সংসার পর্ব-০৭

0
45

#সংসার

পর্ব ৭
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

নোমান আর নিশাত একসাথে বলে উঠলেন,”অসম্ভব। ”

নাজমুল সাহেবের মন অসম্ভব খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু মুখে বললেন,”এখন কোনো ভাবেই সম্ভব না।”

তিতির-তিতলী সমস্বরে বললো,”কেন সম্ভব না? কি এমন কঠিন ব্যাপার? ”

নোমান বোনদের বললো,” আবেগী না হয়ে বাস্তব চিন্তা করো। এই শরীরে বাবার পক্ষে জার্নি করা অসম্ভব। এখন একটু সুস্থ আছেন,সুস্থ থাকতে দাও। আবেগের বশে কাজ করে আবার বাবাকে অসুস্থ বানিয়ে ফেলো না।”

তিতির দৃঢ় গলায় বললো,” গাড়িতে যাবো, গাড়িতে ফিরবো, মাঝখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি। সুন্দর জায়গা। খাওয়া দাওয়া ভালো। ওয়াশরুম গুলো ঝকঝকে পরিস্কার। যেতে আসতে তিন ঘন্টা, ওখানে ঘন্টা দুয়েক লাগবে সব ঘুরে ফিরে দেখার জন্য। কেউ হাঁটতে না পারলে হুইল চেয়ার আছে, বাগি আছে। অসুবিধা কোথায়? ”

নাজমুল সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন,” না, না, থাক। আমি বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারিনা। মাজা ব্যথা করে। এখন জার্নি করার ক্ষমতাও নেই, ইচ্ছা ও নেই। বাসা থেকে বের হতে ইচ্ছা করে না।”

তিতিরের চোখে পানি চলে আসলো। বাবা-মা কতোদিন, কতো মাস বাসা থেকে বের হননি ! বাবা-মা ঘুরতে ভারি ভালোবাসতেন। কি প্রাণোচ্ছ্বল ছিলেন! হারিয়ে গেলো কেন দিনগুলো? বাবা-মায়ের নিশ্চয় ঘুরতে ফিরতে ইচ্ছা করে, গাড়ির মধ্যে প্রিয়জনেরা একসাথে বসে হাসি তামাশা করতে ইচ্ছা করে, নীল আকাশের নিচে সবুজ মাঠে হাঁটতে ইচ্ছা করে, প্রকৃতির রং-রূপ সবকিছু উপভোগ করতে ইচ্ছা করে। বাবা এখন নিষেধ করলেন দুটো কারণে। প্রথমত তিনি ছেলেমেয়েদের অসুবিধা করতে চাচ্ছেন না,দ্বিতীয়ত নিশাত আর নোমানের কথায় তাঁর আত্মবিশ্বাস মুহূর্তেই শূন্য হয়ে গেছে। বাবার মনে হচ্ছে , বেড়াতে গেলে সত্যি তিনি অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন।আর অসুস্থ হলে শুধু তাঁর একার কষ্ট না,বাড়ি শুদ্ধ সবার কষ্ট। সেই হাসপাতাল, ডাক্তার, ক্যানুলা।হাসপাতালে বাবার কাছে নোমানের দিন রাত কাটানো। বাবা মাঝেমধ্যে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে নোমান বাবার সেবার সব দায়িত্ব নিজে নিয়ে নেয়। অসুস্থ বাবার পাশে বসে অনলাইনে অফিস করে, বাবা একটু উহ্ শব্দ করলেও টেনশনে অস্হির হয়ে যায়,সারা রাত ঘুমায়না। বাবার খেয়াল রাখে। সেবার হাত নোমান, তিতলী দু’জনেরই খুব ভালো।বরং ডাক্তার সাহেবার কম। বাবা চাচ্ছেন না অসুস্থ হয়ে সবার কষ্টের কারণ হতে। অথচ তিতির যখন বাবাকে প্রস্তাবটা দিয়েছিল, নিশ্চয় খুশিতে বাবার চোখ চিকচিক করে উঠেছিলো। গলার স্বরেই টের পেয়েছিলো তিতির।

