শেষ পাতায় তুমি পর্ব-৫২+৫৩

0
3088

#শেষ_পাতায়_তুমি (Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৫২|

ঘড়িতে বেলা সাড়ে আটটা বাজছে। তবুও ফায়াজ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহেরের ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ। তবুও শুয়ে আছে। উঠার তাড়া নেই। চুপিচুপি ফায়াজের চুল,গাল, চোখ, নাক ছুয়ে দিচ্ছে। ফায়াজ সারারাত অস্থির অস্থির করেছে। ঘুমাতে পারে নি। এই সকালের দিকে ঘুমিয়েছে৷ ফায়াজ গতকাল রাতে একদম বাচ্চাদের মতো আচরণ করেছে। মেহেরের মনে হচ্ছে প্রতিটি মানুষের ভেতরে একজন বাচ্চা ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে। প্রয়োজনে প্রবলভাবে জেগে উঠে৷
মেহের ফায়াজের বুকে হাত রাখতেই ফায়াজ ঘুমের মধ্যেই মেহেরের হাতটা জড়িয়ে নিল।
মেহের ফায়াজের আরেকটু কাছে গেল। ফায়াজের গালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। ফায়াজ একটু নড়ে-চড়ে উঠে। মেহের স্ট্যাচু হয়ে থাকে যেন ফায়াজের ঘুম না ভাঙে। ফায়াজ কিছুক্ষণ পরে আধো আধো করে চোখ মেলে। ঘুম ঘুম চোখে মেহেরের দিকে তাকাল৷

মেহের জিভে কামড় দিল।
“আহারে! কি সুন্দর ঘুমাচ্ছিলে। জাগিয়ে দিলাম।”

ফায়াজ স্নিগ্ধ হেসে মেহেরকে বুকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করল। তারপর ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,
“অফিসে যেতে হবে।”

“একদিন অফিসে না গেলে কিছু হবে না। রাতে ঠিকমতো ঘুমাও নি। এখন একটু ঘুমাও।”

“তাহ হয় না কি? ঠিকঠাক যদি কাজ না করি তাহলে হবে? এমনিতেই আমি অকর্মা, কুলাঙ্গার ছেলে। নিষ্ঠুর, স্বার্থপর ভাই।”

“ফায়াজ, আবার ও-সব কেন বলছো? তুমি সবদিক থেকে পার্ফেক্ট।”

ফায়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আচ্ছা মেহের একটা সত্য কথা বলবে?”

মেহের ফায়াজের বুকেই মুখ গুজে বলল,
“হু।”

“তোমার কি মনে হচ্ছে আমি ভুল? আমি অন্যায় করছি?”

মেহের একটু সরে ফায়াজের চোখে চোখ রেখে বলল,
“আসলে অন্যায় কার সেটা আমি বুঝতে পারছি না,হয়তো বুঝার চেষ্টা করছি না। তুমি তো জানো আমি কতটা সফট মাইন্ডের। আমি মা, বাবা,ফাইজা,তুমি সবার কষ্ট দেখে সবার প্রতিই গলে যাচ্ছি। সবার কথায় কষ্ট মেশানো থাকে, তাই আবেগপ্রবণ না হয়ে পারি না। তাই এর সঠিক উত্তর আমি জানি না।”

ফায়াজও ভাবছে কা’কে কি জিজ্ঞেস করছে। যে সবার কথা ভাবে। সবার জন্য কাঁদে। কাদার মতো নরম মন যার তাকে জিজ্ঞেস করছে৷

