#শান্তি_সমাবেশ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২০
রুমের মধ্যে ঘাপটি দিয়ে বসে আছে মৃত্তিকা। একবার হাতে ফোন নিয়েও দুই মিনিট তাতে ঠিকঠাক মনোযোগ দিতে ব্যার্থ হয়ে আবার সেল বায়োলজি’র বইটা হাতে নিলো। এমনিতে ওর কাছে এটা বেশ সহজ লাগলেও আজকে চিত্র গুলো দেখেই মাথা ঘুরাতে চায়। খিটখিটে মেজাজে বইটাও পুণরায় টেবিলে স্থান পেলো। তবুও থামলো না মৃত্তিকা। উঠে দাঁড়িয়ে টইটই করলো সারারুম জুড়ে। এতেও যখন শান্তি পেলো না তখন কিছুটা বিরক্ত স্বরে বললো,
— আব্বু কেন আসে না। না হওয়া জামাই’কে কি জামাই আদর করছে?
ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে মিঠি। মূলত এতক্ষণ যাবৎ ওর কার্যক্রম লক্ষ্য করছিলো ও। এই মেয়ে এমন ছটফট করছে সেই ঘুরে ফিরে পূর্ণ’র জন্য অথচ চক্কা মে’রে অসুস্থ পূর্ণ’কে রিজেক্ট করে এসেছে। মিঠি হাতে থাকা কাজুবাদাম আবারও দুইটা মুখে দিয়ে রসিকতা করে বলে উঠলো,
— আপা এত ছটফট করার থেকে তো দুলাভাই’কে বিয়ে করা সহজ হতো। মাত্র তিন কবুল। বলো সহজ না?
মৃত্তিকা অগ্নি চোখে তাকিয়ে শাসানোর ভঙ্গিতে আঙুল নাচিয়ে বললো,
— একদম উল্টো পাল্টা প্যাচপ্যাচ করবি না। কে দুলাভাই হ্যাঁ?
— ঐ যে নিচে চাদরে পেঁচানো দুলাভাই। আমার কিন্তু তাকে দুলাভাই ডাকতে কোন সমস্যা নেই। পুরা নেতা নেতা ধাঁচের। আজকে চাঁদর পেঁচানিতে একদম নেতাদের সর্দার লাগছিলো।
পূর্ণ’র এত এত প্রশংসা হঠাৎ সহ্য হচ্ছে না মৃত্তিকার অথচ মিঠি’র এহেন মনোভাব ব্যক্ত স্বাভাবিক। মৃত্তিকা মিঠি’র নিকট আজ পর্যন্ত কত প্রশংসা যে ঐ পাষাণ পূর্ণ ভাইয়ের করেছে তার ইয়ত্তা নেই। কথাগুলো ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে ওর। আজ সময়টা তাদের ভিন্ন হতো। পূর্ণ’র এত এত অবহেলা ওকে টলাতে পারেনি কিন্তু আজকের ওমন ব্যাবহার কেন জানি মন মানতে চাইছে না। বারবার কোথাও একটা খুঁত খুঁত করে যাচ্ছে।
অবাক হওয়ার আরেকটা বিষটা তার বাবা৷ এতটা সহজে বাবা কিভাবে মেনে গেলো? মাত্র দুই বার সামনা সামনি দেখে কি এত বুঝা যায়? ওর অনুমতিহীন যেই বাবা টাই পড়ে না সে বিয়েতেও জোর করবে না এটা ও জানে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই রুমময় পায়চারি করে যাচ্ছে মৃত্তিকা। তখনই “আম্মা” ডাকটা কানে বাড়ি খায়। বাবা ডেকেছে ভাবতেই তারাতাড়ি ছুটন্ত পায়ে নীচে যায়। বাবা বাদে কেউ ই নেই। মৃত্তিকা গাল দুটো ফুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— এতক্ষণ কি করছিলে তুমি হু? কতক্ষণ অপেক্ষা করছি? খাব আমি। ক্ষুধা লেগেছে।
মৃন্ময় হাওলাদার বেশ বুঝলেন তার মেয়ের মনের অবস্থা। মেয়েটা বেশ করে চাইছে দূর্বল না হতে। তার মৃত্তিকা এমনই। শুধু যে নাম মাত্র মৃত্তিকা তা নয় বরং সে মাটির মতোই নরম। মৃন্ময় হাওলাদার নিজ হাতে গড়েছেন তাকে এমন নমনীয়তায় ও কোমলতায়। এগিয়ে এসে এক বাহুতে পুরে নিলেন মৃত্তিকা’র দেহটাকে। মাথায় আদর দিয়ে টেবিলে বসিয়েই মিঠি’র মা’কে ডাকলেন খাবার দিতে। ততক্ষণে মিঠি ও হাজির। মৃন্ময় হাওলাদার মিঠি’কেও বসতে বললেন। মিঠি বসেই হড়বড় করে বলতে লাগলো,
— মামা আপা কিন্তু এতক্ষণ রুম ভরে টইটই করছিলো।
— জানি।
ছোট স্বরে উত্তর দিলেন মৃন্ময় হাওলাদার। মৃত্তিকা কিছুটা রেগে গেলো,
— বেশি কথা বলিস মিঠি!
