#লাবণ্যর_সংসার
#পর্ব_16
#কৃ_ষ্ণ_ক_লি
গাড়ি থেকে নেমে লাবণ্য এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাড়ির দিকে। আজ সকালেই ও এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো। আর কখনো এই বাড়িতে আসবে না এমন পণ করেছিলো হয়তো নিজের মনের অজান্তেই। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে ও কে আবার সেই ফিরে আসতেই হল। কি না নিজের স্ত্রীর অধিকার নিয়ে! ওর ভাগ্যটা এমন না হলেও পারতো!
এতোকিছুর ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ ওর মনে হয় ও হাওয়ায় ভাসছে , ও কে নিবিড় কোলে তুলে নিয়েছে। ও একপ্রকার চোখ গরম করে নিবিড়ের দিকে তাকায়। গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,,,
—“ এ,, একি আপনি আমায় কোলে তুললেন কেনো? ”
নিবিড় উচ্ছাসের সহিৎ বলে উঠে,,,
—“ তোমায় বাড়ির ভিতরে নিয়ে যাবো বলে। ”
—“ আমায় নামিয়ে দিন। আমার পা ভালো আছে নিবিড় সাহেব আমি হেঁটেই বাড়ির ভিতরে ঢুকতে পারবো। ”
নিবিড় মৃদু হেসে বললো,,
—“ এতোদিন তো আমিও জানতাম তোমার পা আছে। আর পা ছিলো বলেই তো আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিলে। কিন্তু গাড়ি থেকে নামার পরতো তুমি একদম মূর্তির মতোই হয়ে গেছো। তোমায় ডাকলাম , হাত ধরে টানলাম তুমি তো একটুও নড়লেও না চড়লেও না। তাই ভাবলাম তোমায় কোলেই তুলে নিই। ”
লাবণ্য নিবিড়ের কোল থেকে নামার জন্য ছটফট করতে থাকে। কিন্তু নিবিড় লাবণ্যকে নামায় না। শক্তকরে ধরে কোলে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ড্রয়িং রুমে নিয়ে আসে।
ড্রয়িং রুমে বসে থাকা মিজানুর সাহেব , আতীক সাহেব , রুমানিয়া বেগম ও শিউলি বেগম চিন্তিত হয়ে বসে আছেন।
ওদের দেখে শিউলি বেগম এগিয়ে আসেন। নিবিড় লাবণ্যকে কোল থেকে নামিয়ে দেয়। শিউলি বেগম একপ্রকার উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন,,,
—“ কি ব্যাপার নিবিড় বৌমা ঠিক আছে তো? ও কে তুই কোলে তুলে আনলি কেনো! ও কি কোথাও চোট পেয়েছে? ”
—“ না মা , তোমার বৌমা একদম চোট পায়নি। আসলে সারাদিন হাঁটার ফলে হয়তো পা ব্যাথা হয়ে গেছে! অবশ্য এটা আমার অনুমান। ”
—“ যাক আমি শুনে শান্তি পেলাম মা। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে অভ্র পৌঁছেছিল। তা নাহলে আমরা তো চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। ”
লাবণ্য নিবিড়ের বুকে ধাক্কা মেরে ও কে ইশারায় নামানোর কথা বলে। নিবিড় সামনে গুরুজনদের জন্যই বাধ্য হয়ে ও কে কোল থেকে নামিয়ে দিলো। লাবণ্য মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
শিউলি বেগম লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরে। লাবণ্যর হাত ধরে বলে,,,
