সঞ্চারিণী
আফনান লারা
১৮.
-‘শাওন ঠিকঠাক কাজ করে তো?নাকি সারাদিন ধরে ধরে ঝাড়ি দেয় সবাইকে?’
আন্টির কথায় মেধার খুব হাসি পেলো।যাকে বলে বুক ফাটা হাসি।কিন্তু শাওনের ভয়ে হাসিটাকে থামাতে গিয়ে একেবারে কাশি উঠে গেলো তার।তৃনা কাজ ফেলে এসে এক গ্লাস পানি দিয়ে গেলো ওকে।পানিটা খেয়ে মেধা বললো,’শাওন স্যার ঝাড়ি দেয়না’
শাওনের মা এবার জিজ্ঞেস করলেন মেধার বাসা কোথায়।কিসে চাকরি করে।
মেধা তার বাবার পরিচয় দিতেই উনি চিনে ফেললেন।একটু কাছে এসে উৎকণ্ঠা হয়ে বললেন,’তাহলে তুমি ফেরদৌস ভাইয়ের মেয়ে।বাহ বেশ ভালো।আমি তো ভাবতেও পারিনি তার মেয়ে তারই মতন এরকম সাহসী হবে।আসলে এসব চাকরি করা সবার সাধ্য না।উদ্যমী,
সাহসীরাই পারে দেশের জন্য লড়াই করে যেতে।আমি তো গর্ব করে বলি আমার শাওন ক্রাইম ব্রাঞ্চের অফিসার।তোমার পরিবার ও নিশ্চয় তোমায় নিয়ে গর্ব করে।যাই হোক,তোমার বাবা -মাকে নিয়ে অবশ্যই আসবে আমাদের বাসায়।দাওয়াত দিলাম।আসতেই হবে তা নাহলে শাওনকে দিয়ে আনাবো’
-‘আসলে আন্টি,বাবা মা আর আমার ছোটবোন কাল সকালেই পটুয়াখালী চলে যাবে।বাবার ট্রান্সফার হয়েছে তো তাই।’
-‘সেকি!তুমিও যাবে নাকি?’
-‘নাহ।আমার তো যাওয়া সম্ভব না।মিঃ রেদোয়ানের কেস এখনও পেন্ডিং হয়ে আছে।’
-‘ওহ আচ্ছা।তো একা থাকবে কি করে?’
-“আমার ফুফাতো বোন এসে থাকবে।তাছাড়া একা থাকার অভ্যাস আছে আমার।আহামরি কিছুনা।’
শাওন রেডি হয়ে এসে দেখলো তৃনা আর ওর মা মিলে মেধাকে জমপেশ খাওয়াচ্ছে।মেধা শেষে কূল না পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।এক ছুটে শাওনের কাছে গিয়ে বললো,’খাওয়ানো উচিত উনাকে।উনার শরীর দেখেছেন?অপরাধী খুঁজতে খুঁজতে তার কি হালটাই না হলো’
তৃনা হেসে বললো,’শাওন নুডুলস দুচক্ষে দেখতে পারেনা।মিষ্টির ধারের কাছেও তাকে পাওয়া যায়না।মোট কথা এক্সট্রা মিষ্টি আর এক্সট্রা ওয়েলের তৈরি খাবার সে খায়না।
মেধা ভেঁংচি মারলো।সবাই দেখলেও শাওন দেখলো না।কারণ ওকে লুকিয়েই ভেঁংচি মেরেছে সে।তৃনা,আরিফাকে হাসতে দেখে শাওন যেইনা পেছনে তাকালো মেধা মুখ ঠিক করে থতমত খেয়ে বললো,’স্যার যাবেননা?দেরি হয়ে যাচ্ছে’
শাওন আর কথা বাড়ালোনা।চললো ওকে সাথে নিয়ে।কার গ্যারেজ থেকে বের করে আনার পর মেধা আজ আবারও শাওনের পাশের সিটটায় বসতে গিয়ে ওর থেকে ধমক খেলো।শেষে বিড়বিড় করে গালি দিয়ে পেছনের সিটে গিয়ে বসেছে সে।
শাওন সেই আগের মতন রশ্নিট সাথে কথা বলছিল।মেধা তার মাথাটাকে মাঝে বরাবর ঢুকিয়ে কয়েকবার চেক করলো কিন্তু কিছুই দেখলো না।শাওন গড়গড় করে কথা বলেই যাচ্ছে রশ্নির সাথে।মহাখালীতে এসে মেধা ফোন টিপা বাদ দিয়ে খেয়াল করলো শাওন ঝিমোচ্ছে।তা দেখে ওর চোখ কপালে উঠে গেছে।মাথা এগিয়ে এনে চেঁচিয়ে শাওনকে ঝাঁকিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললো সে।শাওন চোখ ঘঁষে বললো,’কি হয়েছে?’