— আহা আম্মা রাগে না৷ আপনি আমার মৃত্তিকা। মাটি তো নমনীয় হয়, আপনি কিভাবে শক্ত হলেন?
বাবা’র এহেন কথার প্রেক্ষিতে চুপ রইলো মৃত্তিকা। ততক্ষণে মিঠি’র মা সব এনে সাজিয়েছে। মৃন্ময় হাওলাদার নিজেই মেয়েকে হাতে তুলে খাওয়াচ্ছেন। মাছের কাটা বাছতে বাছতে মিঠি’র উদ্দেশ্য বললেন,
— পড়াশোনা কেমন চলে?
— ভালো মামা।
এরপর ও টুকটাক কথা হলো। মৃন্ময় হাওলাদার দেখলেন। বুঝলেন মেয়ের অস্থিরতা। স্বাভাবিক স্বরে জানতে চাইলেন,
— পূর্ণ’কে নিয়ে চিন্তিত?
— অসুস্থ ছিলেন অনেক।
সহজ সরল স্বীকারোক্তি। মিঠি মিটমিট করে হাসছে। মৃন্ময় হাওলাদার ও মৃদু হাসলেন। খাওয়া শেষ তার তাই হাত ধুয়ে মেয়ের মুখ মুছে দিলেন ভেজা হাতে। মৃত্তিকা টিস্যু দিয়ে আগে নিজের মুখ মুছে ওটা দিয়ে বাবা’র ভেজা ঠোঁট ও মুছে দিলো। পানি খেতে খেতে মৃন্ময় হাওলাদার বললেন,
— আমি জানি আপনি কেন রাজি না আম্মা। আজকে পূর্ণ’র ব্যবহারে অনেক কষ্ট পেয়েছেন।
— কিছুটা তেমন বাবা। আমি প্রথম ওনাকে ভয় পেতাম। গুন্ডা আর খারাপ লোক ও ভাবতাম কিন্তু উনি ভিন্ন। কোন মেয়ে তো দূর এই যে আমি যখন তার প্রতি মুগ্ধ হয়ে তার পেছনে ঘুরতাম তখন চাইলেই তিনি ছুঁতে পারতেন অথচ অতি প্রয়োজন ব্যাতীত কখনো এমনটা হয় নি। তুমি বলেছিলে না কারো রাগের সময় তার ভেতরের রুপ দেখা যায়। আমি দেখা’র চেষ্টা করেছি বাবা। আমাকে হাজার রাগ দেখানো, ধমকানো যাই করুক না কেন সবটা উপর উপর থাকতো। তিনি ও ভালোবাসেন তাই তো অন্য কারো সাথে দেখলেই অতিমাত্রায় রেগে যান। তোমার মতো পসেসিভ আমাকে নিয়ে। তুমি শান্তি ও সে তুফান। এই পার্থক্য। কিন্তু আজকে তার রাগ করার কারণ কি বাবা? আমাকে ঠিক কুকুর তাড়ানোর মতো তাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। এখন আমার ও মনে হয় হি ইজ নট পারফেক্ট ফর মি বাবা।
“মৃত্তিকা” বাবা’র হাতে তৈরী বেশ নিখুঁত একটা নরম, কোমল চরিত্র কিন্তু বাবা তাকে মোটেও সব বিষয়ে শিক্ষা দিতে ভুলেন নি বরং আজ উপলব্ধি করলেন শিক্ষা তার যথার্থ হয়েছে। আলতো হাতে মেয়ের মাথাটা বুকে তুলে নিতেই সোফায় পা গুটিয়ে তুলে নিলো মৃত্তিকা। কষ্ট হচ্ছে তার অথচ একই সাথে অভিমান জমা হয়ে আছে পূর্ণ’র প্রতি।
মৃন্ময় হাওলাদার মেয়ে’র হাতে চুমু খেলেন। শান্ত স্বরেই বললেন,
