ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-৩০
চোখের পলকে সময় পালিয়ে যাচ্ছে আলতার। এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে আজ তিনদিন৷ তার পরীক্ষার মাঝেই সে জানতে পেরেছিলো বাবা মায়ের লিগ্যাল সেপারেশন এর কথা। এটা নিয়ে তার খারাপ লাগা খুব একটা ছিলো না। না থাকারই কথা কারণ, জন্মের পর থেকে কখনো বাবা-মাকে একসাথে থাকতে দেখেনি। বাবার প্রতি তার ভালোবাসাও খুব বেশি নয় তবে মায়া জন্মে গেছে। হতে পারে রক্তের টান বলে কিছু আছে যা তাকে তার অজান্তেই মায়ায় জড়িয়েছে। বাবার সাথে পরিচয়ের প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেছে৷ অথচ ভাবলেই মনে হয় এইতো সেদিন আলতাকে শাওন তুলে নিয়ে গেল, গাড়ি পানিতে পড়লো আর আওলাদ হাত পা বাঁধা মেয়েটাকে উদ্ধার করে জানলো এই মেয়ে তারই ঔরসজাত সন্তান। সময়গুলো পেছনে যেতে যেতে আবেগে বেঁধে দিয়ে গেছে আলতাকে তার পিতার সাথে। নকশি, আওলাদ দুজনেই চেষ্টা করেছিলো ব্যাপারটা মেয়েকে তার পরীক্ষার পর জানাবে কিন্তু এসব কথা খুব একটা গোপন রাখা যায় না। আলতাকে নিয়ে ভয় ছিল সকলের আপাতত সেই ভয় তারা কাটিয়ে উঠেছে। আলতা স্বাভাবিক আছে বাবা -মায়ের ডিভোর্স নিয়ে কিন্তু সে ভেতরে ভেতরে একটা চিন্তায় অস্থির আছে অনেকটা দিন ধরে। যে স্কুলে সে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল সেখানে একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছে মেয়েটার নাম তানিয়া। মেয়েটা তারই মত অন্য এলাকা থেকে এসেছিল পরীক্ষা দিতে। কিন্তু তার মত অভিভাবক হিসেবে কেউ ছিলো না পাশে মেয়েটার। মূলত, একা একটা মেয়ে আসছে পরীক্ষা দিতে তা দেখেই সে কৌতূহল বোধ করতো খুব৷ একই হলের হওয়ায় দুজনের মধ্যে টুকটাক কথাও হয়েছে। খুব বেশি কথা না হলেও কিছুটা মুক্তমনা হয়েই কথা বলতো মেয়েটা। সেই সুবাদেই আলতা মেয়েটাকে একদিন প্রশ্ন করেছিল সে একা কেন আসে? মেয়েটা খুবই মিশুক প্রকৃতির তা বুঝতে পেরে সে দু চার বার প্রশ্ন করতেই মেয়েটা নিজের পরিবার সম্পর্কে কিছু কথা বলল। মেয়েটার মা একজনের সাথে পালিয়ে গেছে কয়েক বছর আগে। মেয়েটার বাবা তাকে খুব আদর করতো বলে দ্বিতীয় বিয়ে করতে রাজী হয়নি পাছে সৎ মা মেয়েকে কষ্ট দেয়! কিন্তু বছর এক পার হতেই বাবা নিজ প্রয়োজনে দ্বিতীয় বিয়ে করলেন। যে কদিন দাদী বেঁচে ছিল ততদিন সৎ মা আদর-যত্ন করলেও দাদী মারা যাওয়ার পর আর তাকে আদর করে না। খাওয়া, পরার কষ্ট দেয় আর তাদের আরেকটা বাচ্চা হতেই বাবারও পরিবর্তন হয়ে গেল। এই যে মেয়েটা মেট্রিক পরীক্ষা দিল তাতেও নাকি বাবার আপত্তি ছিল। আত্মীয় স্বজন আর গ্রামবাসী পেছনে না লাগে সেই ভয়ে পড়াটা চালাতে দিচ্ছে মেয়েকে। আলতা বলেছিল, “তুমি তোমার মায়ের কাছে চলে যাও মা নিশ্চয়ই তোমাকে নিজের কাছে রাখবে।”
মেয়েটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেছিল, “মা নিজের সুখের জন্য কারো সাথে পালিয়ে গেছে। আমার সুখের কথা ভাবলে তো আর এভাবে চলে যেতো না।”
এসব কথা শোনার পর থেকেই আলতার মন, মস্তিষ্ক অস্থির হয়ে আছে এক ভাবনায়। এই যে তার মা অল্প বয়সেই তাকে জন্ম দিয়ে স্বামী, সংসার হারিয়েও কোন দ্বিতীয় পুরুষের সান্নিধ্যে যায়নি এতে কি তার মায়ের সুখ নষ্ট হয়নি? পনেরো কি ষোলো বছর বয়সী একটা মেয়ের মস্তিষ্ক হয়ত এতোটাও পরিপক্ক হয় না যা দ্বারা সে জীবনে সুখ আর দুঃখগুলোর প্রতিচ্ছবিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করে নিতে পারে। কেউ কেউ হয়তবা কিছুটা পারে কিন্তু আলতার কাছে তো সুখ বলতে নিজের চাওয়া পূরণ হওয়া আর দুঃখ বলতে প্রয়োজনের জিনিসগুলো সময়মত না পাওয়াটাই ছিল। তবুও খুব করে সে মাকে নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করলো আর তখনি মনে পড়লো শিশির ভাইয়ের বলা কথাগুলো। তার বাবার একটা সংসার আছে তার মা না থাকলেও মায়ের জায়গায় অন্য একজন স্ত্রী আছে তার বাবার জীবনে৷ আছে সে ছাড়াও দুজন সন্তান, আছে আত্মীয়-স্বজন। আর এখন সে যখন মায়ের সংসার বিচ্ছেদের ঘটনা জানলো তখন এও জানলো আহসান মামা তার আত্মীয় নয় বরং তার মাকে আশ্রয় দিয়ে অভিভাবকের মত পাশে থেকেছে। মায়ের কাছে না তার স্বামী আছে না তার বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন! মায়ের কি কষ্ট হয়নি এতগুলো বছর তাদের ছেড়ে থাকতে! শিশির ভাই ঢাকায় যাওয়ার আগে একদিন বলেছিলো, “ভালো করে পড়াশোনা করবি তোকে ঢাকায় চান্স পেতে হবে। সেখানে থেকেই পড়াশোনা করবি” তখনি আলতার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো শুনে। মাকে ছেড়ে সে একটুও থাকতে পারবে না৷ এক দুদিন হলে না হয় বেড়ানো যেত কিন্তু মায়ের থেকে এত এত দূরে গিয়ে সে অনেক দিনের জন্য কিছুতেই থাকতে পারবে না। কষ্টে তো তার কলিজাটাই ফেটে যাবে। তাহলে এতগুলো বছর কি মায়েরও এমনই লেগেছে নিজের মা-বাবাকে ছেড়ে থাকতে! আলতার কান্না পেয়ে যায় মাকে নিয়ে ভাবতে গেলেই। পরীক্ষা শেষ বলে আলতাকে বেড়াতে যেতে বলল শিউলির শ্বশুর বাড়িতে। আলতার একদমই ইচ্ছে হলো না মাকে ছেড়ে কোথাও যেতে। বাড়ির সবাই খুব জোর দিচ্ছে তার বেড়াতে যাওয়া নিয়ে। আজ রাতের খাওয়া শেষ হতেই শরত ভাই ডাকলো তাকে। আলতা হাত মুছে গেলো শরত ভাইদের ঘরে। শরত দোকানের একটা হিসাবের খাতা নিয়ে বসেছিল তার মায়ের ঘরেই। জয়তুনও সেসময় উপস্থিত ছিলো। আলতা ঘরে ঢুকতেই শরত বলল, ” শিউলি একটু আগেও ফোন করেছে বলল কাল তোকে দিয়ে আসতে ওর শ্বশুর বাড়ি।”
“আমি যাবো না শরত ভাই।”
শরত হিসাবের খাতার ওপর হাতে থাকা ক্যালকুলেটরটা রেখে তাকালো আলতার দিকে৷ জয়তুন কিছু বলতে চাচ্ছিলো তার আগে শরতই বলল, “কি হয়েছে তোর? ফুপুআম্মা তো অনুমতি দিয়েছে আগেই। তুই নাকি সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকিস! এমন সারাদিন শুয়ে, বসে থাকলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বি।”
“কিচ্ছু হয়নি তো।” আমতা আমতা করতে লাগলো আলতা।
“কিচ্ছু না হলে বয়লার মুরগির মত থম ধরে থাকিস কেন সারাদিন? কালকে সকালে তৈরি থাকবি মা আর তোকে দিয়ে আসবো সেখানে গিয়ে থাক কয়দিন ভালো লাগবে। রেজাল্ট বেরুলে তো আবার পড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবি।”
শরত তার স্বভাবসুলভ শান্ত স্বরেই বলল। আলতা তখনো দোটানায় সে বাড়ি থেকে বের হতে চায় না। কিন্তু শরত ভাইয়ের সাথে এখন জবাব দিলে মামী হয়ত বলবে তর্ক করছি অথবা মা জানলে বকবে এমনটা ভেবেই সে চুপচাপ মাথা কাত করলো যার অর্থ হলো সে তৈরি থাকবে। রাতে আবারও ভাবনায় ডুবে অনেকক্ষণ তার ঘুম আসলো না। সে এপাশ ওপাশ ছটফট করছে তা টের পেয়ে নকশি তার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।
“তুই আজকাল এত অস্থির থাকিস ক্যান আলতা? কি হয়েছে বল তো আমাকে।”
“ঘুম আসতেছে না।”
“কেন ঘুম আসে না তাই জানতে চাই৷ আমি তালাকের কথা তুলছি বলে কি তুই কষ্ট পেয়েছিস?”
