শ্যামারণ্য পর্ব-১২+১৩

0
686

#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ১২
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন

(১৮+ ওয়ার্নিং দেওয়া হলো)

লোকটির চিরকুট টা পড়ে আনমনেই হেসে ফেলে শ্যামা।
এটা কেমন কথা,মায়েরগুলো না পড়লে রাগ করবেনা আবার উনারগুলো না পড়লে রাগ করবে।
চিরকুটটা পড়ে হঠাৎ তার মাথায় এক দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো,সে নূপুর গুলো না পড়ার সিদ্ধান্ত নিল। দেখি উনি কেমন রাগ করে,সবসময় তো মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে। রেগে গেলে কি করবে তা দেখার সুপ্ত বাসনা জাগে তার মনে।

সে গয়নার বাক্সটি ড্রেসিং টেবিলের একপাশে সরিয়ে রেখে শাড়িটি তার গায়ে ছড়িয়ে দিয়ে আয়নার দিকে তাকালো।
লাল রঙটি তার গায়ের কালো রঙের সাথে একদম বিদ’ঘুটে দেখাচ্ছে। অবশ্য খুব কম রঙেই তাকে বিদ’ঘুটে দেখায় না।
তার কলেজের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে হলুদ শাড়ি পরে আসার থিম ছিলো,সেদিন তাকে যেই দেখেছে তার মুখে সে লক্ষ্য করেছে এক অদৃশ্য কৌতুকের ছাপ। সেইদিনের লজ্জার কথা আজও মনে পড়লে উজ্জ্বল রঙের পোশাক পড়ার কথা
মাথায় আনতেও মন সায় দেয়না।

কিন্তু তার একান্ত স্বপ্নপুরুষ বলেছেন এই শাড়িটিতে তাকে মানাবে, তার কথা ফেলে কি করে?
শ্যামা ঝটপট শাড়িটা পড়ে নেয়, মেকআপ সে কখনোই পছন্দ করেনা, যদিও চোখ বাধার পর দেখা যাবেনা,তবুও একটু কাজল একে দেয় চোখে,ব্যাস তার সাজ সম্পূর্ণ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে নিজেকে লক্ষ্য করে সে।
সে যতটা ভেবেছিলো আসলে ততোটা বিদ’ঘুটে দেখাচ্ছে না অন্তত।
মনে মনে আবার নার্ভাস হয়ে পড়ে শ্যামা। লোকটি তাকে দেখে নিজের মত পালটে ফেলবে নাতো?তাকে তার মন মতো ভালো লাগবে তো?
শ্যামা আরও একবার আয়না দেখে নিজের কাজল ঠিক করে নেয়,কোমর পরিমাপ ঘন কালো চুল গুলো এক পাশে সিঁতি করে পিছনে ছেড়ে দেয়,তারপর বালা জোড়া হাতে পড়ে নেয়।

এবার অপেক্ষার পালা। শর্ত অনুযায়ী অরণ্য আসবে রাত বারোটায়,আর বারোটা বাজতে বেশি দেরি নেই। সে তার চোখে কাপড় বেধে অপেক্ষা করতে লাগলো খাটের একপাশে বসে। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত গতিতে উঠানামা করতে লাগলো সময়ের সাথে।

এক সময় সেই কাঙ্ক্ষিত সময়টি এলো, এক দমকা হাওয়ার সাথে সাথে ভেসে আসে মৃদু আতরের সুবাস,এই গন্ধ সে গতবারও পেয়েছিলো যখন অরণ্য তাকে জড়িয়ে ধরেছিলো।
তার মানে তার আগমন ঘটেছে। এটা বুঝতে পেরে বিচলিত মনে খাটের বেডশিট আঁকড়ে ধরে শ্যামা।

তার পর অনুভব করে হাতে হেঁচকা এক টান,সাথে সাথে সে আবদ্ধ হয় সেই বাহুবেষ্টনীতে। অনুভূত হয় সেই একি শান্তি একি উষ্ণতা আর একি গন্ধ…তার অরণ্যের শরীরের গন্ধ।
আকস্মিক ভালোবাসার এই বহিঃপ্রকাশে শ্যামা প্রথমে চমকে গেলেও,পরে নিজেও নিজেকে সেই আবেশের মধ্যে হারিয়ে ফেলে।
প্রথম বারের মতো সেও আঁকড়ে ধরে অরণ্যের বক্ষ,তারপর তার বুকে মাথা রেখে অনুভব করতে থাকে তার স্বপ্নপুরুষটিকে,বুক ভরে শ্বাস নেয় তার শরীরের গন্ধে,বোঝার চেষ্টা করে মানুষটিকে। দুজনের মধ্যে কোনো কথা নেই,শুধু তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ থেকে থেকে শোনা যাচ্ছে নিস্তব্ধ পরিবেশে।

