#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
“কতবার বলব আমি ভূমি নই— মৃত্তিকা!”
কথাটা বলতে বলতেই পা থেকে ঘুঙুর জোড়া খুলে ফেলল মৃত্তিকা। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। কোমড়ে গুজে রাখা শাড়ির আঁচলটা ছেড়ে দিয়ে‚ লম্বা বিনুনি কা’টার সাহায্যে উঁচু করে আটকে নিল। বাচ্চা গুলাকে ইশারায় চলে যেতে বলল। দমকা হাওয়ার গতিবেগ বাড়ছে। গাছের পাতাগুলো খিলখিলিয়ে হেসে উঠল যেন। লেকের পাশটায় এখন লোকসমাগম নেই বললেই চলে৷ মৃত্তিকা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে আবারও বলল‚
“প্লিজ ইউ ম্যে গো! আম টায়ার্ড নাউ।”
প্রলয় শুনল না৷ ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে গেল মৃত্তিকার সমীপে৷ সেই মৃগনয়না অক্ষিবিশেষ‚ গোলাপের পাপড়ি ন্যায় অধরোষ্ঠযুগল‚ গৌরবর্ণ রূপ— কী করে এতটা ভুল হতে পারে? আজ একবছর যাবৎ হন্তদন্ত হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। প্রেয়সীর দেখা তবে আজ মিলল। চিত্তচাঞ্চল্য হয়ে মৃত্তিকার হাত ধরে ফেলল। প্রলয়কে অধৈর্য আর ছটফটে লাগছে অনেকটা৷
“এতদিন তুমি কোথায় ছিলে? তুমি জানো আমি তোমাকে কোথায় কোথায় খুঁজে বেড়িয়েছি? আমাকে ছাড়া তুমি এতগুলো দিন কী করে থাকতে পারলে?”
নির্লিপ্ততায় ভঙ্গুর ধরল। প্রলয়ের হাতটা ঝাড়ে ফেলে দিল মৃত্তিকা৷ কড়া ভাবে শাসিয়ে বলল‚
“এ কী ধরনের অসভ্যতামি? আপনি বুঝি পরনারীর সঙ্গে এভাবেই কথা বলেন?”
স্তব্ধ হলো প্রলয়। পা দুটো টলে উঠল। মুহূর্তেই বহু চেনা মানুষটাকে অচেনা মনে হতে শুরু করল। তার ভূমি তো কখনোই এভাবে কথা বলত না! সে তো ছিল অত্যন্ত কোমলচিত্তের অধিকারিণী। কিন্তু এই রমণী সম্পূর্ণ বিপরীত। অত্যন্ত রুক্ষ আর উগ্র মেজাজের৷ প্রলয় নিজের ভুল বুঝতে পেরে— শুষ্কবিমর্ষমুখে বলল‚
“আম এক্সট্রিমলি স্যরি মিস মৃত্তিকা।”
হন হন করে সেখান থেকে প্রস্থান করল প্রলয়। এদিকে ভুরু যুগল কুঁচকে এলো দাঁড়িয়ে থাকা রমণীর। কিছুটা উঁকি দিয়ে প্রলয়ের চলে যাওয়া দেখল সে। লোকটা দ্রুত পায়ে প্রস্থান করছে। গাড়িও চালাচ্ছে খুব দ্রুত। মৃত্তিকা ঘুঙুর জোড়া ব্যাগের ভেতরে ভরে নিল৷ লেকটা তার বাড়ির অনেকটাই কাছে৷ এখানে সময় কাটাতে বেশ ভালো লাগে। আর একাকীত্বের সঙ্গী হিসেবে নাচ তো রয়েছেই। কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে কিছুক্ষণ আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাওটা ভাবতে শুরু করল।
কিছুক্ষণ আগে….