মায়ের মুখের কথা শেষ হতেই সে মায়ের দিকে মুখ ফেরালো৷ দু হাতে আদুরে ভঙ্গিতে মাকে জাপটে ধরলো৷ কয়েক বছর ধরে আলতা মাকে এমন করে জাপটে ধরেনি ঘুমাতে গিয়ে। কৈশোরে পা দেওয়ার পর থেকেই কেমন যেন ছাড়া ছাড়া শুতেই পছন্দ করে। পাশ বালিশও থাকে মাঝেমধ্যে দুজনের মাঝে৷ কিন্তু আজ এই মুহুর্তে মাকে জাপটে ধরে একদম ছোট হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। মায়ের বুকে মুখ গুঁজে আহ্লাদে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে৷ ভেতর থেকে একটা কান্নাও উঠে আসতে চাইছে। কিন্তু মাকে কান্না দেখাতে চায় না সে। তাই আদুরে ভঙ্গিতে মায়ের সাথে মিশে গিয়ে বলল, “পরীক্ষা নিয়ে চিন্তা হচ্ছে আম্মা৷ আমার শখ শহরের কোন কলেজে পড়ার। যদি ভালো রেজাল্ট না করি তাহলে কি চান্স পাবো?”
ঘরের বাতি নেভানো ; অন্ধকারে নকশি মেয়ের মুখটা দেখতে পাচ্ছে না। তার মনে হলো আলতার মনে অন্যকিছু চলছে। মুখটা দেখলেই সে বুঝতে পারতো আলতা সত্যিটা বলল না মিথ্যে বলে কথা ঘুরিয়ে নিলো! আলতা আবারও বলল, “ঢাকার কোন কলেজে পড়তে কত টাকা লাগবো আম্মা?”
“তুই পারবি শহরে থেকে পড়াশোনা করতে?”
“হ্যাঁ, পারবো না কেন? শিশির ভাইও তো পড়ছে।”
“সেখানে তো আমি থাকবো না।”
“তুমি এখানে থাকবা। আমি রোজ ফোন দিব কিন্তু আগে টাকা পয়সার ব্যবস্থা করতে হবে।”
আলতার কথার গম্ভীরতা দেখে নকশিও এ বিষয়ে গম্ভীর হলো। মা, মেয়েতে আরো কিছুক্ষণ কথা হলো শহরের কলেজে পড়াশেনা নিয়ে। নকশির মাথায় ঢুকে গেল কি করে খরচ পূরণ করা যাবে আলতা শহরে পড়লে৷ আলতাও মনে মনে নিজেকে বুঝিয়ে নিলো তাকে এমন কিছু করতে হবে যাতে মায়ের কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে। এমনই ভাবনায় ডুবে মা, মেয়ের ঘুম চোখে ভর করলো।
কাঁচের মত স্বচ্ছ আর নিরুত্তেজ রোদ সকালের ধরনীটাকে একদম সোনালি করে দিয়েছে। চারপাশে জনমানবের কোলাহল সেই সাথপ গাছে গাছে হাজারো পাখির কিচিরমিচির। আলতার ঘুম ভারী তাই এতসব কোলাহল তার ঘুমের ব্যাঘাত করতে পারেনি। নকশি উঠে গেছে আরো আগেই। সে উঠে নামাজ পড়ে উঠোন ঝাড়ু দিয়েছে। নিজের রান্নাঘরটা সাফ করে রান্নার বন্দোবস্ত করেছে। তখনো বাড়ি বাকি দু ঘরের কেউ বাইরে আসেনি। খুব সম্ভব, আহসানুল্লাহ আজ মসজিদে যায়নি নইলে শিশিরদের ঘরের দরজা খোলা থাকতো। শিফাও ফজর পড়ে শুয়ে থাকে অনেকটা সময়। এদিকে জয়তুনও শিউলির বিয়ের পর থেকে রুটিন বদলেছে। তার অবশ্য বয়সটাও ইদানীং জ্বালাতন করছে কিছুটা হাঁটুর ব্যাথা, কোমরের ব্যথায়। নকশির রান্না প্রায় শেষের দিকে তখন নকশির কানে এলো বাড়ির গেইট বাইরে থেকে কেউ খুলছে। সন্দেহ বশে নকশি আরেকবার তাকালো শিশির আর শরতদের ঘরের দরজায়। দুটো ঘরেরই প্রধান দরজা লাগানো৷ নকশি আরো কিছু ভাববে তার আগেই গেইট খুলে বাইরে থেকে আসা মানুষটা উঠোনে এসে গেছে৷ নকশি বিষ্ময়ে খেই হারানোর জোগাড়।
“শরত তুমি বাড়ির বাইরে ছিলে!”
“না ফুপুআম্মা, ফজরের নামজের জন্য বেরিয়েছিলাম৷ পরে আর বাড়ি আসতে ইচ্ছে করছিলো না তাই একটু খোলা হাওয়ায় হেঁটে এলাম।”
“তাহলে ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ কি করে?” চুলা থেকে তরকারির পাতিলটা নামাতে নামাতেই প্রশ্ন করলো আবার।
“আমার ঘরের পেছনের যে একটা দরজা সেটা খুলেছিলাম কয়েকদিন আগে। এখন মাঝেমধ্যে সকালে সেখান দিয়েই বের হই নইলে আম্মার ঘুম ভেঙে যায়।”
শরতের কথায় আশ্বস্ত হলো নকশি। তার শরতকে কখনো চড়া সুরে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। শরতের জায়গায় এখন শিশির থাকলেই হয়ত, একটা ধমক দিয়ে বলতে ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে কিসের আসা যাওয়া! দাঁড়াও আমি ভাইকে বলতেছি তোমার কীর্তি৷ কিন্তু শরতকে কিছু বলা যায় না। এত চুপচাপ আর হাস্যোজ্জ্বল ছেলে কেমন করে বদলে গেল! নকশি আর কিছু বলল না। সে নিজের কাজকর্ম সেরে টিউশনিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে আর এক ভাবনায় নিগূঢ়ভাবে ডুবে যাচ্ছে৷ আলতা রাতে যেভাবে বলল সে ঢাকায় থেকে পড়াশোনা করতে চায় তাকে কি করে পড়াবে নকশি? সত্যি বলতে আশপাশের এলাকায় তেমন ভালো একটা কলেজ নেই আর শহরের খুব ভালো কলেজে দিতে গেলে খরচ নকশি কি করে চালাবে! হঠাৎ মনে তার ডিভোর্সের জন্য আওলাদ যদি কাবিনের টাকা বা মেয়ের খোরপোশ এর কথা বলে তাহলে সে বেহায়া হয়ে সেগুলো নেবে ৷ মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য তার করতেই হবে। তার যা ইনকাম তাতে সে কিছুতেই পারবে না আলতার পড়াশোনা চালিয়ে নিতে। আবার ভয়ও হচ্ছে মেয়েকে একা দূরে দিয়ে সে চিন্তায় মরে যাবে৷ এমনিতেই তো তারজীবন কাটলো পুরুষদের চোখের থাবা থেকে নিজেকে লুকিয়ে, বাঁচিয়ে। মেয়েটার এইটুকু বয়সে কতবড় একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেল! এই দূর্ঘটনার কথা ভেবে মেয়েকে দূরে দেওয়ার চিন্তা উবে গেল মাথা থেকে নকশির। সে টিউশনিতে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর জয়তুন নকশিকে জানাতে ফোন করলো সে আলতাকে নিজের সাথে নিয়ে যাচ্ছে শিউলির বাড়ি। নকশির অমত নেই তাই বলল, “ভাবী ও গেলে নিয়ে যান।”
ব্যস, জয়তুন আর শোনে না আলতার কথা৷ বকে, ধমকে তৈরি করিয়ে নিলো। শরত আজ আর সকালে দোকান খোলেনি এখন মা আর আলতাকে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের পৌঁছে দিয়ে দুপুরের পর চলে আসবে সে। শিউলি পাঁচ মাসের গর্ভবতী তাই আরো জয়তুন এবার মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থাকতে যাচ্ছে। এছাড়া আগে কখনোই এক রাত কাটায়নি সেখানে। সকাল দশটার মধ্যেই তারা বেরিয়ে গেল। জয়তুন যাওয়ার সময় শিফাকে বলো গেল শরতের দিকে খেয়াল রাখতে। যে কদিন সে থাকবে না সে কদিন শরত চাচীর ঘরেই খাবে। যাত্রাপথে শরত কিছু ফল আর মিষ্টি নিয়ে নিলো। গন্তব্যে পৌঁছে তো সবাই অবাক পুরো বাড়িতে শিউলি আর তার বড় জা ছাড়া কেউ বাড়ি নেই। বড় জা রয়ে গেছে শিউলির জন্যই বাকিরা কোন এক আত্মীয়ের বাড়ি গেছে বিয়ের দাওয়াতে৷ শিউলির স্বামী নিজের কাজে গেছে রাত ছাড়া ফিরবে না। জয়তুনের কেমন সংকোচ হতে লাগলো আসার পর৷ মেয়ের শ্বশুর শ্বাশুড়ি বাড়ি নেই আর সে এসেছে বেড়াতে এখানে না আবার দশ কথা হয়ে যায়। শিউলির জা খুবই আন্তরিক সে বারংবার বুঝিয়ে যাচ্ছে, মাঈ’মা এত ভাববেন না। আমার শ্বাশুড়ি খুশিই হইবো আপনি থাকছেন শুনলেন।
জয়তুন আশ্বস্ত হতে পারলো না। গলার ভেতর কাটার মত বিঁধে রইলো অস্বস্তিটা। দুপুরে ভালোমন্দ রান্না করে খাওয়ালো শিউলির জা। শরত দুপুরের পরপরই চলে গেল আলতা আর জয়তুনকে রেখে। যাওয়ার সময় পই পই করে বলে গেছে আলতাকে সাবধান থাকতে আর কোন রকম সমস্যা হলেও যেন শিউলি আপা বা মামীকে বলে। শরতও একটু চিন্তিত আলতাকে নিয়ে এসে। তার মানসিক অবস্থা শক্তপোক্ত নেই এটা ডাক্তার আগেই বলেছে। তাকে নিয়ে সতর্ক থাকাটাই জরুরি তাই সে শিউলিকেও বলে গেল আলতার মধ্যে কোনরকম সমস্যা চোখে পড়লেই যেন তাকে কল দিয়ে জানায়।
মাগরিবের আজান মাথায় করেই আওলাদ এসে উপস্থিত মাস্টার বাড়িতে। শিফা, নকশি দুজনেই তখন নিজেদের ঘরে নামাজে দাঁড়িয়ে গেছে৷ আওলাদ কখনো এসে নকশির ঘরে ঢোকে না। অন্তত মেয়ের জোরাজুরি না থাকলে সে কোন ঘরেই ঢোকে না। উঠোনে কিংবা শিশিরদের খোলা বারান্দায় মোড়া, চেয়ার কিছু একটাতে বসে। আজও সে সবসময়কার মত এসে নকশির ঘর বরাবর উঠোনে দাঁড়িয়ে আলতার নাম ধরে ডাকলো৷ সন্ধ্যার উঠোনে নিঝুম, নিস্তব্ধতায় ঘেরা, অন্ধকার তখনো গাঢ় হয়নি৷ নকশির কানে গেল ডাকটা। প্রথম ডাকটা শুনে ভাবলো হয়ত ভুল শুনেছে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ডাকের পরে বুঝলো না আওলাদ এসেছে। সে সালাম ফিরিয়ে ছোট করে মোনাজাত করলো। দরজা ঠেলে উঠোনে তাকাতেই আওলাদ বলল, “আলতা কই?”
