সঞ্চারিণী পর্ব-৫৪

0
655

সঞ্চারিণী
আফনান লারা

৫৪.
রেদোয়ান ভেবেছিল মেধাকে শাওন কখনও খুঁজে পাবেনা।সেটা অবশ্য ঠিকই ভেবেছিল।শাওন ওকে নিজ থেকে খুঁজে পায়নি প্রথমে।কিন্তু মেধা তো সঞ্চারিণী।
সঞ্চারিণীদের কেউ আটকে রাখতে পারে নাকি?
তাদের তো কাজই হলো সঞ্চার করে বেড়ানো।তাকে কি আর বন্দী করে রাখা যায়?মেধা কৌশলে ঐ ঘর থেকে বেরিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করলো একটা নির্জন জায়গায় যেখানে দূর দূরান্তেও গাছপালা ছাড়া নজরে কিছুই আসেনা।তাই যদি হয় তবে এখানে আর যারা এসেছে তারা কিভাবে এসেছে?
রেদোয়ানের রাখা লোকগুলো সব দূরে বসে চা পান করছিল।ঠিক সেসময়ে মেধা বেরিয়ে পড়েছে।পা ব্যাথা হওয়া পর্যন্ত সে ছুটেছে।পথের কোনো শেষ সে পাচ্ছেনা।যতদূর চোখ চায় শুধু গভীর জঙ্গল।একটা না একটা তো পথ থাকার কথা তা নাহলে তো এখানে যারা এসেছে তারা বের হতেই পারবেনা।
অনেকটা সময় দৌড়ে,হেঁটে যাবার পর মেধা নির্জন জায়গায় নির্জন মাটির পথ পেলো।অন্ধকারে ছুটছিল।পথ চিনেছে একটুখানি আলো দেখে।
ভয়ে ভয়ে পা ফেলে পথে এসে দেখলো মাটির পথ যেখানে শেষ সেখান থেকে গাড়ী চলাচলের রাস্তা পড়ে।একটা পুরোনো টিনের ঘরের বাহিরে আলো জ্বলছিল।
অন্ধকারে এতটা পথ আসতে মেধার ভয় লাগেনি।একমাত্র ভয় রেদোয়ানের সামনে ধরা না পড়ার।শাওনকে জানাতে হবে রেদোয়ান মরেনি।
এক বিপদ গিয়ে আরেক বিপদ ধরা দিয়েছে হঠাৎ।
এই পথটাও শেষ হবার নাম নিচ্ছেনা।একটা গাড়ী তো দূরে থাক একটা মানুষ ও নজরে আসলোনা।এভাবে কতদূর যেতে হবে?ঠিক কতদূর গেলে একটা ঠিকানা পাওয়া যাবে?
অনেকটা পথ হেঁটে আসার পর একটা কার দেখে মেধা হাত উঠালো হেল্পের জন্য।
হাত উঠিয়ে হেল্প চাওয়ার পর মেধার মাথায় আসলো এটাতো রেদোয়ান বা তার সহযোগীদের কারও হতে পারে।
এটা ভেবে মেধা পাশের একটা গাছের পেছনে লুকিয়ে পড়লো তৎক্ষনাৎ।কার থেকে দুই তিনটা ছেলে বের হয়ে দাঁড়িয়েছে।দেখে নেশাখোর মনে হয়।
মেধা কারের আলোতে সবার মুখ দেখে বুঝতে পারলো এরা কেউই রেদোয়ানের সহযোগী বা সে নিজে না।কিন্তু তারপরেও মেধা ঐ ছেলেগুলের সামনে গেলোনা।লুকিয়ে থাকলো গাছের পেছনে।
যেরকম হেলেদুলে কথা বলছে।মেধাকে একা পেলে তারা হাতছাড়া করবেনা।এখন গায়ে সেই শক্তি নেই যে একসাথে ৩টা ছেলের সঙ্গে সে লড়বে।এইভেবে মেধা আড়ালেই থেকে গেলো।ছেলেগুলো অনেক খোঁজাখুঁজি করেও না পেয়ে চলে গেছে।ঠিক দশ মিনিট পর আরেকটা গাড়ী দেখলো মেধা।জিপ টাইপের।
সন্দেহ মাথায় রেখে মেধা আগের মতন হাত বাড়িয়ে গাড়ী থামাতে বলে চটজলদি আবার লুকিয়ে পড়লো।জিপটা থামলো।ভেতর থেকে কে নেমেছে তা দেখা যাচ্ছেনা কারণ লোকটা অন্যদিকে মুখ করে পেছনের রোড দেখছে।মেধা একটু এগিয়ে গেলো দেখার জন্য ঠিক সেময়ে ওকে পেছন থেকে কেউ একজন টান দিয়ে সরিয়ে নিলো।
মেধার ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে।বুকের ভেতর ধুকধুক করছে।শাওন ওকে টেনে নিয়ে এসেছিল।ওর মুখে হাত রেখে ফিসফিস করে বললো,’ওটা রেদোয়ান’

মেধা মাথা নাড়িয়ে বললো,’আমিও জানি।আপনি জানলেন কি করে?’

