#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১৯|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
নিজের কেবিনে বসে রয়েছে অর্পণ। সবে লাঞ্চ করেছে৷ এখনো ব্রেক টাইম রয়েছেই। ফোনে একটা জামদানী শাড়ির দিকে চোখ আটকে গেল৷ শাড়িটা ভীষণই সুন্দর। লাল পাড়ের কালো শাড়ি। চট করে শাড়িটা অর্ডার দিয়ে দিল অর্পণ৷ এরই মাঝে ওয়ার্ডবয় এসে বলল‚
“স্যার আপনার নামে একটা পার্সেল এসেছে।”
“কোথায়? নিয়ে এসো।”
ওয়ার্ডবয় ছুটে গেল। কিছুক্ষণ পর আবারও পার্সেলটা সঙ্গে করে নিয়ে এসে অর্পণকে দিল৷ এরপর ওয়ার্ডবয় নিজের কাজে চলে গেল৷ পার্সেলটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল অর্পণ। ‘শুধুই আপনার জন্য সাহেব’ লেখাটা পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই ইরার কথা মনে পড়ল৷ মেয়েটা বড্ড চঞ্চল আর চতুর। ভেতরে কী রিয়েছে সেটা জানার আগ্রহ বাড়তে শুরু করল। ইরার নাম্বার বের কল কল দিল অর্পণ। সাথে সাথেই কল রিসিভ হলো। হয়তো অর্পণের ফোন আসারই অপেক্ষা করছিল ইরা৷ অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚
“হুট করে পার্সেল পাঠালে কেন?”
“আপনি আমাকে ভালোবেসে গিফট না-ই দিতে পারেন। আমি তো দিতেই পারি।”
“আমি কী বলেছি তোমাকে গিফট দিতে? আর কী আছে এতে?”
“নিজেই খুলে দেখে দিন।”
“পারব না।”
“আচ্ছা ত্যাড়া লোক তো আপনি।”
“ত্যাড়া লোকের সাথে কথা বলছ কেন?”
“তাহলে রেখে দিন। কথা বলতে কে বলল?”
“তুমিও কম ত্যাড়া না।”
“আপনার সাথে সারা জীবন ত্যাড়ামি করব।”
অর্পণের ক্ষীণ হাসি ইরা দেখতে পেল না৷ দেখলে হয়তো প্রেমে পড়ে যেত! নীরবতা সহ্য হলো না ইরার। তেজি স্বরে শুধাল‚
“লাইনে আছেন তো নাকি?”
“কী বলবে বল!”
“আমি তো ভাবলাম ফোন কানে দেখি হয়তো আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।”
“আমার মত কুম্ভকর্ণ নাকি আমি?”
“কী বললেন আপনি আমাকে? আমি কুম্ভকর্ণ? কুম্ভকর্ণ তো আপনি। সেদিন সকালে কল দিয়েছিলাম— পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিল কে? আমি না আপনি?”
“রাতভর কথা কে বলছিল?”
“অবশ্যই আপনি!”
“অপর প্রান্তের মানুষটা কে ছিল তাহলে?”
“কী জানি!”
শপিংমল থেকে বের হয়েছে প্রলয় আর ভূমি। ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ প্রলয়। এতক্ষণে এসির মাঝে ছিল বলে গরম অনুভূত হয়নি। রাস্তা অপাশের ফুটপাতে আইসক্রিমের দোকান বসেছে৷ প্রলয় একটিবার ভাবল ভূমিকে আইসক্রিম কিনে দেবে। ভূমিকে গাড়িতে বসিয়ে সেখানটায় গেল। যাওয়ার আগে ভূমিকে বারবার বলে গিয়েছে গাড়ি থেকে যেন না নামে। গাড়িতে বসে থাকতে একটুও ভালো লাগছে না ভূমির। ভাবল একটু গাড়ি থেকে নেমে পাশে দাঁড়াবে৷ গাড়ির জানালা খোলা ছিল। ভূমি দেখল‚ প্রলয় রাস্তা পারাপার হচ্ছে। চট করে বের হয়ে বাহিরে দাঁড়াল৷ এখন কিছুটা ভালো লাগছে। লোকসমাগমও খুব বেশি নেই। সবারই তো নিজস্ব কাজ থাকে৷ ভুমি দিক সেদিক তাকিয়ে দেখছে। দুটো আইসক্রিম কিনে প্রলয় যখন পেছনে ঘুরল তখনই দেখতে পেল‚ পেছন থেকে একটা সাদা রঙা গাড়ি ছুটে আসছে৷ কয়েক সেকেন্ডের পথ। মস্তিষ্ক ফাঁকা লাগছে৷ দিকবিদিকশুন্য হয়ে পড়ল প্রলয়। এদিকে রাস্তার কিনারায় দাঁড়িয়ে তার আসার অপেক্ষা করছে ভূমি। মেয়েটাকে বারবার বলা হয়েছিল‚ গাড়ি থেকে যেন না নামে৷ ভূমিকে একা ফেলে আসা তার সম্পূর্ণ ভুল ছিল। একদিকে রাগ অন্যদিকে ভূমিকে হারিয়ে ফেলার ভয় মাথায় জেঁকে বসেছে৷ হাত থেকে আইসক্রিম দুটো পড়ে গেল। প্রলয় সর্বস্ব দিন দৌঁড় লাগাল। মনে মনে একটাই দোয়া করছে‚ ভূমির যেন কোনো ক্ষতি না হয়। দরকার পড়লে সে যেন ক্ষ’তবিক্ষ’ত হয়।
ধুলোবালি জমা রাস্তায় ছিটকে পড়েছে ভূমি। আতঙ্কের মাঝে রয়েছে সে। চোখের পলক ফেলতে বেমালুম ভুলে গেল যেন৷ একটু হলেই সব শেষ হয়ে যেত৷ গাড়িটা তার উপর দিয়েই চলে যেত। ভাবতেই শরীরে কা’টা দিয়ে উঠছে৷ তার উপর গিয়ে পড়েছে প্রলয়৷ ভূমিকে বাঁচাতে গিয়ে হাতে ব্যথা পেয়েছে। সাদা রঙা গাড়িটা এখানে নেই। প্রলয় গাড়ির নাম্বারটা দেখে রেখেছে৷ একটুর জন্য ভূমি আজ বেঁচে গেল। ভাগ্যিস সময় মতো প্রলয় চলে এসেছিল। হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা থেকেই রাগটা তড়তড় করে মাথায় চড়ে বসল। সর্বস্ব শক্তি দিয়ে ভূমি গালে চড় মে’রে বসল প্রলয়। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি মেয়েটাকে মে’রে ফেলতে। একটুর জন্য প্রলয়ের প্রাণপাখি উড়াল দিচ্ছিল। চড় খেয়েও ভূমির কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। বাঁ গালটা ব্যথায় টনটন করছে৷ প্রলয়ের মতো কাটখোট্টা লোকের হাতে চড় খেয়েও থম মে’রে বসে রয়েছে ভূমি। কেমন স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছে! হয়তো আতঙ্কটা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারছে না৷ একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে‚ অশ্রুপ্লাবিত গভীর নেত্র যুগলে। লোকটা কী কাঁদছে? কিন্তু কাঁদার মতো তো কিছু ঘটেনি৷ চড়ের চেয়েও প্রলয়ের অশ্রুপ্লুত রক্তিম চোখ জোড়া তাকে বড্ড কষ্ট দিচ্ছে৷ রাস্তার কিনারায় গুটি কয়েক মানুষ জড়ো হয়েছে৷ লোকসমাগম ছিল না বিধায় ভীড় জমেনি। প্রলয় সকলের উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল। প্রলয়ের দিক থেকে এমন রাগারাগি দেখে মানুষজন চলে যেতে শুরু করল। ভূমিকে কোলে তুলে গাড়িতে বসাল প্রলয়। একটা কথা পর্যন্ত বলল না লোকটা৷ নীরবে অশ্রুপাত করছে ভূমি। প্রলয় তার সঙ্গে কথা বলছে না ব্যাপারটা তাকে বড্ড পীড়া দিচ্ছে৷ কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। প্রলয়ের হাত থেকে র’ক্ত ঝড়ছে৷ কম্পিত হস্তে প্রলয়ের হাতখানা নিজের হাতে নিয়ে বলল‚
“আপনার হাত থেকে তো র’ক্ত ঝড়ছে।”
তাতেও কাজ হলো না। প্রলয় তো কথা বললই না উল্টো ঝামটা দিয়ে হাত সরিয়ে নিয়েছে৷ রাগে কপালের রগ ফুটে উঠেছে৷ এসি চলছে তবুও তড়তড় করে ঘামছে লোকটা। ভয়ে ভয়েই ভূমি প্রলয়ের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল। প্রলয়ের হাতটা আবারও ধরল৷ তখন লোকটার অশ্রুপ্লাবিত গভীর নেত্রে তাকিয়ে কষ্ট হচ্ছিল ভীষণ কিন্তু এখন এই লোকটাকে তার ভীষণ ভয় করছে। চোয়ালে শক্ত হয়ে রয়েছে প্রলয়ের৷ গাড়ির জানালা আটকে রাখা৷ ভূমি পুনরায় কিছু বলতে নেবে এরই মাঝে প্রলয় তার হাতটা নিজের বক্ষঃস্থলে চেপে রেখেছে৷ ভূমি উপলব্ধি করল‚ লোকটার হৃৎস্পন্দন প্রলয়ঙ্কারী ঝড় তুলছে। অল্প মুহূর্তেই কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে৷ এবার কিছুটা শান্ত কণ্ঠে প্রলয় বলল‚
“এতটা কেয়ারলেস কী করে হতে পারো তুমি? তোমাকে আমি বলেছিলাম না— গাড়ি থেকে নামবে না? কথা শুনলে না কেন?”