মেহের ফায়াজকে বলল,
“শুনেছিলাম যেদিন মা চলে যায় তার কিছুদিন পরে তোমার বড় মামা তোমার বাবাকে ফোন করে বলে মা’কে গিয়ে নিয়ে আসতে। কিন্তু বাবা তখনও মা’য়ের উপর রেগে ছিল তাই বলেছিল ওর আসার হলে নিজে আসবে, না ইচ্ছে হলে আসবে না। আমি আনতে কেন যাব? আমি দিয়ে এসেছিলাম? আমি আনতে যেতে পারব না। তারপর বড় মামার সাথে বাবার কথা কাটাকাটি চরম পর্যায়ে চলে যায়। তারপর পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে যায়। মা সবটা মামার পাশে বসেই শুনছিল। বাবার এমন ব্যবহার মেনে নিতে পারে নি। যে সম্পর্কটা জোরা লাগাতে চেয়েয়েছিল তাতে নতুন করে ভাঙণ ধরে। কিছুদিন পর মা বাবাকে আবারও ফোন করে তবে ফেরার জন্য নয়। তোমাকে নিয়ে যাবে সেটা বলার জন্য। কিন্তু বাবা উলটো হুমকি দিয়ে বসে তোমাকে কিছুতেই দেবে না বরং আর কিছুদিন গেলে ফাইজা আরেকটু বড় হলে ওকে নিয়ে আসবে। তাদের সমস্যা কিছুতেই মিটছিল না। দিন দিন বাড়ছিল। নিজের ভাঙা সংসার এ-সব নিয়ে মা ডিপ্রেসড হয়ে পড়ে। তোমার বড় মামাও ইতালি চলে যাবে তারপর একা একা কি করবে দেশে। তোমার বাবা ফাইজাকে নিয়ে যাবে সে ভয়ও ছিল। কারণ বাবা তোমার মামাদের চেয়েও বেশী প্রভাবশালী। আর মামাদেরও তো নিজের লাইফ আছে। কতদিন আর তোমার মায়ের জন্য ঝামেলা পোহাবে। তখন তুমি আরেকটু বড় হয়েছো। তোমার মনের ভেতর রাগ পুষিয়ে রাখতে রাখতে সেটা বড় আকার ধারণ করেছিল। মা তোমার স্কুলে তোমার সাথে দেখা করতে গেলে তুমি রাগারাগি করে চলে এসেছিলে। তুমি মা’য়ের কাছে যাবে না সাফ জানিয়েছিলে। তারপর মা ফাইজাকে নিজের কাছে রাখতে কাউকে কিছু না জানিয়েই ফাইজাকে নিয়ে ইতালি চলে যান। তোমাকে রেখে চলে যা। উনি হয়তো আরেকটু চেষ্টা করলে তোমাকে মানাতে পারতো, বুঝাতে পারতো কিন্তু তিনি তা করেন নি। তোমাকে রেখে না গেলেও পারতেন। এখানে তার দোষ রয়েছে। তবে বাবাও কিন্তু দোষী। তার এতটা রাগ, জেদ দেখানো উচিত হয় নি। পারতেন মা’কে ফিরিয়ে আনতে।”

“হ্যাঁ মেহের বাবাও দোষী আর এটা আমি ছোট থেকেই মানি। তাদের দুজনের জন্যই আমি অনাথের মতো বড় হয়েছি। আমার হাসিখুশি একটা পরিবার ছিল। আদর, স্নেহ, ভালোবাসা ছিল। সারাদিনের খেলার সঙ্গী ফাইজা ছিল। কত সুন্দর ছিল সে-সব দিন। কিন্তু হুট করেই জীবনটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। আমার ইচ্ছে করতো এসব ছেড়ে কোথাও চলে যাই। কিন্তু কোথায় যেতাম আমি মেহের? ছোট ছিলাম। জীবন সম্পর্কে কতটুকুই বা জানি। তাই পারি নি সব ফেলে চলে যেতে। বড় হওয়ার পর অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম এসবে। তবে বাবাকে ভালোবাসতে পারি নি। তাকে সর্বদা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম। আর এড়াবোই বা কি? তিনি তার কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। আমি যে তার ছেলে বেঁচে আছি না মরে গেছি এসব তার মনে কখনো পড়েছে কি-না সন্দেহ। দেখেছো তো আমি বাবার সাথে কেমন ব্যবহার করতাম?”

“হুম দেখেছি। ফায়াজ আমি বাবা, ফাইজা, তুমি, মা সবার ব্যথায় ব্যথিত হই। তবে…..”

ফায়াজ কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তবে কি?”

