সঞ্চারিণী
আফনান লারা
১৩.
মিটিংটা শেষ হয়েছে ঘন্টাখানেক হলো।কিন্তু শাওন এখনও স্লো মোশনে গাড়ী চালিয়ে বাসায় ফিরছে।দরকার হলে বাসায় পৌঁছাতে ভোররাত করে ফেলবে তাও তাড়াতাড়ি ফিরা যাবেনা।
এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে সে এই এক ঘন্টা ধরে।রশ্নির মেজাজ বিগড়ে শেষ সীমানা অতিক্রম করে ফেলেছে।এতক্ষণ বসে বসে শাওনের ইচ্ছে করে দেরি করা দেখছিলো সে।
এবার সহ্য করতে না পেরে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,’বুঝলাম তুমি বিয়ে করবেনা।এরকম ধীরে সুস্থে যাবার কি আছে?তৃনা আপুর হবু শ্বশুর বাড়ির লোকদের সাথে কথা না বলাটা অভদ্রতা।তাদের মেয়েকে বিয়ে করবে কি করবেনা সেটা পরে আসছে।বড়দের কমন সম্মানটুকু তো দিবা।শুনছো তুমি?’
শাওন মোড়ে গাড়ী ঢুকিয়ে বললো,’এমন তো নয় যে আর কখনও তারা আমার বাসায় আসবেনা।আরও অনেকবার আসবে।আমি ঠিক সময়ে ওখানে যাওয়া মানে কাবিন নামায় সাইন করে দেওয়া।তাই যত ধীরে সুস্থে ড্রাইভ করছি।তুমিও ধীরে সুস্থে বাহিরের পরিবেশটা দেখো।কি সুন্দর রাতের ঢাকা।শীতল মিষ্টি বাতাস।লোকজন নেই।পথ ফাঁকা,তুমি আর আমি।গান চলছে রোমান্টিক।টেক ইউর টাইম’
-‘আমার টাইম লাগবেনা।তুমি গাড়ীর স্পীড বাড়াও।নাহলে কথা বলবোনা একদম।’
শাওন কি আর করবে।রশ্নিকে ভালোমতন চেনে সে।সত্যি সত্যি কথা বলা বন্ধ করে দিতে পারে সে।
বাধ্য হয়েই গাড়ীর গতি বাড়িয়ে দিলো শাওন।বাসায় ফিরে কলিংবেল চাপতে হয়নি।দরজা খোলাই ছিল।ভেতরে মানুষে গিজগিজ করছে।এত মানুষ দেখতে ভালো লাগেনা শাওনের।যেটার ভয়ে শামুকের মতন আসছিল অবশেষে সেটার দেখা পেতেই হলো।সোফায় বসে আছেন তৃনা আপুর হবু শ্বশুর শাশুড়ি।তার সঙ্গে বাবাও আছেন।
-‘বাবা আমাকে দেখে গম্ভীর চোখে তাকিয়ে ছিলেন তাও কিছুই বললেন না।দেরি হলো কেন এই টাইপের কোনো প্রশ্নই মুখে আনলেন না।রীতিমত সালাম দিয়ে কেটে পড়লাম আমি।সোজা নিজের রুমে।রুমে এসে দেখি এলাহি কান্ড।যত বাচ্চাবুচ্চা ছিল সব মনে হয় আমার রুমে বাসা পেতেছে।মেজাজ আরও খারাপ হচ্ছে।আরিফার জন্য এমনটা হলো।সে নিজেও এই বাঁদর দলের প্রধান হিসেবে ভূমিকা পালন করছে।’
শাওনের এক ধমকে যে বাচ্চা যেখানে ছিল ওখানে থাকা অবস্থায় আটকে গেছে।এক বাচ্চা সেসময়ে বেডের কিণারায় ডিকবাজি দিয়ে গেছিলো, বেশি কিণারায় বলে দুম করে নিচেও পড়ে গেছে এখন।শাওন ভেতরে ঢুকে বললো,’আমার রুমে ঢুকার পারমিশন কে দিছে তোমাদের?আরিফা তোমায় এর শাস্তি পেতে হবে।বের হও ওদের নিয়ে।’
আরিফা মুখ বাঁকিয়ে পিঁপড়ার মতন হেঁটে চলে গেছে।কোনো সাড়া শব্দ না করে।শাওন তার বিছানার দিকে তাকিয়ে বললো,’আজ আমায় ফ্লোরে শুতে হবে।কি করেছে রুমের!!”