কণ্ঠস্বর কিছুটা খাদে নামিয়ে ভূমি বলল‚ “দুঃখিত! আমি আসলে বুঝতে পারিনি।”
“একটু হলেই আজ আমার জীবনটা এখানেই থেমে যেত! ভাবতেই নিজেকে ছন্নছাড়া লাগছে।”
প্রলয়ের কণ্ঠস্বর ভারী শোনাল। ভূমি তাকাল প্রলয়ের চোখের দিকে। লাল হয়ে রয়েছে গম্ভীর চোখ জোড়া৷ ভূমির হাতে শব্দ করে অধর ছোঁয়াল প্রলয়। নিজেকে স্বাভাবিক করতে বলল‚
“হাত কে’টে গিয়েছে‚ একটু ফু দিয়ে দাও।”
অন্যদিকে…
উচ্ছ্বসিত অর্পণ পার্সেলটা খুলছে৷ র্যাপিং করা হয়েছে৷ র্যাপিং কাগজটায় গোলাপ ফুল আর লাভ আঁকিবুঁকি করা৷ খুবই নিভৃতে খুলল অর্পণ। ভিডিও কলে রয়েছে ইরা৷ বসে বসে একপলকে দেখছে অর্পণকে৷ লোকটা খুবই শিথিলভাবে র্যাপিং খুলতে দেখে হাসি পেল। শব্দ করে হেসেও উঠল মেয়েটা৷ হাসতে হাসতেই বলল‚
“এমন ভাবে পার্সেল খুলছেন যেন‚ একটু এদিকসেদিক হলেই সব শেষ।”
“অ্যাই তুমি এখানে বো’মা টোমা রাখনি তো?”
“হ্যাঁ বো’মাই রেখেছি৷ কিছুক্ষণ পরেই আপনি ফুসসস।”
অর্পণ আবারও পার্সেল খোলায় মনোযোগী হলো। বক্সের ভেতর একটা ঘড়ি‚ পারফিউম‚ ওয়ালেট আর একটা টেডি৷ এগুলো দেখে তার চোক্ষু চড়কগাছ। মেয়েটার বাচ্চামোতে হাসিও পেল ভীষণ। একটা গোলাপও রয়েছে সাথে৷ ছোটো একটা চিরকুট৷
“এইযে ম্যাম? এগুলো কী হ্যাঁ? আপনি কী এখনো টিনএজার রয়েছেন?”
“কেন আপনার পছন্দ হয়নি?” একটু থেমে বলল‚ “পছন্দ না হলেও এগুলো আপনাকে ব্যাবহার করতেই হবে৷”
“সে নাহয় করলাম৷ তবে আমাকেও তো রিটার্ন গিফট দিতে হবে। কী দেওয়া যায়?”
“আপনি আমাকে গিফট দেবেন?”
“হ্যাঁ! রিটার্ন গিফট।”
“তাহলে চুমু দিন। একটা গাঢ় চুমু।”
ইরার কথায় কাশতে শুরু করল অর্পণ। মেয়েটা মাত্রাতিরিক্ত চঞ্চল। অনেকটা দুষ্টু প্রকৃতির। টেবিলের উপর থাকা পানিটা ঢকঢক করে পান করল। তবুও কাশি থামছে না তার৷ ইরা আবারও বলল‚
“কী এমন ভুল বললাম— এভাবে কাশছেন কেন?”
“কল রাখছি। আমার কাজ আছে।”
সন্ধ্যে বেলা…
পনেরো তারিখ থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। দম ফেলারও সময় নেই পূর্ণতা পুষ্পিতার। মেয়ে দুটো কত ভেবেছিল‚ ভাইয়ের রিসেপশনে/জন্মদিনে কত মজা করবে। কিন্তু তা আর হবে কোথায়? খাতাটা বন্ধ করে পুষ্পিতা হাই তুলল৷ ভরসন্ধে বেলা ঘুম আসছে তার৷ বই হাতে নিলেই ঘুম পায় তার৷ পুষ্পিতাকে একটা গাট্টা মে’রে পূর্ণতা বলল‚
“ঘুমচ্ছিস কেন? পড়! এখনো অনেক পড়া বাকি।”
“কোথায় ভাবলাম— চৌদ্দ তারিখ খুব মজা করব! তা আর হলো কোথায়? সরকার আমার সুখে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।”
পুষ্পিতার কথার প্রত্যুত্তর করল না পূর্ণতা৷ পুষ্পিতা আবারও বলল‚ “তুই আর কী বলবি? তুই তো এমনিতেই পড়াপাগল!”
রাতে…
দুপুরের ঘটা ঘটনাটা কাউকে জানায়নি প্রলয়। ভূমিকেও বারণ করে দিয়েছিল জানাতে৷ শুধু শুধু সবাইকে টেনশনে ফেলার কোনো মানেই হয় না৷ ব্যাপারটা সে নিজেই সামলে নিতে পারবে। এখন সবটাই বুঝতে পারছে প্রলয়৷ ছেলের এভাবে হাত কেটে যাওয়া নিয়ে এক বেলা চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলেছেন মাধুরী৷ ছেলের কিছু হলে সহ্য করতে পারেন না তিনি। ছোটো বেলায় একবার সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে চিবুকের অনেকটা অংশ কে’টে গিয়েছিল। তিনটে সেলাই লেগেছিল সেদিন। ছেলের এমন অবস্থায় কেঁদে কে’টে একশা করেছিলেন মাধুরী৷ মোর্শেদ শিকদার তো মাঝে মাঝেই উনাকে ক্ষ্যাপান। আজ ডান হাতে ব্যথা লাগায় প্রলয়কে মাধুরী খাইয়ে দিয়েছেন। খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই প্রলয় তার ঘরে চলে এলো৷ দুপুরের রাগটা এখনো কমেনি। কিন্তু রাগ ব্যক্ত করছে না কারো সামনে। এরই মাঝে হাত মুছতে মুছতে ঘরে প্রবেশ করল ভূমি। তাকে দেখা মাত্রই উঠে দাঁড়াল প্রলয়। বড়ো বড়ো পা ফেলে ভূমির সমীপে এগিয়ে গেল। প্রলয়কে এভাবে কাছে আসতে দেখে অবাক হয়েও হলো না। ভূমির সমীপে এলে সমস্ত রাগ মূর্ছা যায় প্রলয়ের৷ ভূমিকে নিজের কাছে টেনে এনে ঠাস করে দরজা আটকে দিল সে। স্বাভাবিক কণ্ঠেই ভূমিকে জিজ্ঞেস করল‚
“এতক্ষণ নিচে কী করছিলে?”