মেহের ফায়াজের চোখে চোখ রেখে বলল,
“তোমার ব্যথায় আমার ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। মনে হয় আমি তুচ্ছ একদমই তুচ্ছ। তুমি কষ্ট পাচ্ছো আমি কিছুই করতে পারছি না। ফায়াজ যে তোমাকে কষ্ট দিবে, যেটা তোমাকে কষ্ট সে কিংবা সেটা আমার অতি পছন্দনীয় নয়। আমার কাছে তুমি সবার উর্ধ্বে। প্রতিটি মেয়ের কাছেই না-কি স্বামী ফার্স্ট প্রায়োরিটি। কিন্তু তুমি আমার স্বামী বলে নয় আমি তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসি তাই তুমি আমার ফার্স্ট প্রায়োরিটি, তোমার কষ্টে আমার কষ্ট হয়, বুকের ভেতর তীব্র ব্যথা হয়। তোমাকে আমি কষ্টে থাকতে দেখতে পারি না। তুমি ছাড়া সব কিছু আমার কাছে তুচ্ছ। তুমি আমার হৃদয়ে, অনুভবে, শিরায়, রক্তে গভীর ভাবে মিশে আছো।” ( মেহেরের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে)

ফায়াজ মেহেরকে বুকে চেপে ধরে বলল,
“মেহের, আমার ব্যাপারটাও একি রকম। তুমি কষ্ট পেলেও আমার খুব কষ্ট হয়। তুমি কান্না থামাও। আমি ঠিক আছি। তোমার ভালোবাসাই আমাকে রোজ অনুপ্রেরণা দেয় নতুন করে স্বপ্ন দেখার। আমি একটুও কষ্ট পাচ্ছি না মেহের। তুমি আছো তো।”

দুজন অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর ফায়াজ ঘড়ি দেখল। ন’টা পার হয়ে গেছে। অফিসে যাওয়াটা জরুরি। যদিও ভালো লাগছে না।
“মেহের, উঠ। অফিসে যেতে হবে।”

মেহের নাক বাজিয়ে বলল,
“যেতে হবে না।”

“অফিস কেন মিস দেব শুধু শুধু? কাজ আছে আমার।”

মেহের দুম করে উঠে বলল,
“খালি কাজ, কাজ, অফিস। দূর ভাল্লাগে না। আমি যাচ্ছি। যাও তুমি অফিস।”

ফায়াজের মনে পড়ল এই কাজ, ব্যস্ততা নিয়েই বাবা-মায়ের প্রায় ঝগড়া হতো। তাদের সম্পর্কের ফাটল ধরে। এর জন্যই তাদের সুখের সংসারে আগুন লেগেছে।
নাহ, ফায়াজ পরিবারের আগে কাজকে প্রায়োরিটি দিতে চায় না। ও চায় না মেহেরের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হোক। মেহের তো কখনও কাজ নিয়ে অভিযোগ করে না। অসময়ে কোন রকম অপ্রয়োজনীয় আবদারও করে না। তাই আজ মেহেরের কথা শোনা উচিত।

ফায়াজ উঠে মেহেরের হাত ধরে বলল,
“ঠিক আছে জান যাব না আজ অফিসে। তুমি যা বলবে তাই হবে। তাই করব আজ।”

“না, যাও অফিসে। আমার কথা শুনতে হবে না।”

“আমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বউ। তার উপর এত সুন্দরী। তার কথা শুনবো না তো কার কথা শুনবো?”

মেহের ঠোঁট বাকিয়ে বলল,
“ঢং করতে হবে না।”

ফায়াজ বিছানা থেকে নেমে মেহেরকে কোলে তুলে নিয়ে আবারও বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চেপে ধরে বলল,
“মিস. লাল টমেটো। তুমি এত কিউট কেন? যখন রাগার ভান করো না তোমাকে হেব্বি লাগে। শুধু হেব্বি না লোভ লাগে।”

“কারণ তুমি লোভী। প্রচন্ড লোভী।”

