#হৃদমোহিনী
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৪
-কেন এরকম বলছেন? আপনি তো আমায় ভালোবাসেন না?
-ভালোবাসি কিনা জানিনা। তোমাকে আমার প্রয়োজন?
-আমি কি সবার প্রয়োজন মেটানোর জন্য পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছি?
-জানিনা। তবে বুঝতে পারছি তোমাকে ছাড়া আমার গতি নেই।
-গতি করে নিলেই পারেন।
-সেটাই তো করতে চাই। তোমাকে আমার চাই।
আমি ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে দিলাম।
-আমি চাইনা আপনাকে।
ধূসর বলল, ‘কেন চাওনা? আমি কি তোমায় খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি?’
-আপনি জানেন না?
-না। আমি শুধু জানি অর্নি চলে যাওয়ার পর তুমি আমায় সামলিয়েছো।
-হুঁ। এখন আমার প্রয়োজন থাকার কথা নয়।
-তুমি আমায় ডিভোর্স দিতে পারবেনা।
আমি অবাক কন্ঠে বললাম, ‘কেন?’
-আমি বলছি তাই। কোন সাহসে বারবার এই কথাটা বলো? যতোবার বলো ততোবার আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
-বাহ! এজন্য এসেছেন? এতো প্রেম?
-মজা করছো?
-না।
-আপনার সমস্যাটা কী জানেন? আপনি আমায় ভালোবাসেন না। এখন যদি ডিভোর্স দিই তাহলে আপনি অপমানিতবোধ করবেন! শুধু এজন্য আমার কাছে এসেছেন যাতে অর্নির মতো দেখতে মেয়েটা সারাজীবন আপনার চোখের সামনে থাকে। আপনি অর্নির স্মৃতি নিয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দিবেন।
ধূসর মুখটা উঁচু করে বলল,
-একবার বললাম, অর্নির মতো বউ কখনো হতে পারবেনা তুমি। আমি আরুণীকেও চাই।
-আসলে, আপনি আমার মায়ায় পড়ে গেছেন। সব চাওয়া সবসময় পূরণ হয়না। এই যেমন একটা সময় আপনাকে মনেপ্রাণে স্বামী হিসেবে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছি।
-এখন?
-আঁশ মিটে গেছে।
-ভালোবাসোনা আমায়?
-ভালোবাসা এতো সহজ নয়। অপাত্রে ভালোবাসা দান করিনা আমি, আমায় তো আপনি ভালোবাসেননি! যেটুকু মায়ায় পড়েছেন সেটাও একসময় ফুরিয়ে যাবে।
ধূসর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
-এতকিছু জানিনা আমি। আমাকে ছাড়তে পারবেনা কোনোদিন, বলে দিলাম।
-দেখা যাবে!
সেই রাতে ধূসরের বলা কথাটা হৃদয়ে গেঁথে গেলেও পরে মনে হলো অর্নিকে ধূসর ভুলে গিয়েছে। বিয়ের তিনমাসের মাথায় কেউ যদি তার পাঁচ বছরের ভালোবাসাকে ভুলে যেতে পারে তাহলে আমাকে ভুলতে কতোদিন? আমায় তো ভালোবাসেনি। ভালোবাসাকে ভুলে যেতে পারলে মায়াটাকে ভুলতে কদ্দিন? কোনোদিন যদি আমি মারা যাই?
ধূসররা অনির রিসেপশন পর্যন্ত আমাদের বাড়িতেই থেকে গেলো। এর মধ্যেই সপ্তাহখানিক কেটে গিয়েছে। আমার এক্সামও শেষ। ধূসর ফোন দিলেও আমি ধরিনা। ম্যাসেজ করে, রিপ্লাই করিনা। আমার প্রচুর রাগ হলো কেন অর্নির প্রতি এতোটা উদাসীন হয়ে গেলো। আসলে আমি অর্নির প্রতি জেলাস বা হিংসুটে নই। সে আমার কলিজার একটা অংশ। শুধু ওর ভালোর জন্য, ওর ধূসরটাকে সামলানোর জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। সংসারটা টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। সময় পরিবর্তনশীল! এতোদিন তো আমি চাইতাম ধূসরকে, সেও চায়। তবে ভালোবেসে নয়। আফসোস!