“এতক্ষণ কোথায়? একটু আগেই তো সবার খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হলো।”
“কিন্তু আমার যে মনে হলো— তুমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার থেকে পালাই পালাই কর।”
ভূমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। লোকটা কখন কী কথা কীভাবে বলে‚ মাঝে মাঝে তার বোধগম্য হয় না। ভূমির হাই তুলতে ইচ্ছে করছে৷ ঘুমও পাচ্ছে একটু আধটু৷ প্রলয় বুঝতে পেরে বলল‚
“তুমি শুয়ে পড়! আমার একজনকে কল করার আছে। আমি পাঁচ মিনিট পর আসছি।”
কথাটা বলেই বারান্দার দিকে চলে গেল প্রলয়। ভূমি বিছানা গুছিয়ে রাখল। এতকিছুর মাঝে চুল বাঁধেনি সে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত খোপা করা চুলগুলো খুলে ফেলল ভূমি৷ ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে কাঁকই তুলে নিল।
অন্যদিকে…
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ক্রমাগত মোবাইলে টাইপিং করছে প্রলয়৷ মেসেজ টাইপ করার সময় চোখ মুখ দিয়ে যেন আগুন ঝড়ছিল।
“কাজটা একদমই ঠিক করলেন না আপনি। আমার জানের দিকে হাত! এর শাস্তি তো এই সেহরিশ আরশান প্রলয় ঠিকই নেবে।”
একটু থেমে ঠোঁট উঁচিয়ে ‘চ’ শব্দ করল। এরপর আবারও লিখল‚ “সেহরিশ আরশান প্রলয় যে কারোর ঋণ রাখে না— মি. !”
মেসেজ পাঠিয়ে প্রলয় তার বিশ্বস্ত অনুচর রবিনকে কল করল। কল করার সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ হলো। অপরপ্রান্ত থেকে কিছু শোনা গেল না। প্রলয় নিজে থেকেই বলল‚
“একটা গাড়ির নাম্বার দিচ্ছি‚ গাড়িটা কে চালাচ্ছিল সেই খবরটা আমাকে নিয়ে দিবি। পারলে লোকটার একটা ছবি আমাকে পাঠাবি৷ সে লোকটাকে আমার চাই৷ অ্যাট এনি কস্ট।”
অনেকক্ষণ হয়ে গেল প্রলয় এখনো ঘরে আসছে না। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভূমি। অপেক্ষারত রমণী হতাশ হচ্ছে প্রলয় আসার অপেক্ষায়। লোকটা কী বুঝতে পারছে না— তার জন্য কেউ একজন অপেক্ষা করছে? না! আর অপেক্ষা যাচ্ছে না। পেছন ফেরার জন্য উদ্যত হওয়ার আগেই দরজা আটকানোর শব্দ কর্ণগোচর হলো। আয়নাতেই প্রলয়ের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল। ভূমি একটু নড়েচড়ে দাঁড়াতেই দোল খেল লম্বা বিনুনি। বারান্দা থেকে ফিরে ভূমিকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। তারমানে মেয়েটা এখনো ঘুমাইনি। প্রলয় একবার ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত বারোটা বাজতে চলল। মেয়েটা এখনো ঘুমাচ্ছে না। কিছু না বলেই বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসল প্রলয়। ভূমির মনে হলো লোকটা তার উপর রেগে আছে। রাগার যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি। বিকেলের কথাটা মনে পড়ে গেল। ভূমি কাচুমাচু হয়ে চলে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দেখেও না দেখার ভান করে বসে রইল প্রলয়। এমনিতে তো কথার ঝুলি নিয়ে বসে। প্রলয় আজ নিজে থেকে কথা বলছে না৷ লোকটা কী তার উপর মা’রাত্মক রেগে রয়েছে? প্রলয়ের চুপ থাকা সহ্য হচ্ছে না তার। ভূমি বোকা বোকা কণ্ঠে শুধাল‚
“আপনি কী আমার উপর এখনো রেগে আছেন?”
ফোনের দিক থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে প্রলয় বলল‚ “তোমার কী তাই মনে হচ্ছে?”
প্রলয়ের মুখোমুখি বসে জিজ্ঞেস করল‚ “কই বাড়ি ফেরার পর তো একটা কথাও বললেন না!”
একটু সোজা হয়ে বসে প্রলয় আবারও বলল‚ “একটু ব্যস্ত ছিলাম আমি। এখন তো কথা বলছি।”
পরক্ষণেই প্রলয়ের মনে পড়ল এত কিছুর মাঝে ভূমি কোথাও ব্যথা পেয়েছে কিনা জানা হলো না। ত্রস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল‚ “তখন রাস্তায় ছিটকে পড়েছিলে— কোথাও কী ব্যথা লেগে লেগেছিল?”
ভূমি দুই দিকে মাথা ঝাকিয়ে বলল‚ “উঁহু!”
মিথ্যে বলল ভূমি। কোমরে কিছুটা ব্যথা পেয়েছে কিন্তু প্রলয়কে জানাতে চাইছে না। পাছেই না লোকটা আবারও তার উপর রেগে যায়। বুকে দুহাত গুজে বসল প্রলয়৷ ভূমিকে বলল‚
“তখন তো আমি দেখলাম তুমি ঠিক মতো হাঁটতে পারছিলে না৷”
প্রলয় কখন দেখল জানা নেই তার৷ ধরা খেয়ে গেল যেন৷ আমতা আমতা করতে শুরু করল৷ প্রলয় আবারও বলল‚
“লাইট অফ করে এসো।”
প্রলয়ের কথা মতো ধীর গতিতে বিছানার অপর পাশে চলল। এরপর লাইট বন্ধ করে প্রলয়ের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল৷ কোমরের চিনচিনে ব্যথায় হাঁটতে একটু কষ্ট হয়েছে বটে। কামরায় নীলচে ঘুম বাতি জ্বলছে৷ ভূমিকে নিজের দিকে ফিরাল প্রলয়৷ আবছা আলোতেই ভূমির চোখে চোখ রাখল। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল‚
“কোথায় ব্যথা লেগেছে?”
আড়াল করতে ভূমি বলল‚ “ব্যথা নেই।”
কিন্তু প্রলয় যে নাছোড়বান্দা। সত্যিটা সে ভূমির মুখেই শুনতে চায়৷ গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল‚ “সত্যিটা শুনতে চাইছি আমি।”
এবার সত্যিটা বলতেই হলো‚ “কোমরে লেগেছিল।”
“তখন জিজ্ঞেস করলাম— বললে না কেন?”
ভূমি আমতা আমতা করে বলল‚ “যদি আপনি রেগে যান।”
“আমি কী তোমার উপর রাগ করি?”
“সেদিন রাতেও তো রেগে আমার উপর চেঁচিয়েছিলেন। আজ বিকেলেও তো চেঁচিয়েছেন।”
“তুমি বড্ড কেয়ারলেস ভূমি কন্যা।”
“কী করেছি আমি?”
“এখনো জিজ্ঞেস করছ— কী করেছ?”
“হুম!”
“তোমার যদি কিছু হয়ে যেত?”
অকপটে ভূমির জবাব এলো‚ “কী আর হত— ম’রে যেতাম!”
ভূমির গাল চেপে ধরল প্রলয়৷ কথাটা তার মোটেও পছন্দ হয়নি৷ প্রলয়ের স্পর্শ রুক্ষ৷ ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে এলেও অবজ্ঞা করল ভূমি৷ তাকে ছেড়ে দিয়ে প্রলয় মলম বের করল। কোমল স্পর্শে ভূমির কোমরে মলম লাগিয়ে দিতে শুরু করল৷ প্রলয়ের স্পর্শে হৃদয় ব্যাকুল হতে শুরু করেছে৷ কিছু বেহায়া অনুভূতি আটঘাট বেঁধে নেমেছে হৃদয় প্রাঙ্গণে। ভেতরটা কেঁপে উঠছে ক্রমশ। ভূমি ঠোঁট চেপে চোখ বন্ধ করে রেখেছে৷ আবছা আলোয় প্রলয় দেখল বিছানার চাদর খামচে ধরেছে মেয়েটা৷ মুখে ফুটে উঠল বাঁকা হাসি৷ অনুমতি ব্যতীত গ্রীবায় উষ্ণ অধর ছোঁয়াল প্রলয়। কেঁপে উঠল ভূমি৷ অবাক চোখে তাকাল৷ হুটহাট এই স্পর্শ গুলো হৃদয়ে প্রলয়ঙ্কারী ঝড় তুলছে৷ তীব্র জোয়ারে শরীর শিরশির করে উঠছে৷ ভূমির কানে ফিসফিসিয়ে বলল‚
“এভাবে তাকিয়ো না— প্রতিনিয়ত নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা দায় হয়ে পড়ছে।”
সকালে…
ঘুম থেকে উঠে ভূমিকে পাশে পেল না প্রলয়৷ মেয়েটা তার আগেই ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে৷ তাকে একবারও ডাকল না পর্যন্ত। মুখ ফুলিয়ে আবারও চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমনোর চেষ্টা করল৷ এখন উঠতে ইচ্ছে করছে না।
রান্নাঘরে ফিরোজার সঙ্গে কিছু কাজে হাত লাগাল৷ আধঘণ্টা পর ভূমি ঘরে এসে দেখল প্রলয় এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। মুখের উপর থেকে চাদর সরাল৷ কিন্তু একি? লোকটা কোথায়। এ তো কোলবালিশ। ভূমির ভাবনার মাঝেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো প্রলয়। এসেই ভূমিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল৷ মুখ ধোয়ার দরুন চুলও খানিকটা ভিজেছে৷ টপটপ পানি ঝড়ে পড়ছে ভূমির গ্রীবায়৷ প্রলয় ফিসফিসিয়ে বলল‚
“সকালে ডাকলে না কেন?”