ফায়াজ মেহেরকে পরম ভালোবাসায় আগলে বলল,
“তোমার লোভ আমার আজীবন থাকবে।”
দুজন একসাথে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পর মেহের অনুভব করল ফায়াজ ঘুমিয়ে পড়েছে। মেহের নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে গেল। ফায়াজের কপালে আলতো করে ঠোঁটের ছোয়া দিয়ে বলল,
“রেস্ট করাটা তোমার জন্য জরুরী।”

কয়েক দিন পরের কথা। ফায়াজ আগের মতোই নরমাল বিহেভ করছে। বিকেল বেলায় দু’জন বাগানে বসে আছে। মেহের বেঞ্চিতে পা ঝুলিয়ে বসে বই পড়ছে। কিছুদিন পরে থার্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা। ফায়াজ ওর খরগোশ জোড়াকে খাওয়াচ্ছে। আর ওরা খেলছে। ফায়াজ ওর খরগোশের জন্য আরেকটা খরগোশ এনেছিল কিছুদিন পরে। ফায়াজ একটা খরগোশকে তুলে নিয়ে কিছুটা দূরে রেখে আসে। এই খরগোশটা দৌড়ে ওর কাছে চলে যায়। ফায়াজ একি কাজ বারবার করছে। একবার এ পাশের খরগোশ তো আরেকবার ওপাশের খরগোশ দৌড়ে আবার এক হয়ে যায়।

ফায়াজ হাসতে হাসতে মেহেরের সামনে গিয়ে বলে,
“দেখেছো একে অপরকে ছাড়া থাকতেই পারছে না।”

মেহের বই থেকে চোখ তুলে বলল,
“কারা?”

ফায়াজ এক আঙুল তুলে বলল,
“ওয়েট দেখাচ্ছি।”

ফায়াজ মেহেরকে পুরো ঘটনা রিপিট করে দেখাল। তারপর মেহেরের দিকে চেয়ে বলল,
“দেখেছো এরা একে অপরকে ছাড়া থাকতেই পারছে না। এই প্রেমিক যুগলকে আলাদা করতেই পারছি না। কি করা যায় বলো তো?”

মেহের বই রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমার এত হিংসা লাগছে কেন? এমন তো নয় তোমার নিজের বউ নেই। এক কাজ করো ওদের বিয়ে দিয়ে দেও।”

ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে হোহো করে হেসে ফেলল।
“ভালো বলেছো। এদের বিয়ে দিয়ে দেই কেমন?”

ফায়াজ আর মেহের একসাথে খরগোশদের সাথে খেলায় মেতে উঠল।

হটাৎ করে মেহেরের ফোন বেজে উঠল। মেহের ওদের ছেড়ে উঠে বইয়ের পাশ থেকে ফোন নিয়ে দেখে ফাইজার কল। মেহের ফায়াজের দিকে একবার তাকায়। ফায়াজ ওদের সাথে ব্যস্ত। মেহের ফোন রিসিভ করে আরেকটু দূরে গেল।
“কেমন আছো? ”

ফাইজা বিষন্নতা নিয়ে বলল,
“এই তো ভালোই আছি। তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।”

ফাইজার কন্ঠস্বর মেহেরের ভালো ঠেকছে না। মনে হচ্ছে ওর মন খারাপ।
“হ্যাঁ বলো।”

ফাইজা কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলল,
“আমরা চলে যাচ্ছি। পরশু রাতে আমাদের ফ্লাইট। শেষ মুহূর্তে প্যাকিং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ব। হয়তো বলতে ভুলে যাব৷ তাই আগেই জানিয়ে রাখলাম৷ দোয়া করো।”

মেহের অবাক হয়ে বলল,
“ফাইজা, কি বলছো?”

“হ্যাঁ ভাবি। এখানে আমাদের মা-মেয়ের আর কি আছে। তাই চলে যাচ্ছি। পাপা আর ভাইয়াকে দেখো। ভালো থেকো।”

ফাইজা ফোন রেখে দিল। মেহের ফোনের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ওরা চলে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এই পরিবারকে এক করতে পারল না। নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে। তবে চেষ্টা করেছিল অনেক৷ মেহের জানে ফায়াজ যাই বলুক ও ওর পরিবারের সাথেই ভালো থাকত। ওর প্রয়োজন ওর পরিবারকে।”

“কি হয়েছে? কার ফোন?”