এভাবে ঠিক কতটা সময় কেটে গেছে জানেনা শ্যামা। নীরবতা সর্বপ্রথম অরণ্য ভাঙ্গে,শ্যামার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে মৃদু কন্ঠে বলে উঠে,

“তোমাকে আমার কল্পনার চেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে শ্যামাবতী….”

সেই মৃদু কন্ঠের মাদকতা শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে যেনো শ্যামার। সে নিশ্চুপভাবে হারিয়ে যেতে থাকে সেই নেশায়,তখন অরণ্যের কন্ঠস্বর ভেসে আসে,

“কিন্তু আমার কথা অমান্য করার কি শাস্তি দিই তোমাকে বলো তো?”

আকস্মিক বিষয়বস্তুর পরিবর্তনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় শ্যামা,উনি কি তাহলে সত্যিই রাগ করেছেন?
কিছু বুঝে উঠার আগেই অরণ্য তার বাহুবন্ধনী আলগা করে শ্যামার কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে আবার কাছে টেনে নেয়,
তারপর তাদের ওষ্ঠ আবদ্ধ করে নেয় সে।
শ্যামা এমন আকস্মিক আক্রমণে আবেশে নিজেকে হারিয়ে ফেলে,তার মনের কোনো এক কোনা আরও পাওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠে।

তবে অরণ্য কয়েক সেকেন্ড পড়েই তাকে ছেড়ে দেয়,তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে তার মাদকতামিশ্রিত সুরে বলে উঠে,
“এইযে এখন আদর করলাম,অনির্দিষ্ট কালের জন্য তোমার এই আদর পাওয়া বন্ধ। এটাই হবে তোমার শাস্তি….”
তার সাথে সাথে শ্যামা অরণ্যের মৃদু হাসির কম্পন টের পায়,
লজ্জায় গালে গরম আভা অনুভব করে সে।

শ্যামার মন কিছু পেয়েও হারিয়ে ফেলার অনুভূতিতে হতাশ হয়ে যায় ভেতরে ভেতরে,কিন্তু বাইরে লজ্জায় ইচ্ছে করছে তার মাটির সাথে মিশে যেতে। শ্যামা লজ্জায় আনমনেই তার মুখ হাত দিয়ে ঢেকে ফেলে। তারপর আমতা আমতা করে বলে উঠে,
“আ…আপনার আদর আমার লাগবেও না,আমি কি একবারোও বলেছি আপনাকে কিছু”

“তাই নাকি? কই তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছেনা যে তোমার লাগবেনা। তোমাকে একটু হতাশ দেখাচ্ছে” অরণ্য হাসতে হাসতে বলে।

‘তাকে কি এতোটাই হতাশ দেখাচ্ছে নাকি?আর যদিও দেখায় তাতে কি হয়েছে?এই বদ লোকটির তাকে এভাবে লজ্জা দেওয়া কি বেশি জরুরী ছিলো?’, গাল ফুলিয়ে ভাবে শ্যামা।

তার ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ কোলে তুলে নেয় তাকে অরণ্য।
আচমকা নিজেকে শূন্যে অনুভব করে ভয়ে অরণ্যের শার্ট আঁকড়ে ধরে শ্যামা। ভয়ে জান বেড়িয়ে যাবার জোগাড় হয় তার ঘটনার আকস্মিকতায়,সে এবার খানিকটা রাগমিশ্রিত স্বরে বলে উঠে,
“আপনি কি আমাকে হার্ট অ্যাটাক তুলে মা’রার ফন্দি এঁটেছেন? আমার চোখ বন্ধ ভুলে যান কেনো?আপনার এসব রোমান্টিকতায় আজকে নাহোক একদিন আমি প্রাণ হারাবো’