-‘কি হয়েছে মানে?এমন জায়গায় এসে কেউ ঘুমায়?আপনি ড্রাইভিং করছেন এই মূহুর্তে, সেটা মনে আছে নাকি ভুলে গেছেন?আপনি মরুন না আপনার অদৃশ্য প্রেমিকাকে সাথে নিয়ে।কিন্তু আমার ক্ষতি ডেকে আনছেন কেন?স্যারকে বলবো আর কখনও যেন আপনার সঙ্গে আমাকে কাজ করতে না দেয়।যদি দেয় তো চাকরি ছেড়ে দেবো’
-“এই বিষয়ে স্যারের সাথে আমার ও কথা আছে। ঘুরে ফিরে তিনি সবসময় তোমাকে আমার সাথে রাখে এটা ঠিকনা।
আর আমি কখনও ড্রাইভ করার সময় ঘুমাইনা।কাল ঘুমের ঔষধ খেয়েছিলাম বলেই হঠাৎ ঘুমে ধরলো’
-‘আজকে আপনার অফিসে আসা উচিত হয়নি।ছুটি নিয়ে নিতেন’
-‘আমার যত অসুখই হোক আমি ছুটি নেইনা।চুপচাপ বসে থাকো’
—
শাওন পকেট থেকে একটা চুইংগাম বের করে মুখে দিয়ে নড়েচড়ে বসলো।মেধা জানালায় হাত রেখে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে।
-‘শাওনের এই অদৃশ্য প্রেমিকাটাকে দেখার খুব ইচ্ছে।তবে তার কাজকর্ম দেখা কিন্তু তাকে না দেখতে পাবার সাইন্সটা মাথায় ঢুকছেনা কিছুতেই।সে কি ইচ্ছে করেই নিজের থেকে আমার সামনে লুকিয়ে থাকছে নাকি তাকে দেখতে না পাবার পেছনে অন্য কারণ।যেহেতু শাওন স্যার বাদে আর পাঁচটা মানুষ তাকে দেখতে পায়না সেখানে আমি তার কাজ দেখতে পাই অথচ তাকে দেখতে পাইনা।আমার মনে হয় তাকে একদিন দেখতে পাবো।সেদিনের অপেক্ষায় আছি।আচ্ছা স্যার একটা প্রশ্ন করবো?’
-‘না’
মেধার রাগ আরও বেড়ে গেলো।মুখের উপর না করার মানুষ একেবারে পছন্দ না তার।ইচ্ছে করছে সিটে একটা উষ্ঠা মেরে শ্যাওলা স্যারের নাক ফাটিয়ে দিতে।হাত মুঠো করে রাগ দমিয়ে নিলো সে।
রেদোয়ানের বাসা এসে গেছে।দরজা খুলে শাওনের আগেই চলে আসলো সে।শাওন একটু পরেই পৌঁছালো।আজকে রেদোয়ানের বাসার সামনের ভাঙ্গা লম্বা সরু কাঁচটা দেখছে সবাই।
সব কিছু বুঝতে পারলেও বাইরের এই আয়নাটা কেন ভাঙ্গা সেটা মাথায় ঢুকছেনা।রায়হান এসে কাগজ ধরিয়ে দিলো শাওনের হাতে।রেদোয়ানের ইনকাম ট্যাক্সের কাগজপত্র সব। তাতে যে অংক লেখা আছে, রেদোয়ানের ফুলদানি থেকে পাওয়া গুপ্তধন প্লাস করলে ইনকাম ট্যাক্স আরও বেশি হবার কথা।তার মানে সে ট্যাক্স দেওয়ার ভয়ে এত বড় ফুলদানি আনালো তারপর সেখানে লুকালো টাকা।বাহ!কি বুদ্ধি।এই বুদ্ধি নিয়ে শেষে কিনা মরলো।কি লাভ হলো?
যে ফুলদানিটা মিসিং সেটা এখনও পাওয়া গেলোনা।হিসেব মিলছেনা কিছুতেই।রেদোয়ানের বাসার ফ্রিজ থেকে সন্দেহ করার মতন কিছুই মিললো না।নিতু বমি করছে ওয়াশরুমে গিয়ে।রেদেয়ানের ফ্রিজে নাকি সব অক্টোপাস। অনেক মানুষেরই অক্টোপাস মাছ অনেক পছন্দের।কিন্তু নিতুর তার ঠিক উল্টো। দেশি মাছ ছাড়া বাহিরের কোনো মাছই সে খেতে পারেনা।খেতে পারা দূরে থাক, চোখের দেখা দেখলেও বমি এসে পড়ে ঠোঁটের দোরগোড়ায়।
মেধা ফ্রিজের সব ফলকে একটা ঝুঁড়িতে ঢেলে ছুরি দিয়ে একটা একটা করে কাটছে।এগুলোকেও পরীক্ষা করাতে পাঠাতে হবে।
শাওন ভাঙ্গা কাঁচটার সব হারানো অংশগুলো খুঁজছে নুহাশ আর রায়হানকে সাথে নিয়ে।
সাজিদ ওখান থেকে এসে মেধার সামনে বরাবর বসে বললো,’আপেল একটা খেয়ে দেখতে পারেন।আমি খেলাম।অনেক মিষ্টি’
মেধা চোখ তুলে সাজিদের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে হাসলো তারপর বললো,’এমন ও হতে পারে আপেল খেয়ে রেদোয়ান বা তার ওয়াইফ আশার মৃত্যু হয়েছে’
সাজিদ হাত ভাঁজ করে মাুখটা একটু এগিয়ে নিয়ে বললো,’উহু!তাদের শরীর রক্তাক্ত ছিল,ক্ষত ছিল।বিষক্রিয়া হতে পারেনা’
-‘যদি হয়?’
