শেষ পাতায় তুমি পর্ব-৪৮+৪৯

0
3390

#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব৪৮|

পবিত্র কালেমাকে সাক্ষী করে কবুল পড়ে দুজন আবারও নতুন করে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হলো। সবাই ওদের দাম্পত্য জীবনের জন্য দোয়া করছে। ফায়াজ বারবার আড়চোখে মেহেরের দিকে তাকাচ্ছে। দোয়া শেষে ফায়াজ মেহেরের সাথে কথা বলার সুযোগ পেল।
মেহের এতক্ষণ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বসে থাকলেও এখন আর সে ভয়টা কাজ করছে না।

“মেহের, তোমার ফোন কোথায়? তোমাকে কতবার ফোন করেছি রিসিভ করো নি কেন?”

মেহেরের কাছে ফায়াজের কন্ঠ আর বিহেভিয়ার স্বাভাবিক লাগছে। হয়তো ফায়াজ জানে না ওর মা এসেছে। কি করেই বা জানবে ও তো এসেই নতুন বরের মতো বসে আছে। মেহের শুধু শুধু ভয় পেয়েছে। কিন্তু ফোন রিসিভ না করার জন্য কি কারণ দেখাবে। এ নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। কিছু একটা বানিয়ে বলে দিতে হবে।

মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“আসলে তখন ফোন কাছে ছিল না। কত মানুষ ছিল। বুঝতেই পারছেন তাই রিসিভ করতে পারি নি। কোন প্রয়োজন ছিল?”

ফায়াজ মৃদু হেসে বলল,
“তোমার সাথে তো আমার সবসময়ই প্রয়োজন থাকে, বউ।”

মেহের মনে মনে হাফ ছেড়ে বাচল। এর মানে ফায়াজ অন্য কারণে ফোন করেছে৷

বিয়ে পড়ানো শেষ। তাই ফায়াজের মা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি ফাইজাকে একটা মেসেজ করে গেইট দিয়ে বাইরে বের হলো। দাঁড়িয়ে ড্রাইভারকে ফোন করছে।

“কেমন আছো ফাহমিদা?”
গম্ভীর আর পরিচিত কন্ঠস্বরটা শুনে পিলে চমকে উঠল। হটাৎ করেই দম বন্ধ করা অনুভূতি হচ্ছে। বুকের ভেতর হাতুড়ি দিয়ে কেউ যেন অনবরত আঘাত করছে। ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছে না। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে হ্যালো শব্দ বারবার ভেসে আসছে। কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই। কান থেকে ফোনটা নামিয়ে ধীরে ধীরে পেছনে ঘুরে।

সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে কথা বলার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে। মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। সাথে বাড়ছে অস্বস্তি।

ফায়াজের বাবা কোন উত্তর না পেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“আমিও না কি জিজ্ঞেস করছি। নিশ্চয়ই ভালো আছো। তোমাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে তুমি খুব ভালো আছো।”

ফায়াজের মায়ের অস্বস্তি যেন তরতর করে বেড়ে গেল। অস্বস্তি নিয়েই বলল,
“অবশ্যই খুব ভালো আছি। না হলে চোরের মতো লুকিয়ে ছেলের বিয়ে দেখতে আসি? ছেলে বিয়ে করছে আর ছেলের বাবা ছেলের মা’কেও বলার
প্রয়োজন মনে করছে না। হ্যা ভালো তো আছিই।”

“ফায়াজ, তোমাকে এলাও করবে না তাই জানাই নি। আর কি জানাব? কেন জানাব? তোমার ছেলের প্রয়োজন আছে? ছেলের প্রতি কোন দায়িত্ব পালন করেছো?”

ফায়াজের মায়ের তীক্ষ্ণ জবাব,
“এর জন্য নিশ্চয়ই আমি দায়ী নই। আর কে দায়ী সেটা নিশ্চয়ই জানো।”

ফায়াজের বাবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“এখনো দাম্ভিকতা বজায় চলছো। নিজের ভুল, অন্যায় কখনও স্বীকার করবে না। দোষ কি একার আমার?”