এদিকে আমার স্বাস্থ্য, খাওয়াদাওয়ার পরিবর্তন বাসার সবার চোখেই পড়তে লাগলো। ভাবলাম চুপিচুপি গিয়ে একদিন ডাক্তার দেখিয়ে আসবো, আব্বু-আম্মু জানলে চিন্তা করবে, তারপর শরীর খারাপ!
যেই কথা সেই কাজ। একদিন ডাক্তারের কাছে গেলাম৷ কয়েকটা টেস্ট দেওয়া হলো করলাম। পরে গিয়ে রিপোর্ট নিয়ে আসতে বললো। আমি ডাক্তার মিথিলার কাছে সেলফোন নাম্বার দিয়ে এসেছিলাম কিন্তু সেদিন আর যাওয়া হয়নি। দুপুরে দিকে হঠাৎ ধূসরমানবের আগমন। তখন সবে আমাদের খাওয়া শেষ। সবাই অবাক হলো। ওনি দুপুরের খাবারও খেলেন না। কেমন একটা হম্বিতম্বি ভাব, আমি এড়িয়ে গেলাম ওনাকে। একটু পর ঘরে চলে এলাম। ওনিও পেছন পেছন এলেন। আননোন নাম্বারে একটা ফোন এলো সেইসময়। হসপিটালের নাম্বার,আমিই দিয়ে এসেছিলাম যাতে রিপোর্ট না আনলেও ফোন করে জানিয়ে দেয়। আম্মু ডেকে ধূসরের জন্য বানানো কফিটা নিয়ে যেতে বললেন আমাকে। আমি ফোনটা কেটে দিলাম। কফি এনে ধূসরের হাতে দিতেই সে অগ্নিচোখে আমার দিকে তাকালো। কটমট করে বলল, ‘কী সমস্যা তোমার?’
-আমার কোনো সমস্যা নেই।
-তাহলে ফোন ধরোনা কেন? ম্যাসেজ দিলেও কথা বলোনা!
-আমার মুড নেই।
-কাল রেডি হয়ে থাকবে। সকাল সকালই বাড়ি যাবো আমরা।
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওনাকে বললাম, ‘আমি কেন যাবো? আমি যাবোনা।’
ওনি রেগেমেগে মগটা আছাড় মারলেন ফ্লোরে। চিৎকার করে বললেন,
-যাবেনা? তোমার ঘাড়ও যাবে। হাত-পা বেশি লম্বা হয়ে গেলে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেবো বুঝলি!
আমি ভয় পেয়ে গেলাম। এমন তুইতোকারি ব্যবহার কেন! ওনার চিৎকারে ততক্ষণে বাসার সবাই এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে। আব্বু বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে?’
ধূসর বলল, ‘আপনার এই বেয়াদব মেয়েটা আমার সাথে যেতে চাচ্ছেনা।’
-কোথায় যেতে চায়না?
