#শান্তি_সমাবেশ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৯
বাড়িতে এসেই মৃন্ময় হাওলাদার দেখলেন সোফাতে ঘুমিয়ে আছে তার পরী। তার একমাত্র রাজ্যের রাজকন্যা। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মেয়ের শিয়রের নিকট বসলেন। হাত বুলিয়ে দিলেন গালে পরপর কপালে। এই সময় তার এই ছোট্ট মৃত্তিকা ঘুমায় না। উঠে দাঁড়াতেই দেখলেন মিঠি’র মা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মৃন্ময় হাওলাদার আলতো হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
— কখন এসেছে ও?
— কিছুক্ষণ আগে। নাকে মুখে র*ক্ত ছিলো। এত জিজ্ঞেস করলাম বললো না। আপনাকে কল দিতে চাইলেও বাঁধা দিলো। পানি দিয়ে ধোয়ার পর আর তেমন র*ক্ত আসে নি।
— এসেছে র*ক্ত। তুমি খেয়াল করো নি মিঠি’র মা।
কথাটা বলেই আবারও মেয়ের কাছে এসে ঘুমন্ত মেয়েকে পাজা কোলে তুলে নিলেন। ঘুমকাতুরে মৃত্তিকা টের পেলো না কিছুই৷ নিজের রুমে নিয়ে আস্তে ধীরে বিছানায় শুয়িয়ে পাতলা কাপড় ভিজিয়ে এনে তা দিয়ে মেয়ের নাকের সামনে ও ভেতরে জমাট র*ক্ত মোছার চেষ্টা করলেন। পরে হয়তো অল্প র*ক্ত বেরিয়েছিলো তাই জমে আছে।
নিজে ফ্রেশ হয়ে এসে মেয়ের মাথার কাছে বসে চুলে হাত রাখলেন এবার৷ কপালে একটা চুমু খেয়ে এবার ডাকলেন,
— আম্মা আম্মা উঠুন। দেখুন বাবা কি এনেছি।
এপাশ ওপাশ করে মাথাটা বাবা’র কোলে তুলে দিলো মৃত্তিকা। ঘুম জড়ানো চোখ জোড়া খোলা যাচ্ছে না। বাবা’র ওর চুলে হাত বুলানিতে ঘুম যেন আরো বেশি আসছে। এবার দুষ্টমির স্বরে ডাকলেন মৃন্ময় হাওলাদার,
— আমার ছানা কি উঠবে না?
বাবা’র কোলে মুখ গুজতে গুজতে মৃত্তিকা বলে উঠলো,
— উঠবে হুলো বিড়াল।
চমৎকার হাসিটা শুনা গেলো বাবা’র। “হুলো বিড়াল” ডাকটা তার কাছে বেশ লাগে তাই তো মেয়েকে ক্ষ্যাপাতে “ছানা” ডাকেন।
বেশ কিছু সময় নিয়ে মৃত্তিকা উঠলো। ফ্রেশ হয়ে আসতেই বাবা নিজে চুলগুলো বেঁধে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন,
— নাকে কিভাবে র*ক্ত এলো আম্মা?
মৃত্তিকা’র যেন হঠাৎ কিছু মনে পরলো। বুকে তীব্র ব্যাথা অনুভব হলো। গলায় জমাট বাধলো অভিমানে ভরপুর কান্নাগুলো,
— ওনার জ্বর আব্বু।
— কার? পূর্ণ’র?
— হু। আমি কল দিলাম ধরে নি। দেখতে বাসায় যাওয়াতে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে।
বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠে মৃত্তিকা’র মন। ওর অবস্থান বাবা’র নিচে। বাবা বসা সোফাতে মৃত্তিকা নীচে। মেয়ের মাথাটা নিজের দিকে নিতেই হাত দিয়ে মুছে দিলেন ভেজা নেত্রপল্লব। চুমু খেলেন কপালে। গাঢ় কন্ঠে জানতে চাইলেন,
— দেখার আগে তাড়িয়ে দিয়েছে?
— না। দেখার পর।
— তাহলে তো আপনার উদ্দেশ্য সফল।
— মানে?
