হৃদমাঝারে তুমি ছিলে পর্ব-২৯

0
690

#হৃদমাঝারে_তুমি_ছিলে❤
#পর্ব___২৯
#কায়ানাত_আফরিন❤

উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁট গভীরভাবে চেপে রেখেছে মাইশা। চোখে মুখে বিরাজ করছে টানটান উত্তেজনা। এই নিস্তব্ধতায় শুধু ওর প্রগাঢ় শ্বাস ছাড়া আর কিছুই অনুভব করতে পারছে না। একটা চাদর পেচিয়ে গেটের কাছে অপেক্ষা করছে আয়াতের আসার জন্য।
ঢাকার উত্তরার এ অংশটিতে রাতের গভীরতার সাথে নিস্তব্ধতা কেমন যেন হুড়হুড় করে বাড়ে। সুনসান পথের মাঝে কেমন যেন একটা ভুতুড়ে ভুতুড়ে ভাব।সেই সাথে ঠান্ডা হাওয়ায় কেমন যেন একটা ঝিমানো অনুভূতি। মাঝে মাঝেই পথের ধারের কৃষ্ণচূড়া গাছটি থেকে অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছে।মাইশার এখন কেমন যেন ভয় করছে । একপলক ভাবলো, চলে যাবে ভেতরে? পরমুহূর্তেই বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে দিলো। আজ এইমুহূর্তে আয়াতকে না দেখলে ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। লাগুক ভয়, তবুও এই এক ঘন্টার অপেক্ষাকে বিফলে যেতে দেবে না।

বেশ কিছুক্ষণ পর মাইশার অপেক্ষার পূর্ণতাটি ওর দোরগোড়ায় এসে হাসির হলো। অপেক্ষারত মুখে এবার ছেয়ে গিয়েছে উজ্জলতার নূরালো ছাপ। আয়াত এসে শব্দহীনভাবে এক কোণে বাইকে ব্রেক কষলো। মাইশার সাথে চোখাচোখি হতেই মুখে ফুটে উঠেছে একটা মুচকি হাসি। রাতের আধঁারে এমন একটা ছেলেকে মুচকি হাসতে দেখতে যে কেউ মনে করবে এ যেন এ মায়ারাজ্যের রাজকুমার। কোনো ছেলের মুচকি হাসাতেও গালে যে নিখুঁতভাবে একটা টোল পড়ে মাইশার তা জানা ছিলো না।

মাইশা বাড়ির গেটের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে আর আয়াত বাইরের এককোণে। আয়াতকে দেখে তাই একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে বাড়ির সামনের প্রান্তের ছোট গেটটি খুলো দ্রুতপায়ে গেলো আয়াতের কাছে। আয়াত বাইকের কাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।গায়ে সাদা শার্ট । হাতাগুলো ভাঁজ করা। হাতে সিলভার রঙের ঘড়ি, ওপরের দুটো বোতাম খোলা, জিন্স আর পায়ে হোয়াইট কেডস। গলায় এখনও রেডিও স্টেশনের আইডি কার্ডটি ঝুলছে, বাতাসের তালে তা উড়াতে অন্যরকম সুন্দর লাগছে আয়াতকে। চুলগুলো একটু অগোছালো, মুখে ক্লান্তির ছাপ। মনে মনে খারাপ লাগলো একটু মাইশার। এই ছেলে নিজের ক্যারিয়ার সেটেল করার জন্য দিনে পড়াশুনা আর রাতে কাজ করে আর সেইসব পরোয়া না করেও ওর এক কথায় মুখ বুজে এসে পড়লো আয়াত? ভালোবাসা বুঝি এতটাই আবেগে জর্জরিত হয়?

মাইশা কিছু না বলে হুট করে আয়াতের বুকে মিশিয়ে ফেললো নিজেকে। নিজের দুহাত দিয়ে শক্তভাবে আকড়ে ধরেছে আয়াতের পিঠ। আয়াতের বুকের কাছে মুখ ডুবিয়ে এক নাগাড়ে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো আয়াত। এতক্ষণের ক্লান্তি মাখা মুখে এবার বিরাজ করছে রাজ্যের বিস্ময়।মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে।মেজমেজে লাগছে শরীর। শিরায় উপশিরায় চাঞ্চল্যতার ভাব। এই মেয়ের মাথা ঠিক আছে তো? নিজেরই বাড়ির সামনে এভাবে মাঝরাতে নিজের প্রেমিককে জরিয়ে ধরতে একবারও বুক কাপলো না? একেবারও মনে ভয় হলো না যে , কেউ দেখে ফেললে কি হবে।রাত ক্রমশই গভীর হচ্ছে। তারই সাথে বেগ পাচ্ছে ঝড়ালো বাতাস। কৃঞ্চচূড়া গাছের ডাল কেমন যেন মড়মড় করে ওঠছে। আয়াতের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসলো। তাই আস্তে করে মাইশাকে ছাড়িয়ে ধপ করে বসে পড়লো বাইকের সিটে।