-‘হবেইনা।আমার এক্সপেরিয়েন্স আছে।এরকম কেস অনেক দেখেছি’
মেধা দাঁত কেলিয়ে বললো,’তাহলে তো বলতে পারবেন কে আসল খুনি?’
-“আমি জানি আসল খুনি কে?কিন্তু বলবোনা।কারণ আমি দেখতে চাই শাওন স্যার সঠিক মানুষটাকে খুঁজে বের করতে পারে কিনা।’
মেধা আপেলের টুকরো গুলোকে প্যাকেট করতে করতে বললো,’অনেক সময় নিজের বীরত্ব দেখিয়ে মনজয় করে নিতে হয়।
আমার মনে হয় আপনার কাছে এটা মোক্ষম সুযোগ’
-“শাওন স্যার খুঁজুক।তার দ্বারা যদি ভুল হয় তারপর নাহয় আমি সামনে দাঁড়াবো’
মেধা যেতে যেতে বললো,’ফ্লার্টিং করায় আপনার অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে।ফ্লার্টিং করতে এমন কিছু মিথ্যে ব্যবহার করবেন যেটা কিনা প্রয়োজনে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিতে পারেন।আপনাকে আমি দশে শূন্য দিলাম’
সাজিদ মাথার চুলগুলেকে এলোমেলো করতে করতে জিভে কামড় দিলো।মেধাকে দেখে এতক্ষণ বোঝার উপায় ছিল না যে সে সাজিদের ফ্লার্ট করা ধরে ফেলেছে সে।শাওন স্যার ঠিকই বলে।এই মেয়েটার মাঝে রহস্যের প্রতিটা অক্ষর একেবারে সুঁই সুতো দিয়ে আটকে দেওয়া।
—–
রায়হানকে ডেকে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়ে মেধা ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো গুলোর স্পটে এসে বললো,’হয়ত খুনি এখান দিয়ে প্রবেশ করেছে তাই এই গ্লাসের এমন করুণ পরিণতি।’
নুহাশ একটা কাঁচের টুকরোকে উল্টে পাল্টে বললো,’হ্যাঁ তাও হতে পারে’
শাওন মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’এত সোজা না।খুনি এত সাউন্ড করে ভেতরে যাবেনা খুন করতে।এটা কমন সেন্স।তাছাড়া মিস মেধা আপনি তো বলেছিলেন রেদোয়ানের কেসটা আত্নহত্যার কেস’
-‘কিন্তু আশার তো মার্ডার হয়েছে।হয়ত তাকে যে খুন করেছে সে এখান দিয়ে প্রবেশ করেছিল’
শাওন মেধার দিকে ফিরে বললো,’তাহলে তুমি আমায় বোঝাও।রেদোয়ান যদি আশাকে না মেরে থাকে।বাইরের কেউ যদি ওকে মেরে থাকে তাহলে কোন দুঃখে রেদোয়ান সুইসাইড করতে গেলো?’
নুহাশ কাঁচের টুকরো দিয়ে মাটি খু্ঁড়তে খুঁড়তে দুষ্টুমি করে বললো,’খুশির ঠেলায় মরছে।শুনছি রেদোয়ান নাকি মাঝে মাঝে পাগলামি করতো।তার পাগলামির ফুটেজ আসবে আজকে দুপুরের দিকে।’
-‘তাই নাকি?কিরকম পাগলামি?’
-‘ক্লাবে গিয়ে অতিমাত্রায় মদ খাওয়া তারপর উন্মাদের মতন নাচানাচি। টাকার ব্যবহার সে ক্লাবে বেশি করত।’
-‘তাহলে তো ফুটেজ পরে দেখা যাবে।আগে ঐ ক্লাবে যেতে হবে।আজ রাতে আমরা সেই ক্লাবে যাবো।রেদোয়ানের আশেপাশে অথবা ঐ ক্লাবে যতজন যেতো সবাইকে জিজ্ঞাসা করতে হবে’
-“তাদের আবার কি জিজ্ঞেস করবে?’
-“হতে পারে তাদের মাঝেরই কেউ খুনি।রেদোয়ানের শত্রুর অভাব নেই।টাকা থাকা মানুষের শত্রু এমনি এমনি হয়।হয়ত রেদোয়ানেরও তাই।আমরা আগে টার্গেট করবো তার ঘনিষ্ঠ ফ্রেন্ডদের।তাদের থেকে অনেক ক্লু পাওয়া যাবে’
চলবে♥
Afnan Lara