অরণ্য হাসতে হাসতে তাকে কোলে নিয়ে বলে,”সেকি বউ,আমি কেনো তোমার হার্ট অ্যাটাক তুলতে যাবো?
আমার উদ্দেশ্য তোমার হার্ট অ্যাটাক নয়”
তারপর সে তাকে বিছানার উপর বসিয়ে দিয়ে কানের কাছে মুখ এনে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
“আমার উদ্দেশ্য তোমার হার্ট চুরি করা,হৃদয়হরণ করতে চাই আমি তোমার”

শ্যামা তার কন্ঠের এই সুক্ষ্ম পরিবর্তন লক্ষ্য করার আগেই
অরণ্য তার পা নিজের কাছে টেনে নেয়,সে তার শাড়ি গোড়ালির খানিকটা উপরে তুলে তাকে নূপুরগুলো পড়িয়ে দিতে থাকে। অরণ্যের প্রতিটা স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠে শ্যামা।
তার বুকের বা পাশটা প্রচন্ড জোরে ঢিপঢিপ করছে।

“রাতে খাওনি কেনো? আমি না খেয়ে থাকা একদম পছন্দ করিনা। তুমি জানো কত মানুষ এই খাবারের জন্য কত রকমের কষ্ট ভোগ করে?ক্ষিধের জ্বালা এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা, অন্ন কখনো নষ্ট করবেনা।”

এইযে লোকটি আবার হঠাৎ করেই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ফেলেছেন। মাঝে মাঝে শ্যামা ভাবে তিনি কি ইচ্ছে করেই এমন করেন নাকি নিজের অজান্তেই করে ফেলে। এইযে একটু আগেও কি রোমান্টিক ছিলেন উনি,এখন আবার হঠাৎ করেই গম্ভীর হয়ে গেছেন। আচ্ছা উনাকে খাবার নিয়ে এতো বিষন্ন দেখাচ্ছে কেনো?উনি যথেষ্ট ধনী,এটা হতেই পারেনা যে উনি কখনো খাবারের কষ্টে ভুগেছেন। লোকটিকে সে যতই বোঝার চেষ্টা করে ততই সে যেনো আরও অচেনা হয়ে উঠে।

“অরণ্য আমার তখন ক্ষিধে ছিলোনা তাই…..” এই প্রথম শ্যামা তার নাম ধরে ডাকলো,সাথে সাথে যেনো তার পায়ে থাকা অরণ্যের হাত জোড়া কেঁপে উঠে থেমে গেলো।

“আজ অনেকগুলো বছর পরে কেউ আমার নাম ধরে ডেকেছে শ্যামা”, বেদনামিশ্রিত কন্ঠে বলে অরণ্য।
শ্যামা সেই কন্ঠে এক অসহায়ত্ব অনুভব করে।

সে সুযোগ বুঝে একটা প্রশ্ন করে ফেলে,” কেনো? আপনার মা আপনাকে ডাকেনা নাম ধরে?”

“আমি এই ব্যপারে কথা বলতে চাইনা শ্যামা। তুমি আমাদের শর্তের কথা ভুলে যেওনা কিন্তু। আমার ব্যপারে কোনো প্রশ্ন নয়,কোনো কৌতুহল নয়।”

শ্যামা চুপসে যায় অরণ্যের শীতল গলার কন্ঠস্বর শুনে।
“স্যরি, আমি আসলে বুঝতে পারিনি।”

অরণ্য স্মিত হাসার চেষ্টা করে তার গালের একপাশে হাত রেখে বলে,”কোনো ব্যাপার না শ্যামা,আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে।”

শ্যামা মৃদু হেসে সম্মতিতে মাথা দোলালেও তার বুকে এক চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে।
‘আমি এই অভ্যাস করতে চাইনা অরণ্য, আমি আপনাকে জানতে চাই,চিনতে চাই,আপনার কন্ঠের সেই শূন্যতার কারণ শুনতে চাই, আপনি কি কখনো বলবেন আমাকে নিজের সম্পর্কে?’ মনে মনে ভাবে শ্যামা।

তার অব্যক্ত ভাবনা থেকে সে বেরিয়ে আসে দরজার মৃদু কড়াঘাতে। অরণ্য তার পাশ থেকে উঠে গিয়ে দড়জা খুলে,আবার কিছুক্ষণ পর দড়জা লাগানোর শব্দ হয়।
অরণ্য আবার তার পাশে ফিরে আসে,তখন খাবারের সুঘ্রাণ তার নাকে এসে বাড়ি খায়।
অরণ্য কি তাহলে খাবার আনতে বলেছে তার জন্য?তার ভাবনাকে সত্যি প্রমাণিত করে অরণ্য বলে উঠে,
“এরপর থেকে কখনো না খেয়ে থাকবেনা বলে দিলাম।
আজকে নাহয় আমার বউকে আমি নিজ হাতে খাইয়ে দিবো।”