— পূর্ণ’কে বেশ শক্ত ধাঁচের মনে করেছিলাম আমি আম্মা অথচ আজ ভিন্ন ভাবে দেখলাম। যখন আপনি না করলেন তখন তার চোখে ছিলো ভিন্ন কিছু। হারানোর ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া একজোড়া জ্বর কাতুর চোখ। কন্ঠে ছিলো আকুলতা শুধু মাত্র আপনার জন্য। যখন আপনি চলে এলেন আমার হাত ধরে বসে পরলো। দূর্বল হাতে যথেষ্ট চেষ্টা করলো আমাকে ধরে রাখার। অনুরোধের স্বরে শুধু আপনাকে বুঝাতে বললো কিন্তু আমি চাই সিদ্ধান্ত আপনার হোক। বিশ্বাস আমার আমি আমার রাজকন্যা’কে সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো যোগ্য ভাবে গড়ে তুলেছি।
— তার হয়ে সুপারিশ করবে না?
— একটু ও না। ঘুমাবেন। আসুন।
মৃত্তিকা’র বাবা মেয়েকে বিছানায় শুয়িয়ে মাথায় হাত বুলানোর প্রায় আধ ঘন্টা পরই মৃত্তিকা ঘুমিয়ে গেল। আলতো চুমু খেয়ে তিনি বের হন।
________________
রাত বেশি না। এই তো এগারোটা হবে। বাইরে হচ্ছে তীব্র বর্ষণ। এই অক্টোবর মাসে বৃষ্টি মানেই শীত আসতে চলেছে। বেশ ঠান্ডা প্রতিটি কণা। শরীর হীম হওয়ার মতো ঠান্ডা। রাস্তায় নিয়ন বাতি গুলো জ্বলে যাচ্ছে। সেই আলোতে দেখা যাচ্ছে এক মানব’কে। বলিষ্ঠ এক পুরুষ বসে আছে রাস্তার উঁচু জায়গাটায়। শরীরে চাদর পেচিয়ে ঠাই বসে থাকা এক যুবক। ভালোবাসায় প্রত্যাক্ষাণ পাওয়া এক ভঙ্গুর হৃদয়ের অধিকারী। জ্বরের শরীরে এখানে বসে ভিজছে পূর্ণ। শরীরে কাঁপন লেগে গিয়েছে এতক্ষণে। কে জানতো যেই পুরুষ প্রেম করবে না, প্রেমিক হবে না বলে মৃত্তিকা’কে ধমকাতো সেই পুরুষ আজ সবচেয়ে বড় প্রেমিকে রুপান্তরিত হয়েছে। প্রেমিকার দেখা পেতে বসে আছে ঠিক তার বাড়ীর বাইরে।
তখন বাবা-মা’কে বাড়ী পাঠিয়ে দিয়ে বাড়ী ফেরত যায় নি পূর্ণ। মা এত করে বলার পরও না।
কিভাবে যাবে সে? আজতো সে তার মৃত্ত’কে নিজের করে নিতে এসেছিলো। খালি হাতে যাওয়া মানায়? এই হাতে অবশ্যই তার নারীর হাত থাকতে হবে। তার মৃত্ত’র হাত থাকতে হবে। একদম হালাল ভাবে। তার নিজের করে।
মিঠি এতক্ষণ জানালা দিয়ে পানিতে হাত দিচ্ছিলো। হঠাৎ রাস্তার হদলে আলেতে পূর্ণ’কে দেখেই আঁতকে উঠে। নিজের ই চোখ ভরে উঠে। এক দৌড়ে ছুটে যায় মৃত্তিকা’র রুমে। মৃত্তিকা দিন বা রাত যখনই ঘুমাক তাকে ডাকা নিষেধ। এটা মৃন্ময় হাওলাদারের করা নিয়ম। ঘুমন্ত রাজকণ্যা’কে নাকি ডাকা নিষেধ। মৃত্তিকা এটা নিয়ে হাজার বললেও লাভ হয় না। বাবা কখনো তাকে ঘুম থেকে জোর করে তুলে না। সর্বোচ্চ মাথায় হাত বুলিয়ে বা কপালে চুমু খেলে এমনিতেই উঠে যায় ও।
মিঠি আজ নিয়ম ভেঙে ফেললো। মৃত্তিকা’র দেহে ঝাঁকি দিয়ে বললো,
— আপা! আপা!
