাগ৷ মায়ের গলার আওয়াজ পেয়েই ঘর থেকে ছুটে এসেছে পূর্ণতা আর পুষ্পিতা। এসেই সোফায় বসে থাকা মাধুরী গলা জাপ্টে ধরেছে দুটোতে। পুষ্পিতা আদুরে স্বরে তার মাকে জিজ্ঞেস করল‚
“আমাদের জন্য কিছু আনোনি মা?”
“তোদের জন্য কিছু না আনলে উপায় আছে? এক্ষুনি তো চেঁচিয়ে মাথা খাবি।”
পূর্ণতা এসে এবার তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল‚ “দেখি না মা কী এনেছ?”
পূর্ণতা পুষ্পিতার জন্য আনা শপিং ব্যাগ দুটো এগিয়ে দিলেন মাধুরী৷ নিজেদের জিনিস পেয়ে ঘরে চলে গেল দুটোতে৷ রান্নাঘরে শরবত বানাচ্ছে ভূমি। সাবিনা পেঁয়াজ কাটছে৷ বৈঠকখানা থেকেই ভূমিকে ডাকলেন মাধুরী। উনার এক ডাকেই রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো ভূমি। এসে দাঁড়াল মাধুরীর সামনে। সোফায় বসে মুখ টিপে হাসছেন ফিরোজা। মাধুরী তিনটে শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিলেন ভূমির দিকে।
“এগুলো তোমার জন্য। পড়ে দেখ— ফিটিংস ঠিকটাক হয় কি-না!”
আম্মা আর প্রলয়কে ছাড়া আর কখনো কেউ তার জন্য ভাবেনি। আজ নিজে থেকে মাধুরী তার জন্য ভাবছেন। ভূমি আবেগাপ্লুত হলো। নেত্র যুগল সিক্ত হলো মুহূর্তেই। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইল মাধুরীর মুখ পানে।
“এভাবে তাকিয়ে কী দেখছ? যা বলেছি সেটাই কর। যাও এগুলো নিয়ে ঘরে যাও।”
“এগুলো পরেও দেখা যাবে৷ আপনাদের জন্য শরবত নিয়ে আসি মা?”
ফিরোজা মাঝখান দিয়ে বললেন‚ “সাবিনা দেবে৷ তুমি যাও।”
রাতে…
সেই দুপুরে ফুলগুলো কেনা হয়েছিল। এতক্ষণে হয়তো মূর্ছা গিয়েছে৷ একটা ব্যাগের ভেতরে করে ফুলগুলো নিয়ে এসেছে প্রলয়। বৈঠকখানায় সাবিনাকে ছাড়া আর কেউ নেই৷ বসে বসে টিভি দেখছিল মেয়েটা। সদর দরজা ওই-ই খুলে দিয়েছে৷ ফুলের ব্যাগটা নিয়ে পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরের দিকে গেল প্রলয়। দুটোতে মিলে পড়তে বসেছে। ব্যাগ থেকে দুটো লাল গোলাপ আর দুটো রজনীগন্ধার মালা পূর্ণতা পুষ্পিতাকে দিল প্রলয়৷ ফুল অএয়ে খুশি হয়ে গেল দুটোতে৷ ক্ষীণ হেসে প্রলয় নিজের ঘরের দিকে চলে গেল৷ ঘরের দরজা চাপিয়ে রাখা। আলগোছে খুলে ভেতরে ঢুকল প্রলয়। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে বিনুনি গাঁথছে ভূমি। লম্বা চুলে একা বিনুনি গাঁথতে গিয়েও হিমসিম খেয়ে হয় খানিকটা। প্রলয় ঘরে প্রবেশ করল অথচ ভূমি চেরই পেল না। যখন আয়নায় প্রলয়ের প্রতিবিম্বের দেখা মিলতেই ভূমি উঠে দাঁড়াল। ওড়না ঠিক করে মাথায় টেনে নিল৷ প্রলয় ত্রস্ত স্বরে বলল‚
“মাথায় ওড়না জড়াতে হবে না।”
ভূমি শুনল না তার কথা। তপ্ত নিশ্বাস ফেলল প্রলয়। ড্রেসিং টেবিলের উপর গোলাপ ফুলগুলো একটা একটা করে বের করে রাখল। উঠে দাঁড়িয়ে ভূমির মাথার উপর থেকে ওড়না সরিয়ে দিল। পেছনে দাঁড়িয়ে চুলে বেলীফুলের গাজরা লাগিয়ে দিল প্রলয়। বাঁ হাতে রজনীগন্ধার মালাও পড়িয়ে দিল৷ সবকিছুই চুপচাপ দেখে যাচ্ছে ভূমি। মুখে টু শব্দটি পর্যন্ত করছে না সে৷ নীরবতা ঘুচিয়ে প্রলয় বলল‚
“ফুলের সাথে ফুলকেই ভালো মানায়৷ তবে অকৃত্রিম এই ফুলে থেকে আমার ফুলটা বেশি জীবন্ত৷”
মোর্শেদ শিকদার‚ মেহরাব শিকদার আর অর্পণ বসে রয়েছেন সোফায়৷ ভূমি প্রলয় কেউ-ই এখানে উপস্থিত নেই। পুষ্পিতা টিভি দেখছে৷ ওর টিভি দেখা নিয়ে রেগে আছেন মাধুরী। সামনে পরীক্ষা আর মেয়েটা মনের আনন্দে টিভি দেখছে। পূর্ণতা তার ঘর থেকে সবেই বের হয়েছে৷ মাধুরী ডাইনিং স্পেস থেকে চেঁচিয়ে বললেন‚
“বড়োটা পড়াশোনায় কত মনোযোগী আর ছোটোটাকে দেখ! পড়াচোর একটা। পূর্ণ যা তো মা— এই কুম্ভকর্ণের কান টেনে আমার কাছে নিয়ে আয়।”
ফিরোজা হেসে উঠলেন৷ পূর্ণতা বৈঠকখানার দিকে গেল৷ পুষ্পিতা তার বাবার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল‚
“দেখলে বাবা? মা আমাকে সহ্যই করতে পারে না। একটু টিভি দেখছি সেটাও দিচ্ছে না।”
মোর্শেদ শিকদার মেয়েকে প্রশ্রয় দিয়ে স্ত্রীর উদ্দেশে বললেন‚ “কেন মেয়েটার সঙ্গে এমন করছ মাধুরী?”
“তোমার মেয়ে সবই করতে পারে‚ শুধু পড়াশোনা করতে গেলেই নাকি তার মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায়৷”
“কথাটা কী সত্যি পুষ্প?”
ধরা খেয়ে পুষ্পিতা বোকা হাসল৷ কথাবার্তার একপর্যায়ে মেহরাব শিকদারের দিকে তাকিয়ে মোর্শেদ শিকদার শুধালেন‚
“আজ সকালে তাড়াহুড়ো করে বের হলি। কোনো সমস্যা ছিল নাকি?”
“না ভাই কোনো সমস্যা না। হসপিটাল থেকে ক্যাম্প করা হবে।”
“সে তো বেশ ভালো খবর।”
“আমাদের হসপিটালের সিনিয়র ডক্টর যারা রয়েছেন সবাইকে একেক জায়গায় ক্যাম্পের জন্য যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শুধু আমাদের হসপিটাল না অন্য হসপিটাল থেকেও একই নির্দেশনা দিয়েছে মেডিকেল বোর্ড৷ সাতটা গ্রাম সিলেক্ট হয়েছে।”
অর্পণ তার বাবাকে জিজ্ঞেস করল‚ “তোমাকেও যেতে হবে বাবা?”
“হ্যাঁ! আমাদের হসপিটাল থেকে চারজন যাবেন। অনিন্দ্যনগর যাচ্ছি আমরা৷ ওখানে নাকি নতুন হসপিটাল তৈরি হয়েছে৷ সামনের সপ্তাহ থেকে নাকি চালু হবে৷”
অবাক হয়ে অর্পণ বলল‚ “ভূমি তো অনিন্দ্যনগরেরই মেয়ে৷ তোমরা চাইলে আরশদের বাড়িতেই উঠতে পারো৷ এই ক্যাম্পের কথা ভাই মেডিকেল বোর্ডে জানিয়েছিল।”
একটু থেমে অর্পণ আবার বলল‚ “শাহাদাৎ আঙ্কেল বড্ড ভালো মানুষ৷ গ্রামের মানুষের কথা চিন্তা করে স্কুল আর একটা হসপিটাল করেছেন৷ গ্রামের মানুষ উনাকে খুব মানেন৷ উনিই ওখানকার গ্রামপ্রধান।”
ঘরে…
বিছানার উপর প্রলয়ের ঘামে ভেজা পাঞ্জাবি পড়ে রয়েছে৷ বিছানাটাও এলোমেলো৷ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল দেখছে ভূমি। প্রলয় বেলীফুলের গাজরা লাগিয়ে দিয়েছিল তখন। সুন্দর মিষ্টি সুরভি ছড়াচ্ছে। বাঁ হাতে জড়িয়ে দেওয়া মালা শুকল৷ রজনীগন্ধার তীব্র সুবাসে শরীর রিনরিন করে উঠল৷ আয়নায় নিজেকেও একবার পরখ করল৷ ফর্সা গালে রক্তিম আভা। এ কী— ভূমি লজ্জা পাচ্ছে!
অগোছালো বিছানা চট করে গুছিয়ে রাখল ভূমি। প্রলয় ওয়াশরুমে গিয়েছে৷ লোকটা ভীষণই অগোছালো। তা না হলে কেউ এভাবেই জামাকাপড় বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে? গুছিয়েও তো রাখা যায়! তা করবে কেন? ভূমি বিছানার উপর থেকে পাঞ্জাবি তুলে নিয়ে বিনে রাখল। কাল ধুয়ে দেবে৷ আধোয়া কাপড় এখানে জমা করে রাখে। প্রলয় আসার আগেই বিছানা ঝাঁট দিল৷ ড্রেসিং টেবিলের সামনের সবকিছুই অগোছালো। এরই মাঝে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো প্রলয়৷ ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দেখে পছন্দ হলো না যেন! এসেই ভেজা তোয়ালে সেই বিছানার উপরই ফেলে রাখল। এবার ভূমি কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলল‚
“আপনি ভীষণই অগোছালো!”
“গুছিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তোমার— ভূমি কন্যা।”
আর কিছু বলতে পারল না ভূমি। সময় মতো কীভাবে মুখ বন্ধ করিয়ে দিতে হয় তা লোকটা বেশ ভালোই জানে৷ বিছানার উপর থেকে ভেজা তোয়ালে খানা তুলে বলল‚
“অসময়ে গোসল করেন কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে তো!”
“সমস্যা নেই কিছুদিন পর তোমাকেও এই অভ্যেস ধরিয়ে দেব৷”
প্রলয়ের কথা বোধগম্য না হলেও ভূমি বুঝল এই লোকের সঙ্গে কথা বলে কোনো ফায়দা নেই। এর থেকে ভালো নিঃশব্দে সে নিজেই সব গুছিয়ে রাখুক৷ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রজনীগন্ধার মালাটা খুলতে শুরু করল ভূমি। প্রলয় দ্রুত পায়ে ভূমির হাতটা ধরে শুধাল‚
“ফুলের মালাটা খুলছ কেন?”
“চাচি মা ডাকছেন— খাবার খেতে যেতে হবে তো!”
“খাওয়ার সঙ্গে ফুলের সম্পর্ক কী?”
“উনারা কী মনে করবেন!”
“কিছুই মনে করবে না৷ তুমি চল তো আমার সঙ্গে।”
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে ঘরে যাওয়ার জনু উদ্যত হবে তখনই পূর্ণতা এসে ডেকে নিয়ে গিয়েছে ভূমিকে৷ কী যেন কথা বলবে! সব পরিকল্পনা তো আর একা করা যায় না৷ এক্ষেত্রে ভূমিকেও জড়াবে৷ ভূমির সমীপে বসে বলল‚
“তোমাকে কানাকানি একটা কথা বলি?”
