#অঙ্গজা
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|পর্ব ৩|
মাহতাব আমাকে নিয়ে সেদিন ওর একটা বন্ধুর বাড়িতে উঠল। বন্ধুর পরিবারের লোকেরা আমাকে আর আমার মেয়েকে আপন করে নিল ক্ষণিকেই। ভাবির সাথে দারুণ একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে উঠেছিল আমার।
বাবা কল দিয়েছিল রাতে। আমাকে ফিরতে বলেননি। কেবল হাসিমুখে বলেছিলেন,
-“মা, আমি চাই তুই ভালো থাকিস। আমি জানি এখন তুই ভালো থাকবি। আমার নাতনির খেয়াল রাখিস। আমি প্রতি সপ্তাহে দু-বার করে তোদের দেখে আসব।”
মাহতাব পরের তিনদিনের জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নেয়। সকালে উঠেই অফিসের নিকটবর্তী এলাকায় বাসা দেখে ফেলল। একটা দুই বেডের বাসা। মাসের শুরু, বেতনটা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করা হয়েছে দু-দিন আগেই। এতে সুবিধা হলো। মাহতাব বেতনের ষাট হাজার উঠিয়ে নিয়েই সেখান থেকে কুড়ি হাজার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। বাবার ইনকাম যথেষ্ট হলেও, মাহতাব বরাবরই কুড়ি হাজার মার হাতে এবং কুড়ি হাজার আমার হাতে তুলে দেয়। আমার টাকাগুলো ডিপোজিট করে রাখতাম। বাকি টাকার কিছুটা বোনের কাছে এবং নিজের হাত খরচের জন্য রাখত। বাড়ির খরচ বাবার টাকাতেই চলত। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। তবুও নিজ দায়িত্বে মায়ের কাছে পনেরো হাজার এবং বোনের হাত খরচার জন্য পাঁচ হাজার পাঠিয়ে নিল। মোটামুটি চলার জন্য বাকি টাকায় বাসার এডভান্স দিয়ে টুকিটাকি সামগ্রী কেনা হলে, ১০ হাজারের মতো রইল।
বাসা পরিষ্কারের কাজে আমি হাত দিতে পারিনি। আমার মাত্রাতিরিক্ত ডাস্ট এলার্জি। আবার ঝুঁকে মোছামুছিও করতে পারিনি। সবটা মাহতাব একাই করল বিনা অভিযোগে। সারাদিন বাইরের খাবার দিয়েই চললাম। রাতে মেয়েকে ঘুম পাড়ানোর জন্য যখন শুয়েছি, মাহতাব এসে দুম করে পাশে শুয়ে পড়ল। আমি মলিন চোখে ওর ক্লান্তি দেখলাম। ও প্রচণ্ড উদাস গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করল,
-“খুব কষ্ট হচ্ছে, অঙ্গজা? এই তো, ক’টা দিন কষ্ট করো। তারপর আমি সব ঠিক করে দেবো।”
আমার কী যে খারাপ লাগল! এই মানুষটার আমার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই কেন? অন্য কোনো পুরুষ হলে এই ক্লান্তির জন্যই বোধহয় খারাপ ব্যবহার করে ফেলত। অথচ আমার পুরুষটা এমন কেন? নিজেকে নিয়ে ভাবে না কেন?
আমি বিরবির করে বললাম,
-“মাহতাব, চলো ফিরে যাই। এভাবে তোমার অনেক কষ্ট হবে।”
মাহতাব হাসল,
-“আর ও-বাড়িতে তোমাদের কষ্ট হবে।”
-“আমি মানিয়ে নেব।”
-“আমি তোমার কষ্ট মেনে নিতে পারব না রে। আমি তোমাদের কাউকেই কিছু বলতে পারব না। তবে মা-কে বোঝাব। মাঝে মাঝেই বোঝাব সবটা মা-কে। আমি অনেকদিন ধরেই আমার মেয়ের প্রতি মায়ের উদাসীনতা লক্ষ করেছি। কিন্তু টের পাইনি। তোমার বিষয়টা আগে বলা উচিত ছিল।”
আমি ফুঁপিয়ে উঠে বললাম,
-“ভালোবাসি, মাহতাব!”