হঠাৎ এমন ডাকে ধরফরিয়ে উঠে বসলো মৃত্তিকা। সম্মুখে মিঠি’র ফ্যাকাসে মুখ দেখে লাফিয়ে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলো,
— তোর মায়ের কিছু হয়েছে?
— না। তারাতাড়ি আসো আপা। পূর্ণ ভাই বৃষ্টিতে ভিজতেছে।
— মানে?
মিঠি কথা না বলে তারাতাড়ি মৃত্তিকা’কে টেনে বারান্দায় নিয়ে এলো। এক পশলা বৃষ্টির ধাক্কা একদম মুখে এসে লাগলো ওর। ভিজে গেলো মুখটা। নজরে এলো ভেজা পূর্ণ। চাদর এমন ভাবে পেঁচিয়েছে মনে হচ্ছে শীতের প্রকোপে কাঁপছে সে। এদিকে শুধু বাতাস না সাথে ঠান্ডা হীম বাতাস। অক্টোবরে রাত হতেই ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে। এর মধ্যে জ্বরে কাতর পূর্ণ কেন বসে আছে? আঁতকে উঠে মৃত্তিকা’র বুক। এক দৌড়ে সোজা ঢুকে বাবা’র রুমে। মৃন্ময় হাওলাদার বই পড়ছিলেন। হঠাৎ মেয়েকে এভাবে দেখে কিছুটা ভরকে যান। মৃত্তিকা হাঁপিয়ে উঠেছে এতটুকুতেই। কান্না আসছে ওর। বাবা’র হাত ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
— আব্বু…আব্বু উনি বৃষ্টিতে কেন ভিজছে? তুমি না বললা বাসায় ফিরে গিয়েছে তাহলে আমাদের বাসার বাইরে কেন?
মৃন্ময় হাওলাদার ও কিছুটা অবাক হন। মৃত্তিকা ওনাকে টেনে নিয়ে দেখায় পূর্ণ’কে। মৃত্তিকা বাবা’কে নিয়ে ছাতা হাতে নিচে যায়। কিছুটা দৌড়ে বাবা’র আগেই গেলো। পূর্ণ ঝিমুচ্ছে এই বৃষ্টির মধ্যে। সুষ্ঠ পুষ্ট দেহটা কাঁপছে। আচ্ছা এমন দৃশ্যে তো যে কারোই কান্না আসবে সেখানে নরম মনের মৃত্তিকা গলবে সেটাই স্বাভাবিক।
ধরা গলায় মৃত্তিকা বলে উঠলো,
— আপনি এখানে কেন ভিজছেন?