নাজমুল সাহেবের মনটাও খুব খারাপ হয়ে গেছে। সেটা লুকানোর জন্য তিনি ঘুমের ভান ধরে পড়ে আছেন। তিতির গতকাল ফোনে বললো,”বাবা, দারুণ সুন্দর একটা জায়গা আছে। চলো,সামনের শুক্রবারে আমরা সবাই মিলে বেড়াতে যাই। তোমার খুব ভালো লাগবে,আমি শিওর। নিজেদের গাড়িতে কোনো সমস্যা হবেনা। তোমার খাবার,ওষুধ, ইনসুলিন সবকিছু দেখাশোনার দায়িত্ব আমার। এখন ওয়েদারটা খুবই কমফোর্টেবল। আমরা তাহলে যাচ্ছি, বাবা।ঠিক আছে? কাল সন্ধ্যায় আমি আর তিতলী প্ল্যান প্রোগ্রাম করতে আসবো মা,ভাইয়া,ভাবী আর তোমার সাথে।”

আনন্দিত নাজমুল সাহেব উদার গলায় বলেছিলেন, “আমার কোনো অসুবিধা নাই।আমার তরফ থেকে আমি যেতে রাজি।”

“তোমার শরীর তো এখন অনেক ভালো,বাবা। তাই না?”

“হ্যাঁ মা।আলহামদুলিল্লাহ। ”

“প্যান্ট শার্ট পরতে পারো,পাঞ্জাবি পায়জামাও পরতে পারো।”

“প্যান্ট শার্ট ই পরি।”

এখন স্ত্রী পুত্রের একযোগে “অসম্ভব ” শব্দটা শুনে নাজমুল সাহেবেরও টেনশন হচ্ছে। না যাওয়াই ভালো বাবা।

তবে খুব কষ্ট হচ্ছে। অনেক কল্পনা করে ফেলেছিলেন। স্ত্রী, ছেলে,বৌমা,দুই মেয়ে,দুই জামাই, আট নাতি নাতনি মিলে ঘুরে বেড়াবেন, একসাথে খাওয়া দাওয়া করবেন রেস্টুরেন্টে, নদীর পাড়ে ভারি মিষ্টি বাতাস নাকি,তিতির বলছিলো, আর অপূর্ব সুন্দর বিশাল ফুলের বাগান। পরিবেশ ভীষণ সুন্দর,তিতিরের ভাষায় “পৃথিবীর বুকে সাক্ষাৎ বেহেশত। ”

একঘেয়ে জীবন। একই বাসা, একই রুটিন। মাঝেমধ্যে একটু ভিন্ন পরিবেশে শ্বাস নিতে ইচ্ছা করে।

তিতির কড়া গলায় বললো,” বাবা যথেষ্ট ফিট। তোমরা নেগেটিভ কথা বলো দেখে বাবা নিজেকে অসুস্থ মনে করে। একবার আমরা বের হই,দেখবে, বাবা ই সবচেয়ে বেশি এনজয় করছে। যতোটুকু সিকনেস, সেটাও ভালো হয়ে যাবে। চলো, যাই। মনের ভূতে খেলো আমাদের। ”

একসময় ভীষণ বেড়াতো পরিবারটা। দূরের জার্নিতে তিতির খুব বমি করতো। তিতলীও অসুস্থ বোধ করতো। মোশন সিকনেস। নোমান লং জার্নি দারুণ ভালোবাসতো। গাড়িতে নাজমুল সাহেব বসতেন দুই মেয়ের মাঝখানে। দু’জনেই বাবার কোলে মাথা রেখে জার্নি করতো। পায়ে ব্যথা হয়ে গেলেও নাজমুল সাহেব পা নাড়াতেন না, পাছে মেয়ে দুটোর অসুবিধা হয়।