অবুঝ গলায় প্রশ্নটা বাবা’কে করলো। বাবা ওর চোখের ভেজা জায়গাটা আবারও মুছে দিয়ে বললেন,
— দেখতেই তো গিয়েছিলেন। দেখা শেষ তারপরই না চলে এলেন।
অভিমানি মৃত্তিকা উঠে গেলো। বাবা’র দিকে তাকিয়ে আঙুল দিয়ে নাকে ইশারা করে বললো,
— ওনার ধমক খেয়ে দৌড়ে আসতে গিয়ে নাক ফেটে গিয়েছে আমার। র*ক্ত ও এসেছিলো।
— কই দেখি দেখি।
এতক্ষণে বাবা’কে বিচলিত দেখে আহ্লাদী হয়ে উঠলো মৃত্তিকা। কোণ ঠেসে বসে পরলো বাবা’র পাশে। বাবা ওর নাক দেখার ভঙ্গি করে বললেন,
— ফাটে নি তো আম্মা।
— উফ ভালো করে দেখো। র*ক্ত বের হয়েছিলো।
মেয়ে’কে বুকে টেনে নিলেন মৃন্ময় হাওলাদার। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
— বাবা দেখিছি। আচ্ছা আম্মা আপনি তো পূর্ণ’কে অনেক ভালোবাসেন।
বাবা’র বুকে মুখ ঘঁষলো মৃত্তিকা। সরল গলায় বলে উঠলো,
— বাসি বাবা।
— আর আমাকে?
— ভালোলাগে না বাবা। আগেও বলেছি তুমি আমার কাছে তুল্যহীন। আমার সব তুমি আব্বু।
— আচ্ছা আর বলব না। আম্মা জীবন সঙ্গী হিসেবে কেমন মানুষ চান আপনি?
— তোমার মতো।
ঝট করে উত্তরটা দিয়ে ফেলে মৃত্তিকা। মেয়ের বাচ্চামিতে হাসেন তিনি। কপালে ওষ্ঠ ছুঁয়িয়ে শুধু মনে মনে বলেন,
— আমার মতো কেউ কখনো না আসুক আপনার জীবনে আম্মা।
.
পূর্ণ’কে হাজার বলে কয়েও রাজি করানো যাচ্ছে না। একে জ্বরে ওর ঢুলুমুলু অবস্থা এর মধ্যে করবে নাকি বিয়ে। ওর বাবা কিছু বললেই উল্টো কথা শুনিয়ে দেয়। ছেলে ভক্ত মা ও ছেলের কথায় একমত।
ওর মা অবশ্য এই বিয়েতে এত তারাতাড়ি রাজি হওয়ার কারণ ভিন্ন যা পূর্ণ এখনো জানে না। ওর বাবা জানে তার স্ত্রী’র মতলব। তাই বউয়ের দিকে তাকিয়ে একটু খোঁচা মে’রেই বললেন,
— ছেলে তোমার আসল মতলব জানলে…
কথাটা আর ভদ্রলোক সম্পূর্ণ করতে পারলেন না। পূর্ণ’র মা ঝাড়ি দিয়ে উঠলেন,
— একদম চুপ। তোমার খোঁচাখোঁচি বন্ধ রাখ আপাতত। বিয়ে হলে আমি বাঁচি আমার ছেলেও বাঁচে।
কথাটা বলে একটু মেজাজ ঠান্ডা করার চেষ্টা করলেন। রাজনীতি নামক জিনিসটা ভীষণ ভাবে ভয় পান তিনি। এই রাজনীতি তাকে কখনো কিছুই দেয় নি বরং রুর ভাবে কেঁড়ে নিয়েছেন তার সব। শেষ বেলায় বেঁচে থাকার সম্বল এই পূর্ণ এখন যদি ও হারিয়ে যায় তাহলে বাঁচা তার জন্য মুশকিল হয়ে যাবে। পূর্ণ’র বাবা বুঝলেন স্ত্রী’র মনোভাব। আলতো হাতে জড়িয়ে নিলেন নিজের সাথে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
— চিন্তা করো না।
— একটাই পূর্ণ আমার।
— বিয়ে করলেই ঠিক হয়ে যাবে এর কোন গ্যারান্টি আছে?