“আপনি তো ঘুমচ্ছিলেন।”
“তাই বলে আমাকে ডাকবে না? একটু রোমান্টিক ভাবে আজ ঘুমটা ভাঙত।”
মুখ ভেংচি কাটল ভূমি৷ প্রলয় তা দেখল না। তাকে তাড়া দিতে শুরু করল ভূমি। খাবার টেবিলে হয়তো সবাই তাদের দুজনের জন্যই অপেক্ষা করছে। প্রলয়ের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল৷ ওয়ারড্রব থেকে প্রলয়ের জন্য টিশার্ট বের করে দিল ভূমি।
গোধূলি লগ্নে…
ধোয়া কাপড়চোপড় গুলো গুছিয়ে রাখছে। ভূমি দুপুরে ধুয়ে দিয়েছিল। বেশির ভাগই প্রলয়ের। ছেলেদের যে এত জামাকাপড় পাল্টাতে হয়‚ জানা ছিলনা ভূমির। প্রতিদিন চার পাঁচটা জামাকাপড় অনায়াসেই পাল্টে ফেলে। ভাজ করা কাপড়চোপড় গুলো ওয়ারড্রবের ড্রয়ার গুছিয়ে রাখল। এরই মাঝে পুষ্পিতা এসে বসলো তার সামনে। এই সময় ওদের তো পড়াশোনা করার কথা। হুট করে তাদের ঘরে কেন এসেছে জানার জন্য ভূমি শুধাল‚
“তুমি না পড়তে বসেছিলে?”
“ভাবিমণি আমার একটা আবদার ছিল। তুমি প্লিজ না করো না।”
“রায়বাঘিনী ননদিনীর আবার কী আবদার করতে ইচ্ছে হলো? অবশ্যই আমি তা পূরণ করার চেষ্টা করব।”
পুষ্পিতা ভুমির গাল টেনে উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল‚ “ইউ আর সো সুইট! লাভ ইউ ভাবিমণি।”
সশব্দে হেসে ভূমি শুধাল‚ “এবার বলবে তো কী আবদার?”
“আমার না খুব ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু মা কিছুতেই রান্নাঘরে যেতে দেবে না। আর না এগুলো খেতে দেবে। তুমি প্লিজ একটু বানিয়ে দেবে?”
পুষ্পিতার কথা শুনে হতাশ হলো ভুমি। সে যে ফুচকা বানাতে পারে না। এগুলো বানানো তো আম্মা শেখায়নি। শুষ্কবিমর্ষমুখে ভূমি বলল‚
“আমি তো ফুচকা বানাতে পারি না আপু। আর না কখনো বানিয়েছি তবে একবার দেখিয়ে দিলে চেষ্টা করব।”
“ভেলপুরি কিনে আনা হয়েছিল‚ তুমি শুধু একটু ভেজে দেবে। আর ফ্রিজে হয়তো ঘুগনি বানানো রয়েছে। সেদিন মাকে দেখলাম বানাতে। আর হ্যাঁ তেঁতুলের টকটা একটু বানিয়ে দেবে। ঝাল ঝাল করে বানাবে!”
ঘাড় কাত করে সায় জানাল ভূমি। পুষ্পিতা বলল‚ “তাহলে চলো আমি তোমার সাথে রান্নাঘরে যাচ্ছি।”
পুষ্পিতাকে থামিয়ে দিয়ে ভূমি বলল‚ “মা রাগ করবেন৷ তুমি গিয়ে পড়তে বস৷ আমি বানিয়ে এনে দিচ্ছি।”
জড়িয়ে ধরে পুষ্পিতা বলল‚ “থ্যাংক ইউ ভাবিমণি।”
অন্ধকার কামরায় একটা লোককে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। লোকটার কপাল ঠোঁট কে’টে র’ক্ত ঝরছে। দেখে মনে হচ্ছে তাকে বেধড়ক মারা হয়েছে। এরই মাঝে প্রবেশ করল এক চিলতে আলো। লোকটার চোখমুখ কুঁচকে এলো। সুঠাম আঁটসাঁট দীর্ঘ দেহাবয়ব দৃষ্টিগোচর হলো। তবে লোকটা চোখে কিছুটা ঝাপসা দেখল। প্রলয় সামনের চেয়ারে এসে বসল। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল‚
“তোকে কে বলেছিল‚ এভাবে গাড়ি চালাতে?”
লোকটা হাসতে হাসতে বলল‚ “কিছুতেই বলব না৷ আমার অপারগতা এটাই যে‚ তোর ধ্বংস আমি দেখতে পেলাম না৷ গাড়িটা আরও স্পিডে চালানোর উচিত ছিল৷ তোর বউকে মে’রে আমি ম’রেও শান্তি পেতাম।”
চোয়াল শক্ত হয়ে এলো৷ ঠোঁট উঁচিয়ে ‘চ’ উচ্চারিত হলো। প্রলয় সিংহের ন্যায় গর্জে উঠল। পুরো ঘরময় কেঁপে উঠল। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল লোকটার। কম্পিত কন্ঠে ক্ষমা চাইতে শুরু করল। প্রলয় তোয়াক্কা করল না। বরঞ্চ সিংহের ন্যায় আবারও গর্জে উঠল।
“আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করলেও বেঁচে যেতে পারতি কিন্তু তুইতো আমার জানের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছিস। তোকে কে পাঠিয়েছে তা আমার জানার প্রয়োজন নেই! তোকে তো আমি তড়পাতে তড়পাতে মারব। কারণ তোকে বাঁচিয়ে রাখলে অন্যায় করা হবে। মৃ’ত্যু মোবারক।”
লোকটাকে ধাক্কা মে’রে ছোটো কামরা বিশিষ্ট খাচায় ঢুকিয়ে দিল৷ খাবারের লোভে কুমিরগুলো লোকটার কাছে ছুটে এলো। মুহূর্তেই লোকটাকে ছিড়েখুঁড়ে খেতে শুরু করল৷ লোকটার তুমুল আর্তনাদ পৈশাচিক আনন্দ দিচ্ছে প্রলয়কে। তৃপ্তির হাসি হাসছে সে।
চলবে?…..
#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২০|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
সাঁঝক প্রহর নেমেছে অনেক আগেই৷ অদূরেই আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রলয়। পাখিরা যেমন নীড়ে ফিরে যায় ঠিক তেমনই তারও ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। আসার সময় ভূমিকে বলে এসেছিল‚ আজ বাড়িতে তাড়াতাড়িই ফিরবে। অনেকটা সময়ই তো হলো এভাবে চেয়ারের উপর পায়ে পা তুলে বসে রয়েছে। লোকটার মৃ’ত্যু ঘটার আগ অবধি‚ কামরা বিশিষ্ট খাঁচার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। লোকটার মৃ’ত্যু একদিক থেকে তাকে তৃপ্তি দিচ্ছে অন্যদিকে রাগ হচ্ছে ভীষণ। ইচ্ছে করছে প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ে সবকিছু তছনছ করে দিতে। এরই মাঝে রবিন এলো।
রবিন এসে সামনে দাঁড়াতেই প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚ “কাজ হয়েছে? এর সঙ্গে কে জড়িত— জানা গেছে কিছু?”