রঙিন , হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর জন্য মন হু হু করে। নিশাতেরও। কয়েক মাস আগে খুব ডিপ্রেশনে ভুগায় বড় জামাই -মেয়ে তাঁকে দু’দিনের জন্য কক্সবাজার নিয়ে গেলো। নাজমুল সাহেবকেও নিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলো মেয়ে। কিন্তু স্বয়ং নিশাত বাধ সেধেছিলেন। দুটো দিন,শুধু মাত্র দুটো দিন একদম নিজের মতো কাটাতে চেয়েছিলেন তিনি। নোমান মা’কে বলেছিলো,” তুমি নিশ্চিন্তে ঘুরে আসো তিতিরের সাথে। আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি।বাবার খাওয়া,গোসল,ওষুধ সবদিকে লক্ষ্য রাখবো আমি। তুমি একদম টেনশন ফ্রী থাকো।”

কক্সবাজার নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁকে না নিয়ে শুধু নিশাতকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ায় তিতিরের উপরে ভীষণ অভিমান হয়েছিল নাজমুল সাহেবের। মেয়ে কেন তাঁকে নিতে পারলো না,তা অবশ্য তিনি জানতেন না। তিতির এসে যখন তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললো,”মন খারাপ কোরো না বাবা।ডাক্তার বলেছেন , তোমার এখন প্লেনে ওঠা ঠিক হবে না। তাই শুধু মা’কে নিয়ে যাচ্ছি। কয়েকদিন পরে আবার সবাই একসাথে যাবো”, ধরা গলায় তখন নাজমুল সাহেব বলেছিলেন, “মন থাকলে না মন খারাপের প্রশ্ন। আমার মন বলে কোনো বস্তু নেই। ” বাবার চোখের কোলে পানি দেখেছিলো তিতির। বাবার মানসিক কষ্টটা সমস্ত অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পারছিলো সে। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছিল, অসহায় লাগছিলো খুব। বেড়ানোর কোনো আনন্দই হচ্ছিল না তার। কতোবার মা’কে বলেছিলো বাবার সাথে সে দরকার হয় হোটেলে থাকবে, আরিয়ান ওরফে বাবু ওরফে বুবুন বড় ও বুঝদার হয়েছে, সেও নানার যত্ন নিতে পারবে, নিশাত কোনো কথাই শুনতে রাজি না। মায়ের উপরে মনে মনে খুব অসন্তুষ্ট ছিলো তিতির। কিন্তু কক্সবাজারে পৌঁছে মায়ের আনন্দ -উচ্ছ্বাস, শিশু সুলভ চাপল্য, হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে তিতিরের রাগ কর্পূরের মতো উবে গেলো। মা তো একজন মানুষ, তাঁরও তো মাঝে মধ্যে একান্ত নিজের মতো দিন কাটাতে ইচ্ছা হয়, এই ইচ্ছা অন্যায্য নয় মোটেও। তিতির জানতেও পারলো না,সারাদিন আনন্দে থাকা মা হঠাৎ আনমনা হয়ে যাচ্ছেন, গভীর রাতে চোখের পানি ফেলছেন প্রিয়তম স্বামীর অভিমানী মুখখানা মনে করে। টেনশন করছেন নাজমুল সাহেবের জন্য।

সময় ভীষণ নিষ্ঠুর,ভীষণ। একদিন সন্তান আচমকা আবিষ্কার করে, তার অতি ভালোবাসার বাবা-মা একটু ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটছেন, নিউজ পেপার-টিভি- বইপত্র সব কিছুর প্রতি নিরাসক্ত হয়ে যাচ্ছেন, খাবার কম খাচ্ছেন কিন্তু ওষুধ বেশি খেতে হচ্ছে, সবার মধ্যে থেকেও আনমনা হয়ে যাচ্ছেন মাঝেমধ্যে, সন্তানদের ডেকে সম্পত্তি ভাগ করে দিতে চাচ্ছেন।আগের বাবা-মা আর এই বাবা-মায়ের মাঝে ব্যাপক তফাৎ। ব্যাপারটা সন্তানের জন্য বড্ড মর্মান্তিক।