ফায়াজের মা চুপ করে আছে। এক হাতে তালি বাজে না। হয়তো দোষ দু-জনেরই ছিল। কেউ নিজের দোষটা মেনে নেয় নি।
ফায়াজের মা ওনার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল,
“হয়তো একার ছিল না কিন্তু দোষ নামক বস্তুটার ১০আনার মালিক তুমি ছিলে। সেদিন তুমি যদি নিজের ইগো বজায় না রেখে আমাকে ফিরিয়ে আনতে যেতে তাহলে আজ দৃশ্যটা অন্যরকম থাকতো। যাক গে সে-সব কথা। ভালো থেকো।”

ফায়াজের মা চলে যেতে নিলে বাঁধা দিয়ে বলল,
“অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে পালিয়ে যাচ্ছো? তুমি চাইলে নিজের সংসার, সন্তানের জন্য ইগো বিসর্জন দিয়ে আসতে পারতে না? কিন্তু তা করো নি। সেটা যখন করোনি তাই আমাকে দোষারোপ করার কোন রাইট তোমার নেই। ফাইজাকে নিয়ে চলে গেলে দূর দেশে।”

“আমি যদি ফাইজাকে নিয়ে না যেতাম তাহলে তুমি কি করতে নিশ্চয়ই ভুলে যাও নি। ফাইজাকেও আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে। আমাকে নিঃস্ব করে দিতে। তুমি সব সময় নিজেরটা বুঝো। নিজের বুঝের জন্য অন্যকে কষ্ট দিতে তোমার বিন্দুমাত্র বিবেকে বাঁধে না। জানি না এতদিন ফায়াজকে কি বুঝিয়েছো। ছেলেটা আমাকে দু-চোখে দেখতে পারে না।”
(চোখের পানি ফেলে)

ফায়াজের বাবা তাচ্ছিল্যের সাথে বলল,
“হু, ও বোধহয় আমাকে খুব ভালোবাসে? ও আমাকে ঘৃণা না করলেও ভালোবাসে না। ওর জীবনে আমার বিশেষ স্থান নেই।”

ফায়াজের মা বিস্ময় নিয়ে তাকাল।
ফায়াজের বাবা আলতো হেসে বলল,
“এটাই সত্য। ওর সাথে আমার কোন কালেই সু-সম্পর্ক ছিল না। আমি তৈরি করতে পারি নি। ও নিজের মতো থাকতে ভালোবাসে। ওর যা প্রয়োজন ও নিজেই আদায় করে নিতে পারে। কারো প্রয়োজন পড়ে না। শুধুমাত্র ফর্মালিটির জন্য আমি আছি। যেমন আজকের বিয়ে।”

ফায়াজের মা চুপ করে আছে। নিজেদের জন্য দুটো বাচ্চাই ছন্নছাড়া জীবন যাপন করছে। পরিবার, আদর, স্নেহ, ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত।

মেহেরের বিদায় বেলায় মেহের মা’কে জড়িয়ে কাঁদছে। এতদিন বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকে অভস্ত্য হয়ে পড়েছিল। মনেই হয়নি দীর্ঘ সময় তাদের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিল। ফায়াজের বাড়িতে থেকেছে, হোস্টেলে থেকেছে কিন্তু এতদিন বাড়িতে থাকায় মনেই হয় নি এ বাড়ির বাইরেও ছিল। রোজ রাতে মা ওর রুমে গিয়ে ঘুরে আসত। ইচ্ছে হলে মায়ের কোলে ঘুমাত।
মায়ের হাতে ভাত খাওয়াটা ভুলবে কি করে। বাবার সাথে ভাঙাচোরা সম্পর্কটাও জোরালো হয়েছিল। এ বাড়ি পদতলে মুখরিত করেছিল। নিজের ঘরটাকে বেশ ভালোবেসে ফেলেছিল। সেটাকেও মিস করছে। বুকের ভেতর ভাংচুর হচ্ছে। নতুন করে ছিন্ন হওয়ার ব্যথা।

মেহের মা’কে জড়িয়ে কাঁদছে আর বলছে,
“তোমাকে খুব মনে পড়বে। আমি তোমার আদর, ভালোবাসা খুব মিস করব।”

ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে অন্যদিকে ঘুরে গেল। ওর ভেতরটা কেমন করছে। যতই মুখে মা’কে আসতে মানা করুক আজ জীবনের এমন একটা দিনে মা’কে কাছে না পেয়ে ব্যথাতুর অনুভূতি হচ্ছে।
মেহেরের মা-ও কেঁদে ভাসাচ্ছে। এতদিনের শূন্য ঘর মেহের পূর্ন করে রেখেছিল এখন আবার শূন্য করে দিয়ে চলে যাচ্ছে।

মেহের পুরো রাস্তা ফুপাতে ফুপাতে এসেছে।
এখন ফুলে ফুলে সাজানো বিছানার মাঝে বসে আছে। বসে বসেও কিছুক্ষণ ফুপিয়েছে। এখন একটু স্বাভাবিক লাগছে। পা ঝিম ধরে গেছে। আর কেঁদে-কেটে মেকাপেরও বারোটা বাজিয়েছে। ফ্রেশ হওয়া দরকার। মেহের বিছানার মাঝে দাঁড়িয়ে পা দিয়ে বিছানায় আঘাত করছে। তাতে গোলাপের পাপড়িগুলো ছিটিয়ে পড়ছে। ঝিম ধরা পা বিরক্ত লাগছে। কিন্তু এতেও কমছে না। মেহের বিছানা থেকে নেমে পা দিয়ে দাঁড়াতে পারছে না। তাই মেঝেতে বসে পড়ল। পায়ে ডান হাতের আঙুল দিয়ে টুকা দিচ্ছে বারবার।

দরজা খোলার শব্দে মেহের সেদিকে তাকাল। ফায়াজ এসেছে। ফায়াজ মেহেরকে মেঝেতে পা ধরে বসে থাকতে দেখে বিচলিত হয়ে দৌড়ে এসে ওর পাশে বসে মেহেরের পায়ে হাত দিতেই মেহের চেঁচিয়ে উঠে।

ফায়াজ দ্রুত হাত সরিয়ে বলল,
“কি হয়েছে পায়ে? বিছানা থেকে পড়ে গেছো নিশ্চয়ই। ভেঙে গেল না তো? হসপিটালে নিতে হবে।”

মেহের ফায়াজের দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকিয়ে হতবাক। ওর এমন চোখ বড়বড় করা রিয়েকশনের আগামাথা বুঝতে পারছে না।

মেহের পায়ে আবারও টুকা মেরে বলল,
“আমার পা ভাঙে নি। ঝিম ধরেছে।”

ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে ভ্রু কুচকে তাকাল। মেহের অনুভব করছে ওর পা এখন আগের মতো ঝিম ধরা নেই।
ফায়াজ রাগান্বিত হয়ে বলল,
“কিন্তু ভাব তো এমন করলে যে পা ভেঙে গেছে। সামান্য ঝিম ধরা নিয়ে এত নাটক করে কেউ? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিছুদিন আগে একটা মেজর প্রব্লেম থেকে সেড়ে উঠলে এখন আবার…”

মেহের উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“এত জ্ঞান না দিয়ে হাত ধরে তো দাঁড় করাতে পারতেন। মেকাপ নষ্ট হয়ে পেত্নীর মতো বসে আছি।”

ফায়াজ ওঠে দাঁড়িয়ে মেহেরকে ভালো করে দেখল। আসলেই চোখের নিচের বড় একটা অংশ মেকাপ নষ্ট হয়ে গেছে। কান্নাকাটির ফলে এই অংশটুকু খাওয়া খাওয়া লাগছে।

ফায়াজ নষ্ট মেকাপের স্থানে আঙুল দিয়ে বলল,
“বউ সাজে দেখতেও পারলাম না। মেকাপ সব নষ্ট করে ফেলেছো। আজ না কাঁদলে কি হতো?”

মেহের ফায়াজের কথা শুনে অবাক।
“আজ আমার বিয়ে আজ কাঁদব না তো পরশু কাঁদব? অদ্ভুত সব কথা বলেন আপনি। আর না কেঁদে মেয়েরা শ্বশুর বাড়ি ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে আসলে মানুষ কি বলবে?”

ফায়াজ আগ্রহ নিয়ে বলল,
“কি বলবে?”

মেহের ফায়াজের দিকে সরু চোখে তাকাল তারপর বলল,
“বলবে মেয়ে বিয়ের জন্য পাগল। শ্বশুর বাড়ি যাবার জন্য পাগল হয়ে গেছে।”

ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“তা নয় কি? তুমি পাগল ছিলে না? বিয়ের ডেট ফিক্সড করার জন্য কম প্যারা দিয়েছো?”

মেহের ফায়াজের কথা শুনে চোখ নামিয়ে নিল লজ্জায়। ফায়াজ মেহেরের গালের সাথে নিজের গাল মিলালে মেহের ছিটকে সরে গিয়ে বলল,
“ফ্রেশ হবো।”

ফায়াজ মেহেরের অবস্থা বুঝে মনে মনে হাসছে। তারপর বলল,
“হ্যাঁ অবশ্যই। যাও যাও। ফ্রেশ হয়ে এসো।”

মেহের দ্রুত আয়নার সামনে গিয়ে নিজের সব গয়না খুলে ফেলল। গয়নার স্তুপের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“এক গাট্টি গয়না। এত ভার আমি বইলাম কি করে? এগুলোর ওজন বইতে বইতে আমার ওজন এক দিনেই পাঁচ কেজি কমে গেছে।”

মেহের ফ্রেশ হতে যাবার পর ফায়াজ ফুলে ফুলে সাজানো বিছানাটা দেখছে। কতগুলো গোলাপের পাপড়ি হাতে নিয়ে ফু মারল। হটাৎ ওর ফোনটা বেজে উঠল। ফায়াজ পকেট থেকে ফোন বের করে স্কিনে আননোন নাম্বার দেখতে পেল। অপরিচিত কেউ এত রাতে ফোন। ফায়াজ ভাবতে ভাবতে ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলল। কিন্তু ওপাশ থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই। নেটওয়ার্ক প্রব্লেম মনে করে ফায়াজ জানালার পাশে গেল। কিন্তু তাও কেউ কথা বলছে না। ফায়াজ নিশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট অনুভব করছে। কল কেটে গেল। ফায়াজ তখন হ্যালো হ্যালো বলে বিরক্তি নিয়ে হাতের ফোনের দিকে তাকাল।
মেহের বের হয়ে ফায়াজকে দেখে বলল,
“কে ফোন করেছে?”

মেহের মেরুন রঙের একটা শাড়ি পরে বের হয়েছে।
ফায়াজ মেহেরকে ভালো করে দেখে বলল,
“জানি না। অপরিচিত নাম্বার।”

তারপর আবার ফোন বেজে উঠল৷ তখনও কেউ কথা বলছে না। কয়েকবার হ্যালো বলে ফায়াজ ফোন কেটে দিল। মেহের চিন্তিত মুখে ফায়াজের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“প্রয়োজনীয় কল নয়তো? কে হতে পারে?”

“মেহের, প্রয়োজনীয় কল না। কেউ ইচ্ছে করে কথা বলছে না। প্রয়োজনীয় হলে কথা বলত। আমার মনে আমার বন্ধুরা মজা করছে। আমাদের বাসর ঘরে ডিস্টার্ব করতে চায়। ওকে ফাইন।”

ফায়াজ ফোন অফ করে দিল। তারপর বলল,
“প্রায় দু’বছরের বিয়ের প্রথম বাসর। আর ফোন কল ডিস্টার্ব করবে অসম্ভব।”

ফায়াজ ফোন রেখে মেহেরের কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুমি কি বলো?”

মেহেরের কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। আমতা আমতা করে দৃষ্টি নত করে বলল,
“আমি কি বলব?”

ফায়াজ মেহেরের নত চোখের পাপড়িতে চুমু খেয়ে ওর দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে কোলে তুলে নিল। মেহের চোখ বন্ধ করে ফায়াজের হাত শক্ত করে ধরে আছে। ফায়াজ মেহেরকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে ওর কপালে চুমু খেল। দুটো ভালোবাসার মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে পূর্ণতার দিকে।

গভীর রাত। পাখির কিচিরমিচির শব্দ জানান দিচ্ছে সকাল হতে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে আজান পড়বে। ফায়াজের লোমশ বুকে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে তার মেহেরজান। ফায়াজ মেহেরের মুখের উপরে থাকা এলোমেলো চুল কানের পেছনে গুজে দিচ্ছে।

চলবে….!

#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৪৯|

বারান্দা দিয়ে রোদের আঁচ ঘরের ভেতর পড়েছে। ঘরের সবগুলো জানালা খোলা। ঘরে আলো না জ্বলা সত্ত্বেও পুরো ঘর বাইরের আলোয় আলোকিত হয়েছে। ফায়াজ আদো আদো চোখ খুলে হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙল। তখনই মনে পড়ল মেহেরের কথা। পাশ ঘুরে বিছানা ফাঁকা দেখল। মেহের হয়তো অনেক আগেই উঠে গেছে। ফায়াজ উঠে বসে নিজের ফোনটা খুঁজছে। সেন্টার টেবিলের উপর পেয়েও গেল। হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে অন করল। গতকাল রাতে অফ করে রেখেছিল। ফোন অন করতেই ফোনের স্কিনে ১১টা ১৯ সময়টা জ্বলজ্বল করছে।

সময় দেখে ফায়াজের মাথায় হাত। এত বেলা হয়ে গেছে। আজকে রিসিপশন। বাড়ি ভর্তি মেহমান, বন্ধুরা। উফফ বন্ধুরা নিশ্চয়ই এ নিয়ে মজা করবে। ফায়াজ হাতের ফোনটা রেখে দ্রুত
ফ্রেশ হতে গেল।

মেহের আর ফাইজা আত্মীয়দের সাথে গল্প করছে। এরা কেউই মেহের কিংবা ফাইজার পরিচিত নয়। মেহের এ বাড়ির নতুন বউ আর অপরদিকে ফাইজা এ বাড়ির মেয়ে হলেও এখানে না থাকার কারণে কাউকেই চিনে না। সে সৌভাগ্য ওর হয় নি। ছোট বেলায় বুঝ হবার আগেই মায়ের সাথে এ বাড়ি ছেড়েছে।

ফায়াজ নিচে নেমে মেহেরকে খুঁজছে। না পেয়ে ডাইনিং এর সামনে গিয়ে কফি চাইল। কফিতে চুমুক দিতেই মেহেরের দিকে চোখ পড়ল। মেহের আর ফাইজা একসাথে বসে রিলেটিভদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে।
ফায়াজ হাতে কাপ রেখেই ওদের দিকে চেয়ে আছে। আর তখনই হুড়মুড় করে ওর বন্ধুরা এলো। ফায়াজ ওদের দেখেই অনুমান করছে এরা এখানে কি করতে এসেছে। ফায়াজ ওদের দেখেও না দেখার ভান করে কফিতে মনোযোগ দিল। ওদের পাত্তা দিলেই সমস্যা।

ওরা মজা করছে। ফায়াজ পাত্তা না দিয়ে বলল,
“রাতে বারবার কে ফোন করেছিলি?”

ওরা একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে বলল,
“জানি না। আমি করি নি।”
সবাই জানি না বলায় ফায়াজ ওদের দিকে ঘুরে বলল,
“তোদের মধ্যেই কেউ করেছিস। কিন্তু স্বীকার করছিস না। আর তোরা এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বেড়াতে এসেছিস? বসে বসে গিলার জন্য তোদের আসতে বলেছি? যা গিয়ে কাজ কর।”

ফায়াজ ওদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে টেবিলের উপর কাপ রেখে নিজের রুমের দিকে গেল।
ওরা ফায়াজের কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল।

“৫ মিনিটের মধ্যে রুমে এসো।”
মেহের ফোনে ফায়াজের ম্যাসেজ দেখে ফাইজার দিকে চেয়ে বলল,
“আমি একটু আসছি।”

“কোথায় যাচ্ছো?”

“রুমে যাচ্ছি চলে আসব।”

“আরে না না… আসতে হবে না। তুমি রেস্ট নেও গিয়ে। বিকেলে মেকাপ আর্টিস্ট আসবে। তুমি আর রেস্ট করার টাইম পাবে না। আমিও এখন গিয়ে শাওয়ার নিয়ে রেস্ট করব।”

মেহের মুচকি হেসে বলল,
“আচ্ছা।”
তারপর সবার কাছ থেকে বিদায় নিল।

মেহের রুমের দরজার সামনে ৩মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজের দেওয়া ৫মিনিট শেষ হয়ে ৭মিনিট চলছে। কিন্তু রুমে ঢুকতে পারছে না। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে রুমের ভেতরে ঢুকল। বুক ঢিপঢিপ করছে। মনে হচ্ছে এই প্রথম এই রুমে ঢুকছে।

কিন্তু হায়! মেহের পুরো রুমে চোখ বুলিয়েও কাউকে পেল না। ফায়াজ ওকে রুমে আসতে বলে কোথায় গেল? বারান্দায় নয় তো? কিন্তু বারান্দার দরজা বন্ধ। তাহলে ওয়াশরুমে।
মেহের ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াবে তখনই হটাৎ শব্দ করে দরজা বন্ধ করার শব্দে চমকে উঠল। বুকে থু থু দিয়ে বলল,
“দরজা বন্ধ করলেন কেন?”

ফায়াজ বাকা হেসে উত্তর দিল,
“তোমাকে কিছু শেখাব তাই?”

মেহের কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“শেখাবেন মানে? কি শেখাবেন?”

ফায়াজ আবারো আলতো হেসে মেহেরের দিকে এগুচ্ছে। মেহের ফায়াজের আগানো দেখে চিন্তায় পড়ে গেল এই মুহুর্তে কি করবে। মেহের ফায়াজের দ্রুত আগানো দেখে পিছিয়ে গেল। মেহের বারান্দার বন্ধ দরজার সামনে। কিন্তু দরজা খোলার স্কোপই পেল না। ফায়াজ ওকে দু’হাতে ঘিরে রেখেছে। মেহের ফায়াজের দিকে ঘুরল। ফায়াজ দু’হাত মেহেরের দু’পাশে রেখে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজের উষ্ণ নিশ্বাস মুখের উপরে পড়ছে। ফায়াজ ইচ্ছে করে মেহেরের মুখের উপরে ফু দিল। মেহের চোখ বন্ধ করে নিল।

ফায়াজ মেহেরের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“আজকে আমি তোমাকে শেখাব কিভাবে আপনি না বলে তুমি বলা যায়।”

ফায়াজের কথা শুনে মেহের দ্রুত চোখ খোলে ফায়াজের দিকে তাকাল।
“জি জনাবা সেহি শুনা। তোমার মুখে আপনি শুনতে শুনতে তেতো হয়ে গেছি। কেমন পর পর ফিলিংস আসে। তাই তুমি আজ থেকে আমাকে তুমি বলবে।”

“তা হয় না-কি? আপনি বলতে বলতে অভ্যাস হয়ে গেছে। তুমি বলতে পারব না।”

ফায়াজ ডান হাতে নিজের গাল চুলকে বলল,
“আচ্ছা, পারবে না?”

মেহের মাথা নাড়িয়ে বলল,”না।”

ফায়াজ কয়েক সেকেন্ড মেহেরের দিকে তাকিয়ে থেকে ডান হাতে মেহেরের পেটের এক পাশ চেপে ধরল।
মেহের ব্যথায় চিৎকার করে বলল,
“ও মা গো।”

“কিসের মা? চিনকি চামেলি। বলো তুমি।” (পেটের পাশে আরো জোরে চাপ দিয়ে)

“বলছি বলছি।”
মেহের তুমি বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে যেমন তেমন প্রস্তুতি নয়। মনে হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভাষণ দেবে৷ ফায়াজ অতি আগ্রহের সহীত মেহেরের দিকে চেয়ে আছে।

মেহের কয়েকবার ঢোক গিলে বলল,
“তুমি।”
তারপর চোখ বন্ধ করে ফেলল। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল।
ফায়াজ ওর হাত সরানোর চেষ্টা করে বলল,
“চোখ বন্ধ করলে কেন? চোখ খোল। তোমার তুমি বলা আমি উপভোগ করতে পারি নি।”

“উহু। না।”

ফায়াজ মেহেরের হাত টেনে সরিয়ে বলল,
“ওকে ফাইন জানু।”
ফায়াজ মেহেরের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। মেহের ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে চোখ খুলতে পারল না।

ফায়াজ মেহেরকে ছেড়ে দিয়ে ওর খোলা চুলে নাক ডুবাল। ও মেহেরের চুলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হচ্ছে৷
“ফায়াজ!”

“হু।”

“খাবে না?”

ফায়াজ চুলে মুখ রেখেই বলল,
“না, আমার ইচ্ছে করছে না।”

“কিন্তু আমার তো ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে।”

ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি এখনো খাও নি?”

মেহের ফায়াজের দিকে চেয়ে বলল,
“না।”

“তুমি কখন উঠেছো?”

“আটটার দিকে।”

“কি বলছো? ১২টা বাজে আর কেউ তোমাকে খেতে দেয় নি?”

মেহের স্নিগ্ধ হেসে বলল,
“দেবে না কেন? আমি নিজেই খাই নি। তোমার সাথে খাব তাই।”

ফায়াজ রাগী ফেস করে বলল,
“তাহলে আমাকে ডাকো নি কেন?”

মেহের মিষ্টি হেসে বলল,
“রাগ করছেন কেন? চলো এখন গিয়ে খাই।”

“আচ্ছা। এখন নাস্তা করে রেস্ট করবে। কারো সাথে গল্প করার প্রয়োজন নেই। রুমে এসে শুয়ে থাকবে নয়তো বসে থাকবে।”

“আচ্ছা।”

মেহের আর ফায়াজ নাস্তা করে নিল। মেহের খাওয়া শেষে বাড়িতে ফোন করে খোঁজ খবর নিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট করে নিল।

রিসিপশনের জন্য আজ ফাইজা ব্রাউন কালার গাউন পড়েছে। দূর থেকে রুহানকে দেখতে পেয়ে বলল,
“এক্সকিউজ মি!”

রুহান সামনের দিকে যাচ্ছিল। ফাইজার কথা শুনে দাঁড়িয়ে যায়। তারপর ভদ্রতা বজায় রেখে বলল,
“আমাকে বলছেন?”

“জি, আমি ফাইজা। ফায়াজের বোন। ওই যে হলুদের দিন আপনাকে কি সব বলেছিলাম। চিনতে পেরেছেন?”

রুহান আবারও স্নিগ্ধ হেসে বলল,
“জি চিনেছি। চিনব না কেন?”

ফাইজা কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল। এই ছেলে কথায় কথায় হাসে। তার হাসিটা মারাত্মক সুন্দর। স্বচ্ছ, মুগ্ধ করা হাসি। চাহুনিটাও অদ্ভুৎ।

ফাইজা রুহানের চাহুনি দেখে বলল,
“আসলে ও-ই দিনের জন্য আমি সত্যিই দুঃখীত। আমার মনে হচ্ছে আপনি ব্যাপারটা নিয়ে রেগে আছেন।”

রুহান আবারও হাসল।
“আরে না। রাগ করি নি।”

ফাইজার প্রচুর রাগ হচ্ছে। এত হাসার কি হলো। কথায় কথায় এত সুন্দর করে হাসতে হবে।
“আপনি এত হাসেন কেন? সব কথায় আপনাকে হাসতে হবে?”

রুহান ফাইজার কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,
“মানে? বুঝলাম না।”

“এই আপনি প্রতি কথায় হাসেন। এত হাসবেন না। আপনার হাসিটা মারাত্মক।”
ফাইজা কথাটা বলেও লজ্জা পেয়ে গেল। রুহান বুঝতে পেরে পরিস্থিতি অন্য দিকে নিয়ে গেল।
“আপনি ইতালি ফিরছেন কবে?”

“উমম। কিছু একটা ভেবেছি যদি আল্লাহ সহায় থাকেন, যদি সব ঠিক হয় তাহলে আমি আমার পরিবারের সাথেই থাকতে চাই। আর যদি না হয় তাহলে… ( মন খারাপ করে)
রুহান কিছুই বুঝতে পারল না। বুঝার কথাও না।
ওরা টুকটাক নিজেদের মধ্যে নিজেদের পছন্দ অপছন্দ নিয়ে কথা বলছে।

তুষার সামিরার সাথেই দাঁড়িয়ে আছে। আর সামিরাকে রেখে কোথাও যাবে না। আর ভুল বুঝার সুযোগ দেবে না। নয়তো দুদিন পর পর ব্রেকাপ সহ্য করতে পারে না।

মেহের রিসিপশনের জন্য তৈরি হয়ে গেছে। ফায়াজ বাইরে অপেক্ষা করছে। দু’জনকে এক সাথে যেতে হবে। মেহমানরা সবাই অপেক্ষা করছে। মেহের পার্পল কালার লেহেঙ্গা দু’হাতে ধরে হাই হিল পরে ধীরে ধীরে হাঁটছে। ভারী অলংকার, চুলে ছোট ছোট ফুল গুজা। ড্রেসের উপযোগী মেকাপ।
মেহেরকে দেখে ফায়াজ এগিয়ে এল। মেহের চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজকে দেখে ছোট খাটো হার্টবিট মিস হয়ে গেল। ব্ল্যাক স্যুটে ফায়াজকে ইনোসেন্ট, জেন্টেলম্যান লাগছে।

মেহের মুচকি হেসে বলল,
“তোমাকে অনেক কিউট লাগছে।”

“আরে আমার কথা রাখো। তোমাকে তো রাণীর মতো লাগছে। আমার রাণী। আমি তো চোখ ফেরাতে পারছি না।”
ফায়াজ মেহেরের কপালে ঠোঁট ছুয়ালো।
“আমার মেহেরজানের উপর কারো নজর যেন না লাগে।”

মেহের চোখের কাজল নিয়ে বাচ্চাদের মতো ফায়াজের কানের নিচে লাগিয়ে বলল,
“আজকে তোমার দিকে নজর পড়ার সম্ভাবনা আছে। আমার বরের উপর কারো নজর যেন না লাগে।”

ওরা রিসিপশনে যেতেই সবাই ঘিরে ধরল। ওদের সাথে সেল্ফি তুলতে তুলতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। অতঃপর নিজেদের ফটোগ্রাফী। বিভিন্ন এংগেলে হরেক রকম পিকচার নিতে নিতেও ক্লান্ত হয়ে পড়ছে।

মেহের বসে আছে। ওর বাড়ির সবাই এসে পড়েছে। সবার সাথে কথা বলছে। ফায়াজও ব্যস্ত। মেহের কথার ফাঁকে ফাঁকে ফায়াজকে দূর থেকে দেখছে। চোখ ফেরাতে পারছে না। যতই দেখছে তৃপ্তি মিটছে না।
মেহের মনে মনে বলছে,
“কে বলবে এই ছেলেটা গুন্ডামী করত। গুন্ডা থেকে জেন্টেলম্যান তৈরি হচ্ছে। আল্লাহ সহায় হোক। ও যেন প্রকৃত মানুষ তৈরি হয়।”

চলবে….!