মেহের ফায়াজের কথায় চমকে যায়। ফায়াজকে বলতে ইচ্ছে করছে না। ফায়াজ এতদিনে একটু নরমাল হয়েছে।
“কই কিছু না। এমনি ফোন ছিল।”

“মেহের, লুকিও না। তোমার ফেস দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে কিছু হয়েছে। কি হয়েছে বলো আমাকে?”

মেহের জানে ফায়াজ না জানা পর্যন্ত ছাড়বে না। আর ফায়াজকে মিথ্যা বলতে চায় না।
“ফাইজার ফোন ছিল। পরশু রাতে ওদের ফ্লাইট।”

ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে মুখ ভার করে নিল। কোন টু শব্দ করল না। চুপচাপ হেঁটে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।

চলবে……!

#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৫৩|

রৌদ্দমাখা দুপুর। সূর্যের প্রখরতা জানান দিচ্ছে হুট করেই ঝড় বইতে পারে। স্বচ্ছ নীলাভ আকাশে এক টুকরো সাদা মেঘ ভাসছে। মনে হচ্ছে শরতের এক গুচ্ছ কাশফুল অথবা শুভ্র পাজা তুলো। ফায়াজ অফিসের এসি ঘরে বসেও গ্রীষ্মের উত্তাপ অনুভব করতে পারছে জানালা দিয়ে। জানালা দিয়ে রোদ পড়ছে ঘরের ভেতর। জানালা হাট করে খোলা তথাপি সাদা পর্দাটা সরানো। ও ইচ্ছে করেই জানালাটা খোলা রেখেছে। স্বচ্ছ আকাশটা অনুভব করছে না নিজের প্রিয় কিছু হারানোর আশংকা করছে সেটা ভাবার সময় নেই ওর। অনিচ্ছা স্বত্তেও ফাইলপত্র খোলে বসল৷ নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। এই ব্যস্ততাই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারে।

ফায়াজ ফাইলপত্র ঘাঁটছে এরি মধ্যে পিয়ন এসে বলল,
“স্যার একজন মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে। বলছে কিছু দরকারী কথা বলবেন।”

ফায়াজ হুট করে বুঝতে পারল না কে এসেছে। আজ তো কারো সাথে মিটিং নেই, কোন ক্লাইন্টের আসার কথা না। তাহলে কে হতে পারে?
ফায়াজ ব্রেইনে প্রেশার দিয়েও জানতে পারল না কে হতে পারে। পিয়নের দিকে চেয়ে বলল,
“ভদ্রমহিলার নাম কি?”

পিয়ন ফায়াজের দিকে চেয়ে আহাম্মকের মতো বলল,
“স্যার, জিজ্ঞেস করে আসব? আসলে উনার নাম জিজ্ঞেস করা হয় নি।”

ফায়াজ পিয়নের দিকে বিরক্ত চোখে তাকাল তারপর বলল,
“দরকার নেই। আসতে বলুন।”

পিয়ন ফায়াজের অনুমতি নিয়ে দ্রুত প্রস্থান করল৷ ফায়াজ ফাইল বন্ধ করে দরজার দিকে চেয়ে রইল। সিনেমা, মুভি হলে এই মুহুর্তে ফায়াজের ফাইলে মুখ গুজে থাকার কথা৷ কিন্তু ফায়াজ তা করছে না। কাজে মন বসছে না তাই জোর করে মন বসানোর চেষ্টা না করাই শ্রেয়। তার চেয়ে বরং কে এসেছে সেটা জানার জন্য কৌতূহল হোক৷

কিছুক্ষণের মধ্যেই ৪৭-৪৮ বছর বয়সী এক মহিলা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল৷ তার পরনে ধূসর রঙের সুতি শাড়ি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা৷ চুলে পাক ধরেছে৷ সামনের দিকে কালো চুলের ফাঁকে ফাঁকে সাদা চুল দেখা যাচ্ছে৷ এই চুলগুলো চাইলেই তিনি কলপ করতে পারতেন। কিন্তু করেন নি। বাম কাঁধে ছোট একটা ভ্যানিটি ব্যাগ। ফায়াজ ভদ্রমহিলাকে দেখে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। ও যেন থমকে গেল। সাথে ওর পুরো পৃথিবীটাও।

কিছুক্ষণ পরে ফায়াজের হুশ ফিরলে বলল,
“আপনি!”