“ও তো বেড়াতে গেছে শিউলির শ্বশুর বাড়ি।” নকশি এটুক বলতে বলতে ভাবলো আওলাদকে কি সে ঘরে আসতে বলবে! বাড়িতে আহসানুল্লাহ বা শরত নেই। জয়তুন ভাবী বাড়িতে সবচেয়ে মুরুব্বি তিনি থাকলেও হয়ত এতোটা অস্বস্তি হতো না কিন্তু আজ তিনিও নেই৷ আওলাদ বাতির আলোয় বুঝি পড়ে নিলো নকশির চোখের ভাষা। সে নিজে থেকেই বলল একটু সামনে আসলে ভালো হইতো। কিছু কথা ছিল তালাকের কাগজপত্র লইয়া। হাতে আজকা সময় ছিলো না সারাদিন তাই অসময়েই আইতে হইলো।”
শিফার নামাজ শেষ হয়ে গেছে। সেও এসে দরজায় দাঁড়িয়ে আওলাদকে দেখলো। তারপর নকশিকে দেখে বুঝলো নকশি লোকটাকে ঘরে বসাতে দ্বিধাবোধ করছে। সে এগিয়ে এসে বলল, “ভাই আপনে এইখানে এসে বসেন, নকশি আয়।” শিফা তার বারান্দার বাতিটা জ্বালিয়ে মোড়া পেতে দিল। নকশি এতক্ষণে সহজ হতে পেরে বেরিয়ে এসে শিশিরদের বারান্দায় গেল। তার পেছনে আওলাদও এসে বসলো মোড়ায়। নকশির পাশে শিফা দাঁড়ানো। আওলাদ কোন ভণিতা ছাড়াই বলল, “আগামী সাপ্তাহে তালাকের সইসাবুদ কইরা আসতে পারবা? উকিলের লগে কথা কইয়া আইছি। ওইদিন আলতারে সঙ্গে নিতে হইবো।”
চমকে তাকালো নকশি।
“আলতাকে কেন নিব?”
“আলতার মতামতের জন্য ও কার কাছে থাকব সেইটার ফায়সালা করতে৷ ”
“আলতা আমার কাছে থাকবে আমি ওকে দিবো না।”
আওলাদ করুণ চোখে তাকালো তার জীবনের অতি প্রিয় এবং কয়েকমাস সংসার করা নারীটির দিকে৷ সে নকশিকে ভালোবাসে হয়ত সেই ভালোবাসার যত্ন সে করতে পারেনি আর তার ফল হিসেবে বন্ধনটা শুরুতেই ছিঁড়ে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে আওলাদ জানালো আলতা তার মায়ের কাছেই থাকবে এটা শুধু একটা নিয়ম পূরণের স্বার্থে তাকে জজ জিজ্ঞেস করবেন । আলতা নিশ্চয়ই বলবে সে মায়ের কাছে থাকে! নকশি হাফ ছেড়ে বাঁচলো এটা শুনে। শিফা চা করে আনলো আওলাদকে দিলে সে তা নিলো না। মোটামুটি রকম কথা শেষ করে সে চলে গেল। মাস্টার বাড়ি থেকে বের হয়ে সে আবার গেল বাজারে আহসান মাস্টারের দোকানে। আহসান বিশেষ অবাক হয়নি তাকে দেখে। তবুও জিজ্ঞেস করলো আসার কারণ। আওলাদ এখানেও কোন ভণিতা না করে বলল, ” আহসান ভাই নকশির বিয়ার ব্যবস্থা আপনে এবার করতে পারেন৷ আর কয়েকদিন পরেই তালাকের কাগজে সই হইয়া যাইব।”
আহসান লক্ষ্য করেছিলো আওলাদের মুখে বিষাদ কেমন কালো করে দিয়েছে তার মুখটা কিন্তু কি করার আছে তার!
শিউলি আজকাল রান্নাঘরে খুব একটা যায় না। শরীর কিছুটা ভারী হওয়ায় কাজকর্মও করে নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। দু চার কাজ করেই বিশ্রাম নিতে হয় অনেকটা। জয়তুন আসার পর থেকেই সবটা দেখে মনে মনে ঠিক করলেন মেয়েকে শিগ্রই বাড়ি নিয়ে যাবেন। এখানে থেকে যত্ন হয়ত পাবে কিন্তু কেউ কেউ বিরক্তও হতে পারে এ অবস্থায়। আর এমনিতেও মেয়ের প্রথম সন্তান হবে সেজন্যও তো নিতেই হবে বাপের বাড়ি। একটু না হয় আগেই নিলো। সন্ধ্যার নাশতায় বাজারের গরম গরম জিলাপি আর সিঙ্গারা পাঠিয়েছে শিউলির বর শাশুড়ী আর শালির জন্য। আলতার জিলাপি পছন্দ খুব কিন্তু আজ কিছুতেই মুখে তুলতে ইচ্ছে করছিলো না। শিউলি আর তার জায়ের জোরাজুরিতে জিলাপি একটু নিয়ে বসলো। ফোনটা বেজে উঠেছে শিউলির। সে সিঙ্গারা হাতে ফোনটা তুলে দেখল শিশির কল দিয়েছে। সে খুশিতে রিসিভ করে প্রথমেই বলল, “শিশির ভাই ভিডিও কল দাও।”
“কেন রে এটাতে কি সমস্যা।”
“আগে দাও না।”
“আচ্ছা নেট অন কর আগে। নেটে না পেয়েই তো এভাবে কল দিলাম।”
“আচ্ছা ” বলে শিউলি কল কেটে নেট চালু করলো। শিশিরও ভিডিও কল দিয়ে অবাক হলো। তবে তাকে যা দেখাতে শিউলি ভিডিও কল দিয়েছে শিশির বোধহয় তা না দেখে অন্যকিছুই দেখলো।
“জিলাপি আর সিঙ্গারা দেখলে শিশির ভাই? তোমার না এমন গুড়ের চিকন জিলাপি খুব পছন্দ তুমি আসলে আমি উনাকে বলবো আবার আনতে। তুমি তো একটাবারও এলে না আমার বাড়ি! আমার ছেলে মেয়ে হলে একবারেই আসবে মনে হচ্ছে।” এক নাগাড়ে কত কি বলে আক্ষেপ ঝাড়লো শিউলি কিন্তু শিশির সেদিকে খুব বেশি খেয়াল দিতে পারলো না। তার নজর আটকে আছে শিউলির পাশে চুপচাপ অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকা আলতার দিকে। শিউলির কথার জবাব দিয়ে সে প্রশ্ন করলো আলতা এখানে কার সাথে এসেছে? শিশির জানতো না তার জেঠিমাও এসেছে। শিউলির মুখেই শুনলো। রান্নাঘরে বসে জয়তুন এখন রাতের রান্নার আয়োজন করছিলেন তাই শিউলির জা জিলাপি হাতেই বেরিয়ে গেল। কোন কাজে এবার শিউলিও উঠলো তাই ফোনটা আলতার হাতে দিয়ে বলল, “শিশির ভাই আলতার সাথে কথা বলো আমি একটু আসতেছি।”
শিশির বোধহয় এমনই একটা সুযোগ খুঁজছিলো৷ আলতাকে তার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু এই কথাটা মুখে বলার উপায় নেই। ওপরওয়ালাও বুঝি তার মনের ইচ্ছেটা কবুল করেই আজ শিউলির খোঁজ নেওয়ার দিকে তাকে ঠেলে দিয়েছেন৷ প্রায়ই বোনের খোঁজ নেয় সে কিন্তু আজকের খোঁজটা যেন আলতার দর্শনের খাতিরেই ছিল৷ ফোন হাতে আলতা সালাম দিতেই শিশির প্রথম প্রশ্ন করলো, “তুই এখানে আসবি কই কাল তো কিছু বললি না?”
“আমিও জানতাম না। শরত ভাই রাতেই বলল মামীর সাথে আসতে।”
“সকালেও তো একটাবার বলতে পারতি।”
“আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই আম্মা টিউশনিতে চলে গেছে।”
“ওহ তু…”
“শহরে পড়াশোনা করতে কেমন খরচ পড়ে শিশির ভাই?”
