অতঃপর প্রণয় পর্ব-১৬

0
85

#অতঃপর_প্রণয়
#পর্বঃ ১৬
#জেসমিন_জেমি

আজ ইলমির বিয়ে।
বিয়ের সব কিছু প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই যেনো স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। যেনো কাল কোনো কিছই ঘটে নি তবে সব থেকে অস্বাভাবিক হচ্ছে বিয়ের কনে, যাকে এই মুহুর্তে কপালে আঘাত, হাতে আঘাত নিয়ে বউ সাজানো হচ্ছে। অবশ্য কপালের আঘাতের চিহ্নটা মেকআপ আর হেয়ার স্টাইলের জন্য তেমন একটা বুঝা যাচ্ছে না। ইলমি চুপচাপ বসে আছে, কালকে ঘটে যাওয়া কিছুই সে ভূলতে পারছে না। কি হচ্ছিলো তার সাথে? কেনো হচ্ছিলো? লোক গুলো কে ছিলো? ইলমি নিজের সাথে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ভয় এখনো কাটিয়ে উঠতে পারে নি। পারে নি রাতে ঘটে যাওয়া সব কিছু ভূলতে।

জহির মির্জা মেয়ের এমন অবস্থার কথা চিন্তা করে বিয়েটা পিছিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তার কাছে সব কিছুর উপরে তার মেয়ে। সমাজ কি বললো সেসব নিয়ে তার কোনো চিন্তা নেই, নেই কোনো মাথা ব্যথা। বিয়ে পেছানোর কথা ইমরুল তালুকদারকে জানাতেই তিনি কিছুটা দ্বীমত করলেন। তার ছেলে একজন সম্মানিত ব্যক্তি, একজন এমপি সে, তার একটা আলাদা সম্মান আছে তার ছেলের এভাবে বিয়ে পিছিয়ে দেওয়াটা তার ছেলের জন্য অপমানের হবে। তার মধ্যে মিডিয়ার লোক ভালো মন্দ মশলা পাতি মিশিয়ে নিউজ করে বেড়াবে। এতে তার ছেলের সম্মান কি থাকবে? মোটেই না। এ নিয়ে দুজনের মাঝে বেশ কিছুক্ষন কথা কাটাকাটি হলো। এক পর্যায়ে দুজন বেশ রেগেও গেলেন। রাগে জহির মির্জা ফোন কেটে দিয়ে ধপ করে সোফয় বসে ফুসফুস করতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ আবরারের কল আসতেই ভ্রু কুচকে তাকালো, চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, জ্বালিয়ে খাচ্ছে বাপ বেটা। বাপ একটা বজ্জাত তার ছেলে হয়েছে আরেকটা বজ্জাত। রাগে ফুসফুস করে কল রিসিভ করতেই আবরার কি বললো জানা নেই তবে জহির মির্জা শান্ত হলেন, মমের ন্যায় গলেও গেলেন৷ তারপর, তারপর বিয়ের সব কিছু চলছে নিয়ম মেনে। আচ্ছা এমন একটা ঘটনার পর সব কিছু এতোটা স্বাভাবিক? সত্যিই কি সবটা স্বাভাবিক নাকি লোক-চক্ষুর আড়ালে ঘটে যাচ্ছে কিছু অ-স্বাভাবিক ঘটনা। যার সম্পর্কে কেউ অবগত না, কেউ জানলো না অথচ কিছু একটা অস্বাভাবিক হচ্ছে।

———————
পুরো মির্জা বাড়ী মেতে উঠেছে। পুরো বাড়ীতে আত্নীয় স্বজনে ভরে উঠছে। নিচ থেকে হৈ হুল্লোড় উঠে আসছে বড় ছোট সবার । ইলমিকে লাল টুকটুকে শাড়ীতে একটা ছোট পতুল বউ লাগছে। ইলমির থেকে চোখ সড়ানো দায় হয়ে উঠেছে একদম। তিন্নি একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ইলমিকে দেখছে। একটা মেয়ে কেনো এত্তো কিউট হবে। নিজের চোখ থেকে কাজল নিয়ে ঘাড়ের কাছটায় টিপ একে দিয়ে বললো,