মাহতাব এক হাত আমার গালে রেখে বলল,
-“আমিও আমার সন্তানের মাকে ভীষণ ভালোবাসি।”
আমার সে কী সুখ! ধীরে ধীরে সংসারটা গুছিয়ে নিতে লাগলাম। সোনাই বড়ো হতে লাগল। ওর ভালো নাম মেহেরিন সিদ্দিকী অঙ্গনা। ওর চাঞ্চল্য বাড়ল, বাড়ির এ কোণা থেকে ও কোণা হামাগুড়ি দিতে লাগল। বাবা প্রায়ই আসে। রাহাও রোজ স্কুল থেকে ফেরার পথে সোনাইকে দেখে যায়। মেয়েটা বড়ো হতে লাগল বাবার মতো করে। সবসময় ঠোঁটের কোণে বিশালে একটা হাসি থাকে। কাঁদে কম। হাঁটতে গেলে যদি পড়ে যায়, তখন কাঁদে না। কিছুক্ষণ বসে থেকে এদিক-ওদিক দেখে। তারপর ওঠার চেষ্টা করে।
এখন সে কিছু শব্দ বলতে পারে। যেমন মা, বাব্বা, দাদ্দা, মাম্মানি, খাব, যাব! এসব। দু’দিন ধরে ওকে শেখাচ্ছি দাদ্দু বলা। ও শিখেছেও। তারপর আজ আমার অন্য নাম্বার দিয়ে মাকে কল দিলাম। মা যখন কল রিসিভ করল, সোনাইয়ের সামনে ধরলাম। সোনাই একগাল হেসে দাদ্দু দাদ্দু বলতে লাগল। ওপাশে তখন থমথমে নীরবতা। আমি হেসে ফেলে কল কেটে দিই। এরকম কাহিনি আমি মাঝে মাঝেই করতে লাগলাম।
___
সোনাইকে নিয়ে আজ একটু বের হয়েছিলাম কিছু কেনাকাটায়। রাস্তায় মায়ের সাথে দেখা হয়ে যায়৷ তিনি এড়িয়ে গেলেন না। এগিয়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কী খবর?”
আমি মুচকি হেসে বললাম,
-“আলহামদুলিল্লাহ মা, ভালো আছেন?”
-“যার পোলা বাড়ি ছাড়ে, সেই মা ভালো থাকে?”
আমি টের পাই তাঁর সূক্ষ্ম ব্যথাটা। এর মধ্যে সোনাই দু-হাত বাড়িয়ে দিলো মায়ের কোলে যাওয়ার জন্য। গোল মুখের, ফুলো ফুলো গালে হাসছে। মা এড়িয়ে যেতে পারলেন না। কোলেও নিলেন না। কেমন একদৃষ্টে সোনাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। গাড়ির হর্ন বাজতেই মা সংবিৎশক্তি ফিরে পেলেন। এদিক-ওদিক তাকালেন। তারপর বললেন,
-“আমার পোলাকে আমারতে আলাদা কইরা ভালো করো নাই।”
-“আমার ইচ্ছাকৃত না।”
-“বুঝি।”
মা চলে গেলেন। আমিও ফিরে এলাম। তারপর কো-ইন্সিডেন্টলি মায়ের সাথে আমার একাধিকবার দেখা হতে লাগে। একরাতে বাবা আমার ফোনে ভয়েস ম্যাসেজ পাঠায়। সেখানে মা আর বাবার কথপোকথন ছিল। সম্ভাব্য মায়ের অজান্তে তা রেকর্ড করা। মা বলছিলেন,
-“জানেন বাবুর আব্বা, মাইয়াডা না এক্কেরে বাবুর মতো দেখতে। আমার বাবু ছোটকালে যেমনে খালি হাসতো না? ওমনে। বাবুর মতো ডান গালে একটা টোলও আছে। আর চোখও ছোট ছোট হয়ে যায় হাসার সময়। খালি তাকায়া থাকতে মন চায়।”
বাবা বললেন,
-“তুমি না মেয়ের আর মেয়ের মায়ের ব্যাপারে কত কথাই বলছিলা।”
মায়ের থেকে অনেকক্ষণ বাদে উদাস গলায় কথা এলো,
-“পাশের বাড়ির ভাবিরা আমার নাতনির গায়ের রঙ নিয়া যেমনে চোখ-মুখ কোঁচকায়, আমার খারাপ লাগে। সেদিন ভাবি তো মেলা কথা কইলো। রাগের মাথায় অঙ্গজার উপরে ঝারছি। আমার উচিত হয়নাই।”
-“তাইলে কল দিয়ে কও ফিরতে।”
-“কইলেই ফিরবো?”