শিশিরের কথার মাঝেই আলতা প্রশ্নটা করে বসলো। গত কয়েকদিনের চিন্তাভাবনায় সে কোন কিছুতে স্থির হতে পারছিলো না কিন্তু আজ এখানে বসে হঠাৎ করেই ঠিক করে নিলো সে দূরে থেকে পড়াশোনা করবে। হয়ত কোন চাকরি করা এখন সম্ভব হবে না কিন্তু টিউশনি তো সে করতেই পারবে। সে শুনেছে মা নাকি কলেজে ভর্তি হয়েই মাস্টারি করে পড়াশোনা করেছে আবার তার জন্ম, খাওয়া পরা সবই করেছে গ্রামে থেকে। তবে সে কেন শুধু নিজের পড়াটাই চালাতে পারবে না! অন্তত চেষ্টা তো করে দেখতে পারবে৷ মামা আর মামীদের কথাগুলো তার মনে পড়ে যেদিন শিশির ভাইদের ঘরে সবাই বসে আলোচনা করছিলো মায়ের বিয়ে নিয়ে। সত্যিই তো একটা সময়ে তারও বিয়ে হয়ে যাবে ভাগ্য ভালো হলে সেও স্বামীর সংসারে ব্যস্ত জীবন কাটাবে তখন তার মায়ের কি হবে! মায়ের তো সে ছাড়া আর কেউ নেই পাশে থাকার মত৷ আর এই যে শিউলি আপার বিয়ে হয়েছে এখন তো সে চাইলেও যখন তখন মামীর কাছে যেতে পারে না। মামীর সান্ত্বনা শরত ভাই আছে একসময় হয়ত তার বউ আসবে বাচ্চাকাচ্চা। মামী কখনোই একা থাকবে না কিন্তু তার মায়ের তো তেমন কিছু নেই৷ শিশির কোন কিছুই বলল না শুধু অপলক তাকিয়ে রইলো আলতার দিকে। অন্যসময় শিশির ভাইয়ের চোখে তাকাতে আলতার খুব লজ্জা লাগে কিন্তু আজ আর তা হলো না বরং সেও পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আমি চাই আম্মার আবার বিয়ে হোক। আম্মার একটা সংসার হোক আমি শহরে থেকে পড়াশোনা করবো। নিজেই কিছু করতে চাই এখানে থাকলে আম্মা আমাকে মাথায় তুলেই রাখবে। আর আমায় আগলে রাখতে গিয়ে শেষ বয়সে আম্মার কেউ থাকবে না একদম একা হয়ে যাবে আমি এমনটা চাই না শিশির ভাই।”
কান্নার স্রোত ঠেলে উঠলো দু চোখের পাতায়। অবিশ্বাস্য লাগছে শিশিরের সে এই মাত্র যা শুনলো সবটা কি তার চঞ্চল, বোকা আলতাই বলল!
কিছু সময় শিশির চুপ থেকে বলল, “এখানে একা তুই থাকতে পারবি আলতা?”
“পারবো।”
“কান্না থামা, শহরে থাকতে গেলে তোকে অনেক কষ্ট করতে হবে৷ তুই নিজেকে স্বাবলম্বী করবি ভালো কথা কিন্তু ফুপুআম্মার বিয়ে নিয়ে কি করে ভাবলি? তাঁর যদি বিয়ে করার ইচ্ছে থাকতো তাহলে তো সেই কবেই করতো যখন তুই ছোট ছিলি। তুইও নিশ্চয়ই জানিস আব্বা ফুপুআম্মার জন্য বিয়ের প্রস্তাবও খুঁজেছিলো কয়েকটা। একটা তো এলাকায়ই ছিলো জহির কাকা! আজও কিন্তু তিনি ফুপুআম্মাকে ভালোবাসে।”
“আমি জানি। কিন্তু আম্মাকে যে করেই হোক রাজী করাবো আর তা আমি দূরে যাওয়ার আগেই।” আলতার দৃঢ় সংকল্প যেন এ কথায়। শিশির তৎক্ষনাৎ কিছু বলল না আর। আলতা আর জয়তুন টানা পাঁচদিন কাটিয়ে পরে ফিরলো বাড়ি। এই পাঁচ দিন আলতার কষ্ট হয়েছে মায়ের থেকে দূরে থাকতে তবুও থেকেছে। এটাই ছিল তার প্রথম চেষ্টা নিজেকে একলা করার। বাড়ি ফিরতেই জানতে পারলো মা-বাবার লিগ্যাল তালাকের ডেট দু দিন। মনে মনে প্রস্তুতি নিলো আলতা এই তালাকের পরপরই সে মামার সাথে কিছু কথা বলবে এবং তারপর হয়ত মাকেও বলতে হবে। যেদিন বাবা মায়ের সেপারেশন হলো সেদিন আলতাকে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল নিজে থেকে প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল সে কার কাছে থাকবে! যেই মা তাকে জন্ম দিয়েছে, তাকে এতজীবন আগলে রাখলো নিঃসন্দেহে সিদ্ধান্তের তালিকায় তারই নাম থাকবে এবং ছিল। আওলাদও এ নিয়ে আলাদা প্রত্যাশা রাখেনি। দ্বিতীয় একটা সিদ্ধান্ত সে নিজে সকলের সামনে রেখেছে তা হলো কখনো হয়ত ইচ্ছে হলে বাবার কাছেও যাবে। নকশি মন খারাপ করেনি এটা শুনে একটুও৷ আওলাদ নিজেই তুলেছে মেয়ের খরচের কথা যা নকশি মনে মনে না করলেও আলতার নিজ থেকে সম্মতির ফলে নকশি মনের কথা মুখে তুলতে পারেনি। সে বলেছে সে পড়াশোনা করবে অনেক বাবা তার সাধ্যমত যাই দেবে আলতা নেবে। সকল ফরমালিটি পূরণের পরই নকশির মনে হলো একটা বোঝা সরে গেল বুক থেকে। আওলাদের স্ত্রী অনেক কিছুই করেছে এই দেড় বছরে। কিছু কিছু আওলাদ টের পেলেও নকশির সাথে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর কখনো কথা হয়েছে তা জানতো না সে। বাবা মায়ের বিচ্ছেদ খুব একটা কষ্ট দিলো না আলতাকে। সে বাড়ি ফিরে প্রথমেই ফোন নিয়ে শিশিরকে কল দিলো। শিশির তখন টিউশনিতে থাকায় কল কেটে দিলো। আলতার কি হলো কে জানে সে বারবার দিতে থাকলো। একটা পর্যায়ে শিশির কোন বিপদাপদ ভেবে কলটা তুলল আর তখনি কানে তালা লাগা অবস্থা।
“কি সমস্যা এতবার ফোন দিলাম বোঝেন না আমার এখনই কথা বলতে হবে!”
চলবে
ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
(প্রথম খন্ডের সমাপ্তি)
সন্ধ্যের আকাশটা বড্ড ধূসর হয়ে আছে আজ। পশ্চিম কোণে হেলে পড়া সূর্যের রঙ আরো আগেই ঢাকা পড়েছে ছাইরঙা মেঘে। মাগরিবের আজান হবে হবে সময় হয়ে আসছে আজ তবুও নকশি বাড়ি ফেরেনি। অথচ আজ তার বিকেলের টিউশনিটাতে ছুটি আছে। সকাল থেকে আলতার পেটে দানাপানি যায়নি নকশির যায়নি বলে৷ মনে মনে প্রচণ্ডরকম হতাশ হয়ে আছে সে। এখন মনে হচ্ছে যা করেছে হয়ত ভুল করেছে। মা তার হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে সেটা স্বাভাবিক। প্রত্যেক মা-বাবাই নেয় সন্তানের ভালোমন্দের সিদ্ধান্ত। কিন্তু কোন সন্তান কি পারে মা-বাবার জীবনের তাদের ভালো থাকার সিদ্ধান্ত নিতে! অল্পবয়সী, অপরিণত মস্তিষ্ক এত ভারী ভারী চিন্তা ধারণ করতে পারে না তবুও সে অনড় রয়েছে এখনো। আর সবটাই হয়েছে শিশির ভাইয়ের জোরে। দেখতে দেখতে সময় হয়ে এলো পরীক্ষার রেজাল্টের এদিকে হোস্টেলও ঠিক করা হয়ে গেছে। মাসের প্রথম দিনই সে উঠতে পারবে বলে জানিয়েছে শিশির ভাই। কিন্তু আপাতত কোন টিউশনির ব্যবস্থা হয়নি আর হওয়ার সম্ভাবনাও নেই বলেই জানিয়েছে। বর্তমান কম্পিটিশনের যুগে অনভিজ্ঞ, মেট্রিক পাস কোন টিচার সন্তানের জন্য চান না অভিভাবকেরা। তবুও শিশির নিজের পরিচিতদের মাঝেই খোঁজ লাগিয়েছে কোন ব্যবস্থা সম্ভব হয়নি। আলতা তা শুনেও ঘাবড়ায়নি৷ তার একটাই ভাবনা এখন গ্রাম ছেড়ে দূরে যাওয়া। মায়ের সাথে কথা না বলে সে আজ দুদিন কাটিয়ে দিয়েছে৷ দু দিন আগের ঘটনা, আওলাদ এসেছিলো এক হাড়ি রসগোল্লা নিয়ে। তার নতুন ব্যবসায় বড় অংকের একটা লাভ হয়েছে। ব্যবসায়ের দিকে তার মাথা খুব পরিষ্কার এটা সে আগেও বুঝতো কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ভালো ফল পাবে নতুন ব্যবসায় তা বুঝতে পারেনি। তাই খুব শখ করেই এসেছিল মেয়েকে মিষ্টিমুখ করাতে আর একটা কথা নকশিকে জানিয়ে রাখতে। মেয়ের বড় হয়েছে তাই মেয়ের শুধু পড়াশোনা না আরও অনেক দিক ভেবে রাখতে হবে বলে কথাটার ইঙ্গিত দিয়েছে। নকশি খুব একটা রা করেনি এ বিষয়ে তার চিন্তা আপাতত মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করা। আওলাদ যখন কথাটা তুলেছিল তখন আওলাদের পাশেই আলতা বসা ছিল আর নকশি ছিল তাদের মুখোমুখি। আওলাদ আবারও বলল, “মাইয়ার ভবিষ্যত বলতে শুধু বিয়া উদ্দেশ্য করি নাই আমি।”