—“ এ তুমি আমাদের কি শাস্তি দিচ্ছিলে মা? তুমি নিজের অধিকার ছেড়ো চলে যাচ্ছিলে সামান্য একজন মেয়ের জন্য। মা বিয়েটা যে কোনও ছেলে খেলা নয় গো মা। ”
রুমানিয়া বেগম লাবণ্যর কাছে এসে লাবণ্যকে ধরে এনে সোফায় বসিয়ে দেয়।
—“ তুমি কাজটা একদম ঠিক করো নি মা। দেখো মা আমরা তোমাদের গুরুজন। আমরা তোমাদের জন্য যা সিদ্ধান্ত নিই তা ভালোর জন্যই। আমরা চাইলেই মেঘলা আর নিবিড়ের বিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু মা সবকিছুর তো একটা নিয়ম থাকে। সবকিছু চাইলেই তো আর পাওয়া সম্ভব নয়।
মা তুমি নিজের আত্মসম্মানের জন্য চলে গিয়েছিলে। আমি সেটা কিছুটা হলেও বুঝেছি। দেখো মা বিয়েটা যখন হয়ে গেছে আর নিবিড় যখন চাইছে সবকিছু ঠিক করতে। তোমার সাথে সুখে সংসার করতে তাই বলি কি তুমি পুনরায় নতুন করে শুরু করো সবকিছু। ”
লাবণ্য ছলছল চোখে রুমানিয়া বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,,
—“ মেঘ.. মেঘলা.. ”
আতীক সাহেব সোফা ছেড়ে উঠে আসে লাবণ্যর সামনে। গম্ভীর গলায় বলে উঠে,,
—“ তোমায় আর মেঘলার চিন্তা না করলেও চলবে। শোনো লাবণ্য তুমি আমার ছেলের বৌমা। তোমায় আমি পছন্দ করে এই বাড়ির বউ করার জন্য এনেছি আমার ছেলের বউ করে।
এটা যখন আমার বাড়ি তাই এখানে আমার কথাই শেষ কথা। তুমি কাজটা একদম ঠিক করোনি। তুমি আজ যা কাজ করেছো আমার মাথা নত করে দিয়েছো। আমাকে অপমান করেছো। অসম্মান করেছো আমার। ”
মিজানুর সাহেব এবার ক্রুদ্ধ হয়ে লাবণ্যর উদ্দেশ্যে বললেন,,
—“ ছিহ্ তোকে আমার মেয়ে বলতেই ঘৃণা হচ্ছে। তুই এমন একটা কাজ করলি। আর তোর তো শ্বশুর বাড়ির লোকেদের পা ধোয়া পানি পান করা উচিৎ। উনারা কতো ভালো মানুষ তাই তোকে এখনো এখানে ঠাঁই দিচ্ছে। আমার সবচেয়ে বড়ো কষ্ট কি জানিস তোকে আমি ভালো শিক্ষা দিলে কি হবে তুই শিক্ষা নিতে পারিসনি। এমন জানলে জন্মের সময়েই তোকে গলা টিপে মেরে ফেলতাম। অসভ্য মেয়েছেল একটা। ”
মিজানুর সাহেব কথা শেষ করে কষিয়ে এক থাপ্পড় মারলেন। লাবণ্য গালে হাত দিয়ে ওর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। চিৎকার করে লাবণ্য ওর বাবাকে বলে উঠে,,,
—“ আমাকে মানুষ করতে পারোনি! সত্যি বাবা তুমি আমাকে মেরে দিলেই বরং ভালো হতো। আজ আমার এই অবস্থার জন্য তো দায়ী তুমি বাবা একমাত্র তুমিই দায়ী। ”
মিজানুর সাহেব চোখ রাঙিয়ে ধমকে উঠলেন লাবণ্যকে।
—“ চুপপপ.. করো বাবা। একদম ধমকাবে না আমায়। কি বলছো তুমি! বাবা আমার বিয়ে হয়ে গেছে। তাই আমার ওপর আর তোমার কেনোও অধিকার নেই , কোনও অধিকার। ”
লাবণ্য একছুটে নিজের রুমে চলে যায়। নিবিড় ওর পিছন পিছন ছুটে উঠে যায়।