বাবা-মায়ের হাত ছেড়ে দেওয়া কখনো উচিৎ না। কোনো অবস্থায় না। তিতির মনে মনে প্রায় অনুতপ্ত হয়। সে যদি তার বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়িকে জোর করে নিজের কাছে রেখে দিতো। বাচ্চাদের পাহারাদার হিসেবে নয়,বরং নিজেরাই তাঁদের পাহারাদার হয়ে থাকতো! আদর-যত্ন -ভালোবাসায় তাঁদের ভরিয়ে রাখতে পারতো! সব “যদি”র খেলা। বিয়ের পর শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ-দেবরের বিভিন্ন আচরণের জন্য তিতিরের মনে তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁরা সবসময় তিতিরের মা’কে ছোট করতে চাইতেন ঠারে ঠুরে, অকারণে, এটা ছিলো তিতিরের রাগের সবচেয়ে বড় কারণ। শাশুড়ি সবসময় নিজেকে আর নিজের পুত্র কন্যার গুণাবলী ও সৌন্দর্যকে হাই লাইট করতেন, বড় বৌমার নামে মন্দ কথা বলতেন, এগুলো তিতির নিতে পারতো না। তার বয়স ও ম্যাচুউরিটিও কম ছিলো তখন। শ্বশুরবাড়িতে যেতে হবে বা তাঁরা আসবেন শুনলে তার বুক ধড়ফড় করা শুরু করতো। ওঁদের কথাবার্তার কোনো তল পেতো না তিতির। যেমন, ” মামী, তোমার ওই কাজিনটা খুব সুন্দর। আমরা বলাবলি করছিলাম, মামীর ওই কাজিন ই মামীদের ফ্যামিলিতে একমাত্র সুন্দর মেয়ে।” কিংবা,” আমার ভাই ই তোমাদের বাড়ির শ্রেষ্ঠ জামাই, সব দিক দিয়ে আমার ভাই অল স্কোয়ার।” অথবা, ” বাপ-মা তোমাকে কাজকর্ম কিছুই শেখায় নি নাকি? আমার মেয়েরা পড়ালেখা যেমন করেছে, তেমন ভালো ওদের রান্না, সেলাই,সংসার সামলানো, বাচ্চা পালা।” বলা বাহুল্য, কথাগুলো মিথ্যা। ভদ্র ভাবে বলা যায়, ” অমূলক কথাবার্তা। ” তিতিরদের বাড়ির সব জামাইরা হাইলি কোয়ালিফাইড।মেয়েরা কোয়ালিফাইড হলে তো কোয়ালিফাইড জামাই ই আনতে হবে। আসিফের চেয়ে কেউই কম নয়। তিতিরদের বাড়ির সবাই কমবেশি সুন্দর, যদিও বাহ্যিক সৌন্দর্য একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু আসিফদের বাড়িতে বাহ্যিক সৌন্দর্যের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। আসিফের বোনেরা মোটেও বেশি পড়ালেখা জানা নয়। এতে তিতিরের কিছু আসতো যেতো না যদি উনারা অহেতুক মিথ্যা কথা না বলতেন। এখন পরিণত বয়সে তিতিরের মনে হয়, কি হতো এসব কথাবার্তা গায়ে না মাখলে? কেন সে শ্বশুর বাড়ির সদস্যদের কথায়, ব্যবহারে প্রভাবিত হতো? তার উচিৎ ছিলো সবকিছু ইগনোর করে নিজ দায়িত্ব পালন করে যাওয়া। তবে এটাও ঠিক, তিতির কখনোই শ্বশুর শাশুড়ি সহ পরিবারের কোনো সদস্যের সাথে বেয়াদবি করেনি। আসিফের বাবা-মা’কে সে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলো খুব আন্তরিক ভাবে। এ ব্যাপারে স্বামী-ননাসদের কাছে বারবার আবেদন জানিয়েছিল তিতির। শাশুড়ির থাকার ইচ্ছা থাকলেও শ্বশুরের জন্য থাকা সম্ভব হয়নি কারণ নিজের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর বেশিদিন থাকতে পারতেন না। তিতির দাবী তুলেছিলো, তাহলে শাশুড়ি একাই থাকুন তিতিরদের সাথে,শ্বশুর যখন খুশি আসবেন। তার প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায় সবার কাছে। আব্বা বাড়িতে থাকবেন, মা ঢাকায়, তাই কি হয়? আব্বার দেখাশোনা কে করবে? মানুষ কি বলবে? শাশুড়িও একই যুক্তি দেখালেন,যদিও তিতির স্পষ্ট বুঝতে পারতো, নিজ গৃহে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে শাশুড়ির একেবারেই ছিলো না। তিনি জন্ম থেকে কেবল কষ্টই পেয়ে গেছেন। তাহলে কেন তিতির তাঁর নানা কথায় কষ্ট পেতো? তাঁর প্রতি মাঝেমধ্যে তীব্র অপছন্দ,রাগ, ক্ষোভ কাজ করতো? শাশুড়ি মারা যাওয়ার পরে শ্বশুর আরও কয়েক বছর বেঁচে ছিলেন। তিতির তাঁকেও নিজের বাসায় রাখার জন্য ধর্ণা দিয়েছিলো। নিজের বেতনে সার্বক্ষণিক নার্স রেখে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু তার আর্জি মঞ্জুর হয়নি। শ্বশুর গৃহকর্মীর সাথে ফাঁকা বাসায় থাকতে চাননি দিনের পর দিন। আসিফ হাসপাতাল, চেম্বার,পোস্ট গ্রাজুয়েশন সব নিয়ে ব্যস্ত থাকতো ভোর থেকে রাত এগারোটা -বারোটা পর্যন্ত । তিতির হাসপাতালে ডিউটি করতো আটটা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত। বের হতে হতো কমপক্ষে সাড়ে সাতটায়। ছোট্ট বাবুকে নিশাতের বাসায় পৌঁছে সে হাসপাতালে চলে যেতো। বাসায় ফিরতে ফিরতে তিনটা। মায়ের বাসায় ভাতটা খেয়েই বাবু কোলে তিতির ফিরে আসতো নিজের বাসায়,শ্বশুরের কাছে।এটাই শ্বশুরের পছন্দ ছিলো না। তাঁর দাবী ছিলো তিন-সাড়ে তিন বছরের অতি চঞ্চল বাবুকে বাসায় রেখে যেতে হবে। গৃহকর্মী দেখাশোনা করবে। তিতির এ ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ করেনি। তাই শ্বশুরও রাগ করে চলে যান।