-‘আমার সাথে ওর দেখা হয়েছে এখান থেকে এক কিলোমিটার পথ আগে।আমাকে দেখে পালিয়ে এদিকে এসেছে।আমার গাড়ী নষ্ট বলে আমি হেঁটে এদিকে আসছিলাম বনের ভেতর দিয়ে,ভাবলাম শর্টকাটে গিয়ে যদি ধরতে পারি।তখন তোমায় দেখলাম জিপটাকে থামালে মাত্র।’

-‘রেদোয়ান আমাকে মারতে চায়।প্রয়োজনে আপনাকে মারলেও দ্বিধান্বিত হবেনা’

-‘আমাদের এই জায়গায় থাকাটা ঠিক নয়।হসপিটালের পেছনের একটা ফার্মেসীর সিসি ক্যামেরায় দেখা গিয়েছিল তোমাকে যে গাড়ীতে করে ওরা নিয়ে এসেছে।ঐ গাড়ীর লোকেশান জেনে আমি এতদূর আসতে পারলাম।অনেক সময় লেগে গেলো ইতোমধ্যে’
—–
রেদোয়ান ফোনের আলো জ্বালিয়ে এদিকে আসছিল মাঝে পথে থেমে গিয়ে ফোন করে কার সাথে কথা বলে রাগ দেখিয়ে জিপে একটা লাথি মারলো।
মেধার পালিয়ে আসার কথা তার কানে পৌঁছে গেছে।শাওন আর মেধা চুপ করে দাঁড়িয়ে রেদোয়ানকে দেখছে।

দু মিনিট পর রেদোয়ান জিপে উঠে চলে গেলো সামনের দিকে।শাওন আর মেধা রোডে চলে এসেছে এবার।

-‘ আমাদের তো পালানো উচিত না শাওন!আমরা অফিসার!রেদোয়ান একজন খুনী।ওকে তো ধরতে হবে’

-‘আমার রিভলভার ফেলে এসেছি কোথায় জানিনা।তোমার কাছেও তো নেয়??রেদোয়ানের ভাঁড়া করা লোক অনেক।এতজনের সাথে আমরা খালি হাতে মারপিটে পারবোনা।
শুট করে বসবে!’

-“রেদোয়ানকে হাত ছাড়া করার মানে বুঝেন??ওরা যেভাবে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে।কেসটা আরও কতদূর যাবে?আজকে সুবর্ণ সুযোগ এই কেসের অন্তিম পর্ব শেষ করার।’

দুজনে ভাবছিল কি করে কি সিদ্ধান্ত নেবে ঠিক সেসময়ে রেদোয়ানের জিপ ওদের সম্মুখে এসে থেমেছে।মেধা আর শাওন সেদিকে তাকিয়ে দেখছে কি করে সে।রেদোয়ান গাড়ী থেকে হাত তালি দিতে দিতে নেমে তার সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো।হাসতে হাসতে বললো,’বাহহহ!কানের সাথে মাথাও এসে গেলো।আমার আর অহেতুক পরিশ্রম করতে হলোনা।বাহ বাহ’

শাওন এগিয়ে গিয়ে রেদোয়ানের গলা চেপে ধরে বললো,’চলো!!জেলের ভাত খাবে।প্রচুর লুকোচুরি খেলা খেলেছো’

রেদোয়ানের কোনো রিয়েকশান না দেখে শাওন পেছনে তাকিয়ে মেধাকে দেখলো।মেধা ও এগিয়ে এসে বললো,’কিসের বলে এমন চেয়ে আছো??তোমার দিন শেষ।আশাকে মারার শাস্তি এবার তুমি পাবে।’

-‘আচ্ছা আমি বরং মেধার প্রশ্নের উত্তর দেই??আমার কোনো রিয়েকশান নাই কেন জানো?
কারণ আমার দিন শেষ হবেনা,তোমাদের দিন শেষ হবে।আমি কিন্তু আজ একা নই,তোমরা একা।’