— হবে। আমি মৃত্তিকা’কে বলব যাতে ওকে বলে রাজনীতি ছেড়ে দিতে। পূর্ণ যে ওকে কতটা ভালোবাসে তা আমি ওর চোখে দেখি। আজ পর্যন্ত কখনো কোন মেয়ের জন্য এতটা ছটফট করতে দেখি নি ওকে।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পূর্ণ’র বাবা শুধালেন,
— তোমার ছেলে কি আর আমার মতো বউ পালগা হবে যে বউ বললেই সাধের রাজনীতি ছেড়ে দিবে?
হঠাৎ জ্বরে ভারি হওয়া গম্ভীর কণ্ঠে দরজা থেকে পূর্ণ ভেঙিয়ে বলে উঠলো,
— তুমি বউ পাগলা এটা সবাই জানে আব্বু। আর কত স্বীকার করবে? আর আম্মু তুমি আসলা আমার বউয়ের জন্য শাড়ী বের করতে এখন কি না জামাই এর সাথে রোম্যান্টিক মুহুর্ত পালন করছো?
ছেলেকে চোখ রাঙালেন পূর্ণ’র মা। পূর্ণ গা ছাড়া ভাব নিয়ে বাবা’র পাশে বসে কাঁধে মাথা এলিয়ে মা’কে বললো,
— আমার বউ এনে দাও আগে। এরপর যা খুশি করো।আমি বলার কে?
_________________
রাত তখন বেশি নয়। এই তো নয়টা হবে৷ মৃন্ময় হাওলাদার তখন ও টুকটাক কথা বলে যাচ্ছেন মেয়ের সাথে। তিনি খুব করেই চাইছেন পূর্ণ’র সাথে মৃত্তিকা’র বিয়েটা হোক। এমন না সে পূর্ণ’কে চেনেন না বরং ঠিক ঐ প্রথম দিন থেকে চিনেন যখন থেকে মৃত্তিকা ওর সাথে কথা বলত। মৃত্তিকা ও বাবা’র কাছে রোজ রোজ ওর কথা বলতো। তিনি সব দিক থেকেই পূর্ণ’র খোঁজ নিয়েছিলেন। খারাপ দিক পেলে ঠিক শুরু থেকেই মেয়েকে পূর্ণ’র পথ থেকে সরিয়ে আনতেন। অবাক তিনি সেদিন হন যেদিন পূর্ণ নিজে দেখা করতে গিয়ছিলো ওনার অফিসে। এখন প্রায় কথা হয়। ছেলেটাকে মনে ধরেছে ওনার। এমন একজন দৃঢ়, নিষ্ঠাবান, বিচক্ষণ ছেলের কাছে তার শেষ সম্বল, তার কলিজা তুলে দিতে চান তিনি। আগে পরে অনেক প্রস্তাব এসেছিলো মৃত্তিকার জন্য। কোনটাই ফিরিয়ে দেয়ার মতো না। তিনি যেমন বৃত্তশালী প্রস্তাব ও আসতোও ঠিক তেমন। পূর্ণ যখন প্রথম ওনার কাছে মৃত্তিকা’র জন্য প্রস্তাব রাখে সেটা ছিলো তার কাছে সস্তি৷ পূর্ণ সালাম জানিয়ে সোজা ভাবে বলে,
— আমার প্রতি অতিশয় দূর্বল মৃত্ত। ওনার এই দূর্বলতা আমাকে মুগ্ধ করে। আমার হাজার শাসন উনি গায়ে মাখেন না৷ যেখানে আমার ওনার পিছনে ঘুরার কথা সেখানে উনি আমার পেছনে ঘুরেন। এর মানে কি জানেনই তো।
— ভালোবাসা।
— জ্বি। কিন্তু আমি তাকে ভালোবাসি না।
উক্ত কথায় ভ্রু কুচকে আসে মৃন্ময় হাওলাদারের। সেটা লক্ষ্য করে পূর্ণ সরস গলায় বলে,
— ওনার প্রতি আমার অনুভূতি অঘোষিত। আমি জানি না এটাকে কি বলে। ভালোবাসা যদি তার কোনদিন শেষ হয়ে যায় সেদিন থেকে আমি আমার কঠিন খাঁচায় তাকে বেঁধে নিব। বলা যায় শুধু ভালোবাসা না তার প্রতি আবার তীব্র বাসনা রয়েছে যেটা আমৃত্যু বহন করে যাব আমি।
— তুমি কি জানো আমার এতো এতো সম্পত্তির খুব অল্প কিছু আম্মা পাবেন?
