অকিঞ্চন পর্ব-০৮

0
293

গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – আট
_____

কম্পিউটারের কৃত্রিম আলোর সামনে বসে প্রভার দৃষ্টি আটকে আছে ফোনের স্ক্রিনে। নোটিফিকেশনে জ্বলজ্বল করছে ‘বিকাশ’ নাম। এইমাত্র তার ফোনে সাত হাজার টাকা সেন্ডমানি করা হয়েছে। প্রভা কিছুক্ষণ যাবত বিমূঢ় হয়ে বসে থেকে মূহুর্তেই ফোন টেবিলে ফেলে নিজের মাথাটা টেবিলে নুয়ে দেয়। বুকটা কেমন যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে। শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। প্রভার কী করা উচিত তা বোধগম্য হচ্ছে না। চট করে মাথা তুলে বিকাশের ইনবক্সে গিয়ে পুরো ম্যাসেজটা সে আবারো পড়ল। টাকার সংখ্যাটা বেশ অনেক্ষণ যাবত দেখল। এরপর মোবাইল হাত থেকে নামিয়ে, কম্পিউটারে টাইপ করতে বসল, থ্যাংক ইউ, স্যার। টাকা’টা এসেছে। যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে ম্যাসেজ করতে দ্বিধাবোধ করবেন না।
প্রভা তখনও আলোকিত মুখে নিজের ম্যাসেজ দেখতে ব্যস্ত। আজ সে তার জীবনের সবচেয়ে বড় সংখ্যার প্রজেক্ট কমপ্লিট করেছে। সাত হাজার টাকা। আগে যেসব কাজ করা হয়েছে সেসবে কখনো হাজারের ঘরেও অঙ্ক পৌঁছোতো না, তবে হঠাৎ করেই কীভাবে যেন এতো বড় সংখ্যার কাজ মিলে গেল। প্রভা ভার্সিটিতে ওঠার পর পরই কম্পিউটার ক্লাসের পাশাপাশি নিজের ইডিটের স্কিলটা বৃদ্ধি করায় মন দিয়েছে। মন বলেছে নিজের জন্য কিছু করা দরকার। মন বললেও প্রভা তার অন্তর্মুখী স্বভাবের জন্য বাইরের কাজে মন দেওয়ার সাহস কখনো করে ওঠেনি; তবুও দু’একবার কিছু জায়গায় চেষ্টা করা হয়েছে যার কোনোরূপ ফল পাওয়া যায় নি। এরপরেই প্রভা তার একটি মরি-মরি শখকে টেনে তুলে কিছুটা ঝালাই করে নেমে পড়েছে কর্মক্ষেত্রে। শুরুর দিকে তেমন কোনো অর্ডারের দেখা মিলত না। অনেক চেষ্টার পরে সর্বপ্রথম কাজ মিলেছিল ২০০ টাকার। কাজটি ছিল একটি ইউটুব ভিডিও ইডিটের। প্রভা অনভিজ্ঞ হওয়ায় এবং নবীন হওয়ায় তাই মেনেছিল হাসিমুখে। কাজ সম্পূর্ণ করে টাকা হাতে পাওয়ার মূহুর্তটা ভাবলে প্রভা আজও আঁতকে ওঠে। অজানা প্রাপ্তিতে বুক ভরে ওঠে। এই প্রাপ্তির ওজন প্রভার জন্য ভীষণ ভারী। তবে সে তার এই প্রাপ্তিতে কাউকে শামিল করেনি; করতে চায়নি। তার দৃঢ় ধারণা, সে এই টাকা তার মায়ের কাছে প্রকাশ করা মাত্রই সে ভীষণরকমের অনাগ্রহে প্রভার প্রাপ্তিকে উড়িয়ে দিত। প্রভার ইচ্ছে হয়নি নিজেকে ছোট করতে। এমনটা সত্যিই হতো নাকি এসব প্রভার অমূলক ধারণা তা প্রভা জানে না। প্রভা সন্তান তো; হয়তো খুশি তো, হয়তোবা হতো না। কে জানে! একদমই শামিল করেনি বললে ভুল হবে। আচানক এক বন্ধের দিনে নিজে থেকেই ফুচকা আর চটপটি কিনে হাজির হয়েছিল। প্রভার মা মাহমুদা ফুচকা খান না, তার চটপটি প্রিয়; একারণে তার জন্য বিশেষভাবে চটপটি আনা। সবাই যখন একসঙ্গে প্রভার আনা খাবার খেতে ব্যস্ত, প্রভার তখন এক মূহুর্তের জন্য মনে হলো, এই পৃথিবী সে জিতে গেছে। এই পৃথিবী তাকে জিতিয়ে দিয়েছে। সেদিনের খুশিটা যেন আজ আবারো ফিরে এসেছে এতো বড় সংখ্যার একটা কাজ সসম্পূর্ণ করে। মহান আল্লাহ সত্য অর্থেই কাউকে ঠকান না। প্রভা চেষ্টা করেছিল, মহান আল্লাহ তাকে পুরষ্কৃত করেছেন। যদি চেষ্টা না করে হাত গুঁজে বসে থাকত, তাহলে এই আনন্দটা মিলতো বুঝি!