মাইশা এতে অবাক। খানিকটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে ছেলেটার দিকে। কোনো ছেলেকে এভাবে জরিয়ে ধরলে সে যে স্তব্ধ হয়ে যায় জানা ছিলো না মাইশার। আয়াত বাইকে বসে দুহাত দুপাশে ভর দিকে খোলা আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বুঁজে আছে। ত্যাগ করছে বড় বড় নিঃশ্বাস। হয়তো নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।মাইশা অবাক হয়ে বললো,

–”ক-ক-ক-কি হয়েছে আ-আয়াত?”

আয়াত গম্ভীরস্বরে বললো,

–”আমায় পাগল বানানোর ষড়যন্ত্র করছো নাকি এই মধ্যরাতে নিজে পাগল হয়ছো? কোনটা হয়েছে বলো তো? এমন পাগলামো কেনো করছো মাইশুপাখি? তুমি বুঝো না তোমার এসব পাগলামি আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেয়? আমার পাগলামি পরে সামলাতে পারবে তো?”

আয়াতের নেশাকাতুর কন্ঠে বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে মাইশার মন। কেপেঁ কেঁপে উঠছে একটু। আয়াত এবার চোখ নামিয়ে মাইশার মায়াবী চোখে চোখ মিলালো। চোখে খেলা করছে হাজারো অব্যক্ত কথা। উঠে দাঁড়ালো আয়াত।সেই বিক্ষিপ্ত চোখে চোখ রেখে মাইশাকে বলে উঠলো,

–”কাছে এসো।”

মাইশার ভাবভঙ্গি এলোমেলো হয়ে গেলো মুহূর্তেই। শূর্ণ্যমস্তিষ্কে সেভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেই আয়াত নির্বিকারভাবে মাইশার বাহু ধরে নিজের কাছে টেনে নিলো। অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো মাইশা। তাই বিচলিতভাবে বললো,

–”কি করছো তুমি ? ”

–”হুসসস……………”
আয়াতের মিহি গলা। মাইশার মুখের ওপর আয়াতের উত্ত্যপ্ত নিঃশ্বাস পড়ছে। মাইশা আবারও বলে ওঠলো,

–”কেউ দেখে ফেললে কি হবে?”

–”যখন আমার বুকে নিজেকে মিশিয়ে ফেলেছিলে তখন মনে ছিলো না?
আয়াতের কাঠ কাঠ উত্তর।

হঠাৎ বাকশূণ্য হয়ে গেলো মাইশা। কৃষ্ণচূড়া ফুলের তীব্র অনুভূতিতে মনে অদ্ভুত বাসনা জেগে উঠছে। তার সাথে প্রেমিকের উষ্ণ আবেগি ছোঁয়া মাথায় কেমন যেন ঝিম ধরিয়ে দিচ্ছে।মনে হচ্ছে এখনই বাতাসের বেগে হারিয়ে যাবে।আয়াত আলতো করে মাইশার কপালের কাছ থেকে চুল সরিয়ে কপালে নরম ঠোঁট বুলিয়ে মাইশাকে ছেড়ে দিলো। সরে গেলো একটু দূরে।মাইশা তখনও সেভাবে ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বেহায়া মনে কেমন যেন আয়াতের স্পর্শ পাওয়ার জন্য আরও আকুপাকু করছে।

আয়াত মৃদু স্বরে বললো,

–”আমায় প্রাণভরে দেখা হয়েছে মাইশু?”

আয়াতের কথায় মাইশার ধ্যান ভাঙলো।মাথা ঝাকিয়ে বাচ্চাদের মতো করে বললো,

–”নাহ ! ভুলে গেছো যে আমি কি কি বলেছিলাম?”