ভূমি বিছানার উপর ভালো করে বসল বলল‚ “কী কথা গো রায়বাঘিনী ননদিনী?”
পূর্ণতা ফিসফিসিয়ে বলল‚ “আগামী ১৪ই ফেব্রুয়ারি বড়ো ভাইয়ার জন্মদিন।”
প্রলয়ের জন্মদিনের কথা শুনেই ভূমি ভাবতে শুরু করল‚ ‘হাতে আর মাত্র আটদিন! লোকটা তার জন্য অনেক করেছে। তারও তো কিছু করা উচিত কিন্তু কী করবে?’ ভূমিলে চুপ থাকতে দেখে পূর্ণতা আবারও বলল‚
“আমাদের বড়ো ভাইয়া ভীষণই স্পেশাল৷ তাই তো ভালোবাসার দিনে তার জন্ম।”
“ভালোবাসার দিন?”
পুষ্পিতা বলল‚ “এ বাবা তুমি জানো না? ১৪ই ফেব্রুয়ারি তো ভালোবাসা দিবস। ভ্যালেন্টাইন্স ডে।”
“আমার জানা ছিল না।”
এদিকে প্রলয় অনেকক্ষণ ধরেই ভূমির জন্য অপেক্ষা করছে৷ পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরেই আড্ডা দিচ্ছে ভূমি। প্রলয়ের জন্মদিনে ওরা কী কী করবে সেটা ভূমিকে বলছে৷ ভূমিও তাদের কথায় গভীর ভাবে মনোনিবেশ করছে৷ প্রলয় তার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরে কথাবার্তার আওয়াজ ভেসে আসছে৷
“আমরা কিন্তু খুব আনন্দ করব সেদিন। এবারের জন্মদিন একটু বেশিই স্পেশাল বড়ো ভাইয়ার জন্য।”
পুষ্পিতার কথার মাঝেই দরজার কাছ থেকে প্রলয়ের গম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে এলো‚ ‘ভূমি ঘরে এসো।’ রাশভারি সেই কণ্ঠস্বরে আচমকা পিলে চমকে উঠল ভূমির৷ তার পাশ থেকে সরে বসল পূর্ণতা পুষ্পিতা। মেকি হেসে পুষ্পিতা বলল‚
“বড়ো ভাইয়া ডাকছে‚ তুমি ঘরে যাও ভাবিমণি৷”
ভূমি কিছু বলল না৷ বিছানা থেকে নেমে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷ সোজা চলে এলো নিজেদের ঘরে৷ ঘরে এসে প্রলয়কে কোথাও পেল না৷ এই তো লোকটা তাকে ডেকে এলো। এরই মাঝে আবার কোথায় চলে গেল? ওয়াশরুমের দরজাও তো বন্ধ।
বারান্দা ধোঁয়াময় হয়ে গিয়েছে৷ কারো পদচারণ অনুভূত হতেই জ্বলন্ত সিগারেট বাহিরে ছুড়ে ফেলল প্রলয়। হাত দ্বারা ধোঁয়া বিলীন করার চেষ্টা করল৷ ভূমি এসে পাশে দাঁড়িয়েছে ইতিমধ্যেই। সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে না পেরে কিছুটা কেশেও উঠল৷ বারান্দায় একমুহূর্তে দাঁড়াতে দিল না প্রলয়৷ ভূমির হাত ধরে ঘরে নিয়ে এলো৷ আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল ভূমিকে৷ গ্রীবাদেশে সিক্ত কোমল স্পর্শে শিরশির করে উঠল সর্বাঙ্গ। আবেশে দুচোখ মুদে এলো ভূমির৷ কানের কাছে ফিসফিসিয়ে প্রলয় বলল‚
“কোথায় রাত হয়েছে বরকে একটু সময় দেবে তা না— বসে বসে আড্ডা দিচ্ছ!”
“একটু বসে ছিলাম।”
“বসে তো তুমি আমার সামনেও থাকতে পারতে। যাই হোক— এর শাস্তি তো তোমাকে পেতে হবে।”
ভূমি চোখ মেলে তাকাল৷ মুখ তুলে প্রলয়কে দেখে বলল‚ “শা…শাস্তি?”
“হ্যাঁ শাস্তি৷ সারারাত আমার মাথা টিপে দেবে৷”
ভূমির আড়ালেই ঠোঁট চেপে হাসল প্রলয়৷ শাস্তি দেবার কথাটা নিছকই মজা করে বলেছে৷ তবে ভূমিকে দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা সত্যি সত্যিই ভেবে নিয়েছে৷ যাক ভালোই হয়েছে। মেয়েটাকে আরেকটু জ্বালাতন করার সুযোগ পেল। সরে দাঁড়িয়ে‚ ভূমি নিয়ে গিয়ে বসাল বিছানায়। দরজা আটকে‚ ঘুম বাতি জ্বালিয়ে দিল প্রলয়। এরপর নিজের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ল৷ ভূমি আধশোয়া হয়ে বসেছে৷ কোমল হাত জোড়া নিজের চুলের উপর রেখে প্রলয় চোখ বন্ধ করে ভূমিকে বলল‚
“মাথাটা টিপে দাও৷”
প্রলয়ের কথানুযায়ী মাথা টিপে দিতে শুরু করল। কিন্তু কাজটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না৷ ভূমিকে টেনে নিজের পাশে শুইয়ে দিল প্রলয়৷ আচমকা এমন হওয়ায় কিছুটা ভয় পেয়ে গেল ভূমি৷ পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল। বক্ষঃস্থল চেপে রেখেছে ভূমিকে।
নবোদিত প্রত্যুষে ঘুম ভাঙল ভূমির। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন প্রলয় অন্যপাশ হয়ে শুয়েছে৷ আলগোছে উঠে বসল ভূমি। বালিশের পড়ে থাকা ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নিল। ঘড়িতে তখন সাড়ে ছয়টা বাজে৷ এই সময় মনে হয় না কেউ উঠেছে বলে৷ পেটে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে ভূমির। বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে বাতায়ন খুলে দিল। সাঁই বেগে প্রাতঃকালের শীতল হাওয়া আছড়ে পড়ল পুরো ঘরময়৷ রোদ ওঠেনি এখনো। ওয়ারড্রব থেকে থ্রিপিস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল ভূমি। একেবারে গোসল করেই বের হবে। বেশ অনেকটা সময় পর ঘরে ফিরে এসে প্রলয়কে কোথাও পেল না ভুমি৷ বিছানাও গুছিয়ে রাখা৷ ভূমি অবাক হলো৷ তার চেয়েও বেশি লজ্জা বোধ করল বিছানায় অন্য চাদর বিছানো দেখে৷ নিশ্চয়ই এমপি মশাই গুছিয়েছেন? অবাকের থেকেও চরম অবাক হলো ভূমি। প্রলয়কে ঘরে আসতে দেখে ভূমি জিজ্ঞেস করল‚
“আজ এত তাড়াতাড়ি উঠে আপনি কী কোথাও গিয়েছিলেন?”
“আমাকে মিস করছিলে বুঝি?”
“না মানে এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম।”
“একটু বাহিরে গিয়েছিলাম৷ আমার জন্য এক মগ কফি নিয়ে এসো।”
“আচ্ছা!”
কফি বানাতে খুব বেশি সময় লাগেনি৷ সাবিনা তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল। কফি মগ নিয়ে ভূমি আবারও ঘরে ফিরে এলো। কিছুটা ক্লান্ত লাগছে তার। প্রলয় বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ ভূমি সেখানেই গেল। কফি মগ এগিয়ে দিল প্রলয়ের হাতে। কফি নিয়ে ক্ষীণ হেসে প্রলয় বলল‚
“তোমার প্রয়োজনীয় জিনিসটা ওয়ারড্রবের উপরের ড্রয়ারে রাখা আছে৷ তুমি বিশ্রাম নাও৷ নিচে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি তোমার খাবার ঘরে নিয়ে আসছি।”
বড়ো বড়ো পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল প্রলয়। ড্যাবড্যাব করে তার যাওয়ার পানে চেয়ে রইল ভূমি। লজ্জায় এতক্ষণ চোখ তুলে তাকাতে পারছিল না সে৷ লোকটা বুজে ফেলল৷ ইসস! অনাকাঙ্ক্ষিত লজ্জা জেঁকে বসেছে। মেয়েলি সমস্যার কথা কী করেই বা এমপি মশাইকে জানাবে সে? এগুলো ঢোল পিটিয়ে বলার মতো জিনিস নাকি? এরপর আর ঘর থেকে বের হয়নি ভূমি। প্রলয় তাকে বের হতে দেয়নি। বরঞ্চ ভূমির নাস্তাটা পর্যন্ত ঘরে এনে খাইয়ে দিয়েছে৷ সকাল থেকে হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়েছে পুষ্পিতা। পূর্ণতা তৈরি হয়ে বসে রয়েছে৷ আজ তাদের স্কুলে ফেয়ার ওয়েল৷ সকাল এগারোটায় স্কুলে থাকতে হবে অথচ পুষ্পিতা এখনো তার চুল বাঁধেনি৷ মেয়েটা সব কাজেই অলস৷ বিরক্তি নিয়ে পূর্ণতা জিজ্ঞেস করল‚
“অ্যাই পুষ্প তোর কী হলো? নাকি আমি তোকে ফেলেই চলে যাব?”
“আমার বারবি ব্যানটা দে তো পূর্ণ৷”
তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বিছানার উপর থেকে হেয়ার ব্যান নিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছে পুষ্পিতা৷ দুটোকে তাড়া দিতে মাধুরী ছুটে এলেন। প্রলয় সেই কখন থেকে বৈঠকখানায় অপেক্ষা করছে পূর্ণতা পুষ্পিতার জন্য। এই দুবোনের জন্য তারও আজ দেরি হচ্ছে। মাধুরী এসে দেখলেন পুষ্পিতা এখনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছে। তিনি বাজখাঁই কণ্ঠে বললেন‚
“এই মেয়েটাকে নিয়ে আমি আর পারি না৷ অ্যাই পুষ্প তুই তাড়াতাড়ি চুল বাঁধবি? তোদের বড়ো ভাইয়া কিন্তু অপেক্ষা করছে৷ দেরি হলে তোদের দুটোকে ফেলেই চলে যাবে।”
পূর্ণতা বলল‚ “আমি অনেক আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছি মা। তোমার ছোটো মেয়েই লেট লতিফা।”
কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে মায়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল‚ “আমি রেডি। চল পূর্ণ।”
ঘর থেকে বেরিয়ে গেল তিনজনেই। পূর্ণতার বিনুনি ঠিক করে দিলেন মাধুরী। পুষ্পিতার খানিকটা এলোমেলো। মেয়েকে থামিয়ে হাত দিয়ে ঠিক করলেন তিনি। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামল পূর্ণতা পুষ্পিতা। পেছনে মাধুরী আসছেন। বৈঠকখানার কাছে এসে দুবোন একসঙ্গে বলে উঠল‚
“বড়ো ভাইয়া আমরা রেডি। যাওয়া যাক?”
“তোমাদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আমার কাজে যেতে হবে।”
প্রলয় যখন রেগে থাকে তখনই পূর্ণতা পুষ্পিতাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে৷ দুবোন বুঝতে পারল তাদের ভাই রেগে আছে শুধুমাত্র তাদেরই জন্য। চুপচাপ সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল দুটোতে। প্রলয়ও তার মায়ের কাছে বলে বেরিয়ে পড়ল। দেরি হচ্ছে তার।
বিকেলে…
মোবাইল সার্ভিসিং এর দোকানের সামনে অর্পণ তার বাইক থামিয়েছে। হসপিটালে পৌঁছাতেই হাত থেকে পড়ে উপরের স্ক্রিনে ভেঙে গিয়েছিল৷ সকাল থেকেই ফোনটা বন্ধ৷ মেকানিক অপেক্ষা করতে বলেছে একঘণ্টা সময় লাগতে পারে। ভেতরেই অপেক্ষা করছিল অর্পণ। এতক্ষণে হয়তো ঠিকও হয়ে গেছে৷ বারবার হাত ঘড়ি দেখছে সে৷ ঘণ্টাখানেক সময় পর মেকানিক ছেলেটা এসে অর্পণের ফোনটা দিয়ে দিল৷ বিল প্যে করে অর্পণ সার্ভিসিং দোকান থেকে বের হয়ে গেল। ভেতরে এসি চলছিল বিধায় গরম অনুভূত হচ্ছিল না৷ এখন কেমন ভ্যাপসা গরম লাগছে! বাইকের সামনে দাঁড়িয়ে হেলমেট পড়তে নিল অর্পণ। পেছন থেকে চেনা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো যেন।
“ফোন কোথায় আপনার? সেই কখন থেকে আমি আপনাকে কল করছি।”
এই সময় ইরাকে দেখে সহসাই অবাক হলো অর্পণ। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল‚ “তুমি কোত্থেকে টপকালে?”
“দেখতে পাচ্ছেন তো ভারী লাগেজটা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি৷ সাহায্য করুন আমাকে।”
“সাহায্য করতে আমার বয়েই গেল।”
“তাহলে সামনে থেকে সরুন৷ অ্যাই রিকশা। দাঁড়ান মামা।”
লাগেজ তুলতে নিলেই অর্পণ তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল‚ “তোমাকে আমি যেতে বলেছি?”
“যখন বললাম লাগেজটা ধরতে তখন তো ধরলেন না৷ এখন দয়া দেখাতে হবে না।”
“কোথায় উঠেছ?”
“আমি আমার প্রশ্নের জবাব পাইনি তাই আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতেও আমি বাধ্য নই।”
অর্পণ আর কিছুই বলল না। ইরার কাছ থেকে লাগেজটা নিয়ে রিকশায় উঠিয়ে দিল৷ ইশারায় ইরাকেও উঠতে বলল। মুখ ঝামটা দিয়ে ইরাও রিকশায় উঠে বসল৷ অর্পণ রিকশা ওয়ালাকে বলল‚
“উনি যেখানে যেতে চাইছেন সেখানেই নিয়ে যান।”
রিকশা চলতে শুরু করেছে৷ অর্পণ বাইকে চড়ে বসল। ধীর গতিতে বাইক চলছে রিকশার পিছু পিছু৷ একপ্রকার ফলো করছে ইরাকে। জানতে চাইছে ইরা কোথায় উঠেছে৷
সায়াহ্নে…
কালো রঙা গাড়িটা মালঞ্চ নীড়ে প্রবেশ করেছে। ড্রাইভারের কাছে চাবি দিয়েই কলিং বেল চাপল প্রলয়। ড্রাইভার গাড়ি গ্যারাজে পার্ক করছে। সাবিনা এসে সদর দরজা খুলে দিয়েছে৷ বৈঠকখানায় এখন কেউ নেই। প্রলয় সোজা রান্নাঘরে ঢুকল। তাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে সাবিনা ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল‚
“আপনের কী কিছু লাগব ভাইজান? আমারে কন আমি কইরা দিতাছি।”
“পানি গরম করতে হবে। হট ওয়াটার ব্যাগে ভরে রাখবি।”
“আইচ্ছা ভাইজান৷
বৈঠকখানায় অপেক্ষা করল প্রলয়। মিনিট পাঁচেকের মাঝেই হট ওয়াটার ব্যাগে গরম পানি ভরে নিয়ে এসেছে সাবিনা। তাকে ‘ধন্যবাদ’ বলে প্রলয় তার ঘরে চলে গেল। চাদর মুড়ি দিয়ে বিছানার মাঝখানে মুচড়ে শুয়ে রয়েছে। সকালের চিনচিনে ব্যথা এখন প্রবল আকার ধারণ করেছে। পেটে হাত চেপে শুয়ে আছে মেয়েটা। চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে রয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা নিবারণ করার চেষ্টা করছে ভূমি। প্রলয় গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল‚
“আর ইউ ওকে?”
ক্লান্ত আঁখিপল্লব ঝাপ্টাল ভূমি। অর্থাৎ সে ঠিক আছে। কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে না সে ঠিক আছে বলে৷ রজঃস্বলা অবস্থায় পেটে ভীষণ ব্যথা হয়। সহ্য করা যায় না। প্রতিবার আম্মা তার জন্য গরম পানি করে বোতলে ভরে দেন। সেই বোতল কাপড়ে মুড়িয়ে পেটের উপর রাখতেই কিছুটা আরাম হয়৷ আজ আম্মাও কাছে নেই। মনে মনে আল্লাহর কাছে সহ্য করার শক্তি চাইছে ভূমি৷ বিছানার অপরপাশে বসে নিজের বক্ষঃস্থলে নিস্তেজ ভূমির মাথা আলগোছে রাখল৷ হাতে থাকা হট ওয়াটার ব্যাগ ভূমির পেটে চেপে ধরল৷ মুখ তুলে একটিবার ক্লান্ত নেত্রে প্রলয়কে দেখল৷ পরপরই আবার চোখ বন্ধ করল ভূমি। এভাবেই শুয়ে রইল প্রলয়ের বুকে মাথা রেখে। ভূমির চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই জিজ্ঞেস করল‚
“একটু আরাম লাগছে? তোমার সমস্যা হচ্ছে— আমাকে তো কল করে জানাবে৷ পিরিয়ড ব্যাপারটা একদমই নরমাল। বিষয়টি নিয়ে এত হেজিটেড কেন করছ?”
“আমার জন্য আপনাকে…”
ভূমির ঠোঁটে তর্জনী ছোঁয়াল প্রলয়৷ মুখে বলল‚ “হুস! আমি শুধু তোমার শয্যাসঙ্গী নই— আমি তোমার জীবনসঙ্গী!”
চলবে?…..
#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১৭|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
মোড়ল বাড়িতে বৈঠকখানায় মেহরাব শিকদার ছাড়াও আর তিনজন ডাক্তার বসে রয়েছেন। শাহাদাৎ মোড়লও এখানেই বসে রয়েছেন৷ খুব রাতে মোড়ল বাড়িতে পৌঁছেছেন মেহরাব শিকদার সহ বাকিরা৷ গাড়ি করে এসেছেন বিধায় জেমে আটকে পড়েছিলেন। কথাবার্তার একপর্যায়ে মোর্শেদ শিকদারের নাম্বার থেকে কল আসছে৷ ‘এক্সকিউজ মি!’ বলেই সকলের মাঝখান থেকে উঠে গেলেন মেহরাব শিকদার। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ফোন রিসিভ করলেন। অপাশ থেকে মোর্শেদ শিকদার বললেন‚
“তোকে একটা কারণে কল করলাম!”
“কী হয়েছে ভাই?”
“ঢাকা কবে ফিরবি?”
“এক সপ্তাহ খানেক পর৷ কিছু কী হয়েছে ভাই?”
“প্রলয়ের বিয়ে উপলক্ষে একটা রিসেপশনের আয়োজন করতে চাইছি। তোকে তো জানিয়েছিলাম। তুইও বাড়িতে নেই— একাহাতে কী করে করব?”
“আমি তো এক সপ্তাহের মাঝেই চলে আসছি৷ ভাবি আর ফিরোজাকে বল যা যা কেনাকাটা করার আছে করে নিতে।”
“একটু নিশ্চিন্ত হলাম আমি।
ফোন কে’টে দিয়ে পুনরায় বৈঠকখানায় যেতে নিলে মুখোমুখি হলেন মহুয়ার সঙ্গে। এক দেখাতেই চিনে ফেললেন দুজন দুজনকে৷ মেহরাব শিকদার সৌজন্যতার খাতিরে হাসলেন খানিকটা। কারণ মহুয়ার সঙ্গে নাজমাও দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ চিনেও না চেনার ভান করে রইলেন মহুয়া। নাজমাকে জিজ্ঞেস করলেন‚ “উনি কে ভাবি?”
“ইনি প্রলয়ের চাচা মেহরাব শিকদার। অর্পণের বাবা।”
নিটোল পা দুটো টলে উঠল৷ পৃথিবীটা সত্যিই গোল৷ পরিবারের দোহাই দিয়ে মেহরাব যেই সন্তানকে অস্বীকার করেছিল সেই সন্তানই শিকদার বংশের বউ। ভাগ্য কী রঙ্গলীলায় না মেতেছে! ঠোঁট চেপে কান্না নিবারণ করলেন মহুয়া৷ উনিশ বছর আগেই অতীত এখন উনার চোখের সামনে৷ মহুয়ার সঙ্গে কথা বলতে কিছুটা ইতস্তত বোধ করলেন মেহরাব শিকদার। নাজমা চলে যেতেই অস্বস্তি কা’টিয়ে বললেন‚
“ভূলেই গিয়েছ বোধহয়?”