এ কথাতেই চকিতে তাকালো নকশি৷ আওলাদ আবার বলল, “মাইয়ার নামে আমি কিছু জায়গা-জমি কিনতে চাইতাছি আর সেজন্যই জানতে চাই কোন এলাকায় জায়গা কিনলে ভালো হইবো। আমি অরে ছোট দেখি নাই, লালন-পালন করি নাই, অর সাধ-আহ্লাদ এমনকি অর দরকার জিনিসটা কি আর কেমন হইতে পারে সেই আন্দাজটাও নাই। তুমি একলা হাতে মানুষ করছো তাই তোমার অধিকারই বেশি অর ভালোমন্দ দেখার। ছোট থাইকা এই এলাকায় মানুষ হইছে ও আর জন্মের দায়ে অন্য এলাকার মাইয়া। কিন্তু ভবিষ্যতে বিয়া হইলে হয়তো আবার অন্য আরেক এলাকার হইয়া যাইব কিন্তু এখন তো জানি না সেইটা কোন জায়গা তাই অর জন্য জায়গা জমি ঠিক কোনহানে কিন্না রাখলে ভালো হয় তুমি যদি কইয়া দিতা…?” আওলাদ দ্বিধায় ভুগতে ভুগতেই কথাগুলো বলে ফেলল একদমে৷ সে তার জমানো কিছু টাকা পয়সা আর বর্তমান ইনকাম সব মিলিয়ে তিন সন্তানের জন্যই জমি কিনবে ভেবেছে৷ দুই ছেলের জন্য জায়গা ঠিকও করা হয়ে গেছে বাড়ির পাশেই কিন্তু আলতার ভাগের জমি নিয়েই সে নিজে কিছু ভাবাতে চাইলো না। মন তো তার চেয়েছিল বাড়ির পাশেই কেনে এতে করে যদি ভবিষ্যতে মেয়ে সেখানে থাকে যদিও মেয়ে বিয়ে দিলে শ্বশুর বাড়ি থাকবে বাবা হিসেবে এটাই প্রার্থনা। তবুও সে নকশির অনুমতি ছাড়া কিছুতেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস করবে না মেয়ের ব্যাপারে। মনে মনে সে কৃতজ্ঞ নকশির কাছে তার থেকে পিতৃদায় উঠিয়ে না নেওয়ার জন্য। আর এই নিয়েই অনেক কথার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আলতার জন্য জমি এই গ্রামে এমনকি এ বাড়ির আশেপাশেই কিনবে। আলতা চুপচাপ বাবা মায়ের সব কথা শুনলেও মনে মনে ভাবছিলো সে একটা কথা বলবে কিন্তু কি করে বলা ঠিক হবে তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলো না। কিন্তু সময় বয়ে যাওয়ার পর কথাটা বলেও তো লাভ হবে না। বাবাকে যখন বসা থেকে উঠতে দেখলো তখন আর ভাবাভাবিতে না থেকে বলে উঠলো, “যদি জায়গা না কিনে ওই টাকাটা আমারে দেন আব্বা!”
আলতার কথাটা প্রথমে বুঝি বাবা আর মা কেউ বুঝলো না। কয়েক সেকেন্ডেই নকশি প্রথমে বুঝলো আর তাতেই ভীষণ অবাক হয়ে তাকালো আলতার দিকে৷
“তুই এত টাকা দিয়ে কি করবি?”
আওলাদ বোঝার চেষ্টা করছে কি বলল আলতা আর কি বলছে নকশি। নকশি এবার রেগে তাকালো মেয়ের দিকে, “তোর বাবা তোকে কদিন পরপরই টাকা দেয় আর তা দেখেই কি তোর কলিজা বড় হয়ে গেছে আলতা? এজন্যই আমি টাকা পয়সা নিতে দিতে চাইতাম না তোকে।”
“কি বলতাছো এইসব নকশি?” আওলাদ তখনো বুঝলো না আলতা টাকা চেয়ে কি এমন করে ফেলছে! আলতাই মুখ খুলল এবার, “আব্বা আমি শহরে থেকে পড়াশোনা করতে চাই। সেখানে খরচটা অনেক তাই বলছিলাম কি জমি কিনতে হবে না আমার জন্য যদি ওই টাকায় আমার পড়ার খরচ দিতেন?” একটু ইতস্তত না করে আলতা তার কথা বলল। নকশি মেয়ের কথায় রেগে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে। সে তো আলতার ইচ্ছে পূরণের জন্যই আহসান ভাইয়ের সাথে কথা বলেছিলো কদিন আগেই৷ একটা চাকরি জুটাতে পারলেই চলে যেত ঢাকায়। আহসান ভাইও বলেছে তাঁর পরিচিত মানুষ আছে তিনি যোগাযোগ করে চেষ্টা করবেন একটা কিছু করার। কিন্তু আলতা যে আওলাদকে এভাবে বলবে তার কাছে পড়াশোনার টাকা চাইবে এটা ভাবেনি নকশি৷ কিন্তু নকশিকে মেয়ের চেয়েও দ্বিগুণ অবাক করে দিলো মেয়ের বাবা। আওলাদ তো মেয়ের কথা শুনে আমুদে গলায় আরো একধাপ এগিয়ে বলল, “তুমি যা কইবা তাই হইবো আম্মা। পড়ালেখার জন্য তো দিবোই কিন্তু জমিটাও কিন্না রাখতে চাই। এখন হাতরথ আছে কামাই ভালোই করতাছি। কবে কি হইয়া যায়, কবে বিছনায় পইড়া যাই তার কি কোন ঠিক আছে! এইজন্য আমি এই জায়গাখানি কিনতে চাইতাছি। নকশি আমারই ভুল হইছে। আমি আগেই ঠিক কইরা রাখছিলাম মাইয়ার পরের পড়ালেখায় আমি আমার সাধ্যমত দিয়া যামু তোমার কাছে অনুরোধ এই নিয়া মাইয়াডারে কিছু কইয়ো না।”
“তাই বলে ও একটাবার আমাকে না জানিয়েই আপনার কাছে টাকার কথা বলবে! আমি নিজেই খোঁজ লাগাচ্ছি ঢাকায় একটা চাকরির৷ হয়ে গেলেই ওকে নিয়ে চলে যাব।” নকশির এ কথার মত বিষ্ফোরিত চোখে চাইলো আলতা। মা’ও যাবে তার সাথে শহরে! সে তো শিশির ভাইকে বলে কয়ে অনুরোধ করে হোস্টেল রুম এর ব্যবস্থা করিয়েছে মায়ের থেকে লুকিয়ে৷ বুকটা ধড়ফড়িয়ে উঠলো যেন এবার৷ সে তো মামাকে বলেছে মায়ের বিয়ে দিতে চায় যে করেই হোক। মা যদি তার জন্য শহরে চলে যায় আবারও তাকে সাথে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করবে। সে জীবনে আবারও সে ছাড়া মায়ের কেউ থাকবে না। আবারও তার জন্য মায়ের একলা জীবন তার জন্য মায়ের সুখ উৎসর্গিত। নাহ, অনেক হয়েছে এবার আর তা হবে না। সে আর কোন কিছু না ভাবতে পেরে সরাসরি বলে দিলো, “তোমার যেতে হবে না আম্মা আমি হোস্টেলে থেকে পড়বো। শিশির ভাইকে বলে রুমের ব্যবস্থা করিয়েছি৷ রেজাল্টের মাত্র কয়েকদিন বাকি৷ ভর্তির সময় হলে শিশির ভাই জানাবে বলছে।” আলতার কথা শেষ হওয়ার পর দুটো সেকেন্ডও বোধহয় পার হয়নি আলতার গালে কষে এক থাপ্পড় লাগিয়েছে নকশি। আকস্মিক থাপ্পড়ে আলতা খুব একটা না ভড়কালেও আওলাদ চমকে উঠেছে। নিজের অজান্তেই সে ধমকেও উঠছে নকশিকে৷ তারপরই মনে হলো এখানে তার গলা উঁচিয়ে কিছু বলার অধিকার নেই। আলতার দিকে তাকিয়ে রাগে, ক্রোধে নকশি বলতে লাগলো, “তোর এত সাহস হয় কি করে এত কিছু করার? কলিজা বেশ বড় হয়ে গেছে কি বাপকে দেখে? ”
কথাটা ইচ্ছাকৃত আওলাদকে অপমান করার উদ্দেশ্যে না হলেও কথাটা আওলাদের মনে লেগেছে। বোধকরি, নকশির নিজের কানেই লেগেছে বিশ্রীভাবে। কিন্তু মুহূর্তে অতিরিক্ত রাগে আর সেদিকে মন না দিয়ে সে পুনরায় হাত তুলতে যায় আলতার গায়ে আর তখনি আওলাদ হাত ধরে ফেলে তার। ঘটনাটা এত দ্রুত এতোটাই যে শিফা আর জয়তুনও ঝগড়া বিবাদ মনে করে দৌড়ে আসেন। নকশি থেমে যায়, দু চোখ ভরে তার অশ্রুর খেলা শুরু হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় আর আওলাদ চলে যায় মাস্টার বাড়ি থেকে৷ এরপর দু দিন চলে গেল নকশি মেয়ের সাথে কথা বলে না। আলতা সেদিন রাতেই মাফ চেয়েছে, কান্নাকাটি করে নিজের কথাতেই অটল ছিলো তাই হয়ত নকশি এত নারাজ৷ কাল তবুও রান্নার পর নকশি স্কুলে যাওয়ার আগে নিজে খেয়ে আলতার জন্য খাবার বেড়ে রেখে গেছে। কিন্তু আজ সে খেয়ে যায়নি শুধু মেয়ের খাবার গুছিয়ে রেখে বেরিয়েছিলো। দুপুরে খেতে আসেনি সন্ধ্যে পেরিয়ে যাচ্ছে বাড়িও ফেরেনি৷ চিন্তায় অস্থির হয়ে আলতা শিফাকে বলল মাকে ফোন করতে৷ আকশ অন্ধকার হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। মাগরিবের আজান পড়েছে বলে শিফা ওজু করে সবে নামাজে দাঁড়িয়েছে৷ কিছুসময় চুপচাপ শিশিরদের দরজার সামনেই বসে রইলো আলতা। শিফা নামাজ শেষ করে তাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে? ‘মা আসেনি এখনো’ কথাটা বলতেই শিফাও চিন্তিত হলো। এতোটা দেরি নকশি কখনোই করে না আর যদি দেরি হয় তবে নিশ্চয়ই শিফা কিংবা জয়তুনকে ফোন করে জানিয়ে দেয়। তড়িঘড়ি শিফা নিজের ফোন থেকে নকশিকে ফোন করলেও ওপাশ থেকে তোলা হয় না তা দেখে আরো ভয় পেয়ে যায় আলতা। চিন্তায় এবার শিফা আহসানকেও ফোন করলো। আহসান শুধু বলল, “চিন্তা কোরো না নকশি আসছে কিছুক্ষণের মধ্যেই।”