— আমার শুধু মৃত্ত লাগবে। দুইটা কোচিং সেন্টার চালাই। রাজনীতি থেকে ভালো আয় হয়। মৃত্ত’র চাওয়া পাওয়া কম। আশা করি আপনার দেয়া অতটুকু ও তার প্রয়োজন হবে না।
মুগ্ধ হয়েছিলেন মৃন্ময় হাওলাদার সেদিন। মৃত্তিকার জন্য যত সমন্ধ আসতো সবাই আসত টাকার জন্য। বিয়ের পর দেখা যায় এরা একাধিক রিলেশন, নারী লোভী অথবা বাসায় নেশা গস্থ হয়ে থাকা। এক কথায় বড়লোক বাপের বিগড়ানো সন্তান।
তিনি সবসময় চান সৎ পাত্র তার মেয়ে’র জন্য। যার সবগুলো গুণ খুৃঁজে পান পূর্ণ’র মাঝে। তাই কথা বাড়িয়েছিলেন। ঘটা করে যদিও পূর্ণ’র বাবা’র সাথে কথা হয় নি তবুও খোঁজ খবর নিয়েছেন আড়ালে। আত্মীয় বলতে তেমন কেউই নেই ওদের। ছোট বেলায় পূর্ণ বাবা-মা সহ কানাডা থেকেছে। জন্ম ও সেখানেই। যখন পূর্ণ ছোট তখন তারা বাংলাদেশে আসে এবং পরবর্তীতে ওর বাবা তাদের বর্তমান বাড়ীটা ক্রয় করেন। বাবা’র ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো। আগে কানাডায় জব করতেন বর্তমানে দেশে নিজেদের ব্যাবসা দিয়েছেন। ভাই-বোন নেই। ছোট একটা সুখী পরিবার। যেহেতু এক সন্তান তাই তার মেয়েকে আদরে রাখবে এটা তিনি নিশ্চিত। ঘটা করে কথা না হলেও অল্প কথা হয়েছে পূর্ণ’র বাবা’র সাথে। ভদ্রলোক প্রচুর শান্ত ও ভদ্র। পরিবার নিয়ে নিশ্চিত ওর বাবা।
একটু আগেই পূর্ণ’র বাবা কল দিয়েছে। পূর্ণ নাকি এখনই বিয়ে করবে। মৃত্তিকা’র বাবা শুধু মৃদু হেসেছেন। বলেছেন তার মেয়ে রাজি করাতে পারলে তার সমস্যা নেই।
কোন এক অজানা কারণে তিনি চাইছেন যতদ্রুত সম্ভব তার কলিজাটা’কে পূর্ণ’র হাতে তুলে দিতে।
হঠাৎ মৃত্তিকা বাবা’র কাঁধে ধাক্কা দিয়ে ফুৎ করে বুকে ঢুকলো। ওর বাবা মেয়ে’র সামনের কপালের চুলগুলো কানে গুজে দিয়ে বললেন,
— আম্মা খাবেন না?
— তুমি কি ভাবছো বাবা?
— আপনাকে আম্মা। আমার আম্মা কতটা বড় হয়ে গেলো। এই তো সেদিন আমার আঙুল ধরে হাঁটলেন। রাজকণ্যা আমার, বড় হয়েছেন আপনি। বাবা’র একমাত্র রাজ্যের রাজকন্যা’র এখন রাণী হওয়ার সময় এসেছে। কবে এতটা বড় হলেন আম্মা?