রেগে বালিশ নিয়ে ছুঁড়ে মারতে গিয়ে শাওন দেখলো বাবা এসেছে রুমে।বালিশটা আগের জায়গায় রেখে তাকিয়ে রইলো সে।বাবা মুখটা ফুলিয়ে বললেন,’ফ্রেশ হয়ে এসো জলদি’
শাওন মাথা নাড়ালো।রশ্নি ফিসফিস করে বললো,’যেটার ভয় পেয়েছো সেটা হতে যাচ্ছে।হেহে।আমি জিতলাম’
—-
শাওন ফ্রেশ হয়ে বেগুনী টি -শার্ট একটা পরে বের হলো রুম থেকে।বের হতেই মুখোমুখি হলে তৃনার হবু ননদ রামিসার সঙ্গে।ক্রিম কালারের থ্রি পিস আর খোলা চুল।যে কেউ পছন্দ করবে এক দেখাতেই।তাছাড়া গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে।শিক্ষিত মেয়ে।সব কাজে দক্ষ।
একহাতে সংসার আর চাকরি দুটোই সামলাতে পারবে।এর আগে অনেক প্রস্তাব তারা ডিক্লাইন করে এসেছে।মনের মতন পাত্রের খোঁজে শাওনকে তাদের মনে ধরলো।
কিন্তু শাওনের চোখটা একবারের জন্যও আটকে গেলোনা।সে চোখ নামিয়ে চলে গেছে বাবার কাছে।রামিসা এক দৃষ্টিতে ওর চলে যাওয়া দেখলো।তার বাবা মা তাকে বলেছে শাওনের সঙ্গে বিয়ের কথা আজই বলা হবে।তাই তো তার সবচেয়ে প্রিয় রঙ পরে এসেছে।ইচ্ছে ছিল শাওনের প্রিয় রঙ পরে আসার।কিন্তু জানা হলোনা তার প্রিয় রঙটা কি।প্রথম যেদিন তৃনার সঙ্গে শাওনকে সে দেখেছিলো ঠিক সেদিনই ভালো লেগেছিলো ওকে।ভদ্র ছেলেদের প্রতি আলাদা আকর্ষণ থাকে।হয়ত সেই আকর্ষণ রামিসার মনেও সৃষ্টি হলো।লোভ লাগলো।শাওনের লোভ।
তার লোভের কথা জানালো মাকে।মা জানালো বাবাকে।এভাবেই আজ কথা এতদূর আসলো।
শাওন বাবার পাশে বসলো গিয়ে।মা এত রাতে নাস্তা তৈরি করছেন।ডিনার করাবেন বারোটায়।সবাইকেনদেখে মনে হয় সবেমাত্রই এসেছে।তার মানে বাবা আমাকে জলদি আনানোর জন্য মিথ্যে বলেছিল?
বাবার মুখে হাসি দেখেই বুঝে গেলো শাওন।নিজের কপালে নিজেরই চড় মারতে ইচ্ছে করছে এখন।রামিসাকে শাওনের সামনে বরাবর বসতে দিলো ওর মা।রামিসার বাবা বড়ই গম্ভীর স্বভাবের মানুষ।কথা বললে এক লাইন বলেন।পরের লাইন বলতে অনেক সময় লাগিয়ে দেন তিনি।তার পরেও আজ তার কি হলো কে জানে।শাওন কেমন আছে,কাজ কেমন চলছে এরুপ করে প্রায় পাঁচ/ছটা প্রশ্ন তিনি করে ফেলেছেন।তার ছেলে রামিম তো অবাক।বাবা এত কথা বলতে জানে??অবশ্য তাকে বলা হয়নি তার বোনের সঙ্গে আজ শাওনের বিয়ের কথা হবে।জনাব এনামুল অবশেষে ছেড়ে কাশলেন।বলেই ফেললেন রামিসা আর শাওনকে একান্তে কথা বলা উচিত।বললেন না ঠিক কি কারণে।তার মতে সকলেই জানেন আজ তাদের বিয়ের কথা হবে।শাওন ও জানে।বাবার দিকে তাকালো সে।বাবা হেসে হেসে মনে হলো ধাক্কা মারলেন তার হাসি দিয়ে।বাধ্য হয়ে শাওন তার রুমে এসেছে তাও রামিসাকে সাথে নিয়ে।রুমের শেষ প্রান্তে গিয়ে বিন ব্যাগে ধপাস করে বসে গেলো সে।
রামিসা বিছানায় বসে কানের পেছনে অবাধ্য চুলগুলোকে গুজে দিয়েছে।সে কিছু বলতে যাবার আগেই শাওন বললো,’তোমার পছন্দের কেউ আছে?’
-‘নাহ’
-“তার মানে আমাকেও তোমার পছন্দ না?’