“হ্যাঁ ভাই আপনি যা ভেবেছিলেন সেটাই সত্যি হয়েছে।”
কথাটা বলেই খাঁচার দিকে তাকাল৷ পুরো ঘরটা এখন আলোকিত। সেই আলোয় খাঁচার ভেতরে র’ক্ত আর কিছু হাড়গোড় পড়ে রয়েছে। কুমির গুলো তৃপ্তি নিয়ে ঘুমচ্ছে। বেশ কিছুদিনের ক্ষুধার্ত ছিল এরা৷ খাবার পেয়ে আর অপেক্ষা করেনি৷ একদম ছিড়েখুঁড়ে খেয়েছে৷ তাচ্ছিল্য করে হেসে রবিন বলল‚
“দুনিয়া থেকে একটা ঝঞ্ঝাট কমেছে।”
রবিনের কথায় বাঁকা হাসল প্রলয়। মনে মনে অনেক হিসেব কষছে। বড়ো বড়ো পা ফেলে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। হাঁটার সঙ্গে সঙ্গে বলল‚
“হাড় গুলো সঠিক লোকের কাছে পার্সেল করে দিবি৷ আর কাগজে একটা লেখা কম্পিউটারে টাইপ করে দিবি৷”
“কী লিখতে হবে ভাই? আপনি বলেন আমি টাইপ করি।”
দাঁড়িয়ে পড়ল প্রলয়৷ গম্ভীর স্বরে বলল‚ “এটা জাস্ট ট্রায়াল— বাকিটা তোর উপর দিয়ে যাবে শু’য়োরের বাচ্চা।”
“আচ্ছা ভাই কাজ হয়ে যাবে৷ আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি যান।”
“এদিকটা সামলে নিস৷ আমি যাচ্ছি।”
অন্যদিকে…
রান্নাঘরে চুলোয় ঘুগনি গরম বসিয়েছে ভূমি৷ নিজের জন্য এক কাপ আদা দিয়ে রং চা করেছিল। চা পান করে মাথা ব্যথা এখন একটু কমেছে। দুপুরে ঘুম না হওয়ার দরুন মাথা ধরেছিল কিন্তু পুষ্পিতার বায়না ফেলতে পারল না সে। ঝটপট তেঁতুলের কাথ বের করে ফেলল। খুব বেশি পরিশ্রম করতে হলো না তাকে। শসা‚ পেঁয়াজ‚ কাঁচা মরিচ‚ ধনিয়া পাতা কুচি করে কে’টে দিয়েছে। পাঁচফোড়ন আর চিলি ফ্লেক্স আগে থেকেই ছিল। কুচি করে রাখা সবগুলো উপকরণ ঘুগনির সঙ্গে মিশিয়ে নিল। সাবিনা টিভি দেখছে। ভূমি তাকে রান্নাঘরে থাকতে দেয়নি‚ বলেছিল সে একাই সবটা পারবে। সাবিনা তাকে সাহায্য করার জন্য অনেকক্ষণ সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। ভূমির জোরাজুরিতে বৈঠকখানায় চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল ঘুগনিতে এই শসা‚ পেঁয়াজ‚ কাঁচা মরিচ‚ ধনিয়া পাতা মিশিয়ে নিতে। এগুলো কীভাবে বানাতে হয় ভুমির জানাই ছিল না! জানবে কী করে সে তো আর কোনদিন ফুচকা বানায়নি!
ফুচকা গুলো বেশ ফুলকো হয়েছে। একটা ট্রেতে তিনটে বাটি নিল। একটা বাটিতে টক‚ আরেকটা বাটিতে ঘুগনি আর আরেকটা বাটিতে ফুচকা গুলো ভেজে তুলে রাখল। দুটো চামচ আর মসলার ছোট বাটি রাখল এক কোণায়৷ এরপর ট্রে হাতে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বেশ কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে দোতালায় পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরে চলল। মেয়ে দুটো পড়াশোনায় ব্যস্ত। ফুচকা ট্রেটা নিয়ে গিয়ে বিছানার উপর রাখল। পড়াশোনা কিছু সময়ের জন্য স্থগিত। পুষ্পিতা খুশি হয়ে ভূমিকে জড়িয়ে ধরল। আদুরে সরে বলল‚
“তুমি কত সুইট ভাবিমণি। লাভ ইউ।”
পূর্ণতা জিজ্ঞেস করল‚ “অ্যাই পুষ্প! তুই কী ভাবিমণিকে ফুচকা বানাতে বলেছিলি?”
“তুই তো বানিয়ে দিবি না। মাও পারমিশন দেবে না আমাকে বানানোর জন্য। তাই আমি ভাবিমণিকে বলেছিলাম ফুচকার কথা।”
পূর্ণতা কিছুটা ধমকের স্বরে বলল‚ “তোর আক্কেল জ্ঞান কবে হবে? সেই বিকেল থেকে ভাবিমণির মাথা ব্যথা। আর তুই তাকে দিয়ে কাজ করালি?”
ব্যাপারটা একদমই বুঝতে পারিনি পুষ্পিতা। মাথা নিচু করে অপরাধীর ন্যায় বলল‚
“স্যরি ভাবিমণি! আমি বুঝতে পারিনি তোমার মাথা ব্যথা করছিল। শুধু শুধু তোমাকে খাটালাম।”
পুষ্পিতার গালে হাত রেখে ভূমি ক্ষীণ হেসে বলল‚
“তাতে কী? আমার মাথা ব্যথা এখন আর নেই। সেই কখন পালিয়েছে! তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। তোমাদের যা খেতে ইচ্ছে করবে আমাকে বলবে‚ আমি চেষ্টা করব বানিয়ে দিতে।”
“তুমি কত ভালো ভাবিমণি!”
“তোমরা দুজনও অনেক ভালো রায়বাঘিনী ননদিনী। তোমরা খেয়ে পড়তে বোসো। আমি একটু ঘরে যাচ্ছি।”
ভূমি চলে যেতে নিলে পুষ্পিতা তার হাত ধরে ফেলল। তাকে বিছানায় বসিয়ে বলল‚
“তোমাকে এখন যেতে দেওয়া যাবেনা। তুমিও আমাদের সঙ্গে খাবে।”
এই বলেই পুষ্পিতা একটা ফুচকা ভূমির মুখে পুরে দিল। ঝাল ঝাল ফুচকা গুলো খেতেও ভালোই হয়েছে। তৃপ্তির সঙ্গে খেল পূর্ণতা পুষ্পিতা। খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই ভূমি নিজেদের ঘরে চলে এলো। আসার সময় সাবিনাকে ডেকে বলল‚ পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘর থেকে ট্রেটা যেন নিয়ে যায়।
ইরা অর্পণের সঙ্গে এসেছে। তার আসার কথা ছিল সকালে। কিন্তু সকালে কলেজ থাকায় আর অর্পনের হসপিটালে ডিউটি থাকায় ইরাকে নিয়ে সবেই এসেছে। ইরাকে দেখে খুশি হয়ে গেলেন ফিরোজা। মেয়েটাকে ভীষণই পছন্দ হয়েছে উনার। মাধুরীরও বেশ পছন্দ হয়েছে ইরাকে। মনে মনে ভাবলেন‚ এমন একটা পরিবারের মেয়েকেই তো প্রলয়ের বউ হিসেবে তিনি চেয়েছিলেন। আফসোস হলেও কিছু করার নেই। বৈঠকখানায় এখন শুধু ফিরোজা‚ মাধুরী আর ইরা রয়েছে৷ সাবিনা রান্নাঘরে নাস্তা বানানোর বন্দোবস্ত করছে। অর্পণ তার ঘরে চলে গিয়েছে। সারাদিন ডিউটি করে সেও ভীষণ ক্লান্ত। ইরা জিজ্ঞেস করল‚
“আন্টি ভূমির ঘরটা কোথায়? আমি একটু ওর সঙ্গে দেখা করতে চাই।”
মাধুরী জিজ্ঞেস করলেন‚ “তুমি ভূমিকে চেন কী করে?“
নিচু স্বরে ইরা বলল‚ “আমরা তো একই গ্রামের। মহুয়া আন্টি আমাদের বাড়িতে…”
ইরাকে আর কিছু বলতে দিলেন না ফিরোজা। কথার মাঝেই আটকে দিলেন তিনি। মহুয়া যে ইরাদের বাড়িতে কাজ করেন সেটা যদি মাধুরী জানতে পান তাহলে আবারও আরেকটা অশান্তি শুরু হবে। সবে ভূমিকে মেনে নিতে শুরু করেছেন মাধুরী। ভূমির ঘরটা ইরাকে দেখিয়ে দিলেন ফিরোজা।
মাগরিবের নামায আদায় করে‚ বিছানায় একা বসে রয়েছে ভূমি। প্রলয় হয়তো চলে আসবে। বারবার ঘড়ির সময় দেখছে। লোকটা দুপুরে কিছু খেয়েছে কিনা জানা নেই! তখন ভেবেছিল‚ কাপড়চোপড় গুলো গুছিয়ে প্রলয়ের নাম্বারে একবার কল লাগাবে। কিন্তু তখন পুষ্পিতা ফুচকা খাওয়ার বায়না করায়‚ প্রলয়ের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। এরই মাঝে দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো।
“আসতে পারি?”