তাচ্ছিল্য করে হাসলেন মহুয়া। অন্যদিকে ফিরে বললেন‚
“তোমাকে ভুলি কী করে? যেখানে সেই একই চোখ আল্লাহ আমার ঘরেই পাঠিয়েছেন৷ যে চোখের প্রেমে অন্ধ হয়ে আমি নিজের জীবনটাকেই শেষ করে দিয়েছি। বহুবছরের লালন করা স্বপ্নকে মাটিচাপা দিয়েছি। যতবার তোমাকে ভুলতে চেয়েছি ততবারই মেয়েটার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। তোমাকে ঘৃণা করতে পারি তাই বলে আমার অংশকে কী করে দূরে ঠেলে দিই? তোমাকে মনে রেখেছি শুধুমাত্র ঘৃণা করার জন্য।”
আর একমুহূর্ত দাঁড়ালেন মা মেহরাব শিকদারের দিকে৷ রান্নাঘরে ছুটে গেলেন তিনি। অতীত তাহলে আজও পিছু ছাড়েনি। আজও মনে পড়ে উনিশ বছর আগেই অভিশপ্ত জীবনের কথা।
“পড়াশোনা করার উদ্দেশে ঢাকা শহরের বুকে পা রেখেছিলেন মহুয়া৷ বাবা ছিল দিনমজুর। যখন যা কাজ পেতেন সেটাই করতেন৷ বহু কষ্টে মেয়ের পড়াশোনার খরচ পাঠাতেন গাফফার মিয়া৷ গ্রামে উনাকে সবাই গফুর নামেই চিনত৷ পড়াশোনার বদলে মহুয়ার নাচের প্রতি ঝোঁক ছিল ভীষণ। বাবার পাঠানো টাকা দিয়ে হল ভাড়া আর পড়াশোনার খরচ মোটেও হত না। মাঝে মাঝে পায়ে হেঁটে চলাচল করতে হত আবার মাঝে মাঝে সারাদিন না খেয়েই কাটিয়ে দিতে হত৷ প্রিয় বান্ধবীর কথায় দুটো টিউশনিও নিয়েছিল। হঠাৎ একদিন পরিচয় হয় মেহরাব শিকদারের সঙ্গে। কলেজ রোডের সামনেই একটা ছোটো ছেলের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল৷ আর সেখানেই তাদের প্রথম দেখা হয়। প্রথম দেখায় লোকটাকে ভীষণই ভালো মানুষ মনে হয়৷ একজন অচেনা মানুষের জন্য যে এতটা করে সে ব্যক্তি নিশ্চয়ই ভালো মানুষই হবে৷ মেহরাব শিকদারও সেদিন একদৃষ্টে দেখছিলেন মহুয়াকে৷ সময় বসে থাকে না। ঠিকই নিজ গতিতে এগিয়ে যায়৷ এরপরের থেকে প্রত্যেকটা দিনই মেহরাব শিকদারকে কলেজ রোডের সামনে দেখা যেত৷ মাঝে মাঝে বাইক নিয়ে মহুয়া পিছুও নিতেন। ব্যাপারটা খুব ভালো লাগত মহুয়ার। আবেগের বয়সে এসব ভালো লাগারই কথা৷ মনে মনে তিনিও যে মেহরাবকে পছন্দ করতে শুরু করেছেন৷ নিজের অজান্তেই মন দিয়ে বসেছিলেন মেহরাব শিকদারকে। রীতিমতো প্রেমতরঙ্গে ভাসছিলেন মহুয়া৷ কিন্তু তিনি এটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন যে‚ আবেগ দিয়ে জীবন চলে না৷ সকলকে লুকিয়ে দুজনে বিয়েটাও করে নিয়েছিলেন। যে বিয়েতে না ছিল সাক্ষী আর না ছিল কাবিননামা। সময় খুব ভালোই যাচ্ছিল৷ যেই স্বপ্ন নিয়ে মহুয়া শহরে এসেছিলেন সেই স্বপ্ন অর্থাৎ পড়াশোনা‚ নাচের সঙ্গে বাড়ল দূরত্ব। হঠাৎ জানতে পারলেন তিনি অন্তঃসত্ত্বা। ছোটো একটা প্রাণ নিজের মাঝে ধারণ করছেন। খুশিতে পাগলপ্রায় অবস্থা৷ খুশির সংবাদটা মেহরাব শিকদারকে জানাতেই‚ তিনি বললেন বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলতে৷ তার নাকি পরিবার আছে স্ত্রী বাচ্চা আছে৷ জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত যখন এলো তখনই প্রিয় মানুষটার কুৎসিত সত্তার সঙ্গে পরিচিত হলেন তিনি। সেদিন খুব কান্না করেছিলেন তিনি৷ ঠকে যাওয়া জন্য নয়— নিজের করা ভূলের জন্য। মানুষ চিনতে তিনি মস্ত বড়ো ভুল করে বসেছিলেন তিনি৷ তবে থেমে থাকেননি। একাই নিজের আর অনাগত সন্তানের দায়িত্ব নেবেন বলে অনিন্দ্যনগর ফিরে এলেন। গ্রামের মানুষের থেকে কম কটু কথা শুনতে হয়নি উনাকে। তবুও নীরবে সহ সহ্য করে গেছেন। ভূল থেকে শিক্ষা নিয়ে মেয়েকে একা হাতে মানুষ করে গেছেন। একা হাতে সবটা সামলানো খুব একটা সহজ ছিল না উনার জন্য”
বিছানায় উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে অর্পণ। বালিশের পাশে থাকা ফোনটা ক্রমাগত বেজেই যাচ্ছে। সাধের ঘুমটা ভেঙে যাওয়া বিরক্ত সে৷ চোখ বন্ধ রেখে ফোন রিসিভ করে জিজ্ঞেস করল‚
“হ্যালো কে বলছেন?”
“ফোন স্ক্রিনে একটিবার তাকান মহাশয়।”
ঘুম ঘুম আধবোজা চোখে একবার দেখে নিল অর্পণ। ইরাবতী নামটা জ্বলজ্বল করছে৷ কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝে নেওয়া উচিত ছিল৷ ঘুমের ঘোরে এতটা খেয়াল হয়নি। ফোন কানে ধরে অর্পণ পুনরায় জিজ্ঞেস করল‚
“সাত সকালে এভাবে কল করে বিরক্ত করার মানে কী?”
“সাত সকাল তাইনা? ঘড়ি দেখেছেন আপনি? সাড়ে আটটা বাজছে।”
“তো?”
“তো মানে? উঠুন। ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি তৈরি হন।”
“কোথায় যাব? আজ হসপিটালে যাওয়ার তাড়া নেই।”
“আপনাকে হসপিটালে যাওয়ার জন্য আমি কল দিইনি।”
“তাহলে?”
“আপনি এক্ষুনি আমার সঙ্গে মিট করছেন।”
“বললেই হলো?”
“অবশ্যই। আমি আপনার জন্য গুনে গুনে ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করব। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে ভার্সিটির সামনে আসবেন।
এইটুকু বলেই থামল ইরা৷ নিশ্বাস নিয়ে আবারও বলল‚ “আর হ্যাঁ!”
বিরক্তি নিয়ে অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚ “আবার কী হলো?”
“নাস্তা করে তবেই বের হবেন। আমার কাছে বাড়তি টাকা নেই যে‚ আপনাকে নাস্তা করাব৷”
“খেয়ে আসব না৷ রেস্টুরেন্টে বসে খাব। বিল তুমি দেবে।”
“আমার বয়েই গেছে।”
“এক কাজ কর— তুমি আমাদের বাড়িতেই চলে এসো। আমার এখন কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।”
“কেউ একজন বলেছিল— বুদ্ধি থাকলে বিয়ের আগে শ্বশুর বাড়ি যাওয়া যায়।”
“এখানে শ্বশুর বাড়ির কথা আসছে কেন?”
“বাহ্ রে! বিয়ের পর আমি তো আপনাদের বাড়িতেই উঠছি। এইযে আপনি কত বুদ্ধিমান। বিয়ের আগেই নিজের শ্বশুর বাড়ি থেকে ঘুরে গেলেন। এখন আবার আমাকে আপনাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য ডাকছেন।”
“ফালতু লজিক নিজের কাছেই রাখ। এলে আসবে না এলে নেই৷ এত কথা শুনতে বাধ্য নই আমি।”
“আপনি আসবেন না তো?”
“না!”
“সত্যি তো?”
“কানে কী কম শোন? বললাম তো আসব না৷”
“তাহলে আমি পাড়ায় পাড়ায় রটিয়ে দেব‚ আপনার বদনাম।”
ইরা কল কে’টে দিয়েছে৷ অর্পণ গাল এলিয়ে হেসে উঠল মেয়েটার বাচ্চামোতে৷ অল্পতেই রেগে যায় ইরা। এইজন্যই মেয়েটাকে কারণে অ-কারণেই রাগায়৷ অর্পণ ঝটপট তৈরি হয়ে নিল। হসপিটালে আজ তার ডিউটি নেই। আরশের নাম্বারে কল লাগাল অর্পণ। কল রিসিভ হতেই বলল‚
“বাবা পৌঁছেছে? বাবার নাম্বার বন্ধ কেন?”
অপরপ্রান্তে থাকা আরশের কথা কিছুই শোনা গেল না৷ অর্পণ আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন কে’টে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রান্নাঘর ফিরোজা নাস্তা বানাচ্ছেন। অর্পণ তাড়া দিতেই প্লেটে একটা ডিমের অমলেট আর দুটো তেল কম দিয়ে পরোটা বানিয়ে পাঠালেন সাবিনাকে দিয়ে।
নিরুপদ্রব বাহুডোরে আবদ্ধ ভূমি নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে৷ লোকটা তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে নিজের সঙ্গে। বেলা হচ্ছে লোকটা কেন বুঝতে চাইছেন না? একপর্যায়ে প্রলয়ের বুকের মধ্যিখানে চুপটি করে রইল ভূমি। সুযোগ পেয়ে প্রলয় তাকে আরও শক্ত করে জাপ্টে ধরল৷ ভূমির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল‚
“এত সকালে উঠতে হবে না৷ তুমি ঘুমোও৷ পেটে ব্যথা করছে এখনো?”
দু পাশে মাথা ঝাকিয়ে বলল‚ “উঁহু!”
কপালে উষ্ণ ছোঁয়া অনুভূত হতেই চোখ মেলে তাকাল ভূমি। প্রলয়কে এতটা সমীপে দেখে লজ্জাপীড়িত ভূমি। তার গায়ে চাদর জড়িয়ে দিয়ে বিছানা ছাড়ল প্রলয়৷ আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বারান্দার দিকে গেল৷ গোলাপ গাছটায় হলুদ রঙা ফুল ফুটেছে। কাল সকালেও এটা শুধুমাত্র একটা ছোটো কলি ছিল৷
অন্যদিকে…সকালে মহুয়ার মুখে মেয়ের কথা শুনে খুবই কৌতূহল হলো মেহরাব শিকদারের৷ সত্যিটা জানার আগ্রহ দাবিয়ে রাখতে পারছেন না কিছুতেই। নাস্তার পর্ব চুকিয়ে মহুয়া বাকি কাজগুলো করছেন। সবকিছুতেই আজ তাড়াহুড়ো করছেন তিনি। মেহরাব শিকদারের সামনে পড়তে চান না কিছুতেই। একগাদা কাপড় ভিজিয়েছিলেন সকালে। সেগুলো এখন বাগানে মেলে দিচ্ছেন। রোদ আছড়ে পড়ছে সেখানটায়৷ কাপড়চোপড় শুকতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। বালতি হাতে নিয়ে মহুয়া পেছন ফিরতেই মেহরাব শিকদারকে দেখতে পেলেন। লোকটা উনাকে অনুসরণ করছেন কিন্তু কেন? লোকটাকে দেখেই রাগের মাত্রা তড়তড় করে বাড়তে শুরু করল। একটা সময় যে ব্যক্তি উনার সবথেকে প্রিয়‚ ভালোবাসার মানুষ ছিলেন। আজ তাকে দেখে ঘৃণা হৃদয়‚ মস্তিষ্ক জর্জরিত হচ্ছে৷ মহুয়া বাগান থেকে প্রস্থান নিতে চাইলে মেহরাব শিকদার বলে উঠলেন‚
“তোমার মেয়ে কোথায় মহু?”
“সেটা জেনে তোমার কোনো কাজ নেই।”
মেহরাব শিকদারকে ভয় দেখানোর উদ্দেশে মহুয়া আবারও বলে উঠলেন‚
“তোমার সত্যিটা সকলের কাছে বলতে আমার খুব বেশি সময় লাগবে না। বাঁচতে চাইলে খুব শীগ্রই এখান থেকে চলে যাও৷ তোমাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।”
মহুয়ার এহেন কথা ভীষণ রাগ হলো মেহরাব শিকদারের। তবে সেই রাগ প্রকাশ করলেন না৷ বরঞ্চ তাচ্ছিল্য করে বললেন‚
“বেশি বাড় বেড় না ঝড়ে পড়ে যাবে।”
“আর পড়ার বাকিটাই কী রেখেছ? অ্যাই তুমি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও তো। পুরোনো ক্ষ’ত আবার তাজা করতে এসেছ? এবার কিন্তু আমি চুপ থাকব না।”
“মুখ থেকে টু শব্দ বের হলে খু’ন করে রেখে দেব।”
“ড. মেহরাব শিকদার বুঝি ভয় পাচ্ছে?”
“ভয় তাও আবার আমি? হুহ্!”
“তোমার সব অন্যায়‚ পাপের শাস্তি তোমাকে ইহকালেই পেয়ে যেতে হবে৷ বউ‚ বাচ্চার দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারবে তো?”
“কোনো সত্যির মুখোমুখি আমি ওদের হতে দেব না আমি।”
“যতই চেষ্টা কর— সত্যিটা একদিন সবার সামনে আসবেই৷ সেদিন কোথায় মুখ লুকাবে?”