ছোটো মিউজিক বক্সে গান বাজছে৷ সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে নেচে যাচ্ছে‚ খয়েরী রঙা শাড়ি পরিহিত সুনয়না৷ শরীরের অঙ্গভঙ্গির তালের সঙ্গে দুলে উঠছে দীর্ঘ কৃষ্ণগুচ্ছ বিনুনি। প্রতিদিনকার মতো আজও মৃত্তিকা এখানে নাচ শেখাতে এসেছে৷ কিছু সময় অতিবাহিত হতেই হঠাৎ করে এক লোক এসে তাকে জাপ্টে ধরল। আকস্মিক ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল মৃত্তিকা৷ আশেপাশে খুব সংখ্যাল্প মানুষের আনাগোনা না থাকলেও বেশ অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হলো তাকে। বেচারি হতবাক হয়ে— চোখের পলক ফেলতেও বেমালুম ভুলে গেল। পৃথক বয়ঃপ্রাপ্তি বাচ্চাগুলো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখছে মৃত্তিকা এবং তাকে জড়িয়ে রাখা লোকটাকে৷
“এটা কী ধরনের আচরণ?”
মৃত্তিকার কথাতেও টনক নড়ল না লোকটার৷ একই ভাবে জাপ্টে ধরে রেখেছে তাকে। মৃত্তিকা আবারও বলল‚
“এক্সকিউজ মি! আই ফিল আনকম্ফোর্টেবল।”
এবার কিছুটা নড়েচড়ে উঠল দুজনে। মৃত্তিকাকে ছেড়ে দিল প্রলয়। একজোড়া রুক্ষ শীতল হাতের সাহায্য রমণীর সুশ্রী মুখখানা আদলে নিল। কণ্ঠনালি যেন আন্দোলন চলছে। তুমুল আন্দোলন। শুকনো ঢোক গিলল সে৷ অতিশয় কম্পিত পুরুষালি ভরাট কণ্ঠে ছোটো করে শুধাল‚
“এতদিন কোথায় ছিলে ভূমি?”
লোকটার কথার আগামাথা কিছুই বোধগম্য হলো না মৃত্তিকার। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল কিয়ৎকাল৷ বিরক্তবোধ তার চোখমুখে স্পষ্ট দৃশ্যমান।।
“হোয়াট ননসেন্স।”
দূরে সরে দাঁড়াল প্রলয়। মৃত্তিকার বাঁ হাত আলতোভাবে ধরে বলল‚ “ভূমি শেষ বার একটা সুযোগ দাও আমাকে। কথা দিচ্ছি— তোমার সব অভিমান ভেঙে দেব।”
“আমি ভুমি নই। হাত ছাড়ুন আমার।”
খানিকটা হাসল প্রলয়৷ অবিশ্বাস্য তার মুখাবয়ব। কণ্ঠস্বর কিয়দংশ খাদে নামিয়ে বলল‚ “তুমি আমার সঙ্গে মজা করছ— তাই না?”
পুরুষালি ভরাট কণ্ঠস্বর অস্বাভাবিক শোনাল। মৃত্তিকা পাল্টা জবাব দিল না৷ আলতোভাবে ধরে রাখা হাতটা ছেড়ে দিল প্রলয়। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে বলল‚
“প্লিজ ভূমি একবার বল— তুমি এসব মজা করে বলছ।”
বিরক্তবোধ এখন ক্রোধে পরিনত হয়েছে৷ মৃত্তিকা মৃদু চেঁচিয়ে বলল‚ “কতবার বলব আমি ভূমি নই— মৃত্তিকা!”