ঘরের দরজা চাপানো বিধায় কে এসেছে বুঝতে পারল না ভূমি। ঠিকঠাক হয়ে বসে অনুমতি দিল। অনুমতি পেয়ে ইরা ঘরের ভেতর প্রবেশ করল। ইরাকে দেখে খুশি এবং অবাক দুটোই হলো। খুশির মাত্রাটা একটু একটু করে বাড়তে শুরু করল। ভূমি মনে মনে ভাবল‚ ইরা বুঝি গ্রাম থেকেই এসেছে। হয়তো সঙ্গে করে তার আম্মাও এসেছে। কতদিন পর আম্মাকে চোখের সামনে দেখতে পাবে! ভাবতেই চিত্ত উচ্ছ্বসিত হলো। ইরাকে জিজ্ঞেস করল‚
“ইরা আপু কেমন আছ তুমি?
“আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোমাকে কতবার না বললাম— আমাকে আপু বলে ডাকবে না?”
হেসে উঠল ভূমি৷ ইরাকে বলল‚ “ভুলে যাই। কখন এলে তোমরা? আম্মা কোথায়? বড়োদের সঙ্গে কথা বলছি বুঝি?”
“তুমি ভুল বুঝছ! আমি ঢাকায় এসেছি আজ চারদিন হলো। হোস্টেলে থাকছি।”
ভূমির মনঃক্ষুণ্ণ হলো ভেবেছিল আম্মাও সঙ্গে এসেছেন। এতক্ষণের উচ্ছ্বসিত মনটা ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল। ইরা এসে ভূমির পাশে বসে বলল‚
“শুনলাম তোমাকে প্রলয় ভাইয়া ফোন কিনে দিয়েছে। কই আমাকে তো একবারও কল দিলে না! এখন তো যখন ইচ্ছে তখনই কল করে কথা বলতে পারো। ভুলেই গেছ আমাদেরকে!”
“সকালেও তো জেঠি মায়ের (ইরার মা) সঙ্গে কথা হলো। উনি তো কিছু জানালেন না!”
“মা হয়তো বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। আচ্ছা ওসব কথা বাদ‚ তুমি কেমন আছ? এখানে সব ঠিকঠাক তো? সবাই তোমাকে মেনে নিয়েছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ আপু। আমি খুব ভালো আছি। এ বাড়ির সবাই খুব ভালো।”
“কথাটা শুনে বেশ খুব ভালো লাগল।” একটু থেমে এরা আবার বলল‚ “ওয়েট— ওয়েট! তুমি আমাকে আবার আপু বলে ডাকছ?”
বোকা হেসে ভূমি বলল‚ “ভুলে গিয়েছিলাম।”
এরই মাঝে প্রলয় ঘরে এলো। তাকে দেখা মাত্রই উঠে দাঁড়াল ইরা। এভাবে দাঁড়িয়ে পড়ায় প্রলয় ত্রস্ত ভঙ্গিতে বলে উঠল‚
“উঠে পড়লে কেন? বোসো— কথা বল! খুব ক্লান্ত লাগছে আমার। ফ্রেশ হয়ে এসে কথা বলব।”
পকেট থেকে ওয়ালেট মোবাইল ফোন রেখে দিয়ে‚ হাত থেকে ঘড়ি খুলতে খুলতে ভূমিকে বলল‚ “আমার জামাকাপড় গুলো বের করে দাও।”
ভূমি বিছানা ছাড়ল। ব্যস্ত হয়ে ওয়ারড্রব থেকে টি-শার্ট আর ট্রাউজার বের করে প্রলয়ের হাতে দিল। সঙ্গে তোয়ালে এগিয়ে দিল। প্রলয় আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। খুব ক্লান্ত লাগছে তার। লম্বা সময় নিয়ে গোসল করবে। ঘরে এসি চালিয়ে রাখা অথচ ভ্যাপসা গরম লাগছে৷ যাওয়ার আগে ভূমিকে বলল তার জন্য এক প্লাস ঠান্ডা পানি এনে রাখতে। ভূমির সঙ্গে সঙ্গে ইরাও বেরিয়ে পড়ল৷ ইরাকে পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরে নিয়ে গেল। একা একা বোর হওয়ার থেকে‚ ওদের সঙ্গেই না হয় সময় কাটুক। ভূমি রান্না ঘরে চলে গেল। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করল। জগে পানি মিশিয়ে নিল। খুব বেশি ঠান্ডা রাখল না। গোসল করে আবার অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি খেলে প্রলয়ের সর্দি লেগে যেতে পারে। সঙ্গে করে জগ আর গ্লাস নিয়ে ঘরে ফিরে গেল। প্রলয় এখনো ওয়াশরুমে। ভূমি ডাকল না। বিছানা গুছিয়ে রাখল। লোকটাকে দেখে বড্ড ক্লান্ত মনে হচ্ছিল।
অম্বরে আলোর দেখা নেই। বাহ্যজগতে ঝিম ধরা অমানিশা। বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভূমি। প্রলয় এখনো গোসল করে বের হয়নি৷ ভূমি অনেকক্ষণ ধরেই প্রলয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল৷ ইরাকে পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরে বসিয়ে দিয়ে এসেছিল সে। রান্নাঘরেও কাজ রয়েছে কিন্তু ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে প্রলয় যদি তাকে দেখতে না পায় তাহলে চেঁচামেচি করতে পারে। তাইতো অপেক্ষা করছে এমপি মশাই কখন বের হবে! এরই মাঝে ওয়াশরুমের দরজা খোলার খটখট শব্দ কর্ণগোচর হলো। ভূমি বারান্দা থেকে প্রস্থান নিল। প্রলয় তার ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছে নিচ্ছে। ভূমি গিয়ে তার সামনে দাঁড়াল। প্রলয় তার হাতে থাকা তোয়ালেটা হাতে দিয়ে দিল। বিছানায় বসে ভূমিকে বলল‚
“চুলগুলো মুছে দাও।”
প্রলয়ের হাত থেকে তোয়ালেটা নিল ভূমি। কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়ে প্রলয়ের চুল মুছতে মুছতে বলল‚
“আপনাকে কতবার বলেছি— অসময়ে গোসল করবেন না। ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।”
“তাতে কী? বসে বসে বউয়ের সেবা পাব।”
প্রলয়ের চুলগুলো মুছিয়ে দিল ভূমি। কিছু উষ্ণ নিশ্বাস তার সর্বাঙ্গে বিচরণ করছে। নিঃশ্বাস যেন আটকে আসছে। প্রলয়ের সমীপে থাকলেই এমনটা হয়। লোকটার শরীর থেকে কী সুন্দর ঘ্রাণ আসছে। খুবই ভালো লাগে ভূমির। চুল মুছিয়ে দিয়ে প্রলয়ের কাছে থেকে সরে দাঁড়িয়ে ভূমি বলল‚ “পানি নিয়ে আসছি।”
বিছানার পাশের টেবিলের কাছে চলে গেল ভূমি। জগ থেকে পানি গ্লাসে ভরল। এরপর প্রলয়ের সামনে এসে গ্লাসটা ধরল৷ ভূমির কাছ থেকে গ্লাসটা নিল না প্রলয়। অবাক হলো ভূমি। প্রলয় নিজে থেকে বলল‚ “নিজেই খাইয়ে দাও।”
লোকটার কখন কী ইচ্ছে হয় বুঝে উঠতে পারে না ভূমি! পানিও খাইয়ে দিতে হয়? প্রলয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সে। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শব্দ করে হেসে উঠল প্রলয়৷ শ্যামসুন্দর লোকটার হাসি সুন্দর। মা’রাত্মক রকমের সুন্দর। মাঝে মাঝে পলক ফেলতে ইচ্ছে করে না৷ পাছেই না লোকটার সৌন্দর্য ফিকা হয়ে যায়। নিজের এমন ব্যবহারে খুবই অবাক হলো ভূমি। কেন এমন অদ্ভুত কথাবার্তা মাথায় ঘুরপাক খায়?