মেহরাব শিকদার এদিক সেদিক তাকালেন। কাউকে দেখতে না পেয়ে মহুয়ার গাল চেপে ধরলেন রুক্ষ ভাবে৷ ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে এলো মহুয়ার৷ নিজে থেকে মেহরাব শিকদারের হাত ছাড়িয়ে দূরে সরে দাঁড়ালেন৷ চেঁচিয়ে বললেন‚ চোখের সামনে থেকে দূরে চলে যেতে। মেহরাব শিকদার আর একমুহূর্ত সেখানে দাঁড়ালেন না।
ভূমিকে নিয়ে ডাইনিং স্পেসে এসেছে প্রলয়৷ কাল সন্ধ্যের পর আর ঘর থেকে বের হয়নি মেয়েটা৷ মাধুরী রান্নাঘরে রয়েছেন। মোর্শেদ শিকদারের পাশের চেয়ারে প্রলয় বসল। পূর্ণতা পুষ্পিতা সামনাসামনি বসেছে৷ ভূমি রান্নাঘরে গিয়েছে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে। তাকে দেখে কিছু বললেন না মাধুরী৷ বরঞ্চ ভূমির হাতে জুসের জগটা ধরিয়ে দিলেন। রান্নাঘর থেকে প্রস্থান নেওয়ার আগে বললেন‚ ‘দ্রুত নিয়ে এসো।’ মাধুরীর কথানুযায়ী উনার পেছন পেছন ছুটল ভূমি৷ ফিরোজা সকলের প্লেটে অমলেট দিচ্ছেন। ভূমি পরোটা এগিয়ে দিতে লাগল। খাওয়ার একপর্যায়ে প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚
“অর্পণ কোথায়— দেখছি না যে?”
ফিরোজা বললেন‚ “ও একটু বেরিয়েছে।”
খাওয়া রেখে পুষ্পিতা বলল‚ “ওয়েট ওয়েট! বড়ো ভাইয়া তুমি কী ছোটো ভাইয়াকে মিস করছ?”
পূর্ণতা বলল‚ “ছোটো ভাইয়া থাকলে হয়তো আবেগে কেঁদেই দিত।”
নিজেরাই কথা বলছে নিজেরাই হাসছে। পূর্ণতা পুষ্পিতার কানে টেনে ধরলেন মাধুরী। সারাক্ষণ দুষ্টুমি লেগেই থাকে এদের। আজ মনে হচ্ছে দুটোর মাঝে কোনোটার থেকে কোনোটা কম না। চঞ্চল দুটোই। পূর্ণতা মাঝে মাঝে শান্ত থাকে কিন্তু পুষ্পিতাকে বকে মে’রে শান্ত করানো যায় না। পানি পান করে প্রলয় দুবোনের উদ্দেশে বলল‚
“পাগলদের সঙ্গে কথা বললে আমিই কখন পাগল হয়ে যাব!”
“বড়ো ভাইয়া তুমি আমাদের পাগল বললে?“
“ভূল হয়েছে।” কথাটা শুনে হয়ে গিয়েছিল পূর্ণতা পুষ্পিতা। প্রলয়ের পরবর্তী কথাটা শুনে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল দুটোতে৷ যখন প্রলয় বলল‚ “পাগলি বলা উচিত ছিল।”
মুখ টিপে হাসছে ভূমি আর ফিরোজা। মাধুরী বললেন‚ “তুমি খেতে বসে পড় ভূমি। ফিরোজা তুইও বোস৷”
সফট মিউজিক বাজছে। শীতল পরিবেশ৷ রঙ বেরঙের মরিচবাতি জ্বলছে৷ অর্পণ ইরা মুখোমুখি বসে রয়েছে। আজ ভার্সিটি যায়নি৷ কলেজ রোডের পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে এসে বসেছে৷ খাবার আর কোল্ড কফি অর্ডার দেওয়া হয়েছে৷ চুপ করে বসে রয়েছে ইরা। নীরবতা ভেঙে অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚
“এত তাড়াহুড়ো করে ডেকে আনার মানেটা কী?”
“কেন আমার সঙ্গ বুঝি আপনার ভালো লাগছে না?”
“ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল চলবে না৷ সরাসরি কথা বল।”
“আজ তো রোজ ডে। বান্ধবীরা সবাই কত কত ফুল পেয়েছে! আপনি আমাকে ফুল দেবেন না?”
“তা আমি কেন তোমাকে ফুল দেব?”
“আমি এখন অতশত ব্যাখ্যা দিতে পারব না৷ আপনি ফুল কিনে দিবেন কি-না সেটা বলুন।”
“চল ফুল কিনে দিচ্ছি।”
অল্পতেই খুশি হয়ে গেল ইরা৷ মুখে লেপ্টে রয়েছে তৃপ্তিকর মিষ্টি হাসি। অপলক নেত্রে চেয়ে রইল অর্পণ। ইরা বলল‚ “এভাবে তাকিয়ে থাকলে প্রেমে পড়ে যাবেন তো। তখন আপনাকে কে সামলাবে?”
“প্রেমে পড়া কী এতই সোজা? তোমার প্রেমে পড়তে আমার বয়েই গেছে?”
“নারীর চোখ কী ফাঁকি দেওয়া যায়?”
“যায় না বুঝি?”
“অবশ্যই যায় না। প্রেমে পড়ার ব্যাপারটা একটা নারী খুব সহজেই ধরে ফেলতে পারে।”
“তাই?”
“হুম— হুম! এ চোখে তাকালে আপনি প্রেমে পড়তে বাধ্য।”
“আচ্ছা ওসব প্রেমের কথা বাদ। পড়াশোনা কেমন চলছে তোমার?”
“যেমন দেখছেন।”
“তোমার মতো ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে দুটো দেখিনি।”
“দেখেননি তো কী হয়েছে? এখন দেখে নিন।”
“ভারী দুষ্টু তুমি।”
“নতুন কথা বলুন। পুরনো কথা শুনতে শুনতে আমি অভ্যস্ত।”
অর্পণ দুহাত জোর করে ইরার সামনে মাথা নোয়াল‚ “আমার ভুল হয়েছে বোন। তোমার পেছনে লাগা উচিত হয়নি।”
ইরা রেগে বলল‚ “আমি আপনার কোন জন্মের বোন হই? আমার একটা সুন্দর নাম আছে। সেই নামেই ডাকবেন।”
“আরে রাগছ কেন? আমি কী রাগ হওয়ার মতো কিছু বললাম নাকি?”
“অবশ্যই। কফি অর্ডার দিন। গলা শুকিয়ে গেল।”
“যেভাবে ঝগড়া করছ গলাতে শুকবেই।”
“আপনি ঝগড়া করতে এসেছেন কেন বদ লোক?”
“তাহলে চলে যাই?”
“তা তো যাবেনই। আমি কী আটকে রেখেছি নাকি? যান— চলে যান।”
“না যাব না। টায়ার্ড লাগছে।”
“আপনি বড্ড তর্ক করেন।”
“হার মেনে নিলাম।”
“গুড গার্ল।”
চকিত দৃষ্টিতে অর্পণ তাকাল ইরার দিকে। জিজ্ঞেস করল‚ “ওটা গার্ল নয় বয় হবে। স্টুপিড।”
“আপনি থাকুন। আমিই চলে যাচ্ছি।”
ইরা উঠে চলে আসতে নিলে অর্পণ তার হাত ধরে থামিয়ে দেয়। সে তো নিছকই মজা করছিল। মেয়েটা অল্পতেই রেগে যায়৷ তাইতো রাগাতেও ভালোই লাগে৷ অর্পণ বলল‚
“আমাকে ডেকে এনে এখন কোথায় যাচ্ছ?”
“বেশি তর্ক করতে চাইছি না তাই চলে যাচ্ছি।”
“ইরাবতী কী হাঁপিয়ে গেল?”
অর্পণের মুখে ইরাবতী ডাকটা শুনে অবাক হলো ইরা। ভীষণ রকমের অভাক। এই প্রথম ইরাবতী ডাকটা শুনে বেশ ভালো লেগেছে তার৷ অর্পণের মুখে ডাকটা অন্যরকম সুন্দর লাগল যেন৷
রাতে…
বৈঠকখানায় মোর্শেদ শিকদার মাধুরী পাশাপাশি বসেছেন। প্রলয় আর অর্পণ দুজন দুই প্রান্তে বসেছে৷ বড়োদের আলোচনায় পূর্ণতা পুষ্পিতাকে থাকতে দেননি মাধুরী। পরীক্ষা প্রায় চলে এসেছে৷ মেয়ে দুটোর মন খারাপ‚ বড়ো ভাইয়ার রিসেপশন/জন্মদিনে আনন্দ করতে পারবে না বলে। প্রলয় ভূমির রিসেপশনের জন্য কার্ড ছাপানো হয়েছে৷ কাকে কাকে দিতে হবে সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে মূলত। এখনো অনেক কিছু কেনাকাটা করার বাকি রয়েছে৷ সেজন্য মোর্শেদ শিকদার বললেন‚
“রিসেপশনের জন্য যা যা কেনার আছে কিনে নিয়ো প্রলয়। আজ দুপুরে তোমার মা আর ফিরোজা গহনা ঠিক করাতে দিয়ে এসেছিল।”
কথায় বিরতি নিয়ে মোর্শেদ শিকদার আবারও বললেন‚ “ভূমিকে সঙ্গে নিয়ে যেও। ওরও তো পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার আছে৷”
প্রলয় কিছু বলল না৷ মনে মনে তো সে এটাই চাইছিল‚ ভূমিকে নিয়ে শপিং এ যাবে৷ মোর্শেদ শিকদার না বললেও সে ভূমিকে নিয়ে যেত। ক্ষীণ হাসল প্রলয়। মাধুরী বললেন‚
“তোর বন্ধুদেরও বলবি কিন্তু। কেউ যেন বাদ না পড়ে৷”
প্রলয় বলল‚ “ওদের আরও আগেই বলা হয়ে গিয়েছে৷”
অর্পণ টিপ্পনী কে’টে বলল‚ “ভাই তুমি তো ফাইভ জি স্পিডে ছুটছ।”
চোখ গরম করে তাকাল প্রলয়। মনে মনে একটা কথা বলতে খুবই ইচ্ছে হলো তার। কিন্তু বড়োদের মাঝে সেই কথাটা বলা শোভা পাবে না। কথাটা এমন ছিল যে‚
“আমার স্পিড সম্পর্কে তোর কোনো ধারণা নেই! চাইলেই বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তোকে চাচ্চু বানিয়ে দিতে পারি।”
মনের কথাটা মনেই দাবিয়ে রাখল। বলতে তো তার অনেক কিছুই ইচ্ছে হচ্ছে৷ কিন্তু যতই হোক তারও তো লাজলজ্জার বালাই আছে৷
বিছানা গুছিয়ে ঘুমোনো বন্দবস্ত করছে অর্পণ। এতক্ষণ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। একাকী নিজেকে সময় দিতে ভীষণ ভালো লাগে তার। সময়ের পর সময় বয়ে যায়। মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে‚ অর্পণ বারান্দায় বসেই রাত কাবার করে দিয়েছ। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে‚ মশা লাভ বাইট দিয়ে দেয়। ফোন চার্জে লাগানো। এদিকে অর্পণ বিছানায় শুয়ে পড়েছে। ঘুমে চোখ বুজে আসছে। তখনই বেহায়া ফোনটা বাজতে শুরু করল অনবরত। এবার যেন আলসেমি জেঁকে বসেছে৷ বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করল না। বিছানা যে বলছে‚ ‘আমাকে ছেড়ে যেও সোনা। ধরিত্রীর সাধ্যি কোথায় তোমাকে আমাকে আলাদা করার!’ কিন্তু ওইযে নির্লজ্জ মোবাইল। কোন খ্যাপা তার ঘুমের পিছু লেগেছে সেটাও তো জানতে হবে৷ অগত্যা বিছানা ছাড়তে বাধ্য হলো অর্পণ। বিছানাটা যেন আবারও ফিসফিসিয়ে বলছে‚ ‘তুমিও আমাকে ঠকালে? তোমার আমার ভালোবাসা কেউ মেনে নিল না।’
ওয়ারড্রবের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল অর্পণ। স্ক্রিনে সেই একই নাম ‘ইরাবতী’। সমস্ত বিরক্তি ভাব মূর্ছা গেল। প্রাপ্তবয়স্ক আঁখিপল্লব হতে ঘুম পালিয়েছে। চিত্তচাঞ্চল্য হাস্যজ্বল হয়ে উঠল মুখটা। তবুও কণ্ঠ খাদে নামিয়ে অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚
“এতবার কল দিচ্ছ কেন?”