“আপনি খেয়েছেন?” শ্যামা প্রশ্ন করে তাকে।

“তোমার জন্য খেতে পারলাম কই?সারাদিন না খেয়ে ছিলাম,খাওয়ার সময় শুনি তুমি খাওনি।
এবার বলো আমার অর্ধাঙ্গিনী না খেলে আমি খাই কি করে?
তাই বলছি এখন থেকে না খেয়ে থাকবেনা,নয়তো আমারও না খেয়ে কষ্ট পাওয়া লাগবে।”

বলতে বলতেই ভাত মেখে শ্যামার মুখের কাছে তুলে ধরে অরণ্য,”দেখি হা করো”

“আমিও কি আপনাকে খাইয়ে দিতে পারবো?যদি আপনি কিছু মনে না করেন?” তারপর অরণ্যের হাত ধরে লোকমাটি মুখে নেয় সে।

শ্যামার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় অরণ্য,আমতা আমতা করে বলে উঠে,” আমি কিছু মনে করবোনা,কিন্তু তুমি এই অবস্থায় খাওয়াবে কি করে আমাকে? বাদ দাও আমি পরে নিজে খেয়ে নিব”

‘এই বে’হায়া লোকটি লজ্জা পাচ্ছে নাকি?বাহ! যাক একটু লজ্জা তো তার পাওয়াই উচিত,আমাকে কতবার লজ্জায় ফেলেছেন উনি’ মনে মনে ভাবে সে এবং সিদ্ধান্ত নেয় সে দমে যাবেনা এবার।

“আপনি লোকমা বানিয়ে আমার হাতে দিবেন,আমি আপনাকে খাইয়ে দিবো”

“তার দরকার কি শ্যামা,আমি পরে নিজেই খেয়ে নিব”

“ঠিক আছে তাহলে আমিও আপনার হাতে খাবোনা”

“এতো জিদ করো কেনো বলোতো?”

“আমি জিদ করছি? সামান্য আপনাকে খাইয়ে দিতেই তো চেয়েছি। আসলেই সবাই ঠিকই বলে। বিয়ে হওয়ার পর পুরুষ মানুষ বদলে যায়। বিয়ের আগে বলেছিলেন আপনাকে বেছে নিলে আপনি আমার সকল আবদার রাখবেন। আর এখন আমার একটি ছোট্ট কথা রাখছেন না। একরাতেই বদলে গেলেন আপনি।”

“আচ্ছা ঝ’গড়া করোনা তো,তোমারা মেয়ে মানুষদের এই এক জ্বা’লা। তোমরা যখন তখন যেকোনো কিছু নিয়ে ঝ’গড়া করতে পারো”

“আমি ঝ’গড়া কর……” শ্যামা ভ্রু কুঁচকে কিছু বলতে নিবে তার আগেই অরণ্য তার মুখ খাবার দিয়ে বন্ধ করে দেয়।

“আচ্ছা তুমি আমাকে খাইয়ে দিতে পারো,খুশি এবার?”

শ্যামা বিজয়ের হাসি হেসে সম্মতিতে মাথা দোলায়। অরণ্য শ্যামার হাত ধুইয়ে দিয়ে তার হাতে খাবার ধরিয়ে দেয়,
শ্যামা তা হাত উঁচিয়ে ধরে তার দিকে।

অরণ্য কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ইতস্তত করে,তারপর শ্যামা তাড়া দিলে সে খাবার মুখে নেয়। নিজেকে এই পরিস্থিতিতে আবিষ্কার করে লজ্জায় কানের লতি দুটোয় গোলাপি আভা ধারণ করে অরণ্যের।

অরণ্য খেতে খেতেই এক নজর শ্যামার হাসিমুখের দিকে তাকায়। তার বুকের বা পাশটা হঠাৎ দ্রুত গতিতে উঠানামা করছে,
‘এমন অদ্ভুত অনুভূতি কেনো হচ্ছে?আমার এমন লাগছে কেনো?এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলোনা…’ অরণ্য বিচলিত মনে ভাবে।

সে তার ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসে শ্যামার কথায়,
“বলছি কি আমরা যদি রাতের খাবার প্রতিদিন এভাবে একসাথে খাই আপনার সমস্যা আছে?”