প্রভা কিছু দূরে থাকা মাটির ব্যাংকের দিকে তাকাল। ভেবে ফেলল টাকা তুলে এই সাত হাজার টাকাও সে ব্যাংকে রাখবে। বেশ অনেক দিন হলো টাকা রাখা হচ্ছে না। আগের ছোট পরিসরের টাকা সব হাত খরচেই শেষ হয়েছে; সেভাবে জমানো হয়ে ওঠেনি। ক্লাস এইট থেকে প্রভা টুকটুক করে এখানে টাকা জমায়। জমানোর নির্দিষ্ট কোনো কারণ প্রভা জানে না। শুধু জানে কোনো একদিন যদি প্রভার কোনো কিছু করতে ইচ্ছে হয়, এই টাকা দিয়ে করবে। এখন কাজটা কী হবে বা হতে পারে তা নিয়েও বিশেষ মাথা ঘামানোর প্রয়োজন প্রভা কখনো করেনা। জমুক না কিছু টাকা, কিছু আবেগ। যখন ফুরানোর হবে তখব নাহয় এমনিই ফুরোবে।

– আপাআআ!

নিশীর এমন করুণ কণ্ঠের ডাকে প্রভা ফিরে চাইল। নিশীর থোঁতা মুখ দেখে জানতে চাইল,
– কী হয়েছে?

প্রভা এগিয়ে এসে প্রভার হাত ভীষণ সুন্দর করে ধরে বলল,
– বিশ টাকা দিবা?

টাকা চাওয়া দোষের কিছু নয়। লাগতেই পারে। কিন্তু এই সন্ধ্যা-রাতে টাকার কী প্রয়োজন ভেবেই প্রভা প্রশ্ন করল,
– এখনি লাগবে?

নিশী ঘটনা খুলে বলতে শুরু করল,
– না। আসলে আজকে ফেরার পথে অনেক পানিপুরি খেতে ইচ্ছা হলো। খেয়ে নিলাম। দুই প্লেট খেয়েছি। দাম এসেছে বিশ টাকা। আঙ্কেল কে বলে এসেছি টাকা পরে দিব। এখন আমার কাছে তো টাকা নাই। আম্মু শুনলে বকা দিবে। বলবে, ক্ষুধা লাগসে তো কী হইসে? বাসায়ই তো আসতেসিলি। বাসায় এসে ভাত খাইতি।

নিশীর কথায় প্রভা নির্বিকার ভাবে বলল,
– কালকে তো শুক্রবার। তোর স্কুল নাই। যাওয়ার পথে আমি দিয়ে দিবনি। গলির মাথার আঙ্কেল’টা না?

প্রভা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,
– হ্যাঁ।

– ঠিকাছে।

– থ্যাংকিউউউউউ।
বলা শেষ হতে না হতেই পাখির মতো ডানা ঝাপটে চলে গেল নিশী। নিশীর এই হাসিমুখ প্রভার মনে যে কতো গাঢ় একটা দাগ কেটে গেল তা হয়তো নিশী নামক পাখি কখনো, কোনোদিনো জানবে না। প্রভা নিজের মাটির ব্যাংকে দৃষ্টি নিয়ে নিজের সিদ্ধান্তে একটু পরিবর্তন নিয়ে এলো। সাত হাজার পুরোটা ব্যাংকে জমাবে না। পাঁচ হাজার ব্যাংকে রাখবে আর দু’হাজার হাতে। নিশীর কখন কী শখ হয় বলা যায় না। শখ পূরণে টাকার বিকল্প অসীম। অপূর্ণ শখের ভারে তার মুখে যে অন্ধকার নামত, সে অন্ধকার কখনো নিশীর মুখে প্রভা দেখতে চায় না। কখনোই না।
_____