কালো রঙের গাড়িটা ঢুকছে মালঞ্চ নীড়ে৷ নিকুঞ্জকানন দোতলা বিশিষ্ট বাড়ির সামনে এসে বেশ জোরে ব্রেক করল। বড়ো বড়ো মেহগনি গাছের আড়াল থেকে সোনালি রোদ উঁকি দিচ্ছে। রোদের তপ্ততা তেমন নেই। অতিশয় মিষ্টত্ব তার ঝলকানি। গাড়িটা পার্কিং সাইডে রেখেই চাবিটা হাতে নিল৷ ক্ষিপ্রবেগে নেমেই ঠাস করে গাড়ির দরজা আটকে দিল প্রলয়। ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল সাবিনার। হাতে থাকা শুকনো কাপড়চোপড় গুলো দূর্বাঘাসের উপর পড়ল৷ এই মেয়ের এহেন কাজে বরাবরের ন্যায় আজও বিরক্ত হলো প্রলয়। অহেতুক এই মেয়ে তাকে ভয় পায়৷ সেই চার বছর আগে থেকেই। বিরক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে রাগও তুঙ্গে চড়ল তার৷ ক্রুদ্ধ ত্রস্ত কণ্ঠস্বর মুহূর্তেই অত্যন্ত তেজি হয়ে উঠল। ডান হাত দ্বারা চুটকি বাজিয়ে প্রলয় বলল‚
“ন্যাকামো বাদ দিয়ে যা সামনে থেকে— নয়তো এখানেই ঠুকে দেব।”
বিস্ময়ে অভিভূত হলো সাবিনা। তাড়াতাড়ি করে কাপড়চোপড় গুলো তুলে বাড়ির ভেতরের দিকে দৌঁড় লাগাল৷ বেচারি আর এমুখো হবে না। সামনে পড়লে বোধহয় অক্কা পাবে। পেছন পেছন প্রলয়ও গেল। সাদা শার্টটা ঘর্মাক্ত অবস্থায় শরীরের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে৷ বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে একমুহূর্ত দাঁড়াল না সে। হনহন করে নিজের কামরায় চলে গেল। এখন একটু একাকীত্ব প্রয়োজন। নিজেকে একটু একান্ত সময় দেওয়া প্রয়োজন৷ একঘেয়ে জীবনটা নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। কোনো কিছুতে মন বসে না। তবুও সকল কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। শ্রান্ত শরীরটা নরম গদির উপর পড়তেই চোখ দুটো মুদে এলো।
গোসল করে বের হলো প্রলয়৷ এখন রাত সাড়ে আটটা বেজেছে। সেই যে বিকেলে শুয়েছিল—উঠেছে কিছুক্ষণ হলো। ম্যাজম্যাজে শরীরটা গোসল করার সঙ্গে সঙ্গে চনমনে হয়ে উঠল। নীরবতায় আচ্ছাদিত কামরায় মেয়েলি কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি ভাসতে শুরু করল। “আপনাকে কতবার বলেছি— অসময়ে গোসল করবেন না।” আয়নার নিজের প্রতিবিম্ব লক্ষ করে প্রলয় একাই আওড়াল‚
“আমার বিশ্বাস তুমি মৃত্তিকা নও। যে করেই হোক মিথ্যের আবরণে ঢেকে রাখা সত্যিটাকে তো আমি জেনেই ছাড়ব।”
তোয়ালে দিয়ে চুল মুছছে প্রলয়। এমন সময় দুয়ারের ধারে এসে কেউ কড়া নাড়ল। প্রলয় সেভাবেই আয়নার দাঁড়িয়ে থেকে বলল‚
“দরজা খোলা আছে! ভেতরে এসো।”
পূর্ণতা ঘরের ভেতরে এসে প্রবেশ করল৷ প্রলয় ভুরু উঁচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল‚ ‘কী হয়েছ?’
“বড়ো ভাইয়া! মা তোমাকে ডাকছে?”
“তুই যা— আমি আসছি।”
মেয়েটা চলে যেতে নিলে‚ প্রলয় তাকে ডাকল। ভাইয়ের ডাকে থমকে দাঁড়াল পূর্ণতা৷ পেছন ফিরে তাকাল। প্রলয় স্বাভাবিক স্বরে জিজ্ঞেস করল‚
“অর্পণ এসেছে?”
পূর্ণতা ডানে বামে মাথা ঝাকাল অর্থাৎ ‘না’। প্রলয় আবারও বলল‚ “আসছি আমি।”
ওয়ারড্রবের ড্রয়ার খুলে ধূসর রঙা টিশার্ট গায়ে জড়াল৷ তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুলগুলো আলতো হাতে মুছে নিল প্রলয়৷ “ভেজা তোয়ালে একদম বিছানার উপর রাখবেন না।” আবারও সেই মেয়েলি কণ্ঠস্বরের কথাগুলো যেন এখনো কানে বাজছে। প্রলয় ভেজা তোয়ালেটা চেয়ারের উপর রেখে দিল। ভূমির কথা মনে পড়তেই মনটা বিষাদের নীলচে রঙে ছেয়ে গেল।
সিঁড়ি ভেঙে দোতলা থেকে নেমে এলো প্রলয়৷ মেহরাব শেখের পাশে অর্পণকে বসে থাকতে দেখে প্রলয় সেদিকটায় এগিয়ে গেল৷ পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে বলল‚
“পূর্ণ তুই না বললি অর্পণ আসেনি।”
পূর্ণতাকে কিছু বলতে না দিয়ে অর্পণ বলল‚ “আমি এক্ষুনিই এসেছি। হঠাৎ আমাকে কেন খুঁজছ ভাই?”