বাবা বললেন,
-“চেষ্টা করতে পারো।”
মা চেষ্টা করলেন না। কথাও বললেন না আর। এভাবে আরও ক’টা মাস কাটল। ও-বাড়ি থেকে চলে আসার দেড় বছরের বেশিই পেরিয়েছে। একদিন মাহতাব সন্ধ্যের আগেই অফিস থেকে চলে এলো। সাথে মাকে নিয়ে এলো। আমি প্রচণ্ড অবাক হয়ে যাই। মাকে ভেতরে এনে বাড়ির এদিক-ওদিক দেখাতে লাগল। আমাকে বলল মায়ের পছন্দমতো রান্না করতে। আমি রান্নায় লেগে যাই। সোনাই রুমে খেলছিল।
মাহতাব গোসলে গেল। আমি রান্নার একফাঁকে সোনাইকে দেখতে রুমে আসি। ভিড়িয়ে দেওয়া দরজার এক প্রান্ত দিয়ে সোনাইয়ের পাশে মাকে বসে থাকতে দেখলাম। সোনাই তার প্লাস্টিকের খেলনাগুলো নিয়ে খেলছে। একটা একটা মায়ের দিকে দিচ্ছে। আবার খেলছে। মা চুপ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আদর করছে না, ফেলেও দিচ্ছে না। কেমন যেন বিমুগ্ধ চোখে আমার মেয়েকে দেখে যাচ্ছে। প্রশান্তির শীতল হাওয়া আমার অন্তর ছুঁয়ে গেল। আমি দৌড়ে রান্নাঘরে এসে রান্নায় মন দিলাম, পাছে না মা দেখে ফেলে। মাহতাব গোসল সেড়ে বেরোতেই ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
-“মা এলো? নাকি জোর করে নিয়ে এলে?”
মাহতাব হেসে বলল,
-“এভাবে আসত নাকি? আসতে ইচ্ছে হলেও আসত না। তাই জোর করে নিয়ে এলাম।”
আমি আমার দায়িত্বশীল স্বামীকে মুগ্ধ চোখে দেখে গেলাম। যাওয়ার সময় মা বার বার পিছে ফিরে চাইছিলেন। আমি বললাম, মা একদিন থেকে যান। মা তাতে রাজি না। মাহতাবের হাত শক্ত করে ধরে বললেন,
-“আব্বা, ফিরে আয়।”
মাহতাব নিশ্চল আওয়াজে বলল,
-“তোমাকে রেখে বাবা কখনও অন্য জায়গায় থেকেছে, মা? তুমি নানুবাড়ি গেলেও তো বাবা গিয়ে থাকত।”
মা চুপ থাকলেন। মাহতাব আবার বলল,
-“তাহলে আমি কীভাবে ওদের রেখে যাই?”
মা হয়তো খুব করে বলতে চাইলেন, ‘ওদের নিয়েই আয়।’
কিন্তু বললেন না কিছু। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে চলে গেলেন।
____
এরপর সম্ভবত আরও ক’টা মাস যাওয়ার পর একদিন হুট করেই মাহতাব আমাকে বলল, একজায়গায় নিয়ে যাবে, তৈরি হতে৷ আমি সোনাইকে নিয়ে তৈরি হলাম। মাহতাব আমাকে চমকে দিয়ে আমার বাড়িতে নিয়ে এলো। মা দেখে অবাক হলেন প্রচণ্ড। চেহারায় বিস্ময়ের সাথে একঝাঁক খুশি নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-“চলে আসছিস তোরা?”