-আমাদের বাসায়।
আব্বু আমাদের দুজনকে কথা বলতে দিয়ে সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ায় ওরা কী করবে? নিজেদের মধ্যে খোলাখুলি কথা বলে মীমাংসা করে নেওয়াই ভালো। তাছাড়া বাসার কেউওই জানেনা আমি যে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আব্বুকে তো বলাই যাবেনা আমি ধূসরের সংসার করবোনা! সবাই চলে গেলো। ধূসর আমাকে জড়িয়ে ধরে অনুনয়ের স্বরে বলল, ‘চলোনা আরু, প্লিজ। দেখো তোমাকে ছাড়া আমি চলতে পারবোনা।’
-চলতে না পারার কিছুই নেই।
-কেন এরকম করছো? আমিতো চাই তোমাকে।
-আমিতো ভালোবাসা চাই৷
-তো কী হয়েছে আরু? আমি তোমাকে ভা…
সম্পূর্ণ কথাটা বলতে না দিয়েই আমি ওনার মুখ চেপে ধরলাম। কোনো ইমোশনাল কথা শুনতে রাজি নই আমি। এই লোকটাকে অসহায়ের মতো দেখতে ভালো লাগেনা। ভালো না বেসে আমাকে চায়, আমিতো তা চাইনা। মাঝপথে কথা বন্ধ করায় ধূসর রাগে ফুঁসছে। কয়েক সেকেন্ড নিজেকে সামলে নিয়ে এবার সাহসী কন্ঠে বললাম, ‘শুনুন ধূসর! আমি যাবোনা আপনার সাথে বাসায়। আমি আপনার সংসার করতে ইচ্ছুক নই।’
ঠাস করে একটা চড় পড়লো আমার গালে। আমার গাল চেপে ধরে ধূসর বলল, ‘আর একবার ওই কথা বললে জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।’
-আপনি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছেন।
-করবোই।
-আপনার কোনো অধিকার নেই আমার সাথে এরকম করার। কে হন আপনি আমার…..কেউ না…
ধূসর আমার ঠোঁট কামড়ে ধরলো। রাগে, দুঃখে এক ধাক্কায় ওনাকে সরিয়ে দিলাম। উফ, পাগল হয়ে যাবো আমি। এই লোকটা আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে দরজা খুলে একদৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। সবাই ওখানেই বসা। আমি সরাসরি গিয়ে আব্বুকে বললাম, ‘আমি আর ধূসরের সাথে থাকতে চাইনা৷ আমি ডিভোর্স চাই!’
কথাটা বলতে দেরি দ্বিতীয় থাপ্পড়টা খেতে দেরি হয়নি আমার। আব্বু রেগে বললেন, ‘এই কথাটা বলার দুঃসাহস কোথায় পেলে আরুণী? আমাদের বংশের মেয়েদের একবারই বিয়ে হয়, সংসার হয়। তারা স্বামী, সংসার নিয়ে সুখে থাকে। আর তুমি এতগুলো দিন বাপের বাড়িতে পড়ে আছো। আমি তোমায় খোঁটা দিচ্ছিনা, শুধু বলে দিচ্ছি বিয়ের পর বরের বাড়িটাই তোমার আসল বাড়ি। আমার কলিজা মেয়েটাই তুমি, তোমাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। অর্নি কলিজাটার সুখ দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তোমার সুখ-শান্তি দেখতে চাই। সামান্য কারণে সংসার ভেঙে যাবে এটা কখনো হতে পারেনা। ধূসর মোটেও খারাপ ছেলে নয় যে ডিভোর্স দিবে৷ আর আজ পর্যন্ত যা হয়নি তুমি সেই রীতি ভাঙার সাহস দেখাচ্ছো? আমি মানতে পারছিনা!’
আমি কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়লাম। ধূসর সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাত বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে, হয়তো কেটে গেছে। কারোরই নজর সেদিকে নেই। আমি আব্বুর কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলে উঠলাম,
-তো কী করবো আমি? ওই সাইকো লোকটার সাথে থাকবো? যাকে এতোদিনেও ঠিক করতে পারিনি, আমাকে যে ভালোবাসেনা তার মুখ ঝামটা খেয়ে পায়ের নিচে পড়ে থাকবো?