ফায়াজের মা এসেছেন। তিনি আপনি কথার উত্তর না দিয়ে ভেতরে ঢুকল৷ কোনরুপ পারমিশন নিল না৷ এর জন্য যদি কথা শুনতে হয় তবে তাই হোক। তবুও ভেতরে ঢুকবে। কিছু কথা বলবে।

ফায়াজ কেন জানি অদ্ভুত কিছু অনুভব করছে। ওর এখন রাগে ফেটে যাওয়ার কথা। চিৎকার, চেচামেচি করে অফিস মাথায় তোলার কথা কিন্তু পারছে না। অদৃশ্য শক্তি বাঁধা দিচ্ছে প্রবল ভাবে।

“কেমন আছো?” শীতল কণ্ঠে ফায়াজের টনক নড়ে৷ কিন্তু এ কথার জবাব দিতে পারে না।

ফায়াজের মা বিমর্ষচিত্তে বলল,
“জানি এই প্রশ্ন করার যোগ্যতা আমার নেই। আমি তোমার ভালো থাকার অবলম্বনগুলো কেড়ে নিচ্ছি। তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি প্রতিনিয়ত। ফায়াজ বিশ্বাস করো আমি চাই নি আমার জন্য তোমাদের ভাই-বোনের সম্পর্কে কোন বিরুপ প্রভাব পড়ুক। আমি ফাইজাকে অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু ও বুঝতে চাইছে না। হয়তো বুঝতে পারছে কিন্তু অভিমান করে আছে। তবে মনে মনে কষ্ট পাচ্ছে ঠিক তোমার মতো।”

ফায়াজ দৃষ্টি নত করে রেখেছে। রাগটা ভেতরে একান্তে রেখেছে। এই মুহুর্তে মা নামক ভদ্রমহিলার কাছে প্রকাশ করতে চাইছে না।
“ফায়াজ!” অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকাল ফায়াজের দিকে। ফায়াজ চোখ তুলল না।

“ফায়াজ, আমি তোমার মা। ১৬বছর তোমাকে কাছে পাই নি। আমি চাই নি তোমাকে ছেড়ে যেতে৷ কোন মা তার সন্তানকে ছাড়তে চায়? আমি ভেবেছিলাম ফাইজাকে নিয়ে সেটেল হয়ে তোমাকে সুযোগ বুঝে নিয়ে আসব। বুঝতে পারি নি কিছু দিনের ব্যবধানে তুমি আমার উপর এতটা রাগ, অভিমান পুষে ফেলবে। বিশ্বাস করো আমি সত্যি বুঝিনি। এটাই আমার জীবনের বড় ব্যর্থতা। মা হয়ে সন্তানকে বুঝি নি।” (কাঁদতে কাঁদতে বলল)

সন্তান যতটাই রাগ করে থাকুক না কেন বাবা-মাকে কষ্টে দেখতে পারে না। তাদের চোখের পানি সহ্য করতে পারে না। এই মুহুর্তে ফায়াজের ক্ষেত্রেও সেটা হচ্ছে।
“ফায়াজ আমাকে ক্ষমা করে দেও। আমি তোমাকে ছাড়া ভালো ছিলাম না বিশ্বাস করো। তুমি যদি আমাকে না চাও, আমাকে ছাড়া ভালো থাকো তবে আমি কোনদিন তোমার সামনে আসব না, তোমার ভালো থাকার পথে বাঁধা হব না। দূর থেকে তোমার জন্য শুভকামনা করে যাব। তবুও আমাকে ক্ষমা করে দেও।” ( হাত জোড় করে)