যেন তিনি চান আমরা থেকে যাই। কেবল মাত্র ইগোর জন্য মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। মাহতাব জবাবে হাসল, কিছু বলল না। রাহা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলো। আরও কিছুক্ষণ থাকার পর হুট করেই মাহতাব বলল,
-“আবার একদিন আসব, মা। আজ যাই।”
মা সঙ্গে সঙ্গে বলল,
-“না গেলে হয় না?”
মায়ের আওয়াজ ভেজা। মাহতাব মায়ের দুগালে হাত রেখে কপালে চুমু খেয়ে বলল,
-“আবার আসব।”
মা হয়তো কেঁদেই দিতেন। আমরা তখন বিদায় নিয়ে চলে এলাম। তারপর একদিন আমার ফোনে মায়ের কল আসে। মায়ের গলার স্বর ভেজা,
-“কেমন আছ, অঙ্গজা?”
-“আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?”
-“খালি বাড়িতে ভাল্লাগেনা। সারাদিন একা থাকি। মইরা পইড়া থাকলেও কেউ জানব না।”
-“এভাবে বলছেন কেন, মা?”
-“কেমনে কমু আর?”
মায়ের কথা শুনে খারাপও লাগল, বাচ্চামো দেখে হাসিও পেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-“আমরা কি আসব, মা?”
-“আইসাই তো চইলা যাও।”
-“আপনি কি চান আমরা এসে থাকব?”
-“এখন কি মাইক লাগাইয়া কওন লাগব?”
মা রেগে যাচ্ছেন। আমি হেসে ফেলে বললাম,
-“মা, আসছি। দাঁড়ান।”
কল কেটে দিলাম। মাহতাবকে কল দিয়ে বললাম,
-“আমি বাড়ি ফিরব। অফিস থেকে সোজা ও-বাড়িতে এসো। আর এ-বাড়ির সবকিছু ও-বাড়িতে নেওয়ার ব্যবস্থা কোরো।”
মাহতাবকে কিছু বলতে না দিয়েই আমি চলে এলাম। বাড়ি এসে দেখলাম মা সিঁড়ির সামনে বসে আছেন, এদিকে চেয়ে। কেমন যেন লাগল। এগিয়ে গিয়ে সোনাইকে সিঁড়িতে বসিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম,
-“আর যাব না।”
মা কিছু বললেন না, আগলে ধরলেন না, সরিয়েও দিলেন না। আমি সময় নিয়ে সরে এলাম। মা ভেতরে আসতে বলে তড়িঘড়ি করে ভেতরের দিকে চলে গেলেন। যাওয়ার আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম তাঁর চোখ ভেজা। রাতে মাহতাব এলো। মায়ের কাছে বলল,
-“মা, মানুষের কথার জাল খুব শক্ত। কারো কথায় প্যাঁচাবে না, কেমন? তোমার মন-মস্তিষ্ক তাদের শব্দরা কন্ট্রোল করতে পারে। আমার মা এত দূর্বল নাকি? মোটেও না। নিজে দেখবে, শুনবে, তারপর সঠিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। কথার আঘাতের চেয়েও বড়ো আঘাত নেই, মা। এই আঘাত ওষুধ নেই।”
মা সম্পূর্ণ কথা বুঝতে পারে। তারপর আর আমাকে নিচু করে কখনও কিছু বলেনি। মাহতাব! পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো স্বামী। তোমার নিরপেক্ষতা আমায় এক আসমান সুখ উপহার দিয়েছে। সব স্বামীরা তোমার মতো হলে হাজারো মায়ের ঘর ভাঙে না, হাজার নারী অবহেলায়, অবজ্ঞায়, নির্যাতনে এক কোণায় গুমরে মরে না। সব অঙ্গজার ভাগ্যে কেন মাহতাব নেই?
~সমাপ্ত~