“তোর সাথে একটু দরকার আছে। এই নিয়ে পড়ে কথা হবে।”
অর্পণ ঘাড় বাকিয়ে সায় জানাল। প্রলয় গিয়ে বসল চেয়ার টেনে৷ সকলেই বসে অপেক্ষা করছিলেন তার জন্য। মাধুরী আর ফিরোজা মিলে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। প্রত্যেকটা খাবার আজ প্রলয়ের পছন্দসই। এত আয়োজনের মানে খুঁজে পেল না সে। নিজের মতো খেতে শুরু করল। খাওয়ার একপর্যায়ে মাধুরী আহ্লাদে গদগদ করে বললেন‚
“কাল আমি আর তোর চাচি মা মিলে মেয়ে দেখতে যাব। আশাকরি তোর কোনো আপত্তি নেই।”
নিজের মতো করে খেয়ে যাচ্ছে প্রলয়। খাওয়ার সময় কথা বলা তার মোটেও পছন্দ নয়। ছেলের কাছ থেকে মর্জিমাফিক উত্তর না পেয়ে মাধুরী আবারও বললেন‚
“তোকে যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়েছে নিজেকে সামলে নেওয়ার। আর আমাদেরও বয়স হচ্ছে।”
এবার মুখ খুলতেই হলো প্রলয়কে। অত্যন্ত শান্ত স্বরে বলল‚ “ভূমিকে ভুলে যাওয়ার জন্য সারাজীবনও যথেষ্ট নয়। আজন্মকাল ধরে আমি ওকেই ভালোবেসে যাব। ও-ই আমার শেষ ভালোবাসা।”
“ঐ চরিত্রহীনার নাম এ বাড়িতে আমি শুনতে চাই না। এই মেয়ে ম’রেও দেখছি শান্তি দেবে না।”
“প্লিজ মা এবার তুমি থাম। তোমাদের কথায় আমি ভূমিকে অবিশ্বাস করেছিলাম— যার শাস্তি আমি প্রত্যেকটা লহমায় পেয়েছি এবং পাচ্ছি৷”
“আমার আরও কাজ আছে তোর ফালতু কথা শোনার সময় বা বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। চুপচাপ খাবারটা শেষ কর।”
মায়ের কথার পিছে ক্রুদ্ধ ত্রস্ত কণ্ঠস্বরে প্রলয় বলল‚ “ভূমিকে আমার চাই— অ্যাট এনি কস্ট।”
প্রলয় হনহন করে তার ঘরে চলে গেল৷ ছেলে যে না খেয়ে উঠে গিয়েছে‚ তারপরও কোনো ভাবান্তর নেই মাধুরীর। বাকিরা সবাই খাওয়া ছেড়ে মা ছেলের কথপোকথন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল। মাধুরী উনার স্বামীর পাতে আরেকটু তরকারি তুলে দিয়ে বললেন‚
“কী হলো— খাওয়া ছেড়ে সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন?”