নিরাক পড়া বিষণ্ণ বিকেলে প্রভা হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছে। গলির মাথায় আসতেই কিছু বাচ্চাদের হৈ-হুল্লোড় কানে এলো। প্রভা আশ্চর্য হয়ে দেখল বাচ্চাদের অমূল্য খুশি। কয়েকজনের পরনে ছেঁড়া কাপড়ের প্যান্ট, কিছুজনের চেহারার হাল খুবই অশিষ্ট। হাতে-পায়ে ধুলোবালিতে যেন একেকজন গোসল করে উঠেছে। সম্ভবত সামনের বস্তি টাতেই বাচ্চাগুলো থাকে। প্রভার হৃদয় যখন সকলকিছু বিবেচনা করতে ব্যস্ত, সেই মূহুর্তে প্রভার চোখ আটকে গেল বাচ্চাদের মুখ ভর্তি হাসিতে। কী তৃপ্তিময় সে হাসি! কী অকৃত্রিম সে খুশি! কী সুন্দর! কী আদর-সুন্দর এই দৃশ্য! প্রভা হাসতে তেমন পছন্দ করে না। তার অনেক অনেক অপছন্দের কাজের মাঝে হাসিও চরম এক অপছন্দের কাজ। তবুও, আজ প্রভা তার সকল অপছন্দকে ছাপিয়ে মুখ ভরে হেসে উঠল। সে হাসি কোনো রকম লৌকিকতার হাসি নয়; সে হাসি আকাশের তারার মতো ঝলকিত এক হাসি! সে হাসি অন্তরের হাসি।

আচানক প্রভার নিশীর কথা মাথায় এলো। এই আঙ্কেল এর কাছ থেকেই তো নিশী বাকিতে খেয়েছে। কাল শরীর সামান্য অসুস্থ হওয়ায় বেরোনো হয়নি। আজই না হয় দেওয়া যাক। তবুও একবার জেনে নেওয়া প্রয়োজন। প্রভা এগিয়ে গিয়ে শুধাল,
– পরশু কী ছোট একটা মেয়ে আপনার থেকে বাকিতে খেয়েছিল? বিশ টাকা বাকিতে?

পৌঢ় লোকটি প্রভার কথা শুনে ঘটনা মনে করতে চাইল। দু’ সেকেন্ড সময় নিয়ে বেশ কুণ্ঠিত হয়ে বলল,
– না, এমন কেউ তো খায় নাই।

প্রভা জোড় দিয়ে বলল,
– একটু মনে করে দেখুন। পানি পুরি খেয়েছিল। বিশ টাকার। আ…স্কুল ড্রেসে ছিল। মাথায় দুই ঝুটি করে। ক্লাস এই..স্কুলের ছাত্রী। খেয়েছিল বৃহস্পতিবার। গত পরশুর কথা।

নিশীর কথা অনুসারে এই আঙ্কেল এর কাছ থেকেই ওর খাওয়া হয়েছে। তবে ওনার মনে নেই কেন? হয়তো খেয়ালে আনতে পারছেন না। প্রভাও বোকার মতো ক্লাস এইটের কথা বলতে নিচ্ছিল; লোকটি নিশ্চয় জেনে বসে নেই যে নিশী কোন ক্লাসে পড়ে। লোকটির মনে পড়ায় কিছুটা চেঁচিয়ে উঠল,
– মনে পড়সেএ। হো পরশুদিন একটা মাইয়া অনেক অনুরোধ কইরা বলল তার কাছে টাকা নাই। দিয়া দিব পরে। টাকা সত্যি দিব। অনেক অনুরোধ কইরা বইলা গেসে।

প্রভা নিশ্চিত হলো এটা নিশীই। এই মেয়ের সবকিছুতে বাড়াবাড়ি। প্রভা শতভাগ নিশ্চিত যে নিশীর কাছে টাকা নেই জানামাত্রই ও লোকটির সামনে গলে পড়ে আহাজারি শুরু করেছে। প্রভা হাপ ছেড়ে বলল,
– জ্বী, আপনি ঠিক ধরেছেন। এই মেয়েই। নিন বিশ টাকা।

লোকটি বলল,
– টাকা তো তখনই ওর ভাইয়ে দিয়ে দিসে।

প্রভা মুখ কুঁচকে বলল,
– ভাই?

