সঞ্চারিণী পর্ব-১১

0
596

সঞ্চারিণী
আফনান লারা

১১.
ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা আসতে দেরি করছে বলে গার্ডরা মিলে পুল থেকে পানি এনে এনে আগুনের দিকে ছুঁড়ে মারছে এখন।হাত লাগিয়েছে নুহাশ,রায়হান আর শাওন ও।
মেধা শাওনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘাসের উপর বসে আছে।।কিছুক্ষণের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ী এসে গেলো।তাই হাতের কাজ রেখে এক এক করে শাওন,রায়হান আর নুহাশ একেক জায়গায় বসে হাঁপাচ্ছে।
নুহাশ নিতুর হাত শক্ত করে ধরে নিরবে কেঁদেই যাচ্ছে।ওর মাথা কাজ করছিলো না নিতুর বিপদের কথা চিন্তা করে।সে ওকে ছাড়া নিজেকে ভাবতেই পারেনা।ভেবেছিলো সব শেষ।এখন ওকে সুস্থ দেখে আবেগে কেঁদে ফেলেছে সে।এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না তার।প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয়টা যেন জলন্ত রুপে দেখলো।তাকে কতখানি ভালোবাসে এক মূহুর্তে যেন আগুনের শিখার মাঝে ফুটে উঠছিল সব।
——
আগুন নিভাতে ঘন্টা খানেক লেগে গেলো।আশার বাবা মারা গেছেন।তারা পোড়া লাশ দেখে মেধার গা শিউরে উঠলো।পিছিয়ে গেলো সে।কিছুক্ষণ আগেও এই লোকটার সাথে তার কথা হয়েছিলো।পানি এগিয়ে দিয়েছিলো সে।তার হাতেই জীবনের শেষ খাবার খেয়েছিল লোকটা।আর এখন তিনি মৃত।মেয়ের পর মেয়ের বাবার মৃত্যু।কার শত্রুতা থাকতে পারে উনার সঙ্গে?
সব কিছু হুট করে হয়ে গেলো।আচমকা একটা ঝড় সবার বুক কাঁপিয়ে তুলেছে।না জানি আর কত কিছুর সম্মুখীন হতে হবে।’

শাওন লাশের মুখটা সাদা কাপড়ে ঢেকে মেধার দিকে তাকিয়ে বললো,’কি কি জিজ্ঞেস করেছিলে উনাকে?শেষবার তো তুমি উনার সঙ্গে কথা বলতে গেস্ট হাউজে গিয়েছিলে।সেসব বাদ দিয়ে পুল সাইডে কেন গেলে?’

মেধা লাশটার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,’বলছে আর কই!কাশির জন্য কিছুই বলতে পারছিলেন না।এক শব্দ বলতেন আর কাশতেই থাকতেন।
নিতু আপু তাই তো গেছিলো পানি আনতে।আমি জানালা দিয়ে বাহিরেটা দেখছিলাম।হঠাৎ নজরে আসলো রেদোয়ানের পুলটা।তাতে কি যেন ভাসছিল দেখে আমি তন্মধ্যে ছুটে গেলাম সেখানে।গিয়ে কিণারায় একটা পলিথিন ভাসমান অবস্থায় পেলাম যেটার থেকে আঁশটে গন্ধ আসছিল।সেটা আমি সেফ জায়গায় রেখে এসেছি অবশ্য।ফরেনসিকে পাঠিয়ে দিবেন।রক্ত হতে পারে অথবা অন্য কিছু।’

মেধার কথা শুনে শাওন গেস্ট হাউজের পেছন দিকটা ঘুরে দেখতে গেলো।
নুহাশ এগিয়ে এসে ওর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বললো,’আশার বাবা হয়ত খুনির সন্ধান দিতে পারতেন।আর তাই খুনী তাকে জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়েছে। একজন বয়স্ক মানুষের সঙ্গে শত্রুতা দেখালো।কতটা জঘন্য হতে পারে সেই খুনি।আচ্ছা যদি উনি খুনির নামই বলতে পারতেন তাহলে আমাদের কেন বলেননি?’

