#শেষের_পঙক্তি
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৮ ও শেষ
দেখতে দেখতে কেটে গেছে প্রায় তিন বছর। আজ ওরা দেশে ফিরবে। ওদের সাথে আরও দুইটা জান যুক্ত হয়েছে। মিহাল ও তূরের দুই ছেলে নীড় ও মেঘ। পুচকুদের এক বছর পেরিয়ে গেছে। বাচ্চারা এখন তাদের এলেক্স ও ম্যাক্স আংকেলের কোলে চড়ে সময় কাটাচ্ছে। তাওহীদ ও আসফি আরও দুই বছর পর দেশে ফিরবে। আর ফাইজা এরিককে বিয়ে করেছে। এরিক অন্য ধর্মের জানতো তাই ফাইজা কিছুদিন পর নিজের অনুভূতি সংবরণ করতে থাকে কিন্তু এরিক তার বাবা-মায়ের ডিভোর্সের পর কখনও চার্চে যায় নি এরপর সে ফাইজার সাথে রিলেশনে যাওয়ার আগে নিজে থেকে মুসলিম হয়। তখন বন্ধুমহলে সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল আর ফাইজা সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছিল। এরিক তার সপ্তাহ খানেক পর প্রথমবারের মতো ফাইজাকে ভালোবাসার কথা বলে। এরিকের ধর্মান্তরিত হওয়া নিয়ে কারও মনে কোনো বিদ্বেষ নেই কারণ এরিক নিজের জ্ঞান হবার পর থেকে সব জায়গায় নিজের ধর্ম হাইড করতো। অনেকে তাকে না-স্তি ক বলতো। তবে আসল সত্যটা এলেক্স, এলেক্সের বাবা ও একজন মৌলোবি জানতো যার কাছে এরিক নিজের ২১ বছর বয়স থেকে আরবি ও কোরআন পড়া শিখতো। এরিকের ভালো লাগতো এমনকি সে কোরআনের অর্থ অনেকবার তর্জমা করেই আরবিতে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ফাইজার পরিবার কোনো আপত্তি করে নি এই বিষয়ে। এলেক্স ওওলিভার, ম্যাক্স ও এলিনারও বিয়ে হয়ে গেছে দুই মাস হলো।
তূর মিহালের হাত ধরে ঘুরছে আর ছবি তুলছে। প্লেনের সময় আরও ঘন্টাখানেক পর। ম্যাক্স মেঘকে কোলে করে নিয়ে আসে তূরদের কাছে তারপর মুখ ভার করে বলে,
–থেকে যাও না আরও। উই উইল মিস অল অফ ইউ।
তূর মিষ্টি হেসে মেঘের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
–এতোদিন তো বলতে আমার মেঘ তোমাকে প্রচুর যন্ত্রনা দেয়। কাম ড়ে শেষ করে দেয়। তাও বলছো থেকে যেতে?
ম্যাক্স নিজের কান দেখিয়ে বলে,
–লুক। হি বা’ই’টস মি হেয়ার। বাট স্টিল, প্লিজ স্টে।
মিহাল মেঘের মাথায় চুমু দিয়ে বলে,
–আবার আসবো তো। তোমরাও বাংলাদেশে যেও। আর তোমাদের সাথে এই তিন বছর অনেক সুন্দর কেটেছে। ছুটি পেলে ট্যুরে যাওয়া, ঘুরাফেরা, আড্ডা প্রতিটা খুব খুব সুন্দর ছিল। অপরিচিত দেশে এসে এতো ভালো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
ম্যাক্স মিহালকে একবার জড়িয়ে ধরে এরপর সরে গিয়ে বলে,
–আমাদের বেবি হলে কিন্তু আসতে হবে। এলিনা তোমাদের অনেক আপন মনে করে। নিজের ভাই-বোনের মতো মনে করে।
তূর মুচকি হেসে বলে,
–অবশ্যই। এলিনা ও ওলিভাতো আমার রক্তের সম্পর্ক ছাড়া আত্মার সম্পর্কের বোন। খুব ভালোবাসি ওদের।
এক ঘন্টা পর সবার থেকে বিদায় নিয়ে ওরা প্লেনে উঠে। এলিনা ও ওলিভাতো পুরো কেঁদে দিয়েছে। বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েও কেঁদেছে ওরা। তূরও কেঁদেছে। সাত বছরের বন্ধুত্ব ওলিভাদের সাথে। আগেরবার তো দুই-তিন মাসের জন্য গিয়েছিল বলে খারাপ লাগে নি। এবার একেবারে চলে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে আসবে।
এরপর দীর্ঘ ১ দিনের জার্নি পর দেশের মাটিতে পা রাখে। এয়ারপোর্টে এসেই নিজের দেশের বাতাসের সুঘ্রাণ হৃদয় ছুঁয়ে গেলো। কায়রা ও রিয়াদ তাদের বাচ্চাদের নিয়ে ও নীরা ও ইফতি তাদের ছেলে ইফানকে নিয়ে সাথে বাকিদের পরিবারের সদস্যরা এয়ারপোর্টে সবার জন্য অপেক্ষাতে আছে। মিহালের বোনের মেয়ে রিয়ানা বাবার কোলে চড়ে এয়ারপোর্টের মানুষ দেখছে। হুট করে ও নামার জন্য জেদ শুরু করে অতঃপর কোনদিকে যেনো দৌড় দেয়। রিয়াদ মেয়ের এমন কান্ডে অবাক হয়ে পিছু নেয়। পিছু নিয়ে দেখে রিয়ানা তার মামার কোলে উঠছে। রিয়াদ হাসতে হাসতে মিহালের সামনে গিয়ে বলে,
–দেখেছো শালাসাহেব, তোমার ভাগ্নি তোমাকে দেখে কিভাবে দৌড় দিয়েছে?