মাশআল্লাহ, মাশ আল্লাহ। লাল টুকটুকে এই বাচ্চা বউটার উপর কারো নজর না লাগুগ।

—————–

আমেনা বেগম তিন্নির হাতে করে সব গহনা গাটি পাঠিয়ে দিয়েছেন। সব গহনা গুলো একে একে ইলমি পড়ানো শেষ হতেই নিচ থেকে সড়গড় শোনা গেলো বর এসেছে, বর এসেছে। এতোক্ষন যাবৎ সবাই ইলমিকে দেখতে ব্যস্ত এখন সবাই ইলমিকে একা রেখে ছুটলো বর দেখতে । ইলমি কিছু বলতে নিয়েও পারলো না। তার আম্মার হুকুম , যে হুকুম সে অমান্য করবে না। আগ বাড়িয়ে কোনো কাজ করবে না, কাউকে না জানিয়ে রুমের বাইরেও যেনো পা না রাখে, অযথা একটা কথাও না বলে। ইলমি চুপচাপ চোখ মুখ কুচকে বসে বললো,,

আজব, বর দেখতে এভাবে ছুটে যাওয়ার কি আছে? বরটা কি নতুন মানুষ নাকি? উনাকে তো সবাই চিনে এতো ঘটা করে দেখার আছে?
ওর ভাবনার মাঝেই ওর ফোনটা বেজে উঠলো,
ইলমি চোখ মুখ দ্বিগুণ পরিমানে কুচকে ড্রেসিংয়ে থাকা ফোনটার দিকে চাইলো। ইলমি এখন বিছানায় বসে আছে উঠে হালকা ঝুঁকলেই ফোনটা হাতে নিতে পারবে অথচ এই কাজটা তার কাছে খুব খুব খুব বিরক্ত লাগছে। মনটা চাইছে না উঠে দাঁড়িয়ে ফোনটা হাতে নিতে। বিরক্তিতে চ শব্দ করে ফোনটা হাতে তুলে নিতেই দেখলো আবরারের কল। ইলমি চকিতে স্ক্রিনে তাকালো সত্যিই আবরারের কল, ভীষন আশ্চর্য ও হলো। কিন্তু হঠাৎ এখন? আগের বারের মতো ভূল সে করতে চায় না তাই তড়িঘড়ি করে কলটা রিসিভ করে বললো,,

হ্যালো! আ, আ পনি?

অপাশ থেকে গম্ভীর -স্বরে বললো

চল, ছোট ছোট কিউট বাচ্চার মা হওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যা।

ইলমি কিছুু বললো না, লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো। লোকটা কি অদ্ভুত , কি নির্লজ্জ! বিন্দু মাত্র লজ্জাও কি তার নেই? আজকের দিনটাতেও লজ্জা দিতে ছাড়লো না।

_______________

অবশেষ সেই কাঙ্ক্ষিত সময়টা আসলো তিন কবুল বলে তাদের বিয়েটা সম্পন্ন হলো। যেহেতু ওদের আগে থেকে রেজিস্ট্রার করা ছিলো নতুন করে আর করতে হলো না। সব কিছু খুব সুন্দর করেই শেষ হলো। বিয়েটা কোনো রুপ ঝামেলা ছাড়াই সম্পন্ন হলো। বিয়েটা শেষ হতেই পুরো মির্জা বাড়ী দ্বিগুন আনন্দে মেতে উঠলো।