– হ, কইল সে ওই মাইয়ার ভাই লাগে।

প্রভা কিছু বলবে, তার পূর্বেই লোকটি কিছু দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
– ওই যে, ওই ছেলেডা বলসে। ওইযে.. ওইযে…তাড়াতাড়ি যাইতেসেগা যে!

প্রভা পিছন ঘুরতেই দেখল, একজন পুরুষের বেশ ব্যস্ত পায়ে পেছন ফিরে এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। এমন ভঙ্গিতে হেঁটে চলছে যেন পেছন ঘুরলেই বড়সড় কোনো অঘটন ঘটে যাবে।
তাওহীদ নিজের সর্বশক্তি ক্ষয় করে হেঁটে দোকানে ঢুকে পড়ে। তাওহীদ ভাবেনি আচম্বিত লোকটা হাত তুলে তাকে দেখিয়ে দেবে। সে তো টাকা দিয়েছিল এমনি এমনি। নিশী বাড়ি ফিরছিল দেখতে পেয়েই তাওহীদের আচানক আগের দিনের ঘটনা খেয়ালে আসে। আজও মেয়েটা ভয় পায় কি-না এই ভেবে সে পেছন পেছন এলে দেখতে পায় মেয়েটা দোকানিকে অনুরোধ করে বলছে টাকা পরে দিয়ে দেবে। তাওহীদ ভাবল টাকা সে দিতে তো কোনো দোষ নেই। ব্যাস! কিছু না ভেবে দিয়ে দেয়।
আবার আজ প্রভাকে দেখামাত্রই তাওহীদ দোকান থেকে বেরিয়ে পড়ে। পিছু পিছু চলে যায় অকারণেই। সে যে কেবল আজ কাজটি করল — ব্যাপারটি তেমন নয়; প্রায়শই করে। জানে না কেন, প্রভার পিছু পিছু যেতে তাওহীদের ভীষণ ভালো লাগে। প্রভা বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হেঁটে চলে আর তাওহীদ প্রভার পিছু পিছু তার পদরেখা অনুসরণ করে চলে। জীবন তো এতোটুকুতেই সুন্দর, আর কিছু তো চাই না। এতোটুকুর লোভেই তো একটু পথ যাওয়া।

প্রভা এখনো স্থির দাঁড়ানো। সে কল্পনা করেনি তাওহীদ এভাবে টাকা দেবে। টাকা দেওয়াতে তো আশ্চর্য হয়েছে। তবে বেশি আশ্চর্য হয়েছে এভাবে পালিয়ে যাওয়ায়। প্রভা ভ্রু কুঁচকে ভাবল, তাওহীদ কী সাত-আট বছরের কোনো শিশু যে এমন আচরণ করবে? একজন পুরুষের এমন শিশুসুলভ আচরণ কীভাবে হতে পারে! তাওহীদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষণ করেও কোথাও যেন মন একটু তৃপ্ত হলো। অন্তরের কোনো এক জায়গা যেন ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হলো। প্রভা নিজের অবচেতন মনের তাওহীদের সাথে কথা বলার লুকোনো ইচ্ছে থেকে ভেবে ফেলল, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সে তাওহীদের সাথে কথা বলবে। নাহ..কথা বললে বোধহয় ভালো হবে না। জিগ্যেস করার অজুহাতে ঝগড়া করা যেতে পারে।
প্রভা সব ভাবনা থামিয়ে নিজের প্রতি নিজেই বিস্মিত হলো। তাওহীদের সাথে কথা বলার জন্যও যে তার কোনোদিন অজুহাত খুঁজতে হবে – তা সে ইহজনমে কল্পনা করেনি। প্রভা বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল। চোখের সামনে বার বার তাওহীদের চপল পায়ে যাওয়ার দৃশ্য ভাসছে। প্রভা সকল কিছু ছাপিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো হেসে ফেলল।
_____
#অকিঞ্চন
#শারমিন_ইরান