“এত রাতে একটা মেয়ে একটা ছেলেকে কেন কল দেয় জানেন না বুঝি?”
“আবেগ দিয়ে জীবন চলে না মেডাম।”
“চলবে না কেন? অবশ্যই চলবে।”
“তাহলে অপেক্ষা করতে হবে। পারবেন তো মেডাম?”
“কী মনে হয় আপনার?”
“আমার মনে হওয়া দিয়ে কী হবে? তোমার মুখেই শুনি৷”
ইরা চোখ বন্ধ করে বলল‚ “আপনার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করতে রাজি। শুধু শেষ অবধি আপনি থেকে যাবেন।”
ফোন কানে রেখে কোলবালিশটাকে জড়িয়ে ধরল অর্পণ। পুনর্বার কিছু বলার ইচ্ছে হলো না। খানিকটা সময় নীরবতায় কাটুক। অপরপ্রান্ত থেকে গুনগুন ধ্বনি ভেসে আসছে। গুনগুনানো উপলব্ধি করল অর্পণ। তার মনে পড়ল‚ প্রলয় ভূমির রিসেপশনের কথাটা ইরাকে জানানো উচিত।
“বুধবারে ভাই আর ভূমির রিসেপশনের আয়োজন করা হবে। তোমাদের বাড়িতে হয়তো বাবা-ই নিমন্ত্রণ করে আসবেন। বাবা তো তোমাদের বাড়িতে রয়েছেন।”
“হ্যাঁ ভাইয়া জানিয়েছিল।”
“তা মেডাম এত রাত জাগলে চলবে? ঘুমতে হবে তো! এরপর চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে যাবে।”
“তখন বুঝি আমাকে আর পছন্দ করবেন না আপনি?”
“মেয়েরা যে‚ বুঝে কম লাফায় বেশি এটাই তার প্রমাণ।”
“আমার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত নারী জাতিকে অপমান— এ আমি কিছুতেই সহ্য করব না। কদাপি নহে।”
“আমার এত বড়ো সাহস আছে নাকি? একটাকেই সামলাতে হিমসিম খাচ্ছি। পুরো নারী জাতিকে কী করে সামলাব?”
চলবে?…..
#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১৮|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
করিডরে পায়চারি করছেন মেহরাব শিকদার। ঘুম আসছে না কিছুতেই। চিন্তায় মাথা ছিড়ে যাচ্ছে৷ এতকাল পরে অতীত আবার কেন সামনে এসেছে? চোখের সামনে নিজের বিনাশ দেখতে পারছেন তিনি। না— যে করেই হোক এই সমস্যা থেকে নিজেকে রক্ষা করতেই হবে। অতীত মুছে ফেলতে হবে। কিন্তু কীভাবে কী করা উচিত কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। ফিরোজা নাম্বার থেকে কল আসতেই সমস্ত চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছেন মেহরাব শিকদার। উচ্ছ্বাস নিয়ে ফোন রিসিভ করলেন তিনি। ওপাশ থেকে প্রিয় অর্ধাঙ্গিনীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো‚
“কবে আসবে তুমি?”
“সবে একটা দিন হলো।”
“আমার মনে হচ্ছে একযুগ হয়ে গিয়েছে।” একটু থেমে‚ “তোমাকে একটা কথা বলি?”
“আমাকে কিছু বলার জন্য অনুমতি লাগবে বুঝি?”
“তোমাকে না জানিয়ে আমি দুই জোড়া ঝুমকো গড়াতে দিয়েছি।”
অবাক হয়ে মেহরাব শিকদার শুধলেন‚ “হঠাৎ?”
“একজোড়া ভূমির জন্য। আর আরেকজোড়া আমার অর্পণের বউয়ের জন্য।”
“আমার বউয়ের জন্য কিছু বানাতে দাওনি?”
সলজ্জে হেসে ফিরোজা বললেন‚ “ধ্যাৎ তুমিও না।”
“আমি আবার কী করলাম?”
“বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে।”
“অ্যাই তুমি আমাকে বুড়ো বললে? একমাত্র ছেলেকে এখনো বিয়ে করালাম না। নাতি নাতনির মুখ দেখলাম না। আর তুমি আমাকে বুড়ো বলে আখ্যায়িত করলে?”
“অবশ্যই! আচ্ছা— খেয়েছ তুমি? ওখানে সব ঠিকটাক তো?”
“হ্যাঁ আমি খেয়েছি৷ আর এখানে সবকিছু ঠিকটাকই৷”
“তুমি আরশের বাবা মাকে নিমন্ত্রণ জানিয়ো।”
“কীসের?”
“বাহ্ রে! প্রলয় ভূমির রিসেপশনের কথা ভুলে গেলে তুমি?”
“এতকিছুর মাঝে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। আচ্ছা আমি উনাদের বলব।”
আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিলেন মেহরাব শিকদার। রাত হচ্ছে। সময় বারোটার কাছাকাছি। গ্রামে এটাই গভীর রাত। সবকিছু নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে অদূরে কুকুরের ঘেউঘেউ আওয়াজ ভেসে আসছে। গ্রীবাভঙ্গি পরিবর্তন হতেই মহুয়াকে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন মেহরাব শিকদার। এদিকে টিপ্পনী কে’টে মহুয়া শুধালেন‚
“বউয়ের সঙ্গে কথা বলছিলে বুঝি?”
পাল্টা প্রশ্ন করলেন মেহরাব শিকদার‚ “আড়ি পাতছিলে বুঝি?”
“ওসব আড়ি পাতা আমার স্বভাব নয়। সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম কথাগুলো কানে এলো।”
“আমার তো অন্য কিছু মনে হলো!”
“তোমার মনে হওয়া দিয়ে আমার কাজ নেই। সে যাকগে— একটা কথা না বললেই নয়।”
ভ্রুযুগল উঁচিয়ে মেহরাব শিকদার শুধালেন‚ “কী কথা?”
“তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার খুবই আফসোস হচ্ছে৷”
কথাটা বলে থামলেন মহুয়া৷ কিছুটা ফিসফিসিয়ে বললেন‚ “ঘরে বউ বাচ্চা রেখে পরকীয়া করেছ সেটা যদি তোমার বউ জানে— ভাবতে পাচ্ছ কী হবে তোমার? সত্যিটা জানার পর‚ এত ভালোবাসা টিকে থাকবে তো? এই কথা ভাবতেই তো আমার পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে৷”
“তোমাকে নিয়েও আমার খুব আফসোস হচ্ছে।”
“তোমারও আফসোস হয় বুঝি?”
“কেন হতে পারে না বুঝি? এইযে আমার আফসোস হচ্ছে— আমার পরিনতি‚ দোষক্ষালন দেখার জন্য তুমি থাকবে না।”
“মে’রে ফেলবে বুঝি আমাকে? ড. মেহরাব শিকদার বুঝি খুব বেশিই ভয় পেয়ে গিয়েছে?”
“আমার আরও একটা আফসোস হচ্ছে!”
“সুযোগ আছে সকল আফসোস বলে দাও।”
“উনিশ বছর আগেই তোমাকে আমার পথ থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। তাহলে কাহিনী এতদূর গড়াত না।”
তাচ্ছিল্য করে হাসলেন মহুয়া। মেহরাব শিকদার আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না সেখানে। করিডোর থেকে প্রস্থান নিলেন। মহুয়া ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন।
সাড়ে বারোটা…
“কাজটা আপনি ঠিক করছেন না নাজিম চৌধুরী।”
“……”
“আমি বরাবরই রাজনীতি আর ব্যক্তিগত জীবনকে আলাদা রেখেছি। আমি চাইছি না আপনি আমার ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করুন।”
“……”
রাগে শরীর কাঁপছে। কিছুতেই সেই রাগেই বহিঃপ্রকাশ করতে পারছে না প্রলয়। সর্বস্ব দিয়ে ফোনটাকে মেঝেই আছাড় মে’রেছে সে৷ নীলচে জোছনার আলো এসে লুটোপুটি খাচ্ছে মেঝেতে৷ কিন্তু আফসোস আঁধারিয়া বারান্দায় ভাঙা ফোন কোথাও দেখা গেল না৷ অতিরিক্ত রাগ দাবিয়ে রাখতে না পেরে একের পর এক সিগারেট ধরিয়েই যাচ্ছে।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ঘরে কোথাও প্রলয়কে দেখতে পেল না ভূমি। এইতো কিছুক্ষণ আগেও বিছানায় শুয়ে ছিল লোকটা৷ ভূমি বারান্দার দিকে গিয়ে দেখল প্রলয় সেখানেই। তার দরজার সামনে দাঁড়িয়েই ভূমি তাকে ডাকল‚
“শুনছেন? ঘুমবেন না?”
প্রলয়ের কাছ থেকে প্রত্যুত্তর পেল না ভূমি। বোকা মেয়েটা বুঝতেই পারল না তার স্বামী রেগে রয়েছে। সে আবারও জিজ্ঞেস করল‚
“শুনছেন?”