নিজের উৎকন্ঠায় জর্জরিত অরণ্যের মস্তিষ্ক হতে জবাব আসে ‘মানা করে দে…’

কিন্তু মস্তিষ্কের সেই কথা মন পর্যন্ত পৌছায় না তার,মন আর মস্তিষ্কের এই দোটানার মাঝে আপনা আপনি তার মুখ থেকে জবাব আসে, “নাহ,কোনো সমস্যা নেই”

নিজের অনুভূতিগুলো নিজের কাছেই বোধগম্য হয়না অরণ্যের,তবে তার কেনো যেনো মনে হচ্ছে কোথাও অনেক বড় ভুল হচ্ছে তার।

(চলবে)

#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ১৩
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন

জানালা গলে আসা সকালের তীব্র রোদের তাপে ঘুম ছুটে যায় শ্যামার।
কাল রাত খাওয়ার পর অরণ্য তাকে বুকে নিয়ে শুয়েছিলো।
তার মাথায় বিলি কাটতে কাটতে করেছিলো অজস্র প্রশ্ন।
প্রশ্নের মধ্যে ছিলো তার প্রিয় রঙ কি,কি খেতে পছন্দ করে,মা-বাবার সম্পর্কে বলো,তোমার ভাই বোন কি করে, কোথায় লেখাপড়া করেছো,সেখানে কিভাবে ক্লাস হয় এসব গতানুগতিক প্রশ্ন ছাড়াও কথা হয়েছে ছাত্র রাজনীতি,দেশের বর্তমান অবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি ।
অরণ্যের কৌতুহল সীমাহীন। যেনো বাইরের দুনিয়াটাকে তার চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে সে।
এতোটা কথা সে সারাজীবনেও মনে হয় বলেনি যতটা এক রাতে অরণ্যের সাথে বলেছে সে।
তবে শ্যামার একটুও বিরক্ত লাগেনি,সে অরণ্যের বুকে মাথা রেখে আস্তে আস্তে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে।
তার মনকোঠরে যে একটা একাকিত্ব ছিলো,সেটা যেনো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। অরণ্যের ক্ষেত্রেও তাই মনে হয়েছে তার। তার বুকে মাথা রেখে গল্প করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে শ্যামা বুঝতেও পারেনি।
একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে যায় কাল রাতে শ্যামার কাছে।
অরণ্য তাকে শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্য বিয়ে করেনি,
সে তার একাকিত্বের একজন সঙ্গী হিসেবে তাকে চেয়েছে।

চোখের বাধন খোলার সাথে চোখ ধাধানো দিনের আলো তার চোখে মুখে আছড়ে পড়ে। অনেক বেলা করে ঘুম ভেঙ্গেছে তার দেরি করে ঘুমানোর কারণে।
চোখ পিটপিট করে আলো সয়ে আসতেই সে পাশে ফিরে তাকায় যেখানে অরণ্য শুয়ে ছিলো কাল। যথারীতি পাশের বিছানা শূন্য। মানুষটি নেই সেখানে,তার যায়গায় আছে আবার একটি চিরকুট আর তার উপর একটি লাল র’ক্ত’জবা ফুল।

সে চিরকুটটি খুলে পড়ে যাতে লেখা আছে,
“শুভ সকাল আমার প্রিয় অর্ধাঙ্গিনী,
আজকে নীল রঙের শাড়িটা পড়বে এবং চুলে ফুলটি গুঁজে দিবে।
আলমারির প্রত্যেকটা জিনিস আমি নিজ হাতে সাজিয়েছি তোমার জন্য।
আশা করি পছন্দ হবে তোমার।

-অরণ্য”

শ্যামা চিরকুটটি হাতে নিয়েই দ্রুতকদমে গিয়ে আলমাড়িটি খুলে। বিশাল কালো কাঠের সেই আলমারিতে থরে থরে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন রঙের শাড়ি,তার মধ্যে নীল শাড়িটা সবার উপরে রাখা,উপরের দুই তাক শাড়ি,একদম নীচের তাকে রয়েছে শাড়ির সাথে মেলানো কাঁচের চুরি,সাথে কয়েকটি গয়নার বাক্স।
অরণ্য তাকে প্রতিবার নতুন করে চমকে দেয়।
মনটা খুশিতে ভরে যায় তার,এমন নয় যে তার এমন কাড়ি কাড়ি শাড়ি গয়না চাই, অরণ্য তাকে নিয়ে এতটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবে সেটা ভাবতেই মনটা প্রশান্তিতে ভরে যায়।