রাতের আঁধার আরো গাঢ় হয়েছে। গাছে গাছে পাখির হুটহাট ডানা জাপটানোর আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই কানে আসে না। নকশির ক্লান্ত শরীরে মাত্রই চোখ লেগে এসেছে, নিশ্বাসের ভারী আওয়াজ কানে আসছে আলতার। সে ঘুমায়নি এখনো। বহুকষ্টে ঘুমকে হার মানিয়ে জেগে আছে শিশিরকে একটা মেসেজ করবে বলে। মা ঘুমিয়েছে টের পেতেই সে আলগোছে বালিশের তলা থেকে ফোন বের করে কাঁথা মুড়ি দিলো৷ কাঁথায় ডুবে কাঁপা কাঁপা হাতে অনেক কষ্টে লিখলো, “আম্মার বিয়ে ঠিক করতাছি।”
রাত বাজে এগারোটা তিন; শিশির সবে একটা নোট বের করে চোখ বুলাচ্ছিলো তাতে। ক্লাসে আজকাল নিয়মিত উপস্থিত থাকে সে কিন্তু কেন জানি মনটা ঠিকঠাক লাগে না। লেকচার শোনে, লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়াশোনাও করে অথচ সব কিছুই কেমন জানি থমকে আছে তার। মনটা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে পড়ছে আলতাকে নিয়ে। আজ অনেকটা জোর জবরদস্তিই কিছু একটা পড়ার চেষ্টা করছে কিন্তু মনটা লাগছে না। টেবিলের ওপর রাখা ফোনটা হঠাৎ বিপ বিপ শব্দ করতেই সেদিকে তাকালো। স্ক্রীণে ভাসা ফুপুআম্মা নামটা দেখেই ভীষণরকম চমকালো। কালই তো ফুপুআম্মা ফোন করেছে তাকে এবং আলতাকে এভাবে উসকানো নিয়ে খুব করে রাগ ঝেড়েছে। শিশির অনেকবার ক্ষমা চাওয়ার পরও আর নকশি কোন কথা বলেনি। আজ সারাদিনে সে বহুবার ফোন করলেও নকশি তোলেনি আর এখন এই ছোট্ট বার্তাটুকু দেখার পর মনে হলো বাড়িতে তবে বড়সড় কিছু হয়েছে। সেটা জানারও অপ্রতিরোধ্য কৌতূহল জাগছে কিন্তু সেদিকে না পাত্তা দিয়ে সে পাল্টা একটা বার্তা লিখলো আলতার উদ্দেশ্যে, “আমার হাতের থা’প্পড় খাস না অনেক দিন হলো তাই নারে! কয়টা বাজে এখন?”
আলতার ধারণা নেই শিশির ভাই রাতে কখন ঘুমায় বা কতক্ষণ জেগে থাকে। পাল্টা মেসেজ পেতেই সে ভয় পেয়ে গেল। তবে কি শিশির ভাই রেগে গেল তার এত রাতে মেসেজ দেখে কিন্তু তারই’বা করার কি ছিলো! আজ সন্ধ্যারও অনেক পরে যখন মা বাড়ি এলো তখন সঙ্গে এলো বুড়ো মতন এক লোক আর একজন মহিলা। মহিলাটির বয়স তার মায়ের থেকে খুব বেশি নয় শিফা মামীর বয়সী লেগেছে। মা বলেছে মহিলাটি তার মায়ের বড় বোন আর বুড়ো লোকটি তাঁর বাবা। আলতা যারপরনাই অবাক হলেও তখন সে খুশি ছিলো মা ফিরে এসেই তার সাথে কথা বলেছে। আর তারপরই সেই মানুষ দুটো তাকে আদর করে কাছে টেনে নিয়েছে। নানা তাকে ধরে সেকি কান্না আবার খালাম্মাও কাঁদলো। আরো অনেক কথাবার্তার পর জানতে পারলো তার নানী মারা গেছে তবে মামা, মামী আত্মীয়-স্বজন মায়ের দিককার আরো অনেক আছে। এবং সর্বশেষ সে যে চমক পেয়েছে তা হলো নানা যাওয়ার সময় আহসান মামাকে বলেছে মায়ের জন্য পাত্র দেখতে আলতার জন্য যেন না ভাবে। আলতাকে তিনি নিজের কাছে নিবেন। যেই খালাটি এসেছে তার তিনি নিঃসন্তান আলতার দেখাশোনা নিয়ে ভাবতে হবে না। নানা অবশ্য জেনেছেন আলতার বাবাও তার খোঁজ নেয়, অনেক আগে থেকেই আবার তার খরচপাতিও অনেক দেয়। নানা শুনে আলহামদুলিল্লাহ বলেছেন৷ আর কোন চিন্তা নেই এবার মাকে যতোটা সম্ভব জোর করে হলেও একটা নতুন সংসার, নতুন সঙ্গী এবং এমন একজন সঙ্গী খুঁজে দিবেন সবাই মিলে যে কিনা তার মাকে বাকিটা জীবন আগলে রাখবে৷ সহজ ছিলো না এতবড় সিদ্ধান্ত নেওয়াটা তবুও সারাটা সন্ধ্যা নানা, খালা কান্নাকাটি করেছে তাদের সাথে আলতাও তাল মিলিয়েছে। নকশি আগেরবার বিয়ের কথা শুনে প্রচণ্ড রেগেছিলো৷ আজও রেগেছে তবে আজ একটা সময় ক্লান্ত হয়ে হ্যাঁ বা না কোন কিছুতেই আটকে নেই৷ আহসান বিচক্ষণ মানুষ সে সবাইকে থামিয়ে শুধু কিছু কথা বলেছে নকশিকে এবং প্রতিটা কথাতেই সে স্পষ্ট জানিয়েছে আলতা মন থেকে চায় তার মায়ের একটা সংসার হোক। সে বড় হচ্ছে, ভালোমন্দ বুঝতে শিখছে নিশ্চয়ই সে নিজেকে প্রস্তুত করেই এতখানি জেদ করছে! দ্বিতীয় বিয়ে এবং মধ্য বয়সে বিয়ে কোনটাই অন্যায়ের নয়। শুধু দেখতে হবে মানুষটা যেন সঠিক হয় বাকিটা জীবন যেন পাশে থাকার মত হয়। সবাই যত যাই বলুক নকশির বুকে কাঁপন ধরে নিজের আবার একটা সংসারের কথা ভাবতেই। ভয় হয় মেয়েটা যদি তার থেকে দূরে সরে যায়! যদি মেয়েটার প্রতি কোনপ্রকার অবহেলা হয়ে যায়! সে কাউকে বোঝাতে পারে না নিজের ভেতরে চলা কালবৈশাখী তান্ডব। সবাই তার বয়সটা দেখে, তার এখনও বিয়ে দেওয়াটা অন্যায় না ভাবে কিন্তু কেউ ভাবে তার পুনরায় বিয়ে মানেই জীবনে একটা নতুন দ্বায়িত্ব আর এই দ্বায়িত্বের বেড়াজালে আটকে মেয়েটা যদি ভাবে মাও বাবার মত তার থেকে দূরে চলে গেছে! সকালেই নকশির বাবা আর বোন আওলাদের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে পদ্মদিঘি গ্রামে এসেছিলো আহসান মাস্টারের দোকানে। নকশি তখন টিউশনিতে জানে আহসান তাই সে তাদের কিছু সময় অপেক্ষা করতে বলল দোকানেই৷ এরপর যখন ঘড়ির কাটা ঠিক দশটায় তখন আহসান নকশিকে ফোন করে বলল দেখা করতে৷ এরপরই নকশি এসে তার বাবা আর বোনকে দেখে৷ কত কান্নাকাটি, বাবার ক্ষমা চাওয়া অতীতের জন্য। প্রথমে নকশি নিজেকে কঠিন করে রাখলেও বেশিক্ষণ সম্ভব হলো না৷ যতোই হোক জন্মদাতা বলে কথা এরপর মায়ের মৃত্যু ভাইদের বাবার প্রতি বাজে আচরণ সবটাই শুনে আর ধরে রাখতে পারেনি নিজেকে। বাজারে বসে এত কিছু লোকচোখে ভালো দেখায় না ভেবেই আহসান বাড়ি নিয়ে যেতে বলল তাদের। কিন্তু নকশির বাবা হঠাৎ বললেন তিনি এখনই নকশিকে নিজের বাড়ি নিয়ে যাবেন কোন এক জরুরি কাজে৷ নকশির বোনও তাই বলল আর তাই বাধ্য হয়েই বাবা আর বোনের সাথে নিজের গ্রামে গেল। প্রায় ষোলো বছরেরও বেশি সময় পর পা রাখলো নকশি নিজের বাবার ঘরে৷ আবেগে, দুঃখে দিনটা প্রায় শেষ হয়ে গেল তাদের বাবা, মেয়েদের কান্নাকাটিতে। নকশির খোঁজ পেয়ে বাবা আর তার দুই বোন খুব খুশি হলেও তার ভাইয়েরা কেউ মনে মনে খুশি নয়। এত বছর নিখোঁজ দেখে তারা ভেবেই নিয়েছিলেন সম্পত্তির নকশির ভাগটা বুঝি তারাই গলাধঃকরণ করবে। কিন্তু সে আশায় বালি পড়লো নকশির কথা জানতে পেরে আর তাই হয়ত তাকে বাড়ি আসতে দেখে খুব একটা কাছে ঘেঁষেনি, ভাই-ভাবী আর তাদের সন্তানেরা। নকশির বাবা যেই কাজের জন্য নকশিকে নিয়ে এলেন সঙ্গে করে সেই কাজটা চুপিসারেই সেরে নিলেন। খুব সম্ভবত ছেলেদের মনোভাবনা বুঝতে পেরেই তিনি কাউকে না জানিয়ে তিন মেয়ের ভাগের জমির আলাদা কাগজ তৈরি করেছেন। সময় করে বড় দুই মেয়েকে সইসাবুদে তা হস্তান্তরও করছেন