মিহাল রিয়ানাকে আদর করে বলে,
–আমার মামাটা বড়ো হয়ে গেছে। কেমন আছেন দুলাভাই?
–এইতো আলহামদুলিল্লাহ। চলো চলো। আমাদের বাবারা কই?
রিয়াদ তাকিয়ে দেখে একটা বাচ্চা মিহালের কোলে রিয়ানাকে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকে আছে। আরেকটা বাচ্চা তূরের কোলে। নীড় ঘুমিয়ে গেছে কিন্তু মেঘ ঘুমাচ্ছে না। রিয়াদ অর্কর কোল থেকে মেঘকে নিয়ে নেয়। মেঘ রিয়াদকে প্রথমেই খাম’চি দিয়ে বসে। মেঘের এমন রাগ দেখে মিহাল হেসে বলে,
–দুলাভাই, ওর রাগ একটু বেশি। এসবেই সে ওস্তাদ। এদিকে আমার বড় ছেলেকে দেখেন, কী সুন্দর ওর মায়ের কোলে ঘুমোচ্ছে।
রিয়াদ মেঘের নাক টেনে এরপর ওরা হাঁটা শুরু করে। তূর নীরাকে ও কায়রাকে দেখে ঘুমন্ত নীড়কে রাফির কোলে দিয়ে কায়রা ও নীরাকে জড়িয়ে ধরে। ওদিকে কায়রার ছয় মাসের ছেলে শুভ্র মায়ের কোল থেকে চাপা খেয়ে ক্যা করে উঠে। তূর জলদি করে ছেড়ে দিয়ে শুভ্রকে কোলে তুলে নেয়। শুভ্রর চিৎকারে নীড় আড়মোড়া ভেঙে উঠে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। কী গম্ভীর বাচ্চা! ওদিকে ছোট্ট ইফান তার বাবার কোলে ঘুমোচ্ছে। তূর শুভ্রকে আদর করে ঘুমন্ত ইফানকে আর না জাগিয়ে অর্কর কোল থেকে মেঘকে নিয়ে গাড়িতে বসে।
ওরা বাসায় গেলে যেনো উৎসব লেগে গেছে বাড়িতে। তূরের পরিবারও আজ মিহালদের বাড়িতে এসেছে। সবার সাথে এক আবেঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। নীড়, মেঘ ও ইফানের দারুন সখ্যতা গড়ে উঠেছে। তূরের বাবা-মা ও মিহালের বাবা-মা নাতিদের পেয়ে তো মহাখুশি। নাতিদের জন্মের পর আজকেই প্রথম সরাসরি দেখলো। নীড় ও মেঘ তাদের দাদা-দাদী ও নানা-নানির কোলে কোলে ঘুরছে। তূর্যর সাথে মেঘের একদফা মা’রা’মা’রিও হয়ে গেছে। মেঘ তূর্যর চুল ধরে টানে বারবার। আর নীড় নাফিহার কোলে করে ছাদে ঘুরেও এসেছে।
রাত হলে তূরের বাবা-মায়েরা ও নীরারা চলে যায়। কায়রারা আজকে থাকবে এখানে। মেঘ ও নীড়কে ঘুম পারিয়ে তূর ও মিহাল ব্যালকনিতে এসে বসে। শরতের অর্ধচন্দ্র মেঘের আড়ালে লুকুচুরি খেলছে। তূর বেখেয়ালি হয়ে বলে,
–আচ্ছা, চাঁদের গায়েও দাগ আছে তাও মানুষ চাঁদের সাথে তুলনা করে কেনো?