ঠিক সেই মূহুর্তে কয়েকটা গাড়ী এসে থামলো।রেদোয়ানের ভাঁড়া করা সমস্ত লোকেরা এসে চারিদিকটা ঘিরে দাঁড়িয়েছে।শাওন হাত কচলাচ্ছে।প্রথমে শাওনই মারামারি লাগিয়েছিল।
বিপত্তি ঘটলো অন্য কারণে। রেদোয়ান হঠাৎ মেধার হাত ধরে টানা ধরেছিল।কিন্তু সে জানতোনা মেধা হুশে থাকলে ওর সাথে জবরদস্তী করা অসম্ভব। ঠিক তাই হলো।মেধার মারামারি দেখে শাওনই তার মার থামিয়ে দিয়েছে।মেধার হাতে রেদোয়ানকে মার খেতে দেখে সে হাসা ধরলো কিন্তু তারা দুজনেই জানতোনা রেদোয়ান ক্যারাটে জানে।সে হুডি খুলে এবার মেধার উপর আক্রমণ করলো।
দুজনের লড়াই চলছিল।ওদিক দিয়ে শাওন বাকিদের জন্য মেধার কাছেও আসতে পারছিলোনা।লোকসংখা এত বেশি ছিল যে এবার অর্ধেক লোক গিয়ে মেধাকে আটকে ধরেছে।কারণ রেদোয়ান যেমন ক্যারাটে জানতো মেধা ক্যারাটে,আর বক্সিং দুটোই জানতো।তার সাথে শেষের দিলে রেদোয়ান নিজেই পারছিলোনা।
রেদোয়ানকে রক্ষা করতে মেধার দুহাত ধরে দুজন মিলে ওকে থামিয়ে দাঁড়ালো।রেদোয়ান হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,’কি তেজ!!’
.
শাওন তার আশেপাশের গুলোকে যত মারছে তত তারা সংখ্যায় আরও বাড়ছে।পুরো তৈরি হয়ে এসেছে রেদোয়ান।
মারামারির এক পর্যায়ে শাওন পেছনে তাকিয়ে খেয়াল করলো রেদোয়ান একটা গাছের ঢাল হাতে এগিয়ে যাচ্ছে মেধার দিকে।শাওনের অন্যমনস্ক ভাব লক্ষ করে কয়েকজন মিলে ওকে ঝাপটে ধরে ফেললো সেই সুযোগে।
মেধা চুপ করে রেদোয়ানকে এগিয়ে আসতে দেখছে।
রেদোয়ান সবার আগে আঘাত করেছিল মেধার পায়ে।
এক বার দুবার করে তিন চারবার।মেধার অজ্ঞান হবার মতন অবস্থা হলো।
নির্জন একটা জায়গায় শাওন যেটা ভেবেছিল সেটাই হচ্ছে।আর মেধা যেটা ভেবেছিল তার উল্টোটা।তারা দুজন এতগুলো মানুষের সাথে পেরে ওঠার কথানা।
মেধাকে কষ্ট পেতে দেখে শাওনের সহ্য হচ্ছিলো না।কোনোমতে নিজেকে ছাড়িয়ে এদিকে আসতে নিতেই লোকগুলো মেধার হাত ছেড়ে শাওনকে আটকাতে ছুটলো।মেধা পায়ে হাত দিয়ে শাওনের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলছে,’সে ঠিক আছে।’
ওদিকে রেদোয়ান ফোন নিয়ে রকিকে কল করছে বারবার।
সাজিদ আর মিলন মিলে রকিকে নিয়ে এই পথেই যাত্রা হয়েছিল,রকিকে একা রাখা রিস্ক মনে করে।
—-
-‘রকি কাম অন!কল পিক করো।তোমার উপহার আমার সামনে যন্ত্রনায় ছটফট করছে!!এই মূহুর্তে তার লড়ার কোনো গতি নাই।জলদি এসে গ্রহণ করো।নাহলে আমার হাত চুলকায়।এরে মেরে একটু রেস্ট নেবো।এই দেশে আর থাকা হবেনা।মালদ্বীপ চলে যাব।এ্যামিলির ছোটবোন আমার অপেক্ষা করছে।’
—-
তারা সবাই এতক্ষণ রেদোয়ানের জিপের আলোয় মারামারি করছিল।শাওন হঠাৎ মারামারির পালা শেষ করে তার আশেপাশের লোকগুলোকে প্রতিহত করে রেদোয়ানের পকেট থেকে রিভলবারটা ছিনিয়ে নিয়ে জিপের দুইটা লাইটে শুট করে দিলো।মূহুর্তেই জায়গাটা অন্ধকারে পরিণত হয়েছে।রেদোয়ান তাড়াহুড়ো করে ফোনে ফ্ল্যাশ অন করতেই দেখলো বাকি কজন লোক উপস্থিত থাকলেও শাওন আর মেধাই উধাও।
রেগে মেগে চেঁচিয়ে সে বললো,’ফাইন্ড দেম’
চলবে♥