ছেলেদের না জানিয়ে। বাকি ছিলো নকশিরটা আজ সেটাও শেষ করলেন। প্রথম দফায় নকশি রাজী হচ্ছিলো না এভাবে সবাইকে না জানিয়ে জায়গা জমি নেবে কিন্তু তার বাবার কিছু যুক্তির কাছে হার মানলো। সত্যিই তো তার নিজের বলতে একটা জমি থাকলে ভালো হবে অন্তত মেয়েকে নিয়ে মাথা গোঁজার একটা স্থায়ী ঠিকানা রইলো। সারাজীবন তো আর আহসান ভাই আর তার পরিবারের ওপর বোঝা হয়ে থাকা যায় না। তারা দয়ালু মানুষ অনেক করেছেন এতগুলো বছরে অন্তত নিজের পরিবারের মানুষ গুলো তার সিকিভাগও করেনি। সইসাবুদ শেষে নকশি ফিরে যাচ্ছিলো পদ্মাদিঘি আর তা দেখেই নকশির বাবা বায়না ধরলো নাতনিটিকে একবার দেখবেন আজই। তাই বাবা, মেয়েরা মিলে আসতে গিয়ে অনেকটাই দেরি করে ফেলেছে। নিজেদের আবেগ আর অতীতের দুঃসহ যন্ত্রণার নির্মমতার পর বাবা, মেয়ের সাক্ষাতে সারাটাদিনেও নকশি মেয়েকে ফোন করতে পারেনি। বলা যায়, কিছুটা নিশ্চিন্ত ছিলো এই ভেবে হয়ত, আহসান ভাই সকালেই জানিয়েছেন বাড়িতে। কিন্তু তিনিও কাজের ব্যস্ততায় আর মনে রাখেননি ব্যাপারটা। আর সন্ধ্যার পরই নকশির বাবা আর বোনকে নিয়ে বাড়ি ফিরতেই দেখতে পেলো আলতার কান্নামাখা মুখ। সকল কান্নার অবসান হয়ে গেল আলতার যখন নানা বলে গেল তার মায়ের বিয়ে দিতে চান। সে কথাটা শুনেই নিজের মনের কথাটাও প্রকাশ করেছিলো অকপটে। সেও চায় তার মায়ের আবার বিয়ে হোক এবং সুন্দর আর স্থায়ী ঘর হোক। আহসান অবশ্য নকশির নানাকে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন পাত্র একজন আছেন যে সবদিক থেকেই নকশির যোগ্য কিন্তু সরাসরি নামধাম কিছুই বলেননি৷ আগে নিশ্চিত তো হওয়া যাক নকশি মতামত নিয়ে কারণ আগেও একবার এসব নিয়ে কথা তুলে কোন ফায়দা হয়নি৷ তবে এবার সবাই মিলে বোঝালে হয়ত কাজের কাজ হতেও পারে কিছু৷
সকাল নয়টা থেকে দুপুর দুইটা একটানা আজ পাঁচটা টিউশনি সেরেছে শিশির। সপ্তাহের ছুটির দিন এবং সন্ধ্যের পর নিজের কিছু কাজ থাকায় স্টুডেন্টদের অভিভাবকদের অনুরোধ করেই সকালে পড়িয়েছে আজ। তার পড়ানোর সময় বিকেল থেকে রাতের মধ্যে অথচ হুট করে সেই সময় গুলো পাল্টে একদিনের জন্য সকালে পড়ানোটা স্টুডেন্টগুলোর কারোই ভালো লাগছিলো না। তবুও ভাগ্যের প্রসন্নতায় সুযোগ পাওয়া গেল এবং টিউশনিগুলো শেষ করেই হোস্টেলে ফিরেছে সে। আজ নাশতা করেছিলো এক কাপ চা আর এক প্যাকেট এনার্জি বিস্কিটে। গরম আবহাওয়ায় দরদর করে ঘাম বেয়ে সারা গা ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে দুপুরের আগেই৷ পেটের ভেতর খিদেটাও যেন তবলা বাজিয়ে চলেছে৷ অথচ তার সেদিকে খেয়াল দেয়ার সময় নেই। হোস্টেলে ফিরে গোসল সেরে কাপড় বদলে দ্রুত আবার বের হয়ে গেল হোটেলেই খাবার খাবে বলে। হলের পেছনের রাস্তা থেকে একটু সামনে একটা পছন্দের হোটেল থেকে ভুনা খিচুড়ি কিনে খেলো। হাতের ঘড়িটাতে সময় দেখলো তখন তিনটা পেরিয়ে গেছে৷ কথা ছিলো সোহা, তন্ময় ,আর অনু আসবে টিএসসিতে ঠিক চারটায়। সময় কম তবুও তাদের আগেই সে হাজির হতে পারবে। তার আজকের জরুরি কিছু কাজের মধ্যে প্রথম কাজটা হলো মিষ্টি কিনে নিয়ে যেতে হবে বন্ধুদের জন্য। খোঁচাটা অনুই মেরেছিলো কাল রাতে গ্রুপ কলে। আলতার রেজাল্ট পাবলিশ হয়েছে এবং সে শিশিরের মতোই রেজাল্ট করেছে৷ আলতাকে নিয়ে তন্ময় আর অনু একটা বাজি ধরেছিলো আলতা কেমন রেজাল্ট করবে এই নিয়ে। তারা আলতাকে খুব একটা না চিনলেও শিশিরের সাথে বন্ধুত্বের পর তারা না চিনেও আলতাকে খুব ভালো করে চেনে যেন৷ অনু আর তন্ময় দুজনেরই বক্তব্য ছিলো আলতার রেজাল্ট হবে শিশিরের মতোই জেলা ভিত্তিক প্রথম স্তরে৷ শিশির বাজি ধরেছিলো এমন কিছুই হবে না। আলতা একদম অলস আর পড়াশোনায় উদাসীন। সে হয়তো ভালো গ্রেড পাবে তাই বলে জেলায় নাম কামাবে! অসম্ভব। অথচ কাল যখন আলতার ফলাফল পাওয়া গেল অনু নিজেই তার ল্যাপটপে সার্চ করেছিলো শিশিরের কাছে থেকে রোল জেনে তখন বিষ্ময়ে খেই হারিয়েছিলো অনু আর শিশির নিজেও৷ এরপরই শুরু হলো আজ মিষ্টি খাওয়া, বসুন্ধরায় মুভি দেখানো এ দুটো কাজ করতেই হবে বাজির শর্ত পূরণের জন্য। শিশিরও নির্দ্বিধায় রাজী হয়ে বলেছে চলে আসতে সময় মত। সোহা জানতো না এই বাজির কথা তবুও শিশির বলল তাকেও যেন নিয়ে আসে। টিএসসিতে এসে শিশিরের চোখ কপালে। অনু শুধু সোহাকে না আরও চারজন ব্যাচমেটকে ধরে এনেছে। শিশির একবার নিজের ওয়ালেট চেক করো আর যাই হোক এই মুহূর্তে তার পক্ষে এতোগুলো মানুষের মুভি টিকেট কেনা সম্ভব নয়৷ মাসের শেষ হাতে এক্সট্রা টাকা নেই তা ভেবেই কিছুটা সংকুচিত হয়ে পড়েছিলো৷ আর তার অবস্থা খেয়াল করেই বোধহয় সোহা বলল, “শিশির আমার কাছে কার্ড আছে আর তাতে ব্যালেন্স এনাফ।”
কথাটা শুনে খুশিই হলো শিশির আর থ্যাংকসও জানালো সোহাকে। এই মেয়েটা তাকে বিপদে পড়লেই কেমন করে যেন টের পেয়ে যায় আর হাত বাড়িয়ে দেয় তার সাহায্যে। আর অনুটা একদম পাগলি তাই ভাবছিলো শিশির৷ সে আসার সময় সত্যিই মিষ্টি কিনে এনেছিলো আর টিএসসিতে বসে সবাই মিলে তা সাবাড় করলো৷ সন্ধ্যের আগ মুহূর্তে যখন সবাই মুভি দেখতে যাবে বলে উঠে দাঁড়ালো ঠিক তখনি অনু বলল, “আজ আর মুভির মুড নাই চল সবাই মিলে একটু হাতিরঝিল থেকে ঘুরে আসি।”
সোহা আঁতকে উঠেছিল শুনতেই। এখন এই রাত করে ওদিকে যাওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে মিথ্যে বাহানা করলো। অনু অবশ্য সহজে ছাড়ার পাত্রী নয়। জোরজবরদস্তি সবাইকে নিয়ে গেল হাতিরঝিলে। রাত প্রায় দশটা পর্যন্ত সেখানে কাটিয়ে ঝালমুড়ি, বেলপুরি আর বহুদিনের বাসি তাড়ি ( তরল পানীয়) খেয়ে তবেই ফিরেছে৷ অনুর এসবে সমস্যা হয় না সে নেশা জাতীয় আরো অনেক কিছুই খেয়েছে আগেও কিন্তু গন্ডগোল পাকালো সোহা। তার সহ্য হয়নি এসব তরল নেশাপানীয়। সে গাড়িতে বসেই বার দুয়েক বমি করে ফেলল। শিশিরেরও মাথাটা কেমন ভার ভার লাগছিলো খুব। রাতে আর হোস্টেলে ফেরা হলো না শিশিরের এবং দেখা হলো না রাতভরে তার ফোনের বার্তাঘরটায় জমেছিলো আলতার বিশের ওপর ছোট ছোট বার্তা। রাতটা সে এবং বাকি বন্ধুরা কাটিয়েছিলো অনুদের বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়িটাতে৷ সকাল হতেই ফোনটা হাতে নিতে চরম বিষ্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে রইলো শিশির অনেকটা সময়৷ আম্মার বিয়ের কথা পাকা করা হয়েছে কাল এবং পাত্র হচ্ছেন জহির কাকা। দীর্ঘ ষোলোটি বছরের অপেক্ষা শেষে জহির কাকার ভালোবাসা পূর্ণতা পেতে চলেছে। আলতা অনেক খুশি হয়েছে জহির কাকাকে তার মায়ের পাশে পাবে বলে। সেই সাথে সে শিশিরকে আরো একটা কথা লিখেছে যা সে হয়ত এ জীবনে আর কাউকেই বলতে পারবে না, বলবেও না৷ তার শেষের মেসেজটা ছিলো, “আমার ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে আমি অনেক খুশি৷ কিন্তু তবুও আমার ভেতরটা জ্বলছে কেন ? আমার অন্তঃসার শূন্য কেন লাগছে শিশির ভাই?”