রাগ তখন মাথায় চড়ে বসেছে। ভূমির কাছ থেকে লাই পেয়ে প্রলয় তেড়ে এলো। চোখ দিয়েই অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে। প্রলয় চেঁচিয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল ভূমির। নেত্রযুগল অশ্রুপ্লাবিত হলো। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে ভূমি। গলা ঝেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মুখ ফিরিয়ে ভূমি ঘরের ভেতরে চলে এলো। ঘরের লাইট অফ করে নিজের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ল ভূমি। খুব অভিমান হয়েছে তার। বিনাদোষে তাকে ধমক দিয়েছে। এত সহজে তো ক্ষমা করবে না সে৷ এরপর শত চেষ্টা করেও ভূমিকে নিজের দিকে ফেরাতে পারল না প্রলয়। মেয়েটা তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তখন অতিরিক্ত রেগে থাকায় ভূমিকে একটা ধমক দিয়েছিল৷ সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা কেঁদে দিয়েছিল৷ হয়তো ভয় পেয়েছে৷ প্রলয়ের রাগের সঙ্গে তো মেয়েটা পরিচিত নয়। পুরুষ মানুষ সারা দুনিয়ার কাছে বাঘ হয়ে থাকলেও স্ত্রীর কাছে ভেজা বিড়ালই হয়ে যায়৷ ভূমির অভিমান ভাঙতে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল প্রলয়৷ খুবই নিভৃতে ভূমির গ্রীবায় উষ্ণ অধর ছোঁয়াল। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল‚
“এভাবেই অভিমান করে থেক— আমি প্রতিদিন তোমার অভিমান ভাঙাব।”
তবুও মান ভাঙল না ভূমির। মেয়েটা সেই মুখ ফিরিয়েই রেখেছে। পরপরই সে ভূমিকে লজ্জায় ফেলতে প্রলয় আবার বলল‚
“কাঙ্ক্ষিত সেই দিনটার জন্য নিজেকে তৈরি কর ভূমি কন্যা। আমি বেশ বড়োসড়ো উপহার চাই।”
প্রলয়ের বলা কথাটা স্বাভাবিক ছিল না৷ উষ্ণ নিশ্বাস এখনো গ্রীবায় অনুভূত হচ্ছে৷ চিত্ত ব্যাকুল হয়ে উঠেছে ভূমির। দ্রিমদ্রিম মাদল বেশ উপলব্ধি করছে সে। কথাটার রেশ এখনো রয়ে গিয়েছে। সে তো অবুঝ নয়! প্রলয়ের বলা প্রত্যেকটা কথা সে বুঝেছে৷ লোকটা এতটা কবে বদলে গেল? আগের মতো গম্ভীর নেই কেন? পরক্ষণেই মনে পড়ল কিছুক্ষণ আগেই তার উপর চেঁচিয়েছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ভূমিকে কোথাও দেখতে পেল না প্রলয়৷ সেই যে কাল রাতে অভিমান করে বসেছিল এখনো তা অব্যাহত রয়েছে৷ মেয়েটা সকালে তাকে ঘুম থেকে ডাকেনি পর্যন্ত৷ বিছানায় থম মে’রে বসে রইল প্রলয়। ভাবছে কীভাবে বউয়ের মান ভাঙানো যায়! পরক্ষণেই ভাবল ঘরটা অন্তত আজ সেই-ই গুছিয়ে রাখুক। তাহলে যদি একটু মন গলে! চট করে বিছানা ছেড়ে নামল প্রলয়। বালিশ‚ চাদর ঠিকঠাক করে বিছানা ঝাঁট দিল৷ এলোমেলো করে রাখা নিজের শার্ট পাঞ্জাবি বিনে রাখল। এগুলো আধোয়া৷ ড্রেসিং টেবিল এলোমেলো ছিল‚ সেটাও গুছিয়ে নিল প্রলয়। এরপর বারান্দায় গেল সে। গাছে অনেকগুলো গোলাপ ফুটেছে আজ৷ কাল তো শুধু একটা হলুদ গোলাপ ফুটেছিল। আজ যেন ফুলের সমাহার। ফুলগুলো দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠল প্রলয়ের।
রান্নাঘরে সমস্ত কাজ একা হাতে করছে ভূমি। ঘরে যেন যেতে না হয় সেজন্য সকল কাজ নিজের দায়িত্বে নিয়েছে আজ৷ বৈঠকখানার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে প্রলয়৷ মাঝে মাঝে রান্নাঘরের দিকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। সোফায় বসে রয়েছেন মোর্শেদ শিকদার‚ মাধুরী‚ ফিরোজা এবং অর্পণ। উপস্থিত বাকিরা মিটমিট করে হাসছে। ফিরোজা বুঝতে পেরে নিজে থেকে বললেন‚
“তুমি এখন ঘরে যাও। আমি বাকি কাজ করে রাখছি।”
“আমি এখানেই থাকি চাচি মা?”
ফিরোজার সঙ্গে চোখাচোখি হলো প্রলয়ের। লজ্জায় মাথা নিচু করে সিঁড়ি ভেঙে দোতলা চলে গেল। হয়তো নিজের ঘরে গিয়েছে। ক্ষীণ হাসলেন ফিরোজা। ভূমিকে আবারও বললেন‚
“তোমার এখানে থাকতে হবে না‚ এদিকটা আমি সামনে নেব। প্রলয় হয়তো ঘরে গিয়েছে‚ দেখ ওর কী কী লাগে আর এখানে তো সাবিনা আছেই।”
“আচ্ছা চাচি মা।”
ঘরে ক্রমাগত পায়চারি করছে প্রলয়। অপেক্ষা করছে ভূমি কখন আসবে। মেয়েটা কাল থেকে থাকে ইগনোর করছে। দেখেও যেন দেখছে না। ঘরে আসুক মজা দেখাবে— মনে মনে এটাই পরিকল্পনা করছে। এরই মাঝে ভূমি করে প্রবেশ করল। প্রলয় কিছুটা ভাব নিয়ে বিছানায় চুপ করে বসে রইল। কোনো রকম অনুভূতি ব্যক্ত করল না। ভূমি একবার তাকাল প্রলয়ের দিকে। এরপর আলমারির দিকে অগ্রসর হলো। আলমারি থেকে প্রলয়ের জন্য সাদা পাঞ্জাবি বের করে বিছানা এনে রাখল। এবার নীরবতা কাটিয়ে প্রলয় বলে উঠল‚
“শপিং এ যাব৷ ঝটপট তৈরি হয়ে নেবে৷ দুপুরে ওইদিকটায় জ্যাম থাকে।”
ভূমি কিছুই বলল না। কাল রাতের কথা ভুলে যায়নি সে৷ মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা লোকটা তার উপর চেঁচিয়েছে৷ কই আম্মা তো কখনো তার উপর চেঁচামেচি করেননি? বাবা থাকলেও নিশ্চয়ই এমন করতেন না৷ তাহলে তিনি কেন এমন করবেন? অভিমান হয়েছে ভীষণ। মেয়েটার নিস্তব্ধতায় আবারও রাগ চড়তে শুরু করল প্রলয়ের মস্তিষ্কে। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে ভূমিকে শুধাল‚
“কী হলো কথা বলছ না কেন?”
ভূমির স্বাভাবিক জবাব‚ “আপনি আমার উপর চেঁচিয়েছেন।”
“তখন মাথায় রাগ চেপে গিয়েছিল। কিন্তু এখন তো আমি স্যরি বলছি। রাতে একটু বেশি রাগ করে ফেলেছিলাম।”
“সেই রাগটা কী আমাকে নিয়ে?”
“একদমই না। তোমার উপর রাগ করা যায় না৷”
পাল্টা প্রশ্ন করল ভূমি‚ “তাহলে?”
“অফিসিয়াল লাইফ আর পারসোনাল লাইফ দুটোকে আমি মিলাতে চাইছি না।”
ভূমি বুঝলো প্রলয় তাকে ওই ব্যাপারে কিছু বলতে চাইছে না তাই সেও আর কিছু জিজ্ঞেস করল না৷ বিছানায় বসে রয়েছে আর ভুমি বিছানার অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এরপর প্রলয় নিজে থেকেই এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল ভূমিকে। মেয়েটা কোনো রকম দ্বিরুক্তি করল না৷ চুপটি করে মাথা রাখল নিরুপদ্রব বক্ষঃস্থলে।
হসপিটালে…
নিজের কেবিনে বসে রয়েছে অর্পণ। এখন একটু ব্রেক টাইম চলছে। বসে বসে বোর হচ্ছিল৷ তখন একবার ভাবল ইরার সঙ্গেই নাহয় কথা বলা যাক। সময়ও কে’টে যাবে। এই সময়টাতে ইরা হোস্টেলেই থাকে৷ আর কোনো কিছু না ভেবেই ইরার নাম্বারে কল লাগাল৷ কয়েকবার রিং হওয়া সত্ত্বেও কেউ ফোন রিসিভ করল না। অর্পণ ভাবল‚ হয়তো ঘুমচ্ছে তাই আর বিরক্ত করল না ইরাকে। ইউটিউবে প্রলয়ের একটা প্রেস কনফারেন্স ছিল সেটাই দেখছে অর্পণ। মিনিট পাঁচেক পর ইরার নাম্বার থেকে কল এলো। রিসিভ না করে উল্টো কে’টে দিয়ে নিজেই কল ব্যাক করল অর্পণ। ইরাকে শুধাল‚
“কল রিসিভ করছিলে না— কোথায় ছিলে?”
“ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম।”
“ও আচ্ছা!”
“কিছু কী বলবেন? হঠাৎ আয়োজন করে কল দিলেন!”
“কাল একবার আমাদের বাড়িতে আসতে পারবে?”
ইরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল‚ “কেন?”
“সকালে দেখলাম ভূমির মন খারাপ। তোমাকে দেখলে হয়তো ভালো লাগবে। হয়তো খুশিও হয়ে যেতে পারে।”
“ওর খুশি নিয়ে খুব বেশি ভাবা হচ্ছে দেখছি!”
“পূর্ণ পুষ্প যেমন আমার ছোটো বোন‚ ভূমিকেও তেমনি ছোটো বোনের মতোই দেখি। তারউপর ওর সঙ্গে আমার ভাই জড়িয়ে আছে। ভূমির মন খারাপ দেখে আমার ভাইও গম্ভীর হয়ে রয়েছে।”
“আচ্ছা মশাই চিন্তা করবেন না। আমি কাল সকালে আসব। তবে আমাকে দেখে আপনার পরিবার কেমন প্রতিক্রিয়া করবে সেটা নিয়েই টেনশন হচ্ছে।”
“তুমি কিছু চিন্তা কোরো না। আমার পরিবারের সবাই খুব ফ্রেন্ডলি। আমি রাতে বলে রাখব সবাইকে।”
“তাহলে তো কোন সমস্যাই নেই।”
“আচ্ছা আমি এখন রাখছি। পরে কথা হবে।”
“আল্লাহ হাফেজ।”
মহুয়া কে নিজেদের ঘরে ডেকে এনেছেন নাজমা। উনার কিছু কথা বলার আছে। যে কথাগুলো না বললেই নয়। খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছু সত্যি তো উনারও জানা প্রয়োজন। মহুয়া হাতের কাজগুলো সেরে শাহাদাত মোড়লের শয়ন কক্ষে এলেন। নাজমা উনার জন্যই অপেক্ষা করছেন। মহুয়াকে আসতে দেখেই নাজমা বললেন‚ “বোসো!” কথানুযায়ী মহুয়া বিছানায় বসলেন। নাজমা জিজ্ঞেস করলেন‚
“মেহরাব শিকদারকে কী তুমি আগে থেকে চিনতে মহুয়া?”
নাজমার কথা শুনে অনেক খুবই অবাক মহুয়া। স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন‚ “হঠাৎ এমন কথা বলছেন কেন ভাবি?”
“কাল রাতে তোমাদের কথা আমি শুনেছিলাম। তোমরা কি একে অপরকে আগে থেকেই চেন?”
মহুয়া আর লুকিয়ে রাখলেন না। সব কথা বলে দিলেন নাজমাকে। সঙ্গে ওয়াদা করিয়ে নিয়েছেন যেন এই কথা অন্য আর কেউ না জানে। সব কথা শোনার পর ঘৃণায় চোখ মুখ কুঁচকে এলো নাজমার। মেহরাব শিকদারকে কত ভালই না মনে করেছিলেন তিনি! তবে এই ভালো মানুষের মুখোশের পেছনে রয়েছে এক নির্মম সত্যি। আর সত্যি এটাই যে ভূমি মেহরাব শিকদারের মেয়ে। তবে তিনি কেন এটা স্বীকার করছেন না? এসব কথাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নাজমার। মহুয়াকে তিনি কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন না আর। বিছানায় বসে ক্রমাগত কাঁদছেন। নাজমা নিজে থেকেই বললেন‚
“ভূমি যেদিন এই সত্যিটা জানতে পারবে‚ ভাবতে পারছ কী হবে?”
“যেই বাবাকে কখনো চোখেই দেখেনি ভূমির তার প্রতি অগাধ ভালোবাসা। আমি কী করে সত্যিটা বলে মেয়েটার মনে আঘাত দিতে পারি? এটা যে আমি কক্ষনো করতে পারবো না। মেয়েটা যখন আমাকে জিজ্ঞেস করত‚ ‘আমার বাবা কোথায় আম্মা?’ তখন আমি মুখ ফুটে সত্যিটা বলতে পারতাম না। একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমার মেয়েটা ছটফট করত। শুধু মায়ের ভালোবাসাই যথেষ্ট নয়। একটা সন্তানের জন্য বাবা মায়ের ভালোবাসা দুটোই প্রয়োজন হয়। আমার মেয়েটা আজও অপেক্ষায় আছে‚ তার বাবা একদিন আসবে। কিন্তু ভূমি তো এটাই জানে না যে‚ সে তার বাবার কাছে পাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। মেহরাব শিকদারও জানেন না যে‚ ভূমিই উনার সন্তান।”
“সত্যি কোনদিন চাপা থাকে না মহুয়া। সত্যিটা একদিন সবাই জানবে। তার আগেই উচিত ভূমিকে সব সত্যি জানিয়ে দেওয়া তাহলে হয়তো মেয়েটা কষ্ট একটু কম পাবে।”
“আমি প্রতিনিয়ত নিজের সাথে যুদ্ধ করছি। কিছুতেই পারছি না মেয়েটাকে এত বড়ো দুঃখের মুখোমুখি করতে। আমার মেয়েটা যে বড্ড কোমল।”
“আরেকটা কথা তোমাকে জানানোর আছে।”
“কি কথা ভাবি?”