—————

আবিরার পড়নে ব্লু রঙের লং গাউন। বিয়ে বাড়ীতে আসার জন্য তিন বোন খুব সুন্দর করে সেজে এসেছিলো। চুল গুলো খোলা রেখেছিলো তবে এখন মনে হচ্ছে চুল গুলো বাঁধা দরকার খাওয়া দাওয়ার সময় আপাদত চুল গুলো খোলা রেখে সে খেতে পারবে না। বিপত্তি বাঁধলো তখন যখন মনে হলো সে সাথে করে হেয়ার ক্লিপ আনে নি। হুট করেই কিছু মনে পরতেই চট জলদি পা বাড়ালো ইলমির রুমের দিকে, সে চাইলে ইলমির হেয়ার ক্লিপ নিতে পারে । খোঁজা-খু্জির পর হেয়ার ক্লিপ ও পেয়ে গেলো। ড্রেসিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সময় নিয়ে সুন্দর করে চুল গুলো বেঁধে নিলো। হঠাৎ বাইরে কাঙ্ক্ষিত মানুষটার গলার স্বর শুনে তারাহুরো করে রুম থেকে বের হয়ে নিচের দিকে ছুট লাগালো। অতঃপর লোকটার সামনে যেতেই থতমত খেয়ে থেমে গেলো। এভাবে সামনে পড়ে যাওয়ায় আবিরা একটু অপ্রস্তুত ও হয়ে গেলো আড়চোখে চাইলো, লোকটা বোধহয় বিরক্ত হলো, কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকে ধমকে বললো,,

এভাবে ছুটছো কেনো? পরে গিয়ে হাত পা ভাঙ্গার জন্য?

আবিরা মাথা নিচু করে নিলো, আসলেই তো সে এভাবে ছুটলো কেনো? ছুটলো তে ছুটলো একদম লোকটার সামনে এভাবে এসে পড়বে? কি অদ্ভুত! আবিরা মাথা নেড়ে বললো,,

না আসলে একটু দরকার,

ইমির ভ্রু কুচকালো, বললো,,

যাও।

ইলমি মাথা নেড়ে ধীর পায়ে হাটলো, দু পা এগিয়ে বিরবির করে বললো,,

লোকটা কি আমায় দেখছে?
পরপর আড়চোখে পিছু ফিরতেই দেখলো, তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটা তাকে দেখছেই না, বরং লোকটা তার আগেই জায়গা ত্যাগ করেছে। আবিরার মনটা খারাপ হয়ে গেলো, এই লোকটা কি কখনোই তার অনুভূতি গুলো বুঝবে না? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকে? সে কি তবে অন্য কাউকে ভালোবাসে?