মিহাল তূরের সম্মোহিত হয়ে চাঁদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখা দেখে আলতো হাসে তারপর মা’থার ডান পাশে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,
–প্রকৃতির সৌন্দর্যে সবাই বিমোহিত। যেমনটা তুমি এখন।
তূর মিহালের দিকে ফেরে অতঃপর মিহালের অধরে নিজের অধর স্পর্শ করে বি’ড়া’লছানার মতো গুটিয়ে যায় মিহালের বুকে।
ভালোবাসায় রাঙাক সকলের জীবনের প্রতিটা পঙক্তি।
পরাশিষ্টঃ
দুইটা বাচ্চা ছেলে উৎসুক হয়ে বসে আছে। তারা তাদের ফুপিদের কাছ থেকে তাদের বাবা-মায়ের গল্প শুনছে। কিন্তু তাদের ফুপিরা তাদেরকে আর বলছে না। বাচ্চা ছেলে দুটোর মধ্যে একজন অধৈর্য হয়ে গিয়ে তার ফুপিকে বলে,
–এরপর কী হলো?
কায়রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিতীশার দিকে তাকিয়ে বলে,
–ওদের সুখের সময়টা কী আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারতো না? কতো আনন্দ ও ভালোবাসা ছিল ওদের সংসারে। নীড়, মেঘ, আয়ু, আরু সবাইকে নিয়ে সুখী ছিল। কেন ওই ধমকা হাওয়ায় সব মিলিয়ে গেলো? এতিম হয়ে গেল চারটা নিষ্পাপ প্রাণ!
প্রিতীশা ঘুমন্ত আরু ও আয়ুর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
★★★
আয়ু ও আরুর জন্মের আড়াই বছর পর মিহাল, তূর ও রাফিকে আমেরিকা যেতে হয়েছিল তিন দিনের জন্য। ওদের ভার্সিটি থেকেই ডেকেছিল। তখন নীড় ও মেঘের সবে ৭ বছর। বাচ্চাদের রেখেই গিয়েছিল। কিন্তু ফেরার পথে প্লেন ক্রেশে ওদের মৃত্যু হয়। আর ফেরা হয় না ওদের।
★★★
অর্ক প্রিতীশাকে ডাকতে এসে বলে,
–প্রিতী আমার ওয়ালেট কই রেখেছো? খুঁজেই পাচ্ছি না।
প্রিতীশা কপট রেগে বলে,
–এই লোকটা কিছু খুঁজে পায় না। এর ঘরি, ওয়ালেট, চশমা, ব্যাগ সব আমাকে খুঁজে দিতে হয়।
অর্ক হাত দিয়ে ইশারা করে বলে,
–আস্তে আস্তে আরু ও আয়ু উঠে যাবে। জলদি আসো তো। আজ এতিমখানায় যেতে হবে। মসজিদে টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। এলেক্স, ফাইজারাও চলে এসেছে প্রায়।
প্রিতীশা উঠে যায়। আজ মিহাল, তূর ও রাফির তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।
নীড় ও মেঘ বুঝে গেছে ওদের আর বলবে না। তাই নিজেই তাদের ফুপির হাত থেকে ডায়েরিটা নিয়ে নেয়। সেখানে আরু ও আয়ুর জন্মের আগের ও পরের অনেক কিছু লেখা। মাঝের অনেক পৃষ্ঠা ফাঁকা। শেষ পৃষ্ঠাতে লেখা,
“তার নাম রাঙুক আমার শেষের পঙক্তিতে।”
ওরা দুজন নিরিবিলিতে ছাদে এখন। নীড় আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘের হাত ধরে বলে,
–ভালো থেকো বাবা-মা। তোমাদের ছেলেরা খুব স্ট্রং। বোনদের সবসময় আগলে রাখবো আমরা। তাছাড়া এতো এতো ভালোবাসার মানুষ আছে আমাদের সাথে। একটুও টেনশন করো না তোমরা। তোমাদের খুব মনে পরে কিন্তু সামলে নিবো দেখো।
মেঘ চোখ মুছে বলে,
–খুব খুব ভালো থেকো তোমরা। আমি অনেক শান্ত হয়ে গিয়েছি। নীড় ভাইয়া যা বলে সব শুনি। আগের মতো দুষ্টুমি করি না।
দূর আকাশে সূর্য একটু শিথিল হয়ে ছায়ার সৃষ্টি করে। ছায়ার মতো আগলে নিয়েছে ওদের দুই ভাইকে।
সমাপ্ত