বৃষ্টির শব্দে কথাটা কর্ণগোচর হলো না পূর্ণ’র। মৃত্তিকা একবার বাবা’র দিকে তাকিয়ে এবার পূর্ণ’র কাঁধে আলত ধাক্কা দিতেই লাল হওয়া চোখ তুলে তাকালো। কেঁদে উঠলো মৃত্তিকা। টেনে ধরলো পূর্ণ’র হাত। নড়ে না পূর্ণ। মৃত্তিকা ওকে টানতে টানতে বলছে,
— কেন ভিজছেন? আপনার না জ্বর? উঠুন। ভেতরে আসুন।
— বউ লাগবে মৃত্ত। আপনাকে বিয়ে করতে এসেছি। করেই যাব।
কথাগুলো কানে ঠেকলো মৃত্তিকা’র ভেঙে ভেঙে। দাঁত দাঁত লেগে যাচ্ছে পূর্ণ’র। মৃত্তিকা’র বাবা ও ততক্ষণে পূর্ণ’কে ধরেছে। ছেলেটার শরীর অসম্ভব গরম ছিলো তখন এখন হীম হয়ে আছে। তারাতাড়ি পূর্ণ’র মাথার উপর ছাতা ধরে ব্যাস্ত কন্ঠে বললো,
— এসব বাচ্চামি তোমায় মানায় পূর্ণ? উঠে এসো।
— মৃত্ত’কে রাজি হতে বলুন।
— আচ্ছা ভেতরে কথা হবে। প্লিজ উঠো।
— না এখনই বলবে মৃত্ত। বলুন মৃত্ত কেন বিয়ে করবেন না? প্লিজ রাজি হন৷ আমি থাকতে পারছি না। মৃ..ত্ত…
কথাগুলো বলতে বলতে মাথা ঝিমিয়ে উঠলো ওর৷ মৃত্তিকা অনুরোধের স্বরে বললো,
— আগে বাসায়…
— ন…না। আগে রাজি ক..কিনা বলুন।
— ফাইজলামি করছেন আপনি? করব না বিয়ে? কেন করব? বিয়ে করার মতো সম্পর্ক কি আদৌ আছে আমাদের। হয় উঠুন নাহয় বাসায় যান।
এক প্রকার চিল্লিয়ে বলে উঠলো মৃত্তিকা। নিজের কথায় নিজেই অবাক হলো। এভাবে কথা ও কখনো বলে নি। আজ কি হলো? হাতের ছাতা ফেলে দৌড়ে বাড়ীতে ঢুকে পরলো। কান্না করছে ও। পূর্ণ এসব করে কি বুঝাতে চাইছে? ও ভালোভাসে পূর্ণ’কে এটা ঠিক। সত্যি বরং ধ্রুব সত্যি, কিন্তু বিয়ে! এমন সম্পর্ক ও ওদের গড়ে উঠেই নি। কিসের ভিত্তি’তে ও এতবড় সিদ্ধান্ত নিবে। হঠাৎ কি সব হয়? বিয়ে টা এতটাই সহজ?
ফোনের শব্দে মৃত্তিকা মাথা তুললো। বাবা ওর পাশে। মৃত চোখে তাকালো মৃত্তিকা। এখনও বাইরে দেখা যাচ্ছে ভেজা পূর্ণ’কে। পার্থক্য শুধু মাথার উপর একটা ছাতা।
মৃত্তিকা বাবা’র বুকে মুখ গুজে কেঁদে উঠলো। একসময় শব্দটা তীব্র হলো। মেয়ে’র মাথায় হাত রেখে শুধু বললেন,
— কথা বলুন আম্মা। আপনার বন্ধু কল করেছে।
মৃত্তিকা কথা বলতে পারছে না। হিচকি তুলে তুলে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে ও৷ খসখসে হাতটা দিয়ে মেয়ে’র গাল মুছে দিলেন মৃন্ময় হাওলাদার। নিজেই রিসিভ করে মৃত্তিকা’র হাতে দিলেন। কানে ধরতেই ঝাঁঝালো গলা শুনা গেলো উজ্জ্বলের,
— বা*ল ঢং মা*রা*য়া না কাইন্দা পূর্ণ ভাইরে ধর। কিভাবে ভিজতাসে। তোগো মাইয়া মানুষের খুপরি’তে কি ঘুরে আল্লাহ জানে। ওনার এমনিতেই একশত তিন ডিগ্রি জ্বর ছিলো মৃত্তিকা। এখন ভিজতাসে। আমি আর হিমু দাঁড়ায়া আছি ছাউনির নিচে। কখন থেইকা বলতাসি উঠতে। তুই না নিতে আইলি? গেলো না ক্যান?