সে শাড়িটি আর অন্য প্রয়োজনীয় জিনিস হাতে নিয়ে নীচে নেমে আসে গোসল করার জন্য।
এই বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও আধুনিক বাথরুমের ব্যবস্থা নেই।
নীচতলায় ঘরের মধ্যেই গোসলখানা রয়েছে। চাপকল দিয়ে পানি তুলে তারপর যাবতীয় কাজ করতে হয় সেখানে।

নীচে নামতেই রিমুর সাথে দেখা হয়ে যায় শ্যামার। শ্যামাকে দেখেই সে হেসে বলে
“আপনে উঠছেন মালকিন?আমার নাস্তা বানান শেষ,টেবিলে দিমু?”

“না রে রিমঝিম,আমি আগে পরিষ্কার হয়ে নি। আমি গোসল করে এসে খাবো”

“গোসলে যাবেন?চলেন আমি আপনারে পানি তুইলা দি।”

“আরে না না,তোমাকে এতো কষ্ট করতে হবেনা,আমি নিজেই করে নিবো”

“যাই না মালকিন,এই বাড়িতে একলা একলা গা ছমছম করে আমার,সামশের চাচাও কই জানি গেছে।” রিমু খানিকটা মন খারাপ করে বলে।

“আচ্ছা ঠিক আছে চলো তবে,আর একা লাগলে আমার কাছে চলে এসো। আমি নিজেও সারাদিন কি করে কাটাবো জানিনা।”

রিমু হেসে মাথা দুলিয়ে সায় দেয়,তারপর শ্যামার আগে আগে গোসলখানায় এগিয়ে গিয়ে পানি তুলতে থাকে বালতিতে।
শ্যামা তার মুখ ধোয়ায় ব্যস্ত তখন রিমুর কন্ঠ শুনতে পায় সে,
“মালকিন একটা কথা জিগাইতে পারি যদি কিছু মনে না নেন?”

শ্যামা গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,”কি প্রশ্ন?”

“আপনে রাইতের বেলা এই বাড়িতে থাহেন,আপনার ডর লাগেনা?”

শ্যামা শান্ত কন্ঠে বললো,”ভয় লাগবে কেনো?তুমিও তো এই বাড়িতে কাজ করো,তোমার কি ভয় লাগে নাকি?”

“আপনে আসার আগে ভয়ে আমার জান বাইর হই যাইতেছিলো,কেমন গা ছমছম কইরা উঠে থাইকা থাইকা।
টেহার দরকার আছিলো তাই চইলা যাইতেও পারতাছিলাম না। এহন আপনে রে দেইখা ভরসা পাইতেছি। আপনে এইহানে রাইতের বেলা তাহেন তবু কিছু হয়নাই।
এহন ভাবতাছি গেরামের সবাই হুদাই কাহিনি করে।”

শ্যামা তার কাজ করতে করতে হেসে জিজ্ঞেস করে,” কি কাহিনি করে তারা?আমি যখন এখানে প্রথম এসেছিলাম,আমাকেও একজন বলেছিলো এই জায়গা নাকি ভালোনা,তোমরা গ্রামের মানুষ নাকি দিনের বেলায়ও এড়িয়ে চলে”

“জি মালকিন,কেউ এইদিক দিয়া কারো গরু ছাগল পর্যন্ত যাইতে দেয়না। সব ওই বুড়ির দোষ। সে ই এইসব কাহিনি শুনাইয়া সবার মনে ডর ঢুকাই দিছে।”

শ্যামা এইবার থমকে গিয়ে পূর্ণ মনোযোগ দেয় রিমুর প্রতি,”বুড়ি?কোন বুড়ি?”

“আমাগো গেরামে এক কুটনী বুড়ি আছে মালকিন। দুনিয়ার সব খবর তার কাছে থাকবোই থাকবো। বুড়ির বয়স নাকি ১০০বছর পার হইছে,এহনো ম’রে’না। হের নাতবউটারে কি না জ্বা’লা’য় এই বুড়ি। তবু গেরামের মুরুব্বি বইলা সবাই তারে মাইনা চলে। তাইতো তার কথা শুইনা এইদিহে কেউ আহেনা।”

“কি বলে তিনি এই বাড়ির ব্যপারে?”