-‘আশার বাবার ভুলে যাবার অভ্যাস।তবে হুটহাট উনার আবার মনেও পড়ে যায়।
আমাদের আগে দেখতে আর কে আছে এই কেসের সঙ্গে সম্পৃক্ত।এমন ও হতে পারে আমরা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার আগেই খুনি তাকেও দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলো।নেক্সটে আর কারা কারা উইটনেস দেওয়ার আছে তাদের নাম লিস্ট করে ফেলো।তারা সবাই বিপদে আছে।একজন বয়স্ক মানুষকে মারতে পেরেছে, এই খুনি সব করতে পারবে।যাকে আমরা বাঁচাতে চাই তাকে সেটা জানাতে হবে। এই খুনি তাকেও খুন করতে চাইবে। তাকে সাবধান করে গার্ড দিয়ে নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে।তাছাড়া আমাদের একটা কড়া প্ল্যানও করতে হবে।আজকে রাত নয়টায় মিটিং ডাকলাম, সবাইকে জানিয়ে দাও।’
—-
মেধা বাড়িটার ভেতরে ঢুকলো দেখতে দেখতে।আগুনে সব পুড়ে গেছে।পানি দিয়ে নেভানোর পর এখন শুধুই ধোঁয়া।মুখে হাত দিয়ে মেধা চারিদিকটা দেখছে এখন।বুক ধরা কাশি আসছে।এত এত ধোঁয়া কোনো কিছু স্পষ্ট ভাবে দেখাই যাচ্ছেনা।একটা বোমা সবকিছুর চিহ্ন মুছে দিলো।
একজন সহজ সরল মানুষকে এভাবে হত্যা করলো।যে করেছে তাকে শাস্তি পেতে হবে।তাকেও মরতে হবে’

শাওন দূরে দাঁড়িয়ে থেকে ওকে এক ধমক দিয়ে বললো,’ওখানে কি করো তুমি?এবার তোমার মরার শখ জেগেছে?ছাদটা যেকোনো সময়ে ভেঙ্গে পড়তে পারে জানো না?’

শাওনের ধমকে মেধা বাড়ি থপকে বের হতেই কল আসলো মায়ের।এসময়ে মা কখনও ফোন করেনা।এক রাশ কৌতূহল মাথায় চেপে রিসিভ করলো সে।

-‘তোর একটা পার্সেল এসেছে।খুলবো নাকি আলমারিতে রাখবো?তোরে তো বিশ্বাস নেই।কে জানে বোমা- টোমা লুকিয়ে রেখেছে কিনা কে জানে?যদিও ওজনে হালকা’

-‘ওহ।পার্সেল?কে পাঠিয়েছে?নাম লেখা আছে?’

-‘প্রেরকের জায়গায় লেখা সামওয়ান স্পেশাল।ফোন নাম্বার আছে।কল করে দেখিস’

-‘আচ্ছা, আলমারিতে রেখে দাও।আমি এসে দেখবো।আজ আসতে লেট হবে মিটিং আছে’

মেধা ফোন কান থেকে সরানোর আগেই দেখলো মিডিয়ার লোকগুলো হুমড়ি খেয়ে ছুটে আসছে এদিকে।মূহুর্তেই ওদের সামনের সব জায়গা দখল করে তারা দাঁড়িয়ে পড়েছে মাইক সামনে ধরে।মেধা ফোন কান থেকে সরালো এবার
একজন সাংবাদিক ওকে প্রথম প্রশ্ন করে বসলো।বললেন,এটা বোমা হামলা নাকি অন্য কিছু।

মেধা কিছু বলার আগেই শাওন এসে বললো-‘এটা বোমা হামলা ছিল।’
শাওনকে সাংবাদিক আরেকজন প্রশ্ন করলেন,’সব অফিসার এখানে উপস্থিত থাকার পরেও এতবড় দূর্ঘটনা ঘটলো কি করে’

-‘কথাটা ভুল।আমরা সব অফিসার ছিলাম না।আমি, নুহাশ এবং রায়হান সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখতে গিয়েছিলাম এখান থেকে দেড় কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে।মিঃ রেদোয়ানের বাসায় আমাদের অফিসার মেধা আর নিতু ছিলেন।’

-‘একজন আসলো আর বোমা রেখে গেলো।আর আপনারা টেরই পেলেন না?’