মৃত্তিকা অবুঝ চোখে বাবা’কে দেখলো। এর মানে কিছুই বুঝে নি ও। আজকাল মাঝেমধ্যে কিসব কথা বলে বাবা যার কিছুই ওর বোধগম্য হয় না। বুক থেকে মুখ তুলে সোজা হয়ে বসে বাবা’র লম্বা লম্বা আঙুলগুলো নিজের হাতের মুঠোয় পুরে চুমু খেলো। গালে লাগিয়ে আদুরে গলায় বললো,
— আমি সবসময় তোমার রাজ্যের রাজকন্যা থাকব আব্বু। তোমার আঙুল ছাড়ার মতো বড় এখনও হই নি আমি৷ এই যে তুমি এত এত আদর করে রাখ তাই তো এখনও বড় হতে পারলাম না৷ জানো উজ্জ্বল আর হিমু বাদে ভার্সিটির সবাই ক্ষ্যাপায় আমাকে আমি নাকি বাচ্চা বাচ্চা। আমার মন খারাপ হয় না কারণ আমি তো তোমার বাচ্চা। বলো বাবা?
— একদম। আমার ছানা।
গলা ধরে আসে মৃন্ময় হাওলাদারের। বহু কষ্টে এতটুকু উচ্চারণ করেছেন তিনি। বলতে না বলতেই কানে এলো,
— হুলো বিড়াল একটা।
হেসে ফেললেন তিনি। কলিং বেলের আওয়াজ পাওয়া মাত্র মিঠি’র মা খুলে দিলেন। তিনজন অপরিচিত মানুষ দেখে হাঁক ছেড়ে ডাকলেন মৃন্ময় হাওলাদারকে। উনি গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ করলেন,
— ভেতরে আসতে বলো মিঠি’র মা।
মৃত্তিকা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই পরপর তিনবার বিষম খাওয়ার উপক্রম। পূর্ণ সাদা পাঞ্জাবি’র উপর একটা শাল জড়িয়ে আছে। পরপর ওর বাবা এবং মা ও ডুকলো। পূর্ণ’র অবস্থা কিছুটা টালমাটাল। মৃত্তিকা’র দিকে ঐ জ্বরে কাবু হওয়া চোখ দিয়ে একপলক তাকানো যেন বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছে মৃত্তিকা’র। বাবা’র বাহু আঁকড়ে বসেই রইলো। একপলক মেয়ের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। এগিয়ে গিয়ে কোলাকুলি করলেন পূর্ণ’র বাবা’র সাথে।
তিনজনই সোফায় বসা। মৃদু শব্দে সালাম দিলো মৃত্তিকা। পূর্ণ’র মা এসে বসলেন মৃত্তিকা’র পাশে। অপলক তাকিয়ে রইলেন কিছুপল। পরপর হাসি মুখে হাত রাখলেন মৃত্তিকা’র থুতনিতে। মুখ ফুটে বলতে বাধ্য তিনি, “মাশা আল্লাহ”। খুঁত বলতে মেয়েটা শ্যামলা বাদবাকি যেন মায়াপরি একটা। ফুল মালঞ্চের ন্যায় ফুটফুটা একটা সুরত। অবশ্য খুঁত তার গায়ের রং ও না। এই আদলে এই রং মানিয়েছে বেশ। মৃন্ময় হাওলাদার দেখলেন পূর্ণ’র মায়ের চোখে তার মেয়ের জন্য মুগ্ধতা। সন্তুষ্ট তিনি।
মৃত্তিকা তখনও কিছু না বুঝে বাবা’র বাহু আঁকড়ে ঠাই বসে রইলো। পূর্ণ’র বাবা গলা খাঁকারি দিলেন,
— ভাই কাজি কি ডাকব?
মৃত্তিকা ফাঁটা চোখে তাকালো। ওর বাবা ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
— আমার আম্মা রাজি হলে ডাকুন।
একটু থেমে আবারও বললেন,
— আম্মা পূর্ণ আপনাকে বিয়ে করতে চায়। এজন্যই এসেছেন তারা। আপনি কি রাজি?