ভূমির নাক টেনে প্রলয় বলল‚ “তুমি কী একটা জিনিস খেয়াল করেছ?”
চোখ ছোটো ছোটো করে ভূমি জিজ্ঞেস করল‚ “কী?”
প্রলয় ফিসফিসিয়ে বলল‚ “তুমি প্রেমে পড়েছ ভূমি কন্যা।”
কাঁপা কাঁপা গলায় বলল‚ “প্রেম?”
“হুম— হুম!”
প্রলয়ের অধর কোণে হাসি ঝলমল করছে। ভূমি কথা কাটানোর জন্য বলল‚
“রান্নাঘরে আমার কাজ আছে৷ যাই আমি।”
চলে যেতে নিল ভূমি। পেছন থেকে প্রলয়ের কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হলো। প্রলয় বলছে‚ “এখন পালিয়ে যাচ্ছ— ব্যাপার না৷ তবে অনুভূতির তীব্র জোয়ারে ভাসবে তুমিও৷”
বড়ো বড়ো পা ফেলে বেরিয়ে গেল ভূমি। পানির গ্লাসটা বিছানার পাশের টেবিলের উপর রেখে‚ সটান হয়ে শুয়ে পড়ল প্রলয়। চোখ বন্ধ করে কোলবালিশ আঁকড়ে ধরেছে। মনে হচ্ছে যেন বউকেই জড়িয়ে ধরেছে।
ফিরোজা আয়োজন করে রান্না করছেন। দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ খুশি উনি। এত আনন্দের উৎস খুঁজে পেল না ভূমি। মাধুরীও সেখানেই রয়েছেন৷ ভূমি সেখানেই গেল। তাকে দেখা মাত্রই মুখ ঝামটা দিলেন মাধুরী। ভূমি বুঝল না হঠাৎ করে এমন ব্যবহারের কারণ। সে ফিরোজাকে জিজ্ঞেস করল‚
“চাচি মা আমি কোনো সাহায্য করব?”
টিপ্পনী কে’টে মাধুরী বললেন‚ “তোমার সাহায্যের কোনো প্রয়োজন নেই৷ ঘরেই বসে থাক তুমি। সারাদিন তো শুধু শুয়ে বসেই কাটাও৷ কোন কাজটা নিজে থেকে করেছ?”
মাধুরীর কথার আগামাথা কিছুই বুঝল না ভুমি। হঠাৎ করে কীইবা বা হলো যে তার সঙ্গে এমন রুক্ষ ব্যবহার করেছেন তিনি? ফিরোজা বললেন‚
“ভাবি ও তো সব কাজ নিজে থেকেই করতে চায়৷ এমনকি করেও৷”
বাজখাঁই কণ্ঠে মাধুরী বললেন‚ “আমার চোখ আছে। আমি দেখতে পাই।”
অবুঝকে বোঝানো যায় তবে যে সবকিছু বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে তাকে কী করে বোঝাবে? ফিরোজা কথা কাটানোর জন্য বললেন‚ “প্লেট গুলোকে ডাইনিং টেবিলের উপর রেখে এসো ভূমি।”
“আচ্ছা চাচি মা।”
অন্যদিকে…
পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরে অনেকক্ষণ যাবৎ বসে ছিল ইরা৷ মেয়ে দুটো আবারও পড়তে বসবে এখন। তাদেরকে বিরক্ত করা মোটেও ঠিক হবে না। তাই তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে ইরা। এর চেয়ে বরং নিচে বৈঠকখানায় বসে থাকা ভালো। অর্পণের ঘরের দরজা তখন খোলাই ছিল। ইরা সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। অর্পণকে দেখে সশব্দে হেসে উঠল সে। লুঙ্গি পরিহিত অর্পণ ফ্যালফ্যাল করে ইরার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সকালে হসপিটালে যাওয়ার সময় বাইকের সঙ্গে লেগে পায়ে কিছুটা ব্যথা পেয়েছিল। র’ক্তও বেরিয়েছিল খানিকটা। ট্রাউজার পড়লে ব্যথার জায়গায় আবারও ব্যথা লাগে। এদিকে হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হওয়ার উপক্রম ইরার। অর্পণ ত্রস্থব্যস্ত ভঙ্গিতে ইরাকে বলল‚
“এ কী তুমি আমার ঘরে কী করছ?”
হাসি থামিয়ে ইরা বলল‚ “এখানে না এলে আপনার এমন রূপের দেখা কোথায় মিলত তাসরিফ ইফরাদ অর্পণ।”
দরজা দেখিয়ে অর্পণ বলল‚ “বের হও এক্ষুনি আমার ঘর থেকে।”
বিছানায় আয়েশ করে বসে ইরা বলল‚ “যদি না যাই? এই এক মিনিট‚ এক মিনিট! আপনি আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।”
“চেষ্টা নয়! ডিরেক্টলি তোমাকে আমার ঘর থেকে তাড়াতেই চাইছি।”
“একবার পার্মানেন্ট ভাবে এসে নিই। তখন আপনার মজা বোঝাব।”
“তুমি মেয়েটা বড্ড ত্যাড়া৷”
“এ আর নতুন কী? আপনি কী যেন করছিলেন সেটাই করুন।”
“এখন কী আমি তোমার সামনে জামা পাল্টাব?”
“ওয়াশরুম আছে তো!”
“আচ্ছা নির্লজ্জ মেয়ে তো তুমি।”
“ধ্যাৎ! টিকতে দিলেন না আমাকে।”
অর্পণ এগিয়ে এসে ইরার হাত ধরে বলল‚ “এভাবে আমার ঘরে বসে থাকলে‚ বিষয়টা সবাই অন্য চোখে দেখবে। কেন বুঝতে পারছ না তুমি?”
“আচ্ছা— আচ্ছা! যাচ্ছি!”
ইরা চলে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল অর্পণ। মাকে ইরার কথা জানিয়েছে ঠিকই কিন্তু এভাবে দুজনকে একই ঘরে বসে থাকাটা ভালো দেখায় না। ইরা হয়তো কিছুটা রেগে রয়েছে তার উপর৷ কিন্তু তারও কিছু করার নেই। পড়নের আধ ভেজা টিশার্ট পালটে আরেকটা টিশার্ট বের করে পড়ে ফেলল৷
খাবার টেবিলে…
সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে৷ ভূমি আজ সকলের প্লেটে খাবার বেড়ে দিচ্ছে৷ সকলের বললে ভুল হবে৷ মাধুরী নিজের খাবার নিজেই বেড়ে নিয়েছেন৷ তখন থেকে অন্যরকম ব্যবহার করছেন ভূমির সঙ্গে। মেয়েটা মনে মনে ভাবছে‚ তার দিক থেকে না জানি কোন অন্যায় হয়েছে! যে কারণে মাধুরী তার সঙ্গে এমন করছেন৷ ব্যাপারটা আর কারো দৃষ্টিগোচর না হলেও ফিরোজা ঠিকই দেখলেন। খাওয়ার একফাঁকে মোর্শেদ শিকদার বলে উঠলেন‚
“এই রাতের বেলায় তোমাকে আজ যেতে হবে না। আজ নাহয় আমাদের বাড়িতেই থেকে যাও।”
“তা হয় না আঙ্কেল। আমাকে একটু হোস্টেলে পৌঁছে দিলেই হবে।”
অর্পণ বলল‚ “ওদের হোস্টেলের নিয়ম বেশ কঠোর।”
মাধুরী বললেন‚ “তাহলে ওকে পৌঁছে দিয়ে আসিস। রাত হয়েছে তো।”
খাবার মুখে নিয়েই অর্পণ বলল‚ “হ্যাঁ জেঠিমা।”
ইরাকে উদ্দেশ্য করে ফিরোজা বললেন‚ “এখন তো বাড়ি চিনেছই৷ মাঝে মাঝেই আমাদের বাড়িতে চলে আসবে। কেমন?”