আব্বু আমাকে নিচ থেকে তুলে দাঁড় করালেন। তারপর সোফায় নিজের পাশে বসিয়ে আমাকে বলতে লাগলেন, ‘দেখো আরুণী, অর্নি আর ধূসর দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসতো। এতো বছরের ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা সে ছাড়া আর কেউ-ই বুঝতে পারবেনা। ধূসরের বেলায়ও ব্যতিক্রম নয়। আর কোনো মা-বাবা কী চায় তার ছেলে উচ্ছন্নে যাক? তাইতো ওর বাবা-মা যখন তোমার সাথে ওর বিয়ে দেওয়ার কথা বললো আমি রাজি হয়ে যাই। আমি জানতাম অর্নির জন্য হলেও ধূসরকে তুমি সামলাতে চেষ্টা করবে, ওকে বুঝবে। অন্য কোনো মেয়ে হলে সেটা করতো বলে আমার মনে হয়না। ধূসরের এরকম ব্যবহার করাটা নরমাল। কেননা অর্নির জায়গায় তুমি চলে এসেছো হঠাৎ করে। ও মানতে পারেনি। কিন্তু এখন যখন মেনে নিতে চাচ্ছে তুমি বেঁকে বসেছো। ওর ভুলগুলো ক্ষমা করে একবার সুযোগ দেওয়া যায়না? আর বিচ্ছেদই সব সমস্যার সমাধান নয়।’
আমি তখন কোনোকিছুই শুনতে রাজি নই। ধূসর আমার পাশে এসে বসেছে ততক্ষণে। রাগে গা জ্বলে উঠলো। গেস্টরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে পড়লাম। পুনমকে আমার ফোনটা দিয়ে যেতে বললাম। ধূসরের কোনো দোষ নেই মানলাম। তাই বলে এতো সহজে ওর ক্ষমা হয়ে যাবে আর মেয়ে বলে আমাকে সেটা সহ্য করে নিতে হবে? মরে গেলেই ভালো হতো৷ বেঁচে থাকা মানে প্রতিনিয়ত কষ্টে পিষ্ট হওয়া। এই কষ্টে পিষ্ট হওয়া থেকে যে বেঁচে যায় সে-ই এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেললাম। বাইরে থেকে মা-চাচীরা একনাগাড়ে ডেকেই চলেছে। আমি বিরক্ত করতে মানা করলাম। একা থাকতে চাই, ব্যস! মোবাইলটা হাতে নিয়ে অন করলাম। হোয়াটস অ্যাপে ম্যাসেজ করেছে ডাক্তার মিথিলা। আমি সাথে সাথে ফোন লাগালাম। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। চারদিকে নিরব, নিঃস্তব্ধতার খেলা। এই অসময়ে ফোন করেও ডাক্তার মিথিলাকে পাওয়া গেলো। ওনি যা জানালেন সেটার জন্যও আমি প্রস্তুত ছিলামনা। ডাক্তার মিথিলা হেসে হেসে বললেন, ‘ইউ হ্যাভ বিন কনসিভিং ফর সেভেন উইকস!’
ড্রয়ারের উপর ফোনটা রাখলাম। হাত-পা অনবরত কাঁপছে। আমি মা হতে চলেছি! সত্যিই? খবরটা শুনে যেন আমি পাথর হয়ে গিয়েছি। এই শরীর খারাপ, বমি পাওয়া, খেতে না পারা এইজন্য যে আমার সন্তান আসতে চলেছে? খুশি হবো নাকি অখুশি বুঝতে পারছিনা। তখন শুধু ধূসরমানবের বলা সেই কথাটাই আমার কানে বাজছিলো বারবার। যেন চিৎকার করে বলছে, আমি তোমার কোনোকিছুই চাইনা৷ আর বাচ্চা? অভিয়াসলি সেটা নয়ই। তোমার থেকে কেউ সন্তান চায়নি। আমার সন্তান শুধু অর্নির হবে, অন্যকারোর নয়। মনে রেখো আরুণী। হ্যাঁ, মনে রেখে দিয়েছি। রাখলাম ও! অভিমান হলো খুব। এখন কেন নিতে এসেছে আমায় নিষ্ঠুরটা? নিষ্ঠুর ধূসরমানবের সাথে কোত্থাও যাবোনা আমি.. কোত্থাওনা!
আপনারা মতামত জানাবেন আশা করি। ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।
চলবে…ইনশাআল্লাহ!