———————

ঘড়িতে ১১ টা বেজে ২০ মিনিট ।
এবার ইলমির বিদায়ের পালা। বিয়ে বাড়ীর সব থেকে হৃদয় বিদারক এক মুহূর্ত কনে বিদায় ৷ আনন্দঘন পরিবেশে নেমে এলো শোকের ছায়া। একজন বাবার বুকের ভিতর জমে থাকা কষ্টটা এবার দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। একজন বাবার কাছে সব থেকে কস্টের, সব থেকে দুঃখের মুহুর্ত যদি বলা হয় কোনটা? নিসন্দেহে বলা যায় তার কলিজার টুকরাটাকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়া। তার রাজকন্যাকে বিদায় দেওয়ার মুহুর্তটা ।
তেমনি একজন মেয়ের কাছেও এই মুহুর্তটা ভীষন কষ্টের। নিজের ভালোবাসার, আপন মানুষ গুলোকে ছেড়ে এক অচেনা অজানা পরিবারে চলে যেতে হয় কি অদ্ভুত নিয়ম! আচ্ছা এমন নিয়ম না হলে কি বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো? এমন হতে পারতো না একজন মেয়ে সারাজীবনের জন্য তার বাবার রাজ্যের রাজকন্যা হয়েই থাকবে? নিয়তি কেনো এতো কঠোর নিয়ম মেয়েদের উপর চাপিয়ে দিলো ? এই যে হাজার কষ্ট বুকে চেপে নিজের আপন মানুষ গুলো ছেড়ে যেতে হয়। একজন মেয়ের যে ভীষণ কষ্ট হয়, ভীষণ, ভীষণ।
জহির মির্জা তীব্র কষ্ট বুকে চেঁপে ঠোঁট চেঁপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো। বাবাকে এমন তীব্র কষ্টে ছটফট করতে তখনি দেখেছে ইলমি যখন সে অসুস্থতায় কাতর হয়ে ছটফট করেছে । নিজের অসুস্থতায় বাবার অশ্রুসিক্ত নয়নে তার জন্য তীব্র কষ্ট দেখতো পেতো। বাবার চোখে আজ তার থেকে দ্বিগুন পরিমানে কষ্ট দেখতে পাচ্ছে ইলমি। ইলমি বাবার এমন অবস্থা দেখে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো জহির মির্জা মেয়ের এমন অবস্থা দেখে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলো ইলমি তখনও ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো । আমেনা বেগম ও মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। ভূল করলে কাকে বকবেন সে? কার সাথে চেঁচামেচি করবেন? প্রচন্ড রেগে থাকা আমেনা বেগম রেগে হাজার খানেক বকাবকির পর ইলমি এসে আমেনা বেগমকে জড়িয়ে ধরতেই এক নিমিষেই মুচকি হেসে ফেলতেন, সব রাগ উবে যেতো তার। মেয়েটাকে ছাড়া পুরো বাড়ীটা ফাঁকা লাগে আমেনা বেগমের, কিভাবে থাকবে এ বাড়ীতে? কিন্তু তাকে থাকতে হবে যেমনটা তার মা হাজার যন্ত্রনা চেঁপে তাকে ছাড়া থাকে , তেমনি ভাবে তাকেও থাকতে হবে। মেয়েদের জীবনটাই তো এমন। তারা একসময় বাবার রাজ্যের রাজকন্যা হয়ে থাকে, তারপর বাকি জীবনটা অন্য কারো রাজ্যের রাণী হয়ে। ইমির তীব্র যন্ত্রণা বুকে চেপে লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেবোনের বিদায় বেলায়। আবিরা আড়চোখে ইমিরকে দেখলো, সে কাঁদছে না, কি আশ্চর্য ! তবে মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে ইমির তীব্র যন্ত্রনা বুকে চেঁপে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো বাইরে দেখে ইমিরকে বুঝা যাচ্ছে না। ইমির ভিতর থেকে কতোটা ভেঙে পড়েছে। একজন ভাইয়ের কাছে তার বোন কতোটা আদরের সেটা একমাত্র একজন ভাই জানে। আদরের বোনটাকে বিদায় দিতে একজন ভাইয়ের কতোটা যন্ত্রণা হয়। ইমির বোনকে কিছুই বললো না দ্রুত জায়গা ত্যাগ করলো। বোনের বিদায় সে দেখতে পারবে না , কিছুতেই না। ইলমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে এখনো আবরার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। জহির মির্জা নিজেকে শক্ত রেখে মেয়ের হাত আবরারের হাতে তুলে দিতেই আবরার ইলমির নরম হাতটা যত্ন সহকারে ধরল।

______________

তূর্ফার কেনো যেনো রাগ লাগছে, লোকটা কেনো তাকে মিথ্যা বললো? কেনো আসলো না? পুরো বিয়ে বাড়ীটাতে খুঁজলো অথচ পেলো না লোকটা আসবে না তবে তূর্ফাকে কেনো বললো সে আসবে? সে যাই হোক কে আসলো। কে না আসলো। কে কথা রাখলো না রাখলো তা তে তূর্ফার কি যায় আসে । কে হয় লোকটা তূর্ফার? কেনো এতো ভাবছে লোকটা নিয়ে আজব। ভাববে না আর ভাববে না লোকটাকে নিয়ে। তূর্ফা মুখ গোমরা করে গাড়ীতে উঠে বসলো।

চলবে,,,,

( ভুলত্রুটি মার্জনীয়)