রজনী নেমেছে মেদিনীর বুকে। আকাশে চাঁদ নেই— গভীর অমাবস্যা। বাতাবরণ এখন স্বচ্ছ ও শীতল। শয়নকক্ষজুড়ে পিনপতন নীরবতা বিরাজমান। ফোনের ফ্ল্যাশলাইটের সাহায্য বই খুলে পড়ছে মৃত্তিকা৷ উপন্যাস পড়তে তার ভারী আনন্দ লাগে। আগে এই অভ্যেসটা ছিল না— ইদানীং নতুন করে যুক্ত হয়েছে। ওই তো অদূরে ল্যাম্পপোস্টের হরিদ্রাভ বাতির কাছটায় ঝিঁ ঝিঁ পোকার ঝাক বসেছে। ছোট্টো অলিন্দ থেকে একটু আধটু দেখা যাচ্ছে বৈকি৷ একটু উঁকি দিয়ে আরও আঁটসাঁট হয়ে মেঝেতে বসল৷ মেঝে এখন শীতল। মৃত্তিকা একবার জানালা দিয়ে শয়নকক্ষে উঁকি দিল। নিষুপ্তিতে আচ্ছাদিত তনুজা৷ স্বস্তির নিশ্বাসে অন্তঃকরণ উচ্ছ্বসিত হলো৷ সেই সাথে অধরোষ্ঠ যুগল প্রসারিত হলো তার৷
ঘুমের ঘোরে বিছানা হাতড়ে কাউকে পেলেন না তনুজা৷ গাঢ় ঘুমটা তখনই ভেঙে গেল। শয়নকক্ষে আবছা নীলচে আলোয় কিছুই দেখা যাচ্ছে না৷ কিছুটা সময় নিয়ে তিনি শোয়া থেকে উঠলেন। বয়স হয়েছে— হুটহাট কোনো কাজ করে ফেলতে পারেন না। সময় নিয়ে করতে হয়। তিনি দেখলেন ছোট্টো বারান্দা থেকে হরিদ্রাভ আলো আসছে৷ তিনি ভেবে নিলেন মৃত্তিকা সেখানেই রয়েছে। হলোও তাই। কিছুটা সময় নিয়ে ধীর পায়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। বারান্দায় এসে দেখলেন‚ মৃত্তিকা একটা মোটা উপন্যাসের বই নিয়ে বসে আছে৷ খুব নিভৃতে মেয়ের পাশে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসলেন তিনি৷ মনোনিবেশ ভগ্ন হলো মৃত্তিকার৷ পাশে তাকিয়ে যখন তার মামনিকে দেখল‚ তখন একটা হাসির রেখা মিলল অধর কোণে। তনুজা প্রাণ ভরে দেখলেন। মেয়ের এই হাসিটাই তো বাঁচতে শেখায়। তিনি বললেন‚
“রাত জাগলে তো শরীর খারাপ করবে।”
“ঘুম আসছিল না মামনি। তুমি কেন উঠতে গেলে? আমাকে ডাক দিলেই তো আমি ছুটে যেতাম।”
“মা গো তোকে একটা কথা বলি?”
তনুজার মুখপানে তাকাল মৃত্তিকা। মায়াময়ী মানবীর সুশ্রী পানে গভীর আকুলতা। মৃত্তিকা আশ্বাস দিয়ে বলল‚
“অবশ্যই বলবে।”
সাহস পেয়ে মনের কথাটা বলেই ফেললেন তনুজা। “আর কতদিন একা থাকবি? আমি কী আর চিরকাল বেঁচে থাকব রে মা?”
“মামনি তুমি এভাবে কথা বললে আমার কষ্ট হয়। কেন বোঝ না?”
“আমি শুধু তোর সুখ চাই। তোর একটা ছোট্টো সংসার হোক— সেটাই আমি চাই।”
“আমি যে কখনো সুখী হব না মামনি। এটাই আমার ভবিতব্য।”
“ভগবান আমাদের ভাগ্য কী রেখেছে সেটা আগে থেকে জানার সাধ্যি কার আছে?”
“তোমার ভগবানকে বলে দিয়ো— বিষাদে মোড়ানো জীবন নিয়েই আমি সুখে আছি। আর আমি তো একা নই‚ তুমি আছ আমার সঙ্গে।”
তপ্ত নিশ্বাস ফেললেন তনুজা। মেয়ের কথার মর্মার্থ ধরতে খুব বেশি সময় লাগল না উনার৷ মৃত্তিকাকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি।
সূর্যের তেজস্বী কিরন এসে পড়ছে কারুকাজে বেষ্টিত বিছানার উপর। গ্রীষ্মকালীন সূর্যের কঠোরতা সকাল থেকেই শুরু হয়। সোনালি রোদের ঝলকানিতে সমগ্র ঘরময় খাঁ খাঁ উত্তপ্ত হচ্ছে৷ বিশাল বিছানার উপর উদোম গায়ে উবুড় হয়ে শুয়ে আছে প্রলয়। রোদটা তার পিঠে এসে ঠেকছে। তবুও ঘুম ভাঙছে না তার৷ রাতে বারকয়েক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়েছিল৷ অতিরিক্ত গরম সহ্য হয় না তার। ঘামছিলও প্রচুর— তাই তো গায়ে জড়িয়ে রাখা ধূসর রঙা টিশার্টটা খুলে রেখে দিয়েছিল বিছানার অপর পাশে। ভেজা তোয়ালেটা চেয়ারের উপর ঠিক সেভাবেই পড়ে রয়েছে৷ সবসময়কার অভ্যেস কী আর অত সহজে ছাড়ানো যায়? অকস্মাৎ কেউ এসে কড়া নাড়ল।
“বড়ো ভাইয়া তুমি কী এখনো ঘুমচ্ছ?”