— বি..বিয়ে করব না।
কথাটা শুনেই ছ্যাঁত করে উঠলো উজ্জ্বল,
— হ হ এতদিন তো পূর্ণ ভাই ছিলো মধুর হাড়ি তুমি ছিলা মৌমাছি। এতদিন ভ্যান ভ্যান কইরা এখন ভাই পাগল হইসে এহন বা*ল তোমার সমস্যা?
— তুই জানিস না….
— কি জানি না আমি? সব জানি। ভাই তোরে বাসা থেকে বের করসে এই তো…
ফোনটা কেড়ে নিলো হিমু। শান্ত কন্ঠে শুধু বললো,
— তোকে ভাই এর কিছু বিপরীত পক্ষ টার্গেট করেছে মৃত্তিকা। তোর সেফটির জন্যই ভাই দূরে ছিলো। ইভেন তার বাসায় তুই যাওয়াতে হয়তো তোর টেনশনেই ওমন ব্যাবহার করে ফেলেছে কারণ তখন ওনার এলাকায় তোর কিছু হলে উঠে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ওনার ছিলো না। আর কি বলব বল?
ফুপিয়ে কান্নার শব্দ এলো। ফোনটা রেখে বাবা’কে জড়িয়ে ধরে বললো,
— তবুও মন মানছে না বাবা।
শক্ত করে বুকে চেপে নিলেন মৃন্ময় হাওলাদার। বুকটা তার ক্ষত হচ্ছে অদৃশ্য ভাবে। কাকে দেখাবেন সে।
বাবা’র হাত ধরেই বাইরে এলো মৃত্তিকা। পূর্ণ মাথা সাইডে থাকা খাম্বায় ঠেকিয়ে চোখ বুজে আছে। ছাউনি থেকে ছাতা হাতে হিমু, উজ্জ্বল ও বেরিয়ে এলো। মৃত্তিকা পূর্ণ’কে উদ্দেশ্য করে বললো,
— ভেতরে আসুন প্লিজ।
মাথা তুললো পূর্ণ। এভাবে বসে থাকতে পারছে না ও আর। মনে হচ্ছে পরে যাবে এখনই। বহু কষ্টে মাথা তুলে নিলো। কাঁপা ঠোঁট গুলো নেড়ে বললো,
— রাজি আপনি?
— দেখুন। পরে কথা বলি এসন নিয়ে।
— চলে যান মৃ..ত্ত। ঠা..ন্ডা লাগবে আপনার।
পূর্ণ’র হাত ধরে ফেললো মৃত্তিকা। অসহায় চোখ করে বললো,
— প্লিজ।
— বিয়ে করবেন?
— কথাটা..