-‘টের পাওয়া যেতো যদি এই বাসায় সিসি ক্যামেরা থাকতো।ভবিষ্যতে কি হবে কে জানে?খুনি একবার যে হামলা করেছিল দ্বিতীয় বার একই জায়গায় হামলা করবে কে জানতো??
এখনও হামলা করতে পারে সেটা ভেবে আপনি কি দৌড় মারবেন না?নাকি আমাদের মতন ভেবে বসে আছেন তৃতীয় বার হামলা করতে পারেনা সে।
টু মার্ডার কেস ছিল এটা।এখন থ্রি।ট্রিপল খুনের দায় একজনের উপর।সে আরেকটা খুন করতে পিছপা হবেনা।এবার হলে তার তিন দশে ত্রিশটা খুন করতেও হাত কাঁপবেনা।মানে আপনারা সহ।
বোমা রেখে গেলো আর কাজ শেষ।সুতরাং এরকম প্রশ্ন করবেন না।আমাদেরকে আমাদের কাজ করতে দিন।এমনিতেও আর একটুর জন্য আমাদের দুজন অফিসারের জীবন বাঁচানো হুমকির মুখে পড়তো।ভাগ্যক্রমে তারা বেঁচে গেছেন।আমরা এমন জায়গায় কেস দেখতে এসেছি যেখানে না আছে সিসি ক্যামেরা,না আছে পাড়া প্রতিবেশী।যা করতে হচ্ছে সব অন্ধকারে তীর ছোঁড়ার মতন।লেগে গেলে কেস সলভড্।
না লাগলে টু বি কন্টিনিউ।আজকের জন্য এই টুকুই।আপনারা এখন যেতে পারেন।’

মেধা শাওনের দিকে তাকিয়ে আছে।
-‘ওর সাথে কি এখন ভূতটা আছে?থাকলে সে পারে না ভৌতিক কিছু করে চমক সৃষ্টি করতে?কি জানি কি টাইপের ভূত।মেয়ে নাকি ছেলে?অফ কোর্স মেয়েই হবে।কারণ একটা ছেলে তো আরেকটা ছেলের বোতাম লাগিয়ে দেয়না।মেয়ে হলে সে সম্পর্কে কি হয়!অবশ্যই গফই হবে। লোকটার জন্য কি দেশে মেয়ের অভাব পড়েছিলো?কি জানি!!বেশি কাছে দাঁড়াবোনা।নাহলে তার গফের ভাই তাই এসে আমার প্রেমে পড়বে।এরপর আমার বোতাম ও….’

কথাটা বলে মেধা নিজের গায়ের শার্টটা খাঁমছে ধরে ঢোক গিললো।বুকে থুথু দিয়ে বললো,’না না।আমার অদৃশ্য ভূত টাইপের বয়ফ্রেন্ড লাগবেনা।আমি এমনিতেই ভালো আছি।’

শাওন রেদোয়ানের বাসার দিকে চলে গেছে।মেধা আশার বাবার লাশটার আবারও দেখতে গেলো।নিতু ওকে থামিয়ে বললো,’লাশ এভাবে দেখলে খারাপ স্বপ্ন আসে রাতে।ঘুম তো একেবারে গায়েবই হয়ে যায়।অনেক সময় তো চোখের সামনে মনে হয় লাশ দাঁড়িয়ে আছে।’
—–
শাওন মাথার চুল টেনে টেনে ছিঁড়ছে যেগুলো পোড়া গেছে।রশ্নি ওর মাথায় হাত রেখে বললো,’আগুন দেখে সেই ঘটনাটা মনে পড়ে গেলো তাইনা?তোমার সারাশরীর কাঁপছে।আজকে বাসায় ফিরে যাও।আর কাজ করতে হবেনা।রেস্ট নিতে হবে তোমায়।শরীর খারাপ করলে পরে ডিউটিতেই আসতে পারবেনা।তৃনা আপুর বিয়েতেও তো ছুটি নেবে তাইনা?’

-‘না।আমি ঠিক আছি।ভেবেছি চোখের সামনে আরেকটা অগ্নিকান্ড দেখতে যাচ্ছি।একটাতে আমি কিছুই করতে পারিনি।আমার চোখের সামনে তোমাকে চিরজীবনের জন্য চলে যেতে দেখেছি।দ্বিতীয়বার একই কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই।

-‘সবার সাথে একই ঘটনা ঘটেনা শাওন।তাছাড়া আমি চিরজীবনের জন্য গেলাম কই?এই যে দিব্যি তোমার পাশে বসে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।থাকছি অস্থায়ী ‘

-‘স্থায়ী কেন নয়?’

শাওন ঘুরে বসে রশ্নির হাত মুঠো করে ধরলো।রশ্নি মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,’যেদিন তুমি আমায় ভুলে যাবে সেদিন আমি তোমার স্মৃতি থেকে মুছে যাবো একেবারে।অবশ্য তা নিয়ে আমার আক্ষেপ নেই।আমি চাই তুমি আমায় ভুলে গিয়ে একটি নতুন জীবন শুরু করো।একজন সত্যিকারের মানুষের সঙ্গে।যে ভালোবাসা দিয়ে তোমার স্মৃতি থেকে আমায় ভুলিয়ে দেবে’
চলবে♥
Afnan Lara