“তিনি কইয়া বেড়ায় এই বাড়ি নাকি অশুভ,এই জমিদার বাড়ির মানুষ নাকি বহুত খারাপ মানুষ আছিলো, অতীতে নাকি এইহানে বহুত খারাপ ঘটনা ঘটছে,এইহানে নাকি খারাপ কিছু আছে আরও কতো কি কিচ্ছা কাহিনি।
বুড়ির আর তো কোনো কাজ নাই। বাচ্চাগো ডাইকা ডাইকা সাবধান করেন উনি।”

শ্যামা কথাগুলো শুনে চিন্তায় পড়ে যায়। এমন না সে ভুতপ্রেত এসব বিশ্বাস করে,কিন্তু এই বুড়ি যদি সেই যুগের মানুষ হয়ে থাকেন আর এই বাড়ি সম্পর্কে তিনি কিছু জেনে থাকেন, তাহলে তিনি কি অরণ্য ও তার পরিবার সম্পর্কেও কিছু জানেন? তিনি কি তাকে অরণ্যের এই শর্তগুলোর রহস্য জানতে সাহায্য করতে পারে? তার কি উচিত হবে একবার গিয়ে এই বুড়ির সাথে দেখা করা?

এই ভাবনাটি মনে আসতেই কাল রাতে অরণ্যের শীতল কন্ঠে বলা কথাগুলো মনে পড়ে যায়,’তুমি আমাদের শর্তের কথা ভুলে যেওনা কিন্তু। আমার ব্যপারে কোনো প্রশ্ন নয়,কোনো কৌতুহল নয়’
সেই সাথে কানে বেজে উঠে সামশের এর সাবধানবাণী ‘এর মধ্যে একটিও লঙ্ঘন করলে কিন্তু আপনি নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনবেন’।

সাথে সাথেই বুড়ির সাথে দেখা করার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সে। অরণ্য তার সব কথা রেখেছেন। তিনি তাকে তার সবটা দিয়েই ভালোবাসার চেষ্টা করছেন, একবারও তাকে কোনো কষ্ট দেননি। বিনিময়ে শুধু তার শর্তগুলির সাথে মানিয়ে নিতে বলেছেন। সে কি এতোটুকুও করতে পারবেনা তার জন্য? কৌতুহলের কাছে হেরে গেলে সে হয়তো অরণ্যকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে। এই ভাবনাটি মাথায় আসতেই বুক কেঁপে উঠে তার।
শ্যামা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে সে অরণ্যের মন ও বিশ্বাস দুটোই অর্জন করবে,একদিন তাহলে অরণ্য নিশ্চয়ই তার মনের কথাগুলো তাকে খুলে বলবে। সেদিন এই অদৃশ্য দেওয়াল তাদের মধ্যে আর থাকবেনা।

শ্যামা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে রিমুকে বাইরে পাঠিয়ে গোসল করে নেয়। রিমু ততক্ষণে টেবিলে নাস্তা লাগিয়েছে।
শ্যামা গিয়ে বসতেই রিমু হাসিমুখে বলে উঠে,”বাহ মালকিন আপনারে তো অনেক সুন্দর লাগতাছে”
শ্যামা কথাটাকে সহজভাবে নিয়ে ছোট করে একটা ধন্যবাদ জানায়।

নাস্তা খেতে খেতেই সামশের কে ফিরে আসতে দেখে শ্যামা।
তার হাত বোঝাই করা বাজার,বাজারে গিয়েছিলেন তাহলে তিনি। শ্যামা তাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে,
“চাচা আপনি খেয়েছেন?”

সামশের হাতের বাজারগুলি রেখে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে বলেন,
“জ্বি মালকিন,আমার খাওয়া হয়েছে”

“আর আপনার মনিব?উনি খেয়েছেন?”

কোনো উত্তর না পেয়ে শ্যামা এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে,”অরণ্য খায়নি এখনো?তিনি কি ঘুমোচ্ছেন?”

“জ্বি মালকিন,আসলে মালিকের দিনের বেলায় উপোস থাকে”

“উপোস থাকে মানে?অরণ্য দিনের বেলায় কিছু না খেয়ে থাকে?” ভ্রু যুগল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে শ্যামা।

“জ্বি মালকিন।”

“কেনো না খেয়ে থাকেন উনি?”