“আমাদের সবাইকে শহরে যেতে হবে। তোমাকেও যেতে হবে। প্রলয় আর ভূমির রিসেপশনের আয়োজন করা হবে। মেহরাব শিকদার কিছুক্ষণ আগে আরশের বাবাকে জানিয়েছিলেন। ভাবলাম তোমাকেও বলে দিই। তখনই কাল রাতের কথাটা মনে পড়ল। তাই তোমাকে ডেকে আনলাম।”
“আমি শহরে গেলে যে‚ মেহরাব শিকদার জেনে যাবেন ভূমিই উনার মেয়ে। আমি কিছুতেই এই সত্যিটা উনার সামনে আনতে দিতে চাইছি না। হতে পারে এই সত্যিটা জানার পর উনি আমার মেয়েকে কখনো সুখীই হতে দেবেন না।”
“তুমি আমাদের পরিবারের একজন সদস্য তাই তুমি আমাদের পরিচয়ে যাবে। কোন ধরনের সমস্যা হবে না ইনশাআল্লাহ।”
বেশ অনেকগুলো গাড়ির লম্বা লাইন জমেছে। রাস্তার অপর প্রান্তের গাড়িগুলো সাঁই বেগে ছুটে যাচ্ছে। যেই জ্যামের ভয়ে তাড়াতাড়ি করে বাড়ি থেকে বের হলো। সেই জ্যামের মধ্যেই পড়তে হলো দুজনকে। প্রলয়ের রাগ লাগছে ভীষণ। তবে তা প্রকাশ করছে না পাছেই না মেয়েটা অভিমান করে বসে। এখনো চুপটি করে পাশের সিটে বসে রয়েছে। মাথা হেলান দিয়ে রেখেছে। ভূমির কী অস্বস্তি হচ্ছে? নেকাব পড়ে রয়েছে বিধায় বুঝতে পারছে না প্রলয়। তবুও ভাবনাটা মাথায় আসতেই জিজ্ঞেস করল‚
“গাড়িতে অস্বস্তি হচ্ছে তোমার? এসি চালিয়ে দেব?”
কোনো রকম ভণিতা না করেই ভূমিস বলে ফেলল‚ “জানালাটা খোলা যাবে?”
প্রলয় প্রত্যুত্তর করল না। গাড়ির জানালা খুলে দিল। সাঁই বেগে বাতাস গাড়িতে প্রবেশ করছে। এখন কিছুটা ভালো লাগতে শুরু করেছে। এতক্ষন গুমোট অনুভূত হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন দম আটকে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে হাত মোজা খুলে ফেলল। নেকাবও তুলে ফেলল। প্রলয় তা দেখে বলল‚
“জানালাটা বন্ধ করে‚ এসি চালিয়ে দিই?”
ভূমি মুখ তুলে তাকাল প্রলয়ের দিকে। ঘন আঁখিপল্লব জাপটে সায় জানাল। ভূমির চোখের ভাষা বুঝতে পেরে প্রলয় সেটাই করল। জ্যাম ছুটতে শুরু করেছে। প্রলয় গাড়ি চালানোতে মনোযোগ দিল। সফট মিউজিক বাজছে। মাঝে মাঝে গুনগুনও করছে প্রলয়। গাড়িতে চড়ার অভ্যেস নেই ভূমির। কেমন গান গুলাচ্ছে! সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।
বেশ অনেকটা সময় পর একটা শপিং মলের সামনে এসে গাড়ি থামল। চোখের চশমা ঠিক করে‚ সঙ্গে সঙ্গে মাস্ক পড়ে নিল। যাতে তাকে কেউ চিনতে না পারে। শপিং মলের বাহিরে লোকসমাগম ভীষণ। ভিড় অতিক্রম করে ভূমিকে নিয়ে শপিং মলের ভিতরে প্রবেশ করল প্রলয়। শাড়ি লেহেঙ্গার দোকান তৃতীয় তলায়।
এস্কেলেটরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল ভূমি। সে এসে দাঁড়িয়েছে একদম প্রলয়ের পেছনে। পাশেই ভূমিকে দেখতে না পেয়ে‚ পিছন ফিরে তাকাল প্রলয়। এভাবে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল‚
“দাঁড়িয়ে পড়লে যে‚ কোনো সমস্যা?”
“চলন্ত সিঁড়িতে আমি কখনো উঠেনি। অস্বস্তি হচ্ছে— ভয় করছে।”
ভূমির সহজ স্বীকারোক্তি। প্রলয় তার হাতখানা শক্ত করে ধরল। ভয়ে মেয়েটার হাত কাঁপছে। খুব করে অনুভব করল প্রলয়। দুজনে পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে গেল। প্রলয়ের সংস্পর্শে এসে ভূমির সকল ভয় কে’টে গেল। শাড়ি‚ লেহেঙ্গার দোকানে ঢুকে মুখ থেকে মাস্ক খুলে ফেলল প্রলয়। তাকে দেখেই দোকানের লোকটা সালাম জানালো। তবে প্রলয়ের সঙ্গে বোরকা পরিহিত রমণীকে কেউই চিনতে পারল না। অবাক হয়েই তাকিয়ে রইল সবাই। সকলের এভাবে তাকিয়ে থাকায় খুবই অস্বস্তি হতে শুরু করল ভূমির। প্রলয় এখনো তার হাতটা ধরে রেখেছে। দোকানি নিজে থেকেই শুধালেন‚
“স্যার চা নাস্তা কিছু নেবেন? অ্যাই স্যারের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা কর।”
“আপনি ব্যস্ত হবেন না প্লিজ। ম্যাডামের জন্য লেহেঙ্গা‚ শাড়ি‚ আর টপস দেখান। একটু তাড়াতাড়ি করলেই ভালো হয়। আমার একটু তাড়া আছে।”
দোকানি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন‚ “আচ্ছা স্যার।”
দোকানি কর্মচারী আরেকজনকে নির্দেশ দিলেন প্রলয়ের কথা মতো সবকিছু সামনে নিয়ে আসতে। দেখে দেখে মেরুন রঙা লেহেঙ্গা খুবই পছন্দ হলো প্রলয়ের। নিশ্চয়ই তার প্রেয়সীকে এই লেহেঙ্গাতে ভারী সুশ্রী দেখাবে! লেহেঙ্গাটা সাইড করে রাখল। গুনে গুনে বেশ কয়েকটা শাড়ি নিল। প্রলয়ের পছন্দ আছে বলতে হবে। ভূমিরও খুব পছন্দ হয়েছে। বেশ কয়েকটা টপস আর থ্রিপিসও কিনে দিল। বিয়ের পর এই প্রথম প্রলয় ভূমির জন্য নিজে পছন্দ করে কিছু কিনছে। বেশ উচ্ছ্বসিত সে। মেয়েলি শপিং করার মাঝেও উত্তেজনা কাজ করছে তার। ভূমিকে জিজ্ঞেস করল‚
“তোমার পছন্দ হয়েছে তো? পছন্দ না হলে আমরা চেঞ্জ করে নিতে পারি।”
ভূমি দ্রুত ঘাড় দুপাশে ঝাকালো যার অর্থ তার এগুলোই পছন্দ হয়েছে। ভূমি চঞ্চল স্বীকারোক্তিতে ক্ষীণ হাসল প্রলয়। এরপর সবগুলো জিনিস দোকানদারকে প্যাক করে দিতে বলল। এরপর নিজের জন্য শার্ট‚ পাঞ্জাবি আর রিসেপশনের শেরওয়ানি কেনার জন্য অন্য দোকানে গেল। আগের ভঙ্গিতেই ভূমির হাত শক্ত করে ধরে রাখল। মেকআপের আড়ালেও মুচকি হাসছে ভূমি। জীবনকে নিয়ে ভীষণ তৃপ্তি হচ্ছে তার। আল্লাহ তাআলা তাকে একজন যোগ্য জীবনসঙ্গী বেছে দিয়েছেন। মনে মনে শুকরিয়া আদায় করল আল্লাহর নিকট।
বিছানায় ঘাপটি মে’রে বসে রয়েছেন মাধুরী। কিছুক্ষণ আগেই মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি। মায়ের সঙ্গেই মূলত কথা বলে মুখটা গভীর করে রেখেছেন। রিসেপশনে উনার মা আসতে পারবেন না সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিয়েছেন। প্রলয়ের এমন হুট করে বিয়ে করাটাকে কিছুতেই সমর্থন করছেন না তিনি। বড়ো নাতির বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল উনার। ভেবেছিলেন কনিষ্ঠ নাতনি অর্থাৎ ভাসুরের ছেলের ঘরে নাতনি তৃপ্তির জন্য বিয়ের প্রস্তাব রাখবেন। কিন্তু তার আগেই যা হওয়ার হয়ে গেল।
চিন্তায় মগ্ন মাধুরী। তারউপর গহনা গুলো নাকি ঠিক করতে কিছুদিন সময় লাগতে পারে৷ চেনাজানা জুয়েলার্সের দোকানে দেওয়া সত্ত্বেও দেরি হচ্ছে৷ এখনো অনেককেই নিমন্ত্রণ করা বাকি। অনেক কেনাকাটা বাকি৷ এরমধ্যে মায়ের কাছ থেকে এমন একটা কথা শুনে শান্তি লাগছে না উনার৷ তিনিও তো প্রলয়ের বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছিলেন তা কী আর পূরণ হলো? মানুষ সবসময় যা চাই তাই-ই কী পায়? এই চাওয়া পাওয়া নিয়েই তো জীবন! তারপরও ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সবটা মেনে নিচ্ছেন তিনি৷
এরই মাঝে ফিরোজা এলেন৷ সাবিনাকে দিয়ে ডাক পাঠিয়েছিলেন মাধুরী। গোসল করছিলেন বিধায় তখন আসতে পারেননি ফিরোজা। ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে শুধালেন‚
“ভাবি আমাকে ডাকছিলে?”
“হ্যাঁ!” এরপর সবকিছু খুলে বললেন মাধুরী। ফিরোজা অত্যন্ত শান্ত স্বরে বললেন‚
“এত তাড়াহুড়োর কিছু হয়নি ভাবি। হাতে এখনো আট দিন রয়েছে। নিশ্চয়ই ততদিনে মাওই মাকে আমরা রাজি করাতে পারব।”
বিছানায় বসে থেকেই মাধুরী বললেন‚ “ভূমির মায়ের সঙ্গেও তো কথা বলতে হবে।”
“তা তো বলতেই হবে। আরশ এর পরিবারকেও তো নিমন্ত্রণ করতে হবে। শুনেছি আরশের ছোটো বোন ইরা নাকি ঢাকাতেই কোনো হোস্টেলে থাকছে। আমি ভাবছি মেয়েটা যদি আমাদের বাড়িতে আসত।”
“হঠাৎ আরশের বোন আমাদের বাড়িতে আসতে যাবে কেন?”
“ভাবি তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।”
“হ্যাঁ বল না— এত জিজ্ঞেস করার কী আছে! যখন যা মন চায় মুখ ফুটে বলে দিবি।”
“আরশের বোন ইরাকে আমাদের অর্পণ পছন্দ করে। অর্পণকে কাল বলেছিলাম মেয়েটাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসতে।”
“তাহলে কালই আসতে বল।”
“আচ্ছা ভাবি।”
চলবে?…..