দেখতে দেখতে আলতার হোস্টেলে ওঠার ডেট ঠিক হয়ে গেল। এরই মাঝে তার ভর্তি ব্যবস্থাও করে ফেলেছে শিশির সরকারি এক কলেজে। কলেজ সরকারি হলেও তার কোচিং আর পড়াশোনায় যেন ঘাটতি না থাকে তেমন কোচিং সেন্টারেরও খোঁজ লাগিয়েছে। আর এসবে অনেক বেশি সহযোগীতা করেছে সোহা। নকশি মন থেকে এখনও বিয়ে নিয়ে প্রস্তুত নয় অথচ এবার কিছুতেই সে কাউকে নিজের মনের অবস্থা বোঝাতে পারছে না। সবার এক কথা, বিয়েটাই হবে তার একমাত্র ভালো সিদ্ধান্ত। সে ভেবে পায় না যার বছর কয়েক গেলেই যার মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হবে সে কি করে এখন নিজের বিয়ের কথা ভাবতে পারে! কেউ মানে না সেসব কথা। বিয়েটা শুধু জৈবিক চাহিদার জন্য নয় যে বয়সের পরিসীমা দেখে করতে হবে। একটা বয়সের পর প্রত্যেকটা মানুষেরই একান্ত একজন সঙ্গীর প্রয়োজন হয়। এমন একজন সঙ্গী যার কাছে নিজের প্রতিটা মুহূর্ত উল্টেপাল্টে দেখানো যায় নির্দ্বিধায়। সন্তান যতোই আপন হোক কাছের হোক একটা সময় পর সেই সন্তানেরও একটা নিজস্ব জীবন আর তাতে হাজারটা নিয়ম কানুন তৈরি হয়। না চাইতেও একটা ফাঁকফোকর থেকেই যায় তখন সন্তানের সাথে। আর এই ফাঁকটা একমাত্র স্বামী বা স্ত্রীই পারে নিঁখুতভাবে ভরাট করতে। নকশির দ্বিধা দ্বন্দ্বে কেটে গেল অনেকদিন সময় আর এরই মাঝে অভাবনীয়ভাবেই জহির এসে উপস্থিত হলো। নকশিকে বিয়ে করে সে নিজের বাড়িতে নিবে তবে তার আগে সে একটা কথা পরিষ্কার করে বলে দিলো, আলতার দ্বায়িত্বও সে নিবে নিজের সন্তান ভেবে। আওলাদ পর্যন্ত কথাটা গেল আর আশ্চর্যের বিষয় আওলাদ আপত্তি তুলল। নকশি কিছু বলতে চাইলেও সে শুনলো না মুখের ওপর বলে দিল, “আমার মাইয়ার শুধু পড়াশোনা না সবরকম খরচ আমি চালামু। তুমি একলা হাতে অনেক করছো এইবার অন্তত আমারে এটুক করতে দিও। তুমি নিজে যা পারো কইরো কিন্তু অন্য কারো থাইকা নিও না আমার মাইয়ার প্রয়োজনের খরচ।”
সময়ের পরিক্রমায় অনেক কিছু ঘটে গেল মাত্র কয়েক দিনেই। হুট করেই যেন নকশি আর আলতার জীবন আলাদা হয়ে গেল। দেখতে দেখতে আলতার যাওয়ার দিন হয়ে গেল অথচ তার মায়ের বিয়েটা তখনও হয়নি। কেমন যেন একটা ঝুলন্ত অবস্থায় রয়ে গেছে বিয়েটা। সকাল থেকে আলতা নিজের সব গোছগাছ করতে বসেছে। প্রথমে বলেছিলো শিশির আসবে নিতে কিন্তু কারোই তেমন সমর্থন মিললো না এতে। শরত একবার বলেছিলো ফুপু আম্মা আর আমি যাবো আলতাকে নিয়ে সেটাই ভালো হবে। আওলাদ ফোন করে বলল সে যাবে সাথে। কিন্তু আলতা হঠাৎ বলে উঠলো, “আমি মামার সাথে যাবো।” তার এ কথায় আবদার ছিলো নাকি জেদ ঠিক বোঝা গেল না। তবে এতে যেন ভীষণরকম খুশিই হলো আহসান। নকশিও আর এ নিয়ে কথা তোলেনি। রাতের বাসে যাবে বলে শরত টিকিট কিনে এনেছে। বিকেলের রোদ মরে এলে কেমন একটা বিষন্নতা নেমে এলো আলতার মনে। তার মনে হলো সে এখান থেকে চলে যাওয়ার পর মা কিছু একটা করবে। হয়ত এই বিয়ের ব্যাপারটাতেই ঝামেলা করবে আর তাই সে অনেকটা চুপিচুপিই আহসান মামার সামনে কথা তুলল, “আজই যদি বিয়েটা হয়ে যায় তাহলে কেমন হতো মামা।” শান্ত দৃষ্টিতে কিছুটা সময় আহসান চেয়েছিলো আলতার মুখের দিকে। হয়ত বোঝার চেষ্টা করছিলেন মেয়েটার মনের ভেতরে চলা বাতাসটাকে৷ কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, “তুই যা ভাবছিস তাই হবে মনে হচ্ছে।”
এরপর সন্ধ্যের মধ্যেই আলতার নানাকে খবর দিয়ে আনা হলো, জহিরকেও জানানো হলো মেয়েটা থাকতে থাকতেই যদি রেজিস্ট্রিটা হয়ে যায়!”
জহিরের কিছুতেই আপত্তি নেই। নকশিকে পুনরায় বোঝাতে লাগল শিফা আর জয়তুন। সন্ধ্যের পরপর খুব সাধারণ আর মাত্র কয়েকজনের উপস্থিতিতে বিয়ের রেজিস্ট্রি আর কালেমা পড়ে কবুল বলা হয়ে গেল। এরপর থেকে নকশি কেমন থম মেরে চেয়ে রইলো মেয়ের দিকে। হয়ত বুঝতে চেষ্টা করছিলো মেয়ের ভেতরে কি চলছে! আলতা আর আহসান বাড়ি থেকে বের হয়েছে রাত সাড়ে নয়টায়। তার আগ পর্যন্ত নকশি শুধু নিষ্পলক চেয়েই ছিলো আলতার দিকে। একটা কথাও মুখ ফুটে উচ্চারণ করেনি সে। আলতাও মায়ের সেই দৃষ্টি একবার দেখতেই কেঁপে উঠেছিলো ভেতরে ভেতরে। তবুও তার মনে প্রশান্তি নেমেছে এই ভেবে, তার মায়ের সারাটা জীবন অন্তত তার পেছনে ক্ষয় হবে না। একটু হলেও নিজের জন্য সময় নেবে এবার৷ আলতা ভেবেছিলো তার যাওয়ার সময় মা খুব কান্নাকাটি করবে কিন্তু না শিফা, জয়তুন আর আলতা নিজেই কেঁদে ভাসিয়েছে শুধু তার মা ছাড়া। তার মায়ের মুখটা দেখে কেমন যেন মৃত মৃত মনে হচ্ছিলো। চোখের তারায় প্রাণের স্পন্দন ছিলোই না যেন। তবুও মন বলল এই বিষন্নতা, এই নিষ্প্রভতা ক্ষণিকের। নতুন একটা সময় আসবে প্রাণোচ্ছল আর ঝলমলে সে অপেক্ষায় থাকবে সেই দিনের।
(বাকি কাহিনিটুকু ২য় খন্ডে দেওয়া হলো।)