তাই দেবর ননদদের খোঁচা প্রায় খেতে হতো, আসিফেরও, তিতির শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য কিছুই করেনি। এসব কথা ভাবতে অরুচি লাগে। নিজের পক্ষে কথা বলার, নিজেকে প্রমাণ করার অভিরুচিও তিতিরের নেই। এটাও ঠিক, ঐ সময়ে ঐ বয়সে ঐ পরিস্থিতিতে সংসার আর তার জটিলতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ তিতিরের আরও অনেক দায়িত্বশীল, কর্মঠ,কৌশলী হওয়ার দরকার ছিলো। আসিফ তার বাবা-মায়ের জন্য কি করছে না করছে, কতো টাকা দিচ্ছে, কোনোদিন মাথা ঘামায়নি তিতির। তখন আসিফের আয় কম ছিলো। তবে এতোজন ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র আসিফই বাবা-মা’কে আর্থিক সাপোর্ট দিতো।নীরবে এখন পর্যন্ত সব ভাইবোনদের পাশে থাকে আসিফ, জানে তিতির। দুই একটা ক্ষেত্র ছাড়া কখনো বাধা দেয়না স্বামীকে।আর এখনতো সে এসব ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিস্পৃহ। কিন্তু আসিফের বাবা-মা,ভাই -বোনেরা কি করেছেন বা করেন তিতির ও তার সন্তানদের জন্য? একসময় রাগ হলে মনে মনে এসব ভাবতো তিতির,এখন কারো কাছে তার বিন্দু মাত্র প্রত্যাশা নেই। আত্মসমালোচনাতেই সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তার বারবার মনে হয়, আহা,শ্বশুর শাশুড়ি যদি বেঁচে থাকতেন এখনো, তাঁদের মাথায় তুলে রাখতো তিতির। অন্য কোথাও যেতে দিতো না। বাবা-মা ‘কে নিয়ে ভাগাভাগি রীতিমতো ঘেন্নার ব্যাপার। অনুতপ্ত হয়, নিজেকে অপরাধী মনে হয় তিতিরের।

চলবে।