বিনিময়ে সৌজন্যমূলক হাসল ইরা। ভূমির তার পাতে আরও কিছুটা তরকারি দিল৷ কিছুটা তাড়াহুড়োর মাঝেই গোরুর গোশত রান্না করা হয়েছে৷ ফিরোজা নিজের হাতে রান্না করেছেন। ভূমি পূর্ণতাকে জিজ্ঞেস করল‚
“পূর্ণ আপু তোমাকে কী আরেকটু তরকারি দেব?”
“না ভাবিমণি। আমার পেট ভরে গিয়েছে৷”
ভূমি এবার পুষ্পিতাকেও একই কথা জিজ্ঞেস করল। পুষ্পিতার আরেকটু লাগবে। তাকে তরকারি দিল৷ প্রলয় তাকাল ভূমির দিকে৷ গম্ভীর স্বরে বলল‚
“তোমার কী খাওয়ার ইচ্ছে নেই?”
“আমি পরে…”
আর কিছু বলতে পারল না ভূমি। তার আগেই তাকে থামিয়ে প্রলয় বলল‚ “নো মোর ওয়ার্ডস৷ চুপচাপ খেতে বোসো।”
❑
খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই যে যার ঘরে চলে গিয়েছে। অর্পণ ইরাকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে আসতে গিয়েছে। মাধুরী সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন৷ এতক্ষণে হয়তো ঘরে চলে যেতেন কিন্তু ফিরোজা বললেন উনার কী যেন বলার আছে! তাই তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ফিরোজাকে বৈঠকখানায় আসতে দেখে মাধুরী জিজ্ঞেস করলেন‚ “কী যেন বলতে চাইছিলিস?”
কোনো রকমের ভণিতা ছাড়াই ফিরোজা বললেন‚ “ভূমির সঙ্গে এমন করে কথা বলছ কেন ভাবি?”
“কেমন করে কথা বললাম?”
“তোমার এমন ব্যবহারে মেয়েটা কষ্ট পায়। হয়তো প্রকাশ করে না তবে কষ্ট পায় তো৷”
একটু থেকে পুনর্বার ফিরোজা বললেন‚ “তুমি তো ওকে মেনেই নিয়েছ তাহলে হঠাৎ কী হলো তোমার?”
তাচ্ছিল্য করে হেসে মাধুরী বললেন‚ “মেনে নিয়েছি?”
অবাক হলেন ফিরোজা৷ মুখে বললেন‚ “হ্যাঁ!”
“মেনে নিইনি— মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি৷ ওই মেয়ের ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে এখনো অনেক সত্যিই অজানা রয়ে গিয়েছে৷”
তিমিরের ঢল নেমেছে। অন্তরিক্ষের অমা আজ কাটবে না বোধহয়৷ সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আরও ঘুটঘুটে রূপ ধারণ করেছে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে প্রলয়কে ঘরে দেখতে পেল না৷ দিব্যি ঘরের দুয়ার ভেতর থেকে আটকে রাখা। তার মানে প্রলয় বাহিরে কোথাও যায়নি৷ তাই সে বারান্দার দিকে অগ্রসর হলো। আরো উপস্থিতি অনুভূত হতেই সিগারেটের উষ্ণ ধোঁয়া বিলীন করে দিল প্রলয়। ভূমিকে দেখা মাত্রই হাত থেকে ফেলে দিল জ্বলন্ত সিগারেটটা। ভূমি এগিয়ে গিয়ে প্রলয়ের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল‚
“আপনি ধুমপান করেন?”
স্বাভাবিক কণ্ঠে প্রলয় বলল‚ “হ্যাঁ! মাঝে মাঝে ওই আরকি।”
“ধুমপান না করলে হয় না? আসলে এসবের গন্ধ আর ধোঁয়াতে আমার নিশ্বাস নিতে একটু সমস্যা হয়।”
পা দ্বারা জ্বলন্ত সিগারেট নিভিয়ে প্রলয় বলল‚ “আজ থেকে আর না।”
অল্পতেই খুশি হয়ে গেল ভূমি। লোকটা তার কথা শুনেছে৷ ভাবতেও ভালো লাগছে৷ ভূমি এবার জিজ্ঞেস করল‚ “আপনি ঘুমাবেন না?”
“ঘুম আসছে না৷ তুমি গিয়ে শুয়ে পড়।”
ভূমি গেল না৷ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই৷ প্রলয় চেয়ার ছাড়ল৷ ভূমির হাত ধরে ঘরে চলে এলো৷ বিছানায় বসিয়ে ঘরের লাইট নিভিয়ে ঘুম বাতি জ্বালিয়ে দিল৷ বিছানার ডানপাশে শুয়ে ভূমিকেও পাশে শুয়ে পড়তে বলল প্রলয়৷ ভূমি শুয়ে পড়তেই তার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল‚
“চোখ বন্ধ কর। আমি তোমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ঘুম চলে আসবে।”
প্রলয়ের কথামতো চোখ বন্ধ করল৷ ভূমির মাথাটা আলগোছে নিজের বক্ষঃস্থলে আগলে নিল প্রলয়৷ চোখ বন্ধ রেখেও ক্ষীণ হাসল ভূমি৷ আলতো হাতে চুলে বিলি কে’টে দিচ্ছে প্রলয়৷ ভালো লাগছে ভূমির। ঘুমও পাচ্ছে তার। এভাবেই সময় গড়াতে শুরু করল। একপর্যায়ে কখন যে‚ ভূমি ঘুমিয়ে পড়েছে সেটা ইয়ত্তার বাহিরে।
অন্যদিকে…
এখনো লুঙ্গি পড়ে রয়েছে অর্পণ। গরমকালে লুঙ্গি পড়ার উপকারিতা অনেক৷ তখন খাবার টেবিলেও সে লুঙ্গি পড়েই গিয়েছিল। তাকে এভাবে দেখে খুব হেসেছিল পূর্ণতা‚ পুষ্পিতা আর ইরা৷ দেখে মনে হচ্ছিল‚ জোকার কোনো মজার জোকস বলেছে৷ আর তারা ফ্রিতে মজা লুটছে৷ বাকি সদস্যরাও মিটিমিটি হাসছিল৷ অর্পন কখনো লুঙ্গি পড়েনি। তারউপর লুঙ্গিতে গিঁট না দিয়ে বেল্ট লাগিয়েছিল। তাইতো তাকে দেখে সকলে শব্দ করে হেসেছিল। একমাত্র ভূমিই কোনো রকমের প্রতিক্রিয়া করেনি। মেয়েটাকে প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই শান্ত মনে হয়৷ আগ বাড়িয়ে সহজে কোনো কথা বলে না। কথা থাকলেও কিছু বাক্যের মাঝেই শেষ করার চেষ্টা করে৷ বিছানায় শুয়ে থেকেই ইরার নাম্বারে কল লাগাল অর্পণ। রিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কল রিসিভ হলো। ইরা বোধহয় তারই অপেক্ষা করছিল। অর্পণ ফোন কানে নিয়ে জিজ্ঞেস করল‚
“কী মেডাম— ফোন হাতে নিয়ে বসে ছিলেন নাকি?”
“অপেক্ষা করছিলাম কখন আপনি বিরক্ত করবেন!”
“আমি বুঝি তোমাকে বিরক্ত করি?”
“এই যে এত রাতে একটা মেয়েকে কল দিয়েছেন‚ এটাকে বুঝি বিরক্ত করা বলে না? অবশ্য আমি বিরক্ত হচ্ছি না।”
“ওহ আচ্ছা! ওসব কথা বাদ। তা হবু শ্বশুর বাড়ি কেমন লেগেছে?“
“চলার মতো।”
“তাহলে বেটার শশুর বাড়ি খোঁজা উচিত— নয় কী?”
“আমার এটাই চলবে!”
আরও অনেকক্ষণ দুজনের প্রেমালাপন চলল। সময় গড়িয়ে যেতে লাগল। একপর্যায়ে কানে ফোন রেখে ইরা ঘুমিয়ে পড়ল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মেয়েটার ভারী নিশ্বাস কর্ণগোচর হলো অর্পণের। কল কেটে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। এবার অন্তত ঘুমানোর প্রয়োজন। সকালে ডিউটি আছে। তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।
চলবে?…..