-“না সেটা নয়।’
-“তাহলে কি?আমি তো তোমায় আমার কথাই জিজ্ঞেস করলাম। তুমি কি বুঝলে?আমাকে পছন্দ না করলে বিয়ে করলে তো সুখী হবেনা’
রামিসা ব্যস্ত হয়ে পড়ে বললো,’আপনি ভুল ভাবছেন।আমি তো বলতে চেয়েছিলাম আমি অন্য কাউকে পছন্দ করিনা’
-‘তার মানে আমাকে ছাড়া তুমি আর কাউকে পছন্দ করোনা।তোমার মা বাবাকেও না।আমার বোনকেও না?তোমার ভাইয়াকেও না?’
-‘আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন?অগ্রিম ভাবা ঠিক না’
-“আমি এভাবেই কথা বলি।আচ্ছা ছাড়ো ওসব।তোমার কি ভালো লাগে?’
-‘আমার ঘুমাতে ভালো লাগে’
-‘তোমাকে একটা ঘটনা শুনাই।মন দিয়ে শুনবে।প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো সবার শেষে।তো একবার কি হয়েছিলো!ঘটনাটা এক বছর আগের।ধানমন্ডিতে একটা পরিবার থাকতো।পরিবার বলতে একটা কাপল।স্বামী -স্ত্রী। স্বামীটা সারাদিন অফিসে থাকত।স্ত্রী কাজ করে সে ঘুমিয়ে পড়ত।সারাটা সময় ধরে শুধু ঘুমাতো।
কি আর করবে বলো।কাজ তো নেই।সেও তোমার মতোই ঘুমাতে ভালোবাসতো।তারপর একদিন কি হয়েছিলো জানো?সিলিন্ডার লিক হলো।গ্যাস ছড়িয়ে এট লাস্টে বুমমমমমমম।বলোতো কোন রুম?’
-‘রান্নাঘর’
-‘রং!বেড রুম ব্লাস্ট হলো।’
-“সিলিন্ডার তো রান্নাঘরে থাকে’
-“ওটাই তো!সে ঘুমের ঘোরে ডেলিভারি ম্যান থেকে সিলিন্ডার নিয়ে বেড রুমে রেখে দিয়েছিলো যেটা কিনা অলরেডি লিক হওয়া ছিল।তারপর আর কি বুমমম হয়ে পুরো বেডরুম উড়ে গেলো সাথে ঐ স্ত্রীটাও উড়ে গেলো।আহারে!!ঐ কেসটা আমি নিজে দেখতে গিয়েছিলাম।ফ্লোর পর্যন্ত ফুটা হয়ে ছিলো।কতটা মারাত্মক! ভাবতে পারো।ঘুম ভালো জিনিস।তবে এটাকে কন্ট্রোল করে রাখতে হয়।এরকম নেশাদ্রব্যের মতন সেবন করলে এমনটাই হবে।’
রামিসার কপাল ঘেমে গেছে।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো।শাওন এমন ভাবে কথাগুলো বললো যেন জলন্ত উদাহরণ সে দিচ্ছে।এটা মিথ্যে হতে পারেনা।
রশ্নি কপাল চাপড়াচ্ছে।এমন করে শাওন প্রতিবার বিয়ে ভাঙ্গে।
শাওন পায়ের উপর পা তুলে বললো,’তাহলে ভাবো তোমায় বিয়ে করলে আমার আই মিন আমাদের কি হাল হবে।আমি তো মরবোনা।মরবে তুমি।কারণ আমি সকালে বেরুলে বাসায় ফিরি রাত দশটায়’
রামিসা কাঁপা গলায় বললো,’আমরা তো জয়েন্ট ফ্যামিলিতে থাকবো তাইনা?আপনার বাবা,মা,আরিফার সঙ্গে একসাথে।’
-“না তো।কে বললো?আমার একবার এক জায়গায় ট্রান্সফার হয়।এরপর হয়ত খুলনা/বরিশাল/রাজশাহীতে হতে পারে।সাথে করে তো তোমায় নিয়ে যাব।আর যাই হোক তুমি তখন আমার স্ত্রী থাকবে’
-‘তাহলে এখন কি হবে?আই রিয়েলি লাইক ইউ।’
-‘আগামী পাঁচ/ ছয়দিন ধরে দিনরাত ২৪ঘন্টায় শুধু চার ঘন্টা ঘুমাবে।বাকি সময় চোখে টেপ মেরে বসে থাকবে। ঐ যে টম এন্ড জেরিতে টম টেপ লাগিয়েছিলো ঠিক সেরকম।
পারবে?’
চলবে♥