–”না তো।আমার সব মনে আছে। আমায় দেখামাত্রই আমায় টাইট একটা হাগ করে বুকে মুখডুবিয়ে রাখবে। সেটা তো হয়ে গিয়েছে।এখন এতো কথা বলো না সোনা। আমায় দেখার আবদার করেছো। আমি এসেছিনা? এখন যাও। রুমে গিয়ে একটা সুন্দর ঘুম দাও।”

–এখন যাবোনা। ১০ মিনিটই তো হলো তুমি আসলে । আরও কিছুক্ষণ থাকি?

মাইশার অসহায় কন্ঠ। আয়াত চুলে হাত বুলিয়ে বললো,

–ইয়া খোদা ! এই মেয়ে আমায় পাগল করেই শান্তির ঘুম দিবে।

ভ্রু কুচকালো মাইশা। তারপর বলে উঠলো,
–”আমি এখন যাবো না রুমে। আরও কিছুক্ষণ তোমার সাথে থাকবো। ব্যস !”

–”আরও কিছুক্ষণ? [অবাক হয়ে]

–”হ্যাঁ”

–”তো কি করবে এখানে?”

–”ফুটপাতে বসে বসে গল্প করবো। নাহলে এক কাজ করি , হিমু-রূপার মতো হাতে হাত ধরে শহরে ঘুরোঘুরি করি। ভালো হবে না?আফটার অল আমার হুমায়ূন প্রেমি হবু শ্বশুড়ের ছেলের বউ বলে কথা।”

আয়াত কিছুক্ষণ শান্ত চাহিনী নিক্ষেপ করলো মাইশার দিকে। তারপর বলে উঠলে,

–”হয়েছে উদ্ভট কথা? নাও গো।”

–”এমন করছো কেনো তুমি?আমি কি তোমার সাথে এখানে একটু থাকতে পারিনা?

ক্ষেপে গেলো আয়াত। খানিকটা রাগ চেপে বললো,

–”না পারো না। ভুলে যেও না আমরা হাজবেন্ড ওয়াইফ না। তোমার জিদের জন্যই এখানে এসেছি আমি। একটাবার ভেবে দেখেছো যে এট এনি চান্স তোমার ফ্যামিলি আমাদের এভাবে দেখলে কি হবে? ভেবে দেখেছো?

শেষ কথাটি একটু উচ্চস্বরে বললো আয়াত। মাইশা বাকশূণ্য হয়ে গিয়েছে। আয়াতের এমন ব্যবহারে খারাপ লাগা শুরু হয়েছে মনের ভেতর। আয়াত মাথা চেপে ধরলো। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

–আই…………..আই এম সরি। আমি এমন বিহেব করতে চাইনি। কিন্ত জান বোঝার চেষ্টা করো এখানে আমাদের এভাবে দেখা করাটা মোটেও সেফ না। যতই আমরা বলিনা কেন আমাদের মধ্যে কিছুই হয়ি কিন্ত সমাজ আমাদের চরিত্রে দাগ লাগিয়ে দেবে।”

–তো সমাজের কথা ভেবে আমরাও নাহয় সবকিছু শেষ করে দেই। কি বলো?

মাইশার শান্ত কন্ঠ। আয়াত কাছে এসে দাঁড়ালো মাইশার। ফিসফিসিয়ে বলে ওঠলো,

–এভাবে বলো না মাইশু। বোঝার চেষ্টা করো। আর তোমার কি হয়েছে বলো তো? এত মাতাল হয়ে যাচ্ছো কেনো?এমনিতেও তোমায় দেখলে মাথা আমার ঠিক থাকে না আর মাঝরাতে যদি এমন নির্বিকার হয়ে ওঠো তো নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে কষ্ট হয় না?আমার এই অনুরোধটা রাখো প্রিয়। প্লিজ এখন চলে যাও। আমাদের সম্পর্কটা একবার মেনে নিক সবাই । তারপর আর কোনো ছাড়াছাড়ি হবে না। এবার যাও।

মাইশা কিছু না বলে নিরবে গেটের দিকে রওনা হলো মাইশা।আয়াত বাইকে বসতে বসতে একটু জোরালো গলায় বললো,

–তোমার বাপ-ভাইকে বলে দিও ……………আরহাম আয়াত খুব শীঘ্রই তার মাইশুপাখিকে বউ বানানোর জন্য নিতে আসবে।

মাইশার বুকে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো আয়াতের কথায়। চারদিক থেকে এই নীরব রাতের মোহনীয়তা যেন ওকে গ্রাস করে ফেলছে। মনে মনে ভাবছে যে……….আহা ! এত সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে কেনো?
.
.
.
.
~চলবে………..ইনশাআল্লাহ