— বি..য়ে করুন আমায়।
কথাটা বলতে বলতে দাঁতে বাড়ি খেয়ে সৃঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট কেটে গলগল করে র*ক্ত পড়া শুরু করলো যা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে মৃত্তিকা বললো,
— করব করব দয়া করে উঠুন।
কথাটা শুনা মাত্র পূর্ণ তাকালো মৃত্তিকা’র দিকে। পিলারে ঠেস দিয়ে দাঁড়াতে চাইলো। পারলো না। ধপ করে বসে পরতেই উজ্জ্বল আর হিমু ধরলো। তাতেও হচ্ছে না। এত বড় শক্ত পোক্ত পুরুষ শরীর ছেড়ে দিলে তাকে উঠানো কষ্টসাধ্য। মৃত্তিকা’র বাবা নিজেও ধরলেন। ভেতরে নিয়ে বসানো হলো পূর্ণ’কে। মিঠি দৌড়ে টাওয়াল নিয়ে আসতেই চোখ পরলো উজ্জ্বলের দিকে। সাথে সাথে নামিয়ে নিলো চোখ। উজ্জ্বল, হিমু’র সাহায্য পূর্ণ’কে রুমে নেয়া হলো। কল করা হলো তার মা-বাবা’কে। এই বৃষ্টি মাথায় ছুটে এলেন তারা। সাথে আনা পাঞ্জাবিটা পূর্ণ’কে পড়ানো হলো। এত করে বলা হলো যাতে আগামী কাল করে বিয়ে কিন্তু না পূর্ণ রাজি হলো না। ও এখনই বিয়ে করবে। মৃত্তিকা এতসবে যেন পাথর হয়ে গেল। ওর পরণে একটা ঢোলা টিশার্ট আর বিড়াল ছাপার একটা প্যান্ট। সেটার উপরেই মৃত্তিকা’র বাবা একটা লাল দোপাট্টা পড়িয়ে দিলেন মেয়েকে। এতেই যেন সুরত ঘুরে গেলো মৃত্তিকা’র। বিয়ের ছাপ ফুটে উঠলো শ্যামলা চেয়ারায়। পূর্ণ এসেই হা করে তাকিয়ে রইলো। এই মৃত্ত’কে আজ হঠাৎ এতটা কেন সুন্দর লাগছে? সুন্দর আগেও লাগতো এখনকার এই সৌন্দর্য ভিন্ন। আলাদা একটা রঙ লেগেছে যেন। ঘুমু ঘুমু চোখে কাজি নিয়ে হাজির হলো উজ্জ্বল, হিমু। বেচারা কাজি এই ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়াতে গরম গরম বউ ছেড়ে আসার জন্য চওড়া দাম দিবেন ভেবে নিলেন। সাথে এসেছে এলাকার হুজুর। তাকে মৃত্তিকা’র বাবাই কল করেছিলেন।
বুক জুড়ে ধ্রীম ধ্রীম শব্দ করছে মৃত্তিকা’র। কি থেকে কি হয়ে গেল। এখন নিজের অসহায়ত্বের জন্য কান্না পাচ্ছে ওর। ওর বাবা ওর সাথে ওকে ধরে বসে আছে। পূর্ণ ঠিক বরাবর সামনে। দুই পাশে ওর মা-বাবা। মাথা নামিয়ে রেখেছে পূর্ণ। হুজুর দোয়া পড়া শুরু করতেই মৃত্তিকা’র ধুকপুকানি বাড়তে লাগলো। একসময় হুজুর পূর্ণ’কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— রাজি থাকলে বলুন বাবা আলহামদুলিল্লাহ কবুল।
শুনা গেলো জ্বরে কাতর হওয়া রাশভারী কন্ঠে,
— আলহামদুলিল্লাহ কবুল।
থেমে গেলো মৃত্তিকা’র হৃদপিণ্ড। পরপর তিনবার পূর্ণ একই কথা বললো। এবার মৃত্তিকা’কে জিজ্ঞেস করতেই মৃত্তিকা বাবা’কে খাঁমচে ধরলো৷ মৃন্ময় হাওলাদার তাকালেন মেয়ের চোখে। মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো মৃত্তিকা। ওর মন কিছুতেই মানছে না। আতঙ্কিত তার নেত্র। বাবা চোখের ইশারায় আস্বস্ত করে বুকে টেনে নিলেন। বহু কষ্টে বললেন,
— কবুল বলুন আম্মা।
— আলহামদুলিল্লাহ কবুল।
বাবা’র এককথায় মৃত্তিকা বলে উঠলো। শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো পূর্ণ। আর কোন বাঁধা নেই৷ মৃত্ত এখন তার৷ পুরোপুরি তার।
মৃত্তিকা বাবা’র বুক থেকে নড়লো না। পাশে বসে পূর্ণ’র মা মোটা দুটো স্বর্ণে’র বালা পড়িয়ে দিতেই মৃত্তিকা তাকালো বাবা’র দিকে। সন্তপর্ণে চুমু খেলেন মৃন্ময় হাওলাদার। মুগ্ধ কন্ঠে বললেন,
— আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরতম বধু আপনি আম্মা।
#চলবে…..