তবুও ঘুম ভাঙল না প্রলয়ের৷ একই ভঙ্গিতে উবুড় হয়ে গভীর নিদে আচ্ছাদিত। বেলা প্রায় অনেক হয়েছে৷ ছোটো বেলা থেকেই প্রলয় বড্ড ঘুমকাতুরে। পুষ্পিতা আবারও তার ভাইকে ডাকল৷ কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না ঘরের ভেতর থেকে। ব্যর্থ কিশোরী চলে যেতে নিল। অর্পণ এদিকেই আসছে৷
“ভাই ওঠেনি এখনো?”
পুষ্পিতা দুদিকে মাথা ঝাকিয়ে বলল‚ “উঁহু!”
“তুই যা— আমি ভাইকে ডাকছি।”
পুষ্পিতা চলে যেতেই অর্পণ দরজা ধাক্কাতে শুরু করল। সেই সঙ্গে কয়েকবার ডাকলও৷ প্রলয়ের হয়তো ঘুম ভেঙেছে। দরজায় খট করে শব্দ শুনতে পেল অর্পণ। এতক্ষণ নিচের দিকে মুখ করে ছিল। আওয়াজ পেয়ে দরজার দিকে মুখ তুলল। হ্যাঁ— ঠিকই ধরেছে। প্রলয়ের ঘুম ভেঙেছে৷ দরজাটা খুলে দিয়ে আবারও বিছানায় গিয়ে উবুড় হয়ে শুয়ে পড়ল প্রলয়। অর্পণ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। মেঝেতে লুটোপুটি খাওয়া কোলবালিশটা বিছানার উপর রেখে বলল‚
“ভাই মাত্রই খবর এলো পার্টি অফিসে বিরোধী দলের ছেলেরা গ্যাঞ্জাম করছে।”
চিত হয়ে বালিশে কনুই ঠেকাল প্রলয়। ফোলা আধবোজা চোখে অর্পণকে একবার দেখল৷ ঘুমু ঘুমু ভারী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল‚
“কী নিয়ে?”
“রবিন আর শিহাবের সঙ্গে কী নিয়ে যেন কথা কাটাকাটি হয়েছিল। ঝামেলা এতটাই বেড়েছিল যে‚ ওরা মা’রামা’রি পর্যন্ত করেছে।”
ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে প্রলয় বলল‚ “তো আমি কী করতে পারি?”
বোকা বনে গেল অর্পণ। ভাবতেও পারেনি এই গুরুতর বিষয়ে প্রলয় এমন প্রত্যুত্তর করবে। ফ্যালফ্যাল করে বেশ অনেকটা সময় চেয়ে রইল অর্পণ। উঠে বসল প্রলয়। আধ ভেজা তোয়ালে ঘাড়ে ঝুলিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল৷ যাওয়ার আগে অর্পণকে বলল‚
“তুই আমার ফোনটা খোঁজ— আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি৷”
অর্পণ বিছানায় বসে হাফ ছাড়ল। কিয়ৎকাল বসে থেকে শুধুমাত্রই প্রলয়ের কথাই ভাবল। এই ছেলের মাঝে কী কখনো সিরিয়াসনেস আসবে না? মজায় মজায় সবকিছু উড়িয়ে দিতে নেই৷ তাই তো তার জীবনটা আজ এলোমেলো। তমসায় মরীচিকা হাতড়ে বেড়াচ্ছে— ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অর্পণের।
চলবে?…..