“সেটা আমি বলতে পারবোনা মালকিন”

শ্যামার বিচলিত মন আরও খারাপ হয়ে যায় কথাগুলো শুনে। কাল অরণ্য কথায় কথায় বলেও ছিলো যে সে সারাদিন না খেয়ে ছিলো,আর খাবারের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে উনার কন্ঠে এক ধরনের বিষাদের ছোয়া অনুভব করেছে সে। তাহলে তিনি নিজেকে কেনো এভাবে কষ্ট দিচ্ছেন?

“উনি তাহলে শুধু রাতের বেলা খাবার খান?”

“জ্বি মালকিন”

” উনি কি কি খেতে পছন্দ করেন আমাকে বলবেন?”

“জ্বি মালকিন?”

“এখন থেকে রাতের রান্না আমি করবো,কি খেতে পছন্দ করেন উনি?”

“মনিব খাবারের প্রতি বাছবিচার করেন না,আপনি যা রাধবেন তাই খাবেন উনি।”

“আচ্ছা ঠিক আছে আপনি যান চাচা”

সামশের চলে যেতেই তার খাবার প্লেটের দিকে তাকায় শ্যামা।
তার খাওয়ার ইচ্ছেটাই ম’রে গেছে অরণ্য না খেয়ে আছে শুনে। সে না খেয়ে উঠে যেতে চাইতে নিলে আবার অরণ্যের বলা কথা মনে পড়ে যায় তার ‘অন্ন কখনো নষ্ট করবেনা’।

ভারাক্রান্ত মনে সে আবার বসে পড়ে খাবার টেবিলে। রিমু বাজার গুছিয়ে রাখতে গিয়েছিলো রান্নাঘরে, রিমু ফিরে আসলে রিমুকে উদ্দেশ্যে করে বলে উঠে সে,
“এখন থেকে আমার জন্য সকালের আর দুপুরের খাবার রান্না করার দরকার নেই। আর রাতের খাবার আমি নিজে রান্না করবো।”
—————-
পুকুরপাড়ের পাথর বাধানো ঘাটে বসে আছে শ্যামা। দুপুরবেলার ঠান্ডা মিষ্টি বাতাস থেকে থেকে তার গায়ে আছড়ে পড়ছে। কিন্তু প্রকৃতি অনুভব করার মন মানসিকতা একদম নেই এই মুহুর্তে।

হাতে করে ফোনটা নিয়ে এসেছিলো সে। হেনার নাম্বার ডায়াল করে ফোন লাগায় সে। মায়ের সাথে কথা বলা দরকার একবার। দুইবার ওইপাশে রিং হওয়ার পর হেনার কন্ঠ ভেসে আসে অপর প্রান্ত থেকে,

“হ্যালো আপু,আমি তোকেই ফোন করতে চেয়েছিলাম। মা জানতে চেয়েছে তুই ঠিকঠাক পৌছে গেছিস কিনা।”

“হ্যাঁ আমি ঠিকমতো পৌছে গেছি,এখানে সব ঠিক আছে। মাকে ফোনটা একটু দে তো।”

“আমি মায়ের পাশে নেই এখন। বাড়িতে এসেছি কিছু জিনিস নিতে।”

“আচ্ছা তাহলে মায়ের সাথে পরে একবার কথা বলিয়ে দিস আমাকে। বাবার জ্ঞান ফিরেছে?”

“হ্যাঁ আপু,আজ ভোরের দিকেই ফিরেছে। তোর কথা জিজ্ঞেস করেছিলো।”

“আহ যাক অবশেষে বাবার জ্ঞান ফিরেছে,আচ্ছা ডাক্তার কি বললো?”

“ডাক্তার বলেছে আর কিছুদিন পর বাবাকে ডিসচার্জ দিয়ে দিবে”

“ভালো,মা বাবার খেয়াল রাখিস হেনা”

“আপু……” হেনা কিছু বলার জন্য ইতস্তত করতে থাকে।

“কিছু বলবি?”

“আপু দিব্য ভাইয়া আমাকে কল করেছিলো জানার জন্য তুই এতো টাকা কোথায় পেয়েছিস। তুই তো জানিস আমি ভাইয়াকে অনেক ভয় পাই,মুখে মুখে তর্ক করতে পারিনা। তাই আমি ভুলে বলে দিয়েছি যে তোর অনেক ভালো চাকরি হয়েছে।”

(চলবে)