মৃত্তিকা’র বুক খলবলিয়ে উঠলো। পাগলা ঘোড়া’র ছুটতে লাগলো র*ক্ত সঞ্চালন। কিছুই তার বোধগম্য নয়। বাবা’র দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো। তখনই পূর্ণ’র মা মৃত্তিকা’র হাত মুঠো করে ধরলেন। অসহায় ও একবুক আশা নিয়ে বললেন,
— মা আমার ছেলেটা পাগল তোমার জন্য। আমার একটাই ছেলে। তোমাকে মেয়ে করতে চাইছি। অনুমতি আছে?
মৃত্তিকা’র একহাতে বাবা’র টিশার্ট খাঁমচে ধরা। বুকে ধুকপুকানি তখনও অস্বাভাবিক। কিছু বুঝার কায়দা পাচ্ছে না। শুনা গেলো পূর্ণ’র বাবা’র কন্ঠ,
— আম্মু তুমি কি ভয় পাচ্ছো বা নার্ভাস? আমি তোমার বাবা’র মতো। কথা বলতে কোন সঙ্কোচ নেই। তুমি রিলেক্স হও। ভয় পেও না।
— ভয় পাচ্ছি না। আব্বু আছে।
সেকেন্ডের ব্যাবধানে উত্তর দেয় মৃত্তিকা। ওর বাবা’র বুকে হঠাৎ ই যেন জোয়ার বয়ে গেলো। তার ভীতু কলিজাটা এতটা সাহসী উত্তর দিলো? বাবা’কে ঘিরে যার দুনিয়া তার এই ভরসাটা স্বাভাবিক।
ওর উত্তরে মৃদু হাসলেন পূর্ণ’র মা-বাবা। ভঙ্গি বুঝা গেলো না পূর্ণ’র। মৃত্তিকা মাথা তুলতেই নজর আটকালো। কেমন অসুস্থ চোখে তাকিয়ে আছে পূর্ণ। বুকটা যেন ধ্বক করে উঠে ওর। নজর নামিয়ে নিতেই পূর্ণ’র মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— মা সম্মতি দিবে না?
মৃত্তিকা বাবা’র হাতটা আরেকটু আঁকড়ে ধরলো। বেশ সোজা ভাবেই বললো,
— আমাকে মাফ করে দিন আন্টি।
ওর একটা ছোট্ট কথায় চার জোড়া চোখ ওর দিকে তাকালো। মৃদু স্বরে এতক্ষণে জড়ানো কন্ঠে পূর্ণ ডাকলো,
— মৃত্ত।
সর্বাঙ্গে যেন কাঁপন ধরলো মৃত্তিকা’র। এতটা দূর্বল কন্ঠ কেন পূর্ণ’র? জ্বরটা কি বেশি?
না নিজেকে ভেঙে পড়তে দিবে না মৃত্তিকা। অনেকটা অভিমান জমেছে তার বুকে। ছোট্ট চড়ুই সমান হৃদকুঠিড়িতে বাসা বেঁধেছে এক ঝাঁক অভিমান। ছোট ছোট অসংখ্য অভিমান তার মনে। পূর্ণ’র দিকে না তাকিয়েই মৃত্তিকা বাবা’র দিকে তাকিয়ে বললো,
— আমি রাজি না আব্বু।
ওর বাবা মেয়েকে বুঝাতে কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু পূর্ণ’র দিকে তাকিয়ে থামলেন। পূর্ণ অনুরোধের সুরে বললো,
— কথা বলতে চাই।
— আমি চাই না।
— একটা বার মৃত্ত?
— না।
অপেক্ষা করলো না মৃত্তিকা। পূর্ণ’র বাবা-মা’কে উদ্দেশ্য করে সালাম জানিয়েই চলে গেলো। পেছনে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো তিন জোরা চোখ। মৃন্ময় হাওলাদার ফাঁকা শ্বাস ত্যাগ করে বললেন,
— এতটা অভিমানি না ও। হয়তো আজ বেশি কষ্ট পেয়েছে।
পূর্ণ লাল হওয়া চোখে মাথা নামিয়ে নিলো। বুকে কষ্টটা এমন যেন কেউ খঞ্জড় চালিয়ে দিলো। কে চালালো এই অদৃশ্য খঞ্জড়? এতটুকু নমনীয়, ননী পুতুলটা কিভাবে চালালো তার পূর্ণ’র বুকে খঞ্জড়?
#চলবে…..