মিজানুর সাহেব আতীক সাহেবকে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে গেলে আতীক সাহেব উনার হাত ধরে নেন।
—-“ আমি মানছি লাবণ্য আপনার মেয়ে। অবশ্যই আপনার ওর ওপর এখনো অধিকার আছে। কিন্তু আপনি ও কে যে থাপ্পড় টা আমাদের সামনে মারলেন অন্যায় করলেন। লাবণ্য আপনার মেয়ে তাই জন্য আপনাকে সবটা জানিয়ে শুধু আসতে বলেছি মাত্র , শাসন করতে বলিনি। লাবণ্য কোনও ভুল কাজ করেনি। আমার মতে ও যা করেছে ওর পক্ষে সেটাই ঠিক।
কিছু মনে করবেন না মিজানুর সাহেব। আপনি এবার আসতে পারেন। লাবণ্য এখন আমাদের বাড়ির বউ। আমরা আমাদের সমস্যা মিটিয়ে নিব।ভালো থাকবেন। ”
আতীক সাহেবের জোড় হাত করে বলা কথাগুলো শুনে মিজানুর সাহেব বেশ অপমানিত হন। তাই তিনি আর কোনও কথা না বাড়িয়ে মাথা নীচু করে চলে যান।
মিজানুর সাহেব চলে গেলে রুমানিয়া বেগম একপ্রকার ঝাঁঝিয়ে বলে উঠে,,,
—“ এই ভদ্রলোকটা এমন কেনো? আমরা তো ভেবেছিলাম উনি হয়তো লাবণ্যকে এটা নিয়ে বোঝাবেন। কিন্তু এ তো দেখি হিতে বিপরীত। এমন জানলে তো ওনাকে ডাকা তো দূর ওনাকে কিছু বলতাম না। ”
—“ তুই একদম ঠিক কথা বলেছিস রুমা। মেয়েটাকে সান্তনা না দিয়ে মারলেন। আরে উনি তো বাবা নামের কলঙ্ক। আচ্ছা চল আমরা লাবণ্যর কাছে যাই। এমনিতেই মেয়েটার কষ্টের শেষ নেই তার ওপর আবার বাবার খারাপ ব্যবহার। খুব ভেঙ্গে পড়েছে নিশ্চই।”
শিউলি বেগম ও রুমানিয়া বেগম লাবণ্যর কাছে যেতে চাইলে আতীক সাহেব মানা করেন। উনি বলেন,,,
—“ দেখো আমাদের আর ভয়ের কিছু নেই। লাবণ্য ফিরে এসেছে এটাই আমাদের খুশির খবর। আমরা কাল সকালে ওর সাথে কথা বলবো। এখন ওদের দুজনকে আলাদা কথা বলতে দাও। বেগম তুমি এক কাজ করো কোনও মেইড , না তুমি নিজে গিয়ে ওদের রাতের খাবারটা বরং রুমেই দিয়ে এসো। ”
লাবণ্য বালিশ খামছে ধরে কাঁদছে। নিবিড় ওর পাশে বসে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। মূলত ওর কান্না থামানোর চেষ্টা করছে।
—“ দেখো লাবণ্য তুমি যদি মেঘলা কথা ভেবে কাঁদো তাহলে বলবো কাঁদো , আমি কিছু বলবো না। কিন্তু তুমি যদি তোমার ওই জল্লাদ বাপের জন্য কাঁদো তাহলে বলবো বোকামি করছো। ওই তো তোমার সেই বাবা যার জন্য তুমি তোমার প্রেমটা সম্পূর্ণ করতে পারোনি। ”
নিবিড়ের কথায় লাবণ্যর কান্নাটা হালকা হয়। বিছানা থেকে উঠে বসে পড়ে। নিবিড় লাবণ্যর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে কপালে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরে।
—-“ লাবণ্য মেঘলা বলে আর কেউ নেই। তার কথা আর মনে রেখো না। সব ভুলে নতুন করে শুরু করো। আমিও চেষ্টা করছি তুমি সাহায্য করলে পুরোটা ভুলে যাবো। ”
চলবে… ..
(লেখায় কোনও ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন 🙏)