ফায়াজ তখনও চুপ। কোন জবাব দিচ্ছে না।
ফায়াজের মা চোখের পানি মুছে বলল,
“আমরা চলে যাবার পর তুমি প্লিজ ফাইজার সাথে যোগাযোগ করো। অভিমান করে আছে। একমাত্র তুমিই পারো ওর অভিমান ভাঙাতে। তুমি একবার ওর সাথে কথা বললে ওর অভিমান ভেঙে যাবে। বড্ড ভালোবাসে তোমাকে। আমি চাই তোমাদের সম্পর্কটা আগের মতো হয়ে যাক। আমার মতো খারাপ মায়ের জন্য ভাই-বোনের মধুর সম্পর্ক নষ্ট হবে কেন? আমার জীবনে আর কি আছে। তোমাদের ভালো থাকার উপর চেয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব।”

ফায়াজের মা কাঁধে ব্যাগ চেপে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি আসছি ভালো থেকো। নিজের খেয়াল রেখো। মেহেরের যত্ন নিও। ও বড্ড ভালো মেয়ে। দোয়া করি তোমরা সব সময় ভালো থেকো। হয়তো আর কখনও দেখা হবে না। মরে গেলে ছেলের হাতের মাটিও হয়তো পাব না। তবে ফাইজার খোঁজ রেখো।”

ফায়াজের মা মন ভরে ফায়াজকে দেখে নিল। ঠিক মন ভরে না। সন্তানকে দেখে কোন মায়েরই মন ভরে না, তৃপ্তি মিটে না। চোখের পানি মুছতে মুছতে দরজা খুলে বের হয়ে গেলেন। যতই সামনের দিকে হাঁটছেন বুক ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কলিজাটা ছিড়ে রক্তাক্ত করে ফেলে চলে যাচ্ছেন। ফায়াজ মাথা তুললো না। মাথা নিচু করে চোখের পানি মুছল। তারপর নিজেকে কড়াসুরে শাসন করল।
“ফায়াজ, কার জন্য কষ্ট পাচ্ছিস? কার জন্য চোখের পানি ফেলছিস? তোর চোখের পানি কি এতটাই তুচ্ছ আর যার তার জন্য ঝড়ে। আমি আর কষ্ট পাব না। ভালো থাকব খুব ভালো থাকব।”

~পরের দিন সকালে~

ফায়াজ উপর তলার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছে। ফায়াজের মা ঝাপসা চোখে বাড়ির এ কোনা থেকে অন্য কোনা দেখছে। যতই দেখছে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছে। কতদিন পরে নিজের সংসারে পদধূলি পড়েছে। চোখে পানি টলমল করছে। এখনি বুঝি বর্ষণ হয়ে ঝড়ে পড়বে।
মেহের ফায়াজের পেছনে এসে দাঁড়াল। নিচে ফাইজা আর শাশুড়ীকে দেখে অবাক হলো। তারপর আবার ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজের কোন ভাবান্তর নেই। মেহেরের খটকা লাগছে। ফায়াজ মেহেরকে এভয়েড করে রুমে চলে গেল।

মেহের দ্রুত পায়ে নিচে নামল। নিচে নামতেই ফাইজা এসে চিৎকার করে জড়িয়ে ধরল।
“ওহহহ,, ভাবিহহহহ! আমরা চলে এসেছি। এতদিন পরে আমার স্বপ্ন পূরণ হলো। ভাইয়া নিজেই আমাদের আসতে বলেছে। সব ঠিক হয়ে গেছে। ভাইয়া মমকে মেনে নিয়েছে। আমার যে কি মজা লাগছে। তোমাকে বুঝাতে পারছি না।”

ফাইজার কথা মেহেরের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। সন্দেহ নিয়ে ফাইজার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মুচকি হাসল। ফাইজার খুশিটা নষ্ট করতে চায় না। মেহের শাশুড়ী মা’কে সালাম করে কুশলাদি জানতে চাইল। তারপর রুমে গিয়ে রেষ্ট করতে বলল৷ মেহের গেল ফায়াজের কাছে। ফায়াজ গলায় টাই বাঁধছে। মেহের ফায়াজের কাছে এগিয়ে যেতেই ফায়াজ নিজ থেকে বলল,
“আমি জানি তুমি কি বলবে। হ্যাঁ আমি ওদের আসতে বলেছি। বাবাকে বলেছি ওদের নিয়ে আসতে।”

হুট করে ফায়াজ সব মেনে নিয়েছে বিষয়টা হজম হচ্ছে না। মেহেরের চোখে বিস্ময় দেখে বলল,
“তবে শুধু ফাইজার জন্য। ওকে আমি কষ্টে দেখতে পারছিলাম না। তাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর অন্য কারো সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।”

মেহের ফায়াজের কথা শুনে মনে মনে বলছে,
“এসে যখন পড়েছে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। ফায়াজের অভিমানের পাহাড় গলবে। গলে পানি হয়ে মিশে যাবে।”

ফায়াজ টাই বেঁধে আচমকা মেহেরকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুমি আমার পাশে থেকো তাহলেই হবে। আমি শক্তি পাব, সাহস জোগাব। আসছি জান।”
মেহেরের কপালে ভালোবাসার স্পর্শ দিল আর ফায়াজকে মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিল।

পরের দিন মেহের ভার্সিটির ক্লাস শেষে ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হতে। ব্যাগটা রেখে চোখে-মুখে পানি দেয়। পানিতে ভেসিনের আয়না ভিজে অস্পষ্ট হয়ে গেছে। টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতেই পেছনে কাউকে দেখতে পায়। তবে অস্পষ্ট। দেখার জন্য ঘুরতে গেলেই মেহেরের মুখে স্পে করে দেয় মানুষটি। মেহের লুটিয়ে পড়ে।

ড্রাইভার মেহেরের জন্য অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত। এই ক্লান্ত মনে মেহেরের নাম্বারে ফোন করে সুইচড অফ পেয়ে ফায়াজের নাম্বারে ফোন করে। ফায়াজ সব কাজ কমপ্লিট করে বেরুবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজ মেহেরের ৪টা অবধি ক্লাস ছিল৷ আরেকটু আগে নিজের কাজ কমপ্লিট করতে পারলে মেহেরকে ভার্সিটি থেকে নিয়ে আসতে পারত।
টেবিলের উপর ফায়াজের ফোনটা বেজে উঠল। বাজার সাথে সাথে রিসিভ করে।
“স্যার, ভাবিরে পাইতেছি না। ফোন বন্ধ। ভার্সিটিতেও নাই।”

এই ছোট ছোট লাইনগুলো ফায়াজের উপর ভারী পড়ল। ফায়াজ সাথে সাথে ফোন কেটে মেহেরকে ফোন করছে। ওর ফোন অফ। ফোন অফ পাওয়ায় বুকটা ধুক করে উঠল। মেহেরের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। মাথা কাজ করছে না। দ্রুত কেবিন থেকে বের হয়ে গেল।
উদ্ভাটের মতো গাড়ি ছুটছে। আর যাকে পাচ্ছে ফোন করছে। সামিরাও কিছু জানে না। একটা জলজ্যান্ত মানুষ ভার্সিটি থেকে উধাও কি করে হয়।

মেহেরের জ্ঞান ফিরতেই অন্ধকার রুমে নিজেকে দেখতে পেল। মাথাটা কেমন ভারী লাগছে। তবে জায়গাটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। মেহের উঠে দাঁড়াল। এখানে কি করে এলো? মেহেরের আগের ঘটনা মনে পড়ল। কেউ ওকে এখানে নিয়ে এসেছে। কিন্তু কেন? আর সব চেয়ে আশ্চর্যের কথা ওর হাত, পা কিছুতেই কোন প্রকার বাঁধন নেই। রুমের ভেতরে পুরনো আসবাবপত্র, বেঞ্চ, বড় বড় বস্তা এটা সেটা দিয়ে পূর্ণ। আর দেয়ালের রঙ বলছে এটা ভার্